জন্মদিন ও মেয়েটি
নিজের বিশতম জন্মদিনেও রোজকার মতো তার টেবিলে অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। শুক্রবারগুলোতে সব সময়ই সে কাজ করে, কিন্তু পরিকল্পনামাফিক সবকিছু এগুলে নির্দিষ্ট এই শুক্রবারটাতে ছুটি নিতে পারত সে। পার্টটাইম কাজ করে অন্য যে মেয়েটি তার সঙ্গে কাজের পালা বদলাতে রাজি ছিল স্বাভাবিক নিয়মে; কারণ নিজের বিশতম জন্মদিনে ক্রদ্ধ বাবুর্চির হুকুম তামিল করে খদ্দেরের টেবিলে খাবার বয়ে নিয়ে যাওয়াটা নিতান্তই অস্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেই মেয়েটি আকস্মিকভাবেই প্রচণ্ড ডায়রিয়া আর জ্বরে আক্রান্ত হয়, ফলে আগে ভাগেই চলে যেতে হয় তাকে।
সে অসুস্থ মেয়েটিকে একটুখানি আয়েশ দিতে এগিয়ে যায়। মেয়েটি ক্ষমা প্রার্থণা করে তার কাছে। “আমাকে নিয়ে ভেবো না,” বলে সে, “বিশতম জন্মদিনে বিশেষ কিছু করতে যাচ্ছি না।”
সত্যিকথা বলতে কী সে তেমন হতাশও হয়নি ব্যাপারটা নিয়ে। এর একটা কারণ অবশ্য আছে। দিন কয়েক আগে ছেলে বন্ধুর সাথে তার প্রচণ্ড তর্ক বেঁধে যায়। ওই রাতে মেয়েটার সঙ্গে থাকবার কথা ছিল তার। স্কুল জীবন থেকেই তাদের সম্পর্ক। তর্কটা বেঁধেছিল তুচ্ছ একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে। শেষ পর্যন্ত তা খুব খারাপের দিকে গড়ায় আর তিক্ততা, চিৎকার চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে, মেয়েটি নিশ্চিত হয়ে পড়ে যে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। ভেতরে ভেতরে মেয়েটি খুব শক্ত থাকে আবার গলেও যায়। ওই ঘটনার পর থেকে ছেলেটি তার সঙ্গে দেখা করছে না, আর মেয়েটিও যাচ্ছে না তার কাছে।
মেয়েটি টোকিওর রোপাঙ্গি এলাকার একটি ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় কাজ করে। ষাটের দশকের শেষ দিকে রেস্তোরাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নেতৃস্থানীয় না হলেও এর সুনাম যথার্থই ছিল বলা যায়। বারবার আসে এ ধরনের অনেক খদ্দের এই। রেস্তোরাঁটির আছে আর তারা কখনো এর আতিথেয়তায় অসন্তুষ্ট নয়। এর ডাইনিং রুমের পরিবেশ খুব শান্ত। ফলে তরুণদের চেয়ে বয়স্ক খদ্দেররা বেশি আকৃষ্ট হন। এদের মধ্যে নাট্যজগতের কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি আর লেখক রয়েছেন।
পূর্ণকালিন দু’জন ওয়েটার সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে ওই রেস্তোরাঁয়। ওই মেয়েটি আর পার্টটাইম ওয়েট্রেস দু’জনই ছাত্রী। এ ছাড়াও একজন ফ্লোর ম্যানেজার আছেন। কাউন্টারে একজন মধ্য বয়সী মহিলা বসে। সারাক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকে সে। তার প্রধান দুটি কাজের একটি হচ্ছে অতিথিদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা গ্রহণ আর ফোন এলে তা রিসিভ করা। দরকারের সময়ই সে শুধু কথা বলে। সব সময়ই তার পরনে থাকে একই কালো পোশাক।
ফ্লোর ম্যানেজারের বয়স চল্লিশের শেষের কোঠায়। লম্বা তিনি আর চওড়া তার কাঁধ। শরীরের গাঁথুনি থেকে বোঝা যায় যৌবনে তিনি খেলোয়াড় ছিলেন। তবে ইদানীং পেট ও চিবুকে মেদ জমতে শুরু করেছে। তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করেন। তার একটা বিশেষ কাজ আছে- রেস্তোরাঁর মালিকের রুমে ডিনার পৌঁছে দেওয়া।
“রেস্তোরাঁ ভবনের ছতলায় মালিকের নিজের একটা রুম আছে,” সে বলল, “অ্যাপার্টমেন্ট অথবা অফিস কিংবা ওই জাতীয় কিছু।”
যে কোনো ভাবেই হোক সে আর আমি আমাদের বিশতম জন্মদিনের ব্যাপারে আলোচনায় মেতে উঠি। আমাদের দুজনের জন্য কেমন ছিল ওই দিনটি। অধিকাংশ লোকই বিশে পা-দেয়ার বিষয়টি মনে রাখে।
“রেস্তোরাঁয় তিনি কখনোই আসেন না। শুধু ম্যানেজারই তাকে দেখেছে। তার রুমে ডিনার পৌঁছে দেয়ার কাজটি কঠোরভাবে তারই। তিনি দেখতে কেমন অন্য কর্মচারীরা জানে না।”
“বস্তুত নিজের রেস্তোরাঁ থেকে হোম ডেলিভারি পাচ্ছেন মালিক।” “হ্যাঁ,” বলল সে, “প্রতিদিন রাত আটটায় ম্যানেজার তার রুমে খাবার নিয়ে যান। ওটা রেস্তোরাঁর সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। ম্যানেজারের অনুপস্থিতিতে আমাদের সবার সমস্যা। হয়; কিন্তু কারও কিছু করার নেই। কেননা সব সময় ও ভাবেই হয়ে আসছে। রুম সার্ভিসের জন্য ব্যবহৃত ট্রলিটাতে খাবার সাজিয়ে দেয়া হয়। ম্যানেজার তার চেহারায় ভক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে ট্রলিটা ধাক্কিয়ে এলিভেটরে তোলেন। পনের মিনিট পরে খালি হাতে ফিরে আসেন। ঘন্টা খানেক পর গিয়ে ট্রলিটা ফিরিয়ে আনেন তিনি। প্রতিদিন একইভাবে কাজটি তিনি করেন, ঘড়ির কাটা যেভাবে চলে সেই ভাবে। “প্রথম দিনে ব্যাপারটি দেখার পর খুব রহস্যজনক মনে হয়েছিল আমার। এক ধরনের ধর্মীয় আচারের মতো। পরে অবশ্য আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি আর ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাববার অবকাশ থাকে না।”
মালিকের খাবারের তালিকায় প্রতিদিন মুরগির মাংস থাকেই। সবজির বেলায় এক-আধটু পরিবর্তন হয়, কিন্তু মুরগি থাকবেই। এক তরুণ বাবুর্চি তাকে বলেছিল, কী হয় তা পরখ করার জন্য সে ক্রমাগত এক সপ্তাহ তাকে শুধু মুরগির রোস্ট পরিবেশন করে; কিন্তু কোনো অভিযোগ আসেনি।
১৭ নভেম্বর তার বিশতম জন্মদিনে যথারীতি কাজ শুরু করতে হয় তাকে। বিকেল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল আর তা মুষলধারে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পাঁচটার সময় দিবসের বিশেষ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করার জন্য ম্যানেজার সব কর্মচারীদের একত্র করেন।
রেস্তোরাঁর গেট খোলা হয় ছ’টায়। কিন্তু বৃষ্টির কারণে অতিথিরা আসতে দেরি করে। অনেক রিজারভেশন বাতিল করা হয়। মহিলারা জল কাদায় তাদের পোশাক বরবাদ করতে নারাজ। ম্যানেজার চুপচাপ পায়চারি করেন। ওয়েটাররা লবণদানি, মশলাদানি সাফ করে কিংবা বাবুর্চিদের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। সে ডাইনিং রুমে চোখ বুলায়। একটা মাত্র দম্পতি সেখানে বসে আছে। স্পীকার থেকে ভেসে আসা সঙ্গীত শুনছে তারা। রেস্তোরাঁর ভেতর খেলা করছে বিলম্বিত শরতের বৃষ্টির ঘ্রাণ।
সাড়ে সাতটার দিকে ম্যানেজার অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। কাঁপতে কাঁপতে তিনি পেট ধরে একটা চেয়ারে বসে পড়েন, যেন হঠাৎ গুলি