আগের স্টেশন

আগের স্টেশন

-‘এই নীরন্ধ্র তমসাচ্ছন্ন কালরাত্রি। আমার বোধ ক্রমশঃ আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। এ কোন মৃত্যু উপত্যকা? এ কোন অমানিশা? এ কোন নির্বান্ধব পুরী?’

-‘এই তো কত্তার ঘুম ভেঙেছে দেকচি। ওরে কে কোথায় আছিস, গরম দুধে একটু ব্র্যান্ডি মিশিয়ে নিয়ে আয় দিকিন। আস্তে আস্তে কত্তা, সাবধানে গা টা তুলতে হচ্চে যে। ধকল তো কম গেলনা কদিন।’

-‘তুমি কে হে অর্বাচীন? আর এ কি ধরনের ভাষা প্রয়োগ? এই স্থানের নামই বা কি?’

-‘আমি, হেঁ হেঁ, তেমন কেউকেটা নই কত্তা। আপনাদের মতন পুণ্যাত্মাদের কাচে তো অ্যাক্কেরে তুশ্চু। উদিকে আমারে ফেরেশতা ডাকে, ইদিকে দেবদূত। আপনি যা খুশি ডাকতে পারেন। গ্যালো বেস্পতবার দুক্কুরবেলা, এই আপনারই মতন এক মহাপুরুষ এসেছিলেন, হিন্দু হৃদয়সম্রাট মোহন বাবু, আমাকে তো দেকেই বললেন, আমাকে নাকি ওনার খুড়শাশুড়ির মেজছেলের বুজুম ফ্রেন্ড এর মতন দেকতে। উনি আমাকে তকাই বলে ডাকবেন। তা ধরুন এই হপ্তায় আমার নাম তকাই। নাম হিসেবে খারাপ কিচু নয় তো ‘।

-‘আ আ আ আপনি, আপনি….’

-‘এই দ্যাকো, আবার আপনি আজ্ঞে করে। আরে আপনারা হলেন ধর্মচক্রবর্তী ধর্মকূলতিলক ধর্মাধিকরণ ধর্মবেত্তা। স্বয়ং পরমপ্রভু সকাল থেকে কেবলই ঘরবার কচ্চেন আপনি কখন আসবেন ভেবে। আপনি কি সামান্য লোক কত্তা?’

-‘কিন্তু আপনার ভাষা’….

-‘ক্যানো কত্তা, খারাপ কিচু? হেঁ হেঁ , মিঠে শান্তিপুরি বাংলা, খারাপ লাগার তো কতা নয়’।

-‘কিন্তু এই জায়গাটা কোথায়? আমিই বা এখানে কেন? আমার তো এখন….’

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুয়েচি বুয়েচি। একটু ক্ষমাঘেন্না করে ধইয্যি ধরতে হবে বই কি। এতটা পরিশ্রম করে এয়েচেন। একটু আরাম করে নিন। উফফ কম পরিশ্রম, বোমা বানাও রে, নুকিয়ে নুকিয়ে শরীলের সঙ্গে বেঁধে বাজার বা ইস্কুল কিংবা সেনাঘাঁটিতে নিয়ে যাও রে। কি ঝক্কি বলুন দিকিন। তারপর ধরা পরলে তো পিতৃদেবের নাম বদলে শ্রীমান খগেনচন্দ্র… আমি হলে কিন্তু পারতুম না কত্তা, পষ্ট স্বীকার যাচ্চি।’

-‘হেঁ হেঁ, বলছেন? পরমপ্রভু সন্তুষ্ট হয়েছেন তো? যা করেছি ওনার প্রীত্যার্থে, ওনার নামেই। আমার এই আত্মত্যাগ ওনাকে তুষ্ট করতে পেরেছে তো?’।

-‘তুষ্ট মানে? হাসালেন কত্তা। উনি তো কাল সকালেই বলছিলেন, ”বুঝলি তকাই, পুরুষসিংহ কেউ হয়ে থাকে তো এই। য্যামন তেজ, ত্যামন সাহস। মা বাবা,বউ, শ”দেড়েক স্কুলের বাচ্চা, কিছুই খোকাকে আটকাতে পারে নি। আহা আহা, কতদিন বাদে দেখলুম রে তকাই, সিংহের বিক্রম আর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বুদ্ধি। এ কি সহজ কাজ ভেবেছিস পাগল? একা হাতে শ”দেড়েক বাচ্চা কতল করা কি সহজ কাজ? উল্টে ওইটাই সবচে কঠিন। দয়ামায়া নামের কতগুলো কুফরি সেন্টিমেন্ট ফালতু ফালতু হাত পা টেনে ধরে। তারপর কোমরের বেল্টে বাঁধা বোমা উড়িয়ে, উফফ ভাবলে চোখে জল আসে রে তকাই, এত আনন্দাশ্রু কোথায় রাখি বলতো?’

-‘সত্যি বলছেন? উনি প্রীত হয়েছেন? আমার এই শাহাদত ওনার নজরে পড়েছে? হে প্রভু, হে পরমপিতা, দীনদুনিয়ার মালিক, আমার এই আত্মত্যাগ আপনার শ্রীচরণকমলে অর্পন করলাম’

-‘এই তো কত্তা বেশ চনমনে হয়ে উটেচেন দেখচি। এবার যে গা তুলতে হচ্চে কত্তা। কিচু সামান্য কাজ বাকি আছে যে।’

-‘কাজ? সমস্ত কাজের বন্ধন ছিন্ন করেই তো এসেছি। আমার তো এখন শুধু স্বর্গীয় শরাব খেতে খেতে আয়তচক্ষু চিরকুমারী উদ্ভিন্নযৌবনা বাহাত্তরটি অপ্সরার সঙ্গে লীলাখেলা করার কথা, শেষ বিচারের দিন অবধি।’

-‘অপ্সরা সুনে ভালো কতা মনে পড়লো কত্তা, বলি ও মাসি, একটু ইদিকপানে আসুন তো। এই যে ইনি, হ্যাঁ হ্যাঁ ইনিই, আজ এখানে এয়েচেন। এট্টু সেবাযত্ন…. ‘

-‘মানে? এ কি ধরণের প্রগলভ আচরণ? কে এই স্থূলাঙ্গী বৃদ্ধা? কোথায় সেই নীলনয়না বাহাত্তরটি অনন্তযৌবনা অপ্সরী? অধমের সঙ্গে কেন এই ছলনা, হে মহান ফেরেশতা?’

-‘হেঁ হেঁ, আপাতত এই দিয়েই কাজ চালান কত্তা। দিনকাল কি বলব স্যার, ভালো মেয়ে পাওয়াই মুশকিল। যারা আচে, ইদিক উদিক ওভারটাইম খাটচে আর কি। আর আজকাল, বলতে নেই কত্তা, শত্তুরের মুকে ছাই দিয়ে আপনাদের মতন মহাত্মারা ইদানীং একটু বেসি বেসি আসচেন কি না, খাটতে খাটতে মেয়েগুলোর কাঁচা সোনার বন্ন অ্যাক্কেবারে কালি হয়ে হয়ে উটেচে,সে নিজের চোখে না দেকলে পেত্যয় যাবেন না কত্তা’

-‘আর সেই স্বর্গীয় সুরা?’

-‘সব হবে স্যর। আজকাল এট্টু র‌্যাশনিং চলছে কি না। তবে কিনা একবার স্বর্গে গিয়ে পৌঁছুতে পারলে অবিশ্যি কড়াকড়ি একটু কম..’

-‘মানে? এ কি স্বর্গ নয়?’

-‘হেঁ হেঁ হেঁ, না কত্তা। এ হল গিয়ে স্বর্গের আগের ইষ্টিশন। দুএকটা খুজরো কাজ একটু এখানে মিটিয়ে যেতে হবে। সে অবিশ্যি তেমন কিচু না। আপনাদের মতন মহাপুরুষ দের কাচে অ্যাগদম বাঁয়ে হাতকা খেলা।এসব ফালতো কাজ না রাখলেই চলে। তবে কিনা নিয়ম হল গে নিয়ম, আর আজকাল অডিটের যা ঝামেলা বোঝেনই তো। হেঁ হেঁ’

-‘নিশ্চই মহান ফেরেশতা। বলুন কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে?’

-‘কিচ্চু না। তেমন কিচ্চু না। আমি তো ওনাকে বলি, ”এসব নেহাতই বাহুল্য প্রভু। এঁয়ারা সব একএক জন জগতবিজয়ী বীর, এনাদের এইসব তুচ্ছ পরীক্ষা নিতে,বুইলেন কিনা, আমাদেরও বড় ইয়ে লাগে”। তা এখন প্রভুর যা ইচ্ছে, বুইলেন তো! এই তো পৌঁছে গেচি। ইদিকে এই বড় হলঘরটার পানে একটু আসত হচ্চে যে কত্তা, হ্যাঁ মাতাটা একটু নিচে করুন, একটু দরজাটা বাঁচিয়ে, বাঃ বেশ…..’

-‘এ কোথায় আনলেন আমাকে, অন্ধকারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ওরা কারা? ও ও রা কারা? ওদের ওরকম পাথরের মতন চাউনি কেনো? উঃ, এখানে এত শীত, শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু যেন জমে যাচ্ছে, ওদের দৃষ্টি সহ্য করতে পারছি না, বর্শার মতন এসে বিঁধছে আমাকে, সরাও ওদের, উঃ, আমার লাগছে , ভয় লাগছে খুব.. ওরে কে কোথায় আছিস? এক্ষুনি সরিয়ে নিয়ে যা এদের…’

-‘শ শ শ…আস্তে কত্তা। বেয়াদপি মাপ করবেন, কিন্তুক এখানে আমরা কেউ তেমন চিল্লামিল্লি করি না। আর ওদের কথা জিগ্যেস করচেন? চিনতে পারলেন না? সে কি? ওরা ওই তারা কত্তা, যাদের আপনি ইস্কুলে ঢুকে বন্দুক বোম দিয়ে এক্কেরে সাবাড় করে এয়েচেন,এরা তারাই।’

-‘এ এ এ রা এখানে কেন?’

-‘একটা ছোট্ট পরীক্ষা বাকি রয়ে গ্যাচে যে। এইটা পাস করলেই, বুইলেন কিনা, ডাঁয়ে বাঁয়ে হেব্বি সুন্দরি সুন্দরি অপ্সরা, রাত দিন খাঁটি দিব্য শরাব, আরও কত্ত কি সুবিধা বিনা ট্যাক্সো তে, ইশশ আমার ই তো ইচ্ছে করে কত্তা পরমপিতাকে বলে ওইদিকে একটা ডেপুটেশন বাগিয়ে নি, আর টিএ ডিএও হেবি ভালো। শুধু যাতায়াতটাই একটু মুশকিল, তবে কিনা…. ‘

-‘আহ, বাচালতা রাখুন। কি করতে হবে ঝটপট বলুন। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।’

-‘তেমন কিচুই না কত্তা, এই একশো সত্তরজন আপনাকে জিজ্ঞেস করবে ঠিক কি অপরাধে আপনি এদের ওপর গুলি চালালেন। মানে এরা ঠিক আপনার কি কি ক্ষতি করেছিল। সব্বাইকে ইন ডিটেইলস এক্সপ্লেইন করতে হবে, বুইলেনএইটাই আপনার শেষ পরীক্ষা, তেমন শক্ত কিচু নয়, না? আমি তো আগেই কয়েচিলুম আপনাকে’

-‘মা…মা…মানে?’

-‘মানে আবার কি স্যার? এই ধরুন ওই যে বাঁ দিকে মাঝের সারিতে ছ’বছরের ছেলেটা দাঁড়িয়ে, ওর নাম ইমরান। ওর তিন বছরের চুন্নুমুন্নু বোনটা রোজ রাতে খাবার সময়ে কাঁদে, ভাইয়াকে ছাড়া খাওয়ার অব্যেসটা তেমন রপ্ত হয়নি কি না। একদম পেচুনে এগারো বছরের ছোঁড়াটা? ওর নাম হলো তারিক। বাপ ফৌত হয়েচে বহুদিন, বেধবা মায়ের এক লওতা আর কি, সে মাগি একনো, কি আস্পদ্দা দেকুন, একনো রোজ রাতে ছেলের জন্যে খাবার সাজিয়ে বসে থাকে, সুনলে কার না রাগ হয় বলুন দিকি? আর ডানদিকে মাঝের সারিতে মিষ্টি গোলগাল ছেলেটা? ওর নাম সুলতান। এর কতা সুনলে তো আপনি হেসেই খুন হবেন। এর আবার এক বুড়ি দাদি ছাড়া তিনকূলে কেউ নেই, এর জানাজার ওপর আছাড়িপিছাড়ি করে বুড়ির কান্নাটা যদি দেকতেন কত্তা, হি হি হি, আমারই ত ভসভসিয়ে পেটের ভেতর থেকে হাসি উটে আসচে। সে বুড়ি অবিশ্যি পরে গলায় দড়ি দেয়, কি অন্যায় বলুন দিকিন। তারপর একদম সামনে বছর পাঁচেকের মেয়েটা, নার্গিস। বাপ আবার শখ করে ডাকতো প্রিন্সেস নার্গিস বলে, হুঁ, যত্তসব নেকপুষু, ঢং দেকে বাঁচি নে বাপু, সে মিনসে নাকি রোজ রাত্তিরে ছাতে উটে আকাশে তাকিয়ে এই এক আকাশ তারার মদ্যি মেয়েকে খোঁজে। গা জ্বলে যায় না এই সব আদিখ্যেতা দেকলে অ্যাঁ? নিজেই বলুন?’

-‘আ আ মি পারবো না, পারবো না, কিছুতেই পারবো না। ওদের যেতে বলুন, ওরা এগিয়ে আসছে কেন আমার দিকে। বারণ করুন, ওদের বারণ করুন। এই কে কোথায় আছিস, এদের সরিয়ে নিয়ে যা, আমার দম আটকে আসছে, দূর হ, দূর হ তোরা আ আ আ আ……’

-‘কত্তা, বলি ও কত্তা, মুচ্ছো গেলেন নাকি? সাড়াশব্দ নেই যে।

নাহ, এও দেখছি সেই একই ব্যাপার। ওরে কে কোথায় আছিস, এক্ষুণি দৌড়ে আয়। এই বরাহনন্দকেও হাত পা বেঁধে অনন্ত নরকে নিক্ষেপ কর। জিনা হারাম করে দিলো শয়তানের বাচ্চাগুলো।’

হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে এলেন বিরক্ত পরমপিতা। তারপর এগিয়ে গেলেন স্বর্গদ্বারের দিকে, কাজ শেষ হয়নি তারঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *