মার্কেট ভিজিট ১৪
আমার কম্পানিটি দাদা কি বলবো, এমনিতেই ভারি ভালো কম্পানি। কেউ কাউকে কিচ্ছুটি বলে না, কাজ করলেও বলে না, না করলেও না। তার ওপর গত মাসে আমার বস রিজাইন করাতে গায়ে ফুঁ দিয়ে উড়েই বেড়াচ্ছিলাম প্রায়। কিন্তু দুধের ওপরেও যে সরভাজা হয়, বা চিকেনের ওপরে রোগনজোশ সেটা চমৎকার বুঝতে পারলাম ঠিক যে পুণ্যমুহূর্তে আমার টেম্পোরারি ওপরওয়ালা এসে খুবই গম্ভীর মুখে বললেন, ‘বেটা, যবসে ইস্ট রিজিওনকা ম্যানেজার নওকরি ছোড় দিয়া হ্যায়, তব সে ধন্দে কি তো ওয়াট লাগি হুই হ্যায়। আপ এক কাম করো, বোরিয়া বিস্তর উঠাও অওর কলকাত্তা যা কর ব্যয়ঠো’, বিশ্বাস করবেন না, মনে হয়েছিলো গুঁফো লোকটার কোলে উঠে দুই গালে দুটো চকাম চকাম করে চুমু খাই। এদ্দিন যেন সরোবরের মীনগণের মতই হীন হয়ে ছিলুম, ভরসা পেয়েই মনে হলো বান্দা ওরলি সি লিঙ্কের ওপর তোয়ালে পরে লুঙ্গি ড্যান্সই করি। কিংবা গেটওয়ে অফ ইণ্ডিয়ার সামনে খালি গায়ে বারমুডা পরে গ্যাংনাম স্টাইল নাচলেই বা আটকাচ্ছে কে?
ফলে টিকিট কেটে সেই হপ্তার শুক্রবারই দুটো ট্রাউজার্স, একটা শার্ট, খান চারেক ব্লেণ্ডার্স প্রাইডের এক লিটারি বোতল, আর নরবলির ইতিহাসের ওপর খান দুয়েক বই বগলে, ”ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা” গাইতে গাইতে দমদম এয়ারপোর্টে যখন পায়ের ধুলো দিলুম, তখন মনের মধ্যে যে বিচিত্র রংবাহারি প্রজাপতি উড়ছিলো সে না বললেও চলে। আনন্দের আরও কারণ ছিলো যে সেলস সাপোর্ট ছেড়ে সেলসে ফিরে আসতে পেরেছি। আরে মশাই, আমি বলে কিনা উদ্বাস্তু বাঙাল, হাওড়ার মাঠেঘাটে নালানর্দমায় ফুটবল লাথিয়ে আর মারপিট করে মানুষ, কোট টাই পরে অফিসে বসে বাবুয়ানি কি আমার পোষায় , অ্যাঁ? আপনারাই পষ্ট করে বলুন দিকিন!
সে যাই হোক, নেমে হোটেলে ঢুকেই জলদগম্ভীর গলায় এরিয়া ম্যানেজারদের একপ্রস্থ খোঁজখবর নিলুম। আমার সঙ্গে যে কোনওরকম ইয়েমস্তিটি চলবে না সেইটে আগে সমঝে দিতে হবেনি? ফলে দুচারজনকে বজ্রকঠিন গলায় দুচারটে ধমকটমক দিয়ে মনটা বেশ হাল্কা হয়ে উঠেছে, শরীরে বেশ চনমনে ফীল করছি, এমন সময়ে স্থানীয় ম্যানেজারটি খুবই ভব্যসভ্য গলায় জিগাইলেন, ‘ বস কি কাল মার্কেটে যাবেন?’
অন্য সময় হলে কাটিয়ে দিতাম, কারণ শনিবারে রিজিওনাল ম্যানেজার মার্কেট গেলে সেলসঠাকুর পাপ দেন, অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। কিন্তু এলাকায় আমি লতুন, নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন বাঁধার আগেই আমাকে ঝাঁকে ঢুকে পড়তে হবে, ফলে বীরদর্পে বল্লুম, ‘ঠিক হ্যায়, লেটস ডু সাউথ ক্যালকাটা টুমরো’।
পরের দিন তো সক্কাল সক্কাল মাঞ্জাটাঞ্জা মেরে একটা উদার হাসি বিলিয়ে মার্কেটে নামলুম। উদ্দেশ্য অবশ্য খুবই মহৎ, বুঝদার লোক মাত্রেই ঘাড় নেড়ে সায় দেবেন। লোকজনকে চমকে ধমকে বেশ খানিকটা ভয়টয় দেখিয়ে ‘ওরে আমি এলাম, সম্মানটম্মান করিস বাপু। আর হ্যাঁ দেখিস ভাই, যেন টার্গেটের জন্যে আমাকে আবার গতর নাড়াতে না হয়। এমনিতেই বয়েস হয়েছে, আর ওজনের কথা তো কহতব্য নয়’…ইত্যাদি প্রভৃতি সমঝে আসবো। কিন্তু ও হরি! মার্কেটে নেমে দেখলাম দিব্যি চৌখস লোকজন, মার্কেটও তৈরি। ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করেও কোনও ইয়ে খুঁজে না পেয়ে মনটা ভারি উদাস উদাস ফীল হতে লাগলো, বুইলেন? বলি কাউকে কিচ্ছুটি বকাবকি না করে সোনামুখ করে বাড়ি ফিরে গেলে কেমন গা’টা ম্যাজম্যাজ করে না? অ্যাঁ?
ফলে শেষ আশ্রয় হিসেবে কাতরস্বরে বল্লুম, ‘আর কোনও মার্কেট নেই কাছাকাছি?’
প্রশ্নটা শুনেই সেলস অফিসারটি দেখলাম তড়িৎগতিতে বললো, ‘আছে তো স্যার, বারুইপুর মার্কেটে আজ কাজ হচ্ছে তো’, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ম্যানেজারের চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো।
ব্যাস…ক্যাচ কট কট…ম্যানেজার বারণ করছে কেন? নিশ্চয়ই কিছু গোলমেলে কেস হ্যাজ। হুঁ হুঁ বাওয়া, বারো বচ্ছর হয়ে গেলো এই লাইনে রগড়াচ্ছি, হাঁ করলেই হনুলুলু বুঝে যাই, চ্যাঁ করলেই চাইকোভস্কি, আমার সঙ্গে চালাকি পায়া হ্যায়? কম্বুর্ন্টে বল্লুম, ‘ ঠিক হ্যায়, লেটস গো টু বারুইপুর’।
এইবার দেখলাম বর্ষীয়ান এরিয়া ম্যানেজারটি এগিয়ে এলেন, ‘বলছিলাম কি স্যার, গত মাসে ওখানেএকটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে, না গেলেই নয়?’
ব্যস, আমার সন্দেহ একদম যাকে বলে শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছ। লোচাটা গত মাসেই করেছে, তাই আমাকে যেতে দিতে এতো অনীহা। দৃঢ় গলায় বল্লুম যে ‘না হে, আমি বারুইপুরেই যাবো, এক্ষুণি যাবো।’।
যেখানে ছিলাম যেখান থেকে বারুইপুর যেতে আধঘণ্টাটাক লাগে। আদর্শ মফস্বল বলতে যা বোঝায়, বারুইপুর ঠিক তাই। তবে শহর কলকাতার আগ্রাসী থাবা এতদূর এসে পৌঁছতেও ছাড়েনি। বিস্তীর্ণ পেয়ারাবাগান কেটে আস্তে আস্তে উঠছে দামী হাইরাইজ। মার্কেটের রাস্তায় সাইকেল আর ভ্যানগাড়িকে সচকিত করে বেরিয়ে যায় দামি মোটরসাইকেল আর চারচাকা।
মার্কেটে এসে গাড়ি থেকে নামতেই যে ভদ্রলোক সহাস্যে অভ্যর্থনা করলেন, বুঝলাম যে তিনিই এই এলাকার স্টকিস্ট। মাঝারি উচ্চতার দোহারা ছিপছিপে চেহারা, উজ্জ্বল মেটে তামার রঙে গায়ের রঙ, বগলে একটা ছোট হাতলওয়ালা চামড়ার ব্যাগ, মুখে জর্দাপান চিবোনো এক অতি অমায়িক হাসি! নামতেই আস্তাজ্ঞে হোক, বস্তাজ্ঞে হোক ইত্যাদির পর্ব পেরিয়ে বল্লুম, ‘মার্কেট দেখান দাদা’।
তা ঘন্টাদুয়েক ঘুরে দেখলাম এ মার্কেটও বেশ ভালোই। খুচখাচ যা ইস্যু আছে সে সসাগরা জম্বুদ্বীপে সর্বত্র ঘটে থাকে, আমরা বলি ইনফিল্ট্রেশন। মানে অন্য এলাকার স্টক (আমাদেরই) এই এলাকায় ঢোকা। সেসব আটকানোরও উপায় আছে। কিন্তু তাহলে আমাকে আসতে বারণ করছিলো কেন এরা? এমন কি ঘোটালা বা মিসহ্যাপ হয়েছিলো এখানে? হুমম, কেস জটিল লাগতা হ্যায়!
সে যাই হোক, মার্কেট দর্শানান্তে, ভদ্রলোকের সঙ্গে সদুপায়ে অশেষ ভব্যিযুক্ত আলোচনার পর মনে হলো এবার কিছু পারিবারিক আলাপ পরিচয় করে ( যা আমি করেই থাকি) কেটে পড়বো। ফলে আমি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ বাড়িতে কে কে আছেন? ছেলে মেয়ে কয়জন আপনার?’
অপাঙ্গে খেয়াল করলাম, এই প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার ম্যানেজার আর সেলস অফিসার, দুইজনেও যেন শিউড়ে উঠে স্থির হয়ে গেল। কেসটা বোঝার আগেই ডিস্ট্রিবিউটর ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে একটা পান মুখগহ্বরে দিয়ে, একটু জর্দা চিমটি দিয়ে ফেলে বললেন, ‘ আমি আর আমার বউ আছি।’
আমার মশাই অনুসন্ধিৎসা প্রায় পাড়ার খবরচালানি মাসিদের পর্যায়ে পড়ে, মুখে হাসিটা রেখেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলে? মেয়ে?’
নির্বিকার উত্তর এলো, ‘একটা মেয়ে ছিলো স্যার। গত মাসে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেছে।’
আমি প্রস্তরবৎ স্থাণু! মানে? সুইসাইড করেছে ওঁর মেয়ে? আর সেই কথাটা এতো ক্যাজুয়ালি বলছেন? আড়চোখে তাকিয়ে দেখি বাকি দুইজনও ভাবলেশহীন মুখে স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
এইটাই তাহলে সেই মিসহ্যাপ?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, ‘ ক্কি, ক্কি করে? মানে হোয়াই?’
ভদ্রলোক আরেকটু জর্দা মুখে ফেলে বললেন, ‘ কি আর বলবো স্যার, অ্যান্ড্রুজে পড়তো, পলিটিকাল সায়েন্স। পড়াশোনায় ভালো ছিলো স্যার, মাধ্যমিকে এলাকার মধ্যে হায়েস্ট মার্ক পেয়েছিলো।’
চিত্রার্পিতবৎ আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো, ‘তাহলে?’
‘একটা ছেলের সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার্স ছিলো স্যার, সে প্রায় অনেক দিনের। কয়েকদিন আগে জানা যায় যে ছেলেটি ভালো না, দশ জায়গায় বাইক নিয়ে ঘোরে আর মেয়েবাজি করে। আগে একবার বিয়েও করেছিলো, ডিভোর্স হয়ে যায়, সেটা আমার মেয়েকে বলেনি। মেয়েটা আমার খুব সোজা সরল ছিলো স্যার। শুনে খুব মুষড়ে পড়েছিলো। আমরা অনেক বুঝিয়েছি। আমি, ওর মা, ওর কাজিন বোনেরা। বলেছি এরকম তো হতেই পারে। ভাগ্যিস বিয়ের আগে জানা গেলো। নইলে কি কেলেঙ্কারি হতো বলতো?’
‘তারপর?’ নিজের গলা থেকে বেরোনো আওয়াজটাকে নিজেই চিনতে পারছিলাম না।
‘মেয়েটা আমার হেব্বি বোকা ছিলো, বুঝলেন স্যার ‘, সেই একই নৈর্ব্যক্তিক সুরে বলে যেতে লাগলেন ভদ্রলোক, ‘দুদিন কান্নাকাটি করলো, কিছু খেলো না। ব্যাপারটা ওকে হেভি ডিস্টার্ব করেছিলো বুঝলেন। তারপর তিনদিনের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে রয়েছে।’
এরপরে আর কথা চলে না। একহাতে ভদ্রলোককে কাছে টেনে নিলাম, বুকে জড়িয়ে বললাম, ‘সরি টু হিয়ার দ্যাট সাহেব। আগে জানলে আপনাকে বিরক্ত করতাম না। আমিও একজন সাতবছরর কন্যাসন্তানের বাবা। আপনার দুঃখটা কিছু হলেও…’
মূর্খ আমি, গেছি সদ্য সন্তানহারা পিতাকে সান্ত্বনা দিতে। ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন সেই ভরা বাজারের মধ্যে, যেন মুহূর্তের মধ্যে পাথর ফাটিয়ে বেরিয়ে এলো শত ঝর্ণার জল, ‘আপনার তো সাত বছরের মেয়ে স্যার, আমার একুশ বছরের মেয়ে, একটি মাত্র সন্তান। কত কষ্ট করে, কত ভালোবেসে, কত আদর করে মানুষ করেছি ওকে। সামান্য জ্বরজারি হলেও রাত জেগে থেকেছি স্যার, জানেন? আজ অবধি গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, বকাবকি অবধি করিনি। নিজে না খেয়ে মেয়ের জন্যে ভালো কলেজে ভর্তি করেছি স্যার, সবচেয়ে ভালো যা যা পারি তাই এনে দিয়েছি, শুধু ওর জন্যে। গলায় দড়ি দেওয়ার আগে একবার আমাদের কথাটা ভাবলি না মা?’
সমগ্র জগৎ যেন ক্ষণিকের জন্যে আমার সামনে চিত্রার্পিত হয়ে গেলো, আমরা তিনজন মাথা নিচু করে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম, স্থাণুবৎ!
পৃথিবীর তাবৎ রাজকন্যেরা শোনো। দিনকাল রূপকথার সময় থেকে অনেক বদলে গেছে। তোমরা প্রিন্স চার্মিং বা স্বপ্নের রাজপুত্র পেলে পেতেও পারো, নাও পেতে পারো। কিন্তু তোমার জন্যে একজন রাজা ভগবান নিশ্চিতভাবে পাঠিয়েই রেখেছেন। তোমার কিছুমাত্র হলে তিনি সম্পূর্ণ দরিদ্র ও নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তাঁর কাছে আর বেঁচে থাকার কোনও উপায়ই থাকে না।
কিছু ভেবো, কিছু করার আগে একবার তাঁর কথাটা অন্তত কিছু ভেবো!