মান

মান

সুখবতীর বড় ছেলে বেরজো অর্থাৎ ব্রজ এ সংসারের এক মহাবিস্ময়। বলতে কী, এমনটি এ কলিকালে দেখা যায় না। লোকে বলে, ছেলে তো নয়, রতন। সে তুলনায়, ব্রজবিহারীর পর বনবিহারী, অর্থে বুনো। নামে, কামে, স্বভাবে, ও বুনোই। বিধবা সুখবতীর আর আর ছোট ছেলেমেয়েদের এখনও বিচারের বয়স হয়নি। সুখবতীর আসল নাম বেরজোর মা।

ছিল জাতে মালা, এখন জাত নেই। জাতের কাজ থাকলে তো জাত। তা-সে মালার ডিঙ্গি নৌকোও নেই, নেই জাল ঘুনি আটোল। সে সব ঘুচেছে সুখবতীর শ্বশুরের আমল থেকেই, তারা এখন কারখানার মজুর। ব্রজর বাপ মরেছে কারখানার তেলা মেঝেয় পিছলে গড়িয়ে, মেশিনের তলায় পা কোমর গুঁড়িয়ে।

বড় রাস্তার ধারে আবর্জনা-ভরা পুকুর। তার ধার দিয়ে যে সরু গলিপথটা আরও তিনটে ছায়াঘন অর্ধ কানাগলির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে, সেই পথের ধারে ছিঁটে বেড়া আর খোলার ছাউনির, নসীরামের বস্তি। বার মুখো ঘরের নীচে, স্যাঁতানো সরু পথে যখন ব্রজর মরা বাপকে, সুখবতীর সোয়ামীকে, এনে শোয়ালে, তখন সুখবতী বুক চাপড়ে, চুল ছিঁড়ে কেঁদে চেঁচিয়ে আর বাঁচে না।

ভোরবেলা উঠে ব্রজ মাকে প্রণাম করে যখন বললে, মা তোমার বেরজো রয়েছে, ভাবনা কী, তখন যেন সুখবতীর পাষাণভার অনেকখানি নেমে গেল।

হ্যাঁ, এমনি ব্রজ, জাতে মালা, থাকে বস্তিতে, তবু এক মহাবিস্ময় সে। হিরণ্যকশিপুর ঘরে প্রহ্লাদ, অসুরের ঘরে দেব-সূত। সে ভোরবেলা উঠে ভগবানকে স্মরণ করে মায়ের পাদোদক খায়, গঙ্গায় যায় নাইতে ; ফোঁটা দেয় কপালে গঙ্গামাটির, জল দেয় তুলসীতলায়, দিয়ে আবার মাকে প্রণাম করে। সুখবতী মরমে মরে যায়। ভাবে, এ ছেলের মায়ের যুগ্যি নয় সে। নিজেদের জাত বংশে দূরে থাক, এ যে বামুন কায়েতকেও হার মানায়।

ব্ৰজর নেই নেশা ভাঙ, নেই মুখে দুটো কটু কথা। ছেলে মুখ তুলতে জানে না, হাজার চড়ে সুখবতীর এ ধৰ্ম্মিষ্টি ব্যাটার মুখে রা নেই। বোলতার ঠাস বুনোন চাকের মতো এ বস্তিতে হাজারো ইতরের বাস, হাঁকাহাঁকি, খিস্তিবাজি, নোংরামি, ঝগড়া, যেন গুলজার করা নরক। কিন্তু কেউ কোনওদিন এদের সঙ্গে একটা কথা বলতে দেখেছে ব্রজকে? নাওয়া খাওয়া, শোয়া, এ ছাড়া ব্রজ এ তল্লাটে থাকে না। তার বন্ধুবান্ধব সব ভদ্র-পাড়ায়। বামুন কায়েতের লেখাপড়া-জানা অবস্থাপন্নদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব।

বস্তির সবাই সসম্মানে ব্ৰজর কাছ থেকে দূরে থাকে, হিংসে করে সুখবতীর পুত-ভাগ্যিকে। মায়েরা বলে ছেলেদের, ব্ৰজর পাদোদক খেয়ে তোরা মানুষ হ।

পাওয়ার হাউসের সি, এ, পার্সেনের কন্ট্রাক্টরের আন্ডারে কাজ করে ব্রজ। বাঙালি ফোরম্যান সাহেবও বড় ভালবাসেন ব্রজকে। খালাসি তার ডেজিগনেশান, কিন্তু কাজের বেলায়, ফাইল খাতা বাছগোছ করা মেশিনের নম্বর টোকা। একটু আধটু লিখতে পড়তেও জানে সে। তার অমায়িক ভদ্রতায় ফোরম্যান খুশি, প্রতিদানে মর্যাদাও দিয়েছেন, আশাও দিয়েছেন ভবিষ্যতে তাকে বাবু করে দেওয়ার, মানে কেরানি।

পার্সেনের ব্রজর সব খালাসি মজুররা এতে অস্বাভাবিক কিছু দেখে না। সত্যি, ব্রজ তাদের তুলনায় বড়ই। সে ভদ্রলোক। ফলে তাদের সঙ্গে পোট খায় না।

ব্রজ অজাতশত্রু। এক কথায়, দেশে এমন গুণে ছেলে আর হয় না।

সুখবতী নাম সার্থক এ-সৌভাগ্যে। আবার দুর্ভাগ্যজনিত অশান্তিরও অন্ত ছিল না তার ছোট ছেলে বুনোকে নিয়ে!

বুনো তার শক্ত রুক্ষ মস্ত শরীরটা নিয়ে দুম্ দাম্ করে আসে গুপগাপ করে খায়, ঘরে বাইরে গলাবাজি করে ঝগড়া করে, মারামারি করে, গলা ফাটিয়ে হাসে, গান করে, মুখ খারাপ করে। তার কোনও কিছুতেই ঢাকাটাকিও নেই, চাপাচাপিও নেই। উদ্ধত অবিনয়ী। মা-ডাকে তার মধু ঝরে না, যেন মাকে খেঁকিয়ে ওঠে। তেলচিটে এক মাথা চুল নিয়ে, মুখে বিড়ি নিয়ে সে কারখানায় যায়, তারপর এখানে সেখানে ঘোরা ফেরা। বস্তির সকলের সঙ্গে তার এ-বেলা ঝগড়া, ও-বেলা ভাব। মর্জিমতো ছোট ভাই-বোনদের কখনও ঠ্যাঙাচ্ছে, আবার কখনও আদরের ঠেলায় অন্ধকার। সুখবতীর সুখ নেই, সারাদিন বুনো রে বুনো রে করে তার পিছে পিছে ফিরছে, কখন কী অনাছিষ্টি বাধিয়ে বসে সেই ভয়ে। হারামজাদা যে যমেরও অরুচি!

কপালগুণে দোষ পায়। একই পেটে তার দেবাসুর ঠাঁই পেল কেমন করে! সুখবতীর চেঁচামেচির, গালাগালির অন্ত নেই বুনোকে ঘিরে।

বুনোর বন্ধুরাও সব ডাকাবুকো। তাদের আচার বিচার নেই। কেউ কেউ নেশাভাঙে সিদ্ধহস্ত। ভদ্রপাড়ায় মান দূরে থাক, আনাগোনাও নেই।

সেও খালাসির কাজ করে পার্সেনে। ব্ৰজর মতো তার খাতির নেই। কি গ্রীষ্মের পোড়া দুপুরে আর কি শীতের ভোরের তুহিন ঠাণ্ডায় সে টুকটাক করে বেয়ে ওঠে ইমারতের লোহার ফ্রেমের উপর। ছ ইঞ্চি রেলিংএর উপর সমস্ত শরীরের ভার দিয়ে পাঁচ পাউন্ড ওজনের রেঞ্জ দিয়ে স্ক্রু আঁটে আর হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে গান গায় :

দেখে তোমার চাঁদ মুখ
পরাণে ধরে না সুখ।

নীচে থেকে ব্রজ অবাক মানে। এই অবস্থায় সে গান গায় কী করে। আবার মানও যায়। এ-সব যে অসভ্যের অনাচার।

ব্রজ বাবু হবে। বুনোর কাছে সেটাও বিস্ময়। বলে আমার পেটে বোমা মারলেও নম্বর টোকা ফোকা হবে না বাবা। আমি হব ফিটার।

ব্ৰজর পাদোদক খাওয়ার কাহিনী এ-অঞ্চলে বিখ্যাত। বুনোকে কেউ যদি বলে, তুইও কেন খাসনে, বুনো খিলখিল করে হেসে বলে, আমার মাইরি লজ্জা করে। বলে, শালা সং-এর ঢঙ।

মাসের শেষে ব্রজ মাইনে পেয়ে সব মায়ের হাতে তুলে দিয়ে পরে হাত পেতে চেয়ে নেয়, মা দুটো টাকা দেবে গো? বুনোর ও-সব নেই। সে টাকা দুটি পকেটে রেখে বাকিটা মায়ের হাতে ফেলে দেয়। দিয়ে বলে, কিপটেমি কোরো না। আজ এট্টুস মাছ খাইয়ো।

সে খালি সইতে পারে না ব্ৰজর তুলনা। কিন্তু তার মা পড়ে পড়ে সারা দিন তার পেছনে খালি থোক কাটবে, ব্রজ এই, ব্ৰজ সেই, আর তুই হারামজাদা

ব্যস, আর বলতে হবে না। আরম্ভ হয়ে যাবে বুনোর বুনো ঝগড়া আর গালাগাল। আর ঝগড়ায় তো সুখবতীও কম নয়। সোয়ামী বেঁচে থাকতে রোজ ঝগড়া ছিল, এখন সেটা বুনোর সঙ্গে। এ ড্যাকরা যে বাপের মতো কুচাল পেয়েছে।

আর সইতে পারে না বুনো ব্ৰজর শাসন। ব্রজ যদি বলে, বুনো এটা করিসনে, বুনো সটান জবাব দেবে, তোর নিজের চরকায় তেল দিগে যা।

এই সেদিন এক কাণ্ড ঘটল। পার্সেনের কন্ট্রাক্টরি কাজ মানেই হল পাওয়ার হাউসের মতো ও-সব রাক্ষুসে কারখানা তৈরি করা। আর যত ওচা কাজ হল খালাসিদের। সেদিন একটা খালাসি কী কথায় ফোরম্যানকে বলেছে, শরীরটা তার খারাপ, আজ সে উপরে উঠতে পারবে না।

অমনি ফোরম্যান খিঁচিয়ে উঠল, হারামজাদা, পারবিনে তো চাকরি ছেড়ে দে।

সামনে ছিল বুনো। সে হেঁড়ে গলায় গাঁক করে উঠল, গালাগাল দিচ্ছেন কেন মশাই?

ফোরম্যান তো থ। ছোঁড়া বলে কী? মুখের পরে কথা? সে-খালাসিটাকে উপরে উঠতে হল না বটে, কিন্তু বুনোর চাকরি যায় যায়।

ব্রজ এসে ভাইকে বুঝিয়ে বললে, দ্যাখ ভাই, ওদের মুখে সব মানায়, তোর মুখে নয়। মাপ চেয়ে নে।

বুনো এককথায় বললে, দ্যাখ বেরজা, আর একটা কথা বলবি, ঠেঙ্গিয়ে তোর খপড়ি ওড়াব।

সে-যাত্ৰা ব্ৰজর ভাই বলেই বোধ হয় বুনোর চাকরিটা গেল না। কাটা গেল সাতদিনের রোজ আর জন্মের মত সুখবতীর মুখে রপ্ত হয়ে গেল তার প্রতি এ খোঁটা। তাও খেতে শুতে-বসতে।

ভোর হয় হয়। আকাশে ফুটেছে নীলের আভাস। তা বলে নসীরামের বস্তিতে অন্ধকার ঘোচে না। আর ঘরের ভিতরে তো অমাবস্যা। দুপুরবেলা কয়েক ঘণ্টা একটু আলো। তারপরেই আবার যে কে-সেই।

ব্ৰজই সকলের আগে জাগে। ডাকে, মা মাগো।

গলা যেন মধুভরা। আর কী মিষ্টি ডাক। সে-ডাকে সুখবতী জাগে। ব্রজ ঘটির জলে মায়ের পা ছুঁইয়ে খায়, তারপরে চলে যায় গঙ্গায়।

আগে আগে সুখবতীর লজ্জা ও ভয় করত এমনি করে জলে পা ছুঁইয়ে দিতে। এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। মনে পড়ে যায় শ্বশুরের কথা। ব্ৰজর ঠাকুদা। ব্ৰজ তার প্রথম নাতি, আদরেরও বটে। সে-ই ব্রজকে হাত ধরে ধরে নিয়ে গিয়েছে সাধু সন্তদের আড্ডায়, বাবু ভদ্রলোকদের সৎ মজলিসে, কথকঠাকুরের সভায়। সেই থেকেই আস্তে আস্তে দেখা দিল ব্ৰজর এমনি মতিগতি। ভয়ও হয় সুখবতীর, ছেলে না তার আবার বিবাগী হয়।

না, ভাবলে চলে না। সে ডাক দেয় বুনোকে। এক ডাকে তো এ অনামুখো একদিনও জাগবে না। যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম। অনেক ডেকে ডেকে যখন সুখবতী খেঁকিয়ে উঠল, ওরে হারামজাদা লবাবপুত্তুর, তোর কোন কেনা বাঁদি আছে রে ডেকে দেওয়ার?

অমনি লাফ দিয়ে উঠল বুনো। যেন এই কথাগুলো না হলে তার ঘুমন্ত মরমে পশে না। উঠল হাসিখুশি মুখ নিয়ে। কীসের যে এত খুশি তা সে-ই জানে। হয়তো নিদ্রাটি বেশ জমাটি হয়েছে।

ও মা! তারপরে কথা নেই বার্তা নেই, পা ছড়িয়ে বসে সে গান ধরল :

আমার সুখ হল না দুখে মরি,
ওগো, তোমার ঘর করে।

উনুন ধরাতে গিয়ে সুখবতীর পিত্তি জ্বলে যায়, পিত্তি জ্বলে যায় আশেপাশের ঘরের লোকের, এ-ঘরে ছোট ছোট ভাইবোনগুলোর ঘুম ভেঙে যায়।

সুখবতী চেঁচিয়ে ওঠে, হারামজাদা, তোর গানের নিকুচি করেছে। সকালবেলা—

 তাতে বুনোর আবেগ বাগ মানে না, হাত জোড় করে গায় :

সখী, তুমি আগ করো না।

সুখবতী রাগে ঘৃণায় অন্ধ হয়ে চিৎকার করে ওঠে, শুয়োর, আমি তোর সখী হলুম? বুনো তাড়াতাড়ি নিজের মুখে চাঁটি মেরে বলে, থুড়ি থুড়ি, তুমি আমার মা। আবার,

মা গো, তুমি আগ করো না।

 ততক্ষণে সুখবতী একটানা বলে চলেছে, তুই মর মর মর—

বুনো বলে সুর করে,

যম যে তোমার চোখ-খেগো গা—

পরমুহূর্তেই তেলের বাটিতে কোনওরকমে আঙ্গুলটা ছুঁইয়ে, সেটুকুন মাথায় ঠেকিয়ে চলে যায় পুকুরের দিকে। কিন্তু রাস্তা দিয়ে যায় না। যায় বস্তির পেছন দিকের ঘাটে ; যায় না, তাকে টানে ওই ঘাটে।

পুকুরের ধারে, যেখানে বস্তির পেছনটা বেঁকে পড়েছে সেখানে একটা ঘরে থাকে মাদ্রাজি খ্রিস্টান পরিবার। মা বাপ আর বড় মেয়ে কারখানায় কাজ করে। মেজ মেয়েটা সাহেব বাড়ির ঝি। সেই মেয়েটা, কালো বটে, তবু ভারী সুন্দর। আর কাজ কর্ম করে বটে, কিন্তু সব সময়ই থাকে বেশ পরিষ্কার ধপধপে হয়ে। মেয়েটা বুনোর দিকে ঠেরে ঠেরে তাকিয়ে না-হক কেবলি টিপে টিপে হাসে! বুনো প্রথমে চটত, ভাবত বুঝি অবজ্ঞা করে বিবিগিরি দেখাচ্ছে তাকে।

কিন্তু এখন, বুনো মনে মনে বলে এ আবার শালার কী ফ্যাসাদ, তবু ওই না-হক হাসি না দেখতে পেলে তার প্রাণ মানে না! আর মেয়েটাও ভোলে না ওই এঁদো পুকুরের পাড়ে হাজিরা দিতে।

বুনোর পক্ষে হৃদয়ের এ আবেগ চাপা মুশকিল। কিন্তু ব্ৰজর কাছে এ ব্যাপার অকল্পিত। একে তো সে এ-যুগের বিত্তহীন, তার আশাটা হল এ-সমাজের মধ্যজীবীর ভদ্র জীবনযাত্রা ও ধর্মের একনিষ্ঠতা। তার চারপাশে ভয় ও সংশয়ের প্রাচীর খাড়া, প্রতিটি পদক্ষেপ নিঃশব্দ নম্র সন্ত্রস্ত।

.

ব্রজ এল চান করে। তাদের উঠোন নেই, আছে রান্না করবার এক ফালি বারান্দা। সেখানেই ব্রজ রেখেছে তুলসীগাছের টব। সে এসে জল দিল তুলসীতলায়। প্রণাম করল মাকে। তারপর চা খেতে খেতে বলল, হ্যাঁ মা, তুমি নাকি ঘোষ কর্তাদের দোকানে গে ঝগড়া করে এসেছ?

সুখবতী কথাটা বোধ হয় চাপতে চেয়েছিল। বলল, তা করেছি বাবা। করব না? ছ পসার তেল, তাও ওজনে মারবে?

মারুক, ওদের ধম্মো ওদের কাছে।

কথাটা সুখবতীর মনঃপূত নয়। তবু ব্রজ যখন বলছে! বলল, কিন্তু গাল দিলে যে?

 দিক, তাতে কী।

নির্বিরোধ ব্রজ, নির্বিকার তার গলা। তার জীবনের কোথাও প্রতিবাদ নেই, আছে মানিয়ে চলা। সুখবতী চুপ করে থাকে।

বুনো নেয়ে আসতেই ব্ৰজ বলল, হ্যাঁ রে বুনো, কাল তুই মিত্তির ডাক্তারের সঙ্গে ঝগড়া করেছি।

বুনো বলল গা মুছতে মুছতে হুঁ, ঝগড়া আবার কী! পরের পেছনে কাটি দেওয়া কেন?

কেন, তোকে কী বলেছে?

বুনো বলল, কী আবার। কাল সন্ধেয় কারখানা থেকে আসছি, বাড়ির সামনে চার মন কয়লা দেখিয়ে বললে, হেই বুনো কয়লাগুলো এট্টুস বাড়িতে তুলে দে তো। যেন আমি ওর বাপের চাকর। বললুম, নিজেরা তুলে লাও না মশাই। তো ডাক্তার বললে আমাকে, তোর তো হারামজাদা খুব তেল হয়েছে। হাঁকতুম এক ঘুষি। খালি বলে দিলুম, আবার যদি হারামজাদা বলো, তোমার ওই মুখ থুবড়ে দোব।

কথাটা শুনে যেন আঁতকে উঠল ব্রজ। বুঝি সুখবতীও। ব্রজ বলল, তা কয়লাটা তুলে দিলেই হত। আমাদের বাপ দাদা ও-রকম কত দিয়েছে।

দিয়েছে তো দিয়েছে। ও-সব ভদ্দর পিরিত তুই করগে যা।

ব্রজ তবু বললে, তোর মাপ চাওয়া উচিত।

তোর কথায়। ভেংচে উঠল বুনো। দ্যাখ বেরজা, মন্তর দিসনে। তোর কাজ তুই কর।

মন্তর মানে উপদেশ। ব্রজ তাকে ছেড়ে মাকে ধরল, ডাক্তার বাবু কত কথা বললেন। তা সে একটা মিলের ডাক্তার। আজকেই ফোরম্যানকে বলে তোর চাকরি খেয়ে দিতে পারে। গরিবের ছেলেকে কত সইতে হয়।

এ-সব কথায় বুনোর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। সে চেঁচিয়ে উঠল, গরিব বলে কি মান নেই? এতে যদি চাকরি যায় তো যাক। তবে তোর ফোরম্যানকেও দেখে লোব। আর তুই যদি ফের আমাকে তাতাবি—

এবার হামলে পড়ে সুখবতী। চাকরি যাওয়ার কথাটা শুনে ভয়টাই তার রাগের চেহারায় দেখা দিল, বলল, তাতে তোর কী আছে রে ড্যাকরা। তোর জ্বালায় কি আমাদের মরতে হবে? চাইবি, ক্ষ্যামা চাইবি পায়ে পড়ে।

উভয় পক্ষ থেকেই নিরাশ হয়ে বুনো তার মেজাজের শেষ সীমায় পৌঁছুল। চিৎকার করে উঠল, তোমাদের দায় থাকে তো তোমরা চাও গে…আর রইল শালার সংসার আর চাকরি আর ভদ্দরের কুটুম্বিতে।

বলে সে দুম দুম করে ঘরে ঢুকে জামাকাপড় পরে হন্ হন্ করে বেরিয়ে গেল। না খেল রুটি, না চা।

ব্রজ কারখানায় এসে দেখল, বুনো সত্তর ফিট উঁচুতে নতুন চিমনির গায়ে বলটু ঠুকছে।

এই নিয়েই বারোমাস অশান্তি। ব্রজ রোজ এসে বলে, আজ ফোরম্যান এই বলে, কাল কারখানায় এই হয়েছে, বাইরে সেই হয়েছে। আর সুখবতী রাতদিন বুনোকে খিঁচোয়।

বুনো মাথা নোয়ায় না। সে যেন তাদের খালাসিদের শক্তিতে তোলা ওই একশো ফিট উঁচু চিমনিটার মতো সটান ও উদ্ধত। মেঘ ঝড় বৃষ্টিতে সে অবিচল। বলে, খাটব–খাব ; যেমন আয়নাটি দেখাবে, তেমনি মুখটি দেখবে ; কাজ শিখেছি ফিটারের, তুমি বলবে মাইনে বাড়াব না, ফিটারের কাজ কর। কেন? সে হবে না।

সে হবে না ঠিক, কিন্তু মনের কোথায় যেন খচ্‌ করে ওঠে। ভাবে, ফোরম্যান শোধ তুলতে পারে। তবু ভাবে, ও যদি শোধ তোলে, আমরা প্রতিশোধ নিতে পারব না?

ব্ৰজর উন্নতি হয় কাজে। সে সত্যি কেরানির কাজ পায়। তার মান বাড়ে। বাড়ে সুখবতীরও। সে যে বাবু ছেলের মা। এতে বোধ করি বুনোরও একটু গোপন গৌরব-বোধ ছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে সে-বোধের অধিকার নেই। নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে আপসহীনতা যেন তার কলঙ্ক। ব্রজ যে তার গৌরবের ভাগ তাকে দিতে রাজি নয়।

এরপর থেকে বুনোকে নিয়ে অশান্তি আরও বাড়ে, ব্ৰজর দাবি তার চেয়েও বেশি। পাড়া বয়ে লোক শোনাতে আসে ব্রজের কথা। সেই সঙ্গে বুনোর কথাটা বলতে কেউ ভোলে না।

একদিন সেই মাদ্রাজি খ্রিস্টান মেয়েটি ভাঙা বাংলায় বললে, তুমি বড় গোঁয়ার।

বুনো অমনি হাসি ভুলে মাথা সটান করে দাঁড়াল। এ-মিথ্যে অপবাদ সে মানতে রাজি নয়। বললে, আ মলো, গোঁয়ার কোথা দেখলে?

মেয়েটি বোধ হয় তার প্রেমের অধিকারেই বলল, সবাই বলে। তোমার দাদা কেমন ভদ্র, কারুর সঙ্গে–ব্যস, আর বলতে হল না। বলে দিল, তা হলে দাদার সঙ্গে পিরিত করলেই পারো।

বলে গামছাটা কোমরে কষে বাঁধতে বাঁধতে সে আপন মনেই বলতে লাগল, রইল শালার পিরিত, নিকুচি করেছে তোর ভালর। এ মেয়ের জন্য শালা আমি রোজ এঁদো পুকুরে ডুবতে আসি।

সে হন হন করে চলে গেল বড় রাস্তার মিউনিসিপ্যালিটির জলকলের দিকে।

মেয়েটা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল। তার দক্ষিণী টানা চোখে বড় বড় ফোঁটায় জমে উঠল প্রেমের প্রথম অশ্রু।

সারাদিন বুনোর মনটা দমে রইল কারখানায়। বুকের ভিতরটা কেন যে এরকম করছে, সে বুঝল না। ভেবে পেল না, এ-সংসারে কী ব্যতিক্রমটা সে করেছে।

বিকেলে ব্রজর পিছন পিছন বাড়ি এল।

বাড়ি আসতে না আসতেই মিত্তির ডাক্তার প্রায় আধন্যাংটো হয়ে কোমরে কাপড় গুঁজতে গুঁজতে রুদ্রমূর্তিতে ছুটে এল।

ব্যাপার হয়েছে, তার বাড়ির সামনেই মুখুজ্জেদের দুই পুরুষ আগের একটা ভাঙা ভিটা পড়ে আছে। কিছুই নেই, আছে শুধু ইট বের করা গোটা দুই ঘরের দেয়াল, তাতে ইঁদুর আর সাপের বাস। সেটা মিত্তির কিনেছে। সুখবতীর অপরাধ, সেই দেয়ালে সে ঘুঁটে দিয়েছে, দেয়-ও রোজ। বোধ করি দু একদিন বারণও করেছে। কিন্তু সুখবতী জানে, পড়ো দেয়াল, সে না দিলেও অন্য কেউ দেবেই।

কিন্তু মিত্তির একবারে উগ্র মূর্তিতে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল, কোথায় সে হারামজাদা ছোটলোক মাগি, তাকে একবার দেখি।

ভীত সন্ত্রস্ত ব্রজ একেবারে মিত্তিরের পায়ে গিয়ে পড়ল, কী হয়েছে কাকাবাবু, আমাকে বলুন।

বুনো চমকে বন্য বরাহের মতো কাত হয়ে মিত্তিরের দিকে তাকাল। সুখবতী ভয়ে বিস্ময়ে নির্বাক।

মিত্তির কোনও রকমে তার বক্তব্য বলে আবার চেঁচিয়ে উঠল, এত বড় সাহস ছেনাল মাগির, আমি বারণ করেছি তবু

এই অভাবনীয় ব্যাপারে ব্রজ অসহায়ের মতো বলে উঠল, এবারটা ছেড়ে দেন, ক্ষমা করেন। মা আমার বুঝতে পারেনি।

সুখবতী শুধু বলল, ভাঙা পড়ো দেয়াল বাবু, তাই

 মিত্তির রুখে উঠল, হাজার ভাঙা হোক, তোর কী? কথায় বলে, ছোটলোক কখনও

বুনো আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলে ফেললে, ওই ভদ্দর গালাগালগুলোন আর দেবেন না মশাই।

ব্রজ বলে উঠল, বুনো, চুপ!

কিন্তু মিত্তিরের রাগ চড়ল। সে চেঁচাতে লাগল, কেন দেব না। যার যেমন, তার তেমন। ছেনালকে ছেনালই বলব।

ব্রজ দুই হাত জোড় করে বলল, আর নয়, কাকাবাবু, আমি মাপ চাইছি এদের হয়ে, আমি মাপ চাইছি।

মিত্তিরের এত রাগের অন্তঃস্রোত ধরা মুশকিল ছিল। সে বুনোর দিকে একবার দেখে যেন জেদ করে ব্রজকেই বলল, আমি বলছি, তোর মা–ছেনাল।

ব্রজ আবার হাত জোড় করার উদ্যোগ করতেই সবাই দেখল, বুনো চকিতে ছুটে এসে ব্ৰজের হাত দুটো মুচড়ে ধরে একেবারে তার পায়ের কাছে আছড়ে ফেলল। হিসিয়ে উঠল সে, তুই হতে পারিস ছেনালের ছেলে, বুনো নয়, বুঝলি।

তারপর চোখের পলক না পড়তে সবাই দেখল, মিত্তিরের সামনের দাঁত দুটো নেই, আর মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে তার রক্ত পড়ছে। মৃত্যু-চিৎকার জুড়েছে সে। তার সামনে ক্ষিপ্ত নির্বাক যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে বুনো।

তারপর সে এক কাণ্ড। সুখবতীর চিৎকার, বস্তির হট্টগোল ও হাহুতাশ, এক এলাহি ব্যাপার।

ঘণ্টাখানিক পরে, ভাঙা আসর থেকে বুনোকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। মামলা পরে, এখন হাজতবাস তো হোক। সুখবতী যদি পারে, জামিনের যেন চেষ্টা করে।

সুখবতী উঠল। বুঝল, বুনোকে ছাড়াতে অক্ষমতা তার কতখানি। তবু ভাঙা গলায় খালি বলল, কতদিন, তোকে কতদিন বলেছি।

বুনো একবার ফিরল। ব্যাপারটা যেন এখনও তার কাছে পুরো বোধগম্য হয়নি। কেবল বুকের ভিতরটা কেমন করতে লাগল মায়ের দিকে ফিরে। কথা বলল না, কেবলি বুকটার মধ্যে কী হতে লাগল, তবু অনুশোচনার কোনও কারণ নিজের মনে সে খুঁজে পেল না।

কেবল সেই মাদ্রাজি মেয়েটি ভাবল, আমিই ওর মনটা আজ ভেঙে দিয়েছি, তাই। দক্ষিণের সমুদ্রের অথৈ জোয়ার ওর চোখে।

.

ভোর হবো-হবো। আকাশে আলো দেখা দেবে-দেবে করছে। রাস্তায় আলো নিভে গিয়েছে। নসীরামের বস্তি জাগছে।

ব্রজ জেগেছে। ডান হাতটা তার সত্যি ভেঙে গিয়েছে। সে মাকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল। দেখল, মা জেগেই আছে। জেগে বসে আছে। একলা চুপচাপ।

ব্রজ রোজকার মতো জলের ঘটি নিয়ে এল। পা ছোঁয়াতে গেল মায়ের।

হঠাৎ সুখবতী ঘটিটা নিয়ে মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ছেনালের পা ধোয়া জল খাবি, তোর মান যাবে না? তোর লজ্জা করে না? আমি যে ছেনাল।

ব্রজ অবাক। আশ্চর্য, তার মাও সত্যি ছোটলোক, সেই মালা-ঘরনি বস্তিবাসিনী সুখবতী।

সুখবতী তার রাতজাগা চোখ দুটোতে জল দিয়ে বাইরে এল। গলির মোড়ের দিকে মুখ করে খালি বলল, এ সংসারের ধারা বুঝিসনে,… তোকে কতদিন বলেছি, কতদিন…।

ব্রজ অপ্রতিভ নেংটি ইঁদুরটার মতো অন্ধকার ঘরের মধ্যে চোখ পিটপিট করতে লাগল।

কেবল সেই মেয়েটি এঁদো পুকুরের ধারে গিয়ে নির্জন বড় রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরেই ওই খালি রাস্তাটাতে কারখানাগামী লোকের আনাগোনা শুরু হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *