কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈ : আধ্যাত্মিক সাধনা
শ্রীকৃষ্ণের প্রতি মীরাবাঈয়ের যে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল, তাকে আমরা শ্রীকৃষ্ণের মধুর লীলার এক উজ্জ্বল উদাহরণ বলতে পারি। এই মধুর লীলা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই এর শ্রেণী বিভাগ বোঝা দরকার। মধুর লীলা প্রকাশ করতে হলে পাঁচরকম ভাবের উন্মেষ চোখে পড়ে। পাঁচটি ভাব হল যথাক্রমে বিভাব, অনুভাব, সাত্ত্বিক, সঞ্চারী এবং স্থায়ী। সৌভাগ্যের কথা, মীরাবাঈয়ের মধ্যে এই পঞ্চভাবের প্রকাশ ঘটে গিয়েছিল। তাই তিনি মধুরভাবে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শৃঙ্গারে মগ্ন থেকেছিলেন। এই জাতীয় সম্পর্কে শারীরিক আকর্ষণ খুব একটা থাকে না, এখানে মানসিক বন্ধন আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। মীরাবাঈ ও কৃষ্ণের ক্ষেত্রে সেই ঘটনাই ঘটে গিয়েছিল।
যে যে বস্তু রতির আস্বাদনের হেতু হয়, তাদেরই বিভাব বলা হয়। বিভাবকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে—আলম্বন বিভাব এবং ত্রিকোণ বিভাব। যাকে আশ্রয় করে রতি উদয় হয়, তাকে বলে আলম্বন বিভাব। যার দ্বারা রতি উদ্দীপন হয়, তাকে বলে ত্রিকোণ বিভাব।
শ্রীকৃষ্ণ হলেন রতির বিষয়ক। তাই তাঁকে আমরা বিষয় আলম্বন বলব। রাতের চাঁদ, বাঁশির গান, কোকিলের কুজন, ভ্রমরের গুঞ্জন ইত্যাদি হল রতির উদ্দীপন। অশ্বের হ্রেষারব, কারমূকের টঙ্কার, অস্ত্রের ঝনাৎকার ইত্যাদির মাধ্যমে বীর হৃদয়ে জিগীষাভাবের উদ্দীপন হয়। আবার পূর্ণচন্দ্রের অমল ধবল কৌমুদী, পাখির কাকলি, শিখির নর্তন, পুষ্পের হাসি, মধুর বাঁশি প্রেমিকের হৃদয়ে মধুর ভাবের উদ্দীপন ঘটায়।
কৃষ্ণ এই লীলার পরম পুরুষ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ব্রজের সমস্ত লীলার মধ্যে অপ্রাকৃতভাব দেখা যায়। আবার কিছু কিছু প্রাকৃত ব্যাপারও ঘটে গেছে। অপ্রাকৃতভাবের সঙ্গে প্রাকৃতভাবের সম্মিলনের ফলে এই মিলন আরও বেশি রম্য ও মনোহর হয়ে উঠেছে।
কৃষ্ণলীলার মধ্যে অলৌকিকভাবের আদান প্রদান হয়ে থাকে। যেহেতু সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ভাবের তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, তাই সেখানে কিছু প্রাকৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এইভাবে কৃষ্ণলীলা আমাদের কাছে আদরণীয় এবং গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে।
মীরাবাঈয়ের অসংখ্য পদে এই মধুরভাবের উন্মেষ চোখে পড়ে। এই ভাবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল। আমরা জানি জগৎ চৈতন্যময়। নিখিল ব্রহ্মাণ্ড এক অখণ্ড চিৎসমুদ্রে ডুবে আছে। চিন্ময়ী হ্লাদিনী শক্তির উল্লাসে জগৎ উল্লসিত হবে, এতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে?
ভারতীয় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে এ বিষয়টি বারবার উল্লিখিত হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল মানুষের মনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ফেলে। কৃষ্ণ যখন মধুর লীলায় রত ছিলেন, তখন আকাশে ছিল শারদীয় পূর্ণ শশী। এই চাঁদের জোছনধারায় প্লাবিত হয়েছিল বিশ্ব প্রকৃতি। এখানে কিন্তু শুধুমাত্র একটি পূর্ণিমার কথা বলা হয়নি। ব্রজের শত কোটি রাত্রির এক অখণ্ড রূপের সংযোজন দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে থাকে যোগমায়ার অচিন্তনীয় প্রভাব। পরমাণু থেকে ব্রহ্মাণ্ড অথবা কীটাণু থেকে বৃহৎ জীব, সকলেই শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই প্রাকৃত জগতের সাথে অপ্রাকৃত বিষয়কে সংযুক্ত করা হয়েছে।
যে অষ্টসখীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ নানাধরনের লীলা করতেন, তাঁদের পরিচয়ও প্রদান করা দরকার। তাহলে আমরা বুঝতে পারব কীভাবে মীরাবাঈয়ের মধ্যে এই অষ্টসখীর সমাবেশ ঘটে গিয়েছিল। এঁদের প্রধানা হলেন ললিতা। তাঁর অপর নাম অনুরাধা। তিনি শ্রীরাধার থেকে সাতাশ দিনের বড়ো। তাঁকে বামা, প্রখর স্বভাবা, ময়ূরপুচ্ছের ন্যায় বসনযুক্ত বলা হয়। তাঁর মায়ের নাম বিশারদী এবং বাবার নাম বিশোক। গোবর্ধনমল্লের সখা ভৈরব হলেন ললিতার পতি।
এবার আমরা শ্রীকৃষ্ণের দ্বিতীয় সখী বিশাখার কথা বলব। শ্রীরাধা যেদিন জন্মগ্রহণ করেন, তিনিও সেইদিন সেইক্ষণে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। তাই বোধহয় বিশাখার আচার, গুণ এবং ব্রত শ্রীরাধার অনুরূপ হয়েছিল। তাঁর বসন তারাবলী শোভাযুক্ত। অঙ্গকান্তি বিদ্যুতের মতো। মুখরার ভগিনীপুত্র পাবন এবং জটিলার ভগিনীকন্যা দক্ষিণা হলেন তাঁর পিতা ও মাতা। বাহিকের সাথে বিশাখার বিয়ে হয়েছিল।
শ্রীরাধার থেকে একদিনের ছোটো চম্পকলতা হলেন তৃতীয় সখী। তাঁর অঙ্গকান্তি ফুল্ল কুসুমের মতো। বসন চাষপক্ষীর মতো। তাঁর পিতার নাম আরাম এবং মায়ের নাম বাটিকা। পতির নাম চণ্ডাক্ষ। গুণে চম্পকলতা ছিলেন বিশাখার সদৃশ।
চতুর্থ সখীর নাম চিত্রা। তিনি শ্রীরাধার থেকে সাঁইত্রিশ দিনের ছোটো। তাঁর বসন কাঁচসদৃশ। গৌরীর মতো অঙ্গকান্তি। তিনি শ্রীকৃষ্ণের আনন্দকারিণী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। চতুর নামের এক গোপ তাঁর জনক, শ্রীমতী চর্চিকা তাঁর জননী। পতির নাম পিঠর।
পঞ্চম সঙ্গিনীর নাম তুঙ্গবিদ্যা। তিনি বয়সে শ্রীরাধার থেকে পাঁচদিনের বড়ো। তিনি বহুল পরিমাণে কর্পূর—চন্দন সম্বলিত হয়ে থাকেন। তাঁর বসন শ্বেতবর্ণ। তিনি প্রখর স্বভাবা। মায়ের নাম মেধা এবং পিতার নাম পৌষ্কর। বালিশ তাঁর পতি।
ষষ্ঠ নায়িকার নাম ইন্দুরেখা। তিনি শ্রীরাধার থেকে তিনদিনের ছোটো। হরিতালের মতো উজ্জ্বল অঙ্গকান্তিসম্পন্না। দাড়িম্বপুষ্পের মতো বসন। সাগরগোপ তাঁর পিতা এবং মাতা বেলা। দুর্বল তাঁর স্বামীর নাম। তিনি বামপ্রখর স্বভাবা।
সপ্তম সখীর নাম রঙ্গদেবী। তিনি শ্রীরাধার থেকে সাতদিনের ছোটো। তাঁর অঙ্গকান্তি তপ্তের মতো। পিতার নাম রঙ্গসার, মায়ের নাম করুণা। রক্তেক্ষণ তাঁর পতি। এঁর গুণ চম্পকলতার মতো।
অষ্টম সখী সুদেবী। তিনি রঙ্গদেবীর যমজ ভগিনী। শ্রীরাধার থেকে সাতদিনের ছোটো। রূপ ও বসন রঙ্গদেবীর মতো। রঙ্গদেবীর দেবর অর্থাৎ রক্তেক্ষণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বক্রেক্ষণ তাঁর পতি।
এই আট সখী নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখীসমাজ গঠন করেছিলেন। এই সমাজে আরও অনেক কিশোরী কন্যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। প্রত্যেক প্রধান সখীর অধীনে আরও অনেক সখীর স্থান ছিল। সব মিলিয়ে চৌষট্টি জন গোপিনী শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিহার করতেন।
তাঁরা সকলেই ছিলেন বয়সে কিশোরী এবং রূপ যৌবন সমন্বিতা। বাইরের লোক তাঁদের বিলাসিনী গোপরমণী হিসাবে দেখতেন। বাহির স্বভাবে তাঁরা সংসারের সঙ্গে যুক্ত বলে প্রতীয়মানা ছিলেন, কিন্তু তাঁরা ছিলেন যোগিনী বা সন্ন্যাসিনীর আদর্শস্বরূপা। শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ বাক্যে আমরা এইসব গোপিনীর আসল পরিচয় পেয়ে থাকি। সেই বর্ণনাটি এখানে বলা হল—
”কৃষ্ণলীলা মণ্ডল শুদ্ধশঙ্খ কুণ্ডল
গড়িয়াছে শুক কারিকর।
সেই কুণ্ডল কানে পরি তৃষ্ণা লাউ থালি ধরি
আশা ঝুলি কান্ধের উপর।।
চিন্তা কান্থা উড়ি গায় ধূলি বিভূতি মলিনকায়
হাহা কৃষ্ণ প্রলাপ উত্তর।
উদ্বেগ দ্বাদশ হাতে লোভের ঝুলি নিল মাথে
ভিক্ষাভাবে ক্ষীণ কলেবর।।
দশেন্দ্রি শিষ্য করি, মহা বাউল নাম ধরি
শিষ্য ল’য়ে করিলা গমন।
দেহ মোর স্বসদন বিষয় ভোগ মহাধন
সব হারি গেলা বৃন্দাবন।।
শূন্য কুঞ্জ মণ্ডপকোণে যোগাভ্যাস কৃষ্ণধ্যানে
তাহা রহে লঞা শিষ্যগণ।
কৃষ্ণ আত্মা নিরঞ্জন সাক্ষাৎ দেখিতে মন
ধ্যানে রাত্রি করে জাগরণ।।
মন কৃষ্ণবিয়োগী দুঃখে মন হ’ল যোগী
সে বিয়োগে দশ দশা হয়।
সে দশায় ব্যাকুল হঞা মন গেল পলাইয়া
শূন্য মোর শরীর আলয়।।
এই বর্ণনাটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি, গোপিনীরা কিন্তু সেই অর্থে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকা ছিলেন না। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে শারীরিক ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আসলে তাঁদের মধ্যে বৌদ্ধিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।
এক—একজন ব্রজকামিনীর হৃদয়ে যে সমস্ত মহাভাব ফুটে উঠত, তার মধ্যে বিরহ এবং মিলনজনিত আনন্দ ও উৎকণ্ঠা জড়িত ছিল। ব্রজদেবীরা সংসার রূপ একটি আবরণের মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরা মন দিয়ে গৃহকার্য সম্পন্ন করেছেন, আবার কৃষ্ণ—আরাধনায় মত্ত থেকেছেন। এর মাধ্যমে বোধহয় একটি গূঢ়বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তা হল, আমরা গার্হস্থ্য জীবনযাপনের পাশাপাশি ভগবত সাধনায় আত্মনিবেদন করব।
সঙ্গে আমাদের যে আবেগ বা অনুভূতিটি দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত আছে, সেটি হল প্রেম। এই প্রেম আস্বাদন করতে হলে যুগান্তব্যাপী কঠোর তপস্যার প্রয়োজন নেই। এজন্য প্রেমিক—প্রেমিকাকে অসাধারণ মেধাসম্পন্ন হতে হবে না। শত—শত জন্ম ধরে বেদপাঠ করলেও এই প্রেমের রস আস্বাদন করা সম্ভব হবে না। শত শত ভাঁড় সুবর্ণ ও কোটি কোটি গো ও কন্যাদানের মাধ্যমে এই প্রেমকে আমরা উপলব্ধি করতে পারব না।
তাই উপনিষদে বলা হয়েছে—
”নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো
ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন।।”
আবার মহাপ্রেমিকা মীরাবাঈ বলেছেন—
”বিনা প্রেমসে না মিলে নন্দলালা।।”
এই প্রেম কি শুধুমাত্র নারী—পুরুষের তীব্র শারীরিক আকর্ষণ? না, যদি আমরা এই প্রেমের রস বিষয়ে আলোচনা করি, তাহলে বুঝতে পারব, এর মধ্যে এক অপার্থিব আকর্ষণ বিদ্যমান। এই প্রসঙ্গে ‘অনঙ্গবর্দ্ধন’ শব্দটির ব্যাখ্যা করা দরকার। আগে যা অঙ্কুর সদৃশ ছিল, তা এখন বর্ধিত হয়েছে। এইভাবে বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বর প্রেমের ধারাকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন। আমাদের মধ্যে যে বীজ সূপ্ত অবস্থায় থাকে, তাকে কামবীজ বলা হয়। কামবীজ বললে ক্লীং বীজকেই বোঝায়। কিন্তু ক্লীংকার এবং ওঙ্কার একই বস্তু। যে শক্তি জীবকে কৃষ্ণপদকল্পতরুর মূলে নিয়ে যেতে সমর্থ, তাই হল কামবীজ। বিশ্বাসের সাধ্য নেই যে, অন্ধ কর্তৃক চালিত জীবকে তার লক্ষ্যস্থলে নিয়ে যেতে হবে। তাই শ্রীচৈতন্যদেব বলেছেন—
”সংসার মোচন আর সন্তাপ হরণ।
করিতে ক্ষমতা যার নাহিকো কখন।।
তিহঁত গুরুর যোগ্য নহে কদাচন।
তাঁরে ত্যাগ করি কর সদ্গুরু গ্রহণ।।
কাল হইতে মুক্তি যেই করিতে না পারে।
তাঁর সঙ্গে কি সম্বন্ধ আছয়ে সংসারে।।”
তিনি এর দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন—
”বলিরাজ নিজগুরু শ্রীশুক্রাচার্য্যেরে।
অবিজ্ঞ জানিয়া যজ্ঞকালে পরিহরে।।
বিভীষণ জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাবণে ছাড়িল।
হিরণ্যকশিপু পিতার প্রহ্লাদ বর্জিল।।
ভরত কৈকেয়ীমাতা করেন বর্জনে।
খটাঙ্গ রাজর্ষি ত্যাগ কৈল দেবগণে।।”
এই কামবীজ থেকেই অনঙ্গাঙ্কুর উদগত হয়। তাকেই আমরা প্রেমাঙ্কুর বলে থাকি। ‘বংশীশিক্ষা’য় চৈতন্যদেব এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন—
”প্রেমের প্রথমাবস্থা ভাবনায় ধরে।
যাহাতে সাত্ত্বিকভাবে অল্প ব্যক্ত করে।।
ভাব শব্দে রতি কহে রতি শব্দে ভাব।
পূরাণাদি মতে এই একাগ্রতা লাভ।।
রতি গাঢ় হইলে হয় প্রেমের উদয়।
যাহা মানবের মাত্র প্রয়োজন হয়।।
প্রেমের অপর নাম পিরিতি কহয়।
প্রীতির একান্ত অর্থ অনুরাগ হয়।।”
যাকে আমরা কাম বা প্রেম বলছি, তার সাথে অনঙ্গ বা শৃঙ্গারের মিল আছে। কামের সাথে আসে বিরহ, মিলন, সম্ভোগ প্রভৃতি শব্দ। প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে একটি আলাদা প্রতীতি লুকিয়ে আছে। এই জাতীয় প্রেমের গতি—প্রকৃতি অনুভব করতে হলে প্রতিটি শব্দের মানে অনুধাবন করা দরকার।
