ব্যাঙ বাঁচালো টোকিও

ব্যাঙ বাঁচালো টোকিও

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে কাটাগিরি দেখলেন বিশাল একটা ব্যাঙ তার জন্য অপেক্ষা করছে। বেশ শক্ত পোক্ত শরীর তার, ছফিট লম্বা পেছনের দুটি পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাটাগিরি ছোটখাটো মানুষ, লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির বেশি হবে না, ব্যাঙের বিশালত্ব দেখে যারপর নাই অবাক হলেন।

“আমাকে ব্যাঙ বলে ডাকবেন।” স্পষ্ট ও দৃঢ়কণ্ঠে ব্যাঙ বলল।

কাটাগিরি দরজার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরুল না।

“ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিন। প্লিজ।”

কাটাগিরির ডান হাতে ব্রিফকেস আর বাম হাতে তাজা সবজি আর টিনজাত স্যামোন মাছের প্যাকেট। তিনি নড়াচড়া করার সাহস পেলেন না।

“মি. কাটাগিরি দয়া করে শিঘ্ন করুন, দরজা বন্ধ করে দেন। জুতো খুলুন।” নিজের নামের উচ্চারণ কাটাগিরিকে ওই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করল। হুকুম মতো দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, সওদা পাতির ব্যাগ কাঠের মেঝের ওপর রাখলেন, তারপর ব্রিফকেসটা এক বোগলে রেখে জুতা খুললেন।

“আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার বাড়িতে ঢোকার জন্য আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত।” বলল ব্যাঙ, “জানি, আমাকে এভাবে দেখে আপনি কষ্ট পাবেন; কিন্তু কী করব বলুন উপায় ছিল না আমার। এক কাপ চা খাবেন নাকি? আপনি শিগগিরই ফিরবেন জেনে আমি পানি গরম করে রেখেছি।”

ব্রিফকেসটি তখনও কাটাগিরির বোগলে। কেউ কি তার সঙ্গে মস্করা করছে। ভাবলেন তিনি। কেউ কি ব্যাঙের পোশাক পরে তার সঙ্গে মজা করছে। কিন্তু ব্যাঙকে পটে গরম পানি ঢালতে দেখে এবং তার চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে তার মনে হলো এটা আসলেই একটা ব্যাঙ। ব্যাঙ তার সামনে এক কাপ গ্রিন টি রাখল, নিজেও নিল এক কাপ।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ব্যাঙ বলল, “কী এবার মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে তো?” এতো কিছুর পরেও কাটাগিরি কোনো কথা বলতে পারলেন না।

“জানি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আপনার সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল, আপনার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি অবহিত। নিজের বাড়ি ঢুকে ব্যাঙকে এভাবে অপেক্ষা করতে দেখলে যে কেউ ক্ষুব্ধ হবে। কিন্তু জরুরি একটা বিষয় আমাকে এখানে টেনে এনেছে। মাফ করে দিন আমাকে।”

“জরুরি ব্যপার?” শেষ পর্যন্ত কাটাগিরির মুখে কথা ফুটল।

“হ্যাঁ খুবই জরুরি একটা বিষয়, তা না হলে কী এভাবে কেউ কারও বাড়িতে আসে? এ রকম অভদ্রতা করতে আমরা কিন্তু মোটেও অভ্যস্ত নই।”

“এখানে কী আমার কিছু করার আছে?”

“হ্যাঁ এবং না।” ব্যাঙ বলল, “না আবার হ্যাঁ।”

নিজের ওপর আস্থা ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে আমাকে। ভাবলেন কাটাগিরি। বললেন, “আচ্ছা আমি সিগ্রেট খেলে কি তুমি মাইন্ড করবে?”

“মোটেও না।” বলল ব্যাঙ, “এটা আপনার বাড়ি। আমার অনুমতি নেয়ার দরকার কী আপনার। সিগ্রেট খান, মদ পান কিংবা যা ইচ্ছে তা-ই করুন। আমি নিজে অবশ্য ধূমপান করি না; কিন্তু কারও নিজের বাড়িতে ধূমপান বিষয়ে আমার বিরক্তির কথা প্রকাশ করি না।”

কাটাগিরি কোটের পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরালেন। তিনি লক্ষ্য করলেন তার হাত একটু একটু কাঁপছে। মনে হলো তার উল্টো দিকে বসে ব্যাঙ সবকিছু খেয়াল করছে।

“তুমি আবার কোনো গ্যাং ট্যাং এর সঙ্গে জড়িত নও তো?” সাহস করে জিজ্ঞেস করলেন কাটাগিরি।

“হা হা হা…হা হা হা! আপনার রসবোধ দারুণ তো মি. কাটাগিরি।” নিজের উরুতে হাত দিয়ে একটা থাবড়া মেরে ব্যাঙ বলল, “দক্ষ শ্রমিকের অভাব আছে জানি; কিন্তু নোংরা কাজ করাতে কোনো গ্যাং ব্যাঙ ভাড়া করবে? ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায় না?”

“ভাল কথা। যদি তুমি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসে থাক তাহলে বলছি, খামোখা সময় নষ্ট করছ। ওসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার নেই। ওসব কাজ করেন আমার কর্তারা, আমি শুধু তাদের হুকুম তামিল করি। তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না…।”

ব্যাঙ তার একটা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল, “এ রকম কোনো তুচ্ছ কাজ নিয়ে আমি এখানে আসিনি মি. কাটাগিরি। আমি জানি আপনি টোকিও সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাংকের শিনজুকু শাখার ঋণ বিভাগের সহকারী প্রধান। কিন্তু আমার আগমনের সাথে ঋণটিন পরিশোধের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এখানে এসেছি টোকিও শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে।”

লুক্কায়িত কোনো ক্যামেরা আছে কিনা তা দেখার জন্য কাটাগিরি ঘরের চারদিকে তাকালেন, যদি ভয়াবহ কোনো জোকের জন্য তাকে নাছোড়বান্দায় পরিণত করা হয়। কিন্ত ক্যামেরার কোনো অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। অ্যাপার্টমেন্টটি ছোট, কারও লুকিয়ে থাকার মতো জায়গা সেখানে নেই।

“না, আমি একাই এখানে আছি। জানি আপনি ভাবছেন আমি একটা বদ্ধ উন্মাদ আর আপনি স্বপ্ন দেখছেন। আমি পাগল নই আর আপনিও স্বপ্ন দেখছেন না। নিঃসন্দেহে ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস।”

“সত্যি কথা বলতে কী মি. ব্যাঙ …”

“দয়া করে আমাকে শুধু ব্যাঙ বলুন।”

“ও আচ্ছা, সত্যি কথা কী জান ব্যাঙ, আমি আসলে বুঝতে পারছি না এখানে হচ্ছেটা কী। আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করি না তা নয়। বিষয়টা আসলে আমার মাথায় ঢুকছে না। তোমাকে যদি কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করি তাহলে কী কিছু মনে করবে তুমি?”

ব্যাঙ বলল, “মোটও না। পারস্পরিক সমঝোতার মূল্য অনেক।… সম্ভাব্য স্বল্প উপায়ে আমাদেরকে সমঝোতায় পৌঁছুতে হবে। সে যা-ই হোক, যত খুশি প্রশ্ন করুন আমাকে।”

“তুমি আসলেই একটা ব্যাঙ, কি ঠিক বলেছি না?”

“অবশ্যই। আপনি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছেন। সত্যিকারের একটি ব্যাঙ আমি- রূপকালঙ্কার, ইঙ্গিত বা অন্য কোনো জটিল প্রক্রিয়া এর মধ্যে নেই। যথার্থ একটা ব্যাঙ আমি, ডাক দিয়ে শোনাব নাকি?”

এ কথা বলে সে উচ্চস্বরে ডাকতে লাগল। তার কর্কশ চিৎকারে দেয়ালের ছবিগুলো পর্যন্ত কাঁপতে লাগল।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে তুমি যথার্থই ব্যাঙ।” কাটাগিরি বললেন। তিনি এক চুমুক চা খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একটু আগে তুমি বলছিলে না টোকিও শহরকে

ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তুমি এখানে এসেছে।”

“হ্যাঁ। তাই তো বলেছিলাম।”

“কী ধরনের ধ্বংস?”

ব্যাঙ গম্ভীর হয়ে বেশ গুরুত্ব সহকারে বলল, “ভূমিকম্প।”

কাটাগিরি হা হয়ে গিয়ে ব্যাঙের দিকে তাকালেন। ব্যাঙও কিছু না বলে কাটাগিরির দিতে তাকিয়ে রইল। এভাবে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। এখন ব্যাঙের বলার পালা।

“খুব বড় ধরনের একটা ভূমিকম্প; ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় আঘাত হানবে। আজ থেকে তিনদিন পর। গত মাসে কোবেতে যে ভূমিকম্পটি হয়েছে এটা হবে তারচেয়েও ভয়াবহ। এ ধরনের ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা সাধারণত দেড় লাখের কম হয় না। এর প্রভাবে রাস্তায় যানবাহন লাইনচ্যুত হয়, পড়ে যায় রেল লাইন, সাবওয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, ট্যাঙ্কার, ট্রাক ইত্যাদি বিস্ফোরিত হয়। দালান কোঠা ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়, লোকজন এর তলায় পড়ে মারা যায়। আগুন লেগে যায়। অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিস অকার্যকর হয়ে পড়ে। মানুষজন স্রেফ মরে পড়ে থাকে।… ওই ভূমিকম্পের উৎসস্থল হবে শিনজুকু ওয়ার্ড অফিসের নিকটবর্তী একটি স্থান।”

“শিনজুকু ওয়ার্ড অফিসের নিকটবর্তী এলাকা?”

“আরও সংক্ষেপ করে বললে বলতে হয় ভূমিকম্প টোকিও সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাংকের শিনজুকু শাখার তলদেশে সরাসরি আঘাত হানবে।”

এরপরে গভীর নৈঃশব্দ নেমে আসে।

“এবং তুমি ওই ভূমিকম্প ঠেকানোর পরিকল্পনা করছো?” কাটাগিরি বললেন।

ব্যাঙ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক তাই। আমি আর আপনি টোকিও সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাংকের শিনজুকু শাখার তলায় যাব এবং কীটের সাথে আমরণ লড়াইয়ে লিপ্ত হবো।”

.

ট্রাস্ট ব্যাংকের ঋণ বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে নানাভাবে কাটাগিরিকে লড়াই করতে হয়েছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এই ব্যাঙ ব্যাটা এসব বলছে কী?

তিনি খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বললেন, “কীট? এ আবার কে হে?”

“মাটির তলায় থাকে। বিশাল বড় একট কীট। রেগে গেলে সে ভূমিকম্প ঘটায়। আর এই সময়টাতে ভীষণ রেগে আছে সে।”

“কী নিয়ে তার এত রাগ?”

“আমি জানি না। কেউ জানে না তার ওই কদর্য মাথাটার ভেতর কী ভাবনা চিন্তা খেলা করছে। খুব কম লোকই দেখেছে তাকে। সাধারণত ঘুমিয়ে থাকে সে। এই একটি কাজই সে করে- দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটায়। তার চোখ দুর্বল। ঘুমিয়ে থাকার সময় তার মগজ জেলির আকার ধারণ করে। জিজ্ঞেস করেন তো বলি, আমার ধারণা সে সম্ভবত কিছুই ভাবে না, কেবল শুয়ে থাকে আর ঘর্ঘর শব্দ করে। সামনে যা পায় তার প্রতিধ্বনি করে আর শরীরের ভেতর তা জমিয়ে রাখে। এবং তারপর কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলোকে ক্রোধে পরিণত করে। কেন এমন হয় ব্যাখ্যা করতে পারব না আমি।”

কাটাগিরির দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ কিছুক্ষণ নীরব রইল। তার কথার রেশ মিলিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর সে বলল, “দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। ওই কীটের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। আমি তাকে শয়তানের প্রতিরূপ বলেও মনে করি না। আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্বও পাতাতে চাই না; আমার শুধু মনে হয় তার মতো একটা প্রাণীর অস্তিত্ব থাকতেই পারে। পৃথিবী একটা বিরাট ওভারকোটের মতো, আর এতে থাকতে হয় নানা আকার ও আকৃতির পকেট। কিন্ত ঠিক এই মুহূর্তে কীটটি এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে তাকে উপেক্ষা করা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে।… কী বলছি সে ব্যাপারে আমি সচেতন মি. কাটাগিরি। শুনুন, ভূমিকম্পের সময় ও তীব্রতার ব্যাপারে আমার এক ছারপোকা বন্ধুর কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য খবর পেয়েছি।”

ক্লান্তির কারণে সম্ভবত ব্যাঙ খানিকটা থামল আর চোখ বন্ধ করে রাখল।

“অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ,” কাটাগিরি বললেন, “আমি আর তুমি মাটির নিচে যাব আর ভূমিকম্প থামাতে কীটের সঙ্গে লড়াই করব।”

“ঠিক তাই।”

কাটাগিরি চায়ের কাপটি হাতে নিলেন; কিন্তু কী মনে করে তা সরিয়ে রেখে বললেন, “আমি একটা জিনিস ঠিক বুঝতে পারছি না, এ কাজের জন্য তুমি আমাকে বেছে নিলে কেন?”

ব্যাঙ সরাসরি কাটাগিরির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার জন্য বরাবরই আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। গত ১৬ বছর ধরে আপনি একটা ভয়ানক অথচ গ্ল্যামারপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন যা কিনা অন্যরা সবসময়ই এড়িয়ে গেছে। অথচ সেই দায়িত্ব আপনি সুন্দরভাবে পালন করছেন। আমি ভাল করেই জানি আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তা কিংবা সহকর্মীরা যথাযথভাবে আপনার কাজের প্রশংসা করেনি। কিন্তু এ সব নিয়ে আপনার কোনো অভিযোগ নেই।

“শুধু তাই নয়, বাবা-মার মৃত্যুর পর আপনি আপনার ভাই-বোনদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন এমন কী বিয়ে শাদি পর্যন্ত দিয়েছেন। নিজের বিয়ের কথা একবারও ভাবেননি। অথচ এ জন্য আপনার ভাই-বোনেরা আপনার প্রতি সামান্যতম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। আমার মতে তারা বিবেকবর্জিত। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, আপনার তরফ থেকে ওদের আচ্ছামতো পিটুনি লাগাই। অথচ আপনি ওদের প্রতি সামান্যতম ক্রোধও প্রকাশ করেননি।… সত্যিকথা বলতে কী, আপনার মতো বিবেক সম্পন্ন, সাহসী মানুষ আমি গোটা টোকিও শহরে খুঁজে পেলাম না যার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা যায়।”

“ব্যাঙ সাহেব আমাকে বলবে কী,…”

“দয়া করে আমাকে শুধু ব্যাঙ বলবেন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে ব্যাঙ, তুমি আমার সম্পর্কে এতো কিছু জানলে কী করে?”

“ভাল কথা মি. কাটাগিরি, আমি বিগত বছরগুলোতে শুধু ব্যাঙগিরি করে বেড়াইনি, জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল।”

“কিন্তু তারপরেও ব্যাঙ, আমাকে বলতেই হচ্ছে, লোক হিসেবে আমি কিন্তু শক্তিশালী নই। মাটির নিচে কী ঘটছে তা-ও জানা নেই আমার। অন্ধকারে কীটের সঙ্গে লড়াই করার মতো গায়ের জোর আমার নেই। আমি নিশ্চিত তুমি আমার চেয়ে শক্তিমান ক্যারাতে ট্যারাতে জানা কিংবা ধরো সেল্ফ-ডিফেন্স ফোর্সের কোনো কমান্ডোকে পেয়ে যেতে পার…।”

চোখ গোল করে ব্যাঙ বলল, “খাঁটি একটা কথা বলি তবে। লড়াই তো করব আসলে আমি। তবে একা তা সম্ভব নয়। প্রধান কথা হচ্ছে, আপনার সাহস আর ন্যায় বিচারের আবেগটুকু আমার প্রয়োজন। আমি চাই আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আপনি বলেন, “এগিয়ে যাও ব্যাঙ। দারুণ কাজ করছো তুমি। জানি জিত তোমারই হবে। দারুণ লড়াই করছো তুমি সাবাস!”

ব্যাঙ এক হাত দিয়ে হাঁটুর ওপর আবারও একটা থাপ্পড় মারল তারপর বলল, “সত্যি কথা বলতে কী মি. কাটাগিরি অন্ধকারে কীটের সঙ্গে লড়াই করতে আমারও ভয় হয়। বহুবছর আমি শান্তি প্রিয় প্রাণী হিসেবে দিন গুজরান করেছি, শিল্প ভালবেসেছি আর বাস করেছি প্রকৃতির মাঝে। লড়াই করতে আমারও ভাললাগে না। কিন্তু এ কাজ করতে চাচ্ছি বাধ্য হয়ে। তবে এ লড়াইটা নিঃসন্দেহে হবে প্রচণ্ড। জান নিয়ে না-ও ফিরতে পারি; অঙ্গহানিও হতে পারে আমার। কিন্তু না, পালিয়ে আসব না আমি। কারণ নীৎসে বলেছেন, নির্ভীকতাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিচক্ষণতা।”…

কিন্তু এ সবের কোনো অর্থই খুঁজে পেলেন না কাটাগিরি। তারপরেও তার মনে হলো অবাস্তব শোনা গেলেও ব্যাঙ যা বলছে তা বিশ্বাস করা যায়। একট কিছু নিশ্চয় আছে- ওর মুখের অভিব্যক্তি আর বলার ভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের সরল সাধুতা আছে যা হৃদয় স্পর্শ করে। সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাংকের শক্ত একটা বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করে এ ধরনের ব্যাপার বুঝবার মতো ক্ষমতা তার ভেতর তৈরি হয়েছে।

“জানি ব্যাপারটা আপনার জন্য খুব জটিল। বিশাল একটা ব্যাঙ আপনার বাড়িতে ঢুকে বিদঘুঁটে সব জিনিস বিশ্বাস করতে বলছে আপনাকে। আপনার এই প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। কাজেই আমি আমার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু প্রমাণ হাজির করতে চাই। আচ্ছা মি. কাটাগিরি বিগ বিয়ার ট্রেডিং এর ঋণ আদায় নিয়ে তো আপনারা সাংঘাতিক ভোগান্তি পোহাচ্ছেন, তাই না?”

“হ্যাঁ।” কাটাগিরি বললেন।

“বেশ। পর্দার আড়ালে অনেক জুলুমবাজ আছে। তারা কোম্পানিকে দেউলিয়া বানিয়ে ঋণের হাত থেকে বাঁচতে চাইছে। ব্যাংকের ঋণ প্রদানকারী কর্মকর্তারা কোম্পানির পূর্ব ইতিহাস খতিয়ে না দেখেই কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে বসে আছে, আর এখন এ টাকা আদায়ের দায় পড়েছে আপনার কাঁধে। কিন্তু ওদের বুকে কামড় বসাতে বিস্তর বেগ পেতে হচ্ছে আপনাকে। কারণ সহজে দমন করার মতো লোক তারা নয়। আর তাদের মদদে আছে শক্তিশালী রাজনীতিবিদরা। ৭০ কোটির মামলা। এক জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে আপনাকে, তাই না?”

“অতি সত্য কথা।”

“চিন্তার কোনো কারণ নেই মি. কাটাগিরি, সবকিছু আমার হাতে ছেড়ে দিন। আগামীকাল সকালের মধ্যে আপনার সব সমস্যা সমাধান করে ফেলব আমি। আরাম করুন আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমান।”

পরের দিন সকালে অফিসে গিয়ে পৌঁছুতেই কাটাগিরির টেলিফোন বেজে উঠল। মি. কাটাগিরি, একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো। তার স্বর শীতল আর ব্যবসাঘেঁষা। বলল, “আমার নাম শিরাওকা। বিগ বিয়ার কেসের একজন আইনজীবী। আপনাদের পাওনা ঋণের অর্থের ব্যাপারে মক্কেলের কাছ থেকে ফোন-কল পেয়েছি। তিনি আমাকে আপনাদের জানাতে বলেছেন যে, তারা নির্ধারিত তারিখের মধ্যেই তাদের ঋণের অর্থ পরিশোধ করবেন। তিনি একটা মেমোরান্ডামেও সই করে দেবেন। তার একটাই অনুরোধ ভবিষ্যতে আর যেন ব্যাঙকে তার বাড়িতে পাঠান না হয়। আমি আবার বলছি, তার বাড়িতে আর যেন ব্যাঙকে পাঠান না হয়। এর অর্থ কি আমি আসলে জানি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস বিষয়টা আপনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন। কী ঠিক বলিনি?”

“বিলকুল ঠিক।” কাটাগিরি বললেন।

“আপনি কি দয়া করে বার্তাটি ব্যাঙকে পৌঁছে দেবেন?”

“অবশ্যই দেব। আপনার মক্কেল আর কোনো দিন ব্যাঙের দেখা পাবেন না।”

“ধন্যবাদ আপনাকে। কালই আমি মেমোরেন্ডামটি তৈরি করব।”

“আপনার এই পদক্ষেপের প্রশংসা না করে পারছি না।”

লাইন কেটে গেল।

লাঞ্চের সময় ব্যাঙ কাটাগিরির অফিসে গিয়ে হাজির হলো। বলল, “অনুমান করি বিগ বিয়ারের মামলাটি সমাধানের পথে।”

কাটাগিরি অস্বস্তি নিয়ে আশপাশে তাকালেন।

ব্যাঙ বলল, “ভাববেন না, আপনি ছাড়া কেউ আমাকে দেখতে পাবে না। আমি নিশ্চিত যে, আপনি এখন অনুভব করছেন আসলেই আমার অস্তিত্ব আছে। আমি কোনো কল্পনার ফসল নই। আমি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম আর ফল বয়ে আনতে পারি। আমি জীবন্ত প্রাণী।”

“আচ্ছা মি. ব্যাঙ একটা কথা কি আমাকে বলবে?”

“দয়া করে আমাকে ব্যাঙ বলবেন।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে, ব্যাঙ আমাকে বলো তুমি আসলে কী করেছিলে?”

“তেমন কিছু নয়,” বলল ব্যাঙ, “বাঁধা কপির কুঁড়ি সেদ্ধ করার চেয়ে বেশি জটিল কিছু নয়। আমি তাদেরকে সামান্য একটুখানি ভয় পাইয়ে দিয়েছি। একটুখানি মানসিক সন্ত্রাস বলতে পারেন। যে রকম জোসেফ কনরাড একদা লিখেছিলেন, সত্যিকার সন্ত্রাসী সেই দয়াবান লোক কল্পনার ব্যাপারে যারা সচেতন। কিছু মনে করবেন না মি. কাটাগিরি। মামলাটার ব্যাপারে বলুন আমাকে। সবকিছু ঠিক মতো এগুচ্ছে তো?”

কাটাগিরি একটা সিগারেট ধরিয়ে মাথা নাড়ালেন। বললেন, “তাই তো মনে হচ্ছে হে।”

“তাহলে কাল রাতে আপনাকে যে বলেছিলাম সে বিষয়ে আপনার আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি আমি? কীটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমার সঙ্গে সামিল হবেন তো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললেন মুখলেন কাটাগিরি। বললেন, “সত্যি কথা বলতে কী ওই বিষয়ে এত উন্মাদনা আমার নেই, তবে মনে হয় না ওইটুকুর মাধ্যমে আমি ওই ধারণা থেকে নিজেকে বাইরে আনতে পারব।”

“না,” বলল ব্যাঙ, “এটা দায়িত্ব ও সম্মানের বিষয়। ব্যাপারটাতে আপনার উন্মাদনা না-ও থাকতে পারে; কিন্তু আমাদের কিছু করবার নেই; আপনাকে আর আমাকে কীটের সঙ্গে লড়বার জন্য অবশ্যই মাটির তলায় নামতে হবে। ওটা করতে গিয়ে আমরা যদি প্রাণ হারাই, কারও সহানুভূতিও পাব না। আর যদি কীটকে আমরা হারিয়ে দেই, কোনো প্রশংসাও আমাদের কপালে জুটবে না। কেউ কোনো দিন জানবে না তাদের পায়ের তলায় কতো বড় একটা লড়াই সংঘটিত হয়েছিল। শুধু আপনি আর আমি জানব ব্যাপারটা মি. কাটাগিরি।”

কাটাগিরি খানিকক্ষণের জন্য তার হাতের দিকে তাকালেন। দেখলেন তার সিগারেট থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। শেষে তিনি বললেন, “তুমি তো জান মি. ব্যাঙ আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ।”

“দয়া করে আমাকে শুধু ব্যাঙ বলবেন।” কাটাগিরি তার কথায় কর্ণপাত করলেন না। বললেন, “আমি শুধু সাধারণ একটা মানুষই কেবল নই, আমি অতি তুচ্ছ মানুষ। মাথার টাক পড়ে যাচ্ছে, ভুড়ি হচ্ছে আর গেল মাসে ৪০-এ পা দিয়েছি। ডাক্তার। বলেছে, ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে আমার। মাস তিনেক হলো এক মহিলা আমার সঙ্গে থাকে। তাকে টাকা-পয়সা দিতে হয়। ঋণ আদায়ে সাফল্যের জন্য কিছু স্বীকৃতি আমার ভাগ্যে জুটেছে; কিন্তু সত্যিকার সম্মান এখনও পাইনি। এমন লোক একজনও পাইনি, অফিসে কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে যে আমাকে সত্যিকারের পছন্দ করে। মানুষের সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় আমি জানি না। অচেনা লোকদের সঙ্গে আচরণের বেলায়ও আমি ভাল নই, কাজেই কারও সাথে বন্ধুত্বও গড়ে ওঠেনি আমার।

“কোনো খেলাও আমি জানি না, সুরকানা আমি, চোখে কম দেখি। যাচ্ছে তাই জীবন যাপন করি। খাইদাই, ঘুমাই, মলমূত্র ত্যাগ করি। জানি না কেন বেঁচে আছি। আমার মতো এমন একজন মানুষ কেন টোকিওকে বাঁচাতে যাবে?”

“কারণ, আপনার মতো একজন লোকই কেবল টোকিওকে বাঁচাতে পারে মি. কাটাগিরি। আর আপনার মতো মানুষদের জন্য আমি টোকিওকে রক্ষা করতে চাই।”

কাটাগিরি আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এ বার আগের চেয়েও গভীর ছিল তার দীর্ঘশ্বাস। বললেন, “ঠিক আছে, কী করতে হবে বলো!”

.

ব্যাঙ তার পরিকল্পনার কথা মি. কাটাগিরিকে জানিয়ে বলল, তারা ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মাটির তলায় যাবে। (ভূমিকম্পের নির্ধারিত তারিখের একদিন আগে)। টোকিও সিকিউরিটি ট্রাস্ট ব্যাংকের বেসমেন্টে অবস্থিত বয়লার রুম দিয়ে তারা নিচে যাবে। রাতে দেখা হবে তাদের (ওভারটাইম করার অজুহাতে কাটাগিরি ব্যাংক ভবনে অবস্থান করবেন)।

“লড়াইয়ের কোনো পরিকল্পনা কি তোমার মাথায় আছে ব্যাঙ?”

“অবশ্যই আছে। পরিকল্পনা ছাড়া আমাদের শত্রু ওই কীটকে কিছুতেই পরাস্ত করা যাবে না। পাতলা ছিপছিপে একটা প্রাণী সে, ওর মুখ কোথায় আর পায়ু কোথায় বোঝা মুশকিল। কমিউটার ট্রেনের মতো লম্বা।”

“যুদ্ধের পরিকল্পনাটি কী তোমার?”

খানিকক্ষণ চিন্তা করে ব্যাঙ বলল, “হুম, একটা কথা আছে না- নীরবতাই সর্বোৎকৃষ্ট পথ!”

“তার মানে তুমি বলতে চাও এ সম্পর্কে আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না?”

“সাহসের সঙ্গে কোনো কিছু গ্রহণ করার এটাও একটা পথ।”

“শেষ মুহূর্তে আমি যদি ভয় পেয়ে পালিয়ে যাই তখন তুমি কী করবে মি. ব্যাঙ?”

“শুধু ব্যাঙ বলুন।”

“ঠিক আছে ব্যাঙ বলো তখন কী করবে?”

কিছুক্ষণ চিন্তা করে ব্যাঙ বলল, “আমি একাই লড়াই করব। নিজে তাকে মারার সুযোগ গ্রহণ সেই চলমান ইঞ্জিনটাকে আঘাত করার অ্যানাকারনিনার সুযোগের চেয়ে হয়ত সামান্য একটু বেশি হবে। আপনি অ্যানাকারনিনা পড়েছেন মি. কাটাগিরি?”

ব্যাঙ যখন শুনল তিনি অ্যানাকারনিনা পড়েননি, সে তখন মি. কাটাগিরির দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সে বলতে চায়- কী লজ্জার কথা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হলো ব্যাঙ অ্যানাকারনিনার একজন ভক্ত।

“তারপরও মি. কাটাগিরি আমি বলব, আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে একা লড়াই করতে পাঠাবেন না।”

.

অপ্রত্যাশিত ব্যাপার সব সময়ই ঘটে।

১৭ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় কাটাগিরি গুলিবিদ্ধ হলেন। শিনজুকু স্ট্রিট দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এক যুবক লাফ দিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। তার চেহারা ছিল বৈচিত্র্যহীন। এক হাতে ধরা ছিল ছোট কালো একটা রিভলভার। ওটা এত ছোট ছিল যে দেখে আসল বলে মনে হচ্ছিল না। কাটাগিরি জিনিসটার প্রতি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন; কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি ওটি তার দিকে তাক করা আর লোকটি ট্রিগার টিপছিল। খুব দ্রুত ঘটে গেল ব্যাপারটা তার কাছে এর কোনো অর্থই ছিল না। তবে রিভলবার থেকে গুলি বেরিয়েছিল।

কাটাগিরি রিভলবারের নলের নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আর একই সময় তার ডান কাঁধে ভারি একটা হাতুড়ির আঘাত অনুভব করেছিলেন। ব্যথা পাননি তিনি তবে ওই আঘাতের কারণে ফুটপাতের ওপর ছিটকে পড়ে গিয়েছিলেন। হাতের ব্রিফকেসটি উড়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিল তখন। লোকটি তার দিকে রিভলবার তাক করে রেখেছিল, দ্বিতীয় একটি গুলি ফুটেছিল। ফুটপাতের পাশে একটা খাবারের দোকানের সাইনবোর্ড তার চোখের সামনেই বিধ্বস্ত হয়েছিল। লোকজনের চিৎকারের শব্দ গিয়েছিল তার কানে। তার চশমা ছিটকে পড়ে গিয়েছিল বলে সবকিছু আবছা দেখেছিলেন তিনি। খুব অস্পষ্টভাবে তিনি দেখেছিলেন, রিভলবার তাক করে লোকটি এগিয়ে আসছে তার দিকে। তিনি ভেবেছিলেন, মৃত্যু অবধারিত। ব্যাঙ ঠিকই বলেছিল, সত্যিকার সন্ত্রাসী সেই দয়াবান লোক কল্পনার ব্যাপারে যে সচেতন।

কাটাগিরি তার কল্পনার সুইচ অফ করে দিয়ে নির্ভার নীরবতার ভেতর ডুবে গেলেন।

জেগে উঠে দেখলেন তিনি বিছানায় শুয়ে। এক চোখ খুললেন আর চারদিকের পরিবেশ পর্যবেক্ষণের জন্য খুললেন আর এক চোখ। প্রথমেই তার দৃষ্টির সীমায় এলো একটি ধাতব স্ট্যান্ড ও শিরার ভেতর দিয়ে খাওয়ানোর নল। তারপরই চোখে পড়ল সাদা পোশাকের নার্স। তিনি অনুভব করলেন বিছানার ওপর তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন, তার পরনে অদ্ভুত রকমের পোশাক।

ও হ্যাঁ, ভাবলেন তিনি ফুটপাত ধরে হাঁটবার সময় কেউ একজন তার ওপর গুলি চালায়। সম্ভবত তার কাঁধে লাগে গুলিটি। মনের চোখে দৃশ্যটি দেখতে পান তিনি। বেজন্মারা আমাকে মারার চেষ্টা করছিল। আমার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে। শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই। শুধু ব্যথা নয়, কোনো অনুভূতিই নেই। হাত ওঠাতে পারছি না আমি…।

হাসপাতালের এই রুমটির কোনো জানালা নেই। তখন দিন না রাত বুঝতে পারলেন না তিনি। বিকেল পাঁচটার কিছু আগে গুলি চালানো হয়েছে তার ওপর। তখন থেকে কতটা সময় পার হয়েছে? ব্যাঙের সঙ্গে দেখা করার সময় কি পার হয়ে গেছে? তিনি ঘড়ির সন্ধান করলেন; কিন্তু চশমা না থাকায় কিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না তার।

“হেই সিস্টার।” নার্সকে ডাকলেন কাটাগিরি।

নার্স বলল, “যাক শেষ পর্যন্ত ঘুম ভেঙেছে আপনার।”

“ক’টা বাজে এখন?”

নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নার্স বলল, “নটা পনের।”

“রাত?”

“আরে না সকাল।”

বালিশ থেকে মাথাটা একটুখানি তুলে কাটাগিরি গোঙানির স্বরে বললেন, “সকাল সোয়া নটা।” অতঃপর গলা থেকে যে স্বর বেরুল তা শুনতে এ রকম- সকাল সোয়া ন’টা, তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি?

নার্স আবার তার ডিজিটাল ঘড়ি পর্যবেক্ষণ করে বলল, “ঠিক তাই, আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫।”

“আজ সকালে কি টোকিওতে বড় ধরনের কোনো ভূকম্পন হয়েছে?”

“টোকিওতে?”

“হ্যাঁ, টোকিওতে।”

নার্স তার মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমার জানা মতে কোনো ভূমিকম্প হয়নি।”

প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি ভাবলেন, শেষতক ভূমিকম্পটা বন্ধ করা গেছে।

“আমার শরীরের ক্ষতের কী অবস্থা?”

“আপনার শরীরের ক্ষত?”

“হ্যাঁ, যে জায়গায় গুলি লেগেছিল।”

“গুলি?”

“হ্যাঁ, ট্রাস্ট ব্যাংকে ঢোকার মুখে কেউ একজন গুলি করেছিল আমাকে। আমার ধারণা ডান কাঁধে।”

তার দিকে তাকিয়ে নার্স নার্ভাস হাসল। বলল, “আমি দুঃখিত মি. কাটাগিরি, আপনার তো কোনো গুলি-ই লাগেনি।”

“গুলি লাগেনি? আপনি নিশ্চিত?”

“আজ যে ভূমিকম্প হয়নি এ ব্যাপারে যেমন নিশ্চিত তেমনি,…”

কাটাগিরি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, “তাহলে হাসপাতালে শুয়ে আছি কেন আমি?”

“অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার ওপর থেকে উদ্ধার করা হয় আপনাকে। বাইরে কোনো ক্ষত বা আঘাতের চিহ্ন নেই আপনার শরীরে। আপনার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন আমরা বুঝতে পারিনি। শিগগিরই ডাক্তার আসবেন। ওনাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন।”

“অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন, গতকাল সন্ধ্যার আগে থেকে আমি অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছি তাই না?”

“ঠিক তাই। রাতটা খুব খারাপ গেছে আপনার মি. কাটাগিরি। ভয়াবহ রকমের দুঃস্বপ্ন হয়ত আপনি দেখেছেন। আপনাকে আমি- ব্যাঙ, এ্যাই ব্যাঙ বলে ডাকতে শুনেছি। বেশ কয়েকবারই আপনি ডেকেছেন ও ভাবে। ডাক নাম ব্যাঙ এ রকম কোনো বন্ধু আছে নাকি আপনার?”

কাটাগিরি চোখ বন্ধ করলেন আর ধীরে ধীরে বয়ে চলা নাড়ির স্পন্দন শুনতে পেলেন। যা স্মরণ করতে পারলেন তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু হ্যাঁলুসিনেশন? সত্যিই কী ব্যাঙের অস্তিত্ব আছে, আর ভূমিকম্প ঠেকাতে সে কীটের সঙ্গে লড়াই করেছে? নাকি ওটা তার স্বপ্নেরই একটা অংশ?

.

রাতের দিকে ব্যাঙ হাসপাতালে এসে হাজির হলো। মৃদুমন্দ আলোয় কাটাগিরি তাকে একটা স্টিলের চেয়ারের ওপর বসা অবস্থায় আবিষ্কার করলেন।

“ও হে ব্যাঙ।” ডাকলেন কাটাগিরি। কুতকুত করে তাকাল ব্যাঙ। কাটাগিরি বললেন, “কথামতো আমি রাতে বয়লার রুমে দেখা করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিত ভাবে দুর্ঘটনার কবলে পড়ি আমি… তারপর এই হাসপাতালে।”

ব্যাঙ মাথাটা একটুখানি ঝকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, চিন্তা করবেন না, সবই আমি জানি। ওই লড়াইয়ে আপনি ছিলেন আমার বড় সহায়।”

“আমি?”

“হ্যাঁ, আপনি। স্বপ্নের ভেতর আপনি একটা বড় কাজ করেছেন। যার ফলে কীটের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব হয়েছে আমার পক্ষে। আমার জয়ের জন্য আপনাকে আমার ধন্যবাদ জানান উচিত।”

“তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না, কাটাগিরি বললেন, “সারাক্ষণ আমি অচেতন অবস্থায় ছিলাম। ওরা আমার শিরায় সুই ঢুকিয়ে তার মাধ্যমে তরল খাবার খাওয়াচ্ছিল। স্বপ্নে কিছু করেছি বলে তো মনে পড়ছে না আমার।”

“খুব ভাল কথা মি. কাটাগিরি। আপনার যে কিছু মনে নেই সেটাই ভাল। দুর্ধর্ষ সেই লড়াইয়ের পুরোটাই ঘটেছে স্বপ্নে। ওটাই ছিল আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রের সংক্ষিপ্ত স্থান। ওখানেই আমরা আমাদের জয়-পরাজয়ের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেছি। আমরা সবাই একটা সীমিত ব্যাপ্তিকাল নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছি। আমাদের সবার পরিণতি পরাজয়ে। কিন্তু আর্নেস্ট হেমিংওয়ে পরিষ্কারভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন, আমাদের জীবনের চূড়ান্ত মূল্য আমরা কীভাবে জয়ী হয়েছি তা দিয়ে নির্ধারিত হয় না বরং তা ধার্য হয় কীভাবে আমরা পরাজিত হয়েছি তা দিয়ে। আপনি আর আমি মিলে টোকিওকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি। দেড় লক্ষ লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছি আমরা। কেউ তা বুঝতে পারেনি।”

“কীটকে পরাস্ত করলে কী করে তুমি? আর আমার ভূমিকা-ই বা কী ছিল?”

“একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছি। আমরা…” ব্যাঙ একটুখানি থামল, নিঃশ্বাস নিল তারপর বলল, “আমাদের হাতে যে অস্ত্র ছিল তা-ই আমরা ব্যবহার করেছি। সাহসের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেছি। অন্ধকার ছিল আমাদের শত্রুর বন্ধু। পদ-শক্তি চালিত একটা জেনারেটর এনেছিলেন আপনি আর জায়গাটাকে আলোকিত রাখতে আপনার সবটুকু শক্তি ঢেলে দিয়েছিলেন। অন্ধকারের মায়ামূর্তি দিয়ে কীট ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিল আপনাকে; কিন্তু আপনি দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

“ভয়াবহ সেই লড়াইয়ে অন্ধকার আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিল আর আমি আলোর ভেতর কীটকে প্রবলভাবে জাপটে ধরেছিলাম। ও তার পিচ্ছিল-কর্দমাক্ত শরীর দিয়ে আমাকে পেঁচিয়ে ধরেছিল। আমি ওকে ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলেছিলাম; কিন্তু তখনও মরেনি ও। নিজেকে ও ছোট ছোট খণ্ডে পরিণত করে আর তখন…”

ব্যাঙ কোনো কথা বলল না। তারপর শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে আবার শুরু করল, “ঈশ্বর যাদের পরিত্যাগ করেছিলেন ফিওদোর দস্তয়েভস্কি তাঁর পরম মমতা দিয়ে তাদের চরিত্র চিত্রণ করেছিলেন। ভয়ঙ্কর স্ববিরোধের মধ্যেও তিনি মানব অস্তিত্বের চমৎকার গুণাবলী আবিষ্কার করেছিলেন যার দ্বারা যে সব মানুষ ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেছিলেন তারাই স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। অন্ধকারে কীটের সঙ্গে লড়াই করার সময় মনে হয়েছিল আমি দস্তয়েভস্কির ‘হোয়াইট নাইটস’এর কথা ভাবছি।” মনে হলো ব্যাঙের কথা বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। “মি. কাটাগিরি আমি একটুখানি ঘুমিয়ে নিলে আপনি কি কিছু মনে করবেন? ভীষণ ক্লান্ত আমি।”

“ও হে ব্যাঙ,” বললেন মি. কাটাগিরি, “ভাল করে ঘুমিয়ে নাও।”

চোখ বন্ধ করে ব্যাঙ বলল, “শেষ পর্যন্ত কীটকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমি। তবে ভূমিকম্প থামাতে সক্ষম হয়েছিলাম। লড়াইটাকে অমীমাংসিত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওকে আহত করেছিলাম, সে ও আমাকে আহত করেছিল। তবে সত্যি কথাটি কী জানেন মি. কাটাগিরি…”

“কি, ব্যাঙ?”

“আমি খাঁটি ব্যাঙ সন্দেহ নেই তাতে, একই সাথে আমি এমন এক জিনিস যার নাম গিয়ে দাঁড়ায় অ-ব্যাঙ।”

“তোমার এই কথাটিও আমার বোধগম্য হলো না ব্যাঙ।”

“আমার নিজেরও বোধগম্য নয়,” বলল ব্যাঙ। তার চোখ তখনও বন্ধ, “এটা সামান্য একটু অনুভূতির মতো ব্যাপার। আপনি সচক্ষে যা দেখেন তা যে সব সময় সত্য হবে তা কিন্তু নয়। অন্যান্য জিনিসের মতো আমার শত্রু আমার নিজের ভেতরকার আমি। আমার ভেতরে এক না- আমি বসবাস করে। ঘোর অন্ধকার আমার মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ইঞ্জিন আসছে ধেয়ে। কিন্তু মি. কাটাগিরি আমি কী বলছি তা আমি সত্যিই বুঝতে চাই।”

“তুমি এখন ভীষণ ক্লান্ত ব্যাঙ। ঘুমিয়ে পড়। ভাল লাগবে।”

“ঘোর অন্ধকারের ভেতর ঢুকে পড়ছি মি. কাটাগিরি। তারপরও…আমি…”

কথা বলার শক্তি হারিয়ে গভীর আচ্ছন্নতার ভেতর ডুবে গেল ব্যাঙ। তার বাহু ঝুলে রইল মেঝের ওপর, বিশাল মুখটি খোলা। ভাল করে তার দিকে তাকিয়ে কাটাগিরি দেখলেন, ব্যাঙের সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন। চামড়ার ওপর বিবর্ণ ডোরাকাটা দাগ। মাথার ওপর গভীর একটি দাগ যেখানে মাংস বেরিয়ে পড়েছে।

কাটাগিরি দীর্ঘক্ষণ ধরে কঠিন দৃষ্টিতে ব্যাঙের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই আমি অ্যানাকারনিনা আর হোয়াইট নাইটস বই দুটো কিনব আর পড়ব। তারপর ব্যাঙের সঙ্গে দীর্ঘ সাহিত্য আলোচনায় মাতা যাবে। ভাবলেন কাটাগিরি।

অনেকক্ষণ ধরেই কেঁপে কেঁপে উঠছিল ব্যাঙ। কাটাগিরি প্রথমটায় ভেবেছিলেন এটা ঘুমের মধ্যেকার স্বাভাবিক নড়চড়া, কিন্তু শিগগিরই ভুল ভাঙল তার। অস্বাভাবিকভাবে ব্যাঙের সারা শরীর প্রকম্পিত হচ্ছিল, যেন বড় কোনো পুতুলকে পেছন থেকে কেউ নাড়াচ্ছে। কাটাগিরি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। তিনি দ্রুত ব্যাঙের কাছে ছুটে যেতে চাইলেন, কিন্তু তার সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে।

একটু পরে ব্যাঙের ডান চোখে বড় একটা দলার মতো তৈরি হলো। অতঃপর তার কাঁধে আর সারা শরীরে সৃষ্টি হলো একই ধরনের বড় বড় ফোঁড়া। কাটাগিরি বুঝতে পারলেন না ব্যাঙের এমন দশা হচ্ছে কেন। চশমার ভেতর দিয়ে তাকালেন, নিশ্বাস নিতে পারছেন না তিনি।

তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে একটা ফোঁড়া বিস্ফোরিত হলো। চামড়া ছিঁড়ে বেরুল আর তারপর আঠালো তরল পদার্থ নির্গত হলো ধীরে ধীরে। তা থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বেরিয়ে গোটা ঘরটাতে ছড়িয়ে পড়ল। এ রকম পঁচিশ-তিরিশটি ফোঁড়া বিস্ফোরিত হলো। দুর্গন্ধ-তরলে ভরে গেল ঘরের দেয়াল। অসহ্য দুর্গন্ধ ছেয়ে গেল হাসপাতালের কক্ষটি। ব্যাঙের শরীরের ফোঁড়ার জায়গাগুলিতে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় কালো গর্ত আর তা থেকে শূককীট জাতীয় নানা আকারের পোকা বেরিয়ে আসতে লাগল। তাদের শরীর থেকেও বেরুচ্ছিল এক ধরনের গন্ধ। বহু পা অলা এই কীটদের পদচারণায় ঘরের ভেতর গা ছমছম করা খসখসে শব্দ সৃষ্টি হলো। স্রোতের মতো কীটগুলো বেরিয়ে আসছিল ব্যাঙের শরীরের গর্ত থেকে। ব্যাঙের সারা শরীর এখন কীটে আচ্ছন্ন। ওর শরীর থেকে খসে পড়া দুটি চোখের মণি কালো কালো ছারপোকারা তাদের ধারালো দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। কীটেরা পৌঁছে গেছে ঘরের ছাদ অবধি, বাল্বগুলোকে ঢেকে ফেলেছে তারা।

সারা মেঝে ছেয়ে গেছে কীট আর ছারপোকায়। কাটাগিরির বিছানার ওপরেও উঠে পড়েছে তারা। তারা চাঁদরের নিচ দিয়ে তার পা, হাঁটুর ওপর দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। ক্ষুদ্র কীটগুলো তার পায়ু, কান আর নাকের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে। পাঅলা কীটগুলো ঢুকে পড়েছে তার মুখের ভেতর। প্রচণ্ড অবসাদ আর নৈরাশ্যের ভেতর থেকে কাটাগিরি চিৎকার করে উঠলেন।

কেউ একজন সুইচ অন করলে সারাঘর আলোয় ভরে গেল।

“মি. কাটাগিরি!” ডাকে নার্স। আলোর দিকে চোখ মেলে তিনি তাকান। তার সারা গা ঘামে ভেজা। ছারপোকা আর কীটেরা চলে গেছে। তারা রেখে গেছে ভয়ঙ্কর ক্ষীণ এক অনুভূতি।

“আবার দুঃস্বপ্ন! আহারে বেচারা।” একটা ইঞ্জেকশন রেডি করতে করতে বলল নার্স।

বড় একটা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়লেন কাটাগিরি। দ্রুত নিশ্বাস পড়ছিল তার।

“স্বপ্নে কী দেখেন?”

স্বপ্ন আর বাস্তবকে পৃথক করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তিনি নিজেই জোরে জোরে বললেন, “তুমি যা সচক্ষে দেখ সব সময় তা সত্য না-ও হতে পারে।”

“তা অবশ্য ঠিক,” হেসে বলল নার্স, “বিশেষ করে ওইসব স্বপ্নের কথা যখন আসে।”

“ব্যাঙ।” চিৎকার করে বললেন কাটাগিরি।

“ব্যাঙের কী কিছু হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল নার্স।

ভূমিকম্পের কবল থেকে টোকিও শহরকে রক্ষা করেছে সে একা।” প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া একটা ইন্ট্রাভেনাস ফিডিং বটল সরিয়ে নতুন একটা রাখতে রাখতে না বলল, “চমৎকার ব্যাপার তো। আমরা চাই না টোকিও শহরে আর এ রকম ভয়ানক ঘটনা ঘটুক। অনেক তো হয়েছে।”

“কিন্তু এ কারণে জীবন দিতে হয়েছে তাকে। আমার ধারণা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে সে। আর সে এখানে আসবে না…।”

একটুখানি মুচকি হেসে নার্স তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিল।

“ব্যাঙ আপনার খুব প্রিয়, তাই না মি. কাটাগিরি?”

“রেল ইঞ্জিন, বিড়বিড় করে বললেন মি. কাটাগিরি, “কারও চেয়ে কম নয়।”

তিনি চোখ বন্ধ করলেন এবং প্রশান্ত, স্বপ্নহীন নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *