বৈজ্ঞানিক

বৈজ্ঞানিক

দাদি (কিংবা নানি) অনেকক্ষণ চেষ্টা করে তার টেলিফোনের ম্যাসেজটা পড়লেন। তারপর বাচ্চাদের বললেন, “তোদের তারেক মামা আসছে।”

বাচ্চারা ছুটোছুটি করছিল। একজন বলল, “আমাদের সব মামা এখানে থাকে।”

আরেকজন বলল, “মামা এবং চাচা।”

আরেকজন বলল, “মামা এবং চাচা এবং খালা।”

আরেকজন বলল, “মামা এবং চাচা এবং খালা এবং ফুপু এবং মামি এবং চাচি এবং খালু এবং ফুপা–” একটু থেমে বলল, “কেউ বাদ গিয়েছে?”

একজন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। দাদি এবং নানি।”

আরেকজন শেষ করল, বলল, “এবং ঝুমু খালা।”

সবাই মাথা নাড়ল, একজন বলল, “তাহলে তারেক মামা কে?”

দাদি বিশাল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তোদের সাথে কথা বলাই মুশকিল।”

একজন মুখ গম্ভীর করে বলল, “দাদি। দোষ তোমার। আমাদের সব মামা এখানে থাকে তাই তুমি যেটা বলছ সেটা অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিমূলক।”

আরেকজন বলল, “এবং আপত্তিকর।”

আরেকজন বলল, “ উঁহু, আপত্তিকর না। আপত্তিকর কেন হবে?”

আরেকজন বলল, “সবার বাক স্বাধীনতা আছে। যার যেটা ইচ্ছা বলতে পারবে।”

একজন মিনমিন করে বলল, “আমি একটা নূতন গালি শিখেছি। সেটা কি দিতে পারি?”

সবাই তার দিকে ঘুরে তাকালো, “কোথা থেকে শিখেছিস?”

“রাস্তা থেকে।”

যারা একটু বড় তারা বলল, “না। রাস্তার গালি রাস্তায় রেখে আসতে হবে। বাসায় আনা যাবে না।”

শুধু শান্ত উশখুশ করতে লাগল নূতন গালিটা শোনার জন্য।

বাচ্চারা সবাই যখন এই পুরোপুরি অবান্তর কথাবার্তা বলছে তখন টুনি দাদির (কিংবা নানির) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দাদি, তারেক মামা কে? কোথা থেকে আসছেন?”

দাদি বললেন, “আমার দূর সম্পর্কের বোনের ছেলে।”

“কী করেন?”

“ঠিক জানি না। মনে হয় বড় বৈজ্ঞানিক।”

“বৈজ্ঞানিক? সত্যি?”

“হ্যাঁ, তাই তো শুনেছিলাম।”

টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “বাহ! আমি কখনো সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক দেখি নাই। কতদিন থাকবেন?”

“না, না, থাকবে না। আমার সাথে দেখা করে কথাবার্তা বলে চলে যাবে।”

“কখন আসবেন?”

দাদি আবার তার টেলিফোনের ম্যাসেজটা পড়ে বললেন, “বিকালবেলা।”

কাজেই একজন বৈজ্ঞানিক দেখার জন্য টুনি অপেক্ষা করতে লাগল। অন্য বাচ্চারা যখন শুনল তাদের বাসায় একজন বৈজ্ঞানিক আসছেন তখন সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

.

বিকালবেলা বৈজ্ঞানিক তারেক মামা এসেছেন। তাকে দেখে সবার মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই আশা করেছিল যেহেতু বৈজ্ঞানিক মানুষ নিশ্চয়ই হালকা পাতলা হবে, মাথায় এলোমেলো চুল, চোখে চশমা, উদাস উদাসভাবে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তারেক মামার একটা নাদুসনুদুস ঊড়ি। মাথায় টাক সেটাও সমস্যা না কিন্তু অল্প কয়টা চুল দিয়ে সেটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন সেটা খুবই অদ্ভুত। চোখের দৃষ্টি মোটেও উদাস উদাস না, ছোট ছোট কুতকুতে চোখ ইতিউতি করে তাকাচ্ছেন। মানুষটার মুখের কাটা নিশ্চয়ই অনেক বড়, যখন হাসেন তখন মাড়ি পর্যন্ত দেখা যায়। শুধু তাই না হাসির তালে তালে নাদুসনুদুস হুঁড়িটা দুলতে থাকে।

টুনি তার বৈজ্ঞানিক তারেক মামাকে দাদির (কিংবা নানির) কাছে নিয়ে গেল। দাদি তাকে দেখে খুশি হয়ে উঠলেন। “ও মা, তোমাকে দেখতে কত ভালো লাগছে! কতদিন পর তোমাকে দেখছি!”

“জি খালা। ভালো আছেন?” বলে বৈজ্ঞানিক তারেক মামা তার ভুড়ি ঝুলিয়ে নিচু হয়ে দাদির পা ধরে সালাম করলেন। তারপর ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।

ততক্ষণে সবার বৈজ্ঞানিক দেখার শখ মিটে গেছে। শুধু মুনিয়া বৈজ্ঞানিক মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “আপনি বৈজ্ঞানিক?”

তারেক মামা তার ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসলেন, বললেন, “হ্যাঁ। আমি বৈজ্ঞানিক।”

“আপনি কেন বৈজ্ঞানিক?”

মুনিয়ার এই নিরীহ প্রশ্ন শুনে তারেক মামা কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন, মাথা চুলকে বললেন, “আমি বৈজ্ঞানিক কারণ–কারণ–আমি এ্যাঁ এ্যাঁ–” তারপর কী বলবেন বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ মাথা কিংবা টাক চুলকালেন, তারপর বললেন, “কারণ আমি পেপার পাবলিশ করি।”

মুনিয়া একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন না?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ করি। বৈজ্ঞানিক গবেষণাও করি।”

“আপনার ল্যাবরেটরি আছে?”

আবার বৈজ্ঞানিক তারেক মামা মাথা চুলকালেন, তারপর বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। মানে আমার ঠিক নিজের না–সবার জন্য।”

মুনিয়া বুঝে ফেলার মতো মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি।”

তারেক মামা তখন মুনিয়াকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি বড় হয়ে বৈজ্ঞানিক হতে চাও?”

“নাহ।”

তারেক মামা মনে হয় মনে একটু আঘাত পেলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? কেন বিজ্ঞানী হতে চাও না।”

মুনিয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “সেইটা বলা যাবে না।”

টুনি চলে যাচ্ছিল কিন্তু মুনিয়ার প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুইজনের আলাপ শুনছিল। সে বুঝতে পারল মুনিয়া কেন বড় হয়ে বৈজ্ঞানিক হতে চাইছে না। তার নিশ্চয়ই ধারণা হয়েছে বৈজ্ঞানিক হলে তারও মাথায় টাক পড়ে যাবে এবং একটা ছোটখাটো ভুড়ি হয়ে যাবে। শুনল মুনিয়া এবারে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী গবেষণা করেন? রকেট তৈরি করেন?”

তারেক মামা জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, বললেন, “না, না–আমি রকেট সায়েন্টিস্ট না। আমি রকেট তৈরি করি না।”

মুনিয়া বেশ অবাক হলো। তার ধারণা ছিল বৈজ্ঞানিক মাত্রই রকেট সায়েন্টিস্ট। জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আপনি কী তৈরি করেন?”

“আমি জীববিজ্ঞানী। আমি জন্তু জানোয়ার নিয়ে গবেষণা করি।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ।”

“কী আশ্চর্য!”

“আশ্চর্যের কী আছে? সবকিছু নিয়ে গবেষণা হয়।”

দাদি ধৈর্য ধরে দুইজনের কথা শুনছিলেন, এইবারে বললেন, “মুনিয়া! তোর ইন্টারভিউ শেষ হয়েছে? এইবারে যা-আমাকে তোর তারেক মামার সাথে একটু কথা বলতে দে।”

“যাই নানি।” বলে মুনিয়া চলে যেতে যেতে আবার ঘুরে এসে বলল, “লাস্ট একটা প্রশ্ন।”

তারেক মামা তার মাড়ি বের করে হাসতে হাসতে বললেন, “যত ইচ্ছা প্রশ্ন কর। প্রশ্ন না করলে শিখবে কেমন করে?”

তারেক মামার কথা শুনে মুনিয়া বলল, “আপনি কী কী জীবজন্তু নিয়ে গবেষণা করেন?”

“ইঁদুর, বানর এই সব জীবজন্তু।”

মুনিয়া খুশিতে হাততালি দিল, “কী মজা! আমার ছোট ছোট ইঁদুর খুব সুইট লাগে! আমি সব সময় বলেছি আমাকে ইঁদুরের বাচ্চা কিনে দিতে। আমি পালব। কেউ রাজি হয় না।”

দাদি বললেন, “কি বলিস উল্টাপাল্টা কথা! ইঁদুর আবার পালার জিনিস হলো?”

“আমি পালতে চাই।” মুনিয়া তারেক মামার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি ইঁদুরের বাচ্চা কী করেন?”

তারেক মামা বললেন, “এই তো কোনো কিছু খাওয়াই তারপর কেটে কুটে দেখি।”

মুনিয়া একটা আর্তনাদ করল, “কেটেকুটে দেখেন?”

“হ্যাঁ।”

মুনিয়া প্রায় কেঁদে ফেলল, “মেরে ফেলেন?”

“হ্যাঁ, পেট কেটে দেখলে, মাথা কেটে দেখলে তো মেরে ফেলতেই হয়।”

মুনিয়া চিৎকার করে বলল, “পেট কেটে ফেলেন? মাথা কেটে ফেলেন?”

“হ্যাঁ।” তারেক মামা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন। টুনি বুঝতে পারল তারেক মামা মানুষটা বড় সায়েন্টিস্ট হতে পারে কিন্তু ছোট বাচ্চাদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটা সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

মুনিয়া প্রায় কেঁদে ফেলল, তারপর চিৎকার করে বলল, “আমি কোনোদিন বৈজ্ঞানিক হব না। বৈজ্ঞানিক খারাপ। খুব খারাপ। আপনিও খারাপ।”

দাদি বললেন, “টুনি, মুনিয়াকে শান্ত করে নিয়ে যা দেখি।”

টুনি মুনিয়াকে শান্ত করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রীতিমতো জোর করে তাকে ধরে নিয়ে যেতে হলো। দাদি হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, তারপর তারেক মামার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।

মুনিয়াকে টেনে বাইরে নিয়ে অবশ্য লাভ না হয়ে আরও ক্ষতি হলো। কারণ সে বাইরে গিয়ে অন্য সবাইকে জানিয়ে দিল দাদির সাথে কথা বলার জন্য যে তারেক মামা এসেছে সে একজন নিষ্ঠুর হত্যাকারী। মানুষ হয়তো মারে নাই কিন্তু ছোট ছোট সুইট ইঁদুরের বাচ্চাকে মেরেছে। বানরের বাচ্চাকে মেরেছে। যে এত ছোট ছোট বাচ্চাদের মারতে পারে সে নিশ্চয়ই মানুষও মারতে পারবে।

কয়েকজন তার যুক্তি মেনে নিল, কয়েকজন পুরোপুরি মেনে না নিলেও মানুষটাকে নূতন করে দেখার জন্য প্রায় সবাই লাইন ধরে দাদির ঘরে ঢুকে গেল। এতজনকে মুখ শক্ত করে একসাথে ঢুকতে দেখে দাদি হতাশভাবে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারেক মামা এই বাসার বাচ্চাদের চেনেন না, ফলে গুরুত্বটা ধরতে পারলেন না। বাচ্চারা যখন তাকে মোটামুটি ঘিরে দাঁড়াল তখন তারেক মামা একটু নার্ভাসভাবে হেসে বললেন, “কী খবর তোমাদের? তোমরা সবাই ভালো আছ? কোন ক্লাসে পড় তোমরা?”

বাচ্চারা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। একজন বলল, “আপনি নাকি ইঁদুরের বাচ্চা, বানরের বাচ্চা, পাখির বাচ্চা সবকিছুকে হত্যা করেন?”

তারেক মামা প্রশ্ন শুনে একটু চমকে উঠলেন। প্রথমে একটু অবাক তারপর একটু বিরক্ত সবশেষে একটু রেগে উঠলেন। বললেন, “যাও তোমরা খেলো গিয়ে। আমি তোমাদের নানির সাথে একটু কথা বলি।”

দাদি (কিংবা নানি) একটা ধমক দিলেন, “যা। যা ভাগ এখান থেকে তারেক মামা তার বিরক্তি আর রাগকে সামলে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা যদি শান্তশিষ্ট থাক তাহলে যাওয়ার সময় আমি তোমাদের বিজ্ঞানের ম্যাজিক দেখাব। এখন যাও।”

দাদি বললেন, “টুনি এদের ধরে নিয়ে যা–আমাকে একটু শান্তিমতো কথা বলতে দে।”

বাইরে বের হয়ে টুনি শান্তর মুখে এক ধরনের বিষাক্ত হাসি দেখে একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে শান্ত ভাইয়া? তুমি এইভাবে হাসো কেন?”

“দেখিস নাই?”

“কী দেখি নাই?”

“এই লোক ভুয়া বৈজ্ঞানিক।”

“কেন?”

“দেখিস নাই এর গলায় এত বড় তাবিজ। বৈজ্ঞানিকরা গলায় তাবিজ পরে?”

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “তাবিজ?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি নিশ্চয় ভুল দেখেছ শান্ত ভাইয়া।”

শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না? ঠিক আছে আমি দেখাব। আমার ওপর ছেড়ে দে!” বলে শান্ত আবার তার ভয়ংকর হাসিটি দিল। যেটা দেখে টুনির আত্মা উড়ে গেল।

.

দাদির সাথে কথা শেষ হলে তারেক মামা বিজ্ঞানের ম্যাজিক দেখানোর জন্য সবাইকে ডাকলেন। বাচ্চারা মুখ শক্ত করে ভেতরে ঢুকল। তারেক মামা তার টাক মাথাটা অল্প কয়টা চুল দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করে বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে বললেন, “বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান হচ্ছে অজানাকে জানা, যেটা আগে মানুষ জানত না সেটা জানা। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতির রহস্যভেদ করা। বিজ্ঞান হচ্ছে—”

মুনিয়া মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ম্যাজিক দেখান।”

তারেক মামা থতমত খেয়ে বললেন, “ও আচ্ছা ম্যাজিক! হ্যাঁ আমার দরকার হবে এক গ্লাস পানি আর একটা ডিম। আমি তোমাদের শিখিয়ে দেব কেমন করে একটা ডিম না ভেঙে তার ভেতরের অজানা তথ্য বের করা যায়।”

টুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভালো ডিম পানিতে ডুবে যায় পচা ডিম ভেসে থাকে এইটা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে! এইটা কি দেখানোর মতো ম্যাজিক হলো? শাহানা আপু এর চাইতে কত মজার মজার বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাতে পারে! একটা জিনিস দেখা যায় কিন্তু হাত দিলে দেখা যায় সেইখানে কিছু নাই! কিংবা একটা বল গড়িয়ে নিচে না নেমে উপরে উঠে যায়! কিংবা দেয়ালে ইজিবিজি একটা কাগজ ঝুলে থাকে, একটা স্পেশাল চশমা দিয়ে তাকালে ইজিবিজি কাগজ থেকে একটা মানুষ লাফ দিয়ে বের হয়ে আসে। শাহানা আপুর এই রকম ফাটাফাটি সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট দেখে তাদের অভ্যাস, এখন একটা ডিম পানিতে ডুবে থাকে সেইটা দেখতে হবে? টুনি একবার ভাবল বলে দেয় এই রকম হাস্যকর বৈজ্ঞানিকের ম্যাজিক দেখানোর কোনো দরকার নাই কিন্তু সেইটা ভালো দেখায় না। তাই টুনি ডিম আর এক গ্লাস পানি আনতে গেল।

রান্নাঘরে টুনি ঝুমু খালাকে বলল একটা ডিম দিতে। ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কী করবা ডিম দিয়া?”

“দাদির একজন গেস্ট এসেছেন, তারেক মামা, ম্যাজিক দেখাবেন।”

“কী ম্যাজিক।”

“ভালো ডিম পানিতে ডুবে যায় পচা ডিম ভেসে থাকে।”

ঝুমু খালা ভুরু কুঁচলে জিজ্ঞেস করল, “এর মাঝখানে ম্যাজিক কুনখানে?”

“জানি না।”

“ভালো ডিম যদি ভাসে আর পচা ডিম ডুবে যায় সেইটা হচ্ছে ম্যাজিক!”

টুনি বলল, “সেইটা সত্যি–”

“দাঁড়াও” ঝুমু খালা কিছু একটা চিন্তা করল তারপর বলল, “আমার কাছে পচা ডিম নাই–ভালো ডিমকে ভাসাইয়া রাখলে কেমন হয়?”

টুনি বলল, “ঠিক আছে।”

তখন ঝুমু খালা এক গ্লাস পানি নিয়ে সেখানে অনেক লবণ মিশিয়ে দিল। তারপর বলল, “নেও। কেউরে বলবা না–এইখানে

আমি লবণ গুইলা দিছি। এখন ভালো ডিম এইখানে ডুবব না!”

টুনি পরীক্ষা করে দেখল তারপর একটা ডিম আর লবণ গুলানো পানি নিয়ে এল। তারেক মামা তখনো বিজ্ঞানের আবিষ্কার আর বিজ্ঞানীদের মহান জীবন নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। টুনিকে দেখে তার হাত থেকে পানির গ্লাস আর ডিমটা নিলেন। তারপর ডিমটা সবাইকে দেখিয়ে বললেন, “এই ডিমের ভেতরে কী আছে তুমি জান?”

সবাই বলল, “জানি। ডিমের কুসুম।”

“কিন্তু এইটা পচা না ফ্রেশ?”

“ফ্রেশ। পচা কেন হবে? আমরা পচা ডিম খাই না।”

মুনিয়া নাক চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমি ফ্রেশ ডিমও খাই না!”

তারেক মামা আবার বক্তৃতার মতো করে বললেন, “এক্ষুনি আমরা জেনে যাব ডিমটা পচা না ফ্রেশ! পানিতে যদি ভেসে থাকে তাহলে পচা। আর ডুবে গেলে ফ্রেশ। এখন বল, এটা কি ডুবে যাবে নাকি ভেসে থাকবে?”

সবাই বলল, “ডুবে যাবে।”

ডিমটা পানিতে ছেড়ে দিলে সেটা খানিকটা ডুবে আবার ভেসে উঠল। তখন তারেক মামার মুখে বিশাল হাসি, গলা উঁচিয়ে বললেন, “পচা ডিম! পচা ডিম! এক্ষুনি ফেলে দিতে হবে। ফেটে গেলে ঘর গন্ধ হয়ে যাবে।”

“জে না এইটা ফ্রেশ ডিম।”

ঝুমু খালার গলার স্বর শুনে সবাই ঘুরে তাকালো। কখন ঝুমু খালাও ম্যাজিক দেখতে এসেছে কেউ লক্ষ করে নাই।

ঝুমু খালার কথা শুনে তারেক মামা খুবই বিরক্ত হলেন। মুখ প্রায় খিঁচিয়ে বললেন, “যেটা জান না, সেইটা নিয়ে কথা বলো না। ডিমের এভারেজ ডেনসিটি পানির থেকে বেশি। সেইজন্য ফ্রেশ ডিম ডুবে যাবে”

ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, বলল, “জে না। আমরা পচা ডিম কিনি না।”

তারেক মামা এবারে শুধু বিরক্ত না, রীতিমতো রেগে উঠলেন, ঝুমু খালাকে ধমক দিয়ে বললেন, “তোমাকে এখানে কথা বলতে কে বলেছে? যাও তোমার নিজের কাজে যাও। ডিমটা নিয়ে ফেলে দাও।”

ঝুমু খালা বলল, “আমি একটা বাটি আনি। আপনি সবার সামনে ডিমটা ভাঙেন। দেখি এইটা পচা না ফ্রেশ

তারেক মামা হুংকার দিয়ে বললেন, “না। ঘরের মাঝে পচা ডিম ভাঙলে ঘরে দুর্গন্ধ হয়ে যাবে।”

কিন্তু তারেক মামার হুংকারে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ঝুমু খালা বের হয়ে গেল এবং চোখের পলকে একটা ছোট বাটি নিয়ে চলে এল। বাটিটা টেবিলে রেখে ঝুমু খালা বলল, “ভাঙেন!”

তারেক মামা গর্জন করে উঠলেন, “না।”

ঝুমু খালা তখন তারেক মামার হাত থেকে ডিমটা নিয়ে দক্ষ হাতে ডিমটা ভেঙে বাটিতে রাখেন। চমৎকার কমলা রঙের টলটলে কুসুম–মোটেও পচা নয়! মনে হলো হাসি মুখে সবার দিকে তাকিয়ে আছে।

টুনি ছাড়া অন্য সবাই বিস্ময়ের শব্দ করল। ঝুমু খালা পানির গ্লাস এবং ডিমটা নিয়ে বের হবার আগে বলল, “ডিমটা নষ্ট করা ঠিক হবে না। পুচ না মামলেট? কী করমু? কে খাবে?”

মুনিয়া রিনরিনে গলায় বলল, “বৈজ্ঞানিক মামা।”

তারেক মামা তখনো হতভম্ব হয়ে বসে আছেন। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কেউ শুনতে রাজি হলো না। শুধু মুনিয়া রিনরিনে গলায় বলল, “ভুয়া ম্যাজিক! ভুয়া ম্যাজিক!”

তারেক মামা বিড়বিড় করে বললেন, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য–”

শান্ত হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “সাবধান তারেক মামা নড়বেন না। নড়বেন না–”

তারেক মামা অবাক হয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”

শান্ত চিৎকার করে বলল, “গান্ধী পোকা–” তারপর তারেক মামার গলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক টান দিয়ে গলা থেকে কালো সুতা দিয়ে ঝোলানো একটা বড়োসড়ো তাবিজ বের করে আনল। তারপর বোকার মতো হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আসলে তাবিজ! আমি ভেবেছি গান্ধী পোকা!”

তারেক মামা তাড়াতাড়ি তাবিজটা আবার শার্টের ভেতর লুকানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, বাচ্চারা তাবিজ নিয়ে হইচই শুরু করে দিয়েছে।।

একজন বলল, “এইটা কিসের তাবিজ মামা?”

আরেকজন বলল, “জিন ভূতের?”

আরেকজন : “মামলা মোকদ্দমা?”

আরেকজন : “বিবাহ?”

আরেকজন : “না, না, এটা বৈজ্ঞানিক তাবিজ। এইটার ভেতরে সব বিজ্ঞানের ফরমুলা।”

সবাই : “বৈজ্ঞানিক তাবিজ! বৈজ্ঞানিক তাবিজ!”

মুনিয়া তার রিনরিনে গলায় বলল, “আসলে এটা রেডিওঅ্যাকটিভ তাবিজ। তাই না বৈজ্ঞানিক মামা?”

টুনি অবাক হয়ে বলল, “রেডিওঅ্যাকটিভ? তুই এটা কোথা থেকে শিখেছিস?”

“কমিক থেকে। রেডিওঅ্যাকটিভ মাকড়শা কামড় দিলে সুপার পাওয়ার হয়। তাই না মামা?”

তারেক মামার আলোচনায় খুব উৎসাহ দেখা গেল না। উঠে দাঁড়িয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজকে যাই খালা?”

তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে প্রায় ছুটে বের হয়ে গেলেন।

বাচ্চারা “সায়েন্টিস্ট মামার তাবিজ! সায়েন্টিস্ট মামার তাবিজ!” বলে চিৎকার করে পেছনে পেছনে ছুটতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *