কিডন্যাপ

কিডন্যাপ

নানি (কিংবা দাদি) টেলিভিশন দেখছেন, ঝুমু খালা দাদির চুলে কী। একটা জিনিস মাখিয়ে দিচ্ছে, তার গন্ধে ঘর ভরে গেছে। টেলিভিশনে একটা সিরিয়াল দেখাচ্ছে, যেখানে হঠাৎ করে আবিষ্কার হয়েছে নায়ক আসলে পলাতক খুনি। টেলিভিশনে প্রবল উত্তেজনা। ঝুমু খালা এবং দাদির মাঝেও সমান উত্তেজনা।

ঠিক এই সময় বাচ্চারা তাদের পড়াশোনা শেষ করে হুড়মুড় করে এসে ঢুকল। ঢুকেই একজন তার নাক চেপে ধরে বলল, “ইয়াক থু পচা গন্ধ!”

আরেকজন বলল, “মনে হয় ইঁদুর মরে পচে গেছে”

আরেকজন বলল, “এটা ঝুমু খালার টোটকা ওষুধের দুর্গন্ধ–বমি এসে যাচ্ছে। ঝুমু খালা! দাদির মাথায় কী লাগাচ্ছ?”

ঝুমু খালা হুংকার দিল, “চুপ! একটা কথা না।”

বাচ্চারা কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে আবার কথা বলতে শুরু করল। একটু আগে যে দুর্গন্ধের জন্য তাদের বমি এসে যাচ্ছিল তারা সেটার কথা ভুলে গিয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিল। শান্ত একটা ম্যাজিক দেখানোর চেষ্টা করছে, সেই জন্য তার একটা দশ টাকার নোট দরকার কিন্তু কেউ তাকে সেই নোট দিতে চাচ্ছে না।

এ রকম সময় ছোটাচ্চু ঘরে এসে ঢুকল, তার হাতে এক গোছা কাগজ। ভেতরে ঢুকেই কাগজের গোছাটা উপরে তুলে ধরে বলল, “আমার হাতে এই কাগজগুলো কী কে বলতে পারবে?”

শান্ত বলল, “বলতে পারলে কত টাকা দেবে?”

ছোটাচ্চু বলল, “তোর সমস্যাটা কী? টাকা ছাড়া কিছু চিন্তা। করতে পারিস না?”

শান্ত বলল, “তোমার সমস্যা কী? সবকিছুতে একটু টাকা পুরস্কার রাখলে ক্ষতি কী?”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “না। এখানে টাকা কিংবা অন্য কোনো পুরস্কার নাই।” হাতের কাগজের গোছা নাড়িয়ে বলল, “কে বলতে পারবে এই কাগজগুলো কী?”

একজন বলল, “বাতের ব্যায়ামের বিজ্ঞাপন।”

আরেকজন বলল, “দাঁতের পোকা কানের পোকার মহৌষধ।”

আরেকজন বলল, “সন্ত্রাসীর ফাঁসি চাই।”

আরেকজন বলল, “সন্ত্রাসীর মুক্তি চাই।”

আরেকজন বলল, “বদনা মার্কায় ভোট দিন।”

ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “উঁহু। হয় নাই। তোরা ধারেকাছে যেতে পারিস নাই।”

“তাহলে এগুলো কী?”

“এই কাগজগুলো হচ্ছে আমার কালজয়ী উপন্যাসের প্রথম চ্যাপ্টার! বাংলা সাহিত্যের নূতন সংযোজন। প্রথম আদি ও অকৃত্রিম গোয়েন্দা কাহিনি!”

“এর আগে কেউ গোয়েন্দা কাহিনি লিখে নাই?”

“চেষ্টা করেছে। কিছুই হয় নাই। রীতিমতো অখাদ্য।”

ছোট একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন? অখাদ্য কেন?”

“তার কারণ যারা লিখেছে তারা ডিটেকটিভের ড’ও জানে না। আমি হচ্ছি একমাত্র গোয়েন্দা লেখক যে একই সাথে আসল এবং খটি ডিটেকটিভ। আমি ডিটেকটিভ কাজ করেছি, শুধু আমি জানি ডিটেকটিভের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে। তাদের যুক্তিতর্ক বিশ্লেষণ সংশ্লেষণের–”

একজন জিজ্ঞেস করল, “সংশ্লেষণ মানে কী?”

ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে গেল। মাথা চুলকে বলল, “মনে হয় বিশ্লেষণের উল্টা হচ্ছে সংশ্লেষণ–যাই হোক সেইটা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমার লেখা। এর মাঝে আছে বুদ্ধিমত্তা এবং হিউমার, সাহিত্য এবং ক্রিয়েটিভিটি–”

শান্ত ছোটাচ্চুকে থামাল, বলল, “ছোটাচ্চু, নিজের প্রশংসা নিজের করতে হয় না।”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “আমি মোটেও নিজের প্রশংসা করছি না। আমি নির্মোহভাবে আমার লেখার কথা বলছি।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “নির্মোহ মানে কী?”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “নির্মোহ মানে কোনো রকম মোহ ছাড়া।”

“মোহ মানে কী?”

শান্ত বলল, “এইগুলি বড় মানুষের ব্যাপারস্যাপার তোর জানার দরকার নাই।”

টুনি বলল, “এত রকম কথার দরকার আছে? ছোটাবু তুমি বরং তোমার উপন্যাসের প্রথম চ্যাপ্টারটা পড়ে শোনাও।”

ছোটাচ্চুর মুখে হাসি ফুটে উঠল, মনে হলো এই কথাটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। টুম্পা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “পুরোটা?”

ছোটাচ্চু টুম্পার কথাটা না শোনার ভান করে একটা চেয়ারে আরাম করে বসে তার কাগজের গোছা খুলতে শুরু করল। সবাইকে এক নজর দেখে গলা খাকারি দিয়ে ছোটাচ্চু খুবই গম্ভীরভাবে নাটকীয় গলায় পড়তে শুরু করল, “শরতের বিকেল, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলক”

সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, “ঝটিকা ঝলক?”

“হ্যাঁ, আমার উপন্যাসের নায়কের নাম।”

শান্ত বলল, “এটা আবার কী রকম নাম। মনে হচ্ছে লঞ্চের নাম।”

ছোটাবু ধমক দিল, “চুপ কর। একটা উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে নাম। আমি যদি রহিম-করিম নাম দিই তাহলে কেউ পড়তে চাইবে? নাম সব সময় হতে হয় চমকপ্রদ।”

মুনিয়া বলল, “তাহলে চমকপ্রদই নাম দিয়ে দাও। ডিটেকটিভ চমকপ্রদ।”

সবাই হি হি করে হেসে উঠল। ছোটাচ্চু একটা ধমক দিয়ে বলল, “চুপ। সবাই চুপ।”

সবাই চুপ করল, তখন আবার ছোটাছু পড়তে শুরু করল। “ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলক মাথার নিচে হাত দিয়ে আধশোয়া হয়ে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মেঘের খেলা দেখতে দেখতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল ঠিক তখন তার মূল্যবান সিজিএফএক্স ফিফটি টু মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল–”

টুম্পা চোখ বড় বড় করে বলল, “কী জি ফিফটি টু?”

ছোটাচ্চু বলল, “সিজিএফএক্স ফিফটি টু।”

প্রমি বলল, “এটা আবার কোন কোম্পানি, নামই শুনি নাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “কীভাবে শুনবি, এইটা আমার দেওয়া বানানো নাম। আমি তো কোনো কোম্পানির বিজ্ঞাপন করতে পারি না সেই জন্য বানানো নাম দিয়েছি।”

টুনি বলল, “তুমি পড় ছোটাচ্চু।”

ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “পড়তেই তো চাচ্ছি কিন্তু সবাই ডিস্টার্ব করলে পড়ব কেমন করে?”

টুনি বলল, “ঠিক আছে, এখন থেকে কেউ ডিস্টার্ব করবে না। পড়া শেষ হলে প্রশ্নোত্তর পর্ব। এর আগে কোনো প্রশ্ন নাই। সবাই

চুপ।”

ছোটাচ্চু আবার পড়তে শুরু করল, “.সিজিএফএক্স ফিফটি টু ফোনটা বেজে উঠল। ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলক হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নেয়, সাথে সাথে সেখানে একজন লাস্যময়ী তরুণীর অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।”

শান্ত টেলিফোন পদ্ধতি নিয়ে কিছু আপত্তি করতে যাচ্ছিল। মুনিয়া ‘অবয়ব এবং টুম্পা লাস্যময়ী’ শব্দের অর্থ জানতে চাচ্ছিল কিন্তু টুনি সময়মতো তিনজনকেই থামিয়ে দেওয়ায় তারা কিছু বলতে পারল না। ছোটাচ্চু পড়তে থাকল, “তরুণী কিন্নরী কণ্ঠে বলল, আমি কি দেশের উদীয়মান ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলকের সাথে কথা বলছি?”

ঝটিকা ঝলক বলল, “আপনার অনুমান যথার্থ।”

তরুণী বলল, “আপনি কি সত্যিই ডিটেকটিভ?”

“আপনার কি সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে?”

“আপনার সম্পর্কে যে সব বিস্ময়কর কথা শুনি তার সব কি সত্যি?”

ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলক হা হা করে হাসল। তারপর বলল, “ঠিক আছে পরীক্ষা হয়ে যাক: আপনার অ্যাপার্টমেন্ট একটা মসজিদের সামনে, আপনি এই মুহূর্তে উত্তর দিকে তাকিয়ে আছেন। আপনার রুমে একটি ছোট্ট বাচ্চা এবং একজন বড় মানুষ আছে। ছোট বাচ্চাটিকে আপনি খুব আদর করেন, বড় মানুষটির ব্যাপারে আপনি উদাসীন। আপনি খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন এবং আপনি থাকেন শহরের সুন্দর অংশে। বাসার চারপাশে গাছপালা এবং আকাশে টিয়া পাখি। আপনি সম্ভবত একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং রাত জেগে কাজ করতে হয়।”

ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলক এক মুহূর্তের জন্য থামল, বলল, “আমি কি ঠিক ঠিক বলছি। নাকি আমার অনুমানে কোনো ভুল হয়েছে?”

লাস্যময়ী তরুণী ভঙ্গি করে বলল, “কী আশ্চর্য! আপনি আমাকে এক ঝলক দেখে কেমন করে এত কিছু বললেন? সব ঠিক ঠিক?”

ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলক হাসল, বলল, “সে জন্যই তো আমার নাম ঝটিকা ঝলক।”

“কিন্তু এটি তো অবিশ্বাস্য! এটি তো অসম্ভব!”

ডিটেকটিভ ঝলক গম্ভীর মুখে বলল, “এটি অসম্ভব কিছু নয়। এটি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তি।”

লাস্যময়ী তরুণী বলল, “আমাকে একটু বলবেন, আপনার পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তি।”

ঝটিকা ঝলক বলল, “কেন বলব না? একশবার বলব। আপনার ফোনে আমি পেছন থেকে আজানের শব্দ শুনেছি তাই আমি জানি বাসা মসজিদের সামনে। আপনার জানালা দিয়ে যে রোদ এসে পড়েছে সেটা দেখে বুঝতে পারছি সূর্য কোথায় এবং আপনি কোন দিকে মুখ করে আছেন। আপনার চোখ মাঝে মাঝেই সামনে নিচের দিকে আসছে এবং সেদিকে তাকাতেই আপনার চোখে মুখে আনন্দের আভা। সেখান থেকে জানি সামনে একটি শিশু এবং তাকে আপনি ভালোবাসেন। চোখ যখন সামনের দিকে যাচ্ছে তখন আপনার মুখের পেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছে তাই আমি জানি সেখানে একজন দাঁড়িয়ে আছে যার জন্য আপনার এক ধরনের অপছন্দের ভাব। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন চোখ ঘুরে যাচ্ছে দেখে বুঝতে পারছি পাখি উড়ে যাচ্ছে। পাখির ডাক থেকে অনুমান করছি টিয়া পাখি!”

লাস্যময়ী তরুণী বলল, “কী আশ্চর্য। কী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা! কিন্তু আপনি কেমন করে বুঝলেন আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং রাত জেগে থাকি?”

ডিটেকটিভ ঝটিকা ঝলক হা হা করে হাসল, বলল, “আপনি যখন কথা বলছেন তখন আমি দেখছি আঙুলগুলো নড়ছে–কি বোর্ডে যেভাবে নড়ে। সেটি দেখে অনুমান করছি। আপনি ল্যাপটপে অনেক কাজ করেননিশ্চয়ই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের অনেক রাত জাগতে হয়। দুইয়ে দুইয়ে চার।”

লাস্যময়ী তরুণী কল কল করে বলল, “কী অসাধারণ!”

এই পর্যন্ত পড়ে ছোটাচ্চু একটু থামল, তারপর বলল, “কেমন লাগছে।”

বাচ্চারা হইচই করে উঠল, “নকল নকল! শার্লক হোমসের নকল। মিছির আলীর নকল।”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “মোটেও নকল না। সব আমার ডিটেকটিভ লাইফের অভিজ্ঞতা। বলতে পারিস শার্লক হোমস আমার নকল।”

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “এই লাস্যময়ী তরুণীর সাথে কি ডিটেকটিভের বিয়ে হবে?”

সবাই আবার চিৎকার করতে থাকল, “ইয়েস ইয়েস বিয়ে বিয়ে! ইয়ে এবং বিয়ে। ইয়ে এবং বিয়ে!”

বাচ্চারা এত জোরে চিৎকার করতে লাগল যে দাদি আবার ধমক দিলেন। বললেন, “তোদের হয়েছেটা কী, একটু চুপ করবি?”

ঝুমু খালা বলল, “এমনিতে চুপ না করলে মুখের মাঝে টেপ মাইরা দিতে হবে।”

ছোটাচ্চু তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “নাহ্! তোদের মাঝে এখনো ম্যাচুরিটির ম পর্যন্ত নাই। তোদেরকে আমার উপন্যাস পড়ে শোনানোই ভুল হয়েছে।”

তারপর তার কাগজের গোছা হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। অন্য সবাই আগের খেলায় মেতে উঠল, শুধু টুনি ছোটাচ্চুর পেছনে পেছনে হেঁটে হেঁটে গেল।

ছোটাচ্চু টুনিকে দেখে বললেন, “কিছু বলবি?”

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, “তোমার উপন্যাসে তুমি যে পর্যবেক্ষণ আর যুক্তি তর্কের কথা লিখেছ সেগুলো সত্যি তুমি করেছ?”

“হ্যাঁ।” ছোটাচ্চু বুকে থাবা দিয়ে বলল, “তুই ভুলে গেছিস আমি ছিলাম দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ার?”

টুনি মাথা নাড়ল, “তোমার আবার ডিটেকটিভ হওয়া উচিত।”

ছোটাচ্চু একটা নিঃশ্বাস ফেলল, কলল, “নাহ! সরফরাজ কাফী আমার এজেন্সিটা দখল করার পর মন উঠে গেছে। আর ইচ্ছে করে না।”

“তুমি যদি এজেন্সিটা পাও তাহলে করবে?”

ছোটাচ্চু হা হা করে হাসল। বলল, “এই এজেন্সি আমি কেমন। করে পাব? বললাম না, মন উঠে গেছে!”

টুনি কোনো কথা বলল না, তারপর বলল, “বুঝেছি।”

***

সকালবেলা টুনি শুনল দাদির (কিংবা নানি) ঘর থেকে একজন মহিলার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। গলার স্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে মহিলাটি খুব খুশি। দাদির খুব আপন মানুষ না হলে একজন দাদির ঘরে আসতে পারে না। বেশি পরিচিত না হলে দাদি তার সাথে বাইরের ঘরে দেখা করেন। যেহেতু ভেতরে দাদির ঘরে কথাবার্তা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে যে এসেছে সে দাদির পছন্দের মানুষ।

টুনি উঁকি দিল, দেখল আসলে একজন নয়, তিনজন এসেছে। একটা ছয় সাত বছরের বাচ্চা আর তার বাবা মা। মায়ের বয়স বেশি না, খুবই টিশটাশ একজন মহিলা দেখে মনে হয় কলেজে না হয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। বাবা মনে হয় একটু চুপচাপ মানুষ, মুখটা হাসি হাসি করে বসে আছে। মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু টিশটাশ মহিলার উৎসাহের কারণে বেশি সুবিধা করতে পারছে না। তবে তিনজনের ভেতর সবচেয়ে দেখার মতো মানুষ হচ্ছে বাচ্চাটি। তার মুখে বিশাল একটা গাম্ভীর্য। এত ছোট বাচ্চার চেহারার এ রকম গাম্ভীর্য আসলে দেখা যায় না–দেখলে কেমন যেন হাসি পেয়ে যায়।

টুনিকে উঁকি মারতে দেখে দাদি ডাকলেন, “টুনি, শুনে যা।”

অনেক সময়েই দাদির গেস্টদের চেহারা দেখে দাদি (কিংবা নানি) দেখে ফেলার আগেই টুনি পালিয়ে যায়। আজকের গেস্টদের সে রকম বিপজ্জনক মনে হলো না, তাই টুনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। টুনি তার মুখটা হাসি হাসি করে ভেতরে ঢুকল। টুনিকে দেখে মহিলা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, বলল, “ও মা! এই বুঝি টুনি! আমার টুনির কথা মনে আছে শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন টুনির বয়স পাঁচ, মুখ গম্ভীর করে হাঁটে আর বড় মানুষের মতো কুট কুট করে কথা বলে!”

দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “এখনো মুখ গম্ভীর করে হাঁটে। এখনো কুট কুট করে কথা বলে!”

টুনি একটু আপত্তি করল, বলল, “না দাদি! আমি মোটেও কুট কুট করে কথা বলি না!”

দাদি হাসলেন, মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তবে আমাদের টুনি অন্যগুলোর মতো এত দুষ্টু না। খুবই দায়িত্বশীল।”

মেয়েটি বলল, “আপনার নাতনি দায়িত্বশীল না হলে কে হবে?”

দাদি বললেন, “তোমার ছেলেটাকে টুনির কাছে দিয়ে দাও, সে তাকে নিয়ে যাক। অন্যদের সাথে খেলবে।”

মেয়েটি খুশি হলো, বলল, “তাহলে তো ভালোই হবে। টুনি, নিয়ে যাবে?”

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”

বাবা এতক্ষণ পর কথা বলার সুযোগ পেল, বলল, “ভেরি গুড টুনি। শুধু তোমাকে একটা জিনিস বলে দিই। আমরা টিটনকে বাংলায় কথা বলতে শেখাচ্ছি। সামনের বছর আমরা সবাই দেশে ফিরে আসব–”

মেয়েটি বলল, “এখন আমরা আমেরিকা থাকি। ছুটিতে বেড়াতে এসেছি।”

বাবা বলল, “কাজেই টিটনকে সব কথা বাংলায় বলতে হবে। তাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেবে না। ঠিক আছে?”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

টিটনের মা বলল, “টিটন এই প্রথম দেশে এসেছে। আমরা চাইছি পাকাপাকিভাবে ফিরে আসার আগে দেশটা একটু দেখে যাক।”

টুনি আবার বলল, “ঠিক আছে।”

বাবা বলল, “যাও টিটন। তোমার টুনি আপুর সাথে যাও।”

টিটন নামের ছোট ছেলেটা সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। টুনি তার হাত ধরে বের হয়ে ছেলেটাকে বলল, “তোমার যদি বাংলায় কথা বলতে অসুবিধা হয় তুমি মাঝে মাঝে ইংরেজিতে কথা বলতে পার।”

বাচ্চাটি বলল, “কিন্তু আমি যে প্রমিজ করেছি আমি শুধু বাংলায় টক করব।”

“কিন্তু তুমি যদি বাংলা একটা শব্দ না জান তখন কী করব? তখন তো একটু ইংরেজি বলতেই হবে।”

বাচ্চাটা বলল, “কিন্তু আমি যে প্রমিজ করেছি। আমার প্রমিজ যে ব্রেক করে যাবে।”

টুনি বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

“কী আইডিয়া?”

“আমার সাথে আস।”

টুনি টিটনকে নিয়ে রান্নাঘরে গেল। সেখানে ঝুমু খালা নিচু গলায় গান গাইতে গাইতে কড়াইয়ে কিছু একটা ঘুটছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “আরেকটু জোরে গান গাও না কেন ঝুমু খালা, আমরাও শুনি।”

“আমি তোমার জন্য গান গাইছি নাকি? আমি গান গাইছি আমার পায়েশের জন্য। আমার পায়েশ গান শুনলে ভালো মতন পাকাবে।”

এই বাসার ছেলেমেয়েরা ঝুমু খালার কথাবার্তা শুনে অভ্যস্ত। তাই পায়েশের জন্য গান গাইছে শুনে অবাক হলো না। ঝুমু খালা টিটনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেলে কেডা?”

“এর নাম টিটন। এরা আমেরিকায় থাকে, দেশে চলে আসবে তাই দেশ দেখতে এসেছে।”

ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, বলল, “ফাস্ট ক্লাস আইডিয়া। যেই দেশের মানুষ বদনা চিনে না সেই দেশে মানুষ থাকে নাকি!”

তারপর টিটনকে ভালো করে লক্ষ করে বলল, “কিন্তু এই বিদেশি মানুষ আমার পাক ঘরে কেন?”

“আমার একটা কৌটা দরকার।”

“কী করবা? কত বড় কৌটা? ভেতরে কী রাখবা?”

“প্রমিজ।”

ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “প্রমিজ কী?”

“প্রমিজ মানে হচ্ছে প্রতিজ্ঞা। টিটন তার আব্ব আম্মুর কাছে প্রমিজ করেছে সে বাংলায় কথা বলবে। ইংরেজিতে বলবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে ইংরেজি বললে প্রমিজ ভেঙে যাবে। সেই জন্য প্রমিজটা একটা কৌটার মাঝে রেখে দিতে চাই। তাহলে মাঝে মাঝে ইংরেজি বললেও প্রমিজটা ভাঙবে না। তুমি কৌটাটা রেখে দিও।”

ঝুমু খালা সবকিছু বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, “ও আচ্ছা, বুঝেছি।”

“টিটন যাবার সময় কৌটা থেকে প্রমিজটা নিয়ে যাবে।”

“সেইটা তো নিতেই হবে।”

বলে ঝুমু খালা খুবই গম্ভীর হয়ে একটা কৌটা খুঁজতে লাগল। র‍্যাক থেকে খালি কৌটা নামিয়ে ভেতরে তাকিয়ে, গন্ধ শুঁকে, ঝাঁকিয়ে সে কৌটা পছন্দ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত একটা জেলির খালি বয়াম তার পছন্দ হলো। সেটা খুলে টিটনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “রাখ। তোমার প্রমিজটা এইখানে রাখ।”

টিটন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে ছিল। পুরো ব্যাপারটা নিশ্চয়ই এক ধরনের ঠাট্টা কিন্তু ঝুমু খালার গম্ভীর মুখ দেখে সেটা বোঝার উপায় নাই। সে একবার টুনির দিকে তাকালো তারপর ঝুমু খালার দিকে তাকালো, তারপর জিজ্ঞেস করল, “কেমন করে রাখব?”

ঝুমু খালা বলল, “বয়ামে মুখ লাগিয়ে জোরে বল, ‘হুঁক’। প্রমিজটা বের হয়ে আসবে।”

টিটন এইবারে হাসল, বলল, “যাও! এইভাবে প্রমিজ রাখা যায় না।”

ঝুমু খালা বলল, “ঠিক আছে তুমি রাখতে না চাইলে রাইখ না। কিন্তু তাকায়া দেখো আমি কতজনের প্রমিজ এইখানে রাখছি।” ঝুমু খালা হাত দিয়ে কৌটাগুলো দেখাল।

টিটন বুঝল পুরোটাই একটা মজা, কিন্তু সে মজাটা করতে এবারে আপত্তি করল না। বয়ামে মুখ রেখে বলল, “হুক।”

ঝুমু খালা বয়ামটা খুলে ভেতরে তাকালো, তারপর বলল, “পুরোটা বাইর হয় নাই। আরেকটু।”

টিটন আবার মুখ লাগিয়ে বলল, “হুক।”

ঝুমু খালা সন্তুষ্ট হয়ে বয়ামের মুখ লাগিয়ে বয়ামটা র‍্যাকের ওপর রেখে বলল, “ফাস্ট ক্লাস।”

তারপর আবার তার পায়েশ নাড়তে নাড়তে গান গাইতে লাগল।

টুনি ঝুমু খালাকে বলল, “থ্যাংকু ঝুমু খালা।”

তারপর টিটনের হাত ধরে বের হয়ে এল। বের হয়েই টিটন বলল, “শি ইজ এ ফানি লেডি।”

প্রমিজ ভেঙে যাবার ভয় নেই তাই তার ইংরেজিতে কথা বলতেও কোনো সমস্যা নেই।

টুনি বলল, “হ্যাঁ। এ হচ্ছে ঝুমু খালা। এই বাসায় ঝুমু খালা সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট। সবকিছু চালায়। আমাদের যখনই কিছু দরকার হয় আমরা ঝুমু খালার কাছে আসি।”

“ইন্টারেস্টিং।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার দেশ কেমন লেগেছে?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ইন্টারেস্টিং। খুব বেশি মানুষ।”

“তোমরা চলে এলে আরো তিনজন বেড়ে যাবে!”

টুনি ঠাট্টা করছে না সত্যি কথা বলছে বোঝার জন্য একবার টুনির দিকে তাকালো। টুনি বলল, “দেশের মানুষগুলো কেমন লেগেছে?”

এবারে সাথে সাথে উত্তর দিল, “বোরিং।”

“বোরিং?” টুনি অবাক হলো, “কেন?”

“সবাই বোরিং কাজ করে। ডক্টর ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর অফিসার। হাউ বোরিং।”

“কারা বোরিং না?”

“ফায়ার ফাইটার। পুলিশ। রবারস।”

“রবার মানে ডাকত?”

“হ্যাঁ।”

টিটন টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাসার সবাই কী করে?”

টুনি চিন্তা করে দেখল টিটনের হিসেবে তাদের বাসার সবাইও বোরিং কাজ করে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর অফিসার। তখন হঠাৎ করে তার ছোটাচ্চুর কথা মনে পড়ল। টুনি মুখ টিপে হেসে বলল, “আমাদের বাসার একজন হচ্ছে ডিটেকটিভ।”

“ডিটেকটিভ!” টিটন রীতিমতো চিৎকার করে উঠল, “রিয়েল ডিটেকটিভ?”

“হ্যাঁ সত্যিকারের ডিটেকটিভ।”

“সত্যি?”

“সত্যি ।”

টিটনের বাংলায় কথা বলার কথা কিন্তু উত্তেজনায় তার সে কথা মনে নাই। তা ছাড়া প্রমিজটা ঝুমু খালার জেলির বয়ামে রেখে আসার কারণে সেটা নিয়ে অপরাধবোধও নাই। তাই একেবারে হড়বড় করে ইংরেজিতে কথা বলতে লাগল, “সত্যি সত্যি ডিটেকটিভ! কী আশ্চর্য! আমি কখনো সত্যিকারের ডিটেকটিভ দেখি নাই, শুধু বইয়ে পড়েছি আর সিনেমায় দেখেছি। আমি কি এই ডিটেকটিভের সাথে দেখা করতে পারি? কথা বলতে পারি? আমি কি তার সাথে ছবি তুলতে পারি? সে কি আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিতে রাজি হবে?”

টুনি মুখ টিপে হেসে বলল, “এই ডিটেকটিভ হচ্ছে আমার ছোট চাচা, সে এই বাসাতেই থাকে, কাজেই ইচ্ছা করলেই তুমি তার সাথে দেখা করতে পারবে, কথা বলতে পারবে।”

“প্লিজ প্লিজ আমাকে তুমি তার কাছে নিয়ে যাও।”

“ঠিক আছে, চল দেখি। এই ডিটেকটিভ অনেক দেরি করে ঘুমায়, তাই দেখতে হবে ঘুম থেকে উঠেছে কিনা।”

টিটন চোখ বড়বড় করে বলল, “অবশ্যই ডিটেকটিভদের দেরি করে ঘুমাতে হয়। সব ক্রিমিনালরা রাত্রে বেলা বের হয়, তাদের ধরার জন্য ডিটেকটিভদের রাত জাগতে হয়। তোমার ডিটেকটিভ চাচা ঘুমিয়ে থাকলে কোনো অসুবিধে নাই। আমি দরজার বাইরে অপেক্ষা করব।”

টিটনকে অবশ্য দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে হলো না, কারণ ছোটাচ্চু  ঘুম থেকে উঠে বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুল এলোমেলো এবং পরনে ঘুমের কাপড়। তাকে দেখে মোটেও সত্যিকারের ডিটেকটিভের মতো দুর্ধর্ষ লাগছে না। ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকে টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, এই যে টিটন তোমাকে দেখতে এসেছে।”

ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে বলল, “আমাকে? আমাকে কেন?”

“তার কারণ টিটন কখনো সত্যিকারের ডিটেকটিভ দেখে নাই।”

ছোটাচ্চুর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “এত সকালে ডিটেকটিভ দেখার জন্য কোথা থেকে এসেছে?”

“এর আম্বু আম্মু আমেরিকা থাকেন। তারা সামনের বছর দেশে চলে আসবেন তাই এই বছর ছেলেকে নিয়ে দেশে এসেছেন তাকে দেশ দেখানোর জন্য এবং বাংলায় কথা বলানোর জন্য। কিন্তু তোমাকে দেখার উত্তেজনায় সে বাংলায় কথা বলতে ভুলে গেছে।”

টিটন মাথা নেড়ে বলল, “না, না এখন থেকে আমি আবার বাংলায় স্পিক করব।”

টুনি বলল, “ভেরি গুড।”

টিটন ছোটাচ্চুর দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, “তুমি সত্যি সত্যি ডিটেকটিড?”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

“তোমার কাছে কি ম্যাগনিফাইং গ্লাস আছে? আর গান?”

“ম্যাগনিফাইং গ্লাস আছে কিন্তু গান নাই। আমি গান বন্দুক রিভলবার পিস্তল এইসব পছন্দ করি না।”

“কিন্তু তোমাকে যদি ক্রিমিনালরা অ্যাটাক করে তখন তুমি কী করবে?”

এই বাচ্চাটির কোন ধরনের উত্তর পছন্দ হবে ছোটাচ্চু  জানে না তাই চিন্তা করে বলল, “ক্রিমিনালরা মনে হয় আমাকে ভয় পায়। তাই তারা কখনো অ্যাটাক করতে আসে না।”

“ডিটেকটিভরা অনেক ইন্টেলিজেন্ট হয় তুমি কি অনেক ইন্টেলিজেন্ট?”

“সেটা তো আমার জানা নেই। তবে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট অনেক ইন্টেলিজেন্ট।”

“তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট কী করে?”

ছোটাচ্চু হাসল, তারপর টুনিকে দেখিয়ে বলল, “এই যে টুনি আমার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট।”

টিটন প্রথমে কথাটা বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল তখন ধরে নিল ছোটাচ্চু ঠাট্টা করছে। সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একবার ছোটাচ্চু আরেকবার টুনির দিকে তাকালো। তারপর বলল, “তুমি আমার সাথে ফান করছ? চিলড্রেনরা কখনো ডিটেকটিভ হতে পারে না।”

ছোটাচ্চু  বলল, “কিন্তু আমাদের টুনি সত্যিকারের ডিটেকটিভ। তুমি দেখতে চাও?”

টিটন এবারে আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল, “ইয়েস। আমি দেখতে চাই।”

ছোটাচ্চু উঠে তার শেলফ ঘাটাঘাটি করে একটা পুরানো পত্রিকা বের করে আনল। গাবড়া বাবাকে ধরার পর পত্রিকায় একটা প্রতিবেদন বের হয়েছিল সেখানে টুনির ছবি ছাপা হয়েছিল। ছোটাচ্চু পত্রিকাটা টিটনের হাতে দিয়ে বলল, “এই দেখো এখানে লেখা ক্ষুদে গোয়েন্দা, গোয়েন্দা মানে হচ্ছে ডিটেকটিভ। এই দেখো টুনির কত বড় ছবি।”

টিটন বাংলা পড়তে পারে না কিন্তু ছবি তো আর মিথ্যা কথা বলবে না। টুনির ছবিটা সবচেয়ে বড় কিন্তু সেখানে ছোট করে ছোটাচ্চুর ছবিও আছে এবং হাতে হাতকড়া লাগানো গাবড়া বাবার ছবিও আছে। অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।

টিটন মুখ হাঁ করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাংলায় কথা বলার প্রতিজ্ঞাটা পুরোপুরি ভুলে গিয়ে ইংরেজিতে হড়বড় করে বলতে লাগল, “হায় খোদা! কী আশ্চর্য ব্যাপার! কী রহস্যময় ব্যাপার! তুমি একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ? তুমি একজন সত্যিকারের ডিটেকটিভ? তুমি এত বড় সেলিব্রেটি যে খবরের কাগজে তোমার ওপর লেখা ছাপা হয়? ছবি ছাপা হয়? আমি কি সৌভাগ্যবান যে তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তুমি নিজে আমার হাত ধরে এখানে এনেছ? আমি তোমার ছবি তুলে নিয়ে যাব, স্কুলে দেখাব। আমার বন্ধুরা, আমার টিচার সবাই অবাক হয়ে যাবে”

টুনি টিটনকে থামাল, বলল, “এটা এমন কোনো ব্যাপার না। আমাদের দেশে পত্রিকা এমনিতেই এ রকম খবর ছাপায়।”

টিটন মানল না, মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না। তুমি বিনয় করছ। আমাদের টিচার বলেছেন, মহান মানুষেরা সব সময় বিনয়ী হয়! তুমি একজন মহান ডিটেকটিভ! তুমি কি তোমার ডিটেকটিভ জীবনের গল্প আমাকে শোনাবে? প্লিজ!”

টুনি হাসল, একটু লজ্জাও পেল! বলল, “আমার বলার মতো এমন কিছু গল্প নাই, তুমি যদি আসলেই শুনতে চাও বলতে পারি এক দুইটা গল্প! তুমি কিন্তু বাংলা বলতে ভুলে যাচ্ছ!”

টিটন থতমত খেয়ে বলল, “বলব। বলব। এখন থেকে বাংলায়। স্পিক করব। কিন্তু তুমি আমাকে ডিটেকটিভ স্টোরি বলবে প্লিজ!”

টুনি বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে বলব। চল আমার সাথে।”

কাজেই টুনি টিটনের হাত ধরে নিয়ে গেল, তারপর তাকে নিজের ঘরে বসিয়ে ডিটেকটিভ গল্প শোনাল। প্রথমে বানর চোর ধরার কাহিনি, তারপর গাবড়া বাবা ধরার কাহিনি। গল্প শোনানো হচ্ছে সেই খবরটা জানাজানি হওয়ার কারণে টুম্পা আর মুনিয়াও চলে এসেছে, তাদের জানা গল্প তবুও গল্প শুনতে তাদের ভালো লাগে।

গল্প শেষ হওয়ার পর টিটন হঠাৎ করে বলল, “টুনি আপু, তুমি আমাকে তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাবে?”

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“আমিও তোমার মতন ডিটেকটিভ হতে চাই। তুমি আমাকে ট্রেইন করবে।”

টুনি হাসি গোপন করল, বলল, “ঠিক আছে।”

টিটনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। হাততালি দিয়ে বলল, “ইয়েস!”

তারপর টুনির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন থেকে আমি তোমাকে বস ডাকব। ঠিক আছে?”

টিটনের কথা শুনে টুম্পা আর মুনিয়া খিক খিক করে হেসে উঠল। টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “বস ডাকবে? আমাকে?”

“হ্যাঁ।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “আর টুনি আপু তোমাকে কী ডাকবে? অ্যাসিস্ট্যান্ট?”

টিটন মাথা নাড়ল, বলল, “নো। বস আমাকে ডাকবে পার্টনার।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওকে বস?”

টুনি হাসি গোপন করে বলল, “ওকে?”

টিটন হাত উপরে তুলে বলল, “হাই ফাইভ!”

টুনিকে তখন হাত তুলে টিটনের সাথে হাই ফাইভ করতে হলো। দেখা গেল ডিটেকটিভ হওয়ার ব্যাপারে টিটন খুবই সিরিয়াস। তখন তখনই সে ট্রেনিং নিতে রেডি। টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “বস, ডিটেকটিভ হলে কী করতে হয় বস?”

টুনি মাথা চুলকালো, কিছু একটা উত্তর দিতে হবে তাই বলল, “ডিটেকটিভ হতে হলে সব সময় চোখ কান খোলা রাখতে হয়। চারপাশে কী হচ্ছে সেটা সব সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। যে জিনিসটা অন্যরা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না সেটাও তোমাকে দেখতে হবে।”

ডিটেকটিভ হওয়ার এ রকম মূল্যবান একটা উপদেশ জানতে পেরে টিটন খুশি হয়ে উঠল। মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “গট ইট। বুঝতে পেরেছি। আর কিছু আছে?”

বিষয়টার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য টুনি গম্ভীর মুখে বলল, “আরও অনেক কিছু আছে কিন্তু একদিনে বেশি ট্রেনিং নিয়ে কাজ নেই।”

টিটন বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ, বস।”

আরও ঘণ্টাখানেক পর টিটনের বাবা-মা দাদির (কিংবা নানির) কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য রেডি হলেন। এই পুরো সময়টুকু টিটন টুনির পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করে কাটাল। যখন তাকে সম্বোধন করতে হয়েছে তাকে বস বলে সম্বোধন করেছে এবং টুনিকেও প্রত্যেকবার তাকে পার্টনার বলে ডাকতে হয়েছে। বিষয়টা দেখে সবাই মুখ টিপে হেসেছে কিন্তু সে জন্য টিটনের গুরুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এতটুকু কমে নাই।

ঠিক বাসা থেকে বের হওয়ার সময় টিটনের মনে পড়ল সে। রান্নাঘরে ঝুমু খালার কাছে তার প্রমিজটা জমা রেখে এসেছে। কাজেই যখন তার বাবা-মা অপেক্ষা করছে তখন টুনি টিটনকে নিয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল। পেছনে পেছন মজা দেখার জন্য অন্য বাচ্চারা!

ঝুমু খালা রান্নাঘরে চুলাকে বকাবকি করছিল, টিটনকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলল, “তোমার প্রমিজ নিবা?”

টিটন মাথা নাড়ল, বলল, “ইয়েস প্লিজ।”

ঝুমু খালা জেলির বয়ামটা নিয়ে তার মুখ খুলে টিটনের মুখের সামনে ধরে বলল, “নাও। সুড়ৎ করে টেনে নাও।”

টিটন সুড়ৎ করে টেনে নিল। ঝুমু খালা বয়ামের ভেতর তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস।”

টিটন ঝুমু খালার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার বসের হাত ধরে বাইরের ঘরে ছুটে গেল। পেছনে পেছনে অন্য বাচ্চারা।

***

দুইদিন পর সন্ধেবেলা দাদি যখন তার সোফায় বসে একটা মোটা উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করছেন তখন তার টেলিফোনটা বেজে উঠল। দাদির জন্য টেলিফোনটা যথেষ্ট জটিল একটা বিষয়। প্রথমে দাদি বুঝতেই পারেন না যে তার টেলিফোন বাজছে। যখন বুঝতে পারেন তখন টেলিফোনটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকেন। টেলিফোনটা খুঁজে বের করতে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণে লাইন কেটে যায়। টেলিফোনটা খুঁজে বের করে দেখার চেষ্টা করেন কে তাকে ফোন করেছে। সাধারণত তখন তার কোনো একজন নাতি বা নাতনি তাকে সাহায্য করে। আজকেও তাই করতে হলো একজন তার ফোন পরীক্ষা করে বলল, “নানি, টিটনের মা ফোন করেছিল।”

দাদি হতাশভাবে বললেন, “কিন্তু লাইনটা তো কেটে গেল।”

ঠিক তখন আবার ফোনটা বেজে উঠল। দাদি তাড়াতাড়ি এবারে ফোনটা ধরলেন, অন্য পাশ থেকে টিটনের মায়ের গলার স্বর শুনেই দাদির মুখটা নরম হয়ে গেল। হাসি হাসি মুখে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ! আমি জানি তুমি টিটনের আম্মু।”

অন্যপাশ থেকে টিটনের আম্মু কিছু একটা বললেন তখন দাদির মুখের হাসিটা আরো বিস্তৃত হলো। বললেন, “আমি বরং আমার ছেলেকে ডেকে দিই তুমি সরাসরি তার সাথে কথা বলো।”

দাদি তখন তার একজন নাতিকে বললেন, “তোর ছোটাচ্চুকে। ডেকে আন দেখি।”

ছোটাচ্চুকে ডেকে আনা একটা অসম্ভব কঠিন কাজ এবং তাকে ডেকে আনতে গিয়ে জানটা বের হয়ে যাচ্ছে এ রকম মুখভঙ্গি করে সে যন্ত্রণার নানা রকম শব্দ করতে করতে ছোটাচ্চুকে ডেকে আনতে গেল।

কয়েক মিনিট পর ছোটাচ্চু তার পেট চুলকাতে চুলকাতে এবং হাই তুলতে তুলতে এসে বলল, “মা, তুমি ডেকেছ?”

দাদি বললেন, “হ্যাঁ। টিটনের আম্মু তোর সাথে কথা বলবে। টিটনকে চিনেছিস তো–”

ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ মা, চিনি।”

ছোটাচ্চু টেলিফোনটা কানে লাগিয়ে একটা চেয়ারে বসে বলল, “হ্যালো। আমি শাহরিয়ার বলছি।”

অন্যপাশ থেকে টিটনের আম্মু বলল, “আমি টিটনের আম্মু বলছি।”

ছোটাচ্চু বলল, “জি বুঝতে পেরেছি। টিটনকে সেদিন দেখেছি। খুবই মজার একটি বাচ্চা।”

টিটনের আম্মু বলল, “আমি টিটনের ব্যাপারেই একটু কথা বলার জন্য ফোন করেছি। আমি জানি না আপনি জানেন কিনা, আমরা আমেরিকা থাকি, সামনের বছর দেশে চলে আসব।”

ছোটাচ্চু বলল, “জি, আমি শুনেছি।”

“আমরা তো আমার নিজের দেশে ফিরে আসব, কিন্তু টিটনের জন্য সেটা তো সত্যি না। তার জন্ম হয়েছে সেই দেশে, বড় হয়েছে। সেই দেশে, কাজেই সে তো নিজের দেশে আসবে না! এই দেশটা

তো তার জন্য বিদেশ। সে বিদেশে আসবে।”

“ঠিকই বলেছেন।”

“সেইজন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম তাকে দেশের সাথে একটু পরিচিত করতে। তাই তাকে নিয়ে এই বছর দেশে এসেছি। দেশের ভালো ভালো জিনিস দেখিয়েছি, ভালো ভালো জায়গায় নিয়ে গেছি। উদ্দেশ্য একটাই দেশটাকে একটু চিনুক। দেশটাকে একটু ভালোবাসুক।

“বুঝতে পারছি।”

টিটনের আম্মু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয় নাই। টিটন যথেষ্ট চাপা ছেলে। ঠিকভাবে প্রকাশ করে নাই কিন্তু আমরা বুঝতে পেরেছি দেশটাকে এখনো সে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে নাই। তাই সামনের বছর দেশে ফেরা নিয়ে তার ভেতরে এক ধরনের চাপা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল।”

টিটনের আম্মু কেন তাকে এই কথাগুলো বলছে চিন্তা করতে করতে ছোটাচ্চ বলল, “ও, আচ্ছা!”

পরের কথাটি থেকেই অবশ্য ছোটাচ্চ বুঝে গেল কেন তাকে এই কথাগুলো বলা হচ্ছে। কারণ টিটনের আম্মু বলল, “কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন? পরশু দিন আপনাদের বাসা থেকে আসার পর একেবারে ম্যাজিকের মতো সবকিছু পাল্টে গেছে। এখন দেশ নিয়ে তার উৎসাহের শেষ নাই। সারাক্ষণ আপনাদের কথা বলছে।”

ছোটাচ্চু হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের বাসায় স্বাভাবিক মানুষ বলে কিছু নেই! সবাই মাথা খারাপ। ছোট বাচ্চারা সাধারণত সেটা পছন্দ করে।”

“সারাক্ষণ আপনার কথা বলছে। টুনিকে বস বলে ডাকছে। সে নিজে নাকি টুনির পার্টনার। রান্নাঘরে কীভাবে জেলির বয়ামে প্রমিজ জমা করে রাখা যায় সেটাও শিখে এসেছে”

ছোটাচ্চু আবার হাসল। টিটনের আম্মু বলল, “এতক্ষণ যেটা বললাম সেটা হচ্ছে ভূমিকা। এখন আসল কথায় আসি।”

ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে। বলেন।”

“আমরা সামনের সপ্তাহে আমেরিকা ফিরে যাব। আমি চাইছিলাম যাবার আগে টিটন যদি আপনাদের সাথে আরও কিছু সময় কাটাতে পারে।”

ছোটাচ্চু বলল, “অবশ্যই। অবশ্যই।”

“একটু অন্যভাবে।”

ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকালো। বলল, “কীভাবে?”

“আমরা উইকেন্ডে একটা রিসোর্টে যাচ্ছি। টুনি যদি আমাদের সাথে যেতে পারে তাহলে টিটনের জীবনটা পাল্টে যাবে। আপনার বাসার বাচ্চাদের যে কয়জন আমাদের সাথে যেতে চায় আমরা তাদেরকেও নিয়ে যেতে চাই। তবে যেহেতু বাচ্চাদের নিয়ে যেতে চাইছি তাই তাদের গার্জিয়ান হিসেবে আপনি যদি আমাদের সাথে যেতে রাজি থাকেন–”

ছোটাচ্চু কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে! যদি আমরা গেলে টিটনের দেশে ফেরা নিয়ে দুর্ভাবনা কমে–”

ছোটাচ্চু কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই টিটনের আম্মু আনন্দের শব্দ করতে লাগল! ছোটাচ্চু যখন কথা বলার সুযোগ পেল তখন বলল, “আমাকে একটু সময় দেন। আমি বাচ্চাদের সাথে কথা বলে দেখি। আপনাকে আমি জানাব।”

টিটনের আম্মু বলল, “থ্যাংকু থ্যাংকু…”

বাচ্চারা ততক্ষণে ছোটাচ্চুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা জিজ্ঞেস করতে লাগল, “আমাদের সাথে কী নিয়ে কথা বলবে? কী নিয়ে কথা বলবে? বল। বল। কেন বলছ না? বল–”

***

বিশাল একটা মাইক্রোবাসে করে সবাই রিসোর্টে যাচ্ছে। সামনে টিটনের আব্বু আম্মু আর ছোটাচ্চু। তিনজন মিলে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে। তাও যদি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলত তাহলে একটা কথা ছিল–পৃথিবীর রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে। ছোটাচ্চুর গলা সবচেয়ে ওপরে, কথা শুনে মনে হয় আমেরিকা, চীন আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা ছোটাচ্চুকে ফোন করে তার কাছ থেকে বুদ্ধি পরামর্শ নেয়। তাই পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে সবকিছু ছোটাচ্চু জানে। টুনি প্রথম দিকে বড়দের আলাপ একটু শোনার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। বড় মানুষদের মাথায় এত বুদ্ধি কম কেন কে জানে।

পেছনের দুই সিট মিলে ভাগাভাগি করে বসেছে টুনি, টিটন, টুম্পা আর মুনিয়া। প্রমি খুব আসতে চাইছিল কিন্তু তার গান নাকি নাচ কিসের জানি ক্লাস আছে সেইজন্য আসতে পারেনি। অন্যদেরও সে রকম অবস্থা। শান্তর উৎসাহ ছিল কিন্তু অপরিচিত পরিবারের সাথে যাওয়া নিয়ে তার একটু দুশ্চিন্তা হয়েছিল। ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “হাবা টাইপের ছেলেটার আবু আম্মু কী করে?”

ছোটাচ্চু একটু রেগে বলল, “বাচ্চা একটা ছেলেকে হাবা টাইপের ছেলে বলছিস কেন?”

“যে টুনিকে বস ডাকে তার বুদ্ধি আর কত হবে?”

“ছোট একটা বাচ্চা–”

শান্ত হা হা করে হেসে বলল, “এই বয়সে আমি আব্বকে ব্লাফ দিয়ে টাকা কামাই করা শুরু করেছি। আর এই বাচ্চা টুনির পেছনে পেছনে ঘুরে–”

“তোর সাথে তুলনা? তুই হচ্ছিস পাজির পা ঝাড়া–”

পাজির পা ঝাড়া হওয়াটাকে শান্ত প্রশংসার কথা ধরে নিয়ে আনন্দে সব দাঁত বের করে হাসল। তারপর বলল, “ছেলের আব্বু আম্মু কী করে এখনো বলো নাই।”

“ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। ম্যাথমেটিকস আর ইঞ্জিনিয়ারিং-”

“মাস্টার আর মাস্টারনি? সর্বনাশ!”

“সর্বনাশের কী আছে?”

“নিশ্চয়ই পড়া ধরবে!”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “পড়া কেন ধরবে?”

“তুমি এখনো জান না, মাস্টারদের কাজই হচ্ছে পড়া ধরা। তুমি ওদের সাথে যাচ্ছ, দেখো তোমাকে একটু পরে পরে প্রশ্ন করবে। অংকের প্রফেসর দেখো তোমাকে একটু পরে পরে লসাগু গসাগু জিজ্ঞেস করবে।”

ছোটাচ্চু  অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত বলল, “আন্ডা বাচ্চার সাথে তুমি যেতে চাইলে যাও। আমি এর মাঝে নাই।”

কাজেই টিটনকে নিয়ে ছোটাচ্চু শান্তর ভাষায় টুনি, টুম্পা আর মুনিয়া এই তিনজন আন্ডা বাচ্চা যাচ্ছে।

.

মাইক্রোবাসের পেছনে বসে টিটনের উত্সাহের সীমা নেই। টুনিকে বলল, “বস, তুমি আজকে আমাকে ডিটেকটিভ হওয়ার আরেকটু ট্রেনিং দেবে?”

টুনি মাথা চুলকাল। বাচ্চাটা বিশ্বাস করে বসে আছে আসলেই ডিটেকটিভ হওয়ার ট্রেনিং আছে আর টুনি সেটা তাকে দিতে পারবে। তাই বাচ্চাটাকে হতাশ না করার জন্য টুনিকে আবার কিছু একটা বলতে হবে। টুনি একটু চিন্তা করে বলল, “ডিটেকটিভ হওয়ার দুই নম্বর ট্রেনিং হচ্ছে মানুষের চেহারা দেখে তার চরিত্র অনুমান করা।”

‘চরিত্র?’ শব্দটা টিটনের জন্য একটু কঠিন হলো। কাজেই টুনিকে একটু ব্যাখ্যা করতে হলো। বলল, “তার মানে তুমি অনুমান করবে মানুষটা কী রকম।”

টুম্পা হাততালি দিল। বলল, “আমিও করতে পারি? আমি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ তুইও করতে পারবি। সবাই করতে পারবে।”

টুম্পা উৎসাহ নিয়ে বলল, “তাহলে আমি প্রথম।”

“ঠিক আছে।”

টুনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। রাস্তার পাশে একটা দোকানের সামনে একটা মানুষ মুখ ব্যাজার করে বসে ছিল, টুনি তাকে দেখিয়ে বলল, বলল, “দোকানের সামনে লাল চেক শার্ট পরা মানুষটা কী রকম বল দেখি।”

টুম্পার এক মুহূর্ত দেরি হলো না। বলল, “মানুষটা খুবই রাগি। তার বউয়ের সাথে ঝগড়া করেছে তখন তার বউ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সে সকালে নাশতা পর্যন্ত করে নাই তাই তার খুবই মেজাজ খারাপ। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে তার বউ লাঠি নিয়ে আসছে কিনা–”

টিটন চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি এক সেকেন্ড দেখে এত কিছু কেমন করে বলেছ?”

টুম্পা হি হি করে বলল, “আমার মনে হয়েছে তাই বলেছি।”

টুনি বলল, “এই বারে টিটন।”

টিটন অস্বস্তি নিয়ে বলল, “ওকে। আমি ট্রাই করব।”

সামনে রাস্তার পাশে একজন মহিলা তার ছোট ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা পার হওয়ার জন্য। টুনি মহিলাটাকে দেখিয়ে বলল, “ওই যে নীল শাড়ি পরে বাচ্চার হাত ধরে মহিলাটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে বলো তোমার কী মনে হচ্ছে।”

টিটন খুবই তীক্ষ্ণভাবে মহিলাটাকে যতক্ষণ দেখা যায় দেখল। তারপর বলল, “ওই মহিলাটার মনের মাঝে খুবই অ্যাংজাইটি সে কেমন করে সেইফলি রাস্তা পার হবে।”

বলে টিটন থেমে গেল, সে আর বলার মতো কিছু পাচ্ছে না।

টুম্পা বলল, “আর কিছু বলবে না? ছেলেটা সকালে কী করেছে? মা কেন বকা দিচ্ছে? এইসব—”

টিটন অবাক হয়ে বলল, “এইসব কেমন করে বলব?”

মুনিয়া বলল, “শুধু টুম্পা আপু এই রকম বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে।”

ঠিক এই রকম সময় মাইক্রোবাসটা একটা বড় পার্কিং লটে ঢুকল। বাচ্চারা জিজ্ঞেস করল, “এখানে থামবে?”

ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ, টি ব্রেক। যারা যারা বাথরুমে যেতে চায় তারাও নাম।”

টিটন বলল, “আমি গেট ডাউন করব না।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“আমার একটা কাজ আছে বস।”

বলে সে তার ব্যাগটা টেনে বের করে সেখান থেকে একটা ডায়েরি বের করে আনে। একটা কলম খুঁজতে খুঁজতে বলল, “আমার ডায়েরি লেখা বাকি আছে।”

টুনি বলল, “একটু হাঁটাহাঁটি করলে ভালো লাগবে।”

টিটনের আম্মু বলল, “থাক। টিটনের মাথায় একটা কিছু ঢুকে গেলে সেটা আর বের করা যায় না।”

তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, “ড্রাইভার সাহেব একটু দেখবেন।”

ড্রাইভার বলল, “জি দেখব। কোনো চিন্তা করবেন না।”

টিটনকে গাড়িতে একা রেখে গেছে বলে টুনি, টুম্পা আর মুনিয়া রেস্টুরেন্ট থেকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এল। টিটনকে চমকে দেওয়ার জন্য তারা লুকিয়ে মাইক্রোবাসের কাছে এসে বিকট গলায় ভাউ’ শব্দ করে লাফিয়ে উঠল।

গাড়ির ড্রাইভার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে টিটনের সাথে কথা বলছিল, সে ভয়ানক চমকে লাফিয়ে পেছনে সরে যায়। টুনি লক্ষ করল তার হাতের স্মার্টফোনটা সে খুব তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। টিটন তার বস এবং টুম্পা মুনিয়াকে দেখে খুশি হয়ে উঠল। ডায়েরিটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, “আমি তোমাদের মিস করছিলাম।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার ডায়েরি লেখা শেষ?”

“না বস। পরে লিখব।”

একটু পর বড়রা এসে ওঠার পর গাড়ি ছেড়ে দিল, আবার রাজনীতির আলাপ শুরু হয়েছে। আমেরিকা রাশিয়া চীন শেষ হয়েছে, এখন নর্থ কোরিয়া, মিয়ানামার আর আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনা। টুনি এবারে শোনারও চেষ্টা করল না। তারা তাদের আগে খেলা শুরু করে দিল।

টুম্পা বলল, “এখন মুনিয়া বলবে।”

মুনিয়া বাঁকা হয়ে বলল, “না, আমি বলব না।”

টিটন জিজ্ঞেস করল, “কেন বলবে না?”

“আমি পারি না।”

টুম্পা বলল, “না পারার কী আছে। যা মনে আসবে তাই বলে দিবি।”

মুনিয়া বলল, “আমার মনে কিছু আসে না।”

টুনি বলল, “থাক। যদি বলতে না চায় তাহলে জোর করিস না। টিটন বলল, “এখন তাহলে তুমি বলবে বস।”

“আমি?”

“হ্যাঁ।”

“আমি বলার আগে আমার একটা জিনিস জানতে হবে।”

“হোয়াট?”

টুনি এদিক-সেদিক তাকালো তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “টিটন–”

টিটন বাধা দিল। বলল, “পার্টনার–”

“ও আচ্ছা। হ্যাঁ। পার্টনার, ড্রাইভার তোমার সাথে কী নিয়ে কথা বলছিল?”

টিটন টুনির প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হয়ে গেল। সেও টুনির মতো গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমার আব্ব আর আম্মু কোথায় জব করে। কত ডলার বেতন পায়। কয়টা গাড়ি। এইসব।”

টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি এই ড্রাইভারকে বিশ্বাস করি না। আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে।”

মুনিয়া ফ্যাকাশে মুখে বলল, “কেন?”

“মনে হচ্ছে সে টিটনকে।”

টিটন আবার বাধা দিল, বলল, “পার্টনারকে–”

“ও হ্যাঁ। পার্টনারকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করছে।”

টিটনের মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস!”

টুম্পা শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করল, “কেন? তুমি কেন এটা বলছ টুনি আপু?”

“আমি অনেকক্ষণ থেকে এই ড্রাইভারকে লক্ষ করছি। সে গাড়ি চালাতে চালাতে একটু পরে পরে গাড়ির আয়নাতে পেছনে তাকাচ্ছে আর আমাদের দেখছে। আলাদা করে টিটন–তার মানে পার্টনারকে দেখছে। আমরা যখন রেস্টুরেন্টে গেছি তখন ড্রাইভার লুকিয়ে পার্টনারের ছবি তুলেছে। কেন? তার কারণ সেটা সে তার সাঙ্গপাঙ্গকে পাঠাবে। মানুষটা গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলছে আর পেছনে তাকাচ্ছে। পার্টনারকে জিজ্ঞেস করেছে তার আব্বু আম্মুর বেতন কত, তাদের কত টাকা পয়সা, কয়টা গাড়ি–সবকিছু দেখে বোঝা যাচ্ছে এই মানুষটা আমার পার্টনারকে কিডন্যাপ করে নেবে টাকার জন্য।”

টিটন আনন্দে সব দাঁত বের করে বলল, “সো মাচ ফান! কত মজা হবে তাই না বস? এটা এত ফ্যান্টাস্টিক একটা স্টোরি হবে! ইশ! আসলেই কিডন্যাপ করবে আমাদের? করবে তো?”

***

যদিও টিটন খুবই আশা করছিল রাস্তার কয়েকটা গাড়ি এসে তাদের মাইক্রোবাসটাকে থামাবে এবং বেশ কয়েকজন মুখোশ পরা মানুষ আটোমেটিক রাইফেল হাতে নেমে গুলি করতে করতে তাদের কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে কিন্তু সে রকম কিছুই হলো না। তাদের মাইক্রোবাস ঠিক ঠিক রিসোর্টে পৌঁছে গেল। তারা সবাই তাদের জন্য আলাদা করে রাখা রুমে ঢুকে সবকিছু ভুলে গেল।

রিসোর্টে মজা করার নানা রকম ব্যবস্থা আছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য। তাই সবাই মিলে সেগুলোতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বড় একটা সুইমিং পুল আছে, আবার দাপাদাপি করার জন্য ছোেট আরেকটা সুইমিংপুল–ছোটরা সেখানে দাপাদাপি করতে লাগল। রাত্রে বারবিকিউ করে খাওয়ার ব্যবস্থা, সবজি খাওয়ার জন্য কেউ ঠেলাঠেলি করছে না, যত খুশি আইসক্রিম খাওয়া যায়–এক কথায় আনন্দের আর শেষ নাই। রাত্রে সবাই বসে নিজেদের রুমের টেলিভিশনে প্রথমে ডিজনির একটা মজার সিনেমা দেখল, তারপর একটা ভয়ংকর ভয়ের সিনেমা। মুনিয়া সেই সময় বেশির ভাগ সময় চোখ বন্ধ করে রাখল।

কাছেই কোথায় নাকি সমুদ্রের মতো বড় একটা দিঘি আছে। ঠিক করা হলো বাচ্চারা সেই দিঘি দেখতে যাবে। ছোটাচ্চু মনে হয় রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বলতে টায়ার্ড হয়ে গেছে, তাই এখন কবিতা, আধুনিক কবিতা আর উত্তর আধুনিক কবিতা নিয়ে কথা বলছে। টিটনের আব্বু আম্মু মনে হয় কবিতার বিষয়ে খুব বেশি জানে না, তাই তারা শুধু শুনছে আর মাথা নাড়ছে।

পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তারা হাত মুখ ধুয়ে নাশতা করতে গেল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়ার আগে নাশতা করার মতো বিরক্তিকর জিনিস আর কিছু নেই। কিন্তু এখানে অন্য ব্যাপার। একশ রকম নাশতার জিনিস সাজিয়ে রাখা আছে, যার যেটা ইচ্ছা সেটা খেতে পারে। সবগুলো একটু একটু চেখে দেখলেই পেট ভরে যাবে। বাচ্চারা বেছে বেছে যে খাবারগুলো খাওয়া নিষেধ সেগুলো খেয়ে পেট ভরে ফেলল!

নাশতা করার পর তাদের সাগরের মতো বড় দিঘি দেখতে যাওয়ার কথা। সাথে বড় মানুষ হিসেবে ছোটাচ্চু যাবে কিন্তু বাচ্চারা নিজেরা নিজেরা যাবে বলে হইচই শুরু করে দিল। শেষ পর্যন্ত ড্রাইভারকে নানা রকম উপদেশ দিয়ে তাদেরকে নিজেরা নিজেরা যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। বাচ্চারা কেউ কাউকে মনে করিয়ে দিল না যে তারা সন্দেহ করছে এই ড্রাইভার টিটনকে টাকার জন্য কিডন্যাপ করবে।

রওনা দেওয়ার একটু পরেই ড্রাইভার কোথায় জানি ফোন করে চাপা গলায় কথা বলল। তারপর গাড়ি চালাতে চালাতে একটু পরে পরে পেছনে তাকাতে লাগল। খানিকদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তাদের গাড়ির সামনে আরেকটা গাড়ি এসে থেমে গেল। ড্রাইভার কয়েকবার হর্ন দিয়ে ব্রেক করে তার গাড়ি থামাল। সাথে সাথে সামনের গাড়ি থেকে দুজন মানুষ লাফ দিয়ে নামল। একজন এসে ড্রাইভারের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ড্রাইভারের মাথায় একটা রিভলবার ধরে হুংকার দিয়ে বলল, “খবরদার। একটু নড়লেই গুলি করে দিব।”

ড্রাইভার নড়ল না। আরেকজন মাইক্রোবাসের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে টিটনকে ধরে একটানে নিচে নামিয়ে ফেলল। টুনি চিৎকার করে উঠল, “না-না-খবরদার–” তারপর সেও লাফ দিয়ে নেমে মানুষটার হাত ধরে ঝুলে পড়ল।

টুম্পা আর মুনিয়া ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। মানুষটা এক হাত দিয়ে টিটনকে টেনে নিতে নিতে অন্য হাতে টুনিকে ছোটানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু টুনি মানুষটাকে ছাড়ল না। একেবারে ছিনেজেঁকের মতো মানুষটার হাত ধরে ঝুলে থাকল। মানুষটা যখন টিটনকে নিয়ে গাড়িতে ঢুকেছে তখন টুনিও তার সাথে গাড়িতে ঢুকে গেছে। ততক্ষণে অন্য মানুষটাও ছুটে এসে ড্রাইভারের সিটের পাশে উঠে পড়েছে এবং সাথে সাথে গাড়িটা ছেড়ে দিল। পেছনে তাদের গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে কিন্তু তাদের পিছু নেওয়ার চেষ্টা করল না, টুনি অবশ্য তাতে খুব অবাক হলো না।

যে মানুষটা সামনে বসে আছে সে পেছনে ফিরে টুনির দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, “এই ছেমড়ি তোরে সাথে আসতে কে বলেছে?”

টুনি শান্ত গলায় বলল, “কেউ বলে নাই। কিন্তু এই ছেলে বাংলা জানে না–তার সাথে আপনাদের যদি কথা বলতে হয় আমার মতো একজন মানুষ দরকার।”

টুনিদের পাশে বসে থাকা মানুষটা বলল, “থাকুক। একজনের জায়গায় দুইজন খারাপ না।”

গাড়ি চালাতে থাকা মানুষটা বলল, “এদের মাথা নিচু কইরা রাখেন ওস্তাদ। কেউ যেন দেখবার না পারে।”

ওস্তাদ তখন হাত দিয়ে চাপ দিয়ে টুনি আর টিটনের মাথা নিচু করিয়ে দিল। হিসহিস করে বলল, “খবরদার চিল্লাফাল্লা করবা না। তাহলে কল্লা ছিঁইড়া ফেলমু কিন্তু।”

দুইজনের মাথা নিচু করে রাখায় মাথা কাছাকাছি, ফিসফিস করে নিজেদের মাঝে কথা বলা যায়। টিটন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কল্লা মানে কী, বস?”

টুনি বলল, “কল্লা মানে হচ্ছে মাথা। এখন থেকে শুধু ইংরেজিতে কথা বলবে। বাংলায় কিছু জিজ্ঞেস করলে ভান করবে বুঝো নাই। ঠিক আছে?”

টিটন ফিসফিস করে বলল, “ঠিক আছে।”

তারপর সবগুলো দাঁত বের করে হেসে ইংরেজিতে বলল, “কত মজা হচ্ছে! তাই না বস?”

টুনি কী আর বলবে, মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“এদেরকে কীভাবে ধরবে বস?”

“দেখি।”

“কতক্ষণ লাগবে?”

“টুম্পা আর মুনিয়া ঠিকভাবে ছোটাচ্চুর কাছে পৌঁছাতে পারলে দুই থেকে তিন ঘন্টা।”

টিটন হাতে কিল দিল, বলল, “ইয়েস!” তারপর ফিসফিস করে বলল, “পুলিশ কি আসবে কিডন্যাপারদের অ্যারেস্ট করতে?”

“আসতে তো হবেই।”

“গান ফাইট কি হবে?”

“মনে হয় না।”

মনে হলো এটা শুনে টিটনের একটু মন খারাপ হলো। টিটনকে ব্যস্ত রাখার জন্য বলল, “কী কী শব্দ শুনছ মনে রাখার চেষ্টা কর।”

“ওকে বস।”

তারপর গভীর মনোযোগ দিয়ে রাস্তার পাশ থেকে কী কী শব্দ শোনা যাচ্ছে সেগুলো মনে রাখার চেষ্টা করতে লাগল।

কিছুক্ষণের মাঝেই গাড়ি একটা জায়গায় থামল। দরজা খুলে দুইজন গাড়ি থেকে নেমে গেল। কিছু একটা দেখে একজন ফিরে এসে বলল, “চলেন ওস্তাদ।”

তখন ওস্তাদ মানুষটা টুনি আর টিটনকে বলল, “এই ছেমড়া আর ছেমড়ি। কোনো ঝামেলা করবি না। একজন একজন করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাবি। ডাইনে বামে তাকাবি না। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকবি। মনে থাকব?”

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, “মনে থাকবে।”

কিছুক্ষণের ভেতরেই একটা অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দুইজন খুবই ভাঙাচোরা বিল্ডিংয়ের তিনতলায় উঠে গেল। তাদেরকে একটা দরজা দিয়ে একটা বাসায় ঢুকিয়ে মানুষগুলো দরজা বন্ধ করে দিল।

ঘরের ভেতরে বোটকা এক ধরনের গন্ধ। টুনি আর টিটন ভেতরের ঘরটা তাকিয়ে দেখে ময়লা একটা খাট, তার পাশে একটা নোংরা টেবিল। টেবিলের পাশে একটা লোহার চেয়ার। ঘরের একদিকে জানালা, জানালার পর্দাগুলো টেনে রাখা আছে। টুনি উঁকি দিয়ে দেখল বাইরে বারান্দাবারান্দার দড়ি থেকে কাপড় ঝুলছে। শুধু পুরুষ মানুষের কাপড়।

টুনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর কথা শোনার চেষ্টা করল। মনে হলো মানুষগুলো নিজেদের মাঝে ঝগড়া করছে। ঠিক কী নিয়ে ঝগড়া বোঝা গেল না–মনে হলো এখন কী করবে সেটা নিয়ে ঝগড়াঝাটি হচ্ছে। তারপর শুনল যে মানুষটাকে অন্যরা ওস্তাদ ডাকে সে টেলিফোনে কার সাথে জানি কথা বলছে।

টুনি তখন দরজায় শব্দ করল। সাথে সাথে দরজার অন্য পাশে কথাবার্তা সবকিছু থেমে গেল। একজন বলল, “কী হইছে?”

“দরজা খুলেন। একটু কথা বলতে চাই।”

ধমকের সুরে বলল, “কী কথা?”

“জরুরি কথা। আপনাদের জন্য জরুরি।”

কেউ একজন খুট করে দরজা খুলল। টুনি ঘরের ভেতরে উঁকি দিল, খুবই ময়লা ঘেঁড়া একটা সোফায় ওস্তাদ বসে আছে। অন্য দুইজন দুইটা চেয়ারে। ওস্তাদ বলল, “কী বলবি?”

“আপনাদের ঘরে গন্ধ।”

ওস্তাদ খেঁকিয়ে উঠল, “এইটা তোর জরুরি কথা?”

“না।”

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, “শুধু গন্ধ না, ঘরটা ময়লা আর অন্ধকার। একটা বইও নাই, টেলিভিশন নাই। এই ঘরে বেশিক্ষণ থাকলে আমরা পাগল হয়ে যাব।”

ওস্তাদ রেগে উঠল, বলল, “আমার লাট সাহেবের বাচ্চা? তোর জন্য ফাইভ স্টার হোটেল লাগব? তোরে আমি আসতে কইছিলাম।”

“না। সেটা বলেন নাই। আমি নিজেই জোর করে চলে এসেছি–টিটনকে একা আসতে দেই নাই। কিন্তু এখন এইখানে বেশিক্ষণ থাকতে চাই না।”

টুনির কথা শুনে মানুষটা এত অবাক হলো যে রেগে উঠতে পর্যন্ত ভুলে গেল। টুনি তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, “আমি আপনাদের সাহায্য করতে চাই যেন আপনারা তাড়াতাড়ি টাকাটা পেয়ে যান। আর আমাদের তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন।”

মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকালো, একজন বলল, “বলে কী এই ছেমড়ি! এর কি মাথা খারাপ?”

টুনি বলল, “না। মাথা খারাপ না। আমার কথা শুনে দেখেন।”

ওস্তাদের কিছু একটা মনে হলো, বলল, “ঠিক আছে। বল, তুই কীভাবে সাহায্য করবি?

তার আগে আপনারা বলেন, “আমার সাথে তুই তুই করে কথা বলবেন না।”

মানুষগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো, তারপর তিনজন একসাথে এ্যাকশিয়ালের মতো হাসতে লাগল। একটু পর ওস্তাদ হাসি থামিয়ে বলল, “ঠিক আছে। শুনি আপনার কথা।”

“আপনি বলতে হবে না। তুমি করে বললেই হবে।”

ওস্তাদ বলল, “ঠিক আছে, কী বলতে চাও বল।”

“আমার ছোট চাচা রিসোর্টে আছেন, তার সাথে আমাদের ভিডিওতে কথা বলিয়ে দেন। আমাদের দুইজন ভালো আছি সেটা তাদের জানা দরকার। আপনারা কত টাকা চান, কীভাবে চান আমাকে বলে দেন। আমি তাদেরকে রাজি করিয়ে দিব।”

ওস্তাদ বলল, “রাজি করিয়ে দিবে?”

“হ্যাঁ। কিন্তু বেশি টাকা চাইবেন না–তাহলে টাকা জোগাড় করতে দেরি হবে–পুলিশ খুঁজে বের করে ফেলবে। ধরা পড়ে যাবেন। আজকালকার পুলিশের অনেক তেজ।”

চেয়ারে বসে থাকা একজন বলল, “আমরা তোমারে ভিডিওতে কথা বলতে দিব আর তুমি আমাদের ধরায়া দিবা?”

“উঁহু। আমি আপনাদের সম্পর্কে একটা কথা বলব না। আপনারা সামনে থেকে দেখবেন আমরা কী বলি।”

ওস্তাদ বলল, “তুমি রাজি করাতে পারবা?”

“পারব।”

“কোনো ঝামেলা হবে না?”

“না।”

“পুলিশ ডাকবে না?”

“দেরি হলে তো ডাকতেই হবে। তাই দেরি করবেন না।”

মানুষগুলো নিজেদের ভেতর কথা বলল, তারপর রাজি হয়ে গেল। তবে সরাসরি ভিডিওতে কথা বলতে দিল না, তাকে একটা ভিডিও ম্যাসেজ করতে দিল যেটা একটা বেআইনি গোপন টেলিফোন থেকে পাঠাবে। টুনি তাতেই রাজি, কারণ মানুষগুলো কল্পনাও করতে পারে নাই যে খুবই নিরীহ একটা ভিডিও ম্যাসেজ দিয়ে টুনি কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠিয়ে দেবে। ছোটাচ্চুর কালজয়ী উপন্যাস শোনার সময় টুনি জেনেছে ছোটখাটো বিষয় থেকে ছোটাচ্চু অনেক কিছু বের করে ফেলতে শিখেছে।

টুনি একটা ভিডিও ম্যাসেজ তৈরি করে দিল, যেটা পাঠিয়ে কিডন্যাপাররা টাকা দাবি করল। কিন্তু একবারও কল্পনা করল না যে এই খুবই নিরীহ ভিডিও ম্যাসেজটা দিয়ে টুনি ছোটাচ্চুকে জানিয়ে দিল :

১. ড্রাইভার এই কিডন্যাপারদের একজন।

২. আপাতত তাকে আটকে রেখেছে তিনজন।

৩. যেখানে তাদের আটকে রাখা আছে তার কাছাকাছি একটা মসজিদ আছে।

৪. তারা আপাতত তিনতলা একটা বাসায় আটকা আছে।

৫. তাদের বিল্ডিংয়ের পাশে বড় রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে বাস যায়।

৬. তাদের বিল্ডিংয়ের পাশে একটা নারকেল গাছ।

৭. তাদের বিল্ডিংটার পাশের বিল্ডিংয়ের রং হলুদ।

৮. যারা তাদের ধরে এনেছে তারা মোটামুটি বোকা মানুষ।

কাজেই টুনি মোটামুটি নিশ্চিত আগামী দুই থেকে তিন ঘণ্টার মাঝে তাদের উদ্ধার করে নেবে।

ভিডিও ম্যাসেজ তৈরি করে দেওয়ার পর কিডন্যাপারগুলো টুনির ওপর সন্তুষ্ট, কাজেই এখন টুনি আর টিটনের সাথে তারা যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করছে। টিটন যখন জানিয়েছে তার খিদে লেগেছে তখন তার জন্য চিপস আর কোল্ড ড্রিংস কিনে এনেছে। যখন টিটন। বাথরুমে দুর্গন্ধ বলে অভিযোগ করেছে তখন একজন একটা ঝাটা নিয়ে বাথরুমে কয়েক মগ পানি ঢেলে বাথরুমটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছে।

কাজেই তিন ঘণ্টা পর যখন টুনি দেখল সামনের রাস্তায় একটা পুলিশের গাড়ি এসে থেমেছে সেখান থেকে কয়েকজন পুলিশের সাথে ছোটাচ্চু নেমে মাথা উঁচু করে দেখছে, পেছনে হাতকড়া লাগানো ড্রাইভার খুবই ব্যাজার মুখে তাকিয়ে আছে তখন টুনি বুঝল কিডন্যাপ নাটক শেষ।

কিডন্যাপার তিনজন তখনো কিছু জানে না। বাইরের ঘরে বসে টাকাগুলো আনতে কে যাবে এবং কীভাবে টাকাগুলো ভাগাভাগি করা হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করছে।

টুনি মাথা ঢুকিয়ে বলল, “আপনাদের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

ওস্তাদ বিরক্ত হয়ে বলল, “এখন আবার কী কথা?”

আরেকজন বলল, “এখন যাও। পরে কথা বলো।”

টুনি বলল, “আমার মনে হয় এখনই বলতে হবে।”

“এখনই? কেন?”

“যদি আমার কথা শোনেন তাহলে বুঝবেন।”

“ঠিক আছে বলো কী বলবে।”

টুনি বলল, “আসলে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি।”

“কী প্রশ্ন?”

“আপনাদের এখান থেকে কি সিঁড়ি ছাড়া অন্য কোনোভাবে বের হওয়া সম্ভব?”

ওস্তাদ চোখ কপালে তুলে বলল, “সিঁড়ি ছাড়া অন্যদিক দিয়ে বের হতে চাও কেন?”

“আমি বের হতে চাই না। আপনাদের জন্য।”

“আমাদের জন্য? আমরা কেন বের হব?”

টুনি বলল, “রাস্তায় একটা পুলিশের গাড়ি। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আছে পুলিশের সাথে। হাতে হাতকড়া–”

কিডন্যাপার তিনজন এবারে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠল। ফ্যাকাশে মুখে পা টিপে টিপে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দেয় তারপর ঘরের ভেতর ছোটাচ্চুটি করতে থাকে।

টুনি বলল, “বোরকা থাকলে বোরকা পরেই সিঁড়ি দিয়ে মহিলা সেজে বের হয়ে যেতে পারেন–”

ওস্তাদ মুখ খিঁচিয়ে বলল, “চোপ ছেমড়ি। আর একটা কথা বলবি তো একটা মুক্কা দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলব।”

টিটন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “মুক্কা মানে কী বস?”

“আমিও জানি না? এই শব্দটা মনে হয় ডিকশনারিতে নাই। ঘুষি হতে পারে।”

দাঁত ভাঙার ঝুঁকি থাকার পরও টুনি একটু সাহায্য করার চেষ্টা করল, “ছাদে উঠে পাইপ বেয়ে নেমে যেতে পারেন। আপনাদের কারো একরোফোবিয়া নাই তো?”

টিটন জিজ্ঞেস করল, “একরোফোবিয়া মানে কী?”

“উঁচু জায়গাকে ভয় পেলে সেটাকে বলে একরোফোবিয়া।”

মানুষগুলো ক্রুদ্ধ চোখে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে নিচে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আপনাদের হাতে মনে হয় সময় নাই। ড্রাইভার সাহেব আপনাদের বাসাটা দেখাচ্ছেন। হাতকড়া পরে আছেন তাই দুই হাতে দেখাচ্ছেন।”

টিটন একটুখানি আশা নিয়ে বলল, “গানফাইট হবে না?”

“মনে হয় না। উনাদের পিস্তল মনে হয় খেলনা পিস্তল। তাই না?”

ওস্তাদ এবার সত্যিই রেগে উঠল। হুংকার দিয়ে বলল, “চোপ ছেমড়ি। চোপ।”

টুনি টিটনকে ফিসফিস করে বলল, “শব্দটার আসল উচ্চারণ ‘চুপ’ বেশি রেগে গেছে বলে বলছে ‘চোপ’।”

টিটন ফিসফিস করে বলল, “মনে হয় বেশি ভয় পেয়েছে সেইজন্য।”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হতে পারে।”

মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত টুনির পরামর্শ শুনে ছাদের দিকে ছুটে গেল। সেখান থেকে পাইপ বেয়ে নেমে যাবে।

টুনি আর টিটন তখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। ছোটাচ্চু চোখ বড় বড় করে বলল, “তোরা ঠিক আছিস?”

“হ্যাঁ ছোটাচ্চু।”

“কিডন্যাপাররা কই?”

টুনি কিছু বলার আগেই ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, “তোরা ঠিক আছিস?”

“হ্যাঁ ছোটাচ্চু।”

“উনারা পাইপ বেয়ে নামছেন। একটু হেল্প করেন, পড়ে গেলে অনেক ইনজুরি হবে।”

***

গাড়ি করে রিসোর্টে ফিরে যাওয়ার সময় টুনি আর টিটনকে কিডন্যাপার ধরার গল্পটা বলতে হলো। থানায় আরেকবার। তখন পুলিশ অফিসার সেটা লিখে নিল। রিসোর্টে ডিনার করার সময় আরেকবার শুধু টিটনের আলু আর আম্মুকে একবার বলতে হলো। (টিটনের আম্মু তখন চোখে মুখে টিসু চেপে কয়েকবার কেঁদে ফেললেন।) রাতে ঘুমানোর সময় টুম্পা আর মুনিয়াকে আলাদা করে দুইবার।

টুনি জানে বাসায় গিয়ে সবাইকে গল্পটা আরও অনেকবার বলতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *