মীরাবাঈকে নিয়ে কিংবদন্তী
রাজপুতানা অঞ্চলে মীরাবাঈয়ের জনপ্রিয়তা আজও এতটুকু কমেনি। সেখানকার ভাট বা চারণ কবিরা মুখে মুখে মীরাকে নিয়ে নানা পদ রচনা করেন। এই পদগুলি এখনও তাঁরা ভক্তি—শ্রদ্ধা সহকারে উদ্ধৃত করেন। আর এইভাবে মীরার জীবন সম্পর্কে কিছু বিকৃত ঘটনা চারপাশে প্রচারিত হয়েছে। কিছু কিছু কিংবদন্তী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যদি আমরা ইতিহাসের আলোকে সেগুলি বিশ্লেষণ করি, তাহলে বুঝতে পারব এই ঘটনাবলি কখনও ঘটেনি।
এই অধ্যায়ে আমরা মীরাবাঈ সম্পর্কিত এইসব প্রবাদগুলির ওপর আলোচনা করব। কারণ এইসব প্রবাদ লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে মীরাবাঈ সম্পর্কে কোনও কোনও মানুষের মনে বিকৃত ধারণা সৃষ্টি করেছে। অথচ ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিচার করলে এদের ভিত্তিশূন্য এবং সামঞ্জস্যবিহীন বলেই মনে হয়।
প্রথমে আমরা মীরার বিয়ে সংক্রান্ত সংবাদের ওপর আলোকপাত করব। কেউ কেউ বলেছেন, মহারাণা কুম্ভজির সঙ্গে মীরার বিয়ে হয়েছিল। মীরা যখন কৈশোর অতিক্রম করেন, তখন তাঁর পিতা উদয়পুরের রাণা কুম্ভের সঙ্গে তাঁর বিয়ের সম্বন্ধ স্থির করেছিলেন। কুম্ভজি সাজসজ্জা করে বরযাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে মীরার পিতৃগৃহে এসে উপস্থিত হলেন। ধীরে ধীরে তিনি এলেন বিবাহমণ্ডপে। বিবাহলগ্ন উপস্থিত হল। মীরা কিন্তু কোনওভাবে সেখানে যেতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, প্রথমে গিরিধারীলাল সভায় যাবেন, আমি তাঁকে অনুসরণ করব।
মীরার বাবা—মা তাঁর অদ্ভুত আবদার শুনে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু তখন আর বাকবিতণ্ডা করা উচিত নয় মনে করে গিরিধারীলালকে বিবাহ সভায় নিয়ে এলেন। মীরা তাঁকে অনুসরণ করলেন। বিয়ের কাজ সুসম্পন্ন হল। কন্যা সম্প্রদান শেষ হল। তখন বর—কনে অগ্নি প্রদক্ষিণ করছিলেন। মীরা গিরিধারীলালকে সঙ্গে নিয়েই প্রদক্ষিণ করতে থাকেন। বিয়ের কাজ শেষ হবার পর তিনি তাঁর শোবার ঘরে চলে যান।
মীরার মা মেয়ের এহেন আচরণে খুবই ব্যথা পেয়েছিলেন। এমনকি তিনি তাঁকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা করেন। মীরা বলেছিলেন—মা, গোপাল আমাকে স্বপ্নে বিয়ে করেছেন। রাতে হলদে রঙের চুরি পরে, মেহদি দিয়ে হাত রাঙিয়ে রসালো পান খেয়ে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি আবার নতুন করে কাউকে স্বামীত্বে বরণ করতে পারি কি? আমার কাছে এখন সমস্ত জগৎই জঞ্জাল বলে মনে হচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে মীরা একটি দোহাঁ বা ভজন মাকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। মীরা বলেছিলেন—
”মাঈ ম্হাঁ কো সপনে মে, পরণ্যো গোপাল।
রাতী পীলী চুনরী পহিরী, মেঁহদী পান রসাল।।
কাঁঈ ঔর কী ভরো ভাঁররে, ম্হাঁ কো জগ জঞ্জাল।
মীরা প্রভু গিরধরলাল সোঁ, করী সগাঈ হাল।।”
এবার মীরাকে বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে। মীরা গেলেন তাঁর মা—বাবার কাছে। মা—বাবা মীরাকে বলেছিলেন—তোমার যা কিছু প্রয়োজন, তুমি এই সময় চেয়ে নাও। এরপর তো তুমি আর সহজে আমাদের দেখা পাবে না।
মীরা তখন বললেন—মা, এখন তুমি আমাকে আমার গিরিধারীলাল দাও। আমি একমাত্র আমার প্রিয়র চরণ আকাঙ্ক্ষা করি। আমার কোনও অলঙ্কার, মণি—মাণিক্যের দরকার নেই। বন্ধু—বান্ধব, আত্মীয়—স্বজন পারিবারের সকলকে আমার যমসদৃশ মনে হচ্ছে। মীরা তাঁর প্রভু গিরিধারীলালের মূর্তি দেখে এমন পূর্ণ মনোরথ হয়েছেন, যে তাঁর মন আর কিছুই চায় না।
এই প্রসঙ্গে মীরা যে গানটি গেয়েছিলেন সেটি হল এইরকম—
”দেরী অব মাঈম্হাঁকো গিরধরলাল।
প্যারে চরণ কী আনি করত হৌ, ঔর ন দে মণিমাল।।
নাত সগো পরিবারোঁ সারো, মনে লগৈ মনোকাল।
মীরা প্রভু গিরধরলাল কী, ছবি লখি ভঈ নিহাল।।”
মীরার এই বাসনার কথা শুনে মা—বাবা আবার দুঃখ পেলেন। শেষ পর্যন্ত একটি পালকিতে গিরিধারীলালকে বসিয়ে দেওয়া হল। মীরা নিজে ডুলিতে বসলেন। গিরিধারীলালের পালকির সঙ্গে তাঁর ডুলি এগিয়ে চলল উদয়পুরের দিকে। বর—কন্যা সহযাত্রী সকলে উদয়পুরে পৌঁছোলেন। এগিয়ে এলেন মীরার শাশুড়ি। এই বংশের রানিরা কুলপ্রথা অনুসারে দ্বারপূজা করেন। তারপর নববধূকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানান। মীরাকে কুলদেবতার মন্দিরে যেতে হবে। এখানেও মীরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি সর্বজনসমক্ষে বলেছিলেন যে, তাঁর কুলদেব, ইষ্টদেব সবকিছুই গিরিধারীলাল। গিরিধারীলাল ছাড়া অন্য কোনও দেবমূর্তির সামনে তিনি কখনও মাথা নত করবেন না। অন্য কারও পুজো তিনি করবেন না।
রানি নববধূর এহেন আচরণে খুবই দুঃখ পান। তাঁরা মীরাকে অনেকভাবে বুঝিয়েছিলেন। মীরা কারও কথায় কর্ণপাত করেননি। শেষ অবধি তাঁরা ব্যর্থ মনোরথে রাণার কাছে এলেন। রাণা কুম্ভের কাছে সব কথা খুলে বললেন।
রাণার মা বলেছিলেন—এ কেমন পুত্রবধূ আনা হল? সে এত নির্লজ্জ যে, কারও উপদেশ শুনতে চায় না। এমনকি যে কুলদেবতাকে আমরা বংশ পরম্পরায় পুজো করেছি, মীরা তাঁকেও পুজো করতে রাজি হচ্ছে না।
কুম্ভজি এই কথা শুনে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—মীরাকে তোমরা ভূতমহলে পাঠিয়ে দাও। আপনিই সব ঠিক হয়ে যাবে।
মীরার স্থান হল ভূতমহলে, তবুও তাঁর মনের কোনও পরিবর্তন হল না। গিরিধারীলালের প্রতি তাঁর ভক্তি একইরকম আছে। শেষ পর্যন্ত রাণা কুম্ভ নিরুপায় হয়ে অন্য বিবাহ করেছিলেন।
চিতোরে দুটি মন্দির ছিল—একটি কুম্ভস্বামীর, অন্যটি আদি বরাহর। ছোটোটি স্থাপন করেছিলেন তাঁর স্ত্রী মীরাবাঈ। রাণা কুম্ভ এবং রানি মীরাবাঈ সম্পর্কে অনেক গল্প এবং লোকগাথা রাজপুতানায় প্রচলিত আছে। কর্ণেল টড এইসব গল্প অবলম্বন করে তাঁর বিখ্যাত বই ‘দি অ্যানালশন অ্যান্টিকুইটি রাজস্থান’ লিখেছিলেন। জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করেই তিনি বলেছেন যে, মীরা কুম্ভজির রানি। পরবর্তীকালে অনেক লেখক তাঁর গ্রন্থকে প্রামাণ্য গ্রন্থের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এই তথ্য প্রচার করেছেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। কারণ মীরা যে মেড়তার রাজকুমারী ছিলেন, তা আমরা সকলেই জানি। দুদাজি ১৪৬২ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের পরাস্ত করে মেড়তা অধিকার করেন। সেখানে নতুন রাজ্য স্থাপন করেন। দুদাজির বড়ো ছেলে বীরমদেবজি ১৪৭৮ খ্রিস্টাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মীরাবাঈ হলেন বীরমদেবজির ছোটো ভাইয়ের কন্যা। ১৪৯৯ সালে তাঁর জন্ম হয়। আর ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে মহারাণা কুম্ভের মৃত্যু হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, কুম্ভের মৃত্যুর সাত বছর পরে মেড়তা রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর মীরার জন্ম হয় কুম্ভের মৃত্যুর তিরিশ বছর পরে।
সুতরাং ইতিহাসের তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করে আমরা অনায়াসে বলতে পারি যে, মীরাবাঈ কখনও কুম্ভের পত্নী ছিলেন না। তাই এই বিষয়টি এখন পরিত্যাগ করা উচিত।
চিতোর ধ্বংস হবার পর রাজা উদয়সিংহের নামানুসারে উদয়পুর রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়। উদয়সিংহ হলেন মহারাণা কুম্ভের প্রপৌত্র। কুম্ভজি যখন মহারাজা ছিলেন তখন উদয়পুর শহরের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। অথচ কর্ণেল টড লিখেছেন যে, ”নব—বিবাহিতা বধূকে নিয়ে কুম্ভজি উদয়পুর অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন।”
বিবাহ—বিবরণে দেখা যায়, রাণা কুম্ভজি বিয়ে করার জন্য মীরার পিতৃভবন কুড়কী গ্রামে এসেছিলেন। বিয়ের সময় মীরার সঙ্গে তাঁর মায়ের বাদানুবাদ হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানি, মীরার বয়স যখন খুব কম তখন তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। মীরার পিতামহ দুদাজি তাঁকে কুড়কী থেকে মেড়তায় নিয়ে যান। দুদাজির মৃত্যুর পর তাঁর বড়ো ছেলে বীরমদেবজি রাজা হয়েছিলেন। তিনি ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিয়ে দিয়েছিলেন।
মেড়তা এবং মেবার সম্পর্কে যেসব প্রাচীন ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে, সেগুলি পড়েও আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি।
মীরা সম্পর্কে আরও কয়েকটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। এই কাহিনি অনুসারে বলা হয়, যখন মীরা বিক্রমজিতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তখন তিনি বিশিষ্ট কবি এবং সাহিত্য—সাধক গোস্বামী তুলসীদাসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠির মাধ্যমে তিনি তাঁর দৈনন্দিন দুঃখ—জ্বালা—যন্ত্রণার কথা তাঁকে খুলে বলেছিলেন। মীরা বলেছিলেন—
”শ্রীতুলসী সুখ—নিধান, দুখ—হরণ গুসাঈ।
বারহিবার প্রণাম করূঁ, অবহরো সোক সমুদাঈ।।
ঘরকে স্বজন হমারে জেতে, সবন উপাধি বঢ়াঈ।
সাধু সংগ অরূ ভজন করতে মোহিঁ, দেত কলেস মহাঈ।।
বালপন তেঁ মীরা কীনহীঁ, গিরধরলাল মিতাঈ।
সো তৌ অব ছুটত নহিঁ ক্যোঁ হূঁ, লগী লগন বরিয়াঈ।।
মেরে মাত পিতা কে সম হৌ, হরিভক্তন সুখদাঈ।।
হমকো কথা উচিত করিবো হৈ, সো লিখিয়ো সমুঝাঈ।।’
—হে সুখনিধান, দুঃখহারী শ্রীতুলসী গোঁসাই, আপনাকে আমি বার বার প্রণাম নিবেদন করছি। আপনি আমার সমস্ত শোক হরণ করুন। আমার ঘরের যাবতীয় আত্মীয়স্বজন আমার ওপর অত্যাচার করছেন। আমি সাধুসঙ্গ করি এবং ভজন করি বলে তাঁরা আমাকে বিদ্রুপ করছেন। মীরা বাল্যকাল থেকেই গিরিধারীলালের সঙ্গে সখ্যের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। সেই মিত্রতা এখন কিছুতেই বিনষ্ট হতে পারে না। কারণ তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আমার মনের সঙ্গে লেগে আছে। আপনি আমার পিতামাতার সমান, আপনি হরিভক্তদের সুখদায়ক, আমি যে কথা লিখলাম, তা অবিলম্বে বিচার বিবেচনা করুন। এই অন্ধকার জগৎ থেকে আমাকে বাঁচান।
তুলসীদাস মীরার এই পত্রের উত্তরে দুটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠির মাধ্যমে তিনি মীরাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। প্রথম চিঠিটি ছিল এইরকম—
”জা কে প্রিয় ন রাম বৈদেহী।
তজিয়ে তাহি কোটি বৈরী—সম, যদ্যপি পরম সনেহী।।
তজ্যোপিতা প্রহ্লাদ, বিভীষণ বংধু ভারত মহতারী।
বলি গুরু তজ্যো, কংত ব্রজ—বনিতা, ভয়ে সব মঙ্গলকারী।
না তো নেহ রামসোঁ মনিয়ত, সুহৃদ সুসেব্য জহাঁ লোঁ।
অঞ্জন কহা আঁখ জো ফুটে, বহুতক কহোঁ কহাঁ লৌঁ।।
তুলসী সো সব ভাঁতি পরম জিত, পূজ্য প্রাণ তেঁ প্যারো।
জ্যা সোঁ হোয় সনের রামপদ, এতো মতো হামারো।।”
—রাম—সীতা যার প্রিয় নয়, সে পরম স্নেহশীল হলেও কোটি শত্রুর ন্যায় তাকে পরিত্যাগ করবে। প্রহ্লাদ পিতাকে ত্যাগ করেছিলেন, বিভীষণ ভাইকে, ভরত মাকে, বালি গুরুকে এবং ব্রজবনিতারা স্বামীকে ত্যাগ করে মঙ্গল লাভ করেছিলেন। যাঁরা রামের প্রতি অটল ভক্তি প্রদর্শন করেন, তাঁরাই সুহৃৎ। তাঁদের সেবা করা উচিত। যে কাজল চোখে লাগালে অন্ধ হতে হয়, তা লাগিয়ে লাভ কি? অনেক কথাই বললাম, আর অধিক কি বলব? তুমি বুদ্ধিমতী, আশা করি আমার কথার আসল অর্থ বুঝতে পারছো। তুলসী বলে, যার রামপদে ভক্তি আছে, সে—ই সর্বপ্রকারে পরম মঙ্গলকারী, সে—ই পূজ্য এবং প্রাণাপেক্ষাও প্রিয়। এই হল আমার মত।
দ্বিতীয় চিঠিখানিতেও তাঁর সেই প্রাণের আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যে কত বড়ো রামভক্ত ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় এই চিঠিখানির মধ্যে। এই চিঠিখানিতে লেখা হয়েছিল—
”সো জননী সো পিতা সোঈ ভ্রাতা,
সো ভামিন সো সুত সো হিত মেরো।
সোঈ সগো সো সখা সোঈ সেবক,
সো গুরু সো সুর সাহিব চেরো।।
সো তুলসী প্রিয় প্রাণ সমান,
কহাঁ লৌঁ বতাই কহোঁ বর্হুতেরো।
জো তজি গেহ কো দেহ কো নেহ,
সনেহ সোঁ রাম কো হোয় সবেরো।।”
—সেই রামই আমার জননী, তিনিই পিতা, তিনিই ভ্রাতা, তিনিই স্ত্রী, তিনিই পুত্র, তিনিই আমার হিতকারী। তিনি আত্মীয়, তিনিই সখা, তিনিই সেবক, তিনিই গুরু, তিনিই দেবতা, তিনিই প্রভু, তিনিই দাস, তিনিই তুলসীর প্রাণের সমান প্রিয়। কত আর বলব রাম মাহাত্ম্যের কথা। অনেক তো বললাম। দেহ এবং গৃহের মমতা ত্যাগ করে যে রামের প্রতি অটল ভক্তি প্রদর্শন করে, সে রামের একান্ত আপন হয়ে ওঠে।
এই পত্র বিনিময় কি সত্যিই হয়েছিল? এখন ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যাক। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমজিৎ যখন রাণা পদে অধিষ্ঠিত হন, তার এক বছর আগে তুলসীদাসের জন্ম হয়েছিল। তুলসীদাসের প্রামাণ্য জীবনীকাররা এই কথা বারবার বলে গেছেন। তাই রাণা যখন মীরার প্রতি অত্যাচার করেন, তখন তুলসী ছিলেন নেহাতই এক বালক। তখনও পর্যন্ত তাঁর অধ্যাত্ম জীবন শুরু হয়নি। এই অবস্থায় তিনি কীভাবে মীরাকে সাহায্য করবেন? এমনকি ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে যখন মীরার মৃত্যু হয়, তখন তুলসী ছিলেন মাত্র পনেরো বছরের কিশোর। তাই আমরা অবশ্যই বলতে পারি যে, এটি হল এক অলীক কল্পনা।
মীরাবাঈ সম্পর্কে আর একটি রটনা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অনেকে বলে থাকেন যে, মীরাবাঈয়ের কবি প্রতিভার খ্যাতি নাকি স্বয়ং সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। আকবর ছদ্মবেশে মীরার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সঙ্গীত সাধক তানসেন। বাদশাহ আকবর ধর্মনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে নানা প্রশ্ন মীরাকে করেছিলেন। মীরার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। কিন্তু অসাধারণ প্রজ্ঞাবতী ছিলেন তিনি। তিনি বাদশাহ আকবরের সমস্ত প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিয়েছিলেন। সম্রাট মীরার উত্তর শুনে খুশি হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, গিরিধারীলালের সংস্পর্শ এবং সংস্রব মীরাকে এতখানি জ্ঞানী করে তুলেছে।
এবার তানসেন সঙ্গীততত্ত্ব বিষয়ক দুরূহ প্রশ্ন মীরাকে করেন। তানভেদ, রাগভেদ, তালভেদ প্রভৃতি কি, তা জানতে চান। মীরা অবলীলাক্রমে তানসেনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। এক—একটি রাগ—রাগিনীর লক্ষণ কি, তা বিশেষভাবে বুঝিয়ে বলেন। শুধু তাই নয়, কোন ঋতুতে এবং কোন সময়ে কোন রাগ বা রাগিনী গাওয়া উচিত এবং কেন গাওয়া উচিত, সে—বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছিলেন। বাদ্যযন্ত্রের উৎপত্তি এবং বাজনার বিবরণ সম্পর্কেও তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। সঙ্গীত বিষয়ে মীরার এই জ্ঞানের সীমা দেখে তানসেন খুবই খুশি হয়েছিলেন। মীরা সম্রাটকে রাজনীতি এবং দর্শন সম্পর্কে নানা উপদেশ দেন।
শুধু তাই নয়, সম্রাটের সঙ্গে আলাপচারিতা শেষ করে মীরা সঙ্গে সঙ্গে গিরিধারীলালের দিকে তাকিয়ে একটি পদ কীর্তন করতে থাকেন। এই পদে তিনি বলেছিলেন—
”মাঈরী মৈঁ সঁরলিয়া জান্যো নাথ।
লেন পরিচয়ো আকবর আয়ো, তানসেন লে সাথ।।
রাগ তান ইতিহাস শ্রবণ করি, নায় নায় মহি মাথ।
মীরাকে প্রভু গিরিধরনাগর, কীনহ্যো মোহিঁ সনাথ।।”
—মা, আমি তো শ্যামকেই আমার নাথ বলে জানি। আমার পরিচয় নেবার জন্য স্বয়ং সম্রাট আকবর তানসেনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আমার মুখে রাগ, তান এবং তার ইতিহাস জেনে আকবর বারবার মাটিতে মাথা নোয়ালেন। হে মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর, তুমি আমাকে সনাথ করো।
এই ঘটনা বাস্তবে ঘটা সম্ভব নয়। কারণ আকবর ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট পদে অভিষিক্ত হন। যখন মীরার মৃত্যু হয় ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে আকবর ছিলেন মাত্র পাঁচ বছরের বালক। তাই এটিকেও আমরা এক অনৈতিহাসিক তথ্য হিসাবে গ্রহণ করব।
ভাবতে অবাক লাগে, যাঁরা মীরার প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁদের অনেকে এই সব ভ্রান্ত কিংবদন্তীকে সত্য বলে স্বীকার করেছেন। এভাবেই তাঁরা মীরার চরিত্রে জনপ্রিয়তা এবং অলৌকিকত্ব আনতে চেয়েছেন। ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের মতো এক ব্যক্তিত্ব এই ঘটনাগুলিকে সত্য বলে ধরে নিয়েছেন। আর এর জন্য তিনি মীরার মৃত্যুকাল ঘোষণা করেছেন ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দ। কেউ কেউ আবার মীরার জন্ম ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দ বলে অনুমান করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মীরা ছিলেন রাঠোর সর্দার জয়মলের কন্যা।
মীরার পিতৃপক্ষের বংশ পরিচয় থেকে আমরা জানতে পারি যে, জয়মল ছিলেন মীরার জ্যেষ্ঠতাত বীরমদেবজির পুত্র।
মীরার নামে অসংখ্য পদ প্রচলিত আছে। এগুলি হয়তো মীরার রচনা নয়। এর মধ্যে এমন কিছু ভাব এবং ভাবনা আছে যা মীরা লিখেছেন বলে মনে হয় না। মীরা ছিলেন উচ্চশ্রেণীর সাধিকা। তিনি কখনও কদর্য ভাষা ব্যবহার করেননি। তাই এই পদগুলি তাঁর নামে উল্লিখিত না হওয়াই উচিত। এগুলি হল প্রক্ষিপ্ত পদ। কোনও কোনও পদে মীরার স্বামী ভোজরাজকে মহারাণা বলা হয়েছে। আবার কোথাও বলা হয়েছে যে, মীরা তাঁর স্বামীকে অত্যন্ত অশ্রদ্ধা করতেন।
এমন একটি পদ এখানে উল্লেখ করা হল—
”মীরা মহল সূঁ ঊতরী রাণা পকের্যাে হাথ।
হথলেরাকে সায়নে ম্হাঁরে ঔর ন দূজী বাত।।
ম্হাঁরো কহো হোঁ মানো রাণা বরজৈ মীরাবাঈ।।
জো তুম হাথ হমারো পকরো খবরদার মন মাহী।।
দেস্যূঁ স্রাপ সাঁচে মন সোঁ জল বল ভস্ম হোই জাঈ।।
জন্ম জন্ম কে পতি পরমে সুর থাঁরী নহীঁ লুগাঈ।।
থাঁরো ম্হাঁরো ঝুঠো সনেসা গারৈ মীরাবাঈ।।”
—মীরা যখন নিজের মহল থেকে নেমে আসছিলেন, সেই সময় রাণা তাঁর হাত চেপে ধরলেন। মীরা ক্রোধ ভরে বলেছিলেন, হাত ধরেছো ক্ষতি নেই, কিন্তু আর দ্বিতীয় বাক্য বলো না। রাণা, মীরাবাঈ তোমাকে সাবধান করছে। তুমি আমার কথা মেনে চলো। তুমি যে আমার হাত ধরলে, মনে মনে হুঁশিয়ার হও। হয়তো আমার এই পবিত্র মন থেকে তোমাকে অভিশাপ দেবো, তুমি জ্বলে—পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। পরমেশ্বরই আমার জন্ম—জন্মান্তরের পতি। তুমি আমার কেউ নও। মীরাবাঈ মুক্ত কণ্ঠে বলছে, তোমার আর আমার মধ্যে যে সম্পর্ক, তা একেবারে মিথ্যা।
মীরা তাঁর স্বামীর প্রতি যথেষ্ট সদয় ছিলেন। তিনি যথাসম্ভব স্বামীকে দেখাশুনা করতেন। তাই তিনি যে স্বামীকে উদ্দেশ করে এমন একটি ঘৃণিত পদ রচনা করবেন তা কখনও ভাবা যায় না।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে। রাণা ভোজরাজের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে মীরা চিতোর পরিত্যাগ করতে কৃতসঙ্কল্প হলেন। তিনি বৃন্দাবনে গিয়ে সাধুসঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। কিছুদিন বাদে রাণা মীরার কাছে গিয়ে তাঁর এহেন আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর মীরা যাতে চিতোরে থাকেন, সেজন্য চেষ্টা করেন।
মীরা বলেছিলেন—আমি নিজেই ভিক্ষুক, আমার কাছ থেকে কী ভিক্ষা প্রত্যাশা করো?
রাণা উত্তরে বলেছিলেন—আমি যা চাই, তা দেবার শক্তি তোমার আছে। তখন তিনি ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করে মীরার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। স্বামীকে চোখের সামনে দেখে মীরা যথেষ্ট অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং তিনি স্বামীর হাত ধরে চিতোরে ফিরে আসেন।
এটিও একটি গল্প। কারণ আমরা জানি স্বামীর মৃত্যুর পর মীরা বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। অনেকে মীরার স্বামীকে রাণা বা মহারাণা বলেন। এটিও ঠিক নয়। কারণ তিনি যুবরাজ অবস্থাতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। আবার অনেকে মীরাবাঈয়ের একটি পদ বিশ্লেষণ করে তাঁকে চৈতন্যদেবের শিষ্য বা ভক্ত বলেছেন। সেই পদটি হল এইরকম—
”অব তৌ হরী নাম লৌ লাগী।
সব জগ কো য়হ মাখন চোরা, নাম ধর্যাে বৈরাগী।।
কিত ছোড়ী রহ মোহন মুরলী, কঁহ ছোড়ী সব গোপী।
মূঢ় মুঢ়াই ডোরিকটি বাঁধী, মাথে মোহন টোপী।।
মাত জসো মতি মাখন কারণ, বাঁধে জা কে পাঁর।
স্যাম কিসোর ভয়ো নবগোরা, চৈতন্য জাকো নাঁর।।
পীতাংবর কো ভার দিখারৈ, কটি কৌপীন কসৈ।
গৌরকৃষ্ণ কী দাসী মীরা, রসনা কৃষ্ণ বসৈ।।”
—এখন তো হরিনামেই আমার ধ্যান লেগেছে। জগতে যাঁকে সকলে মাখনচোর বলে, সে এখন বৈরাগী নাম ধরেছে। তোমার সেই মোহনমুরলী তুমি কোথায় রেখে এসেছো? গোপীদের কোথায় রেখেছো? দেখছি, তুমি এখন মাথা মুড়িয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে, মাথায় সুন্দর টুপি দিয়েছো। মাখন চুরি করার কারণে মা যশোমতী যার পা বেঁধে রেখেছিলেন, সেই কিশোর শ্যাম এখন নবগৌর হয়েছে। এখন তার নাম চৈতন্য। পীতাম্বরের ভাবে আবার কৌপীন পরেছে। মীরা গৌর—কৃষ্ণের দাসী, তার রসনায় কৃষ্ণনাম লেগেই আছে।
এটিও একটি প্রক্ষিপ্ত পদ। এই পদটি বোধহয় অন্য কোনও কবির লেখা কারণ মীরা এ ধরনের পদ লিখেছেন বলে মনে হয় না।
১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুন মাসে যোধপুরের মালদেবজি মেড়তা আক্রমণ করেন। তিনি মেড়তার সবকিছু একেবারে ধ্বংস করে দেন। রাজপ্রাসাদ ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়। শুধু থেকে যায়, ভগবান চতুর্ভুজজির মন্দির আর রাজপ্রাসাদের কিয়দংশ। এই অংশ এখনও পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে। এখানে একটি ছোট্ট প্রকোষ্ঠ আছে। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে বলা হয়, এটাই মীরার ভজন মন্দির। সেখানে এখনও গিরিধারীলালের বিগ্রহ আছে। মীরার মাহাত্ম্য—প্রভাবে মালদেবজি রাজপ্রসাদের ওই অংশটি ধ্বংস করতে পারেননি।