বিল্বমঙ্গল ঠাকুর শ্রীভগবানকে বলেছেন কামের অবতার। কাম আছে বলেই পৃথিবীতে প্রজনন হয়। তা না হলে মানব সমাজ কবেই ধ্বংস হয়ে যেত। অর্থাৎ মানব—মানবীর মনে যে পারস্পরিক যৌনেচ্ছার জন্ম হয় তা ঈশ্বরের অনুগ্রহেই হয়ে থাকে। এই ইচ্ছা না থাকলে কখনও জগৎসংসার পরিব্যাপ্ত হতে পারত না। বিল্বমঙ্গল ঠাকুর ‘কর্ণামৃত’—এ মন্তব্য করেছেন—
‘চাতুর্যেক নিদানসীম চপলাপাঙ্গচ্ছটামন্থরম্।
লাবণ্যামৃতবীচিলোলিতদৃশাং লক্ষ্মী কটাক্ষাদৃতম্।
কালিন্দি পুলিনাঙ্গন প্রণয়িনং কামাবতারাঙ্কুরম্।
বালং নীলমসিবয়ং মধুরিম স্বরাজ্যমারাধ্নুমঃ।।”
শ্রীকবিরাজ গোস্বামী তাঁর ‘গৌতমীতন্ত্র’—এ লিখেছেন—
”প্রেমৈব গোপরামাণাং কাম ইত্যগমৎ প্রথাম্।”
শ্রীরূপ গোস্বামী এর ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে—
”লঘুত্বমাত্রযৎ প্রোক্তং তত্তু প্রাকৃত নায়কে।
ন কৃষ্ণে রসনির্য্যাসস্বাদার্থমবতারিণি।।”(উঃ নীঃ)
শ্রীকৃষ্ণ যখন মধুররস আস্বাদন করার জন্য এক নবীন রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন তিনি যে রস আস্বাদন করেন তাকে আমরা পরম পূজ্য বলে থাকি। এই প্রসঙ্গে শৃঙ্গার রসের কথা আলাদাভাবে বলা উচিত। কারণ রতি গাঢ় হলে তবেই প্রেমের উদয় হয়। শৃঙ্গার হল প্রেমের একটি বিশেষ অবস্থা। শ্যামসুন্দরকে আলিঙ্গন করার জন্য গোপিনীদের মধ্যে যে উৎকন্ঠা এবং উদ্বেগ দেখা যেত, তার থেকেই শৃঙ্গার রসের জন্ম। শৃঙ্গার রসে রতি বা ভাব অথবা প্রেম স্থায়ীভাব প্রাপ্ত হয়। অনুরাগের আকর্ষণে শৃঙ্গার রস বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। মীরাবাঈ যখন নন্দলালাকে স্মরণ করে পদ লিখেছেন, তখন তাঁর মধ্যেও এই শৃঙ্গার রস দেখা গেছে। তিনি বিরহ এবং মিলনের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের সাথে নিজেকে একাত্ম করার চেষ্টা করেছিলেন। উদাবাঈয়ের সামনে ভগবানের পদ রচনা করেছেন। এই পদে যে উপমাগুলি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলির গ্রহণযোগ্যতা অসাধারণ। মীরাবাঈ বলেছেন—
”কুণ্ডল কী অলক ঝলক কপোলন পর ছাঈ
মনো মীন সররর তজি মকর মীলন আঈ।।”
—ভগবানের কর্ণে কুণ্ডল দুলছে। তার জ্যোতিতে গণ্ডদেশ সমাচ্ছন্ন হয়েছে। মনে হয় মীন সরোবর পরিত্যাগ করে মকরের সঙ্গে মিলনের জন্য ছুটে চলেছে।
এখানে এই পদটির রস গ্রহণ করতে হলে ওই শৃঙ্গার রসের কথাই বলতে হবে। মীরা চোখকে মীনের সঙ্গে এবং কুণ্ডলকে মকরের সঙ্গে উপমা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভগবানের চক্ষু আকর্ণ বিশ্রান্ত। আমরা জানি হিন্দি, গুজরাটি, রাজপুতনা, সংস্কৃত এবং ব্রজভাষায় মীরার বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর রচিত পদগুলিতে এইসব ভাষা থেকে সুনির্বাচিত শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে। মীরা ‘নরসী জী কী মায়রা’, ‘রাগ গোবিন্দ’, ‘গীতগোবিন্দ কী টীকা’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই বইগুলি পড়লে আমরা তাঁর কবিত্ব শক্তির পরিচয় পেয়ে থাকি। তাঁর রচিত পদগুলি সরল এবং সুললিত। বিরহ সম্বন্ধীয় পদগুলি বড়োই মর্মস্পর্শী। মীরা নিজে সুগায়িকা ছিলেন। তাঁর ভজন শুনতে শুনতে শ্রোতৃমণ্ডলী অচেনা জগতের বাসিন্দা হয়ে যেতেন। একজন লেখক তাঁকে Singer and Saint of India বলে মন্তব্য করেছেন।
মীরা যে সমস্ত পদ রচনা করেছেন, সেগুলিকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি। এই চারটি ভাগ হল—(১) চেতাবনী কা অংগ, (২) উপদেশ কা অংগ, (৩) বিরহ ঔর প্রেম কা অংগ এবং (৪) বিনতি ঔর প্রার্থনা কা অংগ। প্রত্যেকটি অংগে এক—একটি ভাব পরিস্ফুটিত হয়েছে। ‘চেতাবনী’ শব্দের অর্থ সাবধান করে দেওয়া। এর মধ্যে যেসব পদগুলি সংযোজিত হয়েছে, সেগুলি পড়লে আমরা বুঝতে পারি যে, মীরা কখন তাঁর মনের কী ভাব প্রকাশ করছেন। উপদেশ পর্যায়ে যে গানগুলি বলা হয়েছে, সেগুলি সাবধানতা সহকারে পাঠ করা উচিত। কারণ এই গানগুলির মধ্যে মানুষকে সুপথে নিয়ে আসার তত্ত্ব বিদ্যমান। মীরার সর্বশ্রেষ্ঠ পদগুলি আছে বিরহ ঔর প্রেম কা অংগ বিষয়ক পদগুলির মধ্যে। বিরহ যে কত অশ্রুসজল হতে পারে, তার প্রমাণ আছে ওই পদগুলিতে। মীরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কৃষ্ণবিরহে উন্মাদিনী অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তো তাঁর কলম থেকে এমন মর্মস্পর্শী শব্দ নির্গত হয়েছে। আর আছে ”বিনতি ঔর প্রার্থনা’ শীর্ষক পদ। জীবনযুদ্ধে পরাস্ত একজন মহিলা ঈশ্বরের কাছে নিজের সবকিছু সমর্পণ করছেন। বিনিময়ে তিনি কেবল ভগবানের করুণা চাইছেন, অন্য কিছু নয়। এমন আত্মত্যাগ ভারতীয় ইতিহাসে খুবই কম দেখা গেছে। তাই তো মীরা আজ অমরত্ব লাভ করেছেন।
মীরা কয়েকটি রাগ—রাগিনী ব্যবহার করেছেন তাঁর লিখিত পদগুলিতে। যেহেতু এটি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়, তাই আপাতত আমরা আমাদের আলোচনা থেকে এই বিষয়টি বাদ দেবো।
মীরার বিরহকাতর অবস্থা যে কোথায় পৌঁছে গিয়েছিল, সেই পরিচয় বহন করছে, তাঁর রচিত একাধিক পদ। তিনি একটি পদের মাধ্যমে বলেছেন—
”পতিয়াঁ মৈঁ কৈসে লিখুঁ লিখিহি নজাঈ।
কলম ভরত কর কংপত জিরদো রহো ঘর্রাঈ।
বাত কহুঁ মোঁহি বাত ন আরৈ নৈন রহে ঝরাঈ।।”
—পত্র কেমন করে লিখব? লেখা তো যায় না, কলম ডুবালেই যে হাত কাঁপে, বুক ধড়ফর করে, কী কথা যে লিখব কিছুই যে মনে আসছে না। চোখ দিয়ে জল পড়ছে, সর্বাঙ্গ থরথর করছে।
শরীর জুড়ে কম্পনও শৃঙ্গার রসের উদাহরণ। মীরা তখন কৃষ্ণপ্রেমে এমনই মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলেন যে, চারপাশের পরিবেশে কি ঘটনা ঘটছে তা বিশ্লেষণ করতে পারেননি।
মীরা এই বিষয়ে বেশ কয়েকটি পদ লিখে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কথা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যেমন মীরা লিখেছেন—
”জিন কে পিয় পরদেস রসত হৈঁ,
লিখি লিখি ভেজেঁ পাতী
মেরা পিয় মো মাহিঁ বসত হৈঁ,
কহুঁ ন আতী জাতী।।”
—যার প্রিয়জন বিদেশে বাস করে, সে চিঠি লিখে তার সংবাদ নিয়ে আসে। কিন্তু আমার প্রিয় তো আমার হৃদয়ের মধ্যে বাস করে দিবারাত্র গুঞ্জন করছেন, কোথাও যান না, আসেনও না। তাই আমি কাকে চিঠি লিখব?
কী অসাধারণ উপমা। যার প্রেমিক হৃদকমলে বসবাস করেন, তার কাছে চিঠি পাঠাবার দরকার কি?
মীরার একাধিক পদে মিলনসূচক প্রত্যাশা লুকিয়ে আছে। তিনি যে ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য ব্যাকুল চিত্তে অপেক্ষমান আছেন, একথা আমরা জানতে পারি পদগুলি পড়লে। তিনি লিখেছেন—
”নানা রং—এর ফুল বিছিয়ে শয্যা রচনা করে শ্যামের পথ পানে চেয়ে বসে আছি। কিন্তু আমার শ্যাম তো এলেন না। প্রিয়তমের অপেক্ষায় বসে আকাশের নক্ষত্র গুনতে গুনতেই রাত ভোর হয়ে গেল, প্রিয়তম তবুও এলেন না।” এই পদটি আমাদের দুটি চোখকে অশ্রুসজল করে দেয়।
শ্রীকৃষ্ণ যখন মথুরায় চলে গিয়েছিলেন তখন বৃন্দাবন জুড়ে নেমে এসেছিল বিরহের সুর। কৃষ্ণবিরহে সাধারণ মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সেই বিষয়টি অনুধাবন করে মীরা লিখেছেন—”তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে বলে মথুরাতে চলে গিয়েছিলে। কিন্তু আজও এলে না। হায়রে, সেই সময় থেকে তোমার অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে আমার আঙুল এবং আঙুলের রেখা ঘষে ঘষে ক্ষয়ে গেছে।” এই আত্মনিবেদনটি উপলব্ধি করতে হবে। এই পদটির মাধ্যমে মীরা তাঁর মনোগত বাসনার কথা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
মীরার আরতির বর্ণনাও চমৎকার। যাঁরা সদগুরুর উপদেশ সদা—সর্বদা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন তাঁরা তো এভাবেই আরতি বন্দনা করেন।
মীরা লিখেছেন—
”য়া তন কোন দিরলা করূঁ, মনসা কী বাতী হো।
তেল জলঊঁ প্রেম কো, কয়ূঁ দিন রাতী হো।।”
—আমি আমার এই দেহকে করেছি প্রদীপ। আমার মন হয়েছে সলিতা। জ্বলছে প্রেমের তেল। এভাবেই আমি ভগবানের আরতি করব। ওই প্রদীপশিখা অনির্বাণ জ্বলতেই থাকবে।
মীরার আর একটি পদ পাঠ করলে আমরা তাঁর দর্শন সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারি। তাঁর বেশিরভাগ পদে আত্মনিবেদনের একটি সুর ফুটে উঠেছে। তিনি নিজেকে পাষাণ প্রতিমা অহল্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর ইচ্ছা, ঈশ্বর যেন তাঁকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। ভগবানের প্রতি কতখানি ভালোবাসা থাকলে, তবেই এমন ইচ্ছা প্রকাশ করা যায় তা অনুমেয়। মীরার ভাষায়—
”পাত্থর কী তো অহিল্যা তারী, বন কে বীচ পড়ি।
কথা বোঝ মীরা কহিয়ে, সৌ উপর এক ধড়ি।”
—তিনি বলেছেন অহল্যা জঙ্গলে পাথর হয়ে পড়েছিল, তুমি সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করলে, তার মীরা কি তোমার এত বড়ো বোঝা যে, যে পাল্লার উপর পাঁচ সের?”
আর একটি পদের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বর উপলব্ধি করেছেন অন্যভাবে। তিনি জানেন প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে লোভ—লালসা বাস করে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এইসব ইন্দ্রিয়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে না পারব, ততক্ষণ ঈশ্বরসান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব হবে না। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় শ্রীমদ্ভাগবতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উচ্চারিত একটি বাণী। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন—অর্জুন, তুমি কাম—ক্রোধকে পরিত্যাগ করো। নাহলে সাধনমার্গের পথে অগ্রসর হবে কেমন করে?
শ্রীকৃষ্ণের ভাষায়—
”ত্রিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ।
কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্রয়ং ত্যজেৎ।।”
মীরাও এইভাবে নিজের মনের সব অন্ধকার দূর করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি বলেছেন—
”কাম কূকর লোভ ভরী, বাঁধি মোঁহি চং ডাল।
ক্রোধ কসাই রহত ঘটমে, কৈসে মিলৈ গোপাল।।
বিলার বিষয়া লালচীরে, তাহি ভোজন দেত।
দীন হীন হ্বৈ ছূধা রত সে, রাম নাম ন লেত।।”
—আমার ভেতর এক চণ্ডাল কাম—কুকুরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। আমার দেহে এক ক্রোধ—কসাই আছে। কাজেই আমি কেমন করে গোপালকে পাব? আমার দেহের ভেতর একটি বিড়াল আছে, সে বিষয়ের জন্য নিত্য লালায়িত, আমি আবার সর্বদাই তাকে উপযুক্ত খাদ্য দিচ্ছি। সে দীনহীন ও ক্ষুধায় প্রপীড়িত হয়ে রামনাম নিচ্ছে না।
তিনটি মনুষ্যেতর প্রাণীকে মানুষের তিন ধরনের প্রবৃত্তির প্রতীক হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই পদটির মধ্যে মীরার জ্ঞানের পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে।
জীবনে চলার পথে সদগুরুর সন্ধান করা উচিত। মীরার সৌভাগ্য তিনি রৈদাসের মতো সদগুরুর সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর সান্নিধ্যে আসার পর মীরার জীবনে একটু একটু করে পরিবর্তন সাধিত হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর আহার্যও প্রায় পরিত্যাগ করেছিলেন। নিদ্রাকেও ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। তখন সমস্ত রাত কেটে যেত শুধু ঈশ্বরসাধনায়। মীরার কণ্ঠনিঃসৃত এক—একটি সঙ্গীত বুঝি সত্যি সত্যি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যেত। মীরা একটি পদের মাধ্যমে তাঁর তখনকার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন—
”জ্যাঁরে হিরদে হরি বকে, ত্যাঁ কূঁ নীদ ন আরে।
ঔর সখী পিউ সূত গমায়ে, মৈঁ জু সখী পিউ জাগি গমায়ে।”
—যার হৃদয়ে হরি বাস করেন, তার নিদ্রা আসে না। অন্যান্য সখীরা দেখি তাদের প্রিয়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে রাত কাটায়। কিন্তু সখী, আমি আমার প্রিয়তমের সঙ্গে রাত্রি জেগেই থাকি, ঘুমোই না।
এটি এক অসাধারণ পদ। প্রেম কতদূর পৌঁছে গেলে তবে একজন মানুষ এতখানি শারীরিক কষ্ট স্বীকার করেন হাসিমুখে, তা কি আমরা বুঝতে পারছি? মীরার সখীরা স্বামীসুখে জীবন কাটিয়েছেন, তাঁরা স্বামী—সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তাঁদের পাশাপাশি মীরা বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও কখনও স্বামী সংসর্গ লাভ করতে সামান্যতম ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। আমাদের মনে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, মীরা কীভাবে তাঁর এইসব প্রবৃত্তিকে জয় করেছিলেন? যাঁরা বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেন, তাঁরা হয়তো এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে দিশাগ্রস্ত হবেন। আর যাঁরা অধ্যাত্ম পথের পথিক, তাঁরা জানেন কোনও কোনও মানুষের জীবনে এমন অবস্থা আসে, যখন এই সব বিষয়গুলির প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ থাকে না। এ হল দেহ এবং আত্মার এক বর্ণনাতীত অবস্থা। একে শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।
মীরা বলছেন—
”তুন নৈনন মেরা সাহিববসতা
ডরতী পালক ন নাউরী।।”
—আমার স্বামী আমার নয়নে বাস করেন। পলক ফেললে পাছে তাঁকে আর দেখতে না পাই, সেই ভয়ে চোখ বুজি না আমি। জেগেই থাকি।
এই জাতীয় পদের ধ্বনি—প্রতিধ্বনি শোনা যায় বৈষ্ণব সাহিত্যে। বৈষ্ণব কাব্যের কবিরাও কৃষ্ণের সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন। তাঁদের কাছেও কৃষ্ণ বুঝি এক চিরচঞ্চলা সত্তা। সামান্যতম অবহেলা দেখলে কৃষ্ণ আর কখনও ফিরে আসবেন না।
এইভাবেই মীরা বারবার বিরহ—অনলে জর্জরিত হয়েছেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর প্রিয়তমের কাছ থেকে মন সরাতে পারেননি।
মীরার এই প্রেম আমরা বিদ্যাপতি রচনায় দেখেছি। বিদ্যাপতি যখন বলেন—
”অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব কি করিব বারিদমেহে।
ইহ নব যৌবন বিরহে গোঁয়ায়ব কি করব সো পিয়া গেহে।।”
তখন আমরা বুঝতে পারি যে, প্রেমিকসত্তা কীভাবে অধ্যাত্ম সত্তার দ্বারা পরিপ্লাবিত হয়।
মহাত্মা শেখর কবি গেয়েছেন—
”সজনি দূর ও পরসঙ্গ।
পহিলাহি উপাজিতে, প্রেমক অঙ্কুর
দারুণ বিহি দিল ভঙ্গ।।”
এখানেও ঈশ্বরকে প্রেমিক রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই কবিতার মধ্যে যে অঙ্কুরের কথা বলা হয়েছে, তাকে আমরা প্রেমাঙ্কুর বলতে পারি। এটি হল শ্রীমতী বিনোদিনীর অনুরাগের পূর্বরাগ। শ্রীরূপ গোস্বামী একে বলেছেন মাঞ্জিষ্ঠ রাগ। ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থে এই রাগের কথা বলা হয়েছে এইভাবে—
”অহার্য্যো নাস্য সাপেক্ষে যঃ কান্ত্যা বর্দ্ধতেসদা।
ভবেন্মাঞ্জিষ্ঠ রাগো, সৌ রাধামাধবয়ো র্যথা।।”
—যে রাগ কোনও প্রকারেই নষ্ট হয় না, অন্যকে অপেক্ষা করে না, নিরন্তর স্বীয় কান্তি দ্বারা বুদ্ধিশীল থাকে, তাকেই মাঞ্জিষ্ঠ রাগ বলে। এই মাঞ্জিষ্ঠ রাগের মধ্যে আছে, এক রক্তিম বর্ণ, যাকে আমরা কোনওভাবেই বিধৌত করতে পারি না। এই রাগকে অন্য কোনওভাবে পরিস্ফুটিত করা যায় না। এই রাগ স্থায়ী। এ অন্য কারও ওপর নির্ভর করে না।
শ্রীমতী বিনোদিনী সখীকে বলছেন—সখি, বালিকা বয়সে ভালো ছিলাম, সরল, অবলা এবং ব্রজবালা। বিরহ—জ্বালা কি, তা বুঝতাম না। অনুরাগ কি, তা বুঝতাম না। বঁধূকে আমি চিনতাম না, বধূঁও আমাকে চিনতেন না। কিন্তু সই—”মা মনে আপনা খাইলু/কৈন বা যমুনা গেলু।।” সত্যিই তো, যদি যমুনাতে না যেতেন, তাহলে কি কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর দেখা হতো? তাহলে কি প্রতি মুহূর্তে এমন উৎকন্ঠিতা চিত্তে সময় কাটাতে হতো? মাঝে মাঝে পুড়তে হতো বিরহের অনলের জ্বালায়?
শ্রীরাধা তাঁর মনের এই অবস্থার কথা স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন—”সই, কী ক্ষণে বৃন্দাবনে বঁধূর সঙ্গে দেখা হল। শয়নে—স্বপনে দেখি কালা। বঁধূ আমাকে দেখলেন। প্রথম দর্শনেই কেউ কোনও কথা বলিনি। নয়নের সাথে নয়ন মিলে গিয়েছিল। চারটি নয়নে একত্র সম্মিলন হওয়া মাত্র উভয়ের হৃদয়ে রাগ—অনুরাগের উদয় হল। সেখান থেকে ঘরে এলাম, কিন্তু কানু বঁধূর অনুরাগ ভুলতে পারলাম না।” শেষ পর্যন্ত কি হল? ”অনুদিন বাঢ়ল অবধি না গেল।”
এই প্রেম নিত্যনতুন রূপে নিজেকে প্রকাশ করেছে। এই প্রেমের ভেতর রতি, অনুরাগ, ভাব প্রভৃতি অঙ্গ নেই।
তাই এ হল অনঙ্গ। প্রেম বা পিরিতির নাম অনঙ্গ কেন হল, ঠাকুর চণ্ডীদাস তা মীমাংসা করেছেন এইভাবে—
(প্রশ্ন) ”শুন সহচরী না কর চাতুরী
সহজে দেহ উত্তর।
কি জাতি মূরতি কানুর পিরিতি
কোথায় তাহার ঘর।।
(উত্তর) সখী কহে সার দেখিনি রাকার
স্বরূপ কহিবে কে।
অনুরাগ ছরী বৈসে মনোপরি
জাতির বাহির সে।।”
এই প্রেমকেই শ্রীভাগবত অনঙ্গ হিসাবে ঘোষণা করেছে। এই অনঙ্গলীলা যেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই বৃন্দাবন তাই মীরাবাঈকে অমোঘ আকর্ষণে ডাক দিয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর ‘বংশীশিক্ষা’ শীর্ষক গ্রন্থে এই বিষয়টি নিজের মতো করে তুলে ধরেছেন। আমরা জানি শ্রীচৈতন্যদেব রাধিকা হয়ে কৃষ্ণের ভজন করেছিলেন। তাঁর মধ্যে স্ত্রীসুলভ অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনিই অনুভব করেছিলেন যে, এই প্রেমকে আমরা পার্থিব প্রেম নামে অভিহিত করব না, এই প্রেমের মধ্যে এমন এক অপার্থিবতা লুকিয়ে আছে, যার ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। তিনি বলেছেন—
”প্রকৃতি অতীত অতি ধবল বরণ।
সহস্র পত্রক পদ্মাকার অপরূপ।
শ্রীগোকুল ধাম নিত্য একই স্বরূপ।।
শ্রীগোকুল বৃন্দাবন শ্রীব্রজমণ্ডল।
একই স্বরূপ হয় জানিবে সকল।।
তাহে ভক্তি যমুনার শ্রদ্ধারূপ তীরে।
প্রেমকল্প বৃক্ষতলে শ্রীভাবমন্দিরে।।
রতন সিংহাসনোপরি চিন্তাসন সাজে।
তদুপরি অত্যাশ্চর্য্য কমল বিরাজে।।
রসের কমল সেই রাগের বরণ।
তার কর্ণিকারে রহে পুরুষ রতন।।
সেই যে পুরুষরত্নে কহি রসভূপ।
হ্লাদিনী সহিত সদা একাত্মস্বরূপ।।
তার মধ্যে অবিচিন্ত্য নিত্যবৃন্দাবন।
যাহার স্বরূপ আগে করেছি বর্ণন।।
হ্লাদিনীর বৃত্তিরূপা অষ্টসখী যাঁরা।
অষ্টদলে রাই রসরাজে সেবে তাঁরা।”
মীরার ক্ষেত্রেও এই জাতীয় অনঙ্গ প্রেমের প্রকাশ দেখা যায়। যেহেতু মীরা তাঁর ঈশ্বরকে কখনও প্রেমিক, কখনও অভিভাবক এবং কখনও বন্ধু হিসাবে কল্পনা করেছেন, তাই তাঁর প্রেমে এই ত্রিবিধ ধারা প্রবাহিত হয়েছে। প্রত্যেকটি ধারাকে অনুসরণ করে তিনি এক—একটি অসাধারণ পদ রচনা করেছেন। এই পদগুলি পড়লে আমরা মীরার সাধন—ভজনের অর্থ খুঁজে পাই।
শ্রীচণ্ডীদাস বলেছেন—
”ভুবন ছানিয়া যতন করিয়া
আঁনিলু প্রেমের বীজ।
রোপন করিতে গাছ যে হইল
সাধিল মরণ নিজ।।
সই প্রেমতরু কেন হইল।
হাম অভাগিনী দিবস রজনী
সিঁচিতে জনম গেল।।”
এইভাবেই তিনি তাঁর প্রিয়তমের বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনায় যে সব শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে তা শুনলে আমরা অবাক হয়ে যাই। প্রকৃতি তন্ময়তা এবং ভগবত তন্ময়তা কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মীরাও তাঁর একাধিক পদে এভাবে ঈশ্বরকে আরাধনা করেছেন। তাঁর শব্দ নির্বাচন ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। মনের কোনও একটি ভাব প্রকাশ করতে হলে কী ধরনের শব্দ প্রয়োগ করা দরকার, মীরা তা ভালোভাবে জানতেন। তাই তাঁর লেখা পদগুলি আজও আমরা পরম শ্রদ্ধাসহকারে পাঠ করে থাকি। এই পদগুলি পড়লে আমরা বুঝতে পারব যে, কীভাবে তিনি তাঁর ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে মীরা একটি পদে বলেছেন যে, ”ঈশ্বর তাঁর নয়নে বাস করেন,” সেই পদটির মাধ্যমে তিনি তাঁর আত্মনিবেদনকে এক ঐশ্বরিক মহিমায় মহিমান্বিত করেছেন।
এই প্রসঙ্গে আমরা বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ শ্যামাসঙ্গীতের কথা আলোচনা করব। শ্যামাসঙ্গীতের মাধ্যমে পদ রচয়িতারা নিজের সঙ্গে শ্যামা মায়ের একাত্মতা অনুভব করতেন। মীরা যেভাবে তাঁর প্রেমিক নন্দলালার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, কালীসাধকেরা ঠিক সেইভাবেই শ্যামা মায়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতেন। তবে মীরার ক্ষেত্রে প্রেম অধিকতর অঞ্চল জুড়ে ব্যাপৃত ছিল, শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতাদের ক্ষেত্রে সেখানে এসেছে মাতৃত্ববোধ এবং বাৎসল্যরস। ভিন্ন পথের পথিক হয়েও তাঁরা বোধহয় একইরকম উপমা ব্যবহার করেছেন। একটি শ্যামাসঙ্গীতে আছে—
”আমি ওই ভয়ে মুদিনে আঁখি
নয়ন মুদিলে পাছে তারা হারা হ’য়ে থাকি।।
একদিন ঘুমায়েছিলাম,
স্বপ্নে তারা হারাইলাম,
আমি ওই ভয়ে মা তারা তোমায় নয়নে নয়নে রাখি।”
ব্যক্তিগত জীবনে মীরা ছিলেন সহজ সরল নির্লোভ প্রকৃতির। এ ছিল তাঁর আজন্ম সংস্কার। তিনি জানতেন যে, ঈশ্বরকে অনুভব করতে হলে কাম, মোহ, মায়া, মাৎস্যর্য প্রভৃতি ত্যাগ করতে হবে। এইসব বিষয়গুলি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না করলে তিনি ঈশ্বরকে দর্শন করতে পারবেন না। এজন্য মীরা এইসব সংস্কার পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি অষ্টপাশ মুক্ত হয়েছিলেন। তাই বোধহয় শেষ জীবনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেন। তাই তিনি অনায়াসে বলেছেন—
”লাজ সরম কুলকী মরজাদা, সীর সে দূর করী
মান অপমান দোউ ঘর পটকে, নিবসী হুঁ জ্ঞান গলী।।”
—আমি ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য আমার লজ্জা—শরম ও কুল—মর্যাদা মাথা থেকে দূর করে ফেলে দিয়েছি। মান—অপমানকে ত্যাগ করে আমি এখন জ্ঞানপথে বাস করছি।
মীরার অধ্যাত্ম জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করতে হলে তাঁর সাধন—প্রণালীর খুঁটিনাটি বিষয় জেনে রাখা দরকার। মীরা সদগুরুর উপদেশ নিয়ে এই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। সাধু রৈদাসের কাছ থেকে তিনি বারবার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তখন শুরু হয় আন্তর সাধন। অনেকে বলে থাকেন, মীরা যদি এত বড়ো সাধিকা হয়ে থাকেন, তাহলে কেন সংসার জীবন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেননি? কেন এর জন্য তাঁকে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল। এর উত্তর পেতে হলে তাঁর গুরু রৈদাসের সাধন প্রণালীর কথাও জেনে রাখা দরকার। রৈদাস এবং কবীর ছিলেন রামানন্দের শিষ্য। তাই তাঁদের দু’জনের সাধন প্রণালী একই হবে। কবীরের সাধনধারা কবীর পন্থা পুস্তকে পাওয়া যায়। এই জন্য আমরা বলে থাকি যে, কবীরও ছোটো ছোটো পদের মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করার চেষ্টা করেছিলেন।
এই সাধনপথেও বেশ কয়েকটি সোপান বা ধারা আছে। প্রথম পর্যায়ে সাধিকা নিজের দেহের আত্মদর্শন করেন। তখন তাঁর মন অপূর্ব আনন্দরসে পরিপ্লাবিত হয়। পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর সব কিছুকে বড়ো বেশি অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়। আবার যখন ওই সাধক—সাধিকা ওই অবস্থায় পৌঁছে যান, তখন ঈশ্বরসান্নিধ্য বিনা নিজেকে বড়ো অসহায় বলে মনে হয়। মীরার ক্ষেত্রে তাই—ই হয়েছিল। সদা সর্বদা তিনি আত্মরতিতে মগ্ন থাকতেন। এই আত্ম—আনন্দের সঙ্গে ইন্দ্রিয় সুখের কোনও সম্পর্ক নেই। মনে হতো তিনি বোধহয় সমাধিমগ্নাবস্থায় সময় কাটাচ্ছেন। পার্থিব জ্ঞানশূন্য হয়ে এমন এক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন, যেখানে প্রবেশ করতে হলে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। মীরা বিরহ অনলে নিজেকে পুড়িয়েছেন। সাধনার চরমসীমায় পৌঁছে তিনি অখণ্ড ব্রহ্মত্ব লাভ করেছিলেন। সেই মুহূর্তে তাঁর বিরহের অবসান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক কোন সময় তিনি এই অবস্থায় পৌঁছে ছিলেন? মীরার জীবনীকাররা বলে থাকেন, জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে রঞ্ছোড়জির মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বোধহয় তাঁর দেবতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। এর জন্য তাঁকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিল। সারা জীবন ধরে অসংখ্য পদ রচনা করে তিনি তাঁর অধ্যাত্ম সাধনার পথটিকে প্রশস্ত করেছিলেন। তাই অনন্ত আনন্দ লাভ করে মীরা বলেছিলেন—
”মেরে পিয় মোমাহিঁ বসত হৈ
কহুঁ ন আতি জাতী।।”
—আমার প্রিয়তম সর্বদাই আমার মধ্যে বিরাজ করছেন। তিনি কখনও আসেন না। কখনও আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যান না। আমার বিরহের অবসর কোথায়?
অর্থাৎ তিনি তাঁর প্রিয়তমের সাথে এক চিরবন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। এখানে সামান্যতম অদর্শন ছিল না। মানুষের মন, শরীর, কোষ, আত্মা কোন পর্যায়ে পৌঁছোলে তবেই আমাদের মনের মধ্যে এমন ভাবনার উদ্রেক হয়, আমরা হয়তো তা অনুভব করতে পারি।
মীরার সাধন নানা পর্বে বিভক্ত। প্রথমে তিনি তাঁর প্রিয় গিরিধারীলালকে এক দেবতা হিসাবে ভজনা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন তাঁর মধ্যে আত্মজ্ঞান এসেছিল, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই নন্দলালা শুধু পাথরের মূর্তিতে নিজেকে বন্দী রাখেননি, তাঁর মাথায় মুকুট, তাঁর পীতাম্বর বস্ত্র, তিনি সারা পৃথিবীতে নিজের পরিব্যাপ্তিকে বিস্তৃত করেছেন। তখন মনে হতো, এই নন্দলালা বুঝি পূর্ণব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জগৎময় তিনি ছড়িয়ে আছেন। এই প্রসঙ্গে মীরা বলেছেন—”তুম্ প্রভু পূরণ ব্রহ্ম হো।”
যে কোনও সাধক—সাধিকা নিজেকে এই পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেন না। যাঁরা পারেন তাঁরা সত্যি সত্যি আমাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পেয়ে থাকেন। মীরার সৌভাগ্য, তিনি শেষ পর্যন্ত এই ধারণাকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। ঠিক এই অবস্থা হয়েছিল সাধক কবি রামপ্রসাদের। সাধনার প্রথম পর্বে তিনি ‘চতুর্ভুজা’, ‘কালোবরণী’, ‘সমররঙ্গিনী’ শ্যামা মায়ের পরিচ্ছন্ন মুখটিকে আশ্রয় করে সাধনা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে স্মরণযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যায়। সদগুরুর উপদেশে তিনি সাধনপ্রাপ্ত হলেন। সাধনার চরম অবস্থায় পৌঁছে যখন রামপ্রসাদ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর উপাস্যা কালী আসলে ‘ব্রহ্মব্রহ্ময়ী ছবি’। তাই মীরার মতো তিনিও গেয়েছেন—”ব্রহ্মময়ী মা আমার”, অথবা ”তারা আমার নিরাকারা।”
এইভাবেই একটি মূর্তি শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্তি লাভ করেছে। রামপ্রসাদ যেমন তাঁর লেখা অসংখ্য সঙ্গীতের মাধ্যমে তাঁর সাধনতত্ত্বের গূঢ় বিষয়টি সহজ সরলভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, মীরাবাঈ ঠিক সেইভাবে তাঁর সাধনার এক—একটি সোপান বা পর্বকে এক—একটি পদের মাধ্যমে বিবৃত করেছেন। তাঁর পদগুলি পাশাপাশি রেখে প্রণিধান সহকারে পাঠ করলে এবং বিশ্লেষণ করলে আমরা তাঁর মনোগত পরিবর্তনকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি। যেমন মীরা লিখেছেন—
”চলো মন আগম কে দেস, কাল দেখতে ডরে
রহ ভণা প্রেম কা হৌজ হংস কেলী করে।।”
—হে মন, তুমি সেই অগম্য দেশে চলো, যমও সেই দেশের দিকে দৃষ্টিপাত করতে ভয় পায়। সেখানে প্রেম সরোবরে হংস নিয়তই ক্রীড়া করছে।
এই পদের মাধ্যমে তিনি প্রেমকে মৃত্যুঞ্জয়ী আখ্যা দিয়েছেন। এ হল এমন এক প্রেমময় দেশ যেখানে মৃত্যুর অধিপতি যম পর্যন্ত আসতে পারে না। অর্থাৎ সেই প্রেম আমাদের অনন্ত জীবনের সন্ধানে নিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হল, আমরা কীভাবে সেই প্রেমের পথ আবিষ্কার করব এবং কীভাবে সেই প্রেমসাগরে নিজেদের নিমজ্জিত রাখব? এ বড়ো কঠিন প্রশ্ন। এর উত্তর দেওয়া খুব একটা সহজ নয়।
মীরা যোগাভ্যাস দ্বারা সমস্ত স্নায়ুপুঞ্জকে উজ্জীবিত রাখতেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কঠিন তাপসী জীবনযাপন করেছেন। তাঁর মন থেকে সমস্ত ইন্দ্রিয়জনিত সুখ—স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়েছেন। তাই তো মীরা লিখেছেন—
”সীল সন্তোষ ধরূঁ ঘট ভীতর
সমতা পাকড় রহুঁগী হো।
জাকো নাম নিরঞ্জন কহিয়ে
তাঁকো ধ্যান ধরূঁগী হো।।
………………………………………..
মীরা কহে প্রভু গিরিধর নাগর
সাঁধা সংগ রহুঁগী হো।।”
—আমি আমার দেহের ভেতর শীল ও সন্তোষ ধারণ করব। সমতাকে ধরে রাখব। লোকে যাঁকে নিরঞ্জন বলে, আমি তাঁর ধ্যান করব। মীরা বলে, আমি আমার প্রভু গিরিধারী নাগর এবং সাধুদের সঙ্গে থাকব।
আমরা দেখেছি, শ্রীরামচন্দ্রকে বিশিষ্ট সাধক বশিষ্ঠদেব এই উপদেশ দিয়েছেন। বশিষ্ঠদেব বলেছেন—
”মোক্ষদ্বারে দ্বারপালাশ্চত্বারঃ পরিকীর্ত্তিতাঃ।
শমো বিচারঃ সন্তোষশ্চতুর্থঃ সাধুসঙ্গম।।”
যুগে—যুগান্তরে ভারতীয় সাধক—সাধিকারা একই পথের পথিক স্বরূপ বিরাজ করেছেন। তবে কাল পরিবর্তনের ফলে তাঁদের সাধনপ্রণালীর মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এসে গেছে। কিন্তু তাঁদের কেউই সাধনার এই বিশেষ ধারা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। এটি বোধহয় ভারতের অধ্যাত্ম সাধনার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
মীরা এক—একটি পদের মাধ্যমে যোগ ও জ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার চেষ্টা করেছেন। মীরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে, যোগসাধনা শুধুমাত্র আমাদের মনকে আরও বেশি ঈশ্বরাভিমুখী করে তোলে তা নয়, আমাদের শারীরিক ক্রিয়াকলাপকেও করে তোলে নিরন্তর প্রবাহী। এইভাবে আমরা মন ও আত্মার চিরক্ষয়িষ্ণুতাকে বজায় রাখতে পারি। তা নাহলে ঈশ্বরকে অনুভব করব কেমন করে?
তিনি ভাব—তন্ময়তার কথা নানাভাবে ও ভাষায় প্রকাশ করেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এই অবস্থায় উপনীত হতে না পারব, ততক্ষণ আমাদের সাধনা সার্থক হবে না। শ্রীচণ্ডীদাস একটি পদের মাধ্যমে এই বিষয়টি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। এই পদটি হল—
ফুলের বৈরী হইল মুরলী
করিল সকল নাশে।
মদন কিরাতি মধুর যুবতী
ধরিতে আইল দেশে।
সই জীব না এমন বাসি।
পিরীতি আঁটা ননদী কাঁটা
পড়শী হইল ফাঁসি।।
বৃন্দাবন মাঝে বেড়ায় সহজে
ধরিতে যুবতী জনা।
যমুনার কুলে গাছের তলে
আসিয়ে করিল থানা।।
গাছের ডালে বসিয়ে ভালে
তাক করে এক দিকে।
জুয়ান আঁটা লাগায় কাঁটা
লাগিল পাখির পিঠে।।
পড়িয়া ভূমিতে ধড়ফড়াইতে
কিরাতে ধরিল পাখে।
পাখে পাখা দিয়া বাঁধিল টানিয়া
ঝুলিতে ভরিয়া রাখে।
চণ্ডীদাস কয় মহাজন হয়
কিনিয়া দেয় পাখি।
ছাড়িয় দেয় পাখায় ধোয়ায়
তবে সে এড়ান দেখি।
মীরাবাঈও তাঁর একাধিক পদে তাঁর চিত্তের এই অবস্থানের কথা আমাদের জানিয়েছেন। তাঁর মধ্যে প্রেম, ভক্তি, বৈরাগ্যের যে ত্রিবিধ সম্মিলন ঘটে গিয়েছিল, সেটি জানতে হলে তাঁর এই পদটি পড়তে হবে।
”সদরিস গোপিন প্রেম প্রকট কলিজু গহিঁ দিখায়ো।
নিরঙ্কুস অতি নিডর রসিক জসরসনা গায়ো।।
দুষ্টন দোষ বিচারি মৃত্যুক্যে উদ্যম কীয়ো।
বার ন বাঁকো ভয়ো গড়ল অমৃত জ্যোঁ পীয়ো।।
ভক্তি নিসান বজায় কে কাঁহুঁ তেঁ নাহী লজী।
লোকলাজ কুল শৃঙ্খলা তজি মীরা গিরিধর ভজী।।”
—তুমি এই কলিযুগে গোপীদের কাছে প্রেম প্রকট করে দেখিয়েছো। তোমার রসনা তোমার প্রেমীর যশ নিরঙ্কুশভাবে নির্ভয় হয়ে গিয়েছে। দুষ্টু লোকে তোমার মধ্যে দোষ খুঁজে তোমাকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা করেছিল। তুমি তাতে বিন্দুমাত্র কম্পিত হওনি। তোমার তাতে কেশাগ্রও স্পর্শিত হয়নি। তুমি অমৃতের মতো সেই বিষ পান করেছো। ভক্তির ডঙ্কা বাজিয়ে কোনও লজ্জা না করে লোকলজ্জা ও কুলবন্ধন ত্যাগ করে মীরা গিরিধারীর ভজনা করে গিয়েছেন।
এই পদটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি যে, মীরা পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর ঘটনাবলী সম্পর্কে কতখানি অজ্ঞ ছিলেন। আসলে তখন তাঁর মন, তনু এবং আত্মা মিশে গিয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। ভক্তিসাধনার একেবারে শেষতম পর্বে গেলে সাধক—সাধিকার মনে এমন একটি ধারণার জন্ম হয়। মীরা জানতেন যে, সদগুরুর আশীর্বাদ আছে তাঁর ওপর। সদগুরুর সান্নিধ্য না থাকলে কেউ সাধনপথের সর্বোচ্চ স্তরে উপস্থিত হতে পারেন না। শাস্ত্র তাই বারবার ‘গুরুরুপায়’ বলেছেন। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে সদ্গুরু লাভ করা সত্ত্বেও সাধক—সাধিকা তাঁর ঈপ্সিত ঈশ্বরের সন্ধান পান না। কারণ তাঁর মধ্যে থাকে আত্মত্যাগ ও আত্মদর্শনের অভাব। মীরা ছিলেন প্রেম ও বৈরাগ্যের সার্থক প্রতিমূর্তি। আবার তাঁর প্রেমসাধনার মধ্যে ছিল একটি ধারাবাহিকতা। তিনি জন্মেছিলেন রাজকন্যা হিসাবে, ইচ্ছে করলে সুখে জীবনযাপন করতে পারতেন। অথচ একেবারে শিশু বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে এমন এক নির্লিপ্তির ছাপ দেখা দিয়েছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অনেকে বলে থাকেন, এ জন্য আমরা মীরার পূর্বজন্মের কৃতিত্বকেই দায়ী করব। জন্ম—জন্মান্তর ধরে মীরা ছিলেন কৃষ্ণ বিরহিনী। গতজন্মে যতটুকু সাধনা করেছেন, তার সুফল নিয়ে মীরা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন। অবশেষে মীরাবাঈ হিসাবেই তিনি বোধহয় তাঁর ঈপ্সিত সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন।
রাজকুলবধূ হয়েও তিনি সমস্ত বিনোদনকে হেলায় ছুঁড়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। রাজকীয় ঐশ্বর্যকে তৃণের মতো পরিত্যাগ করেছেন। তিনি উদাবাঈকে স্পষ্ট বলেছিলেন—”রাজ্যপাট ভোগো তুমহীঁ, হমেঁ ন তাসূঁ কাম।”—তুমি রাজ্য সম্পদ ভোগ করো। আমার তাতে কোনও প্রয়োজন নেই।
সত্যি সত্যি মীরা কিন্তু এই ভাবাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাই তো তিনি অনায়াসে বলতে পারেন—
”ছোড়্যো মেঁ মোত্যো কো হার
গহনো তো পহরো সীল সন্তোষ কো।।”
—আমি মোতির মালা পরিত্যাগ করে এখন শীল ও সন্তোষের মালা ধারণ করেছি।
এটিই হল মীরার সাধন—রহস্যের মূল কথা। এই প্রসঙ্গে আমরা শঙ্করাচার্যের একটি বাণী শ্রবণ করব। শঙ্করাচার্য কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন—কিং ভূষণাদ ভূষণমস্তি, শীলম।”
—যার মধ্যে আত্মজ্ঞান আছে, সে কেন মিথ্যা অলঙ্কারের ওপর নির্ভর করবে।
মীরা ছোটোবেলা থেকেই সাধুসঙ্গ করতে ভালোবাসতেন। তাঁর আন্তরিক বিশ্বাস ছিল, যেহেতু সাধুরা সংসার ত্যাগ করেছেন, তাই তাঁদের মধ্যে এমন এক ঐশী ক্ষমতার জন্ম হয়েছে, যার দ্বারা সাধুরা যে কোনও কাজ অনায়াসে করতে পারেন। জ্ঞানী রৈদাসকে গুরুরূপে পাওয়া মীরার সাধন—জীবনের সবথেকে বড়ো ঘটনা। জ্ঞানী রৈদাস বারবার মীরাকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সেই জন্যই মীরা সাধনার এক—একটি স্তর অতিক্রম করার মতো সাহস অর্জন করেছিলেন। সদ্গুরুর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে মীরা বলেছেন—
”সত গুরু মুকর দিখয়া ঘটকা।”
—সদগুরু আমাকে আমার দেহের ভেতরের আয়না দেখিয়ে দিয়েছেন, এখন সেই আয়নাতে আমার মুখচ্ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে। আর সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আমি আমার নিজস্ব আমিকে চিহ্নিত করতে পারছি।
এটি হল সদগুরুর কাজ। তিনি এইভাবেই সাধক—সাধিকার মনের মন্দিরে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। সেই প্রদীপ শিখা অনির্বাণ জ্বলতে থাকে। এখানে আর একটি বিষয়ের অবতারণা করা উচিত। যখন মীরাবাঈ ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন ভারতবর্ষে জাতপাতের প্রভেদ ছিল। বিশেষ করে রাজপুতানায় এই বিষয়টি ছিল অত্যন্ত প্রকট। রৈদাস জন্মসূত্রে চামার হওয়া সত্ত্বেও রাজকুলবধূ মীরা কিন্তু অনায়াসে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে, গুরু জাত—কুল ইত্যাদি কোনও কিছুকে মানে না। জ্ঞানই গুরুর জাতি, আবার জ্ঞানই গুরুর কুল। তাই দেখা যায় যে, ভারতেও একাধিকবার এমন ঘটনা ঘটে গেছে।
ভারতীয় দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রে এই ঘটনাগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ”গুরুং ব্রহ্মবিদং ব্রজেৎ”, অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ করার জন্য ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর শরণাপন্ন হতে হবে। আত্মজ্ঞানী গুরু হলেন সদগুরু। রৈদাসের মধ্যে এক আত্মজ্ঞানী পুরুষ বাস করতেন। তাই মীরা তাঁকে অনায়াসে গুরু হিসাবে স্বীকার করেছিলেন।
যখন আমাদের মনে বৈরাগ্যের উদয় হয়, যখন আমরা ঈশ্বর—সান্নিধ্য লাভের জন্য সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠি, তখন ঈশ্বরের আশীর্বাদেই বোধ হয় এমন একজন পথপ্রদর্শক আমাদের কাছে আসেন। মীরাও খুব সহজে জ্ঞানী রৈদাসের সাক্ষাৎ পাননি। পথে প্রান্তরে ঘুরে অনেক গুরুর সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছেন। শেষ পর্যন্ত জ্ঞানী সাধু রৈদাসের সঙ্গ লাভ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মীরা একটি পদে তাঁর গুরু—অন্বেষণের কথা পরিষ্কারভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। মীরা লিখেছেন—
”ঐসা বৈদ মিলৈ কোঈ ভেদী, দেস বিদেস পিছানী
খোজত ফিরোঁ ভেদ বা ঘরকো, কোঈ ন করত বখানী
রৈদাস সন্ত মিলে মোহিঁ সতগুরু, দীন্হা সুরত সহদানী।।”
—আমি দেশ—বিদেশে জিজ্ঞাসা করেছি, এমন কোনও বৈদ্য কি আছেন, যিনি আত্মতত্ত্ব জানেন, তার ফলের সন্ধান জানার জন্য আমি পথে—প্রান্তরে অনেক ঘুরেছি। কিন্তু কেউ সন্ধান দিতে পারেননি। অবশেষে ভাগ্য গুণে আমি সাধু রৈদাসকে গুরু রূপে পেলাম। তিনি আমাকে স্বরূপ জ্ঞান দিয়েছেন।
এই গুরু রৈদাস মীরাকে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করেন। মীরা কোন পথের সাধিকা তা অনুধাবন করে তিনি মীরার মন এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছিলেন।
মীরা বলছেন, ”গুরু আমাকে একটি বিশেষ শব্দ লক্ষ্য করিয়ে দিলেন। কী আশ্চর্য, আমার মনে হল এতদিন পর্যন্ত আমি নিদ্রার মধ্যে দিন কাটিয়েছি। আলস্য এসে আমাকে আক্রমণ করেছিল। অমি এখন সেই শব্দ শুনে জেগে উঠেছি। গুরুদত্ত সেই শব্দের অভ্যাস করতে করতে আমার মধ্যে এক ধরনের আত্মপ্রতীতির জন্ম হয়েছে।”
সেই শব্দটি কি? মীরা তার ঈঙ্গিত তাঁর কোনও কোনও পদে দিয়েছেন। সদগুরুর উপদেশ প্রাপ্ত না হল কেউ ওই শব্দটির আসল অর্থ অনুধাবন করতে পারেন না। শুধু তাই নয়, এই শব্দটি বারবার উচ্চারণের মাধ্যমে শরীর এবং মনের কি পরিবর্তন সাধিত হয়, তাও মীরাবাঈ অনুসন্ধানের দ্বারা জানতে পেরেছিলেন। সদগুরুর অনুগ্রহে তিনি আত্মগ্লানি থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। চরম আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন শেষ পর্যন্ত। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে মহাপ্রকৃতির যে লীলা চলেছে, তিনি তার খণ্ডাতিখণ্ড অংশ মাত্র। জীবনে তাঁকে অনেক জ্বালা—যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর চরিত্রে অনেকে কলঙ্ক লেপন করার চেষ্টা করেছেন, তাঁকে হত্যা করার জন্য নানা জঘন্য ষড়যন্ত্র রচিত হয়। অথচ নন্দলালের কৃপায় তিনি কিন্তু কোনওভাবেই মৃত্যুর কাছে হার মানেননি। শেষ পর্যন্ত তাঁর শত্রুরা তাঁর কাছে পরাভব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এটাই বোধহয় মীরার সাধন—রহস্যের সবথেকে বড়ো কথা। একজন সাধক বা সাধিকা তাঁর ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা এমন শক্তির অধিকারী বা অধিকারিণী হয়ে ওঠেন যে, শক্তিশালী শত্রুপক্ষও শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। মীরার ক্ষেত্রেও ঠিক এমন ঘটনাই ঘটে গিয়েছিল। আর এভাবেই তিনি তাঁর সাধনমার্গে অবিচল চিত্তে অগ্রসর হবার মতো সাহস অর্জন করতে পেরেছিলেন।
মীরাবাঈ অনেক অনেকদিন আগে ধরাধাম পরিত্যাগ করে চলে গেছেন। কিন্তু আজও আমরা পরম আগ্রহ সহকারে তাঁর অধ্যাত্ম জীবনের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করি। এটাই বোধহয় মীরাবাঈয়ের সবথেকে বড়ো সার্থকতা।