ছেঁড়া তমসুক

ছেঁড়া তমসুক

তখন রাত্রি প্রায় আটটা। সেই সময় খবরটা এল। একজন এসে ঠোঁটটা বেঁকিয়ে কেমন একরকমের বিদ্রূপময় অথচ নির্বিকারভাবে হেসে খুব সাধারণ গলাতেই বলল, ওই যে, ওই সেই মেয়েটা, মারা গেছে।

পৌষ মাস। অন্ধকার ঘনিয়েছে প্রায় ঘণ্টা তিনেক আগেই। মফস্বল শহরের সদর-অন্দর, সব রাস্তাই এতক্ষণে ফাঁকা হয়ে আসার কথা। হয়ও অন্যান্য দিন। কিন্তু আজ শনিবার। তাই এখনও কিছু লোকের আনাগোনা রয়েছে।

রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ভিড়টা একটু বেশি। কারণ দোকানপাট বেশি, আলোও বেশি আর মানুষের যাতায়াত তো আছেই। তারপর রাস্তাটা উত্তর-দক্ষিণে ক্রমেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, দোকানপাট কমে এসেছে।

আকাশে কুয়াশা, তারাগুলি মরা চোখের মতো নিষ্প্রভ। ধুলো আর ধোঁয়ায় গোটা শহরটা উলঙ্গবাহার শাড়ির মতো একটা অশ্লীলতার আবরণ জড়িয়েছে যেন। উত্তুরে বাতাসে শীতের কাঁটা। সিটি ফাদার ষাঁড়টা স্টেশনের বারান্দায় উঠে পড়েছে। রাস্তার কুকুর আর মানুষেরা গরম আশ্রয়ের সন্ধান করছে।

সেই সময় খবরটা এল।

দক্ষিণের ফাঁকায়, রাস্তার উপরে, সেকেলে নিচু-ছাদ, পোকা-খাওয়া কড়িবরগা আর চুন বালি-খসা ‘গণেশ কাফে’র ঘরে সংবাদটা এল। গণেশ কাফেতে তখন জমজমাট আড্ডা। চায়ের কাপ-গেলাস-ভাঁড়, সবরকম পাত্রই জড় হয়েছে টেবিলের উপর। প্রায় একটা গণতান্ত্রিক ঐক্যের মতো।

শস্তা সিগারেট আর বিড়ির ধোঁয়ায় ঘরটিকে গ্রাস করেছে।

মালিক লুঙ্গি পরে চাদর জড়িয়ে বসে আছে কাউন্টারে। নতুন লোক আসার সম্ভাবনা কম। এখন যারা আছে, তারা প্রতিদিনের, প্রায় সব সময়ের। অধিকাংশই স্থানীয় বেকার যুবক। কলেজ থেকে ফেল করা, ভেগে-পড়া কিংবা পড়তে-না-পাওয়াদের ভিড়ই বেশি। ময়লা পাজামা, ধুতি, প্যান্ট, ছেড়া জামা, উশকোখুশকো চুল আর পুরোপুরি খেতে না পাওয়া মুখের একটা লেপটালেপটি দঙ্গল। অবশ্য এদের মধ্যে এদেরই দু-একজন ফিটফাট চকচকে, ভরপেট-খাওয়া সুস্থ বন্ধুবান্ধব যে না দেখা যায় তা নয়। তবে সেটা অনিয়মিত। খাপছাড়া, করুণা করুণা ভাব। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, পি এস পি, আর এস পি, স্কুল-কলেজ, মিউনিসিপ্যালিটি, খুন-জখম-মারামারি, প্রেম-ফুসলানো-হরণ, গান-বাজনা-থিয়েটার এই শহরের আদি ও অন্ত এখানকার আলোচনার বিষয়। মায় সাহিত্য পর্যন্ত। চেঁচামেচি উত্তেজনা তো আছেই। হাসাহাসি গালাগালি আছে। হাতাহাতিও যে নেই, তা নয়। মাঝেমধ্যে ছুরিও বেরিয়ে পড়েছে ক্রুদ্ধ হুঙ্কারের মধ্যে। হয়নি যদিও, তবু খুনোখুনিরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অনেকবার। আর এরই মধ্যে আবার কান্নাও আছে। রাত্রি আটটার সময়, আড্ডা তখন বেজায় জমজমাটি। কেরোসিন কাঠের পার্টিশান দেওয়া দুটি ছোট ছোট ফর লেডিজ-এর খুপরিতেও আড্ডা জমেছে। যদিও লেডি নেই একজনও।

গণেশ কাফের মালিক গণেশও আড্ডার শরিক হয়ে গিয়েছে। বাতাসহীন চাপা ঘরটায়, শস্তা সিগারেট আর বিড়ির ধোঁয়ায় একটি নরক-গুলজার করা প্রেতছায়ার মতো দেখাচ্ছিল সবাইকে। নানান রকমের কথা, হাসি ও বাদ-প্রতিবাদে সবাই যখন মশগুল, সেই সময়ে একটা নিত্যনৈমিত্তিক পুরনো খবর বলার মতো, হেসে নির্বিকারভাবে একজন এসে বলল, সেই, কলোনি-পাড়ার কাছে, ভটচার্জি পাড়ার রাধু বাঁড়ুজ্যের মেয়ে আমাদের ফেমাস বিজু, বিজলী হে বিজলী, মারা গেছে।

নরকটা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। ছায়াগুলি মন্ত্ৰপড়া জল ছিটনোর মতো অনড় নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইল খবরদাতার দিকে।

একটু পরে একটা মোটা গলা শোনা গেল, কী ভাবে?

জবাব শোনবার আগেই আর একজন বলল, আজ বিকেলেও তো দেখেছি।

আর একজন, হ্যাঁ, এখানেই তো দেখেছি সন্ধের সময়।

বলে সে একজনের দিকে তাকাল। যার দিকে তাকাল, সে দাঁড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণ। তার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুজন। চব্বিশ-পঁচিশের বেশি কারও বয়স নয়। তিনজনেই প্রায় একসঙ্গে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় বলে উঠল, হ্যাঁ, আজ আজই সন্ধেয় সে ছিল। কিন্তু কী ভাবে মারা গেল? কোথায় আছে?

যে খবরটা এনেছিল, সে বলল, নিশি স্যাকরার আমবাগানের ধারে নর্থ কেবিনের কাছে, রেল লাইনের ওপরে।

রেল লাইনে?

হ্যাঁ। মালগাড়ির তলায় কাটা পড়েছে। আমি দেখে এসেছি। ঠিক গলার কাছ থেকে—

 সুইসাইড নিশ্চয়ই? নইলে সেখানে রাত্রিবেলা কে যায়?

 ততক্ষণে সেই তিনজন বেরিয়ে গিয়েছে।

তারপরেও গণেশ কাফের নিচু-ছাদ ঘরটা খানিকক্ষণ যেন দম চেপে রইল। একটু পরে একজনের গলা শোনা গেল, আশ্চর্য! কিছু বোঝা যায় না আজকাল।

গণেশ ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, সত্যি! আর এই রেল লাইনটা যেন কী মাইরি।

 কেউ কেউ উঠল। বলল, যাই, দেখে আসি।

.

সেই তিনজন তখন ছুটতে ছুটতে অন্ধকার রেল লাইন দিয়ে নর্থ কেবিনের কাছে এসে পৌঁছেছে। জায়গাটায় রাস্তার আলো আসে না। কেবিনের আলো এসে পড়বার সুযোগ পায়নি একটি গাছের জন্য। গুটি তিনেক টিমটিমে রেল-লণ্ঠন নিয়ে এসেছে কেবিনের কুলি। জি আর পি পুলিশও এসে পড়েছে। মাঝে মাঝে চমকে উঠছে তাদের টর্চলাইটের আলো। কিছু লোকের ভিড় ঘিরে রয়েছে ফোর্থ লাইনের একটা অংশ।

ওরা তিনজনে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। লাইনের দিকে একবার তাকিয়ে একই সঙ্গে চোখাচোখি করলে তিনজনে। একটা অসহায় জিজ্ঞাসা ও বিস্ময়ে উদীপ্ত তিন জোড়া চোখ। তিনজনেই যে পরস্পরকে জিজ্ঞেস করছে, এটা বিজুই তো?

হ্যাঁ। বিজুই। চোখ নামিয়ে আবার দেখল তারা বিজলীকে। ঠিক ঘাড়ের কাছ থেকে মাথাটা কেটে গিয়েছে। জড়ানো রুক্ষ দীর্ঘ বেণীটা পুরোপুরি এলিয়ে পড়ে আছে লাইনের মধ্যে, কিন্তু মাথা সুদ্ধু লাল ফিতে স্লিপারের উপর। মাথাটা লাইনের মধ্যে, শাড়ি-জড়ানো দেহটি লাইনের বাইরে পাথর আর ঘাসের উপর যেন প্রায় কাত হয়ে এলিয়ে পড়ে আছে।

রেল-লাইনের টিমটিমে আলো বিন্দুর মতো চিকচিক করছে বিজলীর চেয়ে থাকা স্বচ্ছ চোখে। হাঁ-মুখটা খোলা, ঝকঝকে সাদা দাঁতে আলো পড়েছে। কপালের রক্তটিপটা জ্বলজ্বল করছে এখনও। আর এদিকে ঘাড়ের কাছ থেকে খয়েরি ডোরা কালোপাড় শাড়ির আঁচলটা ঠিক বুকের উপর দিয়ে টানা আছে। কোথাও যেন এতটুকুও অবিন্যস্ত হয়নি। কেবল বাঁ-পায়ের থেকে শাড়িটা একটু বেশি উঠে গিয়েছে, ঘুমন্ত যে-রকম উঠে যায় মানুষের। হাতের লাল কাঁচের চুড়িগুলির কয়েকটা ভেঙে পড়ে আছে হাতের কাছেই। বাকিগুলি সবই আস্ত আছে। কোথাও রক্ত লেগে নেই। কেবল ঘাড়ের কাছে খয়েরি ডোরা কাটা শাড়িটা পেরিয়ে লাল ব্লাউজের বুকের উপর গড়িয়ে এসেছে একদলা রক্ত। শীতের উত্তুরে হাওয়ার টানে তা এর মধ্যেই শুকিয়ে যেন বাসি হয়ে গিয়েছে।

তা ছাড়া আর সব ঠিক আছে। যেন, ঘাড়ের সঙ্গে মাথাটা জুড়ে দিলে, এখুনি বিজু ওর বিজলী চমক চমক হাসি হাসতে হাসতে উঠে বসে, চমকে দেবে সবাইকে। যে-হাসিতে এই মফস্বল শহরের সবাই কোনও না কোনও দিন একবার চমকেছে।

বিজু হ্যাঁ বিজুই। কলঙ্ক যার অঙ্গের ভূষণ ছিল। যে-কলঙ্কিনীর কথা বলতে রসিয়ে উঠত শহরের ইতর ভদ্র। যাকে সহজলভ্য মনে করে সেই চিরকালের টোপ-ফেলাফেলি খেলা অনেক হয়েছে কিন্তু প্রচণ্ড আক্রোশে গর্জাতে হয়েছে নীরবে ও সরবে। অথচ যাকে কলেজের কয়েকটা পড়ো কিংবা পড়তে পড়তে সরে-পড়া রথো দুর্বিনীত ছেলের সঙ্গে প্রায়ই এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে নির্লজ্জের মতো। সন্দেহজনকভাবেই রাস্তার উপর গায়ে গায়ে, জোরে হেসে হেসে, শহরের গায়ে জ্বালা ধরাতে দেখা গিয়েছে। এমনকী আজও দেখা গিয়েছে। এ সেই বিজলী, এই রেলে কাটা মেয়েটা।

গণেশ কাফের এই তিনজন আবার চোখাচোখি করল। ওরা তিনজন সেই কয়েকটা রথো ছেলে, যাদের সঙ্গে বিজুকে দেখা যেত সব সময়। তাদের তিনজনেরই চোখের দৃষ্টি যেন গলায় দড়ি দেওয়া লাশের মতো আরও উদ্দীপ্ত। একটা মহাশূন্যের মতো বিশেষ বিস্ময় ও প্রশ্ন নিয়ে যেন এখুনি চোখগুলি রক্ত কিংবা জলের ফোয়ারা ছুটিয়ে ফেটে পড়বে।

বিজু বিজুই তো। যে আজ বিকেলেও তাদের তিনজনের সঙ্গে গণেশ কাফেতে ছিল। যার কথায় হাসিতে, এমনকী রাগ ও অভিমানের মধ্যে, একবারও এই কাটা পড়ার ছায়াও দেখা যায়নি।

তবে?

ভিড়ের মধ্যে কার একটি রসালো দীর্ঘ হুঁ-উ-উ শোনা গেল। তারপর চাপা গলায়, বড্ড বাড়িয়েছিল। বোঝ এবার।

তিনজোড়া চোখ সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের দিকে জুটে গেল যেন খ্যাপা নেকড়ের মতো। কাউকেই চেনা যায় না। রেল-লণ্ঠনগুলি বিজলীর কাছে নামানো। বিজলীকে ঘিরে রয়েছে। ভিড়ের লোকগুলি অস্পষ্ট।

অচেনা আর চেনা লোকের গুঞ্জন একইভাবে চলছে। কে? কার মেয়ে? ও! সেই সেই মেয়ে? কী হয়েছিল?

বুঝে নাও! হয়েছিল একটা কিছু নিশ্চয়।

হবে, জানাই ছিল।

বিজলীর বাবা রাধুবাবুকেও দেখা গেল জি আর পির দারোগার পাশে। বিজুর দিকে ওঁর চোখ নেই। অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন কোলবসা চোখে। খুবই অসহায়, তবু যেন একটা অপরাধীর ভাব। বিজলীর লাশ কিংবা লাশ দেখতে আসা ভিড়ের কারও দিকেই তাকাতে পারছেন না।

দারোগা জিজ্ঞেস করল, কত বয়স হয়েছিল আপনার মেয়ের?

তেইশ।

বিয়ে দেননি কেন?

দারোগার মতোই প্রশ্ন। রাধুবাবু বললেন, সঙ্গতি ছিল না।

 হুঁ। কী হল হে, লাশ বাঁধ।

 একটি সেপাই জবাব দিল, বাঁশ নিয়ে জমাদার আসছে স্যার।

হুঁ। দারোগা আবার বলল, থার্ড ইয়ার থেকে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল কেন আপনার মেয়ে?

ছ মাসের বেতন বাকি পড়েছিল, তাই। 

উঁ, তা হলে বলছেন, কোনও চিঠিপত্রই রেখে যায়নি?

না।

 আঁ-হা! দেখবেন মশাই, চেপে টেপে যাবেন না, পরে মুশকিলে পড়ে যাবেন।

রাধুবাবু যেন ধরা-পড়া চোরের মতো অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।

দারোগার টর্চলাইট একবার ঝলকে উঠল কাটা বিজলীর উপর।

 লাশ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার লোকেরা এল।

ওরা তিনজন এগিয়ে গেল রাধুবাবুর কাছে। ওদের তিনজোড়া উদ্দীপ্ত চোখে একটা হিংস্র প্রশ্ন বাগিয়ে ধরা ছুরির মতো চকচকিয়ে উঠল নিঃশব্দে। রাধুবাবুর কাছে তারা জানতে চায় কী হয়েছিল। কেন মরেছে বিজলী।

রাধুবাবু তেমনি অসহায়ভাবে তাকালেন। বললেন, প্রায় চুপি চুপি, এই যে শঙ্কর আর নরেশ এসেছ। ও প্রভাতও এসেছ?

হ্যাঁ, ওরা এসেছে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। রাধুবাবু কী জানেন, সেইটি বলুন। তারা জানতে চায় তাদের, হ্যাঁ তাদের যে বিজু হাসতে হাসতে এসেছিল গণেশ কাফে থেকে, সে কেন গলা বাড়িয়ে দিয়েছে রেলের তলে।

রাধুবাবুও ওদেরই চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এতক্ষণে দেখা গেল, ওঁর কোলবসা চোখ দুটি সর্দিজ্বরের মতো ভেজা ভেজা লাল হয়ে উঠছে। দাঁতহীন ঠোঁট চাপছেন বারে বারে। বললেন, কিছু জানিনে। বিজুর তোমরা বন্ধু। তোমরা, তোমরা কিছুই জানো না?

শঙ্কর নরেশ আর প্রভাত আবার চোখাচোখি করল। বুঝল ওরা, রাধুবাবু সত্যি কিছু জানেন না। তবে? তবে কে বলবে? কে জানে?

তিনজনেরই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল বিজলীর উপরে। ওরা চমকে পরস্পরের হাত চেপে ধরল। যেন ছিটকে বেরিয়ে যাবে কোথাও। দেখল, বিজলীর শ্যামলী মুখখানি ওর বুকের উপর বসিয়েছে জমাদারেরা। আর বিজলী এখন চেয়ে আছে ঠিক তাদের তিনজনের দিকে।

ওরা তিনজনেই যেন নিঃশব্দে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, বিজু! বিজু!

জমাদারেরা লাশ কাপড়ে বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নিল। দারোগা ডাকল, আসুন রাধুবাবু।

ভিড় ছত্রভঙ্গ হল। একদল লেগে থাকা মাছির মতো চলল জি আর পি পুলিশ অফিসের দিকে, লাশের পিছু পিছু।

ওরা তিনজন কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। তারপর আরও খানিকটা উত্তরদিকে গিয়ে, আঁশশ্যাওড়ার জঙ্গল পেরিয়ে নির্জন আর অন্ধকার রেল-পুলটার উপরে গিয়ে উঠল। রেলিং-এর উপর ভর দিয়ে, ঝুঁকে দাঁড়াল। জংশন স্টেশনের সর্পিল লাইন এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে অনেক দূর।

উপর থেকে দেখা যাচ্ছে, গোটা শহরটাকে ধোঁয়া গ্রাস করে ফেলছে।

ওদের তিনজনকেও একটা ভয়ংকর কিছু গ্রাস করে ফেলছিল। শত চেষ্টাতেও কারও গলা দিয়ে যেন একটি শব্দও বেরুল না।

কেবল নরেশ দম নিয়ে নিয়ে বলল, বিজু-বিজুটা…

আর কিছু বলতে পারল না। কেবল মনে পড়ল, রোজকার মতো আজকেও বিজু কেমন খিলখিল করে হেসেছিল বিকেলে।

তিনজনই চুপ করে রইল। ঝিঁঝির চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

বিজুর খিলখিল হাসি ওদের তিনজনের বুকেই যেন বাজতে লাগল। তিনজনেই তাকাল ফোর্থ লাইনের সেই জায়গাটায়। কিছুই দেখা যায় না। ওখানে লাইনের উপর হয়তো এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। হয়তো এতক্ষণে শেয়াল এসে চাটতে আরম্ভ করেছে। আর ওরা তিনজন যখন চলে যাবে পুল থেকে নেমে, গভীর রাত্রে সেই খিলখিল হাসিটা হয়তো রেললাইনের লোহায় বেজে উঠবে। কেননা, বিজুর গলাটা ওই লাইনের উপরেই কাটা গিয়েছে।

ওদের তিনজনকে এখন যে-কোনও লোক পুলের উপরে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে খারাপ কিছু সন্দেহ করত। যেন তিনটে ষড়যন্ত্রী কোনও সর্বনাশের মতলব আঁটছে। ওদের ময়লা ছেঁড়া জামাকাপড় উশকোখুশকো চুল, সর্বোপরি ওদের রক্তাভ চোখে কুটিল প্রশ্ন ও কঠিন প্রতিহিংসার একটা বাসনা দপদপ করছে।

মণি-হারা অজগরটার মতো দারুণ যন্ত্রণায় ও আক্রোশে যেন ওরা মনের অন্ধকারে হাতড়ে ফিরছে বিজুর মৃত্যুর কারণটা। মনে পড়ছে। আজ যখন বিজু এল বিকেলে ওরা বললে, বিজু তুমি লেট। বিজু বললে, এখন থেকে লেট হতে হতে আর আসাই হবে না। ওরা বললে, কেন?

বিজু হেসে বলে, বা রে, আমার বুঝি বে-থা হবে না। তোমাদের তিনজনের সঙ্গে ঘুরলেই আমার চিরকাল চলবে? বলে জোরে হাসল।

কিন্তু কী এসে যায় তাতে? ওকথা বিজু প্রায়ই বলত। নতুন কিছু নয়। হ্যাঁ। লেট বিজুর প্রায়ই হত। মনে কোনও রাগ থাকলে, কিংবা এমনি রহস্য করেও কতদিন বলেছে, আর আসা হবে না। আজকেই ইতি। এরকম অনেক ইতি হয়েছে, কিন্তু তারপরে পুনশ্চের কোনও অভাব হয়নি। সুতরাং বিজুর আজকের কথায় কিংবা ভাবে নতুন কিছুই ছিল না, যা দিয়ে শেষ দেখাকে চিহ্নিত করা যায়।

তবে? তবে কী হল? ওরা তিনজনে একই সঙ্গে ফিরে তাকাল আবার লাইনের দিকে। তিনজনেরই যেন লাইনটার উপরে গিয়ে কপাল কুটতে ইচ্ছে করছে। কপাল কেটে কুটে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, কেন, কেন বিজু?

কিন্তু ওরা তিনজনেই মুখ চেপে রইল রেলিং-এ। কেননা, কপাল কুটে রক্ত-গঙ্গা করলেও লোহার লাইনটা কিছু বলবে না।

শুধু বিজুকে ঘিরে ওদের পুরনো দিনগুলি আবর্তিত হতে লাগল। সেই দিনগুলি, যখন বিজলী ব্যানার্জি ছিল ওদের সহপাঠিনী।

যখন ওরা ছিল ছাত্র। যখন ওদের জীবনে ছিল ঝড়ের বেগ, ফেনিলোচ্ছল প্রাণ আর চোখে স্বপ্নের কাজল। যখন বিজু ক্লাসে আসত রাজেন্দ্রাণীর মতো, আর ওরা ছিল যেন বিদ্রোহী প্রজা। রানির স্তুতি করত ওরা বিদ্রূপ দিয়েই, বেয়াদপির হাসি থাকত ওদের ঠোঁটে ও চোখে। কিন্তু বিজু ছুটে যায়নি প্রিন্সিপালের ঘরে। খাঁটি রাজেন্দ্রাণীর মতো শুধু হেসেই শান্ত করেছে সেই বিদ্রোহীদের। যে-হাসিটা তখন থেকেই বিজুর কলঙ্কের সন্দেহ ঘনিয়ে এনেছিল সকলের মনে। আর সকলের মতো ওরা তিনজনও সন্দেহ করত। কলঙ্কিনী ভেবেই ওদের বিদ্রোহ মাত্রা ছাড়িয়ে উঠতে চেয়েছে মাঝে মাঝে।

কিন্তু ছাত্র-জীবনের যেখানটায় থাকা উচিত ছিল নিশ্চিন্ত আশ্রয়, আহার আর একটু ভালবাসা, ওদের সেই আসল নৌকাটাই ছিল তলাফুটো। জীবনে যে ঝড়ের বেগটা ছিল, সেটা শুধু নোঙর ছিঁড়ে টেনে নিয়ে গিয়েছে সর্বনাশের মধ্যে। কলেজের প্রাঙ্গণ ছেড়ে কবে ওরা জীবনের আগুন-লাগা অঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নিজেদেরই মনে নেই। মনে নেই, বাইরের প্রাঙ্গণে এসে কলেজের দলাদলি ভুলে, কবে ওরা তিনজন বন্ধু হয়ে গিয়েছিল! বেকারি আর অনাহারের জ্বালায় কবে ওরা শহরে সেরা দুর্বিনীত ও বেয়াদপ বলে কুখ্যাত হয়ে গিয়েছে, সে কথা ওরাও জানে না।

আর কে এক বিজলী ব্যানার্জিকে নিয়ে কোনও একদিন ওরা একটু মস্তানি করতে চেয়েছিল, সেকথাও ওদের মনে থাকত না, যদি না তিনবছর আগের এক সন্ধ্যায়, শহরের দক্ষিণে, নিরালা রেল-কালভার্টের উপর দেখা হয়ে যেত। রাজেন্দ্রাণীর চোখের কোলে সেদিন গভীর পরিখা। চোখ দুটি বড় বেশি ভাসা ভাসা, করুণ। মুখখানি শুকনো। হাত ভরতি বাদাম ভাজা। মুখেও দু-একটি দানা ছিল।

ওদের তিনজনকে দেখে এক মুহূর্ত বুঝি লজ্জা পেয়েছিল বিজু। পরমুহূর্তেই সেই রাজেন্দ্রাণীর হাসি বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল তার করুণ মুখে। বলেছিল, আপনারা এখানে?

বিজলীকে দেখা মাত্র ওদের তিনজনেরই জিভ চুলকে উঠেছিল বিদ্রূপ করার জন্যে। মনে মনে তৈরি হয়ে উঠেছিল পিছনে লাগার ফিকিরে।

কিন্তু বিজলীর কালো চোখ দুটিতে কী জাদু ছিল, ওদের ইচ্ছে পূরণ হয়নি। বরং সেই কুখ্যাত দুর্বিনীতেরা বিজুর গায়ে-পড়া আলাপে যেন একটু থিতিয়েই গিয়েছিল। বলেছিল, এমনি।

কিন্তু একটু রহস্যের আভাস যেন চিকচিক করে উঠেছিল বিজুর কালো চোখে। বলেছিল, আরও কদিন দেখেছি এখানে আপনাদের।

বলে হাতের মুঠি খুলে বাড়িয়ে দিয়েছিল তিনজনের দিকে। বলেছিল, নিন, বাদাম খান।

ওরা তিনজন মুখ চাওয়াচায়ি করে বাদাম নিয়েছিল। দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনজনের মুখে উপোসের ছাপ। ছেঁড়া জামা কাপড় আর উশকোখুশকো চুলে তিনজনকে যতটা হতভাগা মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি মতলববাজের ছাপ ছিল ওদের চোখে মুখে।

ওদের তিনজনকেই একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছিল। কী বলতে চায় মেয়েটা? ওরা কেন আসে এই কালভার্টের কাছে, জানে নাকি সে? জানে নাকি ওই অদূরের সাইডিং-এর পাশে থাক দেওয়া রেল-স্লিপারগুলি সরাতে এসেছে ওরা? কেন না, স্লিপারগুলি একটি কাঠের গোলায় পৌঁছে দিলে তবে ওরা কিছু টাকা পাবে। টাকা ওদের চাই, নইলে বাঁচা যায় না। আর বাঁচবার অন্য-কোনও রাস্তা ওরা আবিষ্কার করতে পারেনি।

কিন্তু বিজলী ওদের কিছুই বলেনি। শুধু সেই হাসিটুকুই লেগে ছিল ঠোঁটের কোণে। বলেছিল, চলুন, শহরের দিকে যাওয়া যাক।

অসম্ভব। কাজ হাসিল না করে যাবে ওরা? পা ঘসছিল তিনজনেই।

বিজলী আবার বলেছিল, চলুন।

আশ্চর্য! সে-ডাক ওরা ফেরাতে পারেনি। যেন কোন সুদূর আবছায়া থেকে এক বিচিত্র রহস্যময়ী তাদের ডাক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল হাতছানি দিয়ে। নিয়ে গিয়েছিল ওদেরই গণেশ কাফের আস্তানায়। আর নিজের খিদের নাম করে এক রাশ খাবার নিয়েছিল। বলেছিল, টি এক্স আর-এর ক্লাস টেনের মেয়েটাকে পড়াই। আজ মাইনে পেয়েছি, খাওয়া যাক।

তখন ওদের চকিতে মনে পড়ে গিয়েছিল কালভার্টের কাছেই টি এক্স আর-এর কোয়ার্টার। তাই বিজু তাদের দেখতে পেয়েছিল কয়েকদিন।

ওরা লোভীর মতো খেয়েছিল। জানত, রাধু বাড়ুজ্যের এক পাল পুষ্যি থিকথিক ঘরে কানাকড়িটি না থাকলেও বিজলীর অভাব নেই। তার মেলাই মক্কেল।

খেতে খেতেই তিনজনের মধ্যে কে যেন জিজ্ঞেস করেছিল, কলেজের খবর কী? বিজু ছোট মেয়েটির মতো এক মুখ খাবার নিয়ে বলেছিল, ছেড়ে দিয়েছি।

কেন?

টাকা নেই।

অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল ওদের। টাকা নেই, সবাই জানত। কিন্তু একথাও সবাই জানত, ব্ৰজেন পালের মতো কাপ্তেন থাকতে, বিজলীর কোনও অভাব নেই। উৎকৃষ্ট ব্যবসায়ী নকুড় পালের নিকৃষ্ট ছেলে ব্রজেন পাল। কিন্তু নকুড়ের মতে, সে তো ভগবানের হাত। ওই হাতটি থাকলে গাধা পিটিয়ে নাকি ঘোড়া করা যায়। আর পালবংশে কলেজের মুখ দেখা সে-ই তো প্রথম। অতএব, বি-এ পাশ করতে দশ বছর লাগলেও ক্ষতি কী? নিকৃষ্টের পিছনে উৎকৃষ্ট টাকা থাকলেই তো গাধা একদিন ঘোড়ার মতো হ্রেষাধ্বনি করতে পারবে।

সেই হ্রেষাধ্বনিরই বাসনায়, খুরেমারা নাল থেকে মাথার শিরস্ত্রাণ পর্যন্ত পোশাকে আশাকে ব্রজেন একটি পাকা অশ্ব হয়ে গিয়েছে তখন। আমেরিকান কাট কোট প্যান্টের পকেটে তার উৎকৃষ্ট টাকা বাজত ঝনঝন করে। বিশেষ করে বাজিয়ে ফিরত সে বিজলীর পিছনে। কলেজ থেকে রাধু বাড়ুজ্যের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করতে দেখা গিয়েছে ব্রজেনকে। ব্ৰজেনের কথা শুনে মনে হত, বিজলীর শাড়ি ব্লাউজ, বই-ফাউন্টেন পেনটি পর্যন্ত ওর টাকাতেই কেনা।

সবাই তাই বিশ্বাস করত। ব্ৰজেনের সঙ্গে তখন বিজলীকে এদিকে ওদিকে দেখাও যেত। তাই, টাকা নেই শুনে ওদেরই গলায় খাবার আটকে যাবার দাখিল হয়েছিল।

বিজুর চোখে সেই রহস্যের ঝিকিমিকি আরও কয়েকটা ঘুলঘুলি দিয়েছিল খুলে। হেসে বলেছিল, কী হল?

একজন জিজ্ঞেস করেছিল, ব্ৰজেনের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেছে নাকি?

পলকের জন্য বুঝি বিজলীর চিকুর চিকচিক চোখ মেঘে ঢেকে গিয়েছিল। ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু গিয়েছিল মরে।

পরমুহূর্তেই আবার হেসে বলেছিল, ঝগড়া হবে কেন। যতটুকু ভাব দেখছেন, এখনও তাই আছে। ব্ৰজেন তো কখনও পেছন ছাড়ে না। আপনারা বোধহয় দেখেননি, ব্রজেন ছায়ার মতো আমাদের পেছন পেছন এসেছে। উঁকি দিয়ে দেখুন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, এই দিকে চেয়েই।

ওরা উঁকি দিয়ে অবাক হয়ে দেখেছিল, সত্যি ব্ৰজেন বাইরে দাঁড়িয়ে। চোখে তার অপেক্ষমাণ কুকুরটার কৃপা প্রার্থনার দৃষ্টি। ঠোঁটে সিগারেট, দু হাত প্যান্টের পকেটে।

ফিরে দেখেছিল ওরা, বিজলীর ঠোঁটে যেন ক্লান্ত বিষণ্ণ হাসি। আর সেই ওদের তিনজনেরই, বিজলীকে বড় অসহায় মনে হয়েছিল। ওদের দুর্বিনীত বুকেও মানুষের হৃৎপিণ্ডের অবশিষ্টাংশে টনটন করে উঠেছিল যেন একটু।

বিজু কেমন একটু হেসে আবার বলেছিল, মেয়ে হয়ে ব্রজেনের টাকা কেমন করে নেওয়া যায়, বলুন।

সেই মুহূর্তেই বিজলীর দিকে তাকিয়ে থাকা চোখের চাউনি একেবারে বদলে গিয়েছিল ওদের। সেই মুহূর্তেই একটি মেয়ে-জীবনের সত্যের তত্ত্বকে আবিষ্কার করে, বিজলীর নতুন পরিচয়ে অপরাধী হয়ে উঠেছিল নিজেরা।

বিজলী তখন উঠে পড়েছিল। ওদের মধ্যেই কে যেন বলেছিল, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

বিজলীর চোখে আবার সেই রাজেন্দ্রাণীর হাসি উঠেছিল চমকে।

বলেছিল, ব্ৰজেনের জন্যে? তার দরকার হবে না। পেছন ঘুরেই যখন ওর শান্তি, ও ঘুরুক। কিন্তু–

বিজলীর চোখে রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল হঠাৎ। একটু থেমে বলেছিল, কালভার্টের ওই বিচ্ছিরি জায়গাটায় আপনারা আর যাবেন না। রেলের গুডসশেডের ওখানটা থেকে পুলিশ বিনা দোষেও লোক ধরে নিয়ে যায়।

 বলে সে চলে গিয়েছিল।

ওরা তিনজন যেন বিজলীতারের শক খেয়ে থমকে তটস্থ হয়ে গিয়েছিল।

সেই ওদের ত্রয়ীকে ঘিরে বিজলীর শুরু। সেইদিনই গণেশ কাফে থেকে গোটা শহরে মাছিরা ভ্যানভ্যান করে উঠেছিল, তিন কুখ্যাতের সঙ্গে বিজলীর মিলনের কথা। বলেছিল, যার যেথা ঠাঁই।

তারপর সে-কাহিনীও পুরনো হয়ে গিয়েছে। এই তিন বছরে, ওই তিনজনের সঙ্গে বিজু প্রতিদিন ঘুরেছে। কবে ওরা আপনি ছেড়ে তুমি হয়ে গিয়েছে। কবে ওরা চারজনের এক সর্বক্ষণের অখণ্ড জুটি হয়ে গিয়েছে, নিজেদেরও বোধহয় মনে নেই। দেখে, শহরের টোপ-ফেলা খেলোয়াড়েরা অনায়াস ভেবে অনেকবার উৎসাহিত হয়েছে আর আক্রোশে দাঁত পিষেছে। ব্ৰজেন পিছন ছাড়েনি, ক্ষিপ্ত হয়েছে আরও। গোটা শহরের গায়ে অনেক জ্বালা ধরেছে। আজও ধরেছে।

আজও ধরেছে ; এবং ধরিয়ে বিজু নিশি স্যাকরার আমবাগানের ধারে এসেছিল। কেন?

রেলপুলের উপর থেকে তিনটে অভিশপ্ত প্রেতের মতো ওরা আবার ফিরে তাকাল ফোর্থ লাইনের সেই জায়গাটায়।

আর ওদের তিন জনেরই মনে হল, প্রথম দিন বিজুকে যে রহস্য ঘিরে ছিল, আজ সেই রহস্যই ওই ফোর্থ লাইনের উপরে শেষবারের জন্য গলা পেতে দিয়েছে। উদঘাটনের কোনও চিহ্নই সে রেখে যায়নি। শুধু তিনটি প্রেতাত্মা চিরকাল ধরে সেই রহস্যের সন্ধানে ফিরবে।

ফিরবে, আর জানতে চাইবে, কেন বিজু নিশি স্যাকরার আমবাগানের ধারে এসেছিল? বিজু তাদের কালভার্টের সেই বিচ্ছিরি জায়গাটায় যেতে বারণ করেছিল, তারা আর যেতে পারেনি। তারপরে বিজু তাদের অনেক জায়গায় যেতে বারণ করেছে, তারা যায়নি।

কিন্তু বিজু কেন নর্থ কেবিনের কাল-আঁধারে, লাইনের উপরে এসে মরেছে? কেন বিজু?

জবাব পাওয়া যাবে না। কালকের শিশিরে-ভেজা লাইনটায় কোনও চিহ্নই থাকবে না। কেবল অদূরের ক্রশ লাইনের কাছে, দু ফুট উঁচু সিগন্যালের এই লাল আলোটা জ্বলবে। থিতিয়ে আসার অন্ধকারে এখন ওই আলোর রক্তাভা বেশ গুঁড়ি মেরে মেরে গিয়ে ঠেকেছে ফোর্থ লাইনের বুকে। ওই রক্তাভ রেশটা চিররাত্রি ধরে দগদগ করবে একটি রক্তাভ ক্ষতের মতো।

কিন্তু তার পরদিন রহস্যের একটি গ্রন্থিমোচন হল। সকলের জিহ্বা আর একবার লকলক করে উঠল। বিকেলের দিকে মর্গ থেকে সংবাদ এল, বিজলী গর্ভবতী ছিল।

আর ওরা তিনজন নরেশ-প্রভাত-শঙ্কর গণেশ কাফেরই ফর লেডিজ খুপরিতে বসেছে মুখোমুখি। চোখে ওদের প্রজ্বলিত ঘৃণা দপদপ করছে। হিংস্র কুটিল সন্দেহে ওরা নিজেদেরই পরস্পরকে হানছে। ওদের গোটা জীবনের সব সর্বনাশ আজ নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি করবার উন্মাদনায় বসেছে কবুল করতে। কে? কে অকলঙ্ক বিজুকে এই কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে মেরেছে?

কবুল খেতে হবে, কেননা তারা তিনজন ছাড়া, বিজলীর এই সর্বনাশের শরিক আর কেউ হতে পারে না। শহরের সব বিষধরদের নির্বিষ করেই এই দুর্বিনীত ছন্নছাড়া ত্রিভুজকে সে নিজেই আশ্রয় করেছিল। একটি মেয়ে যতটুকু পারে, তার সবটুকু নিয়ে সে আত্মসমর্পণ করেছিল এই তিনের কাছে ; তার সব সর্বনাশ, তার সব কলঙ্ক সে বন্ধক রেখেছিল এই তিনজনেরই কাছে, বন্ধুত্বের মূল্যে। সাহস প্রীতি আর স্নেহের মূল্যে। তাদের তিনজনকে সর্বনাশের সব পথ থেকে নোংরা বীজাণুদের সমস্ত আশ্রয় থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার মূল্যে, বিজু তার ভিতর-দুয়ারের কপাটও দিয়েছিল হাট করে খুলে। রাখেনি কোনও সদর অন্দর। তাদের তিনজনের পাঁশআস্তীর্ণ ত্রিভুজ-আঙিনাটায় নিশ্চিন্ত হয়ে ফুটেছিল সে ফুলের মতো। তারই সুযোগ নিয়ে কে তাকে খুন করেছে প্রকাশ করতে হবে। বন্ধুত্বের হাতে নিজেকে অবশ করে ছেড়ে দেবার তমসুক ছিল তাদেরই হাতে। তারাই কেউ ছিঁড়েছে সেই তমসুক। কবুল করতেই হবে।

সেই কবুল করবার জন্যেই, তিনজনে তারা কাঠের খুপরিটার মধ্যে রুদ্ধশ্বাস হিংস্র হয়ে বসে আছে। কারও দিক থেকে কারও চোখ নামছে না। যেন প্রত্যেকেই শিকারি ও শিকার।

বাইরে গণেশ কাফের গুলতানি চলেছে রোজকার মতোই। সেখানে তাকিয়ে বোঝবার উপায় নেই, এই একই ছাদের তলার, একটি খুপরিতে, একটা ভয়ংকর রক্তারক্তির উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে।

কুটিল সন্দেহে, চাপা ক্রুদ্ধ গলায় হিসিয়ে উঠল শঙ্কর আমি নয়, প্রভাত নয়, নরেশ নয়, তবে কে? কে, আমি জানতে চাই। আর কে ছিল তার, আমরা ছাড়া?

যেন ছোবল মারার আগে, কেউটের মতো কাঁধ বাঁকিয়ে নরেশ গর্জে উঠল, আমিও তাই জানতে চাই। সে যেই হোক, আমি তাকে দু হাতে টিপে পিঁপড়ের মতো মারতে চাই।

মানুষ যখন ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তখন তার সবটাই নাটকীয় দেখায়। প্রভাত পকেট থেকে ওর সেই বিখ্যাত বোতাম-টেপা ড্যাগারটা বার করে খুলে রাখল টেবিলের উপর। শাণিত ছুরিটার তীক্ষ্ণ ধার আজ রক্তলোলুপতায় যেন বড় বেশি চকচক করছে। সে ছুরিটা বিজলীর সামনে যতবার খুলেছে প্রভাত, ততবারই বিজলীর দু চোখে ঘনিয়ে এসেছে অভিমান। বলেছে, কতদিন বলেছি তোমাকে প্রভাত, ওটা আমি দু চক্ষে দেখতে পারিনে। রেখে দাও।

বলে নিজের হাতে বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। আজ বন্ধ করবার কেউ নেই।

সে বললে দাঁতে দাঁত পিষে, তাকে যখন আমি পাব, সে যতবড় বন্ধুই হোক, তার বুকটা আমি উপড়ে ফেলব।

কিন্তু এ শুধু কথা। তারপর?

ছুরিটার তীক্ষ্ণ ধার ওদের তিনজনের মুখেই যেন হিংস্র হয়ে জ্বলতে লাগল। যেন হত্যা-উৎসবের আগে, মন্ত্রপূত অস্ত্রটাকে ঘিরে বসেছে ওরা ট্রাইবদের মতো।

আগে ওরা রাগে ও ঘৃণায় যখন কোনও কারণে রুদ্র হয়ে উঠত, তখন বিজলী ওদের শান্ত করত। শান্ত না হলে বিজু রেগেছে। বিজু কেঁদেছেও।

আজ বিজু নেই। আজ ওরা সেই মূর্তি ধরেছে।

প্রভাত ছুরি বের করেছে। নরেশ ওর সেই কালো বিশাল শরীরটার পেশিতে পেশিতে ঘষছে। শঙ্করের রক্তাভ বড় বড় চোখ দুটিতে নেশা ধরেছে। যে-চোখ দেখলে বিজু হাসতে হাসতে আঁচলের ঝাপটা মেরেছে। বলেছে এই, এই রাক্ষস, চোখ করেছে দেখ। নরেশের পেশিশক্ত শরীর বিজলীর ছোট হাতখানির চাপে কোনওদিন নির্দয় দুর্দান্ত হয়ে উঠতে পারেনি।

ওরা প্রতিটি দিনের পাতা উলটে উলটে দেখছে, খুঁজছে, পরস্পরের প্রতিটি দিনের ব্যবহার। প্রতিটি দিন, কে কবে কেমন করে হেসেছিল, কতখানি বেশি ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিল বিজুর। কোনদিন কে কতক্ষণ একলা ছিল বিজুর সঙ্গে। বিজু কাকে কবে একটু বেশি স্নেহ করেছিল।

ওদের মনে এই অবিশ্বাস ও সন্দেহের জড় লুকিয়ে ছিল হয়তো। কিন্তু তখন বিজু ছিল। রামধনুর মতো কোনও কালকূট মেঘকে ঘন হতে দেয়নি। বুক চেপে হাঁটা শ্বাপদ-অন্ধকার পারেনি ফিরে আসতে। আজ ওদের সেই মন হতাশায়, অবিশ্বাস ও সন্দেহে হিংস্র। সেই শ্বাপদ-অন্ধকারটাই গ্রাস করেছে আজ তিনজনকে। তাই প্রতিদিনের উনিশ-বিশ ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজছে ওরা। কে? কে হতে পারে? বিজুর নিশি স্যাকরার আমবাগানের ধারে যাবার আগে, কাল বিকেলেও কে কেমন করে কথা বলেছিল তিনজনে, সেটাও ভাবছে ওরা। ভাবছে, তিনজনের মধ্যে, কাকে বাঁচাবার জন্যে ঘুণাক্ষরেও কিছু বলেনি বিজু?

একসময়ে নিজেদেরই নিশ্বাসে চমকে উঠে ওরা পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর টেবিলের উপর ছুরিটার দিকে। যেখানে অনেকদিন বসেছে বিজু, আর বিজুকে ঘিরে ওরা বসেছে চেয়ারে।

সন্দেহ আর অবিশ্বাস ওদের ছাড়ে না। শেষপর্যন্ত নিজেদের মধ্যে ওরা একটা রক্তারক্তি কাণ্ড করবে। তবু বিজুর প্রতিদিনের স্মৃতি ওদের মাঝে মাঝে আনমনা করে তুলছে।

শঙ্কর হঠাৎ ডাকে, প্রভাত।

প্রভাত সন্দেহ করে আগে থেকেই রুক্ষ হয়ে জবাব দেয় কী?

নরেশ দুজনের দিকেই তাকায় তীক্ষ্ণ চোখে।

শঙ্কর বলে বেচু পাঠক তার বুড়ি দিদিকে খুন করতে চেয়েছিল, মনে আছে?

 প্রভাত ভ্রূ কুঁচকে বলে তাতে কী?

বেচু পাঠক তোকে দিয়েই খুন করাতে চেয়েছিল সম্পত্তির লোভে। তোকে নগদ দু হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল। বেচু পাঠক দরজা খুলে রাখাবে রাত্রে, তুই গিয়ে শুধু বুড়ির গলাটা টিপে রেখে আসবি অন্ধকারে। ব্যস আর-কিছুই নয়। এমনকী, বেচু পাঠক পরে ধরিয়ে দিতে চাইলেও তোকে ধরবার কোনও উপায় থাকত না। 

প্রভাত প্রায় চিৎকার করে ওঠে কিন্তু তাতে কী হল?

শঙ্কর যেন প্রায় চুপি চুপি বলল, তুই তা করিসনি। বিজু তোকে বারণ করেছিল বলে।

শঙ্করের গলার স্বরে প্রভাত আর নরেশ যুগপৎ চমকে ওঠে। দুজনেরই চোখে ঘৃণা আর উত্তেজনা ছাপিয়ে একটা নিশি-পাওয়া ব্যাকুলতা ওঠে ফুটে। ওদের তিনজনেরই চোখের উপর ভেসে ওঠে বিজুর মূর্তি।

 হ্যাঁ, বিজু প্রভাতকে যেতে দেয়নি বেচু পাঠকের দিদিকে খুন করতে। খুন করার ভয়াবহ  নারকীয়তার রূপ ওদের অনুভূতি থেকে বহুদিন বিদায় নিয়েছিল। ওদের সেই অনুভূতিটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে বিজু।

যখন ওরা চাকরির জন্য দরখাস্তের পর দরখাস্ত করেছে, ভেড়ার পালের মতো সর্বত্র লাইন দিয়েছে, চটকলের স্পিনার হবার আশাতেও গিয়েছে ছুটে আর ফিরে এসে হতাশায় অবসাদে পড়েছে ভেঙে, তখন একটিই সৎ ও সত্যিকারের রাস্তা খোলা ছিল, মরা। খবরের কাগজের একটি শিরোনামাকেই ওরা বাড়াতে পারত, অনাহারের জ্বালায় যুবকের আত্মহত্যা।

কিন্তু তা করেনি ওরা। তারই একটা রকমফের জীবনের যত ভয়াবহ অন্ধকার সুড়ঙ্গপথগুলি বেছে নিয়েছিল। কেননা, ওরা দেখেছিল, এ-দেশে ওইটিই প্রশস্ত পথ।

সেই সময়েই বিজুর আবির্ভাব হয়েছিল ওদের জীবনে। সে আগলে দাঁড়িয়েছিল ওই অন্ধকার সুড়ঙ্গগুলি।

সেই সময় দেখেছিল, ওদের রাজেন্দ্রাণীর মুখে ঠিক ওদেরই মতো উপোসের ছাপ। তখন থেকে ওরা দু পয়সার বাদাম, চার পয়সার মুড়ি, দু গেলাস চা, বিজুর সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছে। অনাহারের মধ্যেও সমস্ত লোভ জয় করেছে ওরা।

প্রভাত গোঙার মতো ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, হ্যাঁ, বিজু বারণ করেছিল। বলেছিল, বারণ না শুনলে সে মরবে। বিজু মরবে, তাই আমারও যত ঘেন্না হয়েছিল টাকার লোভে। বিজু বারণ করেছিল। বিজু তোকেও বারণ করেছিল শঙ্কর। দাশু গাঙ্গুলি তোকে পাঁচশো টাকা দিতে চেয়েছিল, শুধু ওর অপজিট পার্টির লিডার কেদার ঘটকের নামে একটা মেয়েমানুষকে জড়িয়ে মিথ্যে বক্তৃতা দেবার জন্য। মানহানির মামলা করলে টাকা দেবার চুক্তি ছিল দাশু গাঙ্গুলির। কিন্তু তুই যাসনি, বিজু বারণ করেছিল। যেন মাতালের মতো সুরহীন গলায় বলতে থাকে প্রভাত, বিজু তোকেও বারণ করেছিল নরেশ। ডাক্তার তালুকদার তোকে মাসে তিনশো টাকা মাইনের চাকরি দিতে চেয়েছিল, শুধু তার স্মাগলিং-এর কর্নারগুলির উপর নজর রাখবার জন্যে, দলের বিশ্বাসঘাতকদের ওপর স্পাইং-এর জন্যে। সেই চাকরি তুই নিসনি। বিজু তোকে বারণ করেছিল।

বিজু তাদের বারণ করেছিল, এই কথাটা কাঠের খুপরির মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। বিজু তাদের ঘেন্না করতে শিখিয়েছিল। তাই তারা অন্ধসুড়ঙ্গগুলির মুখে পা দিয়ে ফিরে এসেছিল। তাই তারা এ-সংসারের সকল অনাহারীর সাধারণ দলেই এসে ভিড়েছিল। বাঁচতে চেয়েছিল আর সকলেরই মতো রোষে ও রাগে, কষ্টে ও কান্নায়।

আর তবু উপোসী বিজু তাদের তিনজনের তিলে তিলে মরা মূর্তিগুলির দিকে তাকিয়ে কখনও চোখের জল চাপতে পারেনি। মুখ নিচু করে, যেন অপরাধিনীর মতো বলেছে, হয়তো আমার জন্যে, আমারই জন্যে তোমরা মরছ। হয়তো আমার ভুল হচ্ছে। তোমরা একটু ভাবো।

কিন্তু তখন আর ভাববার কিছু নেই। একদিন যে-পথ থেকে ফিরে এসে ওরা বিজুকে ঘিরে ছিল সেই পথটাকে ওরা ঘৃণা করতে শিখেছিল। বিজু ফিরিয়ে দিতে চাইলেও ওরা ফিরে যেতে পারত না। পারবেও না। কারণ, ঘৃণা শুধু নয়, ওরা একটি ভালবাসাকে পেয়েছিল। একটি বিজুকে পেয়েছিল, যার সঙ্গে ওরা সংসারের লাঞ্ছিতাদের হাটের মিছিলে চেয়েছিল শরিক হতে।

তাই, রাজেন্দ্রাণীর শোক-বিমূঢ় চোখের জল তারা মুছিয়ে দিয়েছে। ওই কালো চোখে দপদপ করে আগুন জ্বালারই তাপ চেয়েছে তারা। মৃত্যুহীন নির্ভয়ের খিলখিল হাসির ঝনঝনায় এ-বিশ্বসংসার কেঁপে উঠুক, তারা তাই চেয়েছে।

সেই হাসি তাই শেষদিন পর্যন্তও হেসেছিল বিজু। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-ভয়-দুর্দশাগ্রস্ত জীবনে সেই হাসিটাই তাদের অনেক নির্ভয়ের নিশান হয়ে ছিল।

সেই হাসিটা ছিনিয়েছে কে!

আর কারা ছিল বিজুর জীবনের সব অন্ধিসন্ধির খবর জানতে? অসহায় আর অপমানিত ভদ্রলোক। রাধু বাঁড়ুজ্যেকে সপরিবারে তিলে তিলে মরতে দেখেছিল তারা। শুধু তাদেরই তিনজনের জন্যে রাধু বাঁড়ুজ্যে তাঁর আইবুড়ো মেয়ের কলঙ্কে মাথা নত করেছিলেন। সেই সবচেয়ে বড় কলঙ্কের গুপ্ত তথ্য কী, তা তো শুধু তারা তিনজন আর বিজুই জানত। তারা চারজনেই শুধু জানত, সেই কলঙ্ক ছিল শুধু তাদের চারজনের হাত ধরাধরি করে বাঁচা। তাদের বন্ধুত্ব।

বন্ধুত্বের সেই সুযোগ নিয়ে, কে মেরেছে বিজুকে?

তিন জোড়া চোখের কুটিল সন্দেহ, ঘৃণার দৃষ্টি কেউ কারও উপর থেকে নামাতে পারছে না ওরা।

কিন্তু শত অবিশ্বাস সন্দেহেও, ওদের ক্রোধের আগুনে আর তেমন করে ছুরিটার তীক্ষ্ণধার চকচক করছে না। অবসাদগ্রস্ত মনে শুধু একটা হাহাকার ওদের যেন গ্রাস করে ফেলেছে। শুধু মনে পড়ছে, বিজু ওদের কোথায় যেতে বারণ করেছিল, আগলে রেখেছিল কেমন করে? সর্বনাশীর মতো কেমন করে সে তিনটি পুরুষের ছটি থাবার উপরে নিজেকে নিশ্চিন্তে মুক্ত করে দিয়েছিল।

গণেশ কাফের ঘরে ভিড় কমে এসেছে। ক্রমেই চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে সামনের ঘরটা। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার শব্দও কমছে।

নরেশ হঠাৎ যেন ছটফট করে উঠল। ছুরিটা হাতে নিয়ে সে দ্রুত চাপা গলায় বলল, আমি বলব, একটা কথা বলব।

শঙ্কর আর প্রভাত দু জনেই ফিরে তাকাল তার দিকে।

নরেশ যেন স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, একদিন, সেদিন তোরা দুজনে ছিলিনে, কোথায় গেছিলি। এই ঘরে, আমি আর বিজু। বিজু হাসছিল, অনেক কথা বলছিল। কিন্তু আমার কী হল, আমি জানিনে। বিজুর শরীরের দিকে সেই যেন আমি প্রথম তাকালাম। সেই যেন প্রথম জানলাম, বিজুর রূপ আছে, যৌবন আছে, আশ্চর্য সুন্দর তার গঠন। আমি পাগলের মতো দু হাতে জড়িয়ে ধরলাম বিজুকে। বিজু যেন একবার কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল।

বলতে বলতে নরেশ প্রকাণ্ড শরীরটা নিয়ে যেন হাঁপিয়ে উঠল। কিন্তু কেউ ওকে কিছু বলল না। দুজনেই স্থির তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে নরেশের দিকে।

নরেশ আবার বলল, জড়িয়ে ধরে আমি বার বার ডাকতে লাগলাম, বিজু বিজু। বিজুর মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাকাতে আমার সাহসও হচ্ছিল না। কিন্তু একটু পরে, বিজু দু হাত দিয়ে আমার মাথাটা জড়িয়ে ধরল। বলল, কী বলছ নরেশ? আমার চোখে বুঝি তখন রক্ত। ফিরে তাকালাম তার দিকে। দেখলাম, মুখে তার হাসি, কিন্তু চোখে জল। সে যে আমার মাথায় হাত দিল, তখুনি আমার কেমন হয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিলাম। বিজু বলল, নরেশ, বাবা কোনও দিন বিয়ে দিতে পারবে না। আমি নিজে যদি করি, কাকে করব, বলো? তুমি যা চাইছ, তুমি নিতে পারো! শঙ্কর আর প্রভাতকে আমি কী বলব? তুমি কী বলবে? আমার তখন পালিয়ে যাওয়া কুকুরের মতো অবস্থা। আমি দু হাতে মুখ ঢেকে রইলাম। বললাম, ক্ষমা করো বিজু, ক্ষমা করো। বিজু আমার দু হাত ওর কোলের ওপর টেনে নিয়ে গেল। আরও কাছে এল আমার। বলল, তুমিও আমাকে ক্ষমা করো নরেশ! তুমি, আমি, প্রভাত, শঙ্কর কেউই আমরা ভিন্ন হয়ে যেতে পারব না আর। তাই কোনওদিন আর আমরা এসব পারব না।

নরেশ নিশ্বাস নেবার জন্য একবার থামল। আবার বলল, এই, এই আমার একমাত্র অপরাধ বিজুর কাছে, তোদের কাছে। এই–এই।

বলতে বলতে তলিয়ে গেল নরেশের গলার স্বর।

কিন্তু প্রভাত আর শঙ্কর তখন নিশি পাতার জড়ের মতো মুখ ঢেকে বসেছে। ওই একই অপরাধ, ভিন্ন জায়গায় একইভাবে ওরাও করেছে বিজুর কাছে।

একইভাবে প্রভাত অন্ধকার রাত্রে বিজুকে একা বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে সেই গাছতলায় দু হাতে টেনে এনেছিল কাছে। এইভাবেই, বিজুর দুটি ঠোঁটের পিপাসায় ছাতি ফেটে গিয়েছিল তার। কিন্তু তার মনে হয়েছিল বিজুর ঠোঁট যেন শবের ঠোঁট। ঠাণ্ডা, রক্তহীন, অনড়, শক্ত। পরমুহূর্তেই প্রভাতের বুকের মধ্যে একটা ভয়ংকর সর্বনাশের মতো মনে হয়েছিল, বিজুকে চিরদিনের জন্য হারাবে সে। কিন্তু বিজুই তার ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে নির্ভয় করেছিল তাকে। শুধু সেই ঠোঁটে কোন অকূল থেকে ভেসে আসা নোনা স্বাদ ছিল। সেই ঠোঁট নেড়ে সে বলেছিল, তা হলে আর দু জনের কাছে আমাকে মরতে হয় প্রভাত।

একইভাবে এক বর্ষার রাতে, রেলের অন্ধকার ওভারব্রিজের নীচে শঙ্কর বিজুর দুটি হাত চেপেধরেছিল, যে হাত চেপে ধরার মধ্যে পুরুষ তার কিছুই গোপন রাখতে পারে না। তার বড় বড় চোখ দুটিতে দপ দপ করে পতঙ্গ পুড়ছিল। বিজু শুধু অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল রেল লাইনের দিকে। একইভাবে সে শঙ্করকে শান্ত করেছিল। একই কথা বলেছিল, সে স্বৈরিণী হলে একই প্রাপ্য তিনজনকে দিতে পারত। তা যখন নয়, তখন বন্ধুত্বকে রক্ষা করার প্রয়াসই বিজুর জীবনে অক্ষয় হয়ে থাক।

বিজু বন্ধুত্বকে রক্ষা করেছিল। ওদের আত্মনাশের আর বন্ধুত্বের দুর্গের অটল প্রহরী বিজু। তবে? ওদের তিনজনের সর্বক্ষণের ছায়া আর কেউ ভেদ করেছিল নাকি? ভেদ করে কোথায় যাবে? বিজুরই কাছে তো? যে-বিজু তাদেরই সঙ্গে মরছিল আর বাঁচছিল। তাদের ফিরিয়ে এনেছিল, বারণ করেছিল, ভালবেসেছিল।

রাত হয়েছে। ঠাস ঠাস করে গণেশ কাফের দরজা বন্ধের শব্দ ওদের চলে যাবার নির্দেশ দিচ্ছে। ওরা উঠে পড়ল।

কিন্তু পরস্পরকে কেউ ওরা ছেড়ে দিতে পারবে না।

বাইরের রাস্তা ধোঁয়ায় আর কুয়াশায় আবছা শীতার্ত পথটা নরকের মতো জনহীন আর নিস্তব্ধ।

কালকে ওরা কিছুই না জেনে, ফিরে যেতে পেরেছিল। আজকে ওরা ফিরে যেতেও পারছে না। বিজুর যে কলঙ্কে শহর ধিক্কার দিয়ে হেসেছে, সেই একই ধিক্কার দিতে গিয়ে, আর সকলের মতো বিজুর বাবার চোখের সামনেও এই ত্রিমূর্তিই হয়তো ভেসে উঠবে। চির কলঙ্কটা তাদেরই জন্য থেকে যাবে।

উত্তরদিকেই চলল ওরা। নিশি স্যাকরার আমবাগানের ধারটাই টানছে যেন ওদের। একজন হনহন করে তাদের পার হয়ে গেল হেঁটে। যেতে গিয়ে লোকটা যেন চমকে গেল তাদের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ যেন থমকে গেল এক মুহূর্তে। কুয়াশায় অস্পষ্ট দেখা গেল লোকটার উশকোখুশকো চুল। বড় বড় উন্মাদ চোখ দুটিতে চকিতে যেন একটা ভয়ের ঝিলিকও চমকাতে দেখা গেল। এক মুহূর্তমাত্র। তারপরেই, আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল। দেখা গেল। এক মুহূর্তমাত্র। তারপরেই, আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল।

 কে? চেনা-চেনা লাগল যেন মুখটা? ব্রজেন না?

মনে হতেই ওদের তিনজোড়া চোখ, চোখাচোখি করল আর ওদের মনের মধ্যে সহসা কেমন চমকে উঠল। যেন কী একটা ঘটে গেল ওদের মধ্যে, আর সে মুহূর্তেই তিনজনে ছুটে গেল ব্ৰজেনের দিকে। ছুটে গিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজনেই। মুহূর্তমাত্র সময় না দিয়ে, টুটি ধরে নিয়ে গেল সামনের সরু গলির মধ্যে।

কেন ঘিরে ধরল তিনজনে ব্রজেনকে, নিজেরাই জানে না। শুধু ব্ৰজেনের মুখে যেন ওরা কী দেখতে পেয়েছে। দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছে। যদি কিছু জানে ব্ৰজেন, বলুক। ঘোচাক সন্দেহ।

ব্ৰজেন হাঁপাচ্ছে। এই শীতে ওর একটিমাত্র পাতলা জামার বোতাম খোলা। প্যান্টটা জুতো ছাড়িয়ে নেমে গিয়েছে, ধুলোয় লুটোচ্ছে, যেন খুলে পড়বে এখনি। সেটাকে ও ধরে আছে এক হাতে। সারা গায়ে ধুলো মাখা, যেন কোথায় গড়িয়ে এসেছে। ভয় নয়, চোখে ওর অস্থির উন্মাদ অস্বাভাবিক চাহনি।

বেসুরো ভাঙা গলায় দ্রুত বলল, কী, কী চাও তোমরা? বিজু, বিজুর খবর? বিজু। বিজু। ওই নামটা ওরা কারও মুখ থেকে শুনতে চায় না। দাঁতে দাঁত চেপে ওরা তাকিয়ে রইল ব্ৰজেনের দিকে। যদিও চোখে ওদের বিস্ময় চাপা থাকছে না। কেবল প্রভাতের হাতে ছুরিটা চকচক করছে। যেন সময় হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সে।

আবার, একই গলায় আরও তীব্রভাবে বলল ব্ৰজেন, বিজুর খবর চাও তোমরা? বিজুর? বলতে বলতে ওর উন্মাদ চোখ দুটোতে হঠাৎ জল দেখা গেল। আর দু হাত বাড়িয়ে ধরল প্রভাতের হাত। প্রায় ক্রুদ্ধ গর্জনের সুরে বলল, তবে মারো, মারো, আমাকে মারো।

ওরা তিনজনেই যেন দারুণ বিস্ময়ে একটা ভয়ংকর কিছুর কাছ থেকে সরে দাঁড়াল।

ব্ৰজেনের গলা ক্রমেই অতলে ডুবতে লাগল। তবু অস্থির গলায় বলল, হ্যাঁ, আমি, আমিই সে-ই। আমাকে তাড়াতাড়ি মারো, মেরে ফেললো। আমি, আমি সে-ই। আমি তাকে তিনমাস আগে সাতশো টাকা দিয়েছিলাম। সে আমার কাছে এসে চেয়েছিল। নইলে তার বাপকে, তার মা-ভাইবোনকে বাড়িওয়ালা এক রাত্রে বাইরে বার করে দিত। দু বছরের বাড়িভাড়া, আমি তাকে দিয়েছিলাম একটা শর্তে। যে-শর্তে আমি তার পেছনে ছায়ার মতো ঘুরেছি। ছায়ার মতো।

ওরা তিনজনেই যেন ওঁত পেতে দাঁড়াল ব্ৰজেনকে টুকরো টুকরো করবার জন্য। ব্ৰজেনের গলা সহসা আরও চড়ল। বলল, মারো, প্রভাত, শঙ্কর, নরেশ, মারো আমাকে। আমি সেই, বিজু যাকে সবচেয়ে বেশি ঘেন্না করত, যার কাছে শুয়ে তাকে মরার যন্ত্রণা পেতে হয়েছিল। যার ঠোঁটে, মুখে সে থুথু দিয়েছিল, অভিশাপ দিয়েছিল। তবু তার নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়েছিল; আমি সেই, যে তাকে তবু লোভীর মতো ছিঁড়ে খেয়েছে, অনেকদিনের লালসায়। আমি সেই, যে তাকে শেষবারের মতো মেরেছে। মারো, মারো আমাকে।

কিন্তু খুনের নেশা কোথায় গিয়েছে তিনজনের। একটা অবিশ্বাস্য ভয়ংকর কাহিনী শুনে তিনজনেই যেন চলচ্ছক্তিরহিত, বিহ্বল হয়ে গিয়েছে। শুধু একটা উন্মাদ জন্তু, তাদের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মৃত্যুভিক্ষা করছে।

মৃত্যুভিক্ষার আর্তনাদ ওরা শুনছে, কিন্তু এখনও যেন সেই বিজুই ওদের হাত ধরে রেখেছে, যে। তাদের সব পঙ্কিলতা আর পাঁশ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। মনে হল, ব্রজেনকে খুন করার নিষ্ঠুরতাকে বিজুই যেন দু হাত দিয়ে আগলে ধরে রেখেছে। ওরা দেখল, সেই পাঁশ-আস্তীর্ণ ত্রিভুজের ভিটেটায় এখনও ফুলটা ফুটে আছে, অম্লান।

সহসা ব্ৰজেনের গলার স্বর মোটা আর স্পষ্ট শোনাল। বলল, মারতে পারলে না তোমরা। আমি কাল রাত্রি আটটা থেকে চব্বিশ ঘণ্টা বাঁচবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। ঘুরেছি, সে বেঁচে থাকলে আজীবন তার পিছে পিছেই ঘুরতাম।

আবার ওর চোখে সেই উন্মাদ ভাব পুরোপুরি ফিরে এল। প্যান্ট হেঁচড়ে হেঁচড়ে, টলতে টলতে চলে গেল। গেল সামনের ঝুপসি জঙ্গলের দিকে।

ওরা তিনজন তখনও তেমনি দাঁড়িয়ে। তখনও ওদের নড়বার ক্ষমতা ছিল না। হয়তো ব্ৰজেন রেল-লাইনেই মরতে গেল। যাক। ওরা ফেরাতে যাবে না। কারণ, ওদের বুকের মধ্যে তখন ফেটে পড়ার একটা ভয়ংকর যন্ত্রণা টনটন করছে। তিনটি বুকে বিজুই তখন ফিসফিস করে যেন বলছে, কেন, কেন বিজু মরেছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *