মার্কেট ভিজিট ৫
পাক্কা তেরো বছর পর ব্যাঙ্গালোরে এসে যেটা প্রথম খারাপ লাগলো সেটা হচ্ছে ট্র্যাফিক। এর কাছে কলকাতার সি আর এভেন্যু বা মুম্বাইয়ের গ্রান্ট রোডের ট্র্যাফিক তুশ্চু। এগারো কিলোমিটার রাস্তা যেতে যদি আড়াইঘন্টা সময় লাগে, কারই মেজাজ ঠিক থাকে দাদা ??
আজ সারা সকাল ধরে একটি অত্যন্ত গুরুগম্ভীর এবং ততোধিক অপ্রয়োজনীয় মীটিং শেষে হোটেল রুমে ঢুকেই ঠিক করলাম ব্রিগেড রোড যাব, পাব হপিং করতে। লাস্ট এসেছিলাম দশ বছর আগে, তখন থেকেই জায়গাটা আমার ভারি প্রিয়।
ব্রিগেড রোডের ঠিক মোড়ে কাভেরী এম্পোরিয়ামে ঘোরাঘুরি করে, সত্তর লাখ থেকে এক কোটির মধ্যে দাম, এমন কিছু চন্দনককাঠের দুর্ধর্ষ মূর্তি দেখে ব্রিগেড রোডের আলোঝলমল শাইনিং ভারতের হাসিরাশি স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম।
টুকটুক করে এগোতে এগোতে ইদিকউদিক তাকাতে তাকাতে রঙিন দোকানপাট, খাটো স্কার্ট পরা আফ্রিকান ললনা, চওড়া শর্টস, মেহেদিরঞ্জিত হাতের কনুই অবধি চুড়ি পরিহিত সদ্য বিবাহিত মাড়োয়াড়ি কন্যা,জিন্স টি শার্টস পরা সপ্রতিভ কেজো তরুণী দেখতে দেখতে যেখানে এসে থামলাম, সেখানে একটু জিরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়েই দেখি, উইমা, ব্রিগেড ডিলাইট বার (উইথ লাইভ ব্যান্ডস)।
তখন সন্ধ্যে প্রায় সাতটা। বার দেখেই গলাটা কেমন শুকিয়ে উঠলো। অতএব হাসিমুখে সেখানে যাওয়াই সাব্যস্ত করলাম।
সে প্রায় মুঘলাই সিঁড়ি চড়ে ওপরে উঠেই আমি ধাঁ!!
বিশাল বড় বার। কম করে চারটে সেকশন, তার মধ্যে মাঝেরটা সবচেয়ে বড়। সেখানে এক ভূঁড়োকাত্তিক দুলে দুলে বীভৎস বাজে সুরে ‘চুপকে চুপকে রায়ায়াত দিন, আঁসু বহানা ইয়াদ হ্যায়’ গাইছে।
আমি বাঁদিকের দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়লাম।
ঢুকেই চোখটা ধাঁধিয়ে গেলো। সাউন্ডপ্রূফ বোঝাই যাচ্ছে, কারন বাইরের আওয়াজ কিছু কানে আসছে না, আর খুব আলতো সুরে ”মোরা সাঁইয়া মোসে বোলে না” গান বাজছে স্টিরিও তে।
হাতড়ে হাতড়ে, আবছা ধীরলয়ে ঘুরে যাওয়া, হালকা সাইকোডেলিক আলোর বিভ্রম সৃষ্টকারী আলোআঁধারির মাঝে এসে একটা টেবিলে এসে বসলাম।
সংগে সংগে ওয়েটার এসে দাঁড়াতে আমি রেটকার্ড না দেখেই অর্ডার দিলাম দুটো লার্জ ব্লেন্ডার্সের।
খানিক পরে চোখটা সামান্য আঁধার সয়ে আসাতে খেয়াল করলাম আমার পাশের টেবিলে দুটি মেয়ে বসে বিলক্ষণ হা হা হি হি করছেন।
আমি প্রথমে পাত্তা দিই নি। কিনতু কিছু কথা কানে যাওয়াতে কান দুটো উদগ্র রকমের অসভ্য হয়ে উঠলো। যা বুঝলাম, তা হল
১) দুজনেই বাঙালি। সে তো সফটওয়ার পারদর্শী অনেক বঙ্গললনাই এখানে আছেন। আলাপ জমাবো নাকি? সন্ধ্যেটা না হয় চমৎকার কেটে যাবে?
২) যেটা খটকা লাগলো সেটা হল দুজনের উচ্চারণ। শহুরে কলকাত্তাইয়া মার্জিত বাঙলা আর গ্রাম্য মিষ্টি বাঙলার মধ্যে অনেক পার্থক্য, যেটা শুনেই বুঝতে পারছিলাম। তাছাড়া সেলসের কাজে গত দশ বছর বিবিধ জায়গা পরিভ্রমণের ফলে অন্তত পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু ডায়ালেক্ট চিনতে শিখেছি। সেই জ্ঞানে বুঝনু যে স্থূলাঙ্গী মহিলাটি অবাঙালী, খুব সম্ভবত বিহার বা ইউপির এবং দীর্ঘাঙ্গী মহিলাটি দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত এলাকার। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বাংলাদেশ সংলগ্ন এলাকাতেই এই ডায়ালেক্ট বা কথ্য ভাষার টান শোনা যায়।
এই উচ্চারণের কোন বঙ্গললনা বেঙ্গালুরুতে সফটওয়্যারে কাজ করলে আমি সত্যি খুব খুশি হতাম, সোশাল আপলিফটমেন্টের জাগ্রত নমুনা দেখে, কিন্তু আমার ষষ্ঠ ঈন্দ্রিয় বলছিল ডাল মে সামথিং প্রচন্ডরকমের ব্ল্যাক তো হ্যায়! তাছাড়া এনাদের হাহাহিহি ঠিক আমার চেনাশুনা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুনিদের হাসিঠাট্টার সংগে মিলছিল না, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তো নয়ই।
সে যাই হোক, প্রথম পেগটা এসে পড়াতে আমি হাল্কা চুমু দিয়ে ফেসবুক দেখছি, এমন সময় দীর্ঘাঙ্গী কন্যেটি হাল্কা হাস্কি স্বরে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বললেন, ‘থোড়া ইধর ভি দেখিয়ে জনাব, মোবাইলমে কেয়া রাকখা হ্যায়?’, সংগে একটি বিলোলমদির মক্ষীরানি মার্কা হাসি।
আমি প্রথম রাতেই বিল্লি মারতে অভ্যস্ত, ঘুরে দাঁত কেলিয়ে বললাম, ‘আরে, আপনারা বাঙালি নাকি? বাহ বাহ’।
দুইজনেই একটু থমকে গেলেন, স্থূলাঙ্গীটি একটু কাষ্ঠ হেসে হিন্দি ঘেঁষা বাংলায় বললেন, ‘আপনিও আমাদের মতুন বংগালি নাকি?’
আমি দাদা, সেলসের লোক, দরকার থাকলে যে কোন পাবলিককে নিজের পছন্দসই দূরত্বে রেখে বা কাছে টেনে আলাপ জমানোটা আমার পেশাগত দক্ষতার মধ্যেই পড়ে। আমি ভারি উৎসাহ ভরে ওদিকে ঘুরে কান এঁটো করা হাসি দিয়ে বলি ‘আলবাত। আপনারা কোথায় থাকেন? কি করেন?’
দুজনেই সন্ধিগ্ধভাবে একে অন্যকে দেখে নেন। তারপর আমাকে ঠিক একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন।
আমি সত্যি কথাই বলি। আমি কে, কি, কেন, হোয়াই ব্যাঙ্গালোরে টুডে, সওব।
দুজনেই একটু আড়ষ্টতা কাটিয়ে সহজ হবার চেষ্টা করেন। দীর্ঘাঙ্গী কৃষ্ণা রমণীটি একটু ভেবে বলেন, ওনার নাম নেহা। স্থূলাঙ্গীটি জানান যে ”হামার নাম পূজা আছে”।
দুটো নামের গা দিয়েই পাক্কা মিথ্যে মিথ্যে গন্ধ বেরচ্ছিল। কিন্তু কিছু বললাম না। সহজ সুরে জিজ্ঞাসা করলাম ‘আপনাদের বাড়ি কোথায়?’
‘আপনার?’ – নেহা
‘আমার বাড়ি দমদমে’
‘আপুনি কি কাজ করেন?’- পূজা
‘সেলসএ আছি ম্যাডাম। সারা দেশ ঘুরতে হয়’।
লক্ষ্য করলাম ”ম্যাডাম” শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও একটা ম্যাজিক ঘটে গেলো, দুজনেই একটু প্রীতিসহকারে সহজ হলেন।
‘আমার বাড়ি নৈহাটিতে’ – নেহা
‘হামি…উমমম, পার্ক সার্কাসে থাকি’। – পূজা
এটাও মিথ্যে পাক্কা, কিন্তু ততক্ষণে আমার ভেতরের ফেলুদাটি হাসিমুখে বলছেন ‘ধৈর্যং রহু’।
আমি অযাচিতভাবেই একটু বাগাড়ম্বর করি। নিজের চাকরি সংক্রান্ত ঝামেলার কথা বলি, মেয়েকে নিয়ে নাজেহাল হবার গল্প। আমার দওশ হাজার টাকা দিয়ে একটা ”ফালতু” মোবাইল কিনে ঠকে যাবার গল্প।
এনারাও কিছু সহজ হতে শুরু করেন। তখন আমিও জিজ্ঞাসা শুরু করি,
‘আপনারা কি করেন এখানে?’
পূজা জবাব দেয় ”হামরা এখানে বিউটি পার্লারে কাজ করি”।
আমি মুখে হাসিটা টেনে রেখেই সটান জিজ্ঞেস করি, ‘তা এখানে সন্ধ্যেবেলা কি করছেন দুজনে? রোজই কি আসেন? টেবিল তো পুরো খালি দেখছি’।
নেহা ফাজিল হেসে বলে ‘ধুর, ও মিথ্যে বলছে। জানেন আমরা কি করি? পেছনের দিকে তাকান’
তখন অল্প আলোতেই দৃষ্টি চোখসই হয়ে এসেছে।
এর আগে ওদিকে, মানে বারের একদম পেছন দিকে, যাকে বলে আলো আঁধারির সীমানা ছাড়ায়ে, কিছু যুবকযুবতীর কলোচ্ছল হাসিতরঙ্গ ভেসে আসছিল বটে, এবার ওদিকে তাকিয়ে কারণটা সুস্পষ্ট দিবালোকের মতনই প্রত্যক্ষ হয়ে উঠলো।
প্রতি টেবিলে একেকজন পুরুষ একেকজন নারী নিয়ে ব্যস্ত। সেই সব নারীদের চেহারাছবিও এই আমার সমীপবর্তিনী দুই মহীয়সীর মতনই!!
আর ”ব্যস্ততার” কি বর্ণনা দেবো? হে শেয়ানা পাঠক/ পাঠিকা, সময়কালে কি আপনারা নিজ নিজ নিষ্পাপ মহিলা/ পুরুষ বন্ধুদের সহিত, সেই যৌবনতাড়িত দিনে, সবচেয়ে খাজা সিনেমাগুলির মর্নিং শো”তে সর্বোচ্চ সারির একদম কোণার দিকের সীটগুলি বুক করে ঘনিষ্ঠতম আদিম আকাঙ্ক্ষা গুলির খবর নেননি??
পার্থক্য এই যে, এখানে এই আদিম প্রবৃত্তির প্রকাশ বড় ঘৃণ্য। বছর ষোলর রাহুল বছর পনেরোর সালমা র বুকে থরথরকম্পিত হাত রেখে ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে ইলেক্ট্রিক শকসম একটি চুম্বন করিলেন, সে বড় ভালো।
কিন্তু এখানে বছরপঞ্চাশের একটি পারভার্ট আধবুড়ো একজন বছর কুড়ির মেয়েকে হিংস্র বুভুক্ষু দানবের মতন চটকাচ্ছেন, আরও অস্থানে কুস্থানে হাত ঢোকাচ্ছেন , সেটা হজম করা একটু ইয়ে লাগে প্রথম দর্শনে।
চোখ সরিয়ে এদিকে আনলাম। দ্বিতীয় পেগে চুমুক মেরে ভাবছি কেসটা কোনদিকে যাবে, এমন সময়ে নেহা বললেন, ‘আপনার পাশে বসবো নাকি? দশ মিনিটে পাঁচশো টাকা নিয়ে থাকি। আপনি দেশের লোক, না হয় পনেরো মিনিটই থাকবো, হি হি হি।’
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। কত কি যে করে যেতে হয়, পেটে খিদে পেলে।
মৃদু বললাম ‘না না ম্যাডাম, আমার ওসবের শখ নেই, আমি শুধু মদ খেতেই এসেছি’।
দু কন্যেই চুপ করে গেলেন। অন্তত বাহ্যিক দিক দিয়ে। নেহা জিজ্ঞেস করলো (আর আপনি আপনি বলতে পারছিলাম না কেউই)
‘তোমার বাড়িতে কে কে আছে?’
‘মা, বাবা, মেয়ে, বউ। তোমার?’
‘মা বাবা, বোন, ছেলে’
ছেলেই শুধু? হাজব্যান্ড নেই? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ভারি সংকোচ হচ্ছিল।
এমন সময় পূজা খেঁকিয়ে উঠলো,’তোর মর্দের নামটা লিচ্ছিস না যে?’
নেহা কি একটু অপ্রতিভ হল? খানিকক্ষণ চুপ থেকে জানায় যে ওর ”মরদ” ব্লাড ক্যান্সারের রুগি। ঠাকুরপুকুরে আছে দু বছর।
খানিকক্ষণের নৈঃশব্দ।
আমার যা স্বভাব। সুযোগ পেলেই লোকজনের ইনকাম, লাইফস্টাইল, স্পেন্ড প্যাটার্ন, সোশিও ইকনোমিক চয়েস, ডেমোগ্রাফিক প্রোফাইল এসব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করা আমার অভ্যেস। এই স্বভাবের জন্যে সমাজের বিভিন্নস্তরে কিছু চিত্তাকর্ষক রুজির বন্ধু আছে আমার। আমি থার্ড পেগের অর্ডার দিয়ে হাসি মুখে কাজে লেগে পড়ি।
পূজাকে নিয়েই পড়লাম, ‘তুমি কতদিন আছো এখানে?’
‘তিন বোছর হোবে’।
‘বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘তাইজি’
মানে? আর কেউ নেই?
নাহ। অসুস্থ জ্যেঠিমা ছাড়া ভদ্রমহোদয়ার তিনকূলে আর কেউ নেই।
এইবার খাপ খুললাম, ‘ইয়ে, তোমাদের কি রকম রোজগারপাতি হয় এই কাজ করে?’
সমস্বরে উত্তর এলো ‘ডিপেন্ড করে’।
আহ। সে তো বুঝনু। কার ওপর কি কতটা ডিপেন্ড করলে কতটাকা হাতে আসে ভাই? অন অ্যান অ্যাভারেজ?
আবার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, পেটে প্রায় বোমা মেরে জিজ্ঞেস করে যা জানতে পারলুম, রোজগার প্রতি মাসে প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কোন কোন মাসে স্পেশাল মুর্গি / কাস্টমার পাকড়াও করতে পারলে ওটা সত্তরও হতে পারে। আর যে বুদ্ধু মেয়ে দিওয়ালি আর ”ফাসট জানুয়ারি” মাস দুটোতে কম সে কম দেড় লাখ টাকা কামায় না, তার এ লাইনে থাকা না থাকা সমান।
এবার আড়াই পেগ মেরে দেওয়ার পর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা বাড়ি যাও? বছরে কবার?’
‘তা দাদা, বলতে গেলে, উমম (দাদা বলেছে শুনে, সত্যি বলছি, খুউব ফ্রি লাগলো নিজেকে) এক দুবার তো যাইই’।
‘কিসে যাও?’
‘ধরো টেরেনে বেশিরভাগ সময়েই। মাঝেসাঝে ফেলাইটেও যাই’।
‘একাই থাকো? খাবার কোথায় খাও?’ (নিজেকে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার মনে হতে থাকে এর পরে।)
‘তিনচারজন মিলিয়ে থাকি দাদা। ধরো বারো হাজার টাকা ভাড়া দিইই। বাঁধা মাসি আছে, রান্না করে দিয়ে যায়।’
‘উইকেন্ডে কি করো?’
দুই জনেই হেসে গড়িয়ে পড়লো, ‘আমাদের আবার ছুটি কি দাদা, সনিরোব্বারেই তো বেসি কাস্টমার আসে। তখনি তো নগদাপাত্তি কিছু পকেটে ঢোকে দাদা। ছুটি বলতে, ধরো পোনরো আগস, কি গান্দি বাড্ডে, এই আর কি’।
পরের প্রশ্নটা করতে খুবই ইতস্তত করছিলাম বটে, শেষে করেই ফেললাম, ‘তোমাদের, ইয়ে, আর কোন, মানে, ইয়ে আর কোন ইনকামের রাস্তা আছে? মানে, ইয়ে, এইসবের থেকে একটু এগিয়ে?’, জিজ্ঞেস করে একটা বোকা বোকা ক্যালানে মার্কা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখি।
দুজনেই প্রশ্নটার মানে বোঝে, ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে হাসে। স্পষ্ট স্বরে, চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে, ‘সবই তো বোঝ দাদা। ওই ধরো সেখান থেকেও আরও বিস পচ্চিস হাজার হয়। পার শট পাচ নিইই। মাসে চারপাচটার বেসি কাজ করি না’।
এতক্ষণে অনেকটা সহজ হয়ে এসেছি বলে বললাম, ‘কিছু খাবে নাকি?’
শোনা মাত্র শিকারি বিড়ালের ক্ষিপ্রতায় ওয়েটার এগিয়ে আসে, বুঝতে পারি
(১) ইনি বাঙলা বোঝেন (‘জোয়ন্ত দা কিস্ননগরের লোক’), এবং
(২) এই সাকীদের যে খাদ্য পাণীয়ের অর্ডারটা আসে, সেটাও একটা উপার্জনের রাস্তা বারের পক্ষে, হয়ত মত্তাবস্থায় ক্যাবলার অর্ডার করানো একই তন্দুরি চিকেন সংগিনীটির ইশারাতে ডাবল দামে পরিবেশিত হয়।
নেহা আমার দিকে চোখ ফেরায়, ‘তুমি তো বসলেই না। ফ্রিতে আমরা কিন্তু কিছু খাই না।’।
আরে ধুর। কি জ্বালা, ‘না না এমনি বলছি। কিছু খাবে?’
দুইজনে চোখাচোখি করে। তারপর পূজা হেসে বলে, ‘ঠিক আছে, জোয়ন্তদা, দুটো সুইট লাইম সোডা নিয়ে এস। নর্ম্যাল’।
‘নর্ম্যাল মানে’?
দুজনেই দাবড়ে দেয়, ‘তোমাকে বুঝতে হবে না’।
কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করি,
‘এখানে কজন মেয়ে কাজ করে?’
‘তা ধরো পনেরোষোলো জন’
‘এরা কোন কোন স্টেট থেকে আসে?
দুজনেই চুপ।
‘কি হল’
অনেক্ষন পরে জবাব আসে, ‘আর্ধেক আসে বিহার আর কোলকাত্তা থেকে, বাকি আর্ধেক বাংলাদেশ থেকে’।
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। ইস্ট ইন্ডিয়ার মেয়েরা এতই সস্তা নাকি?
এবার শুষ্কস্বরে জিজ্ঞাসা করি, ‘তোমাদের নাম গুলো ভুল বলেছ, তাই না?’
দুজনেই একটু বোকা বোকা হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, ততক্ষণে এসে যাওয়া স্যুইট লাইম সোডাতে চুমুক দিতে থাকে, এলোমেলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকে ‘তোমার মেয়ে কত বড়?’ ‘ওলে বাবা’ ‘কোন ক্লাসে পড়ে?’ ‘খাওয়া নিয়ে ফালতু ঝামেলা উমেলা করে না?’
ততক্ষণে আমারও তিন পেগ শেষ, নেশা পুরো টঙএ চড়ে বসেছে।
আলো আরও আঁধার হয়ে এসেছে, উচ্চস্বরে গান বাজছে, ‘হায় হায় জওয়ানি লে ডুবি’, সন্ধ্যে হয়ে উঠেছে আরও মদির মাতাল, আগত রাত্রির পরতে পরতে পাপ বুনে দিচ্ছে তার শোষণের দীর্ঘমেয়াদি ইতিহাসের কালিমা।
অন্ধকার টেবিলের চারিদিকের সাইকোডেলিক আলো আর বেআইনি ধোঁয়াতে দুনিয়াটা পুরো সুররিয়ালিস্টিক হয়ে উঠেছে,
এমন সময় পূজার ডাক এলো, হুমদো বঙ্গভাষী ওয়েটারটি পূজার কানে কানে কিছু বলতেই, কন্যেটি মাথা নামিয়ে দু টেবিলপরে একটি মাঝবয়েসী পুরুষের পাশে কোলঘেঁষে বসে বিনা কারণেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
আমারও নেশা তখন তীব্র হয়ে উঠেছে। তবুও ওয়েটারকে আরেকটা স্মল পেগ অন রক্স দিয়ে যেতে বললাম
মাঝবয়সী পুরুষটি যেভাবে জড়িয়ে, চটকে, জামার নিচে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ভোগ করা শুরু করলো, তার একটাই তুলনা মাথায় আসে, হরিণীর মাংসখন্ড পেয়ে হিংস্র হায়েনার ভোজনউল্লাস!
আপনা মাংসে হরিণী বৈরী? সত্যি? কাহ্নপা ভুষুকপা এনারা কি শিকারি শ্বাপদ দেখেননি?
সব দোষ শুধু ক্ষুধার্ত হরিণীরই?
তখন নেশার তীব্র বিষে আমার শরীর বেপথু ও চেতনা উন্মার্গগামী। সামনে বসা নেহার হালকা হাসিমুখটুকু অবধি মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে আসছে। সমস্ত ঘর জুড়ে জেগে উঠেছে মাদকতাময় মায়াবী আলোর বিভ্রম, লাউডে মিউজিকে বাজছে নেশালু গান, ‘জানু, আজ রাত কা সীন বানা দে’
এমন সময় দুটেবিল পরে পূজার চোখে চোখ পড়লো।
আমার দিকেই আবছা হাসি দিয়ে চেয়ে আছে সেই মেয়ে, বিহারের কোন অজ্ঞাত গ্রাম থেকে বেঙ্গালুরুতে শরীর বিক্রি করতে আসা সেই মেয়ে, মাথা শক্ত করে তাকিয়ে আছে সে, একটা নোংরা হাত, তার জামার নিচ দিয়ে বুকের ওপর খেলে চলেছে হিংস্র উল্লাসের সংগে , একটা সাপের মতন দীর্ঘ লোলজিহবা গাল আর কান চেটে দেয় তার। হাসি মুখে বিহারের সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মেয়ে আমার চোখে চোখ রেখে থাকে, সেই হিংস্র জিহ্বা শুষে নেয় আমাকে দাদা বলে ডাকা সমস্ত অসহায়তা টুকু…
পাঁচশো টাকায় দশ মিনিট ভোগ করা যায় জ্যান্ত নারীমাংস! মানুষ এত সস্তা?
অনেক ছোটবেলার বাজারে দেখা একটা দৃশ্য মনে পড়ে গেলো, একটা কচ্ছপকে উল্টো করে শুইয়ে রাখা হয়েছে, সে হাত পা ছুড়ছে, আর একটু একটু করে তার বুক থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে মাংস কেটে শালপাতায় খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কচ্ছপের জান বলে কথা!
মৃতপ্রায় কচ্ছপের বুক কেটে তুলে আনা টাটকা তাজা মাংস, কখনো খেয়েছেন কর্তা?
প্রায় নীট হুইস্কি কাঁচাই গলাধঃকরণ করি। সিগারেটের ধোঁয়ায় আবছা হয়ে আসে নেহার মুখ। স্খলিত স্বরে জিজ্ঞেস করি ‘কেন কর এসব? ভালো লাগে করতে? আর সত্যি করে বলতো তোমাদের কি নাম?’
বিল আসে, ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চিং মেশিনও। নেহা চুপ করে থাকে, বুঝি যে জবাব টা আমাকেই দেবে শুধু।
ক্লান্ত নেশাজর্জরিত হাতে পাসওয়ার্ড টাইপ করি মেশিনে,কার্ড ওয়ালেটে রাখি, দরাজ টিপস গুছিয়ে দিই বিলের ভাঁজে।
ওয়াটার স্পষ্টতই খুশি হয়, মাথা নুইয়ে দরজা খুলে ধরে।
চলে আসবো, টেবিলের ওপার থেকে উঠে দাঁড়ায় সেই মেয়ে, আমার কানে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘আমার নাম তবাসসুম দাদা, নেহা নয়। আমি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছি’।
টলতে টলতে ভাবলাম একে কি বলবো, এও কি আমার মতনই উদ্বাস্তু?
স্খলিত পায়ে সেই মুঘলাই সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াই। বাংলাদেশ থেকে আসা সেই দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি সাবধানে ধরে ধরে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে আমাকে, ব্রিগেড রোডের উচ্ছল হাসিআলোর মাঝখানে আমাকে ছেড়ে দেয়, সস্নেহে বলে ‘সাবধানে যাবে’।
আমি ঘুরে দাঁড়াই, জিজ্ঞেস করি, ‘এসব কাজ কেন কর বললে না যে?’
‘কি বলবো দাদা, বরের ক্যান্সার আছে, শুনলেই তো। বম্বেতে টাটায় নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে। অনেক টাকা লাগবে দাদা, তুমি বুঝবে না’।
এই বলে বিষন্ন আলোয় সেই বাংলাদেশ, আমার চেতনার সাড়ে তিনহাত ভূমি, আমার সবটুকু মাড়িয়ে উঠে যায় নতুন খদ্দেরের হাতে নিজেকে সঁপে দিতে।
টলতে টলতে একটা অটো ধরি, সীটে বসে শরীরটা এলিয়ে দিই, শ্রান্ত মগ্নচৈতন্য জুড়ে বাজতে থাকে ”কেন চেয়ে আছো গো মা, মুখপানে..”