আহা টুনটুনি উহু ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২২
উৎসর্গ
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের যারা আমাদের অনুরোধে অনশন ভাঙতে রাজি হয়েছিল।
ভূমিকা
আমাকে দেখে একটা দশ এগারো বছরের মেয়ে ছুটে এসেছে, কাছে এসে বলল, “স্যার আপনাকে একটা কথা বলি?”
আমি বললাম, “আমি বলব তুমি আমাকে কী বলবে?”
সে অবাক হয়ে বলল, “আপনি জানেন আমি কী বলব?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। আমি জানি। তুমি আমাকে আরেকটা টুনটুনি আর ছোটাচ্চুর বই লিখতে বলবে।”
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, “আপনি কেমন করে বুঝতে পারলেন?”
সেজন্য আমার আরও একটা টুনটুনি আর ছোটাচ্চুর বই লিখতে হয়েছে!
টুথ পেস্ট শেষ হবার পর টিপে টিপে যেভাবে আরো একটু পেস্ট বের করে ফেলা যায়, ঠিক সেভাবে আরো একটা টুনটুনির বই বের করা হয়েছে!
কিন্তু আর কতদিন?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
৩০.০১.২০২২
মার্ডার কেস
নানি (কিংবা দাদি) তার ছোট সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছেন। ঝুমু খালা তার পায়ের কাছে বসে একই রকম উৎসাহে এই সিরিয়ালটি দেখছে। অত্যন্ত নাটকীয় একটা দৃশ্যের পর বাসন ধোয়ার সাবানের বিজ্ঞাপন বিরতি, তখন ঝুমু খালা মাথা নেড়ে নানি (কিংবা দাদি) কে বলল, “বুঝলেন খালা, এই বউরে বিশ্বাস করা যাবে না।”
সিরিয়ালটিতে এইমাত্র বাড়ির ছোট ছেলে বিয়ে করে নৃতন বউ ঘরে এনেছে, তাকে কেন বিশ্বাস করা যাবে না নানি বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? আমার তো মেয়েটাকে ভালোই মনে হচ্ছে।”
ঝুমু খালা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “না, খালা না। দেখছেন না বউয়ের বিলাইয়ের মতো চোখ? বিলাইয়ের মতো চোখ মানেই উপরে মধু ভেতরে বিষ!”
বাচ্চারা ছবি আঁকার একটা খেলা আবিষ্কার করেছে, কাগজটা অনেকগুলো ভাজ করে একেকজন একেক ভঁজে তার ইচ্ছামতো একটা জন্তুর ছবি আঁকে। অন্যরা সেটা দেখতে পারে না, তাই ছবি আঁকা শেষ হওয়ার পর কাগজটা খুলে সেই বিদঘুঁটে জন্তুর ছবি দেখে সবাই হাসিতে গড়িয়ে পড়ে। টুনি তার সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে করতে নানি আর ঝুমু খালার কথা শুনছিল। সে ঝুমু খালার ব্যাখ্যাটাতে আপত্তি করে বলল, “ঝুমু খালা, মানুষের চোখ কখনো বিড়ালের চোখের মতো হতে পারবে না মানুষের পিউপিল গোল, বিড়ালের লম্বা।”
ঝুমু খালা ঝংকার দিয়ে বলল, “ফালাও তোমার গোল আর লম্বা। তুমি আমারে বিলাই শিখাবা! তুমি জীবনে বিলাই চোখা কয়টা দেখছ?”
টুনি আর আলোচনায় গেল না, বিড়াল চোখা মানে কী সেটাই সে জানে না! ঠিক এই সময় টুম্পা এসে বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার একজন গেস্ট এসেছে।”
ছোটাচ্চু তার কেনে আঙুল দিয়ে প্রবল বেগে কান চুলকাচ্ছিল বলে টুম্পার কথা শুনতে পায় নাই। বলল, “এ্যা, কে এসেছে?”
“গেস্ট। তোমার কাছে একজন গেস্ট এসেছে।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “মহল না মহিলা?”
ছোটাচ্চু চেয়ার থেকে নেমে ভুরু কুঁচকে শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বললি? মহল না মহিলা? মহল আবার কী রকম বাংলা?”
শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “বাংলা ভাষায় অনেক সমস্যা। মহল শব্দটা থাকা উচিত ছিল। শব্দটা ডিকশনারিতে ঢুকাতে হবে। আস্তে আস্তে ভাষাটাকে ঠিক করতে হবে।”
ছোটাচ্চু ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, “সেই দায়িত্বটা তোকে দেওয়া হয়েছে? কে দিয়েছে?”
ছোটাচ্চু প্রশ্নটার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, তার গেস্টের সাথে দেখা করার জন্য বের হয়ে গেল। শান্ত গলা উঁচিয়ে বলল, “দায়িত্ব দিতে হয় না। দায়িত্ব নিজের থেকে নিতে হয়!”
শান্তর কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে। শান্ত বাংলা ভাষা ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েছে শুনে হাসাহাসি করা যেতেই পারে। শান্ত মুখ গম্ভীর করে টুম্পাকে জিজ্ঞেস করল, “টুম্পা, তুই এখনো বলিসনি কে এসেছে, মহল না মহিলা?”
প্রমি হাসি গোপন করে বলল, “টুম্পা তুই ইচ্ছা করলে অন্যভাবেও উত্তর দিতে পারিস।”
টুম্পা বলল, “কীভাবে?”
“বলতে পারিস গেস্ট কি পুরুষ নাকি পুরিষা।”
আরেকজন বলল, “কিংবা লোক নাকি লুকিয়া।”
আরেকজন বলল, “কিংবা ছেলে নাকি ছেলিয়া।”
মুনিয়া তার কিনকিনে গলায় বলল, “কিংবা গরল নাকি গরিলা।”
মুনিয়ার কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে। চিৎকার করে বলতে থাকে, “গরিলা-গরিলা-”
শান্ত রেগে দাঁত কটমট করে বলল, “বাসায় গরিলা আসবে কেমন করে? বেকুবের মতো কথা বলিস না।”
ঝুমু খালা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমাগো যন্ত্রণায় শান্তিমতো একদিন টেলিভিশন পর্যন্ত দেখতে পারি না। খালি চিল্লাপাল্লা চিল্লাপাল্লা।”
তারপর নানির (কিংবা দাদির) দিকে তাকিয়ে বলল, “খালা, গেস্টের জন্য একটু চা নাশতা দিয়া আসি।”
টুম্পা মাথা নেড়ে বলল, “দরকার নাই ঝম খালা। মহিলার খুবই আলুথালু চেহারা। মনে হয় না চা নাশতা খাবে।”
সবাই চোখ বড় বড় করে তাকালো, বলল, “আলুথালু?”
তারপর একসাথে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাইরের ঘরের জানালার নিচে বসে তারা উঁকি দিয়ে আলুথালু মহিলাকে দেখবে। ঝুমু খালা পর্যন্ত পেছনে পেছনে আলুথালু মহিলাকে দেখতে গেল।
বাইরের ঘরের জানালার নিচে বসে উঁকি দিয়ে সবাই দেখল যে মহিলার সত্যিই খুবই আলুথালু চেহারা এবং শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শোনা গেল মহিলা বলছে, “আপনি কেমন করে আমাকে শান্ত হতে বলছেন? কেউ যদি আপনার সন্তানকে হত্যা করত আপনি কি শান্ত থাকতে পারতেন? মিঠুন আমার সন্তান না?”
জানালার নিচে বসে থাকা সবাই চমকে উঠল। শুধু শান্ত তার সবগুলো দাঁত বের করে আনন্দে হাতে কিল দিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ইয়েস, মার্ডার কেস।”
সবাই শুনল ছোটাচ্চু বলছে, “আপনি কি আমাকে ঠিক করে বলবেন, ঠিক কী হয়েছিল? মানে মিঠুন কে, ঠিক কীভাবে–”
আলুথালু মহিলা বলল, “আগে আপনি কথা দেন এই কেসটা আপনি নিবেন?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “একটু ডিটেলস না জানলে-”
“আপনাকে আমি সব বলব। কিন্তু আগে আমাকে কথা দেন–প্লিজ-মিঠুনের আত্মা শান্তি পাবে”
ছোটাচ্চু বলল, “আপনি যেভাবে বলছেন তাতে তো মনে হচ্ছে এটা পুলিশ কেস হওয়ার কথা–”
“পুলিশ?”
আলুথালু মহিলা মুখে একটা বিচিত্র হাসির ভঙ্গি করে বলল, “আপনি কি ভাবেন পুলিশ এই কেস নিতে আসবে? যেখানে আমার নিজের বাসার মানুষজন এটাকে শুরুত্ব দেয় না সেখানে পুলিশ গুরুত্ব দেবে?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “একটা মার্ডার কেসকে গুরুত্ব দেয় না ঠিক বুঝতে পারলাম না–”
ছোটাচ্চুকে থামিয়ে দিয়ে আলুথালু মহিলা গলা উঁচিয়ে বলল, “আপনিও আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?”
ছোটাচ্চু বলল, “না-না-না আমি মোটেও আপনাকে অবিশ্বাস করছি না। শুধু বলছি যে এটা খুবই অস্বাভাবিক লাগছে যে–”
আলুথালু মহিলা আবার ছোটাচ্চুকে থামাল, বলল, “আপনি এই পৃথিবীর কোনো খোঁজখবর রাখেন না। মানুষের হৃদয় এখন পাষাণ-কারো জন্য এখন কোনো মায়া নাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “তারপরেও—”
মহিলা আবার ছোটাচ্চুকে থামাল, বলল, “আপনি আমার বাসায় আসেন। নিজের চোখে সবকিছু দেখেন, তারপর বের করে দেন কে মিঠুনকে মার্ডার করেছে। আর কেউ পারবে না। আপনি পারবেন। শুধু আপনি–”
ছোটাচ্চু কেমন যেন ফ্যাকাশে মুখে তার মাথা চুলকাতে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় খুব বিপদে পড়ে গেছে।
টুম্পার কথা সত্যি, চা নাশতা দেওয়ার পরও আলুথালু মহিলা সেগুলো ছুঁয়ে দেখল না। ছোটাচ্চু অনেক আপত্তি করার পরও একটা মোটা টাকার বান্ডিল টেবিলের ওপর রেখে আঁচল দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে কাঁদো কাঁদো হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার আগে ছোটাচ্চুর কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়ে গেল যে ছোটাচ্চু পরেরদিন বিকেলেই তার বাসায় গিয়ে মিঠুন মার্ডার কেসের তদন্ত শুরু করে দেবে।
আলুথালু মহিলা চলে যাবার পর ছোটাচ্চু তার গাল চুলকাতে চুলকাতে নিজের ঘরে যাচ্ছিল, সব বাচ্চারা সারি বেঁধে তার পেছনে পেছনে গেল। শান্ত তার সবগুলো দাঁত বের করে আনন্দে হাসতে হাসতে বলল, “ছোটাচ্চু, এতদিন পর তুমি সত্যিকারের ডিটেকটিভ হয়েছ। তুমি শেষ পর্যন্ত একটা মার্ডার কেস পেয়েছ।”
প্রমি বলল, “একটা মার্ডার হয়েছে আর তুই খাটাসের মতো আনন্দে দাঁত বের করে হাসছিস?”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “খাটাস দাঁত বের করে হাসে?”
মুনিয়া বলল, “খাটাস কী?”
শাহানা বলল, “শান্তর মতো মানুষকে বলে খাটাস।”
শান্ত বলল, “ভালো হবে না কিন্তু।”
তারপর ছোটাচ্চুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, টাকার বান্ডিলটা দিবে?”
ছোটাচ্চু বলল, “কেন?”
“তোমাকে গুনে দেই।”
“তোকে কেন গুনে দিতে হবে? আমি গুনতে পারি না?”
“তোমাকে একটু সাহায্য করি।”
প্রমি বলল, “ছোটাচ্চু ভুলেও শান্তর হাতে টাকা দিবে না।”
টুনি তখন একটু এগিয়ে এসে বলল, “ছোটাচ্চু—”
“উঁ।”
“তুমি কালকে যাবে তো?”
শান্ত বলল, “যাবে না কেন? একশবার যাবে। এই প্রথম একটা মার্ডার কেস পাওয়া গেছে যেতে তো হবেই।”
টুনি শান্তর কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না, ছোটাচ্চুকে আবার জিজ্ঞেস করল, “যাবে?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকালো, বলল, “জোর করে টাকার বান্ডিলটা দিয়ে একটু ঝামেলায় ফেলে দিল। আমি কেসটা নিতে চাচ্ছিলাম না।”
শান্ত গলা উঁচিয়ে বলল, “কেন নিবে না? একশবার নিবে। এটা হচ্ছে অ্যাডভান্স। মার্ডারারকে ধরার পর বাকি পেমেন্ট। তাই না ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু শান্তর কথার উত্তর দিল না, তখন শান্ত আবার জিজ্ঞেস করল, “কত দিয়েছে ছোটাচ্চু? নোটগুলো পাঁচশ টাকার নাকি হাজার টাকার?”
ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে বলল, “তোর এত খবরের দরকার কী?”
“না, মানে, কম দিল কিনা জানতে চাইছিলাম।”
টুনি বলল, “তুমি কখন যাবে ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু বলল, “কেন? তুই যেতে চাস?”
টুনি বলল, “না—মানে–”
তখন শান্ত এসে টুনিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গলার স্বর খুবই গম্ভীর করে বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
“কী কথা?”
“সিরিয়াস কথা।”
ছোটাচ্চু বলল, “শুনি তোর সিরিয়াস কথা।”
“যখনই তোমার কোনো ডিটেকটিভ কেস আসে তখনই তুমি সব সময় টুনিকে নিয়ে যাও। সে তোমার সাথে থাকে।”
টুম্পা বলল, “টুনি আপুকেই তো নিবে? টুনি আপুই তো সব কেস সলভ করে। টুনি আপুকে না নিলে কাকে নিবে? তোমাকে?”
শান্তকে ডিটেকটিভ কাজে নেওয়ার ব্যাপারটা এতই অবাস্তব যে মুনিয়া সেটা চিন্তা করে খিক খিক করে হেসে ফেলল।
শান্ত মুনিয়ার হাসিটা না শোনার ভান করে তার মুখ আরও গম্ভীর করে বলল, “একশবার আমাকে।”
এবারে শুধু মুনিয়া না অন্যরাও একটু হাসল। প্রমি বলল, “তুই ছোটাচ্চুর কেস সলভ করবি?”
শান্ত বলল, “হ্যাঁ। আমি সলভ করব। তোমরা কী মনে করো? আমি পারব না?”
প্রমি বলল, “না–মানে ইয়ে–”
শান্ত বলল, “আমাকে কখনো সুযোগ দেওয়া হয় নাই। কিছু হলেই টুনি টুনি টুনি–এখানে যে শান্ত বলেও একজন মানুষ আছে তার মাথাতেও যে বুদ্ধি আছে সেইটা তোমাদের কারও চোখে পড়ে না?”
টুম্পা বলল, “তার মানে এখন থেকে টুনি আপুর বদলে তুমি ছোটাচ্চুর অ্যাসিস্ট্যান্ট?”
শান্ত বলল, “না। আমি কারো অ্যাসিস্ট্যান্ট না। আমি সব সময় নিজের জন্য কাজ করি।”
টুম্পা বলল, “কিন্তু এইটা তো ছোটাচ্চুর কাজ। আলুথালু মহিলা তো তোমার কাছে আসে নাই। ছোটাচ্চুর কাছে এসেছে!”
ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, “ব্যস, ব্যস, ব্যস। অনেক হয়েছে। এখন তোরা বিদায় হ এখান থেকে। আমারে কাউকেই নিতে হবে না। আমি নিজে নিজেই যাব।”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শান্ত ভাইকেই নিয়ে যাও।”
“কেন? শান্তকে কেন নিতে হবে?”
“শান্ত ভাইয়ার এত ইচ্ছা সেই জন্য।”
শান্ত বলল, “শুধু ইচ্ছা তোকে কে বলেছে? তুই মনে করিস এই সব কেস আমি সলভ করতে পারব না। তুই গিয়েছিস আলতু ফালতু কেসে। এইটা আলতু ফালতু কেস না। এইটা হচ্ছে মার্ডার কেস। মার্ডার কেসে তুই বাচ্চা মেয়ে কী করবি?”
শাহানা বলল, “টুনি বাচ্চা মেয়ে আর তুই বড় মানুষ?”
“আমি টিনএজার। টিনএজার বড় মানুষ থেকেও ইম্পরট্যান্ট। সবাই টিনএজারদের ভয় পায়।”
“তুই এই কেস সলভ করে ফেলবি? আগে করেছিস?”
“আমাকে যদি সুযোগ দেওয়া না হয় আমি কেমন করে দেখাব যে আমি পারি?”
শাহানা ছোটাচ্চুর দিকে তকিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু–তুমি এবারে শান্তকেই নিয়ে যাও দেখি সে কী করে!”
টুম্পা বলল, “তাহলে এর পরেরবার আমাকে।”
মুনিয়া বলল, “এর পরেরবার আমাকে।”
ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “আমার কাউকে নিয়ে যাওয়ার দরকার নাই। সবাই বিদায় হ এখান থেকে। তোদের যন্ত্রণায় আমার জীবন শেষ।”
পরেরদিন বিকালবেলা দেখা গেল শান্ত ছোটাচ্চুর সাথে যাওয়ার জন্য রেডি। ছোটাচ্চু মোটেই শান্তকে সাথে নেবে না কিন্তু সবাই মিলে তাকে রাজি করিয়ে ফেলল। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় টুনি শান্তর হাতে একটা অ্যাডভেঞ্চারের বই ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিয়ে যাও।”
“কেন? এই ফালতু বই কেন নিতে হবে?”
“যখন ছোটাচ্চু কথাবার্তা বলবে তখন তুমি এই বই পড়ার ভান করবে। বড়দের কাজের মাঝে ছোটরা থাকলে সবাই খুব বিরক্ত হয়।”
“কিন্তু তুই যখন যাস–”
“আমি সব সময় ভান করি কোনো একটা অন্য কাজে ছোটাচ্চুর সাথে চলে গেছি। ছোটাচ্চু আমাকে কোথাও নামিয়ে দেবে। এই রকম কিছু।”
শান্ত কিছু না বলে বইটা নিল। টুনি বলল, “আরও একটা কথা।”
“কী কথা?”
“তুমি ভুলেও মুখ খুলবে না। বড়দের কথার মাঝখানে কথা বলবে না। কোনো প্রশ্ন করবে না।”
শান্ত অবাক হয়ে বলল, “কোনো কথা বলব না?”
“না।”
“হিস্যু চাপলে?”
“চেপে রাখবে।”
“চেপে রাখব?”
“হ্যাঁ।”
“কী আজব।”
টুনি বলল, “মোটেও আজব না। বড়রা কখনো ছোটদের সিরিয়াসলি নেয় না। তুমি যে ওখানে আছ সেটা যেন কেউ বুঝতেই না পারে।”
“কী যন্ত্রণা।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, ছোটদের ডিটেকটিভ হওয়া অনেক যন্ত্রণা!”
টুনির আরও কিছু উপদেশ দেওয়ার ছিল কিন্তু ছোটাচ্চু তার আগেই বের হয়ে যাচ্ছিল, তাই শান্তকেও চলে যেতে হলো।
.
সবাই এক ধরনের আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে তাকে। ধরেই নিয়েছিল তাদের ফিরে আসতে অনেক সময় নেবে। কিন্তু দেখা গেল কিছুক্ষণের মাঝেই তারা ফিরে চলে এসেছে। ছোটাচ্চুর হাতে একটা ঠোঙ্গা এবং শান্তর মুখ বাড়াবাড়ি গম্ভীর।
সবাই ছোটাচ্চু আর শান্তর কাছে ছুটে গেল। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ছোটাচ্চ? শান্ত ভাইয়া? মার্ডারারকে ধরেছ?”
শান্ত দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “যদি কেউ আমার সাথে এই মার্ডার কেস নিয়ে কথা বলে তাহলে আমি একটা ঘুষি দিয়ে তার নাকটা চ্যাপ্টা করে দিব।”
সবাই অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। টুম্পা হাত দিয়ে নিজের নাকটাকে রক্ষা করে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “কেন? কেন ঘুষি মেরে নাক চ্যাপ্টা করে দিবে?”
শান্ত এবারে গর্জন করে উঠল, “আবার? আবার প্রশ্ন করিস?”
টুনি বলল, “কিন্তু শান্ত ভাইয়া, তুমি কিছু বলবে না–”
শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “না। বলব না। খালি এটা নিয়ে কথা বলব না তা না। কেউ যদি ডিটেকটিভ হওয়া নিয়ে কথা বলে তাহলেও ঘুষি মেরে নাকটা মাথার পেছন দিকে পাঠিয়ে দেব।”
মুনিয়া এবারে ছোটাচ্চুর পিছে গিয়ে লুকাল। টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু শান্তর মতো রেগে গেল না। মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “এ লিটল মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ভুল বোঝাবুঝি।”
“ভুল বোঝাবুঝি? কার সাথে কার?”
শান্ত আবার হুংকার দিল, “খবরদার কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবি না।”
টুনি বলল “কী আশ্চর্য। আমি তো তোমাকে জিজ্ঞেস করছি না। ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করছি।”
“না। আমার সামনে ছোটাচ্চুকেও জিজ্ঞেস করতে পারবি না।”
সবাই অবাক হয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো। প্রমি বলল, “ঠিক আছে শান্ত। তুই তাহলে যা। আমরা ছোটাচ্চুর কাছ থেকে শুনি কী হয়েছে।”
সবাই ভেবেছিল শান্ত বুঝি চলে যেতেও অস্বীকার করবে। কিন্তু অস্বীকার করল না। চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে বলল, “পরেও কেউ আমার সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে পারবে না।”
মুনিয়া বলল, “বললে কী করবে?”
শান্ত বলল, “একবার খালি বলে দেখ–”
টুনি বলল, “কী আশ্চর্য! তোমার সাথে পরেও মিঠুন মার্ডার কেস নিয়ে কথা বলা যাবে না?”
শান্ত গর্জন করে বলল, “মিঠুন নামটাও যেন আর কেউ উচ্চারণ করে।”
“মিঠুন নামটাও বলা যাবে না?”
শান্ত চিৎকার করে বলল, “না, না, না।”
তারপর জোরে জোরে পা ফেলে চলে গেল।
সবাই শান্তর পা দাপিয়ে চলে যাওয়া দেখল, তারপর ছোটাচ্চুর দিকে তাকালো। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, কী হয়েছে বলবে? মিঠুন মার্ডার কেস থেকেও বড় রহস্য শান্ত ভাইয়ার কেস।”
ছোটাচ্চু বলল, “ওই যে বললাম, একটা ভুল বোঝাবুঝি! কালকে ওই মহিলা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন যে মিঠুন তার গোল্ড ফিশ।”
একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল, “গোল্ড ফিশ!”
“হ্যাঁ। এই যে মরা মাছটাকে নিয়ে এসেছি।”
ছোটাচ্চু তার ঠোঙ্গাটা দেখাল, “ফ্রিজে রাখা ছিল আমার জন্য।”
“কেন এনেছ?”
“পোস্টমর্টেম করে একটা রিপোের্ট দিতে হবে।”
চোখ কপালে তুলে শাহানা বলল, “গোল্ড ফিশের পোস্টমর্টেম? কে করবে?”
“কে আবার। ঝুমু।”
সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো, তারপর মাথা নাড়ল, টুনি বলল, “হ্যাঁ। ঝুমু খালা পারবে। ঝুমু খালা ছাড়া আর কেউ পারবে না।”
.
ঝুমু খালার অবশ্য পোস্টমর্টেমও করতে হলো না। পেট মোটা মরা গোল্ড ফিশটা হাতে নিয়ে একটু এঁকে নাক কুঁচকে বলল, “বুঝছি।”
“কী বুঝেছ।”
“মাছে ফিনাইলের গন্ধ। মাছের ঘর, পাথর মাথর সবকিছু নিশ্চয়ই ফিনাইল সাবুন দিয়ে ধুইছে বুঝে নাই–ব্যস পানির মাঝে বিষ। মাছ পটপটাং-পেট ভাসাইয়া ডেড।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ। কাঁচের একটা বোলে রাখত, নিচে পাথরও ছিল সেখানে নাকি শ্যাওলা পড়েছিল, সেই জন্য নাকি সবকিছু খুব ভালো করে ধুয়েছে হার্পিক দিয়ে।”
টুনি বলল, “কে ধুয়েছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “বাসার কাজের মানুষ।”
টুনি বলল, “অস্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু মার্ডার কেস না। অবহেলাজনিত কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলা যায়।”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকালো, বলল, “এখন তাহলে কী করি?”
শাহানা বলল, “ঝুমু খালার পোস্টমর্টেমের সাথে একটা রিপোর্ট লিখে দিয়ে দাও।”
টুনি বলল, “সাথে এ রকম আরেকটা গোল্ড ফিশ।”
টুম্পা বলল, “এইবারে একটা মেয়ে গোল্ড ফিশ দিও, তার নাম হবে মিঠুনি!”
ছোটাচ্চু বলল, “তোরা সবাই মিলে একটা সুন্দর রিপোর্ট লিখে দিতে পারবি? টাকার বান্ডিলটা তাহলে তোদের দিয়ে দেব।”
সবাই মিলে একটা আনন্দের চিৎকার করে উঠল।
মুনিয়া রিনরিনে গলায় বলল, “শান্ত ভাইয়া কি এই টাকার ভাগ পাবে?”
উত্তর না দিয়ে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে।