পায়ের নিচে জল
গুড়ের চা, তবে নতুনরকম স্বাদ একটা পাওয়া যায়। কিন্তু মাথার ওপর লোক দাঁড়িয়ে থাকলে কি রয়ে সয়ে চা খাওয়া চলে? দোকানের পাটখড়ির বেড়া, খড়ের চাল, বাঁশের খুঁটি সব সরানো হয়েছে, এখন এদের চা খাওয়া শেষ হলেই বেঞ্চিটা নিয়ে যেতে পারে। সকালবেলার লালচে রোদে, পাতলা মেঘে, ভিজে ভিজে বাতাসে, যমুনার ছলাৎ ছলাৎ স্বরে শরীরটাকে তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করা যাচ্ছিলো। কিন্তু লোকজন বড়ো ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা দিয়ে এরা পানির ধার ঠেকাবে? যার মৌন তাগাদায় চায়ের পেয়ালা শেষ করে উঠে দাঁড়াতে হলো তার সঙ্গে সঙ্গী কলাগাছটার পার্থক্য কী? চালাটা ভেঙে ফেলায় দোকানের পেছনে ব্যবহৃত চা-পাতার ভাঙা-চোরা স্তূপ, জলকাদা, শ্যাওলা ও ছাইগাদার পাশে দাঁড়ানো কলাগাছের উরুটুরু সব একেবারে উদাম হয়ে গেলো; তো লোকটার এই হাটু পর্যন্ত ছিদ্রসর্বস্ব লুঙ্গি থাকলে কী, না থাকলেই কী? তবে এদের কালোকিষ্টি গতরে পানির বলো হিমের বলো, তাপের বলো, ভাপের বলো— ঠোকাঠুকি যা হয় তা ঐ হাডডি কটার সঙ্গেই। কিন্তু এখন এদের উত্তেজনা, এতো ব্যস্ততার মানে কী?—মানে জানে আলতাফ মৌলবি, ‘কামকাজ নাই তো, আজ বেলা ওঠার আগেই কাম পাছে, তাই এতো ফুর্তি, বুঝলা না?’
আতিক বুঝলো। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সোসিওলজির ভালো ছাত্র, কৃষকের কর্মসংস্থানের ওপর কোনোদিন পেপার লিখতে হতে পারে; বোঝবার জন্য সে সর্বদাই উদগ্রীব। — ৩.০০ কাঁচে ভারাক্রান্ত চোখজোড়া মেলে সে কেবল মানুষের কর্মতৎপরতা দেখে। যেদিকেই তাকাও মানুষ গিজগিজ করে। এই যে চায়ের দোকানের খুঁটি উপড়ে দিচ্ছে যে লোকটি এবং যে লোকটি কাঁধে করে সেই বাঁশ নিয়ে যাচ্ছে বাঁধের দিকে এরা কিন্তু দুজন লোক। কারো কাঁধে মুড়ির টিন কি গুড়ের জালা; আবার আটার বস্তা নিয়ে রওয়ানা হয়েছে অন্য কোনো লোক। বস্তার ফুটো দিয়ে আটা গড়িয়ে পড়ে হাড় রঙের মাটিতে আঁকাবাঁকা সাদা রেখা গড়িয়ে গেছে; হাতের তেলোয় এক আধ চিমটি আটা তুলে নেওয়ার একনিষ্ঠ সাধনায় মগ্ন লোকটি মনে হয় কোনো কাজই পায় নি যদিও বেঞ্চিকাঁধে লোকটির সঙ্গে তার চেহারার মিল দেখে দুজনকে একই লোক বলে ভুল হতে পারে। সবার ব্যস্ত গতিবিধি এবং অবিরাম চ্যাঁচামেচি এখানে একই সঙ্গে একটি মেলা ও মেলা-ভাঙার বিশ্রাম তৈরি করে। কিন্তু বাজার ভাঙা তো আর নিত্যকার উৎসব হতে পারে না। এই বাজারের আয়ু আর কতোক্ষণ? আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যমুনা কি জিভ সামলে রাখতে পারবে? যমুনাবিবির আগামীকালের মধ্যাহ্নভোজন যদি এই ভাঙা বাজার দিয়েই সম্পন্ন হয় তবে পরশুদিন এদের করার থাকবে কী? সে প্রশ্নের জবাবও আলতাফ মৌলবি ঠিকই দিতে পারবে। কিন্তু তাকে জিগ্যেস করার আগেই ওরা ওয়াপদার বাঁধে উঠে এলো।
বাঁধের পুবদিকে চাষের জমি, মাঝে মাঝে কলাগাছ ও ভেরেন্ডাগাছ ঘেরা ছোটো ছোটো বাড়ি। এখানে ওখানে খাবলা খাবলা করে ফসলকাটা পাটখেত। ধানের খেতে কাটা ধানগাছের গোড়া। জমিতে জমিতে তাড়াহুড়া করে কাজ করার চিহ্ন। কিছুদূরে গিয়ে খাড়া পাড় থেকে জমি লাফিয়ে পড়েছে যমুনা নদীতে। নদীর একেবারে ধার ঘেঁষে ঘন পাটখেত। এখান থেকে যমুনাকে অনেকটা দেখা যায় নদীর ওপরে মথুরাপাড়ার চর। এই চরও উঁচু থেকে ডাইভ দিয়ে নেমেছে নিচের বালুচরে, তারপর ঢালু হয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়েছে যমুনার পানিতে। ওপারে মথুরাপাড়া ঘেঁষে নদীর গা একেবারেই এলিয়ে দেওয়া, কিন্তু এদিকে আসতে আসতে যমুনা তার কোঁকড়া কোঁকড়া ঢেউ ঝাঁকিয়ে নিজের সীমানাকে অস্বীকার করে।
এতো হলো যমুনা, বাঁধের পূর্বদিকে। আর বাঁধের ওপর সারি সারি চালাঘর তোলা হচ্ছে। পাটখড়ির দুটো বেড়া তাঁবুর মতো খাড়া করিয়ে নিয়ে তার ভেতর মানুষ, মেয়েমানুষ, শিশু, হাঁড়ি, মাদুর, ন্যাকড়া, মাটির সানকি ও কলসি। একটি বেড়ার গায়ে বিড়ির সচিত্র লেবেল সাঁটা। এইসব ঘরের বাইরে গোরুবাছুরের সঙ্গে কিলবিল করে মানুষ। আলতাফ মৌলবি নিচু স্বরে বলে, এতোগুলো মানুষ বান্দের উপরে উঠছে, এই বান্দ থাকবো?’
আলতাফ মৌলবিকে প্রায় সবাই চেনে। কেউ সালামালকি’ বললে সে মাথা ঝাঁকায়। কাউকে কাউকে জিগ্যেস করে, ‘তর ভিটাও খাইছে?’ একটুও অপেক্ষা না করে সে এগিয়ে চলে। পেছনে পেছনে জবাব শোনা যায়, ‘কাল হামাগোরে মাঝিরা ছয় আনাই খাছে।’ কিংবা ‘উদিনক্যা শঙ্করপুর ধরছে, উত্তরপাড়ার জলিল মণ্ডলের ভিটা বাকি আছিলো, আজ বুঝি খালোই নাকি গো!’ কিংবা ‘দরগাতলার আলা ফকিরের গোইল, বাথান খাইয়া নদী এহন দম নিবা নাগছে।’ কিংবা ‘না গো, কামারটুলি ফকিরপাড়া বাদ দিয়া দরগাতলার ব্যামাক চরই বুঝি এই ফিরা থাকলো গো। নদীত মনে হয় টান পড়ছে। এদের কথা শোনার জন্যে আতিক গতি একটু কমিয়ে দিলেই আলতাফ মৌলবি অনেকদূর এগিয়ে যায়। মৌলবির পেছনে ছুটতে ছুটতে আতিক শোনে, বাঁশের খুঁটি পুঁততে পুঁততে কে একজন রসিকতা করে, আর খাবো না গো। নদী এহন জিরাবা নাগছে! বেশি খালে পরে নদীর হাগা ধরবো না?’ নদীর উদরাময়ের সম্ভাবনায় সবাই খুব হাসে। সবার মুখে মুখে এই রসিকতা প্রচারিত হতে থাকে। এক জায়গায় পেটিকোট-ব্লাউজ-পরা ২৪/২৫ বছরের একটি মেয়ে যমুনার ভাঙনে সলিলসমাধিপ্রাপ্ত তার ছেলের ৭ বছরের জীবনের নানা কাহিনী ইনিয়ে বিনিয়ে জানায়। এইসব হাস্যকৌতুক তাকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু ওদের স্বভাব আলতাফ মৌলবির ভালোভাবে জানা, সে বিড়বিড় করে, ‘শালার বেন্যার বিটির আবার ছোলপোল! আজ ময়না পাখি ময়নাপাখি করা কান্দিবা নাগছে, কালই ফির কার ঘরোত যায়া নিকা বসবো তার দিশা পাবো না। বেন্যা পুরুষদের ওপর ক্ষোভ তার আরো বেশি, ইগলান কি মানুষের পয়দা? এই যে বান্দের উপরে দাপাদাপি ঝাঁপাঝাঁপি বান্দ একবার ভাঙলে এক ঘড়ির মধ্যে থানা হাসপাতাল ইস্কুল ব্যামাক পয়মাল হয়া যাবো না?’ অতিককে ভালো করে বোঝাবার জন্য সে গতি একটু কমায়, ‘গওরমেন্ট ডেভেলপমেন্টের জন্যে এতো টাকা ঢালবা নাগছে, ব্যামাক এ্যারা সান্দাবো নদীর প্যাটের মধ্যে। —অর্থের অপচয়! অর্থের অপচয়!’ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমকে সমীহ করার জন্য আলতাফ মৌলবি শক্ত শক্ত কথা ব্যবহার করে।
এবার এই বটগাছ থেকে ছাপরার যে সারি শুরু হলো তা আর শেষ হতে চায় না। বাঁধের যতোদূর দেখা যায় দুইদিকে সাজানো শনের চাল ও ময়লা পাটখড়ির বেড়া। এই ঘরগুলো মনে হয় পুরনো। বটগাছের নিচে পুরুষমানুষের জটলা। দেখে কোনো দৃশ্য বা ঘটনা আশা করা যায়। ভিড়ের বেশিরভাগই বাঁধের ওপর, বাকিটা বাঁধ থেকে গড়ায় পশ্চিমের জমিতে। বটগাছেরও তাই—অর্ধেকটা বাঁধের ওপর, বাকিটা মাটির ওপর ঝুলছে। গাছের শেকড়ে পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে অন্তত ১০ জন। আলতাফ মৌলবিকে দেখে তাদের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে যায়। যারা বসেছিলো তাদের প্রায় সবাই উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে-থাকা লোকেরা এগিয়ে আসে।
কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত লুঙির একটি টুকরা জড়ানো এবং ব্লাউজ পরা, থুতনিতে কয়েকটি মাত্র দাড়িওলা একটি লোক সামনে এসে বলে, ‘আপনের গজারিয়ার পাট জাগ দেওয়া শুরু করছেন?’
‘গজারিয়া?’ আলতাফ মৌলবি একটু চিন্তা করলো, দুই একের মদ্যেই দেওয়া নাগবো।
ব্লাউজ পরা দাড়িওয়ালা লোকটির চোখ ও ঠোঁট কাঁপে, বলে, ‘আমাক না কিষ্যাণ নেওয়ার কথা কছিলেন হুজুর।’
আলতাফ মৌলবির চাপ দাড়ির ভেতর থেকে হাসির রশ্মি উদিত হয়, ‘তোমাক কই নাই, কছিলাম তোমার ব্যাটাক। তুমি বাপু বুড়া মানুষ হয়া বিটিছোলের পিরান গাওত দিছো, তোমাক দিয়া কাম হবো?’
এই কথায় সবাই হাসে, মাত্রা ছাড়িয়ে হাসে এবং তাতে কাজ হয়; আলতাফ মৌলবি খুশি হয়ে চাপা ঠোঁটজোড়ায় ঢেউ তুলে রাখে। ব্লাউজ পরা দাড়িওয়ালা তখন তোতলায়, ‘উদিনক্যা গোলাবাড়ির হাটোত থ্যাকা কিনল্যাম বাপু। একটা ট্যাকা নিলো। হামরা বাপু অতো বুঝি?’
‘চেংটুর দুই ব্যাটা আর এক ভাতিজাক বছর-কিষাণ রাখছি, গজারিয়ার পাটের তয়তদবির করবো তারাই।’ আলতাফ মৌলবি তার কথার জবাব দিচ্ছে এতোক্ষণে, ‘তোমাগোরে বাপু ঠিকমতোন পাওয়া যায় না। গাওত ব্লাউজ দিছো, নাচের বায়না নিয়া কোর্টে যাবা কেডা জানে?’ এবার এদের হাসি তেমন জমে না।
অন্য একজন বলে, ‘চাচামিয়া, দেলুয়াবাড়ির আউশ কাটেন না?’
‘আর কয়টা দিন যাক। আল্লা বাঁচায়া রাখলে শুক্কুরবার দিন কাটা হবো।’
‘আমাক একটা সোম্বাদ দিয়েন।‘
‘দেখি। আলতাফ মৌলবির এই জবাব শোনবার সঙ্গে সঙ্গে ১০/১২ জন তাকে ছেঁকে ধরে। এই ১০/১২-র বৃত্তের বাইরে আরো ১০/১২ জন। ২০/২৫ জনের প্রধান আকর্ষণরূপে আলতাফ মৌলবি তার সাদা রঙের ময়লা পাঞ্জাবি, সবুজ-হলুদ ডোরাকাটা লুঙি, অল্প কারুকাজ-করা কিস্তি টুপি এবং মেহেদি লাগানো ইটরঙের দাড়ির সাজসজ্জায় নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার একটি সুযোগ পায়। বটগাছের ওদিকে নতুন চালের সারির দিকে সে তর্জনী দিয়ে দেখায়, ‘অরা না হয় নদী ভাঙা মানুষ, তোরা?’ তার বিড়বিড় নালিশ এখন পরিণত হয় স্পষ্ট অভিযোগে, ‘তিনটা বছর আগে বান্দের উপরে উঠলি, তগো নামাবো ক্যাডা? এই বান্দ ভাঙলে নোকসান কার? নদীর মাথাও ঘুরান দেওয়া লাগবো না, এ্যাল্লাখানি হাত-পাও মোচড়ালেই ভাঙা বান্দ দিয়া পানি ঢুক্যা পশ্চিমমুড়ার তামাম গাঁও তলায়া দিবো না? থানা হাসপাতাল ইস্কুল কিছু থাকবো?’ কিন্তু এই সব আতঙ্ক তাদের স্পর্শ করতে পারে কি-না সন্দেহ। তার আক্ষেপ ও উদ্বেগ শুনতে শুনতে তারা আলতাফ মৌলবির বিভিন্ন জমির শস্যের অবস্থা সম্বন্ধে রিপোর্ট ছাড়ে। আলতাফ মৌলবির হাঁসখালির ডাঙা জমিতে একটা শেষ-নিড়ানি দেওয়া খুব জরুরি। তার দেলুয়াবাড়ির আউশের খেতে ধান কাটার সময় প্রায় যায় যায়। আয়েন শেখের বাড়ির পৈঠা পর্যন্ত পানি এসেছে, নৌকায় এ-বাড়ি ও-বাড়ি করার সময় তারা আলতাফ মৌলবির ধানখেতের শোভা দেখে, ‘আহা কি সোন্দর লকলক করব্যা নাগছে গো!’ আবার মরিচা গ্রামে নতুন বাতাসে ও পানিতে আলতাফ মৌলবির পাট বেড়ে উঠছে হু হু করে, দেখে তাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। সপ্তাহখানেকের মধ্যে ঐ পাট কাটা চলবে, তা আলতাফ মৌলবি লোক নেবে না?
কিন্তু আলতাফ মৌলবির বছর-কিষাণই খাটে জনা সাতেক, আশে-পাশের খন্দ তারাই দেখবে। আর হাসখালির জমি নিয়ে তার মাথাব্যথা কম; সেই জমিতে এবার বাছপাটই বেশী। দেলুয়াবাড়িতে তার শ্বশুরবাড়ি, সেখানে জনমঞ্জুর খাটাবার দায়িত্ব তার সম্বন্ধী ল্যাংড়া সোনা কাজীর। আলতাফ মৌলবির মনোযোগ এখন বাঁধের নিরাপত্তার দিকে। সুতরাং দুই পক্ষ কেবল নিজেদের কথা বলতে বলতে এবং পরস্পরের কথায় কান না দিতে দিতে বাঁধের পশ্চিমে নামে।
বাঁধের পশ্চিমে নিসর্গ কিন্তু আলাদা। এপারে খুব পুরনো গ্রাম, এপারে তাই অন্যরকম। মানে যেমন হওয়া উচিত— ছবিতে ফিলো কবিতায় যেমন পাওয়া যায়—শস্য-শ্যমল ছায়া-সুশীতল বাঙলার গ্রামখানি। মাতৃসম গ্রামবাঙলার এই অপরূপ রূপ দর্শনে চোখজোড়ার প্রত্যেকটি জুড়িয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু ২০/২৫-এর সেই দঙ্গল আর পিছু ছাড়ে না। প্রকৃতির রূপ তেতো করার জন্যে এই সংখ্যাটি যথেষ্ট। আলতাফ মৌলবি শেষপর্যন্ত কষে ধমক লাগায়, ‘আল্লায় তগো এক ছটাক বুদ্ধি দেয় নাই, জাহেল করা রাখছে। কও তো জাহেলে জানোয়ারে তফাৎ কী? কও সে!’ নিজেই এই জটিল প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্যে সে একটু দাঁড়ায়, ‘না, জাহেলের পাও দুইখানা কম, সেদিক দিয়াও তরা কমই আছস। তিনটা বছর তরা বান্দের উপরে বসত করস, আরে, বান্দ ভাঙলে গওরমেন্টের কি রে? যমুনা যদি একটা ছোবল মারে তো থানা এটি থাকবো? সোনাতলাত তুল্যা নিয়া যাবো না?’
একজন দুজন করে সবাই সরে পড়লেও আলতাফ মৌলবির রাগ আর কমে না। একি ২/১ মাসের ব্যাপার? বাঁধের ওপর এরা নিয়মিত বসবাস শুরু করেছে সে ৩ বছরের বেশি ছাড়া কম নয়। তখন কি হলো? –আরে তখন নদীর ভাঙন নাই, বন্যা নাই, গোর্কি নাই—আকালের সময় কোনদিক থেকে কী হলো আশপাশের গ্রাম উজাড় করে মানুষ এসে বাঁধের ওপর মাইলকে মাইল জায়গা ভরে ফেললো। আলতাফ মৌলবির হাঁসখালির জমিতে বর্গা করতো এক শালা চাষা, ঝরু পরামাণিক। আলতাফ মৌলবিকে একটা কথা জিগ্যেস পর্যন্ত না করে নিমকহারামটা তার সর্বমোট সোয়া বিঘা জমি বেচে উঠে এলো বাঁধের ওপর। কোথায় হাঁসখালির পানধোয়া বিলের পাশে আলতাফ মৌলবির ডাঙা জমির ধার ঘেঁষে ছিলো তার গোপালভোগ আমের গাছ ও খাজা কাঁঠাল গাছওয়ালা জমি, ভালোভাবে চাষ করতে পারলে বছরে তিনটে ফসল: কোন ছোটলোকের কাছে সেসব বেচে শালা এখন বাঁধের স্থায়ী বাসিন্দা। পাটখড়ির তিন-কোণা খুপরির মধ্যে এখন বাপে ঝিয়ে মায়ে বেটায় দিনরাত গুয়েমুতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। আরে ইগলান কি মানুষ? তিনটা বছর হয়া গেলো বান্দের উপরে কি জুলুমটা করব্যা নাগছে কও সে!’ আলতাফ আলীর একটানা কথা গরমে ঘামাচির মতো কুটকুট করে, ওয়াপদার বাঁধে মানুষের বেআইনি বসতি এবং এই নিয়ে আলতাফ মৌলবির বিরামহীন ঘ্যানঘ্যান করা— আতিকের কাছে দুটোই বিরক্তিকর। জুতো হাতে হাঁটু পানির ছোট্টো একটি সোঁতা পার হবার সময় আতিকের ভ্রূজোড়া কুঁচকে আসে, পানি বেশ গরম। গরম নীল আকাশ থেকে ছুঁয়ে পড়ে শ্রাবণ মাসের রোদ; মাটিতে, আউশের খেতে জমে থাকা পানিতে আঠালো গরম। গোরুর গাড়ি চলার মতো চওড়া রাস্তার ধার ঘেঁষে বাঁশঝাড়, দড়ি বাঁধা ছাগল, বেগুনখেতের পেছনে জবুথবু হয়ে দাঁড়ানো খড়ের দোচালা। ফের বাঁশঝাড়, পার হলে একটা বাঁক। বাঁশঝাড় পেরিয়ে আলতাফ মৌলবি বলে, ‘হুঁ আছে।’ আরো দু’পা হেঁটে বাঁক পেরোলেই চোখে পড়ে গোরুর গাড়ির চাকার দাগ চিহ্নিত আধশুকনা কাদার পাশে ঘাসের চাপড়ায় দাঁড়িয়ে পাকা দাড়িওয়ালা একজন লোক রাস্তার ওপারে তাকিয়ে কার উদ্দেশ্যে বকাবকি করছে। ওপারে জলমগ্ন জমি। জমির পর পাটখেতে পাট-কাটা চলছে। পাটখেত ঘেঁষে ৭/৮ বছরের একটি ছেলে লগি হাতে কলার ভেলা বাইছে। বুড়োর ভরাট কিন্তু দুর্বল স্বর কি বর্ষার পানি পেরিয়ে ভেলায় ঠেকবে?
ওরা আর একটু এগিয়ে গেলে বুড়ো জিগ্যেস করে, ‘ক্যাটা গো?’ তার খালি গায়ে গা জুড়ে ছড়ানো লোমরাজি, কালোর ওপর তামাটে সাদা, তার লুঙি থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, কাঁধে গামছা। লালচে, ঘোলাটে ও বিভ্রান্ত চোখ এদিক-ওদিক করে লোকটা ফের বলে, ‘ক্যাটা?
জবাব না দিয়ে আলতাফ মৌলবি তার কুশলে আগ্রহ প্রকাশ করে, ‘সাকিদারের বেটা, ভালো আছো?’
‘আল্লায় রাখছে বাবা।’ বলে আলতাফ মৌলবির মুখমণ্ডলে সাকিদারপুত্র তার ঘোলা চোখের মণি বিঁধে দেওয়ার জন্য একাগ্রচিত্ত হয়। একটু পর তার চোখের রেটিনাসমূহ শিথিল হয়, খাঁ বাড়ির আলতাফ ভাই না? তাই তো কই! চোখেত ভালো দেখি না বাপু। দুই হাত আড়াই হাত তফাৎ থ্যাকা মানুষ চিনব্যার পারি না। কথা বলতে বলতে তার সৌজন্যবোধ জাগে, ‘সালামালেকুম হুজুর, সাথে ক্যাটা?’ দীর্ঘ সংলাপের পর তার চোখের রেটিনা ফের সঙ্কুচিত হয়।
‘ভালো করা চায়া দেখো।’ আলতাফ মৌলবি রসিকতার ভঙ্গি করে। তারপর এক মুহূর্তে কণ্ঠের রস নিঙড়ে ফেলে সাদা গলায় বলে, ‘করিম ভায়ের বেটা। বড়ো মিয়ার নাতি।’
চোখে ছাইরঙের পুরু ছানি পড়ায় তার আড়ালে তরল মণির কাঁপাকাঁপি বোঝা যায় না। মিনিটখানেক সে একটি কথাও বলে না, তার শরীরের অবস্থান যেমন ছিলো তেমনি থাকে। এমন কি তার শ্বাস প্রশ্বাসের স্পন্দন পর্যন্ত প্রায় স্থগিত। কথা বলতে হয় আলতাফ মৌলবিকেই, ‘ক্যাগো, টাসকা ম্যারা গেলা?’ কিসমত সাকিদার বোবা চোখে তার দিকে তাকালে আলতাফ মৌলবি জিগ্যেস করে, ‘খন্দ তো ভালোই, না?’
‘আল্লায় দিলে ভালোই হজুর।’ বলতে বলতে কিসমত সাকিদারের চমক ভাঙে, কিম্বা চমক ভেঙে সেই কথা বলে। হঠাৎ করে তার ডাকাডাকি শুরু হয়,
‘আকালু, আকালু! ক্যারে আকালু! আসমত, আসমত! ক্যারে সোটকা, তোরা সব কোটে গেলু রে? আকালু। এইসব হাঁকডাক আতিকের সর্বঅঙ্গে দমাদম ঘা দিতে শুরু করলে সে বিচলিত চোখে সামনের দিকে তাকায় : পাটখেতে গরম পানির ওপর ঘামের গন্ধে ভারি চটচটে বাতাস। গরম হাওয়া এসে পাটখেতের সবুজ পাতা উসকে দেয়, ধোঁয়ার মধ্যে শিখার মতো পাটপাতা লকলক করে বাড়ে। কিসমত সাকিদারের এই ভাঙা গলার ডাকে তাদেরই জমির বর্গাচাষীর দল কি এসে পড়লো? চারদিকের পোকা কিলবিল করা পানি, বড়ো কোনো পোকার রোঁয়াওয়ালা ডানার মতো পাটপাতা, রাক্ষুসে শুঁয়োপোকার মতো আউশ ধানের শীর্ষ এবং কালচে সবুজ, ঘোলা নীল ও ঈষদুষ্ণ কাদাকাদা মাটির মধ্যে নিজের নিশ্চল ও স্থায়ী অবস্থানের সম্ভাবনায় আতিক শরীরের শিরা-উপশিরা আঁটোসাঁটো করে দাঁড়ালো।
‘আকালু, ক্যারে আকালু, সায়েবের বেটা আসছে রে! পিঁড়া নিয়া আয়। তাঁই খাড়া হয়া থাকবো? বসব্যার দে। বিরিঞ্চি নিয়া আয়।’
কিসমত আলীর দীর্ঘ নির্দেশ শেষ হওয়ার আগেই আতিকের মাংসপেশী ও শিরাউপশিরার গেরোগুলো খুলে যায় এবং এই লোকটিকে ভয় পাওয়ার লজ্জায় সে কাচুমাচু হয়।
‘সালামালেকুম চাচামিয়া।’ সামনের জলমগ্ন মাঠের ওপার পাটখেত থেকে এসে পড়ে লম্বা ও রোগা একটি যুবক। পানিতে ভিজে ভিজে তার শরীরের রঙ জ্বলে গেছে, সে কালো না ফর্সা না শ্যামলা না নীল না সবুজ না হলুদ বোঝা মুশকিল। হাঁটুর ওপর তার একটি ভিজে গামছা, পায়ের আঙুলে আঙুলে পানির কামড়ের দাগ। ‘সায়েবের বেটা না?’ বলতে বলতে যুবক কলাপাতার পর্দার আড়ালে চলে যায় এবং এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসে। তার হাতে ছোট্টো একটা বেঞ্চ। বেঞ্চের পাগুলো সব বাঁশের, বসার জায়গাটা ভারি কাঠের। বেঞ্চটাকে সে কাঁধের গামছা দিয়ে ঝাড়লো অন্তত ৫ বার। আতিক ও আলতাফ মৌলবির মুখোমুখি মাটিতে বসলো কিসমত সাকিদার। বড়ো একটা জামগাছের নিচে বাঁশের মাচায় কোমর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই রঙ-জ্বলা যুবক নিজের অনাবৃত বুকে গামছা দিয়ে হাওয়া করতে লাগলো।
উঁচু ও সাদা দাঁত বের করে সে হাসে, ‘ভাইজানোক দেখ্যাই আমি চিনছি। ঠিক সায়েবের মুখখান পাইছে।’
‘আগে দেখস নাই?’ কিসমত সাকিদারের এই প্রশ্ন করার কোনো মানে হয় না; তার সঙ্গেও আতিকের এই প্রথম দেখা।
‘না, আগে মনে হয় কুনোদিন আসে নাই।’
‘আপনারা আসেনই না।’ এই অনুযোগ করতে গিয়ে দ্বিতীয়বার কিসমতের চমক ভাঙে। ‘পান খান বাবা’ বলে ভেতরের দিকে মুখ ফিরিয়ে সে চিৎকার করে, ‘ক্যাগো, পান দিল্যা না?’ তিন হাত দূরে ঘর, এতো চ্যাঁচাবার দরকার কী? ‘আকালু, পান নিয়া আয়।’
যুবক উঠে গিয়ে মাটির থালায় পান, শুপারি, চুন ও তামাক-পাতা নিয়ে এলে কিসমত পান সাজতে শুরু করে। বাপদাদার ভিটা ভুল্যা গেলেন বাবা? আপনের বাপের হাতোপায়োত ধরা এই কয় বিঘা জমি আটকালাম। তো আপনের বাপ কলো, সাকিদার, বেচব্যার যখন তুমি দিল্যাই না তো দেখাশোনা তোমাকই করা নাগবো।’ কিসমত তামাক পাতার অনেকটা ছিঁড়ে মুখে পোরে, একটু জড়ানো স্বরে আক্ষেপ করে, তাঁই তাও বছর দুই বছর অন্তর একআধবার আসছে, গাঁয়ের সাথে আপনেরা কুনো সম্পর্কই থুলেন না।’
গ্রামের ওপর আলতাফ মৌলবিও বড়ো অপ্রসন্ন, ‘গাঁওত অ্যাসা লাভ কী? টাউনেত গেছে যারা, ব্যবসাপাতি করা হোক চাকরিবাকরি করা হোক, তারা সর কতো কি করা ফালালো, ছোলপোলেক মানুষ করলো। আমাগোরে কি হলো?’ গ্রামের মানুষের ওপর সে আরো বিরক্ত, ‘গাঁও গিরামত মানুষ থাকে না বাপু! জাহেল মানুষের সাথে বাস করার মুসিবত কি একটা?’ নিজের কথার তাপে আলতাফ মৌলবি নিজেই তেতে ওঠে, ‘তোমরা বাপু এই গাঁও গিরাম ব্যামাক ভাসায়া দেওয়ার বন্দোবস্ত করব্যা নাগছো, না কি?’
‘জে?’ আলতাফ মৌলবির অভিযোগের কারণ বা বিবরণ না শুনেই কিসমত অপরাধে একেবারে নুয়ে পড়ে, মাথা পেতে শাস্তি নেওয়ার জন্য সে প্রস্তুত। ‘বোঝো না?’ রাগে ও উৎসাহে আলতাফ মৌলবি সোজা হয়ে বসে, ‘বান্দের উপরে জুলুম দ্যাখো না? তিনটা বছর হয়া গেলো শয়ে শয়ে ঘর-বাড়ি করা বাস্তু গ্যাড়া বসছে। আর বছর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার না ওয়ার্নিং দিয়া গেলো মানুষ না নামলে বাঁধ থাকবো না! কয়দিন হলো আবার নদী-ভাঙা মানুষ আসা ধরছে। ঠ্যালা সামলাও!’
‘নদী-ভাঙা মানুষের কথা কি আর কই বাবা?’ আলতাফ মৌলবির এক কথাতেই কিসমত তার অজ্ঞাত অপরাধ মেনে নিয়েছিলো, কিন্তু অভিযোগের স্পষ্ট বিবরণ শোনবার পর সে কিছুমাত্র বিচলিত হয় না, ‘আমরাও তো বাপু নদী-খাওয়া মানুষ। বাপু, যমুনা হলো বড়ো গাঙ, ব্রহ্মপুত্রের পরিবার। ময় মুরুব্বি কইছে, যমুনার সাত স্রোত, ঊনপঞ্চাশ তরঙ্গ –তো তার খোরাক লাগে না? বাপদাদার আমলে দুইচার বিঘা যা পাছিলাম তাও তার খোরাকেতেই গেছে। এখন আপনাগোরে জমিত খাটি, ছোলপোলগুল্যান খাটে, আল্লা কুনোমতে দিন চালায়া নেয়।’
এইখানেই তো মুশকিল, আতিক এই ভয়টাই করছে। আলতাফ আলী রাতে সব বলেছে। এইসব লোকজন দিনদিন বড়ো আনরিজনেবল হয়ে উঠছে। কিসমত সাকিদারের জোয়ান জোয়ান সব ছেলে। মুক্তিযুদ্ধে খতম হয়েছে একটা, আর একটা ধান কাটতে গেছে পশ্চিমে খিয়ার এলাকায়। দুটো আছে বাপের সঙ্গে। এদের একটি বাতে পঙ্গু। শেষ সন্তান আকালু বাপের সঙ্গে আতিকদের জমি চাষ করে। এই জমি থেকে ওদের উচ্ছেদ করা একটু কঠিন বৈ কি! এই ঝুঁকি কভার করার জন্যে আলতাফ মৌলবি দামও কিছু কম দিতে চায়। মৌলবির দ্বিতীয় শর্ত হলো এই যে আতিককে নিজে গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। জমি বেচে তো ওরা খালাস, জীবনে কি আর এমুখো হবে? সব সামলাতে হবে এই আলতাফ আলী খানকেই। গত কয়েক বছরে গ্রামে মেলা রক্ত বয়ে গেছে, ভদ্রলোকদের মান-ইজ্জত সব ধুয়ে মুছে সাফ।
কথাটা পাড়বে কী করে? আতিক কি আর করে, ওপরের দিকে তাকায়। খড়ের চালে চালকুমড়া, জামগাছ ভরা কালোজাম। নিচে খুঁটিতে বাঁধা গোরু অল্প পানিতে দাঁড়িয়ে ছপছপ করে ঘাস খাচ্ছে। এখন সে কি করে জমি বেচার কথা তোলে? তবে কথা বলার পালা এখন কিসমত সাকিদারের।
‘তোমরা বাপু আসোই না। তোমার বাপ এই খুলিত বস্যা কতো গল্প করা গেছে। যখন হাই ইশকুলেত পড়ছে বর্ষার সময় ঐ ওটি বস্যা বড়শি দিয়া মাছ ধরছে, বানায়া দিছে।’ কথার ভারে সে নুয়ে পড়ে, আমার বাজান চার তুমি-আপনির ভেদ লোপ পায়, শ্লেষ্মা ও আবেগে কিসমতের গলার ঘর্মর ধ্বনি আরো ঘন হয়। এটি বস্যা মাছ ধরছে, আমার মায়ের কাছ থ্যাকা পানি চা নিয়া খাছে। তার কুনো দেমাগ আছিলো না, গরিব মানুষকে তাই হেলা করে নাই। টাউনেত বাড়ি করার পর বাড়িতে অ্যাসা কতো দরবার, কতো গল্প, কতো হাসি ঠাট্টা। ভাইজান একখান মাটির মানুষ আছিলো।’
শুনতে শুনতে আতিকের মুখে ও কপালে পাতলা ভাপের পরত জমে, বাপের স্মৃতি তার মাথা থেকে চুলের মতো বেরিয়ে চোখমুখ সব ঢেকে ফেলবার উপক্রম করে।
‘ভাইয়ের নাহান মানুষ হয় না গো! ফসল তুললে বেচ্যা ট্যাকা পাঠায়া দিছি, ফসল নিবার চায় নাই, জোর করা সাথে একবার গম দিছিলাম, কল্যাম, ভাইজান আপনের কি, মটোরেত যাবো, গাড়িত যাবো, আপনাক কি উব্যান লাগবো? দুই বছর অন্তর অ্যাসা কয়, এই খুলিত বস্যা, এই এটি,’ আতিকের বাবার আসল অবস্থান ঠিক কোথায় ছিলো অবিকল তাই দেখাবার জন্যে কিসমত উঠে সরে বসে, ‘না গো এটি, এবিন করা পুব মুখ হয়া বস্যা কয়, সাকিদার, তুমি কি গম দিছিলা গো, আটা হচ্ছে ময়দার নাহান, ধলা ফকফকা। তোমার ভাবী ঠাওরাবার পারে না আটা না ময়দা। ছোলপোল রুটি খায়া কি খুশি।’ আলতাফ মৌলবির দিকে জিজ্ঞসার ঢঙে বলে, কন তো বাপু, নিজের ভিউয়ের গম, তা আটার রুটি স্বাদ হবো না? কন তো বাপু স্বাদ হবো না?’ বিরতি দিলেও তার ফাঁক করে রাখা মুখের ভেতর হলদেটে সাদা জিভের অনেকটা দেখা যায়, তার নিজের জিভে সে কি আতিকের বাবা ও আতিকের বাবার ছেলেমেয়েদের রুটি খাওয়ার স্বাদ অনুভব করার চেষ্টা করছে? নিজেদের জমির গম হলে কি রুটির স্বাদ বাড়ে? আব্বা কি কখনো বলেছিলো? আম্মা কি জানতো? কৈ, কবে?
জিভে অন্যলোকের রুটি খাওয়ার স্বাদ চাখার খাটনিতে কিসমত আলী হাঁপায়। একটু নিচু স্বরে বলে, ‘বানে খরায় খন্দ মাইর গেলে কাকো দিয়া এখখান পোস্টকার্ড ল্যাখায়া দিছি, সায়েব, এবার বানে ধান খাছে, কি খরা হচ্ছে, খন্দের সোমাচার ভালো নয়, সায়ের কুনোদিন তদন্ত করবার আসে নাই।’
তদন্ত করার লোক তো ছিলোই, আতিকদের কিছু জমি তো আলতাফ আলীও দেখে, সুতরাং কিসমত আলী এদিক-ওদিক কিছু করলে আলতাফ মৌলবি কি আর খবর পাঠাতো না? এই জমিটা বর্গা নেওয়ার ইচ্ছাও তার অনেকদিনের। এই জমির সঙ্গে লাগোয়া বিঘা পাঁচেক জমি আছে তার, এটা নিতে পারলে এক দাগে অনেকটা জমি হয়। এই নিয়ে আলতাফ মৌলবি ঢাকায় গিয়ে আতিকের মায়ের কাছে তদবির করেছে। আব্বা রাজি হয় নি, ‘চাষাটা তবু টাকা পয়সা যা হোক কিছু পাঠাচ্ছে, আলতাফকে দিলে প্রথম কয়েক বছর খুব রেগুলার দেবে, এমন কি বেশিও পাঠাতে পারে, তারপর তোমার জমির আর কোনো ট্রেস করা যাবে না। ওকে যেগুলো বর্গা করতে দিয়েছি তাও হজম করে ফেলবে।’ আব্বা লোক চিনতো। যাকে বিশ্বাস করলে রিটার্ন আসে তার ওপর আব্বার আস্থা ছিলো অপরিসীম। এই বুদ্ধি না থাকলে সিভিল সাপ্লাইয়ের চাকরি ছেড়ে এক হাতে এতো বড়ো ইন্ডেন্টিং বিজনেসের ফার্ম করতে পারে? তবু মনে হচ্ছে কিসমতকে আব্বা একটু বেশি পাত্তা দিতো! আব্বাকে যে রকম র্যানডম কোট করছে তাতে মনে হয় আব্বার সঙ্গে লোকটার বিশেষ রকম একটা সম্পর্ক ছিলো। কিসমতের অবিরাম স্বরপ্রবাহে তার বাবা যেভাবে আসছে মনে হয় পাতলা একটি পর্দার ঠিক ওপারেই তার অবস্থান। আব্বা বোধহয় এক্ষুনি উঠে এসে এই বেঞ্চে বা ঐ মাচায় বসে পড়বে। মনে হচ্ছে এখানে আর কেউ নাই, এমন কি আতিকও অনুপস্থিত, সে বড়োজোর বসে থাকতে পারে এই জামগাছের একটি মগডালে। নিচে বসে থেলো হুঁকায় তামাক টানতে টানতে গল্প করছে তার বাবা। আতিক জাম খেতে খেতে কিসমতের সঙ্গে আব্বার গল্প করা শোনে। দুজনের কথকতা একটুও বিঘ্নিত হয় না, আতিকের জামের বিচি হাওয়ায় উড়ে যায়। ছানির পুরু পর্দা ছিঁড়ে কিসমত আলীর তরল মণি টলটল করে। এই ছানি-ঢাকা চোখ, জলে -খাওয়া পুরু আঙুল, পাতলা নোনা-ধরা চুল—না, এসব থেকে আতিক হাতপা বেড়ে উঠতে পাচ্ছে না। অথচ জমি বিক্রি না করলেই নয়। আতিকের যখন এরকম একটা সঙ্কট চলছে, লোকটা বললো, ‘চাষাভুষার বাড়িতে আসছো, একটা আবদার রাখা নাগবো।’ আবদার বলতে কি বোঝানো হচ্ছে অনুমান করার আগেই সে আতিকের হাত ধরে, ভাত খায়া যাওয়া নাগবো বাবা।’
এইবার সুযোগ। হাত পা ঝেড়ে আতিক এবার মুক্ত হতে পারে। না না, আজ না।’ মিনতিতে লোকটি বাঁকা হয়ে যায়, ‘না বাবা আজই। বেলা গেছে কোটে!’ বলে সে আঙুল দিয়ে সূর্য দেখায়, ‘দেবডাঙা যাবা, এক কোশ দূরের ঘাটা, যাতে যাতে প্যাট খোলের মধ্যে সান্দাবো। বাড়িত যায়া না হয় চাচীর হাতোত পোলোয়া কোর্মা খাবাহিনি। হামার এটি এ্যানা শুদা ভাত খায়া যাও।
‘ভাইজান, মেয়েলি বিনয়ে আকালু নত হয়, গরিব মানুষের বাড়িত আসছেন, উপস্থিত মতো যা আছে তাই দিয়া খায়া যান। গরিব মানুষকে হেলা করেন না। থালিবাসন যা আছে ম্যাঞ্জা ঘয্যা দিমু।’
এরপর না করা মুশকিল, তবু আতিক উঠে দাঁড়ায়, ‘না, আজ না, আজ একটু তাড়া আছে।’ কিসমতকে এবার সোজাসুজি বলার প্রস্তুতি নেয়, ‘আপনার সঙ্গে একটু কাজ ছিলো—’। মাঝপথে আলতাফ মৌলবি তাকে থামিয়ে দিলো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কিসমতকে সে বলে, ‘ঠিক আছে, সাকিদারের জেয়াফত কবুল না করলে চলে? তোমরা খাবার জোগাড় করো। আমি বান্দের গোড়াত করিম ভায়ের হাটিকুমরুলের জমিটার একটু খবর নেই।’
হাতে একটা পলো নিয়ে বেরিয়ে যায় আকালু, আতিকের দিকে সে মিষ্টি করে একটু হাসে। আলতাফ মৌলবি এরপর আতিককে আড়ালে ডাকে, তুমি বসো, গল্পগুজব করো, আমি এক ঘণ্টা দেড় ঘণ্টার মধ্যে আসতিছি। জমি বেচার কথা কিছু করো না, আমি আসলে কথাবার্তা হবো।’
জমি বিক্রির কথা বলা আতিকের পক্ষে এখন অসম্ভব। বড়োভাই মেজোভাই কি যে একটা কাজের ভার দিয়ে এখানে পাঠালো। আর এই আলতাফ মৌলবির ওপর নির্ভর না করে উপায় কী? এই লোকটার গার্জেনি আর কতোক্ষণ সহ্য করা যায়? মেজোভায়ের কথা সব কাঁটায় কাটায় মিলে যাচ্ছে। ১৯৬৪ সালে মেজোভাই একবার এখানে এসেছিলো, আতিক তখন স্কুলের ছাত্র। ১৯৭১-এ সবাইকে নিয়ে এখানে পালিয়ে আসার কথা ভেবেছিলো। তুখোড় বাম যুবনেতা বলে বড়োভাইকে তখন পালাতে হলো কলকাতা। তার শোকে আম্মা একেবারে ভেঙে পড়লে আর কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় নি। তো একবারের অভিজ্ঞতা থেকেই মেজোভাই কি চমৎকার ব্রিফ করলো, গ্রামের সলভ্যান্ট আর এডুকেটেড হাফ-এডুকেটেডদের সঙ্গে ডিল করা সবচেয়ে টাফ। আনফরচুনেটলি অল অফ আওয়ার রিলেটিভস্ বিলং টু দিস সেকশন এ্যান্ড দে ফর্ম দি রুলিং এলিট। একটু কেয়ারফুল থাকতে হবে।’ আলতাফ মৌলবির কাছে সব জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত অবশ্য বড়োভায়ের। জমি কিনে সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ ছাড়তে পারবে এই মোল্লা বেটাই। তার এক ছেলে ডিস্ট্রিক্ট ফুড অফিসের ক্লার্ক, আব্বার রেকমেন্ডেশনে চাকরি হয়েছিলো, আর এক ছেলে রিসেন্টলি মিডল ইস্ট গেছে। তবে—এই তবেটাই তো আতিকের মাথাব্যথা টু হ্যান্ডল উইথ কেয়ার।’ ট্যাটফুল হতে হবে। মুশিকল! কিন্তু টাকারও খুব দরকার। ধানমণ্ডির বাড়ি তিনতলা করতে হবে, টাকা চাই। গুলশানের প্লট আর কতোকাল ফেলে রাখবে—টাকা চাই। মেজোভাই ইকনমিকস পড়ার জন্যে হার্ভার্ডে এ্যাডমিশন পেলেও স্কলারশিপের নিশ্চয়তা নাই, টাকা চাই। এখন টাকা সংগ্রহের এই তেতো কাজটা করতে হবে আতিককে 1 গুলশানের প্লটে কনস্ট্রাকশন শুরু করার জন্যে বড়োভাই হন্যে হয়ে উঠেছে। কোন গভর্নমেন্ট কি পলিসি নেয় এই দেশে কে বলতে পারে? শহরে জায়গা খালি রাখা রিস্কি। দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না বলে বড়োভায়ের আক্ষেপের সীমা নাই। গুলশানে বাড়ি করে সমাজতান্ত্রিক কোনো দেশের এমব্যাসিকে ভাড়া দিলে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে একটা লিঙ্ক থাকে, মাসে বিশ পঁচিশ হাজার টাকাও আসে। — আতিকের অস্বস্তি, লজ্জা ও সংকোচ গড়ায় বিরক্তিতে : বড়োভাই মেজোভাই তাকে দিব্যি এই ঝামেলার মধ্যে ফেলে আরামসে টাকার জন্যে অপেক্ষা করছে। ‘গ্রাম দেখে আয়, নিজেদের রুট না জানলে তোর কিসের সোসিওলজি পড়া?’—এসব শুনে সে-ও কিনা বোকার মতো একা একা রওয়ানা হলো। আব্বা বেঁচে থাকলে তাকে একা আসতে দেয়? গ্রামের সম্পত্তির ব্যাপারে যা করার আব্বা একা একাই করেছে, তাদের কারো গায়ে এতোটুকু আঁচ লাগাতে দেয়নি। নিজের গ্রাম, গ্রামের আত্মীয়-স্বজন কি লোকজন নিয়ে আব্বার বোধহয় কোনো দুর্বলতা ছিলো, তার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের জড়াতে চায়নি। গ্রামের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে
মেজোভায়ের ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে আতিক এখন অস্বস্তি বোধ করছে। তারা সবগুলো ভাইবোন আসলে এই ব্যাপারে প্রশ্রয় পেয়েছে আম্মার কাছে। শহরে নিম-শহরে বড়ো হওয়ায় আম্মা গ্রামের শ্বশুরবাড়ি নিয়ে বিশ্রী সব রসিকতা করতো। আম্মার গ্রাম্যতা তাদের ভাইবোনদের মধ্যে নেই, কিন্তু মেজোভায়ের কথায় ধার বড্ডো বেশি। এই কিসমত লোকটিকে বাগে পেলে মেজোভাই যে কি নাস্তানাবুদ করতো ভেবে আতিক একটু অপরাধ বোধ করে। কিসমতকে সে কাছে ডাকে, ‘আপনি এখানে বসেন না। তার আগের জায়গাতেই ছড়িয়ে বসতে বসতে কিসমত বলে, ‘তোমরা কয়ো ভাই মাঘ মাসোত একবার আসো, চরের মদ্যে খুব পাখি বসে, শিকার করবার পারবা।
‘আব্বা বোধহয় এখানে এসে শিকার করতেন, না?’
‘শীতের সময় তাঁই বন্দুক ছাড়া কুনোদিন আসে নাই!’
আলতাফ মৌলবির অনুপস্থিতিতে বাপের স্মৃতিতে আতিক ইচ্ছামতো স্যাঁতসেঁতে হতে পারে।
‘শেষবার আব্বা যখন আসে, স্বাধীনতার আগের বছর, তখনো বন্দুক নিয়ে এসেছিলেন। হুঁ. আমার মনে আছে। শিকারে সেবার আপনি সঙ্গে ছিলেন?’
এই প্রশ্নে কিসমত মনে হয় আহত হলো। তাকে ছাড়া করিম সায়ের শিকারে বেরুবে, করিম সায়েবের ছেলে এই কথা ভাবতে পারলো? তার চোখ, পাকা ভুরু, চাপা নাক, যমুনার হাওয়ায় ফাটা পুরু ঠোঁট ও দাড়িওয়ালা গাল ও চিবুক রেখা-উপরেখায় আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ সে চুপ করে থাকে। তারপর সামলে নিয়ে বেদনা বা স্নেহে বা বেদনাময় স্নেহে একটু হাসে। সে তার আগের প্রসঙ্গই অব্যাহত রাখে।
‘তোমরা বাপু তার কী দেখছো? তার হাতের যা নিশানা! আমি বাপু মেলা শিকারী দেখছি, তোমার বাপের নাহান কাকো দেখি নাই। কী কমু, পাখি না উড়লে তাই গুলি করে নাই।‘
‘মানে?’
‘বুঝলা না? আগে হাতোত তালি দিয়া বসা-পাখি উড়ায়া দিছে, তারপরে বন্দুকের টোটা ফুটাছে।’ আতিকের প্রশ্নের জবাব দেয় সে এতোক্ষণে, ‘আমাক না নিয়া তাঁই কুনোদিন শিকারত যায় নাই। মানষে হিংসা করছে, এই চাষার সাথে আপনের এতো খাতির কিসের?’
‘আলতাফ মৌলবি কী কম জ্বালাছে?’ বাপের পাশে বসতে বসতে আকালু বলে। তার গায়ে টাটকা মাছের আঁশটে গন্ধ।
‘থো, উগল্যান কথা থো।’
‘ন্যায্য কথা কতে দোষ কি? এই জমি নেওয়ার জন্যে ফন্দি কি তাই কম করছে? ঢাকাত যায়া সায়েবেক ফুসলাছে! কি? না, তার কাছে বর্গা দেওয়া নাগবো। খালি জমির তালে থাকে। আকালের বছর গাঁয়ের ছয় আনি জমি তো তাঁই নিলো। কিসের ট্যাকা, কিসের দাম, কয় মন ধান দিয়া কয়, চল রেজিস্টি অফিসত চল। কতো দলিল করা নিছে তার বলে হিসাব কিতাব নাই। মানষেক ভিটা ছাড়া করছে, মানষে এখন বান্দের উপরে ঘর তুললে তার গোয়া কামড়ায়।’
‘থো বাপু, উগল্যান প্যাচাল থো। চ্যাংড়ার সাথে তার বাপের গল্পো করি এ্যানা। সায়েবের সঙ্গে শিকার করার ঘটনা সে সায়েবের ছেলেকে দেখিয়ে ছাড়বে। ‘শোনো, একবার মাঝিরার চর পার হয়া জাহাজের খাটাল ধরা নাও নিয়া গেলাম কচুয়ার চর। অনেক দূর বাপু, ময়মনিসং জেলা, জামালপুর মহকুমা, থানা মাদারগঞ্জ। বেলা তখন আর এক ঘড়ি আছে—’ কিন্তু আকালুর জন্যে গল্প এগোতে পারে না, তার কথা সে বলবেই, ঝরু পরামানিকের ভিটা মৌলবি কিনবার পারলো না, ঝরু ভিটা বেচলো হাফিজদ্দি সরকারের বেটার কাছে। কিসক? না, নগদ কিছু পাইলে পরে ঝরু পরিবার পরিকল্পনা অফিসে ট্যাকা দিবার পারে তো তার বেটার একটা চাকরি হয়। আকালের টাইমে ধান কিন্যাই ঝরুর ট্যাকা পয়সা শ্যাষ, বেটার চাকরিও হলো না, আলতাফ মৌলবি খেপ্যা যায়া ঝরুক বর্গা দেওয়া বন্দ করা দিলো। দেখেন তো বাপু জুলুম!’
‘চুপ কর।’ কিসমত এবার ছেলেকে জোরে ধমক দেয়, ‘দেখ তো রান্দাবাড়ির কী হলো?’
রান্নার খবর নিতে আকালু ভেতরে গেলেও কথাবার্তা আর এগোয় না। আতিক একটু দমে যায়। শীতকালে তাদের অপরিচিত একজন লোকের সঙ্গে তার আব্বা নদীতে খালে ও চরে বন্দুক হাতে শিকার করে বেড়াচ্ছে, বন্দুকে ট্রিগার টেপার আগের মুহূর্তে হাততালি দিয়ে পাখি উড়িয়ে দিচ্ছে—এই দৃশ্যে করোটি জুড়ে চমৎকার মাখনের প্রলেপ পড়ছিলো; এই মূর্খ চাষী যুবকের জন্য সব পশু হবার জো হলো। কিসমতকে কি করে ফের উসকে তোলা যায় আতিক এই নিয়ে ভাবছে এমন সময় আলতাফ মৌলবির হাঁক শোনা যায়, ‘ক্যাগো ভাত বাড়ো. বেলা গেলো।’
বেলে মাছের একটা তরকারি, তাতে চিকন করে কাটা বেগুন ও বেগুনের চেয়ে অনেক বেশি কাঁচা মরিচ। লাল আউশের ভাতের গন্ধে ছোটো ঘরটা আরো চেপে এসেছে। মাটির মেঝেতে পাতা বাঁশের চাটাই, তাতে পাশাপাশি বসেছে আলতাফ মৌলবি, আতিক আর কিসমত সাকিদার। ভাতের গন্ধে হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে পঙ্গু একটি লোক, এটা হলো কিসমতের বাতব্যধিগ্রস্ত পুত্র আসমত। কাঁথার অজস্র ছিদ্র দিয়ে তার বাঁকা পা জোড়ার প্রায় সবটাই দেখা যায়। দেখে মনে হয় এগুলো সব সময় বাঁকা হয়েই রয়েছে। আবার পা দুটো তার কাঠির মতো সরু: সোজা হলেও দাঁড়ানো বা হাঁটার জন্যে সেগুলোর ওপর ভরসা করা যেতো না। আলতাফ মৌলবির নানা ধরনের জেরা ও মন্তব্যের জবাবে জানা গেলো যে, তার জলজ্যান্ত একটা বৌও আছে. কিন্তু বর্ষাকালে আসমত আলী মরিচা হাটের রাস্তায় বটতলায় ভিক্ষার থালা হাতে বসতে পারে না বলে বৌটাকে বাপের বাড়ি পাঠানো হয়েছে। বর্ষা শেষ হলে পোয়াতি মেয়েকে নিয়ে বৌয়ের বাপ নিজেই চলে আসবে। এখন আসমত আলীর কাথার ভেতর থেকে হাল্কা আঁশটে ভ্যাপসা গন্ধ বেরিয়ে আসছে। আপাতত তার চেয়ে অনেক তীব্র হলো লাল আউশের ধোঁয়া ও ভাজা কলায়ের ডালের তীব্র সুবাস। দরজার আড়ালে ঘোমটায় মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিসমতের স্ত্রী, ঘোমটার ভেতর থেকেই চোখ দিয়ে সে ইসারা চালায় আর একজনের পাতের ভাত শেষ হতে না হতেই মাটির হাঁড়ি থেকে হাত দিয়ে ভাত তুলে দেয় আকালু। ঘরের দরজার ওপারে ছোটো উঠান। সেখানে উনানের পাশে বসে মাটির বাটিতে মাছের তরকারি তুলে দিচ্ছে আর একজন ঘোমটাধারিনী। এ বোধহয় কিসমতের বড়োছেলের বৌ। তার কোলে একটি শিশু, শিশুর মুখ দেখা যায় না। উঠানের এক কোণে কুয়া থেকে পানি তুলছে ৮/৯ বছরের একটি বালিকা। এইসব দেখতে ভালো লাগছে, কিন্তু আসমতের কাথার গন্ধ এবং আকালুর হাত দিয়ে ভাত তোলার ব্যাপারটা না থাকলে লাল আউশের সোঁদা গন্ধ, মাছের তীব্র ঝাল তরকারি ও মাসকলায়ের তীব্র সুবাস আব্বার স্মৃতির মতোই আপ্লুত করতে পারতো। তার পাতের দিকে তাকিয়ে আকালু বলে, ‘আপনেরা কি এবা মোটা চাউলের ভাত খাবার পারেন?’ কিন্তু কিসমত তাকে উৎসাহ দেয়, ‘তোমাগোরে জমির আউশ বাবা। দেখোসে কি ঘেরান, কী মিষ্টি!’
‘এই চাল বেচ্যাই তো আর বছর ট্যাকা পাঠালাম। বাজানোক কল্যাম কয়টা দিন পরে বেচেন, চাউলের দর আরো উঠবো,’ আকালু একটু অভিযোগ করে, ‘বাজান শোনে না, কয়, না বাপু, সায়েব নাই, দেরি হলে সায়েবের বেটারা আবার কি মনে করবো।’
‘সাকিদারের বেটা, আকালুকে হঠাৎ বাধা দেয় আলতাফ মৌলবি, আতিক আসছে জাম
‘কোন জমি?’ ভাতের গ্রাস হাতে কিসমত একটু ধাক্কা খায়।
‘ব্যামাক। করিম ভায়ের নামে যা আছে।’
আকালু জিগ্যেস করে, ‘জমি বেচবেন?’
‘হুঁ।’ আলতাফ মৌলবি জবাব দেয়, ঢাকাত বাড়ি করতিছে, ট্যাকা নাজাই পড়ছে, জমি বেচবো।’
আকালু বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।
.
কিসমত সাকিদার খাওয়া অব্যাহত রাখে। খেতে খেতেই আকালুকে ধমক দেয়, ‘ক্যারে, দেখস না হুজুরে শুদা ভাত খায়। মাছ দ্যাস না?’
কারো পাতে মাছ আছে কি-না স্পষ্ট করে দেখার ক্ষমতা তার নাই, তবে সে কি সকলের পাত থেকে গন্ধ পায়?
আতিকের দিকে মুখ তুলে কিসমত বলে, ‘বাবা খালি খালি কষ্ট দিলাম, খিল্যান দিল্যান কিছু করবার পাল্যাম না। মাছ নাই, ভাত খাবা কী দিয়া? মাছ পাওয়া যায় না, আমাগোরে এটি মাছের বংশ শ্যাষ।’
আকালু সোজা তাকায় আলতাফ মৌলবির দিকে, ‘জমি বেচবো তো গাহক ক্যাটা? আপনে?’
‘ধরছে, এখন কী করি?’ আলতাফ মৌলবির গলায় পবিত্র ঔদাসীন্য, করিম ভায়ের বেটা, তাক তো না করব্যার পারি না। করিম ভাই যে আমার কি আছিলো তা তো আর কেউ কবার পারবো না। না হলে জমি-জমা নিয়া জড়াপল্টা আর ভাল্লাগে না।’ তার ঔদাসীন্যকে ক্রমে বিরক্তিতে উঠতে দেখে আতিকের সরাসরি রাগ হয়, জমি কিনে আলতাফ মৌলবি কি তাদের উদ্ধার করবে? কিন্তু রাগ প্রকাশ করবে কি করে ঠিক বুঝতে পারে না। তার মৌন রাগে আলতাফ মৌলবির কী এসে যায়? তার বিরক্তি ফের নামে বৈরাগ্যে, ‘গাহক থাকলে আমি আর নেই না। তোমরা ন্যাও তো কও, আমি তাইলে সরা পড়ি।’
এ কথার কোনো জবাব হয় না। আকালু তবু বলে, ‘জমি তো আমাগো আছেই। আমাগোর জমি বান্দের উপরে। আমরা বান্দের জমিন্দার। কিসমত কিছু বলে না। তার প্রতিক্রিয়া ভাববার জন্য আতিক মাথা নিচু করে কলাই-ওঠা টিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেখানে কলায়ের ডাল মাখা কয়েকটি আউশের দানা। বুকের টিপটিপ ধ্বনি এবং ডাল-তরকারির ঝালে দুটো কানই জোড়া বলে কিসমতের দীর্ঘশ্বাস আতিকের কানে ঢোকে না। আকালু বলে, ‘ক্যান, ঢাকাত না আপনাগোর বাড়ি আছে!’
জবাব দেওয়ার কথা আতিকের, কিন্তু আলতাফ মৌলবি এসেছে তাকে রক্ষা করতে, তাই আতিকের হয়ে সে বলে, ‘বাড়ি আরো লাগবো না? ভাই তিনজন, দুইটা বাড়ি দিয়া কুলাবো?’
তাদের এতো বাড়ি থাকা সমীচীন নয়, এই বিবেচনা খোঁচা দিলে আতিক বলে, ‘না, মানে ঠিক তা নয়। মানে গুলশানে আব্বা একটা প্লট কিনেছিলেন তখন প্লট এ্যালোট করা হচ্ছিলো, ডিআইটির চেয়ারম্যান ছিলেন মাদানী সাহেব, আব্বার পুরনো বন্ধু,–’ এইসব কথা তার নিজের কানেই এলোমেলো ও অর্থহীন ঠেকলে আতিক চুপ করে ফের আলতাফ মৌলবির দিকেই তাকায়।
কিসমতের খাওয়া এখন প্রায় শেষ। ভাতের প্রতিটি দানা শেষ করার পর সে সশব্দে তার আঙুলগুলো চোষে। ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলে, ‘ঢাকাত না শুনছি তোমাগোরে বাড়ি খুব বড়ো, দুইতালা না তিনতলা শুনছি।’
একথার কী জবাব দেবে? ধানমণ্ডির বাড়ি না বাড়ালে বাড়িটা ইনকমপ্লিট রয়ে যায়। গুলশানের বাড়ি শেষ করলেই মাসে বিশ বাইশ হাজার টাকা আসে। ব্যবসার অবস্থা আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে মোটেই ভালো নয়। এসব কথা এদের বোঝায় কী করে? বড়োভাই এলে ঠেলাটা বুঝতো!
কাঁথার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে আসমতের খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা মুখ। আলতাফ মৌলবির দিকে তার পিঁচুটি ভরা চোখ রেখে সে মিনমিন করে, ‘আপনে হুজুর আমাগোলে দিয়া আল বগগা কলাবেন না? আমাগোলে উথায়া দিবেন গো?’ ভাঙা ভাঙা গলায় এরকম আধো আধো বোল শুনতে অসহ্য ঠেকে। এটা তার রোগেই একটা লক্ষণ, এতে তার পেশারও কিছু উপকার হয়। হাটের রাস্তায় বটতলায় এই আধোবোলে ভিক্ষা চাইলে আতিক হয়তো এমন কি একটা সিকিও দিয়ে দিতে পারতো!
কিসমতের বড়োছেলের স্ত্রী উঠানে বসেছিলো একা। এখন তার পাশে কিসমতের স্ত্রী। ওরা কি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে? কারো মুখ দেখা যায় না। নেভানো উনানের ওপর ডালের হাঁড়ি কাকের ঠোকরে ভোঁতা শব্দ করে। কাক তাড়িয়ে বড়োছেলের বৌ ঘরের পাশে দাঁড়ালো। ঘোমটা তার অনেকটা উঠে গেছে। এখান থেকে আতিক তার ডানদিকের প্রোফাইল দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটার একটা চোখ কানা। ঘরের ভেতর দরজায় দাঁড়িয়ে আকালু কেবল আলতাফ মৌলবিকেই দেখছে। কাঁথার সবটা পায়ের নিচে ফেলে প্রায় দিগম্বর আসমত ফের কোঁকায়, ‘অ হুজুল, আমাগোলে উথায়া দিবেন না গো!’ কিসমত তাকে ধমক দেয়, চুপ কর।’ আবার আকালুকেও ধমকের ভঙ্গিতেই পান আনতে বলে। কিন্তু সমস্ত ধমক ও নিষেধ সত্ত্বেও আসমতের সবিনয় বিলাপের আর বিরতি হয় না, ‘আমাগোলে উথায়া দিবেন না হুজুল। আল্লায় আপনাল দেলের ইত্তা পুলন কলবো গো! একতা পয়তা দিলে আপনে সত্তল পয়তাল সওয়াব পাইবেন গো!’ ঘরটিতে সে বটতলার গুমোট নিয়ে আসে এবং এই একটানা কোঁকানি উঠানে বসে-থাকা তার মায়ের ঘোমটায় ভেতর বাষ্প হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। তারে মায়ের ডান হাত এখন তার চোখের ওপর। এখানে বেড়ার আড়ালে দাঁড়ানো বড়োছেলের বৌয়ের ঘোমটা একেবারে খসে পড়েছে। তার গোটা মুখটা এখন স্পষ্ট দেখা যায়। ডান চোখটা তার কানা, সেই চোখের অব্যবহৃত আলো ও শক্তি কি তার বাঁ চোখে উপচে পড়ছে? সেই ঝকঝক করা চোখের দিকে একবার তাকিয়ে আতিককে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়।
বাইরে এসে সবাই নিজের নিজের আসনে বসলে কিসমত বলে, ‘বাবা, বাপদাদার গেরামের সাথে সম্পর্ক রাখবা না সাব্যস্ত করছো?’
‘না, ঠিক তা নয়, ঐ কনস্ট্রাকশনটা শুরু করে একটু প্রবলেম হয়েছে—’
‘ওটা কোনো কথা নয় বাবা, নিজেগো ভিটাতে আসো না, মায়া মোহাব্বত আশা করাই অন্যায়, না কী কও?’
আতিকের সমস্যা বোঝা এদের সাধ্যের বাইরে। বুদ্ধিমানের মতো আতিক তাই চুপ করে থাকে। বেশি কথা বলছে কেবল আকালু। এবার সে দাঁড়িয়েছে জামগাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে। অবিরাম সে বিড়বিড় করে, কয় পুরুষ থ্যাকা এই জমির খেদমত করল্যাম। এই ভিটা ছাড়লে আমরা কৈ যাই? মৌলবি চাচামিয়া কি আমাগোরে এটি থ্যাকবার দিবো? আলতাফ মৌলবি পানের পিক ফেলে, ঢোঁকও গিললো একটা, তার চোখে মুখে দাড়িতে পবিত্র বৈরাগ্য ফের ফিরে এসেছে। তার গলায় এখন ওয়াজের উদাত্ত স্বর, ‘বাপু জমি কও জিরাত কও, রেজেক কও আহার কও—সবই আল্লার হাতে। মানুষ ক্যাডা? কওসে মানুষের তৌফিক কয় পয়সা? মানুষ জানে কী? মানুষ করবো কী? আল্লায় কার জায়গা কোটে রাখছে আমি করার পারি, না তুই পারস?’
‘আমি পারি।’ আকালু সামনে এগিয়ে আসে, ‘আমাগোরে জায়গা রাখছে বান্দের উপরে।’ আকালু কি রাগ করলো? তার ফাটা পুরু ঠোঁটের ওপর থেকে উঁচুউঁচু চকচকে দাঁত ভেতরে লুকিয়ে রাখার দিকে তার এখন মনোযোগ নাই। বিদায় নেওয়ার সময় কিসমত আতিকের হাত ধরে বলে, ‘বাবা, দোষত্রুটি হলো, কোদ্দ করেন না। খিলান দিলান তো কিছু করব্যার প্যারলামই না, খালি কষ্ট দিলাম। তোমাক দেখলাম, মনে হলো তোমার বাপের পাঁজরার কাছে বসা ভাত খায়া উঠলাম।’
বেগুন খেতে ঢুকে আলতাফ মৌলবি নিবিষ্টচিত্তে নতুন বেগুনের ফলন পরীক্ষা করে, কিসমত আতিকের হাত ছাড়ে না, তবে তার স্বর এখন খুব নিচু। প্রায় ফিসফিস করে সে বলে, ‘খুব জোস্না উঠলে রাত দুই ঘড়ির সময় তোমার বাপ মাচার উপরে বস্যা খালি ঝিমায়। মনে হয় কতপা রাত ভাইজান নিন্দ পাড়ে নাই! আমি কিছু করবার সাহস পাই না। কথা কলেই তাঁই মিলায়া যায়, ধলা ফকফকা।
এই ঘোরতর বিকালে আতিকের সারা গা ছমছম করে ওঠে। শীতের বেলা, দেখতে দেখতে কোথায় চলে যাবে! জ্যোৎস্না উঠতে আর কতোক্ষণ? এক্ষুনি রওয়ানা হওয়া দরকার।
আবার সেই বাঁধ; বাঁধে সারবাঁধা নতুন ও পুরনো চালাঘর। আবার সেইসব কালোকিষ্টি মানুষ, আবার অপরিচিত আঁশটে গন্ধ। নিচে চরের ওপারে নদীর ভেতর থেকে মেঘ ডেকে উঠলো। আলতাফ মৌলবি বলে, আতিক, শুনছো, নদী দৌড়ায়!’ তার মানে এই বাঁধে আরো লোক আসছে। এরপর উঠে আসছে কিসমত আর আকালু আর কিসমতের বৌ আর কিসমতের বড়োছেলে আর বড়োছলের বৌ আর কিসমতের নাতি আর কিসমতের পঙ্গু ছেলে আসমত আর—। এদের ধ্যাবড়া পায়ের কাণ্ডজ্ঞানহীন চলাচলে বাঁধের ফাটলে চিড় ধরবে, চিড় পরিণত হবে মস্ত মস্ত হাঁ-তে। যমুনার কোলোকাঁখে এরা মানুষ, যমুনার হাভাতেপনা কি এরা দেখেও দেখে না? আর এদের পেছনে মস্ত বড়ো একটি ছবির নিগেটিভ, হাল্কা তামাটে রঙ জ্যোৎস্নায় বাঁশের মাচানে বসে ঘুমঘুম চোখে ঝিমায় ওর বাবা। আব্বাও কি এসে পড়বে? আলতাফ মৌলবি বলে, ‘তুমি না আসলে কিসমতের বেটা কাইজা করতো। বেন্যার বাচ্চা শালা বড়ো নটখট্যা ছ্যারা। তুমি অ্যাসা খুব ভালো করছো বাপু, এখন শালারা আর কিছু অছিলা পাবো না।’ কিন্তু আলতাফ মৌলবির সন্তুষ্ট চেহারা দেখার জন্য কে দাঁড়াবে? বাঁধ কখন ফাটে বিশ্বাস আছে? বর্ষাকালের ভিজে মাটি মানুষের পদভারে ফাঁক হতে কতোক্ষণ? তারপর সপ্তস্রোতে উনপঞ্চাশ তরঙ্গ তুলে যমুনা গ্রাস করতে আসছে এইসব গ্রাম, ধানী জমি, পাটখেত, স্কুলের পাকা দালান, নতুন সার্কল অফিস, অফিস, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, ইউনিয়ন কাউন্সিলের টিনের ঘর, সবুজ ও লাল পতাকা শোভিত লাল রঙের থানা। তাড়াতাড়ি কেটে পড়ো। — আতিক খুব লম্বা লম্বা পা ফেলছে।
‘কদমে বাদাম খাটায়া নিছো বাবা?’ আতিকের কানে স্বর পৌঁছাবার জন্য আলতাফ মৌলবিকে পেছন থেকে চেচাতে হয়, ‘ও আতিক, আস্তে চলো বাবা।’
কে শোনে কার কথা? আতিকের সুটকেসটা আছে দেবডাঙায় আলতাফ মৌলবির বাড়িতে। সুটকেসটা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে উঠতে হবে দেবডাঙা বাজার। ৬টার বাস ধরতে পারলে সাড়ে ৮ টার মধ্যে সোনাতলা স্টেশন। রাত্রি ৮ টা ৫০-এ ঢাকার ট্রেন।