রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

মার্শাল টিটো (১৮৯২–১৯৮০) – জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা

মার্শাল টিটো (১৮৯২–১৯৮০) – জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা

একেবারেই এক সাধারণ ঘরে যাঁর জন্ম পরবর্তীকালে তিনিই হয়েছিলেন যুগোস্লাভিয়ার লৌহমানব বলে খ্যাত। নাম তাঁর মার্শাল ইওসিপ্ ব্রোজ টিটো (Josif Broz Tito)। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দেশটির অন্যতম প্রধান সেনানায়ক। পরে হয়েছিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট।

যুদ্ধের পর তিনিই প্রথম যুগোস্লাভিয়াকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন। লৌহকঠিন দৃঢ়তার সঙ্গে দেশকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন তিনি নতুন করে তাই তাঁকে অভিহিত করা হয় আধুনিক যুগোশ্লভিয়ার জনক হিসেবে। তিনি দেশ ও তাঁর নিজের ব্যক্তিত্বকে এমন দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড় করিয়েছিলেন যে, রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তির প্রভাবকে পর্যন্ত অস্বীকার করা সম্ভব হয়েছিল। এত বিরোধিতা ও প্রভাবকে অস্বীকার করেও তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মাথা তুলে। আর এমনি করে তিনি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সৃষ্টি করেছিলেন নিজস্ব মত ও পথের।

লৌহমানব ইওসিপ ব্রোজ টিটোর জন্ম ১৮৯২ সালের ৭ মে যুগোস্লাভিয়ার ক্রোয়েশিয়া এবং স্লোভেনিয়া প্রদেশের সীমান্তবর্তী কুমরোভেক নামের একটি শহরে।

পিতা ছিলেন গাঁয়ের এক গরিব কৃষক। ঘরে ছিল একপাল সন্তানসন্ততি। টিটো ছিলেন এমনই নিঃস্ব পরিবারের ১৫টি ভাইবোনের মধ্যে ৭ম স্থানীয়। স্বাভাবিক কারণেই বাল্যকালে স্কুলে যাবার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। ফলে ১৩ বছর বয়সেই বের হতে হয় উপার্জনের ধান্ধায়। বাবা তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন পার্শ্ববর্তী মফস্বল শহর সিসাকের এক তালাওয়ালার সঙ্গে। সেখানে তিনি তালা মেরামত করতেন।

তারপর সেখান থেকে কয়েক বছর পরে চলে আসেন এয়েস্তে শহরে। শিখতে শুরু করলেন কামারের কাজ। লোহার কাজ শেখার অবসরে সময়ে তিনি ঘুরতে লাগলেন এ দেশ থেকে সে দেশে। এয়েস্তে থেকে বোহেমিয়া সেখান থেকে জার্মানি।

কামারের এই কাজ নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই তিনি কর্মকার শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মিশে যান। অচিরেই সদস্য হন ক্রোশিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির।

এর পর-পরই শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তিনি কামারের কাজ ছেড়ে দিয়ে যোগদান করলেন সেনাবাহিনীতে। নাম লেখালেন যুগোস্লাভ ২৫তম রেজিমেন্টে। তাঁদের বাহিনী তখন যুদ্ধরত ছিল সাইবেরিয়ায়। সালটা ১৯১৪। কিন্তু সেখানে তিনি যুদ্ধ বিরোধী প্রচারণা চালানোর দায়ে গ্রেফতার হন।

পরে অবশ্য তিনি এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পান এবং তাঁকে কারপাথিয়ান ফ্রন্টে বদলি করা হয়। সেখানেই তিনি যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলে কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে তাঁকে পদোন্নতি দেন।

যুদ্ধের পরে তাঁকে বুকোভিন ফ্রন্টে পাঠানো হয়। সেখানেই তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে রুশ বাহিনীর হাতে বন্দি হন। রাশিয়ার বন্দিদশা থেকে তিনি ফিরে আসেন ১৯২০ সালে। তবে ঘরে ফেরার সময় তিনি একটি রাশিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। এ বিয়ে অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। ১৯৩৫ সালে টিটোর এই বিয়ে ভেঙে যায়।

যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনি আবার যোগ দেন তাঁর পুরনো পেশায়—লোহালক্কড়ের কাজে। বিজেলোভার শহরে একটি মিলে তিনি চাকরি নেন টেকনিশিয়ান হিসেবে। এসময়ই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯২৩ সালে বরণ করেন তিনি গ্রেফতারি।

এই সময় তাঁর আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তাঁর আর্থিক অবস্থা এমন ছিল যে, তাঁর দু-দুটো সন্তান বিনা চিকিৎসায় এবং অনাহারে মারা যায়। তিনি অর্থের জন্য নিজের সন্তানদের বাঁচাতে পর্যন্ত পারেননি।

১৯২৫ সালে ক্রাভিকা শিপ ইয়ার্ডে কাজ করার সময়ও তিনি একবার গ্রেফতার হন এবং তাঁর সাত মাসের জেল হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর ১৯২৭ সালে জাগরেবের প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯২৮ সালেই যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পুলিটব্যুরোর ডেপুটি মনোনীত হন এবং আগস্ট মাসে ক্রোয়েশিয়ান ও স্লোভেনিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই বছরই তাঁর পাঁচ বছর জেল হয়। জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৩৫ সালে। এর পর থেকেই পার্টিতে তাঁর অবস্থানের দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। তিনি সেন্ট্রাল কামিটির পুলিটব্যুরোর সদস্য হন। পার্টির সাংগঠনিক কাজে ভ্রমণ করেন মস্কো, প্যারিস, প্রাগ, ভিয়েনা প্রভৃতি শহর।

এই সময় আত্মগোপন করার জন্য তাঁকে নানারকম ছদ্মবেশ নিতে হতো—নিতে হতো ছদ্মনামও। এই ছদ্মানামগুলোর মধ্যে একটি ছিল টিটো। নামটি তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন। তখন থেকেই টিটো শব্দটি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

টিটো ১৯৩৫ সালে মস্কোতে কমিউনিস্ট পার্টির বলকান সেকশনে কাজ করেন এবং ১৯৩৭ সালে কুয়োমিনতাং-এর এক্সিকিউটিভ কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালে যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির যে সম্মেলন হয়, তাতে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।

১৯৩৭ সালে টিটো স্পেনের গৃহযুদ্ধ দমনের জন্য ১৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রেরণ করেন। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীই পরে যুগোস্লাভিয়ার জাতীয় মুক্তিবাহিনীতে রূপান্তরিত হয়।

১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল জার্মানি যুগোস্লাভিয়া আক্রমণ করে। টিটো দেশের এই মহাদুর্যোগ মুহূর্তে সকল দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য দেশের যুবসমাজকে সংঘটিত করে তিনি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন জার্মানির বিরুদ্ধে।

প্রথম ধাক্কায় হিটলার যুগোস্লাভিয়া দখল করে নিলেও টিটো তাঁর মুক্তিবাহিনী নিয়ে পরে দেশের অধিকাংশ অঞ্চল মুক্ত করেন এবং পশ্চিম সাইবেরিয়ার ইউজিস নামক স্থানে তাঁর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন। এখান থেকেই হিটলারের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চলতে থাকে সংগ্রাম।

১৯৪৩ সালের দিকে টিটোর মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় আড়াই লাখে। এই সময়েই টিটোকে মার্শাল উপাধি দেওয়া হয়। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হন মার্শাল টিটো নামে।

১৯৪৪ সালের ২৫ মে হিটলার মার্শাল টিটোর বসনিয়ায় অবস্থিত হেড কোয়ার্টারে ট্যাংক ও বিমান নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। টিটো অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। মে মাসে হিটলারের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য উইনস্টন তিনি চার্চিল এবং স্ট্যালিনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন।

যুদ্ধে অবশেষে মিত্রবাহিনীর জয় হয়। হিটলারের নাৎসি বাহিনী পরাজিত হয়। দীর্ঘ কয়েক বছরের সংগ্রামের পর দখলদারের হাত থেকে রক্ষা পায় যুগোস্লাভিয়া। কিন্তু দীর্ঘ চার বছরের একটানা যুদ্ধে গোটা দেশই বিধ্বস্ত। দেশের প্রায় শতকরা এগারো ভাগ লোক নিহত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। গোটা দেশ তখন এক ধ্বংসস্তূপ

এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই তিনি আবার শুরু করেন সংগ্রাম- দেশকে গড়ে তোলার সংগ্রাম। ১৯৪৫ সালে তিনি নির্বাচিত হন দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট।

কিন্তু দেশগড়ার কাজেও তাঁকে প্রতিমুহূর্তে মোকাবেলা করতে হয়েছে নানারকম বাধাবিঘ্নের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বৃহৎ দেশ রাশিয়া চাইত তার পার্শ্ববর্তী দেশ যুগোস্লাভিয়া তার বশ্যতা স্বীকার করুক, রাশিয়ার প্রভুত্ব মেনে চলুক।

কিন্তু মার্শাল টিটো ছিলেন স্বাধীনচেতা ও দৃঢ় মনের অধিকারী। তিনি নিজের দেশকে রাখতে চাইলেন স্বাধীন ও সার্বভৌম।

কিন্তু স্ট্যালিন যখন দেখলেন টিটো সহজে তাঁর কাছে মাথা নত করছেন না, তখন আশ্রয় নিলেন কূট কৌশলের। ইচ্ছাকৃতভাবে যুগোস্লাভিয়ার সীমান্তে গোলযোগ সৃষ্টি এবং দেশে অশান্তি বাধানোর চেষ্টা করতে লাগল রাশিয়া। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। টিটো রাশিয়ার এই কূটকৌশলগত ব্যাপার-স্যাপার তুলে ধরলেন দেশবাসীর সামনে। আহ্বান জানালেন রাশিয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার। সারা দেশে আবার গড়ে উঠল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। দেশের সমগ্র মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলো টিটোর পেছনে। টিটো তখন সারা দেশের জনপ্রিয় নেতা।

১৯৫৩ ফলে সালে স্ট্যালিনের মৃত্যু হলো। এরপর যাঁরা রাশিয়ায় নেতৃত্বে এলেন, তাঁদের মনোভাব ততটা কূট ষড়যন্ত্রী ছিলেন না। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে আবার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এলো যুগোস্লাভিয়ার। ১৯৫৩ সালের ৭ এপ্রিল যুগোস্লাভিয়াকে সোশ্যালিস্ট ফেডারেল রিপাবলিক ঘোষণা এবং প্রণয়ন করা হয় নতুন সংবিধান।

১৯৭০ সালে মর্শাল টিটো দেশশাসনের জন্য একটি নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। দেশে যৌথ প্রেসিডেন্সি পদ্ধতি চালু করা হয়।

এই পদ্ধতির আলোকেই ১৯৭৪ সালে যুগোস্লাভিয়ার সংবিধান পুনঃ প্রণয়ন করা হয় এবং এই পদ্ধতি কার্যকর করা হয় মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর। টিটোর মৃত্যু হয় ১৯৮০ সালে ৪ মে। মার্শাল টিটো শুধু যুগোস্লাভিয়ার নন, আজও তিনি গোটা ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরনায়ক এবং সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *