একটু নীল আকাশের খোঁজে

একটু নীল আকাশের খোঁজে

আমাদের এই কল-মিল-গঞ্জ-স্টেশনওয়ালা ঘিঞ্জি ছোট শহরের আকাশটাও এত নীল হয়ে ওঠে মধ্যম ঋতুতে, নানান আকারের সাদা মেঘগুলি নরম গা এলিয়ে এলিয়ে ঘুরে বেড়ায় তার অথৈ বুকে, বর্ষার সদ্যস্নাত গাছপালাগুলি সবুজ সমারোহে এত মেতে ওঠে, চিলগুলি চিৎকার করে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে এমন ডাকে আকাশ থেকে যে আমাদেরও মনটা ছুটি-ছুটি করে ওঠে।

নানান ভাগে বিভক্ত, কাজ আর কাজঠাসা সময়ের মধ্যে থাবা বাড়িয়ে মুঠোখানেক সময় অপহরণের লোভ কিছুতেই সামলানো যায় না। জানি, আপনি অফিসে বসে বড় সাহেবের সুইং-ডোরটার দিকে একবার তাকাবেন আমার কথা শুনে। তারপর ঠোঁট কুঁচকে একটু হাসবেন। কিংবা যিনি কারখানায় মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন, দোকানের হিসেব লিখছেন, তাঁরাও আমার এই মুঠো বাড়িয়ে সময় অপহরণের এ রকম কাব্যিক চৌর্যবৃত্তিকে চার্জশিট এবং ওয়ারনিং, এমনকী ডিসচার্জের বাইনাকুলার দিয়ে কাছাকাছি দেখে, চোখ বড় বড় করে তাকাবেন আমার দিকে। তারপরে জিজ্ঞাসা করবেন, আমি এখনও আমার বাপের ভাতে আছি কি না।

নেই। বিশ্বাস করতে পারেন।

কাজ? তাও করতে হয়। অনেকখানি করতে হয়। আর এমনি একটা কাজ, যেখানে ফাঁকি দিলে কোম্পানি ফাঁকি পড়বে না—সব ফাঁকিটা পড়বে এসে সরাসরি নিজের ঘাড়ে। সেখানে জমার অঙ্কে শূন্য নিয়ে যদিও বা নিজে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতুম, কিন্তু কাজটা যেহেতু একেবারে সোজাসুজি দশজনের পাতে গিয়ে পড়ছে, সেই হেতু তৎক্ষণাৎ লোক-জিহ্বা আমাকে সমালোচনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।

কী রকম?

ধরুন, এই-রকম?

ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি
পরখ করে সবে, করে না স্নেহ।

যখন ফুল তুলি আর মালা গাঁথি, তখন মনের মতোটি করেই গাঁথি, চেষ্টা করি। কিন্তু সময়টা উনিশশো আটান্ন সাল। জমার অঙ্ক শুন্য রেখে সত্যিই তো আর নিশ্চিন্তে মালা গাঁথা যায় না। তাই, সে-মালা নিয়ে আপনাদের দোরে আসতেই হয়।

আর আপনিও জানেন, দেখেশুনে না কিনলে ফাঁকিতে পড়তে হবে। আপনি নানান ভাবে পরীক্ষা করেন।

এ যুগে মালা সাজি ভরে রাজসভায় কিংবা অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দিলেই কদর হয় না। ওই রাজসভা আর অন্তঃপুর এখন রাজপথে আর জনপদে ঠাঁই নিয়েছে। তাই–

যাক গে, এত কথা বলার প্রয়োজন কী? বলতে চাইছিলুম কাজের কথা। কাজ করি আর তাতে ফাঁকি দিলে মোটেও চলে না। কারণ, কোম্পানি নয়, মালা এখানে মালাকারের নামে বিকোয়। অতএব সাবধান!

তবু সময় চুরির লোভ সামলাতে পারিনে।

 ক্ষতি এসে চোখ রাঙায়, কাজ এসে উপদেশ দেয়।

কিন্তু চৌর্যবৃত্তিটা এমন একটি জিনিস যে, বিবেকের শাসনটা আপাতত মানতে রাজি নয়।

কেন? সেইজন্যই বলছিলুম, আমাদের এই ছন্নছাড়া ঘিঞ্জি ছোট শহরটার আকাশটার দিকে একবার চেয়ে দেখুন। সে তার চিমনি আর পুরনো গাছের ডালপালায় যেভাবে আকাশটাকে ধরে আছে, সেই আকাশ যেখানে মুক্ত অবাধ হয়ে ছড়িয়ে আছে দূর চক্ৰবালে, সেখানে যেতে আপনার মন করে কি না, নিজেই একবার পরখ করুন।

না, আমি মোটেই হিল্লি-দিল্লি যাবার কথা চিন্তা করিনি। নিতান্তই, এই শহর থেকে মাইল দশেকের মধ্যেই, কোনও একটা নির্জন স্টেশনে গিয়ে নেমে পড়া। তারপরে, আকাশটাকে দেখা।

পারবেন না আসতে? তা হলে আমাকে একা-একাই কাজে ফাঁকি দিতে হয়। দিলুমও। আর মাত্র তিনটে স্টেশন পরেই নেমে পড়লুম।

যা ভেবেছিলুম, তাই। আকাশটাকে কেউ বাঁধতে পারেনি। শরতের মাঠ দিগন্ত ছাড়িয়ে গিয়েছে। আর এই ঘোর দুপুরে, জনহীন স্টেশনটার পাশের বনেই পাখিটা ডাকছে, খোকা কোথা! খোকা কোথা!

মায়ের এই চিরদিনের কান্না শুনতে গেলে, আমার আর মাঠ আর আকাশ দেখা হবে না। তাই পা বাড়ালুম।

কোথায়ই বা পা বাড়াব? ওই তো আবার কোন পাখিটা ডেকে উঠছে পুবের মাঠ থেকে। কেহে? কেহে? কেহে?

জবাব দেবার কোনও দরকারই নেই জানি। আমাকে নমস্কার করে হেসে বলতেও হবে না, আজ্ঞে, আমি অমুক, অমুক জায়গা থেকে এসেছি।

শুধু এই অবাধ মুক্ত আকাশের তলে, চারপাশে সবুজ সমারোহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই সব নানান কিচিরমিচির আমাকে শুনতেই হবে। নইলে আকাশটাও এতখানি দেখা যেত না, মাঠও এত অবারিত হতে পারত না।

.

টিকেট নেবার লোক নেই। প্ল্যাটফরম্ শেষ হয়ে গেল। খানিকটা এগোলেই বাঁ দিকে অনেকগুলি চালাঘর। রেললাইনটা সোজা চলে গিয়েছে উত্তরে টেলিগ্রাফের তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

চালাঘরগুলির দিকেই পা টানতে লাগল। এই চকচকে অবাধ নীল আকাশটার সঙ্গে নিঝুম চালাঘরগুলির কী একটা সম্পর্ক যেন আছে।

বড় বড় গাছ এখানে সেখানে, তারই নীচে চালাঘরগুলি সারি সারি। ঝাঁপ নেই। বেড়াও নেই। চারদিকেই খোলা। অতএব এগুলিকে ঘর বলা যাবে কি না বুঝতে পারছি নে। মাটি এখনও রীতিমতো এবড়োখেবড়ো। মানুষ, গোরু আর গোরুর গাড়ির চাকার গভীর দাগ চালাগুলির পাশে। বর্ষার সময়, হাটের দিনে যারা এসেছিল, এ-সব তাদেরই চিহ্ন।

বোঝা গেল এটা বাজার।

খাবারের দোকানে লোক নেই। দোকানদার ঘুমোচ্ছে। কাচ-লাগানো একটা খাবারের কেস যদিও আছে, তার কাচ গেছে ভেঙে। কাঠগুলিতে ন্যাতা বুলিয়ে বুলিয়ে ন্যাতারই রং হয়ে গেছে। খাবারও বিশেষ নেই, বোঝাই যায়। মাছিগুলি খালি পাত্রের রসেই যা একটু ভ্যানভ্যানাচ্ছে।

শুধু তেলেভাজার কড়াটাই উনুনের উপর চুপড়িটাকা। সকালবেলা নিশ্চয়ই তেলেভাজার খদ্দের কিছু আসে। নইলে উনুনের তলায় সাতদিনের বাসি ছাই ওগুলি নয় নিশ্চয়ই। আর কুকুরটাও ওভাবে ছাইগাদায় শুয়ে থাকত না, হপ্তাবারে অথবা হাটের দিনেই শুধু আসত হয়তো। একদিনের আশায় কে আর সাতদিন পড়ে থাকে?

খিদে যদি পায় আমার?

ভেবে কোনও লাভ নেই। এখানে খাবার খেতে কেউ আসে না।

আর একটা মুদির দোকান পাশেই। ঝাঁপ হাপ-বন্ধ। নাসিকাধ্বনি শোনা যাচ্ছে মুদির।

দাওয়ায় বসে আছে একটি লোক। ওর চোখে বোধ হয় ঘুম নেই। দিব্যি পিলেখানি নিয়ে হলদে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে একখানি কাস্তে রয়েছে পড়ে। গামছা দিয়ে মাথাটি বাঁধা। বেশ করে বাঁধা। বোধহয় মাথা ধরেছে। তার কাছেও একটি কুকুর বসে রয়েছে। সামনে পড়ে থাকা শালপাতাটি চাটা হয়ে গেছে নিশ্চয়।

একটা খোলা চালায় একজন বসে আছে সের পাঁচেক ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল নিয়ে। পোকা-খাওয়া কিছু বেগুন চটের ওপর বিছানো একজায়গায়। লোক নেই কেউ সামনে।

মনিহারি দোকান আছে একটা। বেড়ায় অনেক ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার। নানারকমের ছবি। দোকানি বসে বসে কী যেন লিখছে। তাকিয়ে দেখল আমাকে। দেখতেই লাগল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবেন?

–বেড়াতে এসেছি।

-ও।

বিরক্ত হল কিংবা বিদ্রূপ করল, বুঝতে পারলুম না। অ-ভক্তিটা টের পাওয়া গেল। আর টের পাওয়া গেল চোখের কোণে একটু সন্দেহ।

কয়েকটি লোক, প্রায় উলঙ্গ, বসে আছে গোল হয়ে। একটা হুঁকো নিয়ে টানাটানি করছে সবাই। সামনে দুটো গোরুর গাড়ি, বলদ-হীন, ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে। বলদ চারটে একটা গাছের গোড়ায় বাঁধা। লোকগুলির মতোই,হাড়সার চেহারা বলদগুলি, অপুষ্ট ঝুঁটিতে জোয়ালের ঘষায় ঘষায় ঘা হয়ে গেছে। কেউ শুয়ে, কেউ বসে। কেউ চোখ বুজে, কেউ অলস চোখে চেয়ে রয়েছে শূন্যে।

আকাশ দেখছে নাকি?

লোকগুলি কী একটা আলোচনা করছিল। থেমে গিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। তারপর চোখাচোখি হল নিজেদের মধ্যে। আবার তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

ওদের সকলের চোখই কি হলদে? একটু নীল আকাশের ছায়াও নেই?

আর একটু এগোলাম। একটি জীর্ণ সাইকেল, এবড়োখেবড়ো মাটিতে ঝনঝন করে এগিয়ে এল সামনে। আরোহীর মাথায় শোলার টুপি, শার্ট কাপড়ের মধ্যে ঢুকানো। গলায় মালার মতো স্টেথিসকোপ।

ডাক্তারবাবু। এখনও বাড়ি যাবার সময় পাননি। আমাকে দেখতে লাগলেন ঘন ঘন। তারপর নামলেন একটি ঘরের সামনে। রেডক্রস-আঁকা একটি সাইনবোর্ডও আছে। বেলারাণী ফার্মেসি। ডাঃ হরেন্দ্রকুমার মিশ্র, এল. এম. এফ।

–কোথায় যাবেন?

বেড়াতে এসেছি।

–অ! কোত্থেকে আসছেন?

বললুম জায়গার নাম।

 ডাক্তারবাবু বললেন, বেড়ান।

ঘরে ঢুকে গেলেন। চোখ ডলতে ডলতে, বোধহয় কমপাউন্ডারই হবে লোকটি, বেরিয়ে এল। এসে ডাকল, কই হে, এসো।

সেই গোল-হয়ে বসা লোকগুলি উঠল।

আমি এগোলুম।

.

বোধহয় ভুল করেছি। রেললাইনের পুবদিকে গেলেই বোধহয় ভাল হত। ওদিকটায় লোকজন পড়বে ভেবে গেলুম না। মনে করেছিলুম, হাটটা পেরিয়ে গেলেই মাঠ মিলবে। বেশ একটু মেজাজ নিয়ে, একটি গাছতলায় বসব। আকাশটাকে চোখ দিয়ে গিলে গিলে নেশা করব। কিন্তু কী রকম একটা ছন্নছাড়া রিক্ত শ্বাসচাপা চাপা ভাব চারদিকে। কালো কালো গায়ে নখ দিয়ে চুলকানো খড়ি ওঠা খসকা খসকা রং যেন সবখানে।

একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাটের এলাকাটা পার হতে চাইলুম।

কিন্তু থামতে হল। যেন কাউকে কেউ মারছে, আর কে হাউমাউ করে চিৎকার করছে, এমনি ভাবে শব্দ করছে টিউবওয়েলটা। যে পাম্প করছে, সে একটি বুড়ি। পাম্প করছে কিন্তু জল উঠছে না। এক ফোঁটা জলও দেখা যায় না কলের নীচে, মাটির ওপর। আমাকে বলল একটু টিপে দিতে।

দিলুম। সেই গলাটিপে-ধরা। চিৎকারের মতো একটা বিশ্রী শব্দ। কিন্তু এক ফোঁটা জলও নেই।

বুড়িটা জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে চলে গেল হাটের দিকে।

আমি এগোলুম। শরতের রোদে বেশ জ্বালা আছে। মাটি থেকেও একটা গরম তাপ উঠছে। কিন্তু লোকালয় দেখা যাচ্ছে যেন? লোক নয়, বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছে যেন। মাটির বেড়া, টালির চাল, টিনের চাল, গোলপাতা কিংবা খড়ের চাল, এ-সবই বেশি। পাকা বাড়িও আছে যেন।

কিন্তু মাথার ওপরে এগুলি কী?

মশা। দুপুরেও দল বেঁধে চক্কোর দিচ্ছে মাথার ওপরে। খেতে চায়। ঘ্যানোর ঘ্যানোর করছে যেন।

তা হলে গ্রাম পড়ে গেল এটা? পার হতে হবে তাড়াতাড়ি।

একটা ভাঙা পুরনো বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলুম। দেয়ালে ঘুঁটে। দোতলাটা চিড়-খাওয়া, তার ফাঁকে ফাঁকে বেত-আচড়া সাপের মতো কী সব গাছের শিকড়েরা জড়াজাপটি করে আছে।

বাড়িটার দরজা খুলে, একটি মেয়ে দাঁড়াল দরজায়। আর এই মৃত্যুপুরীর নৈঃশব্দ্যে শোনা গেল, কোথায় যাচ্ছেন?

কাকে জিজ্ঞাসা করছে? পিছন ফিরে দেখলুম, কাকপক্ষীও নেই। ফিরে দেখলুম, মেয়েটি আমার দিকেই তাকিয়ে হাসছে।

–আমাকে বলছেন?

 জবাবের আগে, মেয়েটি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসল এবং ভিতরের দিকে এমনভাবে তাকাল যে, তার চোখেই একাধিক মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। বলল, আর কাকে বলব? আপনি অমুকবাবু, মানে, অমুকদা তো?

মিথ্যে নয়, আমি সেই অমুক। কিন্তু ইনি? হ্যাঁ, ইনিই বলা উচিত। কেননা বয়স কুড়ির নীচে নয় নিশ্চয়ই। অবশ্য দেখতে কেমন, সেটা না বলাই বোধহয় ভাল। কারণ প্রথমটা দেখেই সেটা বোঝা যায় না। তবে চোখ দুটি বড়ই। মুখখানিও কোমল। সিঁথিতে সিঁদুর নেই, অবিবাহিতা, যেটা এখানে অচল। স্বাস্থ্য? মনে হচ্ছে রুগণ। আর চোখ, কী আশ্চর্য! এর চোখও হলদে।

আমাকে বলতেই হল, আপনাকে চিনতে পারলুম না তো?

মেয়েটি হাসল। বলল, ভুলে গেলেন? সত্যি, আপনারা ভাবুক বটে। তা তো হবেই। শত হলেও

একটু অতিমাত্রায় স্মার্ট হবার চেষ্টা পীড়াদায়ক বোধ হল। বোধহয় পরিবেশেরই গুণে। একটু বিব্রত ভাবে হাসতে হয় আমাকে, এবং অপেক্ষাও করতে হয় শেষ পর্যন্ত শোনার জন্যে।

মেয়েটা আবার বলল, সরযূর সঙ্গে আপনাদের বাড়ি গেছলাম, মনে নেই? সেই সরযূ, আপনাদের মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইনস্পেক্টরের মেয়ে?

ঘাড় নেড়ে স্বীকৃতি জানালুম, সরযূকে আমি জানি।

মেয়েটি বলে আবার, সরযূ আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে বাড়ি গিয়ে। আমি আমার দিদিরা গেছলুম শহরে সিনেমা দেখতে, সেই সময়। আপনাকে নেমন্তন্ন করেছিলাম আমাদের এখানে আসতে। আপনি বলছিলেন, আসবেন। অবিশ্যি আসবেন, সত্যি বিশ্বাস করিনি কোনওদিন। তা হলেও আপনারা

আমাকে বলতে হল, না না, তার কী মানে আছে।

অনেকগুলি গলার ফিসফিসানি আমার কানে এল। দৃষ্টির সীমানাতেও কয়েকটা এলোমলো চোখ, চিবুকের অংশ, একটু কাঁধ, আঁচলের ঝাপটা দেখা গেল।

মেয়েটি বলল, আসুন। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন যে।

–হ্যাঁ, চলুন।

হায়রে নীল আকাশ! শরতের নীল আকাশ!

একটা উঠান, ঘাস ভরতি। কুয়ো, কুয়োর বাঁধানো পাড়, শেওলায় যার অকালের কোনও তারিখই জানা যায় না। দড়ি বালতি আর এক রাশ এঁটো বাসন ডাঁই করা রয়েছে। দুটো গোরু, খোঁটায় বাঁধা রয়েছে উঠোনে।

এবড়োখেবড়ো ফাটাফুটি বারান্দা দিয়ে, একটি ঘরে নিয়ে গেল আমাকে মেয়েটি। বাকিরা দুড়দাড় করে দৌড়ে অন্য ঘরে গিয়ে ঢুকল।

যে ঘরে নিয়ে এল, সেটা পুরনো হলেও মোটামুটি পরিষ্কার। দেয়ালে চুনের পোঁচড়া আছে। সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি আছে। পারিবারিক ফটোও আছে দু-একটা। খান দুই পুরনো চেয়ার, একটা টেবিল। বইও আছে। সিনেমার পত্রিকা, খানকয়েক সাম্প্রতিক বহুবিক্রীত জনপ্রিয় উপন্যাস, বেশ সযত্নে গুছিয়ে রাখা আছে।

মেয়েটি বললে, বসুন।

বসলুম। মেয়েটি চলে গেল। এবার ভাবনার পালা। অবশ্য, মনে পড়ছে, কবে যেন দেখেছি মেয়েটিকে। আমাদের বাড়িতেই দেখেছি। সরযূই বোধহয় নিয়ে এসেছিল।

কিন্তু এবার কে আসবে? মেয়েটির বাবা? সেইটেই স্বাভাবিক। বাড়ির পুরুষ মানুষ এসে আলাপ করবেন।

অনেকগুলি মেয়ে-গলার হাসি কানে এল। আমার লজ্জা করতে লাগল একলা একলা। কারণ, ওরা জানে আমি ওদেরই খোঁজে এসেছি। যদিও নামটাও মনে নেই।

কিন্তু গায়ে হাতে পায়ে চুলকোচ্ছে কেন?

মশা। বোধহয় অনাস্বাদিত রক্তের গন্ধ পেয়েছে।

 আশেপাশে কি লোকজন নেই? এত নিঝুম কেন?

একটু পরেই, দরজার পাশে একটা ছোটখাটো ভিড় দেখা গেল। সকলেই মেয়ে, সকলেই পরস্পরকে ঠেলাঠেলি করছে।

–আহা! চল না।

–তুই যা না।

খিলখিল হাসি।

–সেজদি আগে।

না, বড়দি যাক না।

–আচ্ছা, মা তুমি চলো।

না, না।

 –হ্যাঁ।

যিনি প্রথম ঢুকলেন, তিনি ঘোমটায় মুখ-ঢাকা। বাকিরা সকলে ঘোমটা-বিহীনা। বোধহয় কুমারী, দিদি এবং বোনেরা।

মেয়েটি বলল, ঘোমটা টানা মহিলাকে দেখিয়ে, আমার মা।

নমস্কার করলুম। তিনি সকলের বেশি জড়সড়। কোনওরকমে একবার ঘোমটা খুলে আমাকে দেখলেন। আমিও দেখলুম। বয়স বছর পঞ্চাশ হতে পারে। মেয়েটির মতোই মুখ প্রায়। ওঁরও চোখ দুটি বড়, কিন্তু কী আশ্চর্য ওঁর চোখও হলদে।

উনি কী যেন বললেন মেয়েদের ফিসফিস করে। তারপর আমার দিকে ফিরেও যেন চুপিচুপিই বললেন, বসুন।

বলতে বলতেও, হেসে মরে গেলেন যেন। আর লজ্জাতেই মিলিয়ে গেলেন বোধহয়।

তারপর পাঁচ বোন। কুড়ির পরে একজন, হয়তো আঠারোর পাড়ে। বাদ বাকি ওপরে। কারুরই বিয়ে হয়নি, বোঝাই যায়। সবাই বসে পড়ে মেঝেতে। পরমুহূর্তেই গায়ে গায়ে পড়ে ভীষণ হাসাহাসি আরম্ভ হয়ে গেল।

আমিও কি হাসব? কী জানি, ঠিক বুঝতে পারছিনে।

এই বড়দি, কথা বল্ না।

 -কী বলব?

 –তুই যেন কী জিজ্ঞাসা করবি বলছিলি?

–আমি না, টুকু।

–ও, মেজদি?

-না না। আমি না, তুই তো।

–ভাগ।

নীল আকাশটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, যে আকাশটাকে এই দরজার পুরনো চৌকাঠের সীমানায় বেঁধে এনেছে।

জানেন, অমুকদা, বড়দি কবিতা লেখে।

বললুম, তাই নাকি?

 বড়দি ধাক্কা দিতে লাগল একজনকে। –এই মিথ্যুক কোথাকার। আপনি জানেন, নমি গল্প লেখে।

নমির কুড়ি বছর। সে মুখে আঁচল চেপে না না করতে লাগল।

যার নাম টুকু, সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনার কোন গল্পটা সিনেমা হচ্ছে?

 বললুম।

–অমুককুমার থাকবে?

না।

পাঁচজনের মধ্যেই একটা হতাশা দেখা গেল।

–আচ্ছা কী করে লেখেন?

বোকার মতো হেসে বললুম, সেটা ঠিক বলতে পারি নে।

আবার চুপচাপ। পাঁচজনের মিটিমিটি হাসি।

জিজ্ঞাসা করলুম, আপনাদের বাবা

–বাবা কলকাতায়। চাকরি করেন কলকাতায়, রাত্রে আসবেন।

বললুম, আজকে চলি, কেমন?

একটা প্রবল কলরোল উঠল। না না, ইশ! এখুনি কী? অনেক গাড়ি আছে ফিরে যাবার। একেবারে রাত্রে খেয়েটেয়ে যাবেন।

খেয়ে এবং টেয়ে? সে আবার কী কথা? পাঁচজনের দিকেই ফিরে তাকালুম। আর, পাঁচজনেই সহসা লজ্জায় যেন মাটিতে মিশিয়ে গেল। আর সকলেই আড় চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল।

দশটিই হলদে-চোখ, শীর্ণ-গাল। তবু একটি কোমল করুণ স্নিগ্ধতাও আছে।

কিন্তু আকাশটা আর নীল নেই, ধূসর হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কেন? শ্বাস ক্রমাগতই আটকে আসছে। আর ভয় নয়, তবুও একটা ভুতুড়ে আবহাওয়া যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। চারদিকেই কতগুলি অশরীরী আত্মার অস্তিত্ব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কারা তারা?

ঘোমটা জড়িয়ে মা এলেন। থালায় লাল রসগোল্লা (নিশ্চয়ই সেই দোকানের?) আর এক কাপ চা। পানাপুকুরের জলে দুধ দিলে যে-রকম রং হয়, সে রকম চায়ের রং।

না না করেও খেতে হল।

এবার চলি?

 পাঁচজনের চোখের দিকে তাকিয়ে যেন থমকে গেলুম। হলদে রংটা কখন উঠে গেছে, পাঁচজোড়া চোখ, পাঁচজোড়া কালো দীঘির মতো শান্ত, নিস্তরঙ্গ, কিন্তু পরিত্যক্ত বিষণ্ণতা সেই কালো জলে। বারে বারে চমকে উঠলুম, কারা এত দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আমাকে ঘিরে?

নমি, টুকু, বড়দি, সেজদি, কাউকেই আলাদা করে চিনতে পারছি নে আর।

কে যেন বলল, আবার আসবেন।

–আসব।

আর একজন, আসবেন তো?

–আসব।

মা বললেন, একটা অনুরোধ করব বাবা।

বলুন।

বললেন, কত জায়গায় তো যান, কত লোকের সঙ্গে আপনার জানা শোনা। একটু দেখবেন আমার এই মেয়ে ক’টির জন্য। মোটামুটি আনে নেয়, খায়, এরকম ছেলে হলেই চলবে।

আচ্ছা বলতে গিয়েও থেমে গেলুম। ফিরে তাকালাম পাঁচজনের দিকে পাঁচটি মুখ অবনত। পাঁচজোড়া চোখে, এই অনামী অবাধ মুক্ত নীল আকাশ-গ্রামটার কী এক অবোধ বোবা রহস্যময় কাহিনী যেন চিকচিক করতে লাগল। ঠোঁটের কোণে লেগে রইল একটু অস্পষ্ট হাসি।

বললুম, দেখব।

বেরিয়ে আসবার মুখে, পাঁচজনেই বলল, শহরে ওরা একদিন আসবে ছবি দেখতে, নতুন যে-ছবিটা আসছে।

বাইরে যখন এলুম, আকাশে অন্ধকার নেমেছে প্রায়। মশারা চিৎকার করছে আমাকে ঘিরে। হাটের কাছে এসে মনে হল, এক-আধটা লক্ষ-হ্যারিকেনের আলোয় ভৌতিক ছায়ারা ঘুরছে ফিরছে, কথা বলছে, বোধহয় গুনগুনও করছে কেউ।

সবটা মিলিয়ে একটা পরিত্যক্ত মৃত-পুরী যেন এই অবাধ-উন্মুক্ত নীল-আকাশ গ্রামটা। হায়রে নীল আকাশ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *