মিলির হাতে স্টেনগান

মিলির হাতে স্টেনগান

‘ও মা এখনো দাঁড়িয়ে আছিস!’

এর পরও মিলি দাঁড়িয়ে রইলো। জানলা বন্ধ করার জন্যে অনেকক্ষণ থেকে তার ডান হাত জানলার বাঁদিকের পাল্লায় রাখা, আরেকটা হাত জানলার শিকে। দুটো হাতই ভিজে যাচ্ছে, পানির ঝাপ্টা এসে পড়ছে চুলে ও মুখে। সামনের রাস্তা, রাস্তার ওপাশে ল্যাম্পোস্ট ও তার পাশে ঝাপ-ফেলা পানের দোকান এবং গলির নালা ও পানির মিলিত গন্ধ এই কড়া, এই হালকা। স্পষ্ট শোনা যায় কেবল আব্বাস পাগলার ধমক। আকাশের দিকে তাকিয়ে আব্বাস পাগলা একনাগাড়ে চিৎকার করে, তার চিৎকার তেপান্তরের মাঠে ঝিঝি পোকার একটানা আওয়াজের সঙ্গতে ডাকাতের হাতে-পড়া পথিকের আর্তনাদের মতো কড়াৎ করে বাজে। মিলির মা মনোয়ারা হ্যাঁচকা টানে জানলা বন্ধ করে। জানলার পাশে বিছানায় বালিশ ভিজে গেছে, বালিশের অড় খুলে মনোয়ারা মশারি টাঙাবার দড়িতে ঝুলিয়ে দেয়। জানলার তাকে বি. এস. সি. ক্লাসের কেমিস্ট্রি বইয়ের ধুলোপড়া মলাটে পানির থ্যাতলানো ফোঁটা। হাল্কা নীল রঙের শাড়ির আঁচল দিয়ে বই মুছতে মুছতে মনোয়ারা বলে, ‘কখন থেকে বলছি জানলা বন্ধ কর, জানলা বন্ধ কর! রানা আসুক, মজাটা বুঝবি!’ মিলি খুব মনোযোগ দিয়ে আব্বাস পাগলার একটানা ধ্বনিকে শব্দে ভাগ করার চেষ্টা করে। রানাকে তার ভয় পাবার কিছু নাই, এইসব ফিজিক্স কেমিস্ট্রির জন্যে রানার বয়েই গেলো!

ভেতরের বারান্দা থেকে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলো মিলির বড়ো ভাই, এরই নাম রানা। ঢুকেই বললো, ‘চিরুনিটা দেখি।’

‘টেবিলে দেখো!’

ঘরের একমাত্র টেবিলে রাজ্যের জিনিস। এক পাশে ক্লাস এইটের বইপত্র, মিলির ছোটোবোন লিলি বছর দুয়েক ধরে ঐ ক্লাসেই পড়ছে; বইপত্রের পাশে আয়না, চিরুনি, পাউডার কেস, স্নোর কৌটা, তেলের বোতল, সেফটিপিন, শ্যাম্পুর বোতল। গতকাল পর্যন্ত অনেক আগে শেষ শ্যাম্পুর খালি বোতল এবং স্নোর খালি কৌটাও ছিলো। রানা আজকাল এইসব ফালতু জিনিস দেখতে পারে না বলে মনোয়ারা ওগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। তবে টেবল কখনো এলোমেলো থাকে না, মনোয়ারা বা লিলি যে যখন আসছে একবার গুছিয়ে রেখে যাচ্ছে। সুতরাং এক সেকেন্ডে চিরুনি পাওয়া যায়। ক্লাস এইটের মলাট-লাগানো বইয়ের স্তূপে আয়না ঠেকিয়ে তক্তপোষে বসে রানা ধীরেসুস্থে চুল আঁচড়ায়। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে মনোয়ারা মিলিকে ডাকে, হাতে হাতে কাপ পিরিচগুলো ধুয়ে ফেল তো।’

‘আসি আম্মা!’ কিন্তু মিলি ফের জানলা একটুখানি ফাঁক করে দাঁড়ালো। বৃষ্টি বেশ চেপে এসেছে। পানির ঠাসবুনুনি ধারার তোড়ে আব্বাস পাগলার মুখ কান নাক মাথা আলাদা হতে পারে না। ওর বলকানো ছাদে রিবাউণ্ড হয়ে বৃষ্টির মোটা ধারা মিহি হয়ে সাদা ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাবার জবাবে আব্বাস পাগলা গর্জন করে উঠলে তার মস্ত হাঁ মশালের আলোয় উদ্ভাসিত পাহাড়ের গুহার মতো প্রতিধ্বনিময় হয়ে ওঠে। সেই বিদ্যুৎ ফের আকাশের মুখে থুতুর মতো ছুঁড়ে দিতে দিতে সে যা বলে কিছু ঠাহর করা যায় না। আরেকটু মনোযোগ দিলে বোঝা যাবে এই ভরসায় মিলি একটু গুছিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আব্বাস পাগলার শব্দ চাপা পড়ে রানার কথায়, ‘মিলি, চা দে।’

মিলি বিরক্ত হয়, ‘এইতো সবাই চা খেলো। চা খাওয়ার সময় তুমি রোজ থাকো কোথায়?’

ভেতর থেকে আম্মা ডাকে, ‘মিলি, রানার চা নিয়ে যা।’

চায়ের পেয়ালার পিরিচে ঝোলা গুড় মাখানো দুটো টোস্ট বিস্কিট। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে টোস্ট শুদ্ধ পিরিচ রানা ফিরিয়ে দিলো।

‘খাবে না?’

নাক কুঁচকে রানা বললো, ‘এসব খাওয়া যায়?’

মিলির কিন্তু খুব খেতে ইচ্ছা করে। বিকালবেলা চায়ের সঙ্গে কিছু থাকে না। রানার জন্যে আম্মা কোত্থেকে কি বার করে দেয়। গুড়-মাখানো টোস্টে কামড় দিতে দিতে ফের জানলা খুলতে গেলে রানা বলে, ‘খুলিস না।’

‘বৃষ্টি কমে গেছে, খুলে দিই?’

‘না থাক।’

‘গরম লাগছে তো।’

‘আঃ!’ রানা ধমক দেয়, ঐ পাগলা শালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। জানলার দিকে পিঠ ফিরিয়ে রানা বালিশে ঠেস দিয়ে বসলো, শালা চেচায় কী! ইনটলারেবল বাস্টার্ড। মিলি তখন বন্ধ জানলা থেকে রান্নাঘরে চলে যায়। রানার কথা আর শেষ হয় না, ‘কাল ইভনিংটা পয়েল করে দিলো। তারপর জোর দিয়ে সংকল্প জানায়, ‘আজ আসুক শালা! ঘাড় ধরে বের করে দেবো।’

কিন্তু বের করে দেওয়া কি এতো সোজা? কাল সন্ধ্যায় সোহেল না সিডনি না ফয়সল কি নাম, ফর্সা–রোগা ছেলেটা,- বলছিলো, ছেলেটা,-বলছিলো, ‘দেখো, এসব লোক দেখতে পাগল পাগল হলে কী হবে, এই বেটাদের সঙ্গে একটু রেসপেকট করে কথা বলা ভালো। কার ভেতর কী পাওয়ার আছে কে বলতে পারে। রিস্ক নিয়ে লাভ কি? কেয়ারফুল থাকাই ভালো। ছেলেটা কিন্তু নিজেই একটু অসাবধান টাইপের; বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে টেলিভিশনের জন্য প্লাগ পয়েন্ট লাগাচ্ছিলো, বাঁদিকে ঝোঁকটা এমন ছিলো যে একটু এদিক-ওদিক হলেই পড়ে যেতো। রানারা পঞ্চপাণ্ডবের চারজন মিলে বিকালবেলা কোত্থেকে একটা টেলিভিশন নিয়ে আসে, সেটা চালু করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।

এদিকে রানার ঘর মানে ওর বাবারও ঘর। ছেলে সেখানে সবান্ধব টেলিভিশন ফিট করায় ব্যস্ত। বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সরু গলিতে ঘোলা সূর্যাস্ত দেখা ছাড়া আশরাফ আলীর আর কোনো কাজ থাকে না। আবার বারান্দায় এসে জুটেছিলো আব্বাস পাগলা। তাই নিসর্গে সম্পূর্ণ মগ্ন হওয়া আশরাফ আলীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না, কারণ আব্বাস পাগলার তক্ষুনি একটা স্টেনগান দরকার। রানাকে বলে দশটা না পাঁচটা না, একটা স্টেনগান জোগাড় করে দেওয়ার জন্য আশরাফ আলীকে সে খুব বিনীত অনুরোধ জানায়। দুটো তিনটে বিনীত বাক্য প্রয়োগের পর তার গলা চড়ে গেলে মগরেবের নামাজ পড়তে আশরাফ আলী ভেতরে ঢোকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রানাদের মধ্যে প্রবেশ ঘটলো আব্বাস পাগলার।

সোহেল না সিডনি না ফয়সল,–ফর্সা-রোগাটা বাঁদিকে ডানদিকে সমান ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আব্বাস পাগলাকে সম্মান জানায়। তার দেখাদেখি রানা এবং আরেকজন— সোহেল না সিডনি না ফয়সল—এটা অবশ্য কালো-লম্বা-সেও দাড়ায়। বাকি রইলো একজন। এর একটি গাড়ি আছে বলে তবু একে একটু আলাদা করা যায়। তো এই সর্বশেষ যুবকটি,–সোহেল না সিডনি না ফয়সল –নাম তিনটে এই তিনজনেরই, কিন্তু মিলির কাছে এদের সবাইকে একই রকম মনে হয়, আরেকজন বন্ধু আছে, সে আজ আসে নি, এমন হতে পারে যে এই তিনটে নামের মধ্যে তার নামটিও রয়ে গেছে, সেদিক থেকে বিবেচনা করলেও সুনির্দিষ্ট নামে এদের একেকজনকে সনাক্ত না করাই ভালো, সেও বসে থাকা অবস্থাতেই একটু সোজা কিম্বা একটু বাঁকা হলো। কিন্তু এতো লোকের অবস্থানের অদলবদল, আনকোরা নতুন টেলিভিশন সেট — আব্বাস পাগলার গায়ে এসব একটুও আঁচড় লাগাতে পারলো বলে মনে হয় না। রানার সামনে সে হাত পাতে, ‘রানা, স্টেনগান দিলি না?’ টেবিলে রাখা ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেট থেকে সিগ্রেট বের করে আব্বাস পাগলা ঠোঁটে দিতে না দিতে ফর্সা-রোগা দেশলাই জ্বালিয়ে তার সামনে ধরে। কিন্তু সিগ্রেটের মাথায় আগুন স্পর্শ করার মুহূর্তে কাঠি নামিয়ে নেয়, ‘উল্টো হলো তো!’ ফিল্টারের দিকটা আব্বাস পাগলার ঠোঁটে নেই, সামনে। সিগ্রেট ঠিক না করেই আব্বাস পাগলা হাত থেকে জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে ফিল্টারে আগুন ধরাবার চেষ্টা করে। দেশলাই কাঠির আগুন আব্বাস পাগলার আঙুল পর্যন্ত এসে পড়ায় মিলির ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনী একটু একটু জ্বলছিলো। কিছুক্ষণ পর না-ধরানো সিগ্রেট আব্বাস পাগলা খুব কষে টান দিতে শুরু করে।

তিনটে চেয়ার ও দুটো তক্তপোষে সবাই ভাগাভাগি করে বসলে ফর্সা-রোগা ঝুঁকে জিগ্যেস করে, ‘কেমন আছেন?’ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আব্বাস পাগলা মহাসুখে নাধরানো সিগ্রেট টানে, তার চোখে ধোঁয়া লাগার অস্বস্তি পর্যন্ত ফোটে। মিলি নিজের চোখজোড়ায় সেই অনুপস্থিত জ্বালা অনুভব করার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। ফর্মালম্বা বসেছিলো তক্তপোষের এক ধারে, আরো খানিকটা ঝুঁকে গলা আঠালো করে নিবেদন করে, ‘কাল পরশু একটা পারমিট পেতে পারি।’ জবাবে আব্বাস পাগলা ‘হোগার মইদ্যে ব্যাণ্ডেজ বান্দলে সিগারেটের স্বাদ থাকে? বলে ফিল্টার টিপড সিগ্রেট জানলার দিকে ছুঁড়ে মারে, শিকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে অক্ষত সিগ্রেট ট্রাঙ্কের আড়ালে পড়ে রইলো। আজ সকালবেলা মিলি ওটা কুড়িয়ে নিয়ে গন্ধ শুঁকে আবার ওখানেই রেখে দিয়েছে। কাল একটা পারমিট পাবো’ ফর্সা-রোগা আরো ঝুঁকে পড়েছিলো, ‘মজনু ভাই ওয়ার্ড দিয়েছে ম্যানেজ করে দেবে।‘

‘কী?’

ফর্সা-রোগা দ্বিগুণ উৎসাহে বলে, ‘মজনু ভাই ওয়ার্ড দিয়েছে। আহসানুল হক মজনু। ভালো পার্টি পেলে ছেড়ে দেবো, না ইউটিলাইজ করবো? আপনি যা হুকুম করবেন তাই করবো।’ চেয়ারের ওপর দুই ঠ্যাং তুলে আব্বাস পাগলা হুকুম করে রানাকে, ‘স্টেনগান দে।‘

টেলিভিশনের পর্দায় পুরুষ ও মেয়েদের তোড়ে দেশাত্মবোধক গান করা দেখতে দেখতে গাড়িওয়ালা বিড়বিড় করে, ‘ইভনিংটা শয়েল করে দিলো।’ এরপর গত ২৪ ঘণ্টায় রানা এই বাক্যটি কয়েকবার রিপিট করেছে।

আব্বাস পাগলা ফের হাত পাতে, ‘কইলাম, আমারে একটা স্টেনগান দে! একটা স্টেনগান পাইলে ব্যাকটিরে আমি পানির লাহান ফালাইয়া দিবার পারি!’ স্টেনগান কোথায়? আমি কি-?’ রানা বিরক্ত হতে শুরু করেছিলো, কিন্তু ফর্সা-রোগার চোখে চোখ পড়তেই কথাটা আর শেষ করতে পারে না। রানার সমস্যার আর অন্ত নাই। কার দিকে টেনে সে কথা বলে? একজন শালা গাড়ির মালিক। ওর বাপও টপ লেবেলের এম. পি.। আবার সেক্রেটারিয়েট আত্মীয়-স্বজনে ভরা। ওদিকে বিজনেস বলো এ্যাকশন বলো—সব ধরনের ব্যাপারে ফর্সা-রোগোর মাথা একেবারে পরিষ্কার। সুতরাং কারো দিকে পক্ষপাত না দেখিয়ে রানা ভেতরে গেলো এবং কয়েক ফোঁটা পেচ্ছাব করে এবং মাকে অনাবশ্যক নির্দেশ দিয়ে ফিরে এলো। আসতে না আসতে আবার আব্বাস পাগলা। কাল রাইতে একটা চানাস পাইছিলাম। রাইত ভইরা চাঁদনি আছিলো না? আসমান এক্কেরে ধবধবা, ইট ওয়াজ ক্লিয়ার লাইক, এ লাইক এ লাইক এ। জুতসই উপমা খুঁজে না পাওয়ার ভাঙা রেকর্ডের মতো সে একই কথা কয়েকবার বলে। কয়েক বছর আগে স্কুলে মাস্টারি করার সময়ও সে প্রচুর উপমা দিয়ে পড়া বোঝাতো এবং উপমান ও উপমিতের সন্তোষজনক সামঞ্জস্য না ঘটা পর্যন্ত উত্তেজিত হয়ে কয়েকবার ‘লাইক এ’ বলতো। এই কারণে ছাত্রদের মধ্যে সে ‘লাইকে স্যার’ উপাধি অর্জন করে এবং নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পাগলা কথাটি যুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত রোকনপুর, একরামপুর এমন কি লক্ষ্মীবাজারের একটি এলাকা জুড়ে ঐ নামেই পরিচিত ছিলো। হঠাৎ উপমা জুটে গেলে আব্বাস পাগলার একই শব্দের পুনরাবৃত্তির অবসান ঘটে, ‘লাইক এ হোয়াইট শিট অফ পেপার। একটা পিচ্চি মেঘ ভি আছিলো না। এক মিনিট বাদে বাদে কল আসতাছে, এ্যালার্ট থাকো, এ্যালার্ট থাকো। গেট প্রিপেয়ার্ড ফর দি ফাইনাল এ্যাকশন!’ একটু বিরতি দিয়ে সে একটা হুঙ্কার ছাড়লো, আমার ভি আছে, ব্যাকটি বানাইয়া ঠিক কইরা থুইছি! ফাইনাল মেসেজ আইয়া পড় ক, আমি স্ট্রং কানেকশন কইরা রাখছি, ইন্সট্রাকশনের লাইগা ওয়েট করতাছি, দেহি!’ দিনরাত চেচামেচি করার ফলে তার গলা সবসময় ভাঙাভাঙা, ভাঙা গলা পেরিয়ে এবড়োথেবড়ো ধ্বনি বেরিয়ে এসে শ্রোতাদের কানে খোঁচা মারে। এইসব খোঁচাখুঁচি সামলে নিতে নিতে ফর্সা-রোগা জিগ্যেস করে, কার ইন্সট্রাকশন?’

রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা ডাকে, ‘মিলি!’

দরজার আড়াল থেকে ওদের দেখা বাদ দিয়ে মিলিকে মায়ের কাছে যেতে হয়। রান্নাঘর থেকে ট্রে নিয়ে ফের রানাদের ঘরে যাচ্ছে, আশরাফ আলী জায়নামাজ গোটাতে গোটাতে বলে, ‘রনি নিয়ে যাক না।’

‘না মিলি যাক।’ পেছনে মনোয়ারা। ট্রের ওপর ভালো করে দেখে আশরাফ আলী কপাল কোঁচকায়, এতো প্যাটিস খাবে কে?’

রান্নাঘরে ফিরে যাবার আগে ট্রের ওপর একটি চায়ের কাপ থেকে সরের টুকরা তুলে মনোয়ারা মেঝেতে ফেললো। আম্মার পেছনে রনি ঘুরঘুর করছে আর ঘ্যানঘ্যান করছে, ‘আম্মা, প্যাটিস দিলে না, আম্মা প্যাটিস দিলে না?’ আম্মা বলছে ‘আর নেই!’ রনি বলছে, ‘দাও না! ভাইয়া কতো বড়ো প্যাকেট নিয়ে ঢুকলো!’ আম্মা বলছে, ‘থাকলেই একবারে সব খেতে হবে, না? কাল সকালে নাশতা করিস!’ রনি বলছে, আম্মা বলছে, রনি বলছে, আম্মা বলছে! — রানাদের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আম্মা ও রনির বলাবলি আড়াল হয়ে যায়।

রানা ওর পড়ার টেবিল রেখে দেয় সবার মাঝখানে। মিলিয়ে সঙ্গে মুখোমুখি হতে ফর্সারোগার মাখোমাখো মার্কা চোখে মুখে লাল রঙ ক্যাট-ক্যাট করে ওঠে, এই জিনিস মিলি আগেও লক্ষ করেছে। কালো-লম্বা এক্সট্রা স্মার্ট হয়, ‘রানা কাল বিকালে ঢাকা ক্লাবের প্রোগ্রামটা মিস কইরো না! ফাইভ থার্টি শার্প!’ তার মুখটা মিলি ভালো করে দেখে নেয়। অতো ছটফট করার দরকার কী বাপু? প্রেম ট্রেম করতে চাইলে সরাসরি বললেই পারে। এরা তো সব একই টাইপের, মিলি কী বাছাবাছি করতে বসবে, না তাই করা তার পোষায়? তবে গাড়িওয়ালা কিন্তু যেমন ছিলো, তেমনি রইলো। হায় রে, আম্মার টার্গেট তো এই গাড়িওয়ালাই। কিন্তু মিলির দোষ কী? বড়ো লোকের ছেলে, কতো ভালো ভালো মেয়েমানুষ দেখে, এদেরে চোখে পড়া কি তার মতো মেয়ের কম্ম?–নইলে মিলির আপত্তি কী? সব তো একই।

আব্বাস পাগলা বলে, ‘খুব ভোরের দিকে হালাগো আর্টিলারি -এ্যাট লিস্ট এ হান্ড্রেড টু এ থাউজ্যান্ড, এক লাখও হইতে পারে, আর্টিলারি পাস করলো, আমি সিগন্যালের লাইগা বইসা রইছি।’ একটু থেমে ফিসফিস করে, ‘ট্রেটরগুলি কম্যুনিকেশন ডিসরাপ্ট কইরা দিলো।’

ট্রে থেকে এক এক করে প্যাটিস, ফিরনি, চানাচুরের প্লেট ও চায়ের পেয়ালা নামে। সেদিকে আব্বাস পাগলার কোনো মনোযোগ নাই। ‘রাইত তহন কিছু বাকি রইছে। চান্দে হালায় তহন ভি পুরা ফোকাস মারতাছে। একবার উপরে চাইয়া দেখি, ঐগুলি কী? আসমানের মইদ্যে উঁচালিয়ে এগুলি কী? গাত মালুম হয় না?-হ, তাই তো! এন্টায়ার স্কাইস্কেপ হ্যাজ বিন রেপড মিজারেবলি! খালি বাঙ্কার, ট্রেঞ্চ, এইখানে গর্ত, ঐখানে খন্দ!–এক্কেরে ঝালাঝালা কইরা ফালাইছে, বুঝলি না?’ এর মধ্যে খুক করে ছোট্টো একটু হেসেও নিলো, তগো কী কই? আমি তো হালায় ঠিক দেখতাছি, কারা আহে, কেল্লায় আহে–লগে লগে বুইঝা ফালাইছি! মগর—।’ এবার তার আকাশচিত্রবর্ণনা এতো দ্রুত হয় যে শব্দবিন্যাসে ঘোরতর অনিয়ম দেখা দেয়, তখন তাকে ঠিকঠাক অনুসরণ করা বেশ মুশকিল। তবে একনিষ্ঠ মনোযোগ দিয়ে শুনলে তার ব্যাকরণ মোটামুটি আয়ত্তে আসে এবং কুচি কুচি ছবিগুলো সম্পাদনা করলে জানা যায় যে শত্রুর যুদ্ধকৌশল সবটাই আব্বাস পাগলার নখদর্পণে এবং তাদের বিনাশ করার চূড়ান্ত নির্দেশের জন্যে অস্থির হয়ে সে একটু চোখ ফিরিয়েছিলো, তক্ষুনি হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে ছিন্ন সম্পর্ক হয়ে পড়ে। একটি মাত্র অস্ত্র হাতে থাকলে আব্বাস পাগলা কি হেড কোয়ার্টারের অর্ডারের জন্য প্রতীক্ষা করে? ‘একটা স্টেনগান থাকলে হু বদারস ফর দি ফাইনাল মেসেজ?’

‘কী মেসেজ?’ ফর্সা-রোগা খুব ব্যাকুলভাবে জিগ্যেস করে, ‘কী মেসেজ হুজুর?’

আব্বাস পাগলা হঠাৎ চাঁদের চেয়ে ধারালো কোনো গ্রহ, এমন কী, বলা যায় কোনো নক্ষত্রের মতো ওর দিকে সোজাসুজি ফোকাস মারে। তার দুটো চোখের ঘোলাটে জমিতে কেবল কাটাকুটি। চোখজোড়া সঙ্কুচিত হয়ে তীক্ষ্ণ ও ছুঁচলো হলে চারজন বন্ধু নিজনিজ নিতম্ব ও আনুমানিক শিরদাঁড়ায় প্রায় স্থির হয়ে পড়ে। হঠাৎ করে চোখজোড়া সম্পূর্ণ খুলে ফেলে আব্বাস পাগলা হুঙ্কার ছাড়ে, ‘হু আর ইউ?’ তোপধ্বনির মতো দ্বিতীয় হুঙ্কার বাজে, ‘টেল মি হু আর ইউ!’

মিলি ছিলো দাঁড়িয়ে। পায়ের পাতায় চাপ দিয়ে আওয়াজটা সামলে নিলো ফর্মারোগার মুখ একেবারে তেলজলরসশূন্য অক্ষরহীন দোমড়ানো সাদা কাগজের মতো পড়ে আছে ধড়ের ওপর, আর একটি হুঙ্কারেই উড়ে যেতে পারে। গাড়িওয়ালা বারবার দরজার দিকে দেখছে; হঠাৎ যদি আব্বাস পাগলার এ্যাকশন শুরু হয় তো প্যাটিস চানাচুর ফিরনির প্লেট চায়ের পেয়ালা এ্যাশট্রে প্রভৃতি বোঝাই টেবিল সরিয়ে, নতুন টেলিভিশন সেটের গা ঘেঁষে মেঝেতে রাখা ট্রাঙ্ক টপকে এবং লাস্ট বাট নট দি লিস্ট আব্বাস পাগলাকে ওভারটেক করে তবে কিনা বেচারা পৌঁছুতে পারবে দরজার কাছে। আর গাড়িতে পৌঁছুতে ওর ঢের দেরি, গাড়ি রেখে এসেছে বড়ো রাস্তায়। লম্বা-কালো উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত ঘষছে, বেচারার হাতের ঘাম কিছুতেই মোছা যাচ্ছে না।

কিন্তু সম্ভাব্য আক্রমণ প্রত্যাহার করে নিয়ে আব্বাস পাগলা দরজার দিকে চলে গেলো। ‘চুতমারানি, খানাকির বাচ্চা, তগো ব্যাকটিরে আমি চিনি। আমার পেটের মইদ্যো থাইকা ইনফর্মেশন বাইর কইরা এনিমি ফ্রন্টে পাঠাইবার তালে আছো, না? ইস্পাইং করনের আর জায়গা পাইলি না?’ তারপর বারান্দায় গিয়ে ‘ও আশরাফ সাহেব, এনিমির ইস্পাই ছ্যামরাগো এ্যাসাইলাম দিয়ে বহুত মৌজ মারেন, না?’ বলতে বলতে সে বেরিয়ে যায়। এতোক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকার পর আব্বাস পাগলার পেছনে পেছনে মিলি বারান্দায় গেলো। একটু পরে মনোয়ারা এসে বলে, ‘একি মিলি! এখানে কী?’

‘দেখো না!’ মিলি আঙুল দিয়ে দেখায়, পানের দোকানের সামনে হাত পা নাড়িয়ে আব্বাস পাগলা খুব চ্যাঁচাচ্ছে।

আম্মা বিরক্ত হয়েছে, যা, রানা ওদিকে কখন থেকে চিনি চাইছে, দেখ!’

কিছুক্ষণ পর নিজেদের ঘরের জানলায় দাঁড়ালে আব্বাস পাগলাকে মিলি আর দেখতে পায় না। জানলায় দাঁড়াবার একটু পরেই বন্ধুদের সঙ্গে রানা বেরিয়ে গেলো। ওরা দোকানে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট কিনছে। ওদের দুজন মিলির জানলার দিকে তাকালো। ঘাড় কিম্বা কাঁধ চুলকাবার জন্য আরেকজনকেও এদিকে মুখ ফেরাতে হয়, ল্যাম্পোস্টের ঘোলা আলো তিনটে মুখে পাউডারের মতো ছড়িয়ে পড়ায় একজন থেকে আরেকজনকে আলাদা করা যায় না।

কাল তো তবু আকাশটা পরিষ্কার ছিলো। ঝোলাগুড় মাখানো টোস্ট না ছুঁয়ে এক পেয়ালা চা খেয়ে হঠাৎ গাড়ির হর্ন শুনে রানা আজ বেরিয়ে গেলো তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে। অনেক রাত করে রানা ঘরে ফিরলে মনোয়ারার দরজা খুলে দেওয়ার শব্দে মিলি জেগে ওঠে। রাস্তায় আব্বাস পাগলা তখন লম্বা বিরতি দিয়ে হাততালি দিচ্ছে।

‘খেয়ে এসেছি,’ জড়ানো স্বরে খবরটা জানিয়ে রানা আব্বার ঘরে ঘুমোতে গেলে আম্মা এই ঘরে আসে। মিলির পা দুটো ঠিক করে নিজের বিছানায় বসে আম্মা একা একা পান সাজে। ‘কোথায় যায়! এতো রাত করে কোথায় থাকে!’ মায়ের নিশ্বাস ঐ তক্তপোষ থেকে মেঝেতে এবং মেঝের হিম ও ছোটো শূন্যতার আর্দ্রতা নিয়ে মিলির গায়ে শিরশির করে। তার উঠে পড়তে ইচ্ছা করে। আম্মাকে ভুলভাল একটা পান সাজিয়ে দিলে হতো। কিন্তু মিলি জেগে আছে টের পেলে সশব্দ নিশ্বাস চেপে রাখা ছাড়া আম্মার আর উপায় থাকবে না। মিলি তাই শুয়েই থাকে এবং এই ওলটপালট সময়ে রানার কবে যে কি হয়—এই ভাবনা মাথায় খামচা দিলে তাকেও কয়েকটা নিশ্বাস গিলে ফেলতে হয়। আম্মার ভাবনা আম্মার, রানার জন্যে ঘরের এতো শ্রী আসছে, তার সঙ্গে একটু রয়েসয়ে কথা না বললে কি চলে? আবার মিলির ভাবনা মিলির। কারো চোখেই তাই জলের সঞ্চার হয় না এবং মিলির চোখ করকর করে। তখন পাশ ফিরলে স্বস্তি পায়। এই ভাবে রাত্রি গড়ায়। বাইরে আব্বাস পাগলার হাততালি এখন স্পষ্ট ও উচ্চশব্দ। তালির মাঝে বিরতি খুব দ্রুত কমে আসছে। তার তাক্ তাক্/তাক্ তাক্ তাক্ তাক্ তাক্/তাক্ তাক—এই তালের নিয়মিত ও দ্রুত পেটায় বাইরের নীরবতা সংহত। আম্মার একাকী জাগরণের নিশ্বাসের পটভূমিতে তাক তাক্/তাক তাক্ তাক্ ক্রমেই তেজি হয়, কিছুক্ষণের ভেতর ভারি হাতের গলি-কাঁপানো তালি দেখতে দেখতে আম্মার নিশ্বাস প্রশ্বাস—সব গ্রাস করে ফেলে। জানলা দিয়ে হাততালির ধ্বনি ছলকে ছলকে এসে ঘরময় থৈ থৈ ভাসছে। মিলির চোখেমুখে ছলাৎ ছলাৎ ঝাপ্টা মারে তাক্ তাক্/তাক্ তাক্ তাক্ হাততালি। তাক তাক/তাক তাক তাক –মিলির চোখ জলময়। তাক্ তাক্/তাক্ তাক্ তাক —তার চোখ জোড়া নিঃশব্দে বন্ধ হয়, চোখের জলভরা শাঁসে এখন অন্ধকার। তাক তাক/তাক তাক তাক–চোখের পানি ঘন হতে হতে কালো মেঘের আকার ও রঙ পায়, অন্ধকার এখন নিশ্চিদ্র। তাক্ তাক/তাক্ তাক্ তাক্—অন্ধকারের ভেতর ডিমের মধ্যে বড়ো হওয়ার স্পন্দন অনুভব করা যায়, তখন সেই হাততালির সঙ্গে পা ফেলে মিলি একটা উঁচু ক্রেনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। ক্রেনের মাথায় রেলিং-ঘেরা ছোট্টো একটি জায়গা, রেলিঙের ওপর আব্বাস পাগলা। তার হাতে তালির বদল এখন স্টেনগান। রানা এবং ফর্সা-রোগার হাতে মিলি এই জিনিসটা আগেও দেখেছে, এর নাম স্টেনগান হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। আর এতো নিচে থেকে জিনিসটা স্পষ্ট ঠাহর করা কঠিন। আকাশের দিকে তাক করে আব্বাস পাগলা আব্বাস পাগলা নিশানা ঠিক করছে। যুদ্ধরত শত্রুসৈন্যরা মিলির দৃষ্টির অনেক বাইরে। আব্বাস পাগলা ক্রেনের সিঁড়ি বেয়ে আরো ওপরে উঠে যাচ্ছে বলে তার এলোমেলো উড়ন্ত চুলের কালো শিখা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ে না। কোমরে শাড়ি জড়িয়ে নিয়ে মিলি সিঁড়ির ধাপ ভাঙছে, আব্বাস পাগলার চুল কালো আগুনের মতো দপদপ করে জ্বলে, সেই দিকে চোখ রেখে সে ওপরে উঠছে। এক ধাপ এক ধাপ করে মিলি বেশ অনেকটা উঠে পড়ে। হঠাৎ মিলির সমস্ত শরীর দুলে উঠলো।–তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে তার পা ফস্কে গেছে, অনেক ওপরে কালো আগুনের শিখা—মিলি পড়ে যাচ্ছে গভীর নিচের খাদে।

তবে ভূমি স্পর্শ করার আগেই তার চোখ খুলে যায়; দেখে, ঘরে ঘন ঘোর অন্ধকার। পাশের বিছানায় মায়ের মিহিসুরে নাকডাকা ও নিজের বিছানায় লিলির নিশ্বাসের একটানা আওয়াজ। মিলির তখন মুখের তালু খা খা করছে, তার তখন দারুন পানির পিপাসা। স্বপ্নকে মুহূর্তে স্বপ্ন বলে সনাক্ত করতে পারলেও তার খুব ইচ্ছা করে, জানালা খুলে ওপরে যতোটা পারে একবার দেখে নেয়। কিন্তু ক্রনের সিঁড়ির এতোগুলো ধাপ ভাঙা এবং পা ফস্কে নিচে পড়ার ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছে। পানি আর খাওয়া হয় না, জানলা খোলার জন্যে ওঠার আগেই মিলি ঘুমিয়ে পড়ে।

ক্রেন থেকে নেমে এসে পরদিন দুপুরে আব্বাস পাগলা ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো। বেলা একটা দেড়টার দিকে বাইরের দরজায় কড়ানাড়া শুনে দরজা খুলতেই সামনে আব্বাস পাগলার জখম হওয়া-ট্রাকের মতো থ্যাবড়ানো মুখ।

‘রানা কৈ? রানারে ডাক।

‘বাসায় নেই।’

‘ন্নে-ই!’ আব্বাস পাগলা মুখ ভ্যাংচায়, ‘নেই! নাই কেল্লায়? কৈ গেছে? কারে হাইজ্যাক করবো? দুই ঘণ্টা আগে দেখলাম মস্তানগুলি টেলিভিশন লইয়া আইলো, অহন গেছে রেফ্রিজারেটর আনতে? কৈ গেছে, কইলি না?’

ধমক খেলে মিলি চুপ করে থাকে। ওরা টেলিভিশন নিয়ে এসেছে পরশু, আর লোকটা কিনা পুরো দুটো দিনকে গুটিয়ে নিয়ে এল দুই ঘণ্টায়! লোকটা এতো শক্তি পায় কোত্থেকে? আব্বাস পাগলার মুখের দিকে সে সরাসরি তাকায়। এই সময় পাগলা বারান্দায় উঠে আসে। লোকটিকে ভালো করে দেখার জন্য মিলি দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলে ওদের দূরত্ব দাঁড়ায় দুই থেকে আড়াই হাত। আব্বাস পাগলার গায়ে পচা ডিম ও স্যাঁতসেঁতে কাপড়ের ভ্যাপসা গন্ধ। ঠিক তাও না। নবদ্বীপ বসাক লেনে রেহানাদের বাড়িতে যেতে একটি হালুইকর দোকানের কারখানার পেছনটা পার হতে হয়। সেখানে মাঝে মাঝে এই গন্ধ পাওয়া যায়। তার মস্ত বড়ো মুখের বেগুনি-কালো জমিতে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ির ঘন কাঁটাবন। দাড়ি তার বড়ো ছুঁচলো, এখান থেকেই মিলির ঘাড় কুটকুট করে, ডান হাতের দুটো আঙুল দিয়ে সে আস্তে আস্তে ঘাড় চুলকে নেয়। রানার ওপর আব্বাস পাগলা মহা চটা, ‘খাটাশটা কৈ গেছে কেউরে কইয়া যায় নাই?’

বারান্দায় একটা মোড়া পাতা ছিলো, আব্বাস পাগলা রাজকীয় ভঙ্গিতে মোড়ায় বসে হুকুম করে, ‘বস!’ কিন্তু আর কোনো আসন না থাকায় মিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আব্বাস পাগলা এবার গলা নামিয়ে বলে, ‘রানায় তরে কিছু দিয়া গেছে?’

‘না।’

‘কিছু কইছে তরে?’

‘না।’

‘খালি না, না, না!’ আব্বাস পাগলা চিৎকার করে, ‘ঠিক আছে! আমি ভি দেইখা লমু! খানকির বাচ্চারে কইস, আব্বাস আলী মাস্টারের লগে রঙবাজি করলে হালারে এক্কেরে জানে মাইরা ফালামু, বুঝলি?’

কিন্তু এই চিৎকার কাটিয়ে উঠে মিলি জিগ্যেস করে ‘ভাইয়া আপনাকে কী দেবে?’ এই কথায় পরশুদিন সন্ধ্যাবেলাকার মতো তার চোখ ছুঁচলো হতে শুরু করলো, চোখের পাতা ব্যবহৃত হচ্ছে শক্ত আঙুলের মতো, চোখের পাতা দিয়ে আঁকড়ে ধরে সে তার চোখের ঘোলাটে লাল সর ও তার ওপরকার আঁকিবুকি ছেঁকে ফেলতে চায়। হঠাৎ তার ভাঙাভাঙা গলায় হুঙ্কার বেরিয়ে আসে, ‘শাট আপ!’ ঘরের নোনা ধরা দেওয়াল কাঁপে, মিলির পা হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবার উপক্রম হয়। নিচে গভীর খাদে পড়ে যেতে যেতে সে ওপরের দিকে তাকায়; না, ওপরে কেবল ছাদ, ছাদে কড়ি-বর্গা, বাড়িওয়ালার ঠিকা ঝির মশলা বাটার শব্দ। মিলি তাড়াতাড়ি দরজার পাল্লা ধরে ফেললো। লিলি রনি স্কুলে, আব্বা অফিসে, আম্মা বাথরুমে ঢুকেছে একগাদা ময়লা কাপড় নিয়ে। খালি ঘর পেয়ে আব্বাস পাগলার হুঙ্কার সারা বাড়ি স্বেচ্ছাভ্রমণ সারে।

ভিজে শাড়ি-ব্লাউজ কোনোরকমে গায়ে জড়িয়ে মনোয়ারা এসে দাঁড়ালো। প্রথম এক আর মিনিট বেচারা কোন কথাই বলতে পারে না। তারপর মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি পরে আসবেন। বাসায় কেউ নেই।’ তার ক্ষীণকণ্ঠের অনুরোধ আব্বাস পাগলার হুঙ্কারধ্বনির ফাঁকে ফোকরে কোথায় লুকায় তার কোনো পাত্তাই পাওয়া যায় না। আব্বাস পাগলা মিলির দিকে চোখ রাখে, ‘তুমি হেইদিনের ছেমরি, আমার লগে দুষামনি করো?’

মনোয়ারা দু’জনকে দু’রকম নির্দেশ দেয়, মিলি, এদিক আয়, ঘরের ভেতর আয়। আপনি এখন যান, বললাম তো বাসায় কেউ নেই। যান, পরে আসবেন। মিলি, ঘরে আয়।’

মিলি ব্যাকুলভাবে জানতে চায়, ‘আপনাকে কী দেওয়ার কথা আছে? আমি ভাইয়াকে বলে রাখবো। কী দেবে?’

‘তোমারে কইতে হইবো? বেঈমানের বইনরে সিক্রেট আউট কইরা দিমু?’ আব্বাস পাগলা হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আরে আরে, অরা আইয়া পড়বো না? মনে লয় আউজকা আসমানের ব্যাকটি অকুপাই করবো!’ বলতে বলতে সে চার ধাপের সিঁড়ি লাফিয়ে নামে, খানকির বাচ্চারা, তোমরা দুনিয়ার পুরাটাই কব্জা করছো, অহন আসমান চোদাইবার তালে আছো, না?’

কিন্তু আকাশ জুড়ে কিসের আয়োজন? মিলি ওপরে যতোটা পারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ওপরে কেবল আকাশ। সকাল পর্যন্ত বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় মেঘ সব ধুয়ে মুছে সাফ। নীলচে সাদা আকাশ আসন্ন শীতকালের অনিবার্য বৈধব্যের জন্যে এখন থেকেই তৈরি হচ্ছে, তার শরীরে গয়না বলতে কিছু নাই। নাঃ! মিলি ভালো করে তাকালো, নাঃ! কোথাও কিছু নাই। লোকটা এতো কী করে দেখে?

বড়ো বড়ো পা ফেলে আব্বাস পাগলা এগিয়ে যায়, যেতে যেতে চ্যাঁচায়, ‘এনিমি এ্যাডভান্স করতাছে, যাই গিয়া, এইবার এ্যামবুশ করবার পারলে চুতমারানি ব্যাকটিরে এক্কেরে ফিনিস কইরা দেই!’ তার একটা হাত মাথায়, ছোটোখাটো গোলাবারুদ কি বোমার কুচি সে এই হাত দিয়ে ঠেকাতে পারবে।

আশারাফ আলী অফিস থেকে ফিরলে মনোয়ারা হৈ-চৈ করলো, এসব পাগল ছাগলের সঙ্গে এতো বড়ো মেয়ে কিনা যেচে কথা বলে! কখন কী করে বসবে, এদের কিছু ঠিক আছে? আশরাফ আলী স্ত্রীর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, ‘না, না, এদের এ্যাভয়েড করতে হয়। সব জায়গায় আজকাল আই. বি’র লোক। কে যে কী ডিসগাইজ নিয়ে আসে!’

‘আই. বি হবে কেন?’ মনোয়ারা বিরক্ত হয়, ‘তুমি কি এমন মস্ত বড়ো মানুষ যে তোমার ঘরে আই. বি ঢুকবে?’

‘আহা, আমি কেন? আমি কেন?’ দু’একবার তোতলালেও আশরাফ আলী শেষ পর্যন্ত বুকে বল নিয়ে বলে, ‘তোমার ছেলে বড়োলোক হচ্ছে না?’

‘ছেলের জন্যই একটু মানুষের মতো দিন চলছে, আবার ছেলেকে হিংসা করে!’ মনোয়ারা হঠাৎ রেগে যাওয়ায় আশরাফ আলী ফ্যাকাশে হয়ে যায়, ‘আরে না, না। আমি ঠিক তা বলি নি! মানে রানাকে তো আজকাল সবাই চেনে টেনে, মানে পপুলার তো, তাই ধরো।’ আশরাফ আলীর গোঁফদাড়ি কামানো মুখে কোনো ভাঙচুর নাই, সেখানে চট করে রেখা-উপরেখা তৈরি হয় না। কিন্তু তার ঠোঁট ও চোখ এলোমেলো হয়ে খসে পড়বার উপক্রম হয়। বাপের জন্য মিলির একটু মায়াই হয়, আব্বা যে কখন কী ভাবে! তার ইচ্ছা করে বাপকে বলে যে আই. বির যারা বাপ, তাদের বাপের সঙ্গে রানার কড়া লাইন। দামি দামি সব জিনিসপত্রে ঘরবাড়ি ভরে তুললো, গায়ে একটি আঁচড় পর্যন্ত লাগে না, আর আই. বি আসবে তাকে ধরতে?

আব্বাস পাগলা পরদিন ফের আসে। আজ মনোয়ারা তার বোনের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে বোনের ছেলের বিয়ের শাড়ি কিনতে, দরজায় ধাক্কা শুনে মিলি একবারে মোড়া হাতে দরজা খুললো। আব্বাস পাগলা প্রথমেই বলে, ‘রাইখ্যা যায় নাই?’

‘না।’

মোড়ার ওপর আব্বাস পাগলা ধপাস করে বসে পড়ে। তাকে হতাশ ও উদ্বিগ্ন দেখায়। ‘রানায় আউজকাও দিলো না, না?’ তার গলায় একটু অভিমান, ‘আমার প্রবলেম বুঝবার চায় না। তামাম রাইত আমার ঘরের উপরে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছে। কাউলকা বেলা দুইটা বাজলে আমারে সিগন্যাল পাঠাইলো, ইস্পেশাল মেসেঞ্জার পাঠাইছিলো, আমার কানের মইদ্যে লাইট মারলো পরে চোখের উপরে সাউন্ড পাইলাম, হালায় কি চোখা সাউন্ড, চোখের পাতা আমার খালি ফাল পাড়ে লাইক, লাইক, লাইক এ বাম্পিং স্যভর জেট। — কি? না, রাইত দুইটা বাজলে দুশমুনে পজিশন লইবো;–কোন জায়গায়?–না, কয় চান্দের ঐ সাইডে। ঐ সাইডটার ভিউ দুনিয়া থাইকা ঠিক ক্লিয়ার আসে না। পাহাড় পর্বতই বেশি, মাউনটেনিয়াস জোন। পাহাড়ের মইদ্যে গাত উত আছে না?— দুশমুনে হালায় গাতগুলিরে আর্টিলারি বানাইয়া রাখছে।’

আব্বাস পাগলা কথা বলে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। একবার সে মিলিকে বোঝায়, একবার আকাশ দেখে। এর ফাঁকে একেকবার বারান্দার দেওয়ালে চুনসুরকি খসে-পড়া মানচিত্রের দিকে চোখ কুঁচকে কি সনাক্ত করতে চেষ্টা করে। গুহাময় পাহাড়-পর্বত খচিত চাঁদ দেখার জন্য মিলির মনটা ছটফট করে উঠলো। এখন বেলা মোটে বারোটা সাড়ে বারোটা। দুপুর ভালোভাবে জমবে, বিকাল হবে,–দিন ছোটো হয়ে আসছে, বিকালটা তবু একেবারে ফ্যালনা নয়। সন্ধ্যায় আজকাল পাতলা কুয়াশা পড়ছে, আকাশের নীলচেকালো বুকে কুয়াশা মিলিত হলে তারপর রাত্রি। সে এখনো মেলা দেরি। তারো পরে মধ্যরাত। মধ্যরাত্রির চাঁদে দখলদার বাহিনীর কাঁটাতার-ঘেরা ক্যাম্প। জনবিরল চাঁদের অপর পিঠে পাহাড় পর্বতের ভেতর সেই ক্যাম্প কী রকম দেখায়? আব্বাস পাগলা এগুলো কি সব দেখতে পায়? সেই ক্যাম্পের দিকে চোখ রেখে নিরস্ত্র হাতে বেচারা কী করে ওদের গতিবিধি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনবে?

‘বুঝলি? চান্দের পশ্চিম দিকে’–চোখ বন্ধ করে আব্বাস পাগলা দিকনির্ণয় করে, ‘হিলি রেঞ্জ থাইকা ফোর্টি ফাইভ ডিগ্রি এ্যাঙ্গেল কইরা কয় মাইল উড়তে পারলেই নদী, বহুত বড়ো নদী।’

‘নদীর নাম কী?’ হঠাৎ জিগ্যেস করে ফেলেও মিলি আব্বাস পাগলার কাছে ধমক খাওয়ার ভয়ে কুঁকড়ে যায় না, কারণ চাঁদের নদীর নাম জানা তার খুব দরকার। ‘নাম কইতে পারুম না।’ আব্বাস পাগলা বিরক্ত হয় না, ‘নদীর আবার নাম কিয়ের? এই চুতমারানিরা গেছে, খানকির বাচ্চাগুলি অহন নাম দিবো। –নাম দিবো, দাগ দিবো, খতিয়ান করবো, কবলা করবো, দলিল করবো, মিউটেশন করবো—হালারা বাপদাদাগো সম্পত্তি পাইছে তো, বুঝলি না? নদীর দোনো পাড়ে পজিশন লইয়া রেডি হইয়া আছে। দুনিয়ার পানি বাতাস মাটি আগুন পাথর তো জাউরাগুলি পচাইয়া দিছে, অহন পচাইবো চান্দেরে!’

এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে যাচ্ছে সে, তার কথার আঁচে উস্কুখুস্কু চুল দপদপ করে ওঠে আর নামে। মিলি বুঝতে পারে যে আব্বাস পাগলার করোটির ভেতর কোথায় অঙ্গার রয়েছে, তারই তেজে তার কালো চুল ধকধক করে জ্বলে। সেই গোপন অঙ্গার ছোঁয়ার জন্য মিলির আঙুলগুলো কাঁপে। একবার ছুঁতে পারে তো এই ঘোরতর দুপুরবেলা চাঁদের ভেতর সৈন্য সমাগম স্পষ্ট দেখা যায়।

‘মেইন প্রবলেম তো কেউরে কই নাই।’ মূল সমস্যাটিকে গোপন রাখা দরকার বলে সে মোড়া নিয়ে সামনে এগোয়। দরজার চৌকাঠে বসে পড়া মিলির কাছাকাছি এসে সে আস্তে আস্তে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চাগুলি চান্দের গ্র্যাভিটেশন বাড়াইয়া দিতাছে। এতোগুলি মানুষ গেছে, এতোগুলি আর্মস লইয়া গেছে, গ্র্যাভিটেশন বাড়াবো না? অহন কী হইবো? তুই ক, অহন কী হইবো?’ মিলি বলতে না পারলে আব্বাস পাগলা নিজেই জবাব দেয়, ‘অহন দুনিয়ার জানোয়ারগুলির লাহান চান্দের বাসিন্দাগো পায়ের মধ্যে গোদ হইবো, জিন্দেগিতে অরা আর উড়বার পারবো না।’

‘কারা উড়তে পারে?’ সাঙ্ঘাতিক কৌতূহলে মিলি একটু এগিয়ে আসে। এখন তাদের মধ্যে ব্যবধান এক থেকে দেড় হাত। কিন্তু আব্বাস পাগলার গা থেকে পচা ডিম, স্যাঁতসেঁতে কাপড় ও নবদ্বীপ বসাক লেনের হালুইকরের কারখানার পেছনদিককার নালার মিলিত গন্ধ আসছে না। কিংবা এমন হতে পারে যে নিঃশ্বাস নিতে মিলি ভুলে গিয়েছিলো। কিন্তু আব্বাস পাগলার কথা তো স্পষ্ট শোনা যায়, ‘চান্দের ব্যাকটি জীব উড়বার পারে। চান্দের ওজন আমাগো এই ধুমসা দুনিয়ার একাশি ভাগের একভাগ। অরা উড়বো না কেল্লায়? তুই সাইন্স পড়লে আমারে এতোটি কথা কইতে হয়?’ তবে মিলি বিজ্ঞান পড়েনি বলে আব্বাস পাগলা রাগ করে না, বরং ছোট্টো করে একটু হাসে, ‘আরে ছেমরি, তর ওজন যদি পঞ্চাশ পাঁচপঞ্চাশ পাউন্ড রিডিউস করবার পারস তো আমি তোরে গ্রান্টি দিতাছি তুই ভি উড়াল দিবার পারবি। পারবি না?’ বিজ্ঞানে বুৎপত্তিওয়ালা আব্বাস পাগলার এই গ্যারান্টি অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না মিলির। মিলির ওপর আব্বাস পাগলা বেশ আস্থা স্থাপন করেছে। চাঁদে বিভিন্ন সময় তার অভিযানের কথা সে ফিসফিস করে ফাঁস করে দিচ্ছে। চাঁদ এমন একটা জায়গা যেখানে সব শালাই সব সময় ভাসে, ওড়ে এবং দোলে। সেখানে কারো সঙ্গে কারো ক্ল্যাশ হয় না। নিল আর্মস্ট্রংকে আব্বাস পাগলা অনেক আগেই এই তথ্য জানিয়ে দিয়েছিলো। ১৯৬৯ সালের ১৬ই জুলাই কেপ কেনেডি থেকে এ্যাপোলো ১১ তে চাঁদের দিকে রওয়ানা হবার ঠিক আগের মুহূর্তে নিল আর্মস্ট্রং আব্বাস আলীর ইংরেজিতে লেখা–হ্যাঁ ইন কিংস ইংলিশ — চিঠিটা ভালো করে পড়ে নেয়। আব্বাস আলী লিখে দিয়েছিলো যে চাঁদে গিয়ে তাদের হাঁটাহাঁটি করতে হবে না। দিব্যি উড়াল দিয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু হাজার হলেও ওরা পৃথিবীর পয়দা, তাই তার কথাটাকে তেমন আমল দেয়নি। এখন নিল আর্মস্ট্রং লোকটি কে প্রশ্ন করতে মিলি ভরসা পায় না। সাধারণ জ্ঞান তার কম জানতে চায়, ‘তা উনি উড়েছিলেন?’

আব্বাস পাগলা বলে, ‘অফ কোর্স। মগর বুঝলি না? এই ইনফর্মেশনটা বেটা সিক্রেট রাখছে। কইলেই তো আমার চিঠির কথাও কইতে হয়। তাইলে অরা ক্রেডিট লইবো ক্যামনে? নেমকহারামের পয়দাগুলি! আঙুলের কড়ে ১৯৬৯ সাল থেকে বর্তমান বছর পর্যন্ত গুণে সে বলে, ‘চাইরটা বছর ভি পুরা হয় নাই, অকুপেশন আর্মি গিয়া চান্দের বহুত এরিয়া ক্যাপচার কইরা রাখছে, বুঝলি?’ চারপাশে একবার দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে আব্বাস পাগলা বলে, ‘আমি ব্যাকটিরে সাফ কইরা দিবার পারি। ফর্টি ফাইব ডিগ্রি এ্যাঙ্গেল কইরা এমুন ফায়ারিং করুম বুঝলি, ফটাফট ফালাইয়া দিমু। প্যাসিফিকের যে স্পটটার মইদ্যে নিল আর্মস্ট্রং নামছিলো, হালারা ঐ জায়গার মইদ্যে পইড়া এক্কেরে ফিনিস হইয়া যাইবো।’ একটু থেমে সে আক্ষেপ করে, ‘রানায় আমারে দিলো না। একটা স্টেনগান দিবো —আমারে জবান দিয়া অহন খালি ঘুরাইতাছে! উই হালায় ভি অকুপেশন আর্মির লগে লাইন দিছে কৈ যাই? খালি দালাল, খালি কুইসলিং!’ মন খারাপ করার ভঙ্গিতে সে বলে, ‘ঠিক আছে! আমারে তো চিনে নাই। এই কোলাবোরেটারগুলিরে আমি টিকটিকি দিয়াও মারাই না। অহন ঠ্যাকায় পইড়া আইছি! ঠিক আছে একদিন না একদিন তগো ব্যাকটিরে কব্জার মইদ্যে পামু, দুই উংলির মইদ্যে ধইরা তগো মাক্ষির লাহান জাইত্তা মারুম।’ নক্ষত্র কি অন্য গ্রহ-উপগ্রহ থেকে আসা রোদ কি গোলাবারুদের আঁচ এড়াবার জন্য কপালে হাত রেখে লম্বা পা ফেলে আব্বাস পাগলা বড়ো রাস্তার দিকে রওয়ানা হয়। তার ধ্যাবড়া পায়ের নিচে টায়ারের স্যান্ডেল এবড়োখেবড়ো রাস্তায় থাপ থাপ আওয়াজ করে। ডাঙা থেকে শূন্যে ওঠার আগে সে কি পা ঝাপটাচ্ছে? মিলি খুব মনোযোগ দিয়ে আব্বাস পাগলার হাঁটা লক্ষ করে।

পরদিন সকালে একটা ফোক্সওয়াগন গাড়িতে রানা ফিরে আসে। গাড়ি চালাচ্ছে সে নিজে, মনে হয় মালিকও সে নিজেই। ঘণ্টা দেড়েক পর মিলিকে ডেকে রানা জিগ্যেস করে, ‘মিলি, আব্বাস পাগলা তোকে ইনসাল্ট করেছে?’

‘না তো!’ মিলি অবাক হয়, ‘কে বললো?’

‘অনেকেই বললো। আম্মাও জানে। তোকে নাকি বেটা গালাগালি করেছে?’

‘আরে না! উনাকে তুমি কী নাকি দিতে চেয়েছিলে, তাই নিতে এসেছিলেন। দিচ্ছো না কেন?’

রানা বিরক্ত হয়, ‘ওটা একটা থরোব্রেড বাস্টার্ড।’

রানার তলব পেয়ে আসতে হয় আব্বাস পাগলার ভাইকে। রানা রাগ ঝাড়ে এখন তার ওপরেই, ‘এইসব পাগল ছাগলকে ঘরে চেন দিয়ে বেঁধে রাখবেন। না হলে আমরাই যা করার করবো। পাড়ায় এই পাবলিক নুইসেন্স টলারেট করা যায় না।’

ছোটো ভাইয়ের জন্যে রমজান আলীর দুঃখের শেষ নাই, তকদিরে নাই, বি. এস. সি. পাশ করবার পারলো না, দুইবার পরীক্ষা দিলো, আমার কতোটি ট্যাহা পানিত ফালাইলাম! ফেল করলি, কারবারের মইদ্যে ঢোক, বাপ-দাদাগো আমলের কারবার আমাগো। –না, ইস্কুলের মাস্টার হইবো। বিশ বাইশ বছর আগে বি. এস. সি ফেল করছে, তখন লেখাপড়া আছিলো, ফেলের ভি ভ্যালু দিছে! সালাউদ্দিন মিয়ার বইনের জামাইরে ধইরা একরামপুর ইস্কুলের মইদ্যে ঢুকলো। ইস্কুল তো তার ভালোই ফিট কইরা গেছিলো। পোলাপানে বহুত ইজ্জত করছে।

সোহেল না সিডনি না ফয়সল কি নাম, ফসা রোগাটা আব্বাস পাগলার জীবনী শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়, বলে, ‘আমি প্রথমে দেখেই বুঝেছি।’ সে কি বুঝেছে তা বোঝাবার জন্য কিছুমাত্র চেষ্টা না করে রমজান আলী তার বিলাপ অব্যাহত রাখে, মহল্লার মানুষে ভি ইজ্জত করছে। চার বছর হইলো এই বিমারি ধরছে। স্বাধীনের টাইমে ইন্ডিয়া গেলো. কৈ কৈ যুদ্ধ করছে, অহন ওয়ার ছাড়া আর কথা নাই। শীতের টাইমে আমাগো ভি পাগলা বানাইয়া ছাড়ে। ৩/৪ দিন বাদে বাদে ফাল পাইড়া চিক্কুর ছাড়বো, কি কমু, ভাড়াইটা থাকবার চায় না। দোতলার ভাড়া বাড়াইতে পারি না!’

‘ডাক্তার দেখান, ডাক্তার দেখান।’ গাড়িওয়ালা ছেলেটি–সোহেল না সিডনি না ফয়সল কি নাম— তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়, ডাক্তার দেখান, ডাক্তার দেখান।

‘ডাক্তারে হাকিমে হাজার বারোশো টাকা বারাইয়া গেছে। ত্যালপড়া, পানিপড়া, শিরনি, তাবিজ–কিছু বাদ রাখছি?’

গাড়িওয়ালা বলে, ‘পাবনা পাঠিয়ে দিন।’

পাবনা পাঠাতে হলো না। রানা এবং ফর্সা-রোগা দু’তিনজন একটু দৌড়াদৌড়ি করার ফলে পি. জি হাপাতালের সাইকাট্রি ওয়ার্ডে লাল ছাপ মারা সাদা চাদর বিছানো শয্যায় আব্বাস পাগলা স্থাপিত হলো। বেলা ৩টার দিকে বাড়ি ফিরে আব্বাস পাগলার কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকে রানা দেখে মুখে মাথায় লেপ জড়িয়ে মিলিটা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এতো বড়ো মেয়েটার ছেলেমানুষি এখনো গেলো না। যখন একেবারে ছোটো ছিলো, একটু একটু পড়তে শিখেছে, তখন খবরের কাগজে মিলি কেবল নিখোঁজ সংবাদ দেখতো। রানাকে বলতো, ‘ভাইয়া এই জায়গাটা পড়ো তো। একসঙ্গে স্কুলে যাবার সময় কোনো ছেলে মেয়েকে একা একা যেতে দেখলে থমকে দাঁড়াতো, ‘ভাইয়া, ছেলেটা দেখতে ঠিক ঐ ছবির মতো না? দেখো, পরনে নীল রঙের হাফ শার্ট, কথা বলে দেখো, ঠিক বাঙলায় কথা বলে।’ রানা তো দুই বছরের বড়ো, তার বড়োত্ব দেখাবার জন্যে একটু রাগ না করলে চলে?–‘দূর! এ বেটা কোনো বাসায় কাজ করে।’ কিংবা, ‘আরে দেখ না, হাতে টিফিন ক্যারিয়ার দেখছিস না? অফিসে ভাত নিয়ে যাচ্ছে। আবার দেখো, এখন পাগল ছাগলের চিৎকার শোনার জন্যে এতো বড়ো হলো, রানা আস্তে আস্তে ডাকে, ‘মিলি!’

তুলোট অন্ধকার দেখার জন্যে একটু আগে ভাত খেয়ে মিলি লেপ মাথায় করে শুয়েছে। কতোকাল আগে রানার সঙ্গে একই লেপের তলায় শুয়ে আবছা আলো অন্ধকার দেখতে মিলি ঘুমিয়ে পড়তো। কতোকাল আগে, কিন্তু এখনো সব স্পষ্ট মনে পড়ে। লিলি রনির বোধ হয় জনাই হয়নি তখন। কিন্তু আজ এই লেপের ভেতর আলো ঢুকতে পারে না। নতুন তুলোতে ঠাসা লেপের ভেতর নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। অনেকক্ষণ একনাগাড়ে দেখলে লেপের পাতলা অড়ে একটি রেখা চোখে পড়ে। রোগা একটি রেখা। সেই রেখা আস্তে আস্তে হৃষ্টপুষ্ট হলে বোঝা যায় যে, সেখানে একটি স্রোতস্বিনী প্রবাহিত। স্রোতস্বিনী বেশ বেগবান, জল স্বচ্ছ ও শীতল। দুই তীরে অস্ত্রসজ্জিত দুই সারি মানুষের নিগেটিভ রেখা। তাদের স্পষ্ট রূপ দেখার জন্য সমস্ত মনোযোগ দিয়ে মিলি প্রাণপণে চেষ্টা করছে, এমন সময় শোনা যায়, ‘মিলি!’

মিলি ধরফর করে উঠে বসলো।

রানা বলে, আব্বাস পাগলার এ্যাডমিশন হয়ে গেছে। মজনু ভাই টেলিফোন করে দিয়েছিলো। গণভবন থেকে ফোন পেয়ে সাইকাট্রির প্রফেসার বলে, পাবনা পাঠাবার দরকার কী?’ প্রফেসার নিজের ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে নিয়েছে।’ মিলি চুপচাপ শোনে। তারপর রানার খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের ঘরের জানলায় এসে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপার আব্বাস পাগলার বাড়ির ছাদে শেষ দুপরের রোদ। শীত এসে গেলো। তাদের উত্তরমুখো এই স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে কয়েকটা মাস রোদ পড়বে না বলে মিলির মন খারাপ হয়ে যায়।

মিলির আজকাল জানলার দাঁড়াবার দরকার হয় না। তাকে নিয়ে তবু মনোয়ারার দুঃখের সীমা নাই। ‘সেভেন এইট পর্যন্ত পড়া ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত ম্যাট্রিক পাশ করলো। আমার রানাই কতো লোককে পার করে দিলো!’ আবার আশরাফ আলীও মিনমিন করে, ‘বি. এ. পরীক্ষাটা দেনা! রানা গ্র্যাজুয়েশনটা নিলো না, তুই একবার ফেল করে কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিলি! না হয় প্রাইভেট দে।’

পরদিন দুপুরে মিলি গেলো রেহানাদের বাড়ি। আম্মাকে বললো, ‘বইপত্রের সঙ্গে কতোদিন টাচ নেই, ওর কাছ থেকে একটু দেখে আসি।

রেহানাদের বাড়ির পথে নবদ্বীপ বসাক লেনে হালুইকরের কারখানার পেছন দিয়ে রিকশা যাচ্ছে, মিলি খুব জোরে নিঃশ্বাস নেয়, নাঃ সেই ভ্যাপসা গন্ধটা আজ নাই, কারখানার চুলায় মস্ত কড়াইতে জিলাপি ভাজা হচ্ছে, তার গন্ধ একেবারে পেটের ভেতর ঢুকে যায়, ওর একটু বমি বমি লাগে।

রেহানা বাসায় নাই। ভালোই হলো। থাকলে নাহোক ঘণ্টাখানেক তো বসতেই হতো। শীত পড়ে গেছে, হাসপাতালে পাঁচটার পর হয়তো ঢুকতে দেবে না।

ওয়ার্ডটা ছোটো। ১০/১২টা বেড হবে কি-না সন্দেহ। আব্বাস পাগলাকে দরজা থেকেই দেখা যায়। অর্ধেক-খাওয়া একটা কলা হাতে সে বারান্দার দিকে কী দেখছে। তার ঘাড়ের নিচে বালিশ। মাথা খাটের সঙ্গে ঠেকানো। কলা সে ধরেছে লাঠির মতো, আঙুলের ভাঁজ দেখে মনে হয় কলায় অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, যে কোনো সময়ে ভেতরকার শাঁস সবটাই বেরিয়ে পড়তে পারে। আব্বাস পাগলার চোখজোড়া সম্পূর্ণ খোলা, কিন্তু এখান থেকে তার চোখের রঙ অস্পষ্ট। ভেতরে ঢোকার আগে মিলি একটু ঘাবড়ে যায় এবং অস্বস্তি বোধ করে। সে একবার পেছনে তাকালো। বারান্দার রেলিঙের পর খানিকটা জায়গা ফাঁকা, তারপর হাসপাতালের প্রধান দালান। এই দোতলার বারান্দা থেকে আকাশের অনেকটা চোখে পড়ে। হাল্কা রোদে আকাশ প্রায় বর্ণহীন। শীতের শেষ দুপুরবেলায় শূন্যতা সবরকম বাহুল্যবর্জিত; শূন্যতা ও শূন্যতার গন্তব্য মহাশূন্য তাই ধারালো বর্ণহীনতায় ঝকমক করে। এই বিরান আকাশে আব্বাস পাগলা কি না লিখে ফেলতে পারে। কৈ মিলি তো পারে না! প্রায় এক মিনিট বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিলি তার টিপটিপ-করা বুক সামলে নিলো। তারপর ঘরে ঢুকে দাঁড়ালো আব্বাস পাগলার বিছানার পাশে।

‘স্লামালায়কুম। কেমন আছেন?’

‘ভালো।’ আব্বাস পাগলা একটু নড়াচড়া করে, হাতের কলার অবশিষ্ট অংশ মুখে দিয়ে জড়ানো স্বরে বলে, ‘রানার বইন না?’ খাটের নিচে থেকে টুল টেনে নিয়ে মিলি বসলে আব্বাস পাগলা বলে, ‘রানা কৈ? রানায় আহে নাই?’

‘ভাইয়ার কি আসার কথা ছিলো? আব্বাস পাগলার বহু আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি নিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো ভেবে মিলি চঞ্চল হয়ে ওঠে, ‘ভাইয়ার কিছু নিয়ে আসার কথা ছিলো কি?’

‘আরে কতো মানুষ কতো কি আনে!’ অন্য কোণে একটি বিছানার দিকে আব্বাস পাগলা আঙুল দেখায়, দশ নম্বরে এই আপেল আইতাছে, আঙুর আনে, সুপ হর্লিক্স হাবিজাবি কতো কি খায়।’

‘ভাইয়াকে কি আনতে বলবো?’ মিলির এই ব্যাকুল প্রশ্নের জবাবে আব্বাস পাগলার স্বরের ক্লান্তি কমে না, একই রকম ধুকে ধুকে সে বলে, ‘রানায় আমারে কইয়া গেলো মঙ্গলবারের মইদ্যে একদিন আইবো। কৈ? দশবারোদিন হইলো আইছি, বেটাই চুপিটাও মারলো না!’

এই কথা শুনে মিলির বুকের বল ফের ফিরে আসে; সময়ের প্রচলিত বিভাগকে লোকটা অগ্রাহ্য করে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দেড় মাস তো হবেই, দেড় মাস সময়কে একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে সে এক সপ্তাহে ছেঁটে ফেলতে পারে।

মিলি জিগ্যেস করে, ‘ওকে কিছু বলবো?’

‘কইবি না? হাসপাতালে ভাত তরকারি বহুত কম দেয়, বুঝলি?’

‘কম দেয়?’ মিলির রাগই হয়, আব্বাস পাগলার মতো মানুষ কম খেয়ে থাকবে কী করে?

‘বহুত কম। কি বালের ইঞ্জেকশন দিয়া ঘুম পাড়াইয়া রাখে, পাঁচ ছয় ঘণ্টা ঘুমাইয়া উঠি, মনে লয় কি প্যাটের মইদ্যে খালি আগুন জ্বলবার লাগছে।’

শুধু খাবার চাই? মিলি নিশ্চিত হবার জন্যে বলে, ‘ভাইয়াকে কি বলবো?’

‘আমার বহুত ভুখ লাগে রে।’ তার খালি পেট আরো ফাঁকা করে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, ‘রানায় একটা ধামকি দিলে হালারা আমার ভাতের কোটাটা বাড়াইয়া দেয়, বুঝলি না?’

এইসব শুনতে শুনতে মিলি দেখছিলো, দরজার ওপারে বারান্দা, বারান্দার রেলিঙ ডিঙিয়ে হাসপাতালের মূল দালান। এই উঁচু দালান দিয়ে মহাশূন্য আড়ালে পড়ে গেছে। না, এখানে শুয়ে সৈন্যসমাবৃত মহাকাশ দেখার কোনো উপায় নাই।

কিন্তু রাত্রিবেলা ঘুমিয়ে পড়লে আকাশ ও গ্রহনক্ষত্র জুড়ে অস্পষ্ট সৈন্যবাহিনীর সমাবেশ মিলি একটু একটু দেখতে পারে বৈ কি! আজ ভাঙা চাঁদের সঙ্গে সাঁটা গোল চাঁদের ছায়া। কোনো একটা উঁচু ছাদ কি পানির ট্যাঙ্কের মাথায় কি ক্রেনের সবচেয়ে উঁচু তাকে দাঁড়িয়ে আব্বাস পাগলা ওকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, দূর ছেমরি, ঐ তো! আরে তুই কি কানা হইলি? আরে ঐ তো ট্যাঙ্ক দেখতাছস না? চান্দ থাইকা ঐগুলি আসমানে গেলে উড়বো বুঝলি? মাটির উপরে নামলে ছুটবো, লাইক, লাইক লাইক ইলেকট্রিসিটি; ইলেকট্রিক কারেন্টের লাহান ছুটবো, বুঝলি না?’ মিলি একটু একটু দেখতেও পাচ্ছে, ঐ তো ট্যাঙ্ক। যুদ্ধের পর টিকাটুলিতে খালাম্মার বাড়ির দোতলা থেকে ওরা এইসব ট্যাঙ্ক দেখে এসেছে। তবে ঐগুলো চলে পানিতে ও ডাঙায়। আর এগুলো? আব্বাস পাগলা বলছে, ‘এইগুলি উড়াল ভি দিবার পারে, এইগুলির মইদ্যে ইবলিসের ব্রেন ফিট করা, বুঝলি না?’ ব্রেনওয়ালা সেইসব ট্যাঙ্ক মিলির চোখের সামনে স্পষ্ট আকার নিতে শুরু করেছে, এমন সময় শুরু হলো প্রবল গুলিবর্ষণ। সমস্ত আলো নিভে গেলো। কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। ইস! এই গোলাগুলির জবাব দেওয়ার মতো একটা গ্রেনেডও আব্বাস পাগলার সঙ্গে নাই। মিলির রাগ হয়, তোমাদের ঘরে ঘরে স্টেনগান এলেমজি, এসেমজি। তোমাদের পকেটে পকেটে রিভলভার, পিস্তল। তোমাদের বগলে কুঁচকিতে গ্রেনেট। একটি মাত্র অস্ত্র দিয়ে এই লোকটির হাত দুটোকে তোমরা তৈরি করতে দিলে না? দেখো কি রকম ফায়ারিং চলছে, এখন তোমরা কী করবে? —’মিলি! এই মিলি! খাট থেকে নাম, নিচে নেমে শুয়ে পড়।’ গুলিবর্ষণের প্রবল আওয়াজে আম্মার ফিসফিস কথা ভালো করে বোঝা যায় না।

মিলি উঠে বসলো। ঘর অন্ধকার। দরজা জানলা সব বন্ধ। ঘরের ওপরের দিকে ভেন্টিলেটর দিয়ে আবছা আলো আসছে, ছাদের দুই বর্গার ফাঁকে চুনসুরকি খসা একটা ছোট্টো জায়গায় পড়ে সেই আলো আর নিচে নামে নি। রনি বলে, ‘আপা, মেঝের ওপর শুয়ে পড়ো।’ লিলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘জানলার ওপারেই!’ মিলিকে কে যেন টেনে মেঝেতে প্রায় গড়িয়ে নামালো। তাদের এইসব কাণ্ড কারখানায় মিলির হাসি পায়; চাঁদে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য শত্রুসৈন্য নিচে গোলাবর্ষণ করে চলেছে, আর এরা ধরে নিয়েছে যে গুলি চলছে জানলার বাইরে গলিতে!—এদের এখন বাঁচায় কে? কানের একেবারে কাছে শোনা গেলো, ‘সরে যা, জানলা দিয়ে গুলি—। মনোয়ারার বাক্য অসম্পূর্ণ থাকে। ‘গলিতেই, না ভাইয়া?’—এবার রনির গলা। না না ভাইয়া যে বললো বড়ো রাস্তা-। লিলি শেষ করতে না করতে আশরাফ আলী সাবধান করে, ‘আঃ। বেশি কথা বলো কেন? কে কোথায় শুনে ফেলবে?’ গোলাগুলির চেয়ে আই. বি’র লোকের ভয়ে আশরাফ আলী বেশি তটস্থ। বোধহয় বড়ো রাস্তায়। রানা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে এই কথা বললো বটে কিন্তু তার চাপা স্বরে বোঝা যায় বেচারা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে। অন্ধকারে তার হাতে ধাতব অস্ত্রের শীতলতা টের পাওয়া যাচ্ছে। তার হাতের অস্ত্রের কথা কি সবাই বুঝতে পেরেছে? সেইজন্যই কি মনোয়ারা, আশরাফ আলী এবং রনি ও লিলি একেবারে চুপ হয়ে গেলো?

গুলিবর্ষণ বন্ধ হওয়ার মিনিট বিশেষ পর মনোয়ারার চাপা অনুনয় উড়িয়ে দিয়ে রানা চলে গেলো নিজের ঘরে। ওর ঘর মানে ওর বাবারও ঘর। তবে আশরাফ আলী নিজের ঘরে না গিয়ে শুয়ে থাকে এই ঘরের মেঝেতেই। ভোর হওয়ার আগে আগে আব্বা ও রানার ঘরে গিয়ে মিলি দেখে টেবিলে মাথা রেখে রানা চেয়ারে বসে রয়েছে। তার বড়ো বড়ো চুল ছুঁয়ে আলগোছে শুয়ে রয়েছে ছিদ্রওয়ালা একটা লোহার অস্ত্র। যুদ্ধের পর এই জিনিসটি নিয়ে রানা বাড়ি ফিরেছিলো। এটা নিয়ে ভাইয়া তখন কতো কথা বলতো। আর এটা এখন কোথায় রাখে, কখন লুকিয়ে নিয়ে বেরোয় কিছু জানা যায় না। ভাইয়াটা কি হয়ে যাচ্ছে কতোদিন চুল কাটে না! মিলি কি রানাকে এখন জাগিয়ে দেবে? থাক, বেচারা আরেকটু ঘুমিয়ে নিক।

সকালবেলা জানা গেলো বড়ো রাস্তার মোড়ে ব্যাঙ্ক লুট হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কের দরজায় দুটো লাশ ধুলায় লুটোপুটি খাচ্ছে।

আজকাল মিলির সারাটা সকাল কাটে রানার ঘরে। রানার চেয়ার টেবিলে সে পড়ে, রানার ও আব্বার জিনিসপত্র গোছায়, রানার স্যুটকেস খুলে মাঝে মাঝে কাপড়চোপড়ের নিচে অস্ত্রটিকে দেখে এবং মুছে রাখে। গোসলের আগে আম্মাকে একটু আধটু সাহায্য করে। রান্নাবান্নার ব্যাপারে মিলিটা আনাড়ি, কিছুক্ষণ রান্নাঘরে থাকলে আম্মা নিজেই পাঠিয়ে দেয়। দুপুরবেলা পর্যন্ত রানার ও আব্বার ঘরের বাইরে ওকে আসতে হয় না। মাঝে মাঝে মনোয়ারাকে বলে, ‘আম্মা, রেহানাদের বাড়ি যাওয়া দরকার।’ তা আজ যাবো কাল যাবো করতে করতে যাওয়ার আর দরকার হলো না।’

মার্চের প্রথমদিকে আম্মার কথা মতো মিলি লেপকাঁথা ট্রাঙ্কে তোলার আয়োজন করছে, এমন সময় দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো।

‘কেমন আছো মিলি? ভালো? ‘

ক্লিন শেভ করা গাল, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পাট ভাঙা শার্টপ্যান্টের ভেতরে আপাদমস্তক আব্বাস পাগলা।

ঝকঝকে দাঁতে সে হাসছে, ‘মিলি, ভালো আছো? রানা কোথায়?’

‘আপনি?’ মিলি বলে, ‘কবে এলেন?’

মুখের হাসি অব্যাহত রেখে আব্বাস পাগলা জানায়, পরশু দিনের আগের দিন। তোমার লগে’–এক পলক বিরতি দিয়ে আব্বাস পাগলা বলে, ‘একটু ব্যস্ত ছিলাম, তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি নাই।’ মিলি একটা মোড়া পেতে দিলে আব্বাস পাগলা প্যান্টের ক্রিজ অক্ষত রাখার উদ্দেশ্যে খুব আলগোছে বসে। বলে, ‘রানার সঙ্গে আমার দেখা হইছিলো, দেখা হয়েছিলো। তে রানায় বলে তুমি নাকি কৈ বেড়াইতে গেছো, কোথায় নাকি বেড়াতে গেছো। কথা ভালো করার জন্য আব্বাস পাগলাকে একই বাক্য দুবার করে বলতে হয়, তা কোথায় গেছিলা? কবে আসছো? এসেছো কবে?

‘না, কোথাও যাইনি তো!’

‘বুঝছি!’ আব্বাস পাগলা লাজুক লাজুক হাসে, মিলি, তুমি হাসপাতালে গেছিলা, রানা জানে না, না?’

মিলি জবাব না দিলে মসৃণ গালে একটা রঙ উপচে পড়ে। এছাড়া গালের ও ঠোঁটের কোণে গুপচিতে তার লাজুক হাসি বড়োলোকের বিয়ে বাড়িতে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে লালনীল বাল্বের মতো মিটমিট করে জ্বলে। বিয়েবাড়িতে এইসব টিমটিম করা আলোতে আকাশজুড়ে আব্বাস পাগলার দেখা ছবি সে নিজের চোখে দেখার জন্য পা থেকে মাথা পর্যন্ত গুছিয়ে নিচ্ছে।

আব্বাস পাগলা বলে, ‘মিলি, রানাকে একটু দরকার ছিলো।’

‘এক মিনিট’ বলে মিলি রানাদের ঘরে গেলে আব্বাস পাগলা বলে, বলে, ‘মিলি, এখন চা দিও না।’

মিনিট তিনেক পর শাড়ির আঁচলের ভেতর হাত গুটিয়ে মিলি ফিরে আসে।

‘রানা নাই, না? রানার সঙ্গে একটু দরকার ছিলো।’

‘এই জন্যে তো?’ আঁচলের ভেতর থেকে হাতজোড়া বের করে মিলি তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

আব্বাস পাগলা তখন মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ায়, ‘এ কী?’

মিলি দুই হাতে শিশুর মতো করে শোয়ানো স্টেনগান এগিয়ে ধরলো, তাড়াতাড়ি নিন। আম্মা এসে পড়বে।’

আব্বাস পাগলার ফিটফাট মুখ ঝুলে পড়ে, তার মুখ এখন একরঙা, মানে কেবলি কালো, তার লালনীল হাসির মিটিমিটি বাল্ব সব ফিউজড হয়ে গেছে, সে বিড়বিড় করে, মিলি আমি না ভালো হইয়া গেছি। তুমি বোঝো না? আমার ব্যারাম ভালো হইয়া গেছে।’

কিন্তু মিলির হাতের ভঙ্গি অপরিবর্তিত। সে কেবল আব্বাস পাগলার চোখ দেখছে। ঐ চোখজোড়ায় দেখা সমস্ত ঘটনা মিলি নিজে দেখতে পারলেই আব্বাস পাগলার সঙ্গে ও শত্রুপক্ষ ঠেকাবার কাজে নেমে পড়তে পারে। কিন্তু আব্বাস পাগলার চোখের বহুবর্ণ জমি ঘুমের ঘষায় ঘষায় পানসে শাদা হয়ে গেছে। তার দুই চোখের রঙ-জ্বলা কালো মণি পদ্মপাতায় জলের মতো টলমল করে— কখন পড়ে কখন পড়ে। মিলি তাই বলে, ‘ও।

‘রানারে একটু বুঝাইয়া কইয়ো। রানারা কয় বন্ধু একটা ইন্ডেটিং ফার্ম করছে। রানা ইচ্ছা করলে আমারে প্রভাইড করতে পারে।’

মিলির চোখজোড়া এখন সম্পূর্ণ হাট করে খোলা। মনে হয় চোখের গহ্বরে আব্বাস শুদ্ধ বারান্দাটা গ্রাস করে নেওয়ার জন্য মনে মনে সে মন্ত্র পড়ছে। আব্বাস মাস্টারের গা শিরশির করে ওঠে। তার সাফ-সুতরো মাথার কাঠামো একটুখানি কাঁপে। ‘মিলি, আমি ভালো হইয়া গেছি। আচ্ছা আসি।’ বলে আব্বাস মাস্টার বারান্দা থেকে টলোমলো করে নামতে না নামতে মিলি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

ঘরে এসে মিলি আধ মিনিটও দাঁড়ায় নি। ভেতরের বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে সোজা ছাদে উঠে সে দেখে যে ধোয়ামোছা মসৃণ ঘাড় নিচু করে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে আব্বাস মাস্টার। গোলগাল মুণ্ডুটা তার অতিরিক্ত নোয়ানো। এটা তার ধড়ের সঙ্গে কোনোমতে সাঁটা। তার পেছনে আর একটি মানুষ, এর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মাথাটিও সংশ্লিষ্ট ধড়ের ওপর ঢিলেঢোলা ভাবে ফিট-করা। কয়েক পা এগিয়ে গেলে এই দুটোর কোনটা যে আব্বাস মাস্টারের তা ঠাহর করা যায় না। এদের পর আর একজন পানের পিক ফেলে উল্টোদিকে হাঁটে। পরের লোকটি হাঁটে পানের পিক না ফেলে। এর পর দু’জন লোক হাঁটছে পাশাপাশি। ডানদিকেরটা চশমার ভেতর দিয়ে মিলিকে দেখতে দেখতে হাঁটে। চশমাবিহীন বাঁদিকেরটা হাঁটে মিলিকে না দেখতে দেখতে! এইসব পার্থক্যে কিছু এসে যায় না, কারণ গলির মাথায় পৌঁছবার আগেই সবগুলো মুখ একই রকম ঝাপশা হয়ে আসে। ওখানে বড়ো রাস্তায় বড্ডো ভিড়। ট্র্যাফিক পুলিসের বাঁশির সবিরাম শব্দে রিকশা, স্কুটার, হোন্ডা, কার, বাস, ট্রাক, ঠেলাগাড়ি এবং পথচারীরা সব একই তালে এবং একই গতিতে নড়াচড়া করে, একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করে সনাক্ত করা যাচ্ছে না। এ কি রঙবাজি শুরু হলো, দুপুরবেলার রোদে মানুষ ও যানবাহন ও রাস্তা ও ট্রাফিক পুলিসের দাঁড়াবার উঁচু জায়গা ও ফুটপাথ ও রেস্টুরেন্ট ও দোকানপাট ও তারের জটা-মাথায় ইলেকট্রিক পোল —সবাই মিলে মিশে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে? ওমা! এ কী ধরনের রোদ? আকাশের দিকে মুখ তুললে মিলি টের পায় যে চারদিকের বাতাস চাপা হয়ে আসছে। চাঁদ তাহলে এতক্ষণে শত্রুর কব্জায় চলে গেছে! দখলকারী সেনাবাহিনীর একনাগাড় বোমাবাজিতে চাঁদের হাল্কা মাটির ধুলা এবং বারুদের কণা নিচে ঝরে পড়েছে। রোদ ও বাতাস তাই ধোঁয়াটে ও ভারি, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বৈ কি! হাতের স্টেনগানের ইস্পাতে আঙুল বুলাতে বুলাতে পায়ের পাতায় চাপ দিয়ে মিলি আরো ওপরে দেখার চেষ্টা করে। রাস্তায় মানুষজন ও যানবাহন তো বটেই, ইলেকট্রিক তারের জটাধারী পোল এবং আশেপাশের ছাদের টেলিভিশনের এ্যান্টেনাগুলো পর্যন্ত তার চোখের লেবেলের নিচে। তবে কি-না চাঁদের রেঞ্জ এখনো মেলা দূর, ওকে তাই দাঁড়াতে হয় পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে। এতে হচ্ছে না। এবার একটা উড়াল দেওয়ার জন্য মিলি পা ঝাল্টায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *