মানুষ-খেকো বিড়াল

মানুষ-খেকো বিড়াল

বন্দর থেকে একটা খবরের কাগজ কিনেছিলাম। ওখানে এক বৃদ্ধ মহিলা সম্পর্কে একটা নিবন্ধ পড়েছিলাম যাকে বিড়ালেরা খেয়ে ফেলেছিল। বৃদ্ধার বয়স ছিল ৭০ বছর। এথেন্সের একটা ছোট্ট শহরতলীতে থাকতেন তিনি। খুব সাদাসিধে ছিল তার জীবনযাত্রা। একটা অ্যাপার্টমেন্টের ছোট্ট একটা ঘরে ছিল তার বাস। তিনটি বিড়াল ছাড়া তার সংসারে আর কেউ ছিল না। একদিন হঠাৎ তিনি সোফার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যান। সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। পড়ে যাওয়ার কতক্ষণ পর তার মৃত্যু হয়েছিল কেউ বলতে পারেনি। বৃদ্ধার আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না যারা নিয়মিত তার ওখানে যাতায়াত করত। ফলে তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে সপ্তাহখানেক লেগে যায়। দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় বিড়ালগুলো ওই ঘরে আটকা পড়ে। সেখানে খাবার-দাবার কিছু ছিল না। ফ্রিজের ভেতর হয়ত খাদ্যবস্তু কিছু ছিল; কিন্তু বিড়ালেরা ফ্রিজ খোলার কোনো উপায় উদ্ভাবন করতে পারেনি। না খেয়ে মরবার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য বাধ্য হয়ে তারা তাদের মৃত মালকিনের মাংস ভক্ষণ করে।

আমার অদূরে বসে থাকা ইজুমিকে নিবন্ধটা পড়ে শোনাচ্ছিলাম। রোদেলা দিনগুলোতে আমরা বন্দর থেকে এথেন্সের ইংরেজি দৈনিকের একটা কপি কিনি। ট্যাক্স-অফিসের পাশের কফিশপে কফির অর্ডার দেই। তারপর জাপানি ভাষায় চমকপ্রদ বিষয়গুলোর একটা সারসংক্ষেপ দাঁড় করাই। দ্বীপ-জীবনে এটা আমাদের নিত্যদিনের কাজের একটা অংশ। বিশেষ কোনো নিবন্ধের ওপর আমাদের আগ্রহ থাকলে তা নিয়ে আমরা মত বিনিময় করি। ইংরেজির ওপর ইজুমির দখল বেশ ভাল। নিজে নিজেই সব কিছু পড়তে পারে; কিন্তু তাকে একা কখনো পত্রিকা পড়তে দেখিনি।

“আমি সব সময়ই চেয়েছি কেউ একজন আমাকে পত্রিকা পড়ে শোনাক।” বলে ইজুমি, “ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল রোদে বসব, আকাশ কিংবা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকব আর তখন কেউ আমাকে জোরে জোরে পড়ে শোনাবে, হতে পারে তা খবরের কাগজ, পাঠ্যবই কিংবা উপন্যাস। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ তা করেনি। কাজেই অতীতে হারানো ওই সুযোগের সবটা এখন তুমি আমাকে পুষিয়ে দেবে। তাছাড়া তোমার কণ্ঠস্বরও আমার খুব প্রিয়।”

আকাশ আর সমুদ্র আমাদের কাছেই ছিল। অতএব দেরি না করে আমি জোরে। জোরে পড়ার মজা উপভোগ করতে লাগলাম। জাপানে থাকার সময় আমার ছেলেকে প্রায়ই জোরে জোরে ছবির বই পড়ে শোনাতাম। বাক্যগুলোতে নিছক চোখ বুলিয়ে যাওয়া থেকে উচ্চস্বরে পাঠ করার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা বিষয়। আপনার মনের মধ্যে অপ্রত্যাশিত একটা কিছু উছলে উঠবে, অব্যাখ্যাত এক ধরনের সাড়া আমি অনুভব করেছিলাম যা রোধ করা অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে।

তেতো কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিবন্ধটা পড়ে শোনাচ্ছিলাম তাকে। নিজে নিজে কয়েকটা লাইন পড়ে জাপানিতে তা কিভাবে প্রকাশ করব তা ভেবে উচ্চস্বরে অনুবাদ করছিলাম। আমাদের আগের কোনো অতিথির ফেলে যাওয়া জ্যাম টেবিলের ওপর থেকে মুখে তুলে নেয়ার জন্য কয়েকটা মৌমাছি আনাগোনা করছিল ওখানে। পুরো নিবন্ধটা পড়া শেষ হয়ে গেলে টেবিলে কনুই রেখে ইজুমি ঠায় বসে রইল। দু’হাতের আঙ্গুলগুলো জড়াজড়ি করে ঢুকিয়ে তাঁবুর একটা আদল তৈরি করে জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হলো। পত্রিকাটি ভাজ করতে করতে বললাম, “তারপর আর। কি।”

“বিড়ালগুলোর কী হলো?”

“কাগজে কিছু লেখেনি।”

“দুনিয়ার সব জায়গার কাগজ একই ধরনের। যা তুমি জানতে চাও তা লিখবে না কখনো।”

ইজুমি সালেম সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে খুঁজে ম্যাচ জ্বালাল। রোজ সে এক প্যাকেট সালেম খায়- কমও না বেশিও না। আমি ধূমপান করি না। স্ত্রী গর্ভবতী থাকার সময় আমাকে সিগারেট ছাড়িয়ে দিয়েছিল সে।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইজুমি বলল, “যা আমি জানতে চাই তা হলো, পরে বিড়ালগুলোর কী হয়েছিল? নরমাংস ভক্ষণের দায়ে কর্তৃপক্ষ কি ওদের মেরে ফেলেছিল, নাকি- বড় দুঃসময় গেছে তোদের এ কথা বলে একটুখানি আদর করে বিদায় দিয়েছিল? তোমার কী ধারণা?”

টেবিলের ওপর গুঞ্জরনরত মৌমাছিগুলোর দিকে তাকালাম। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, টেবিলের ওপর থেকে মৌমাছিদের জ্যাম তুলে খাওয়া আর বিড়ালদের নরমাংস ভক্ষণ একই ব্যাপার। দুর থেকে ভেসে আসা শঙ্খচিলের কর্কশ চিৎকার মৌমাছির গুঞ্জনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার চৈতন্য বাস্তব আর অবাস্তবের প্রান্তসীমায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। মনে হলো, কোথায় ছিলাম আমি? এখানেই বা কী করছি? অবস্থাটা ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না। দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলাম। আকাশের দিকে তাকালাম, তারপর ইজুমির দিকে ফিরে বললাম, “ওই ব্যাপারে আসলে আমার কোনো ধারণাই নেই।”

“ব্যাপারটা নিয়ে ভাবো একবার। তুমি যদি নগরীর মেয়র কিংবা পুলিশ প্রধান হতে, তাহলে বিড়ালগুলোর ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিতে?”

আমি বললাম, “সংশোধনের জন্য তাদের কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠানো যেত হয়ত, যাতে তারা নিরামিষভোজীতে পরিণত হতে পারে।” আমার কথায় হাসল না ইজুমি, সিগারেট দীর্ঘ টান দিয়ে ধীরে ধীরে ধোয়া ছাড়তে লাগল।

“গল্পটা আমাকে একটা লেকচারের কথা মনে পড়িয়ে দিল। ক্যাথলিক জুনিয়র হাই স্কুলে ক্লাস শুরু করার ঠিক আগে গল্পটা শুনেছিলাম। তোমাকে বলেছিলাম নাকি একটা কড়া ক্যাথলিক স্কুলে পড়তে হয়েছিল আমাকে? প্রবেশিকা পরীক্ষার ঠিক পরে প্রধান শিক্ষয়িত্রী আমাদের সবাইকে ডেকে জড়ো করলেন, তারপর মঞ্চে গিয়ে ক্যাথলিক ধর্মের ওপর বিরাট এক বক্তৃতা ঝাড়লেন। অনেক কথাই তিনি বলেছিলেন; কিন্তু একটা কথাই আমার মনে আছে তা হলো জাহাজডুবির পর একটা বিড়াল নিয়ে দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ।” বলল ইজুমি।

“মনে হয় খুব ইন্টারেস্টিং ছিল ব্যাপারটা।” আমি বললাম। সে বলল, “তিনি আমাদের বললেন, “জাহাজডুবি হয়েছে। লাইফবোটে শুধু তুমি আর তোমার বিড়াল। একটা অজানা দ্বীপে এসে আশ্রয় নিয়েছ তোমরা। ওখানে কোনো খাবার দাবার নেই। শুধু পানি আর একজনের দিন দশেক চলার মতো শুকনো বিস্কুট। অবস্থার কথাটা ভাবো সবাই একবার। চোখ বন্ধ করে ছবিটা একবার কল্পনা কর। দ্বীপে আর কেউ নেই, তুমি আর তোমার বিড়াল। তোমার খাবার প্রায় শেষ। খুব ক্ষুধার্ত তুমি, তৃষ্ণার্ত, প্রায় মরার দশা হয়েছে তোমার। তখন কী করবে তুমি। তোমার শেষ খাবারটুকু থেকে কি বিড়ালটিকে একটু দেবে? না, ঠিক হবে না তা। কিছুতেই দেবে না তুমি। দেওয়াটা মস্ত বড় ভুল কাজ হবে : কারণ তোমরা প্রাণী হিসেবে অনেক মূল্যবান, ঈশ্বর-ই এটা নির্ধারণ করেছেন। বিড়াল কিন্তু সেরকম না। কাজেই সব খাবার একাই তুমি খাবে।” এ কথা বলে শিক্ষয়িত্রী আমাদের দিকে কঠিন চোখে তাকালেন। আমি খানিকটা দুঃখ পেলাম। সবে স্কুলে পড়তে এসেছে। এমন শিশুদের এ ধরনের গল্প বলার কী কারণ থাকতে পারে? মনে মনে ভাবলাম। এ কেমন জায়গায় এসে পড়েছি আমি?

গ্রিসের একটি ছোট্ট দ্বীপে একটা অ্যাপার্টমেন্টে আমি আর ইজুমি থাকি। তখন ট্যুরিস্টদের মৌসুম ছিল না আর ওই জায়গাটা কোনো ট্যুরিস্ট স্পট নয় বলে ভাড়াও কম। ওখানে যাওয়ার আগে আমরা কেউ-ই ওই জায়গার নাম শুনিনি। এলাকাটি তুর্কি সীমান্তের কাছাকাছি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে তুরস্কের সবুজ পাহাড় দেখা যায়। খুব বাতাস থাকলে স্থানীয় লোকজন ঠাট্টা করে বলে শিশ কাবাবের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।

শহরের কেন্দ্রস্থলে গ্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বীরের ভাস্কর্য আছে। ইজুমি আর আমি ক্যাফের বাইরে বসে কফি কিংবা বিয়ার পান করার সময় উদ্দেশ্যহীনভাবে বন্দরের নৌকা আর দূরের তুর্কি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। জায়গাটা ইউরোপের এক কোণায় অবস্থিত।

মাস দুয়েক আগেও আমি স্ত্রী ও পুত্রসহ টোকিওর উনোকিতে থাকতাম। খুব বড় সড়ড়া জায়গা নয়, তবে কাজ চালিয়ে নেয়া যেত। আমার ও আমার স্ত্রীর আলাদা। শোবার ঘর ছিল। ছেলেটার জন্যও একটা রুম ছিল। আর একটা রুম আমি স্টাডি হিসেবে ব্যবহার করতাম। অ্যাপার্টমেন্টটা ছিল কোলাহলহীন আর ওখান থেকে চমৎকার দৃশ্যও দেখা যেত। সপ্তাহান্তে আমরা তিনজনে মিলে তামা নদীর ধারে ঘুরে বেড়াতাম। বসন্তে নদীর তীরে চেরি ফুল ফুটত। আমি আমার ছেলেকে মোটর বাইকের পেছনে বসিয়ে টোকিও জায়ান্টস ট্রিপল এ টিমের বসন্তকালিন প্রশিক্ষণ দেখিয়ে আনতাম।

মধ্যম মানের একটা ডিজাইন কোম্পানিতে কাজ করতাম আমি। বই আর ম্যাগাজিনের লে-আউট তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ছিল ওরা। আমার বস ছিলেন খুব ভাল লোক। সহকর্মীদের সাথে আমার সম্পর্কও ভাল ছিল। বেতন খারাপ ছিল না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ওই কোম্পানিতে ভবিষ্যত ভালই ছিল আমার। আর আমার জীবনটা মোলদাও নদীর মতো দ্রুত বয়ে যেত সমুদ্রের দিকে…।

কিন্তু আমার সঙ্গে ইজুমির দেখা হয়ে গেল।

.

ইজুমি আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। ব্যবসা সংক্রান্ত একটা সভায় তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। প্রথম চোখাচোখির সময়ই সম্ভবত প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমরা। সচরাচর এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। তারপর আমাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয় বেশ কয়েকবার। তখন আমাদের যৌথ-প্রকল্প নিয়ে আলাপ হয় তার সাথে। আমি তার অফিসে যেতাম, সে-ও আসত আমার অফিসে। আমাদের দেখা-সাক্ষাগুলো হতো অল্প সময়ের জন্য, সেখানে অন্য লোকজনও এসে পড়ত আমাদের মধ্যে। সবই ছিল ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপার।

আমাদের প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলে সাংঘাতিক রকমের নিঃসঙ্গতার ভেতর পড়ে যাই আমি। মনে হতো জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক অনেক কিছু আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। গত দশ বছরে এ রকম অনুভূতি আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। আমার ধারণা ওর-ও তেমনি হয়েছিল।

সপ্তাহখানেক পরে সে আমাকে ফোনে তার অফিসে ডাকে। আমরা কিছুটা সময় আড্ডা দেই। আমি একটা জোক বললে সে হাসে। আমি বলি, “চলো কোথাও গিয়ে একটা কিছু পান করি। আমরা ছোট একটা বার-এ গিয়ে ঢুকি ও সামান্য পান করি। ঠিক মনে নেই কী নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল, তবে লক্ষ লক্ষ বিষয় আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম যা নিয়ে আমরা সারাজীবন কথা বলতে পারি। আমরা দুজনেই ছিলাম বিবাহিত। বিবাহিত জীবন নিয়ে কারও কোনো গুরুতর অভিযোগ ছিল না। আমরা আমাদের পতি/পত্নীদের ভালবাসতাম ও শ্রদ্ধা করতাম।

কিছু একটা পান করার জন্য আমরা নিয়মিত বাইরে যেতে শুরু করলাম। চাকরির কারণে তার স্বামী দেরিতে বাড়ি ফিরতেন, ফলে যে কোনো সময় আসতে ও ফিরে যেতে পারতাম। আমাদের দেখা হলে সময় দ্রুত পার হয়ে যেত। যখন ঘড়ি দেখতাম, মনে হতো শেষ ট্রেন হয়ত মিস করব। তাকে বিদায় জানানোর সময়ও আমার হাতে থাকত না। কারণ আমাদের বিস্তর কথা জমে থাকত, এতো অল্প সময়ে যা বলে শেষ করা যেত না।

আমরা কেউ-ই বিছানায় যেতে একে অপরকে প্রলুব্ধ করিনি, তারপরও আমরা শয্যায় যাওয়া শুরু করলাম। সেই সময় পর্যন্ত আমরা পত্নী/পতির প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম। যে কোনো ভাবেই হোক আমাদের মধ্যে কোনো পাপবোধ ছিল না; কারণ, আমরা জানতাম এটাই বাস্তবতা। তার শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেলা, শরীর দলাই মলাই করা, জড়িয়ে ধরা ইত্যাদি আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তারই অংশ বিশেষ ছিল। কাজেই আমাদের ওই দেহ-মিলন হৃদয়-ঘেঁষা কোনো শরীরী আনন্দমাত্র ছিল না; এটা ছিল সুন্দর সুস্থ আর চমৎকার একটা কাজ, কোনো রকম ভান বা ভণ্ডামির স্থান সেখানে ছিল না। দেহ-মিলনের আনন্দের পর আমরা শুয়ে শুয়ে অনেক কথা বলতাম। আমি তার নগ্ন শরীর জাপটে ধরে রাখতাম, সে আমার দু’হাতের ভেতর লুটিয়ে পড়ত; আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত গোপন ভাষায় ফিসফিস করে কথা বলতাম।

যখন ইচ্ছে তখনই আমরা মিলিত হতাম। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, হয়ত অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আমরা বিশ্বাস করতাম আমাদের ওই সম্পর্ক চিরস্থায়ী হবে। সমীকরণের একদিকে ছিল আমাদের দু’জনের বিবাহিত জীবন, অন্যদিকে আমাদের দুজনের সম্পর্ক, কোনো সমস্যাই তৈরি করেনি। আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমাদের সম্পর্কের কথা কেউ কোনোদিন জানবে না। হা দৈহিক মিলন ঘটেছিল আমাদের মধ্যে; কিন্তু তাতে তো কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। যে-রাতে ইজুমির সাথে বিছানায় যেতাম, বাড়ি ফিরতে দেরি হতো আমার, আর এ জন্যে স্ত্রীর কাছে মিথ্যে বলতে হতো আমাকে। বিবেকের দংশনও সইতে হয়েছে; তবে কখনোই। আমার মনে হয়নি এটা সত্যিকারের একটা বিশ্বাসঘাতকতা। ইজুমি ও আমার মধ্যেকার সম্পর্কটি কঠোরভাবে শ্রেণীবদ্ধ হলেও তা ছিল সম্পূর্ণরূপে অন্তরঙ্গ আর আন্তরিক।

এর ভেতর আর কিছু না ঘটলেও এইভাবেই আমরা সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম। ভোদকা পান করতাম মাঝে মধ্যে, আর যখন ইচ্ছে তখন বিছানায় যেতাম। অথবা নিজ নিজ পতি/পত্নীদের সাথে থেকে থেকে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওই সম্পর্কের স্বাভাবিক মৃত্যু কামনা করতে পারতাম যাতে আমরা আমাদের। আরামদায়ক ক্ষুদ্র জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারি। আমার ধারণা এ রকম ঘটলে খারাপ হতো না। প্রমাণ করতে পারব না, তবে ওই রকম অনুভব আমার মধ্যে ছিল। কিন্তু ভাগ্য এসে বাধ সাধল। ইজুমির স্বামী আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটি আঁচ করে ফেললেন। তাকে আটকে রেখে তিনি এলেন আমার বাড়িতে, নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না তার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তখন আমার স্ত্রী বাড়িতে ছিল, ফলে ব্যাপারটা কুৎসিত আকার ধারণ করল। বাড়ি ফেরার পর স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করল, কী ঘটছে এসব? ইজুমি এর মধ্যেই সবকিছু স্বীকার করে ফেলেছিল, ফলে কোনো রকম গল্প ফেঁদে বসার সুযোগ আমি পেলাম না। যা যা ঘটেছিল সবই বলে দিলাম স্ত্রীকে। “ভালবেসে ফেলেছিলাম ব্যাপারটা আসলে এ রকম ছিল না, আমি ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করে বললাম, “বিশেষ ধরনের এক সম্পর্ক বলা যায়, তোমার-আমার মধ্যেকার যে-সম্পর্ক তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দিন আর রাতের মতো। তুমি কিছুই টের পাওনি, তাই না? তার মানে হচ্ছে যে, তুমি যে-রকম সম্পর্কের কথা ভাবছ, আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন ছিল না।”

আমার স্ত্রী কোনো কিছুই কর্ণপাত করল না। ওটা বিরাট আঘাত ছিল তার জন্য এবং সে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। আমার সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো বাক্যালাপে গেল না। পরের দিন সকালে সে মালপত্র সব প্যাক করে গাড়িতে ওঠাল, আর আমার ছেলেকে নিয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দিল, গন্তব্য চিকাসাকিতে অবস্থিত তার পিত্রালয়। বেশ ক’বার ফোন করলাম তাকে। ধরল না। শেষে ফোন ধরলেন তার বাবা। বললেন, “তোমার কোনো খোঁড়া যুক্তি শোনার ইচ্ছে আমার নেই। তোমার মতো বেজন্মার ঘরে আমার মেয়েকে ফেরৎ পাঠাতে চাইনে।” প্রথম থেকেই আমাদের বিয়েতে ঘোর আপত্তি ছিল তার। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো, তিনি তার আপত্তির যথার্থতা খুঁজে পেয়েছেন এবার।

হতাশ হয়ে আমি কয়েকদিন ছুটি নিলাম আর বিছানায় শুয়ে রইলাম একা একা। ইজুমির ফোন এলো। সে-ও একা। তার স্বামীও তাকে ত্যাগ করেছেন। তবে তার আগে তাকে কিছু উত্তম-মধ্যম দিয়ে গেছেন তিনি আর একটা কাঁচি দিয়ে ওর সব কাপড়-চোপড় কেটে নষ্ট করে দিয়েছেন। স্বামী রত্নটি কোথায় গেছেন তা সে জানে না। সে বলল, “আমি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। কী করব বুঝতে পারছি না, সব শেষ হয়ে গেছে। সে আর ফিরবে না।” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। সে আর তার স্বামী ছোটবেলাকার প্রেমিক-প্রেমিকা। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম; কিন্তু এখানে আমার কী-ই বা বলার ছিল?

শেষে ইজুমি বলল, “চলো কোথাও গিয়ে একটা কিছু পান করি। আমরা শিবুইয়াতে গেলাম আর সারারাত ধরে মদ পান করলাম। কতটা পান করেছিলাম তার হিসাব আমার কাছে ছিল না। ওর সাথে পরিচয়ের পর এই প্রথম বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। ভোরবেলা হারাজুকু এলাকায় হেঁটে হেঁটে মদের প্রভাব কাটিয়ে উঠলাম আমরা। তারপর ডেনিতে গিয়ে কফি সহযোগে নাশতা করলাম। আর তখনই গ্রিসে যাওয়ার মতলবটা ওর মাথায় এল।

“গ্রিসে যাবে?”

“জাপানে থাকা কোনো মতেই আর সম্ভব নয়।” আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে।

আইডিয়াটা আমার মনের মধ্যে খেলালাম আমি। কিন্তু ভোদকা-আক্রান্ত আমার মস্তিষ্ক যুক্তিটা গ্রহণ করতে পারল না।

“গ্রিসে যাওয়ার ইচ্ছে আমার বরাবরই ছিল।” বলল সে, “আমার স্বপ্ন ছিল ওই দেশটা। হানিমুন করতে চেয়েছিলাম ওখানে; কিন্তু টাকার অভাবে যেতে পারিনি। চল এখন আমরা দুজনে মিলে যাই। আমরা থেকে যাব ওখানে। ওখানে আমাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা থাকবে না। জাপানে থাকলে বিষণ্ণতায় ভুগব আমরা, ভাল কিছু হবে না এখানে।”

গ্রিসে নির্দিষ্ট কোনো আগ্রহের বিষয় ছিল না আমার। তবে তার সঙ্গে একমত পোষণ করলাম। হিসাব করে দেখলাম আমাদের হাতে কত টাকা আছে। ওর সঞ্চয়ে ছিল ২৫ লাখ ইয়েন আর আমার হাতে ছিল ১৫ লাখ ইয়েন। সব মিলিয়ে ৪০ লাখ ইয়েন। অর্থাৎ ৪০ হাজার ডলার।

ইজুমি বলল, “ওই টাকা দিয়ে গ্রিসের কোনো গ্রামে বেশ ক’ বছর থাকা যাবে। বিমানের টিকেটের জন্য খরচ হবে ৪ হাজার ডলার।” আমি তখন চারপাশে তাকালাম। ভোরের ডেনিতে যুবক-যুবতীদের ভিড়। আমরাই একমাত্র দম্পতি যাদের বয়স তিরিশের ওপরে, আর তারা বিপর্যয়ে ভরা ঘটনাবলীর পরে গ্রিসে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। কী করুণ অবস্থা, ভাবলাম আমি। দীর্ঘ সময় ধরে নিজের করতল পর্যবেক্ষণ করলাম। এটাই কী আমার ললাট লিখন? ঠিক আছে, দেখাই যাক না!

.

পরের দিন অফিসে গিয়ে পদত্যাগ পত্র জমা দিলাম। আমার বস আমার সম্পর্কে নানা রকম গুজব শুনেছিলেন। তিনি আমাকে কিছুদিনের ছুটি দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি সবকিছু গোছগাছ করে ফেললাম। মাঝারি সাইজের নীল রঙের একটা সামলোনাইট স্যুটকেস জোগাড় করে ফেললাম। ইজুমিও আমারই মতো ব্যাগেজ সঙ্গে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

বিমানে মিসরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় একটা আশঙ্কা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলল- ভুলক্রমে কে যেন আমার স্যুটকেস নিয়ে গেছে। পৃথিবীতে হাজার হাজার নীল রঙের স্যামসোনাইট স্যুটকেস আছে। গ্রিসে গিয়ে ওই রকমের একটা স্যুটকেস আমার হাতে আসবে, খুলে দেখব সেখানে অন্য লোকের জিনিস। স্যুটকেসটি খোয়া গেলে ইজুমি ছাড়া আমার নতুন জীবনের সাথে কোনো সংযোগই থাকবে না। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি উধাও হয়ে গেছি। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। বিমানে যে লোকটি বসেছিল সে আমি নই। আমার মস্তিষ্ক সুবিধাজনক কিছু বোচকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে যা দেখতে আমার মতো। মনের ভেতর বিশৃঙ্খলা। জাপান ফিরে যেতে হবে আমাকে, তারপর নিজের শরীরখানা ফিরে পেতে হবে। কিন্তু এখন জেট বিমানে মিসরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি, কোথাও ফেরার উপায় নেই। শরীরের রক্ত মাংস হাড় যেন প্লাস্টারের তৈরি। প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে লাগলাম আমি। সেই কাঁপুনি কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিমানের ভেতর গলগল করে ঘামতে লাগলাম। শার্ট গায়ের সঙ্গে এঁটে গেছে। শরীর থেকে বেরুচ্ছে অদ্ভুত গন্ধ। ইজুমি দৃঢ়ভাবে আমার হাত ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে বুকে জড়িয়ে ধরছে আমাকে। কোনো কথা বলছে না সে; কিন্তু বুঝতে পারছে আমার মনের মধ্যে কী চলছে। ওই রকম কম্পন চলল প্রায় আধা ঘন্টা। মরতে চেয়েছিলাম আমি। কানের কাছে রিভলভার ধরে ঘোড়া টিপে দিয়েছিলাম যাতে শরীর মন উভয়ই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়…।

এক সময় কম্পন থেকে যায়। খুব হালকা অনুভূতি আসে আমার মধ্যে। গভীর নিদ্রায় ডুবে যাই। যখন চোখ মেলে তাকাই, দেখি আমার নিচে এজিয়ান সাগরের আকাশি রঙের জল।

.

দ্বীপটিতে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ওখানে করবার মতো কিছুই ছিল না। ওখানে কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না। সিনেমা হল বা টেনিস কোর্ট ছিল না। ছিল বইপত্র বা পত্রিকার অভাব। আমরা এতো তাড়াহুড়ো করে জাপান ছাড়ি যে, সঙ্গে তেমন বই আনতে পারিনি। এয়ারপোর্ট থেকে দু’টো উপন্যাস কিনেছিলাম আর ছিল ইজুমির সংগ্রহ করা এস্কেইলাসের ট্র্যাজেডির একটি সংগ্রহ। ওগুলো দু’বার করে পড়ে ফেলেছিলাম।

ইজুমি গ্রিক ভাষা শিখতে শুরু করেছে। দোকানদার বা কফিশপের ওয়েটারদের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা গ্রিসে সে এখন কথা বলতে পারে। ফলে আমাদের একটা পরিচিত গণ্ডি তৈরি হয়েছে।

কাজকর্ম না-থাকায় আমরা এখন সর্বত্র ঘুরে বেড়াই। বন্দরে গিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করি; কিন্তু মাছ পাই না। মাছ যে নেই তা নয়। ওখানকার পানি এত স্বচ্ছ যে মাছেরা চোখ মেললেই স্পষ্ট দেখতে পায় কারা তাদের ধরতে চাচ্ছে।

আমি একটা স্কেচবুক কিনেছি। দ্বীপের এখানে-ওখানে ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য কিংবা মানুষের মুখ আঁকবার চেষ্টা করছি ওয়াটার কালারে। ইজুমি সব সময় আমার পাশে বসে ছবি আঁকা দেখে আর গ্রিক ধাতুরূপ মুখস্ত করে। সে বলে, “পোর্ট্রেট এঁকে আয় করবার ব্যবস্থা করা যায় তো। ভালই তো আঁক। সত্যটা তুলে ধর, তুমি একজন জাপানি শিল্পী…।”

আমি তার কথা শুনে হাসি। এ বাবদে সে ভীষণ সিরিয়াস। একদিন সে বলল, “আমি জাপানি ট্যুরিস্টদের গাইড হতে পারি। ভবিষ্যতে এখানে আরও অনেক জাপানি পর্যটক আসবে, যা আমাদের জন্য হবে লাভজনক। তবে গ্রিক ভাষাটা আমাকে আরও ভাল করে শিখতে হবে।”

আমি বলি, “কিছু না করে আড়াই বছর এখানে থাকা যাবে বলে তোমার মনে হয়?”

“খারাপ কিছু না ঘটলে বা অসুখ বিসুখ না হলে অবশ্যই থাকা যাবে। তবে অপ্রত্যাশিত সবকিছুর জন্য তৈরি থাকতে হবে আমাদের।”

আমি বললাম, “এ যাবৎ তো আমি কোনো ডাক্তারের কাছেই যাইনি।” ইজুমি সরাসরি আমার দিকে তাকাল। ঠোঁট সংকুচিত করে বলল, “ধর আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লাম। তখন কী করবে? সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থাটাতো নিতে হবে, তাই না? তা যদি হয় তাহলে আমাদের টাকা-পয়সা ফুরিয়ে যাবে।”

“এ রকম কিছু হলে জাপানে ফিরে যাব আমরা।” আমি বললাম। সে বলল, “ওরকম কিছু করবে না তুমি। কিছুতেই জাপানে ফিরে যাব না আমরা।”

.

ইজুমি তার গ্রিক ভাষা শিক্ষা অব্যাহত রাখল আর আমি অংকন বিদ্যা চালিয়ে গেলাম। এটাই ছিল আমাদের সারা জীবনের মধ্যে সবচেয়ে শান্তিময় সময়। আমরা সাধারণ খাবার খাই, সস্তা মদ পান করি। প্রতিদিন নিকটবর্তী পাহাড়ে উঠি। পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটি গ্রাম। ওখান থেকে আমরা দূরের দ্বীপ প্রত্যক্ষ করি। তাজা বাতাস আর ব্যায়াম করার ফলে শিগগিরই আমার স্বাস্থ্য ফিরে আসে। সূর্য ডুবে গেলে দ্বীপটি নিঝুম হয়ে আসে। সেই নৈঃশব্দ্যের ভেতর আমরা নীরবে সঙ্গম করি আর দুনিয়ার তাবৎ বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলি। তখন মানুষ খেকো বিড়ালের কথা ওঠে। আমি বলি, যখন আমি ছোট ছিলাম আমার একটা বিড়াল অদ্ভুতভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিল। “বিড়ালের উধাও হওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। বিশেষত গরমের সময় এমন হয়। তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে আর বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেলে।” বলল ইজুমি। সে তার দ্বিতীয় সালেম সিগারেটটি ধরিয়ে বলল, “তোমার সন্তানের কথা ভাব কি মাঝে মধ্যে?”

“কখনো কখনো ভাবি। সব সময় না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যায় ওর কথা।”

“তাকে দেখতে ইচ্ছে হয়?”।

“মাঝে মধ্যে হয়।” বলি আমি। কিন্তু ওটা মিথ্যে কথা। আমি কেবল ভেবেছিলাম, ওই ভাবেই ব্যাপারটা অনুভব করা উচিত। ছেলের সঙ্গে যখন থাকতাম মনে হতো ও হচ্ছে আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটা কিছু। বাড়িতে ফিরেই আমি প্রথমে ওর ঘরে যেতাম আর ওর ঘুমন্ত মুখটি দেখতাম। কখনো কখনো মনে হতো ওকে বুকে নিয়ে প্রবলভাবে আঁকাই যাতে ও ভেঙে খান খান হয়ে যায়…। এখনও সবই আছে- তার মুখমণ্ডল, তার কণ্ঠস্বর, তার হাঁটাচলা, কার্যকলাপ- কিন্তু সবই দূর এক দেশে। তার ব্যবহৃত সাবানের ঘ্রাণটি এখনও মনে আছে আমার। তার সঙ্গে গোসল করতে আর তার গা ঘষে মেজে দিতে খুব ভাল লাগত আমার।

“জাপানে ফিরে যেতে চাইলে যেতে পার। আমার জন্য ভেবো না। চালিয়ে নিতে পারব আমি।” ইজুমি বলল। মাথা নাড়ালাম আমি। জানি এটা কোনো দিন হবার নয়।

সে বলল, “তোমার ছেলে বড় হয়ে যদি তোমার মতো ভাবে, তাহলে কি হবে? যেন তুমি সেই বিড়াল, যে পাইন বনে হারিয়ে গেছে!” তার কথা শুনে আমি হাসি। বলি, “হতে পারে।” ইজুমি তার সিগারেটের অবশিষ্টাংশ অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিতে দিতে বলে, “চলো বিছানায় গিয়ে শরীরের খেলায় মাতি, কেমন?”

“এখন তো সকাল।” বলি আমি।

“তাতে কী হয়েছে?”

আমি বলি, “না কিছু হয়নি।”

.

মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি ইজুমি নেই। সাড়ে বারোটা বাজে। বাতি জ্বালিয়ে ঘরের চারদিকে তাকাই। ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ্য সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে। অ্যাসট্রেতে দু’টো সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পড়ে আছে। পাশেই সিগারেটের খালি। প্যাকেট। বিছানা ছেড়ে উঠে শোবার ঘরের দিকে যাই। ইজুমি ওখানেও নেই। রান্নাঘর কিংবা বাথরুমেও ছিল না সে। দরজা খুলে আঙ্গিনার দিকে তাকাই। দুটো লাউঞ্জ চেয়ার চমৎকার জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে ডাকি, “ইজুমি, এ্যাই ইজুমি।” কেউ সাড়া দেয় না। আমি জোরে জোরে ডাকি। আমার বুক টিপৃটিপ করতে থাকে। কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। নিজেই ভাবি- এটা কি আমার গলার স্বর? তখনও কোনো উত্তর আসে না। সমুদ্রের দিক থেকে হালকা বাতাস ভেসে আসে। দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে আসি। নিজেকে সুস্থির করার জন্য গ্লাসে মদ ঢালি। একটুখানি।

রান্নাঘরের জানালা গলিয়ে চাঁদের আলো এসে দেয়াল ও মেঝেতে অদ্ভুত আলো ছায়া তৈরি করেছে। গোটা পরিবেশকে প্রতীকী নাটকের দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে। মোটা একটা স্যুয়েটার আর জিন্সের প্যান্ট পরে বাইরে বেরিয়ে আসি। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় ইজুমি হয়ত বাইরে হাঁটতে গেছে। তখন বাতাস ছিল না। কাঁকর বিছানো পথে আমার টেনিস শু’র ক্রমাগত পদবিক্ষেপের শব্দ কানে আসে। ইজুমি সম্ভবত বন্দরের দিকে গেছে। এ ছাড়া তার যাওয়ার জায়গা তো দেখছি না। বন্দরে যাওয়ার একটাই রাস্তা, তাকে আমি পাবোই।

বন্দরে যাওয়ার মাঝ রাস্তায় বাজনার হালকা শব্দ আমার কানে আসে। প্রথমে মনে হয়েছিল এটা হ্যাঁলুসিনেশন। খুব খেয়াল করে শোনার পর বুঝলাম এটা আসলে সুরেলা ধ্বনি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে যতটা সম্ভব সুরটি শোনার চেষ্টা করলাম। কেউ বাজনা বাজাচ্ছে। কিন্তু কী যন্ত্র ওটা? ম্যাভোলিনের মতো লাগছে, ‘জোরবা দ্য গ্রিকে’ অ্যান্থনি কুইন এরকম একটা বাজনা বাজিয়েছিলেন। বাজনাটি কি বাওজুকি? কিন্তু এত রাতে কে এখানে ওই বাজনা বাজাবে?

প্রতিদিন পাহাড়ের ওপরে যে গ্রামটিতে আমরা যাই, বাজনাটা ওখান থেকে আসছে বলে মনে হলো। কী করবো, কোন দিকে যাবো? ইজুমিও তো ওই বাজনা শুনতে পাচ্ছে। মনে হলো, ও যদি ওই বাজনা শুনে থাকে তাহলে তার উৎস খুঁজতে ওদিকেই যাবে।

আমি চৌরাস্তার ডানদিকে মোড় নিলাম। ঢালুর ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। রাস্তার দু’পাশে গাছ-গাছালি ছিল না। ছিল হাঁটু সমান ঝোঁপঝাড়। যতই হাঁটতে লাগলাম সঙ্গীতের শব্দ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। ওই সঙ্গীতে উৎসবের আমেজ ছিল। কল্পনা করলাম পাহাড়ের ওপরের গ্রামটিতে ভোজোৎসব চলছে। মনে। পড়ল, সেদিনই বন্দরে আমরা বরযাত্রীদের একটা মিছিল দেখেছিলাম। ওটা নিশ্চয় বিয়ের ভোজোৎসব।

আর তখনই কোনো রকম হুঁশিয়ারি ছাড়া উধাও হলাম আমি। হয়ত চন্দ্রালোকিত রাত ছিল, মধ্যরাতে বাজছিল বাজনা। প্রতিটি পদক্ষেপেই মনে হচ্ছিল গভীর বালুর ভেতর ডুবে যাচ্ছি আমি। বিমানে মিসরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আমার মনের অবস্থা যে রকম হয়েছিল এখনও সেরকমই অনুভূত হচ্ছে। মুখের ওপর হাত ঘষলাম। কিন্তু ওটা আমার মুখ ছিল না। হাত দুটোও আমার ছিল না। আমার বুক টিপটিপ করছে। শরীর প্লাস্টারের পুতুল। সত্যিকার জীবনের কোনো ভাবাবেগ সেখানে নেই। একটা পুতুল বই কিছুই ছিলাম না আমি যাকে বলিদানের কাজে ব্যবহার করা হবে।

অবাক হয়ে ভাবলাম- সত্যিকার আমি কোথায়?

.

তখন অজ্ঞাত কোনো স্থান থেকে ইজুমির কণ্ঠস্বর ভেসে এল- সত্যিকার তোমাকে বিড়ালেরা খেয়ে ফেলেছে। তুমি যখন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলে ওই ক্ষুধার্ত বিড়ালেরা তোমাকে গ্রাস করেছে। খেয়ে ফেলেছে তোমাকে। হাড়গোড়গুলো শুধু বাকি আছে…।

আমি চারদিকে তাকালাম। এটা নিশ্চয়ই কোনো মায়া। দেখতে পেলাম পাথর ছড়ানো মাঠ, ছোট ঝোঁপঝাড় আর তাদের ছায়া। কণ্ঠস্বরটা ছিল আমার মাথার ভেতর। অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করলাম। উনাকিতে আমার সেই ফ্ল্যাটে ফিরে গেলাম। সংগৃহীত রেকর্ডগুলোর কথা মনে পড়ল। চমৎকার জাজ কালেকশন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের জাজ পিয়ানো বাদকগণ ছিলেন আমার প্রিয় ও লেনি ক্রিস্তানো, আল হেইগ, ক্লদ উইলিয়ামসন, লো লেভি, রুস ফ্রিম্যান… কিন্তু ওসব তো আর নেই। আমি নিজেই সব নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছি। জীবনে আর ওই রেকর্ড শুনতে পাব না আমি।

ইজুমিকে চুম্বন করার সময় যে তামাকের ঘ্রাণ পেতাম, সেই ঘ্রাণ স্মরণে এল। তার ঠোঁট আর জিহ্বা অনুভব করতে পারছি। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার পাশে পেতে চাইলাম তাকে। কামনা করলাম, সে আমার হাত দুটো ধরুক, মিসরের ওপর দিয়ে বিমানে উড়ে যাওয়ার সময় যেমন ধরেছিল।

একটা ঢেউ শেষ অবধি আমার ওপর দিয়ে চলে গেল, সঙ্গে ছিল সঙ্গীত।

তাদের বাজনা কি থেমে গেছে? সে সম্ভাবনা নিশ্চয়ই আছে। যে যা-ই বলুক। রাত এখন একটা।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। মনে হলো হাতে কোনো ঘড়ি নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম। সময়ের ব্যাপারে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না আমার। আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদটি ঠাণ্ডা পাথর, বছরের নানা হাঙ্গামায় এর ছাল বাকল ভক্ষিত হয়েছে। এর উপরিভাগের ছায়া যেন বা একটা কর্কট, তার বিচ্ছিরি খুঁড় বিস্তার করে আছে। চাঁদের আলো লোকেদের মনের সঙ্গে চাতুরি করছে আর বিড়ালদের উধাও করে ফেলেছে। ইজুমিকেও উধাও করে দিয়েছে। হতে পারে সবকিছুই করা হয়েছে সতর্কতার সঙ্গে, যার সূচনা হয়েছিল অনেকদিন আগের একরাতে।

আমি কি চালিয়ে যাব, না যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যাব। কোথায় গেল ইজুমি? তাকে ছাড়া এই নিশ্চল দ্বীপে থাকব কী করে? সে-ই তো ছিল একমাত্র মানুষ যে আমার মতো একজন ভঙ্গুর, অস্থায়ী ব্যক্তিকে আগলে রেখেছিল।

পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগলাম। এখানে কি সত্যিই কোনো বাজনা বেজেছিল? পরখ করে দেখতে হবে, যদি কোনো কু পাওয়া যায়? পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাহাড়ের শীর্ষে আরোহণ করলাম। দক্ষিণ পাহাড়টা সমুদ্রের দিকে নেমে গেছে, তারপরেই বন্দর, নিদ্রিত শহর। উপকূলের রাস্তায় বাতি জ্বলছে। পাহাড়ের অন্য দিকটা অন্ধকারে ঢাকা। কিছুক্ষণ আগে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রাণবন্ত কোনো উৎসবের চিহ্নমাত্র ছিল না সেখানে।

ঘরে ফিরে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি নিলাম। ঘুমুতে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। পূর্বাকাশে আলো না ফোঁটা পর্যন্ত চাঁদের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। তখনই হঠাৎ সেই বিড়ালগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো যারা তালাবদ্ধ অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর না খেয়ে মারা পড়েছিল। সত্যিকার আমার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তারা জীবিত এখনও। আমার মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে। কামড়াচ্ছে আমার হৃদপিণ্ড, রক্ত পান। করছে, গ্রাস করছে আমার পুরুষাঙ্গ। দূরে, দেখতে পেলাম তারা আমার মগজ লেহন করছে। ম্যাকবেথের ডাইনিদের মতো তিনটি কোমল বিড়াল আমার ভাঙা মাথা ঘিরে আছে, হাপুসহুপুস করে খাচ্ছে ভেতরের পুরু স্যুপ। তাদের খসখসে জিহ্বার ডগা আমার মনের নরম ভঁজগুলো লেহন করে চলেছে। এবং প্রতিটি লেহনের সঙ্গে সঙ্গে আমার চৈতন্য অগ্নিশিখার মতো দপদপ করে জ্বলে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *