ভিক্টর হুগো (১৮০২-১৮৮৫) – ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল
প্যারিসের একজন খ্যাতনামা প্রকাশক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থটি প্রকাশের সময় লেখক উপস্থিত ছিলেন না। লেখক সেই বিদেশ থেকেই তাঁর নতুন বইয়ের কাটতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে পত্র লিখলেন প্রকাশকের কাছে।
কিন্তু পত্র খুলে প্রকাশক সাহেব তো অবাক। পত্রে কিছু লেখা নেই। শুধু গোটা পাতা জুড়ে একটি মস্ত বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?) এঁকে দিয়ে লেখক সই করে দিয়েছেন।
এই আজব পত্র পেয়ে প্রকাশক মুচকি হেসে তিনিও একটি প্যাড টেনে নিয়ে তাঁর ওপর শুধু একটি বিস্ময়বোধক চিহ্ন (!) এঁকে দিয়ে সই করে ছেড়ে দিলেন পত্রের উত্তর।
গিনিস বুকস অব রেকর্ডের দেয়া রিপোর্ট অনুসারে এটাই হল বিশ্বের সংক্ষিপ্ততম পত্রালাপের বিশ্বরেকর্ড। এই পত্রালাপের লেখকের নাম ভিক্টর হুগো (Victor Hugo), যিনি ছিলেন ফ্রান্সের রোম্যান্টিক সাহিত্যধারার সর্বাধিক শক্তিমান পুরুষ।
এই পত্র লেখার মজার ঘটনা তিনি ঘটিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লা মিজারেবল’ (Les Misrables) প্রকাশের সময়। ভিক্টর হুগো শুধু একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর সদ্যপ্রকাশিত বইয়ের কাটতি কেমন হচ্ছে। প্রকাশক বিস্ময়বোধক চিহ্নে তাঁকে বুঝিয়েছিলেন—বিক্রি বিস্ময়কর।
ভিক্টর হুগোর মতো বিস্ময়কর প্রতিভা সেকালে শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা বিশ্বেও ছিল বিরল। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, সমলোচনাসাহিত্যে তাঁর সমতুল্য ব্যক্তিত্ব আজও বিরল। তাঁর প্রতিভা এবং কর্মদক্ষতা কত বিস্ময়কর ছিল, সে সম্পর্কে আজও বহু প্রবাদ প্রচলিত। বলা হয়, তিনি প্রতিদিন গড়ে হয় ১০০ লাইন করে কবিতা, আর না হয় ২০ পৃষ্ঠা করে গদ্য রচনা করতেন।
সাহিত্যের এই প্রবাদপুরুষ ভিক্টর হুগোর জন্ম ফ্রান্সের বেসানকঁয় নামক স্থানে ১৮০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। পিতা ছিলেন সম্রাট নেপোলিয়ানের রাজকীয় বাহিনীর জেনারেল জোসেফ লিওপোল্ড সিগিসবার হুগো।
জন্মের দুবছর পরই উগো মায়ের সাথে প্যারিসে চলে আসেন। তাঁর বাল্যকালটা ছিল খুব বৈচিত্র্যময়। পিতার ছিল সেনাবাহিনীতে ক্রমাগত বদলির চাকরি। আজ এখানেতো কাল ওখানে। তাই উগোও বাবা-মায়ের সাথে ঘুরে বেড়াতেন দেশময়। দেখার সুযোগ হতো দেশের নানা অঞ্চল ও সমাজকে।
সেই বাল্যকালেই তাঁর জীবনে একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে। তাঁর বাবা-মায়ের মধ্যে কী কারণে যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ফলে হুগো একাকী মায়ের সাথে ঘুরে বেড়ান ইলবা থেকে নেপলস, নেপলস থেকে মাদ্রিদ এবং মাদ্রিদ থেকে প্যারিস পর্যন্ত। এই সময়টা ছিল হুগোর জীবনের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও বেদনাদায়ক। এই অস্থির অবস্থাতেই তিনি প্যারিস থেকে ১৮১৮ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। কিন্তু পড়াশোনায় তিনি খুব একটা কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। পারিবারিক অশান্তিও এর একটা মূল কারণ হতে পারে। তবু এই সময় থেকেই তাঁর ভেতরে অতি সংগোপনে সাহিত্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটতে থাকে। সবার অলক্ষ্যে নিজের নোটখাতা ভরে উঠতে থাকে পদ্যের ছন্দে ছন্দে, যদিও সেগুলোকে তিনি পরবর্তী সময়ে ‘ননসেস’ বলেই অভিহিত করে বলেছেন, ওটা ছিল আমার জন্মগ্রহণের পূর্বপ্রস্তুতি।
১৮২২ সালে ভিক্টর হুগো তাঁর এক প্রেমিকা আদেলে ফুচেকে (Adele Foucher) বিয়ে করেন। এর আগের বছরই অর্থাৎ ১৮২১ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়।
ভিক্টর হুগোর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ওড্স্ ইট পোয়েসিয়ে ডিভার্সেস’ (Odes it poesies diverses)। কাব্যগ্রন্থটি পড়ে ফ্রান্সের অষ্টাদশ লুই দারুণ খুশি হন এবং তাঁকে একটি মাসিক বৃত্তি প্রদান করেন। এতে ভিক্টর হুগোর কিছুটা আর্থিক অনটন দূর হয়। এরপর ১৮২৫ সালে প্রকাশিত হয় উগোর প্রথম উপন্যাস ‘হাঁড দে ডি আইলান্ডে’ (Hand de Islande)। এই উপন্যাসের রোমান্টিক চিন্তাধারা পাঠকমহলকে খুব সহজে প্রভাবিত করে।
১৮২৩-২৪ সালে প্রকাশিত হয় হুগোর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মিউউ ফ্রঁসেজ’ (Muse Francaise)। তিনি এই বইটিতে ‘আলফ্রেড দ্য ভিগনে, লর্ড বায়রন এবং ওয়ালটার স্কটসহ স্বনামখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কর্মকাণ্ডের ওপর গবেষণামূলক নিবন্ধ রচনা করেছেন। ১৮২৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত ‘ওস্ অ্যাট ব্যালাড্স’ (Odes at ballades)। এটি ছিল তাঁর ইতিপূর্বেকার রোম্যান্টিক কবিতাসমূহের একটি সুদৃশ্য সঙ্কলন। এই সঙ্কলনই ইউরোপে সর্বপ্রথম রোম্যান্টিক চিন্তাধারার প্রবর্তন করে। সামালোচকদের দৃষ্টিতে এটি ছিল ঊর্ধ্বে নিক্ষিপ্ত বিশুদ্ধ শিল্পরচনার প্রস্তরখণ্ডবিশেষ। এরপর ভিক্টর হুগোর বিশুদ্ধ রোম্যান্টিক কাব্য ক্রমওয়েল (Cromwell) প্রকাশিত হয় ১৮২৭ সালে।
১৮৩০ সালে তিনি ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র ‘লে গ্লোব’ (Le Globe) পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। উল্লেখ্য, এই সময় ফ্রান্স ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর ‘ম্যারিওঁ দ্য লরমেঁ’ (Marion de Lorme) নামে একটি নাটক রচনা করেন। নাটকটি দেশের স্বাধীনতাকামী তরুণসমাজকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। এই নাটকের প্রধান বীর চরিত্র ছিল হারনানি, চরিত্রটি তরুণসমাজের ওপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় যে, তখনকার স্বাধীনতার আন্দোলনকেই বলা হতো হারনানির যুদ্ধ। ফলে তৎকালীন ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক সরকার এই ‘ম্যারিওঁ দ্য লরমঁ’ বইটি বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়।
১৮৪৩ সালে ভিক্টর হুগোর জীবনে নেমে আসে আর এক মর্মান্তিক দুঃখময় ঘটনা। এই সময় তাঁর সর্বাধিক আদরের সদ্যবিবাহিতা কন্যা লিওপলডাইন তাঁর স্বামী জুলিয়েট দ্রুয়ের সাথে একত্রে এক সামুদ্রিক জাহাজডুবিতে মারা যান। এই মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি ভয়ানকভাবে ভেঙে পড়েন, এমনকি তাঁর কলম প্রায় থেমে যাবার উপক্রম হয়ে যায়। এই সময়ই তিনি তাঁর পরবর্তীকালের বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’ (Les Mizerable) রচনায় রত ছিলেন। তিনি গদ্যরচনা ফেলে রেখে কন্যার বিয়োগব্যথা বিজড়িত লিরিক কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রকাশিত হয় তাঁর কন্যাবিয়োগের শোকাশ্রুতে সিঞ্চিত কাব্য ‘ল কনটেমপ্লেশনস’ (Le Contemplations )।
এর বহু বছর পর তিনি আবার তাঁর পরিত্যক্ত উপন্যাস ‘লা মিজারেবল’ রচনায় হাত দেন এবং উপন্যাসটি ১৮৬২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি হুগোর জন্য বয়ে আনে বিশ্বব্যাপী সম্মান আর প্রতিপত্তি। বিশ্বসাহিত্যের আসরে লাভ করেন সম্মানজনক স্থায়ী আসন। ফ্রান্সে এই উপন্যাটিকে এত সম্মানের চোখে দেখা হয় যে, এটিকে একটি ধর্মীয় কাজ বলে অভিহিত করা হয়। এর চার বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর আর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘লা ট্রেভেইলেউরস ডি লা মের’ (Le Trevailleurs de la mer), যা সকলের কাছে ‘টয়লার্স অফ দি সি’ (Toilers of the sea) নামে পরিচিত।
ভিক্টর হুগো একবার দেশের রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি ১৮৭১ সালে একবার জাতীয় সংসদের (National Assembly) ডেপুটিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তাঁর জীবনে নেমে আসতে থাকে একটির পর একটি দুর্যোগ। তিনি ১৮৬৮ সালে হারান তাঁর প্রিয়তমা পত্নীকে। ১৮৭১ সালে মারা যায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র চার্লস এবং ১৮৭৩ সালে মারা যায় তাঁর আর এক পুত্র ফ্রঁসেজ ভিক্টর।
ভিক্টর হুগো প্যারিসে যে রাস্তাটির ওপর বাস করতেন, তার নাম ছিল অ্যাভিনিউ ডি এইলাউ। উগোর ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন হিসেবে এ সড়কের নাম রাখা হয় অ্যাভিনিউ ভিক্টর হুগো।
এর পরেই তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে এবং ১৮৮৫ সালের ২২ মে মহাপ্রয়াণ ঘটে এই বিশ্বাবরেণ্য সাহিত্যিকের।
ফ্রান্সের আর একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক অঁদ্রে জিদ-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁর মতে ফ্রান্সের সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক কে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ভিক্টর হুগো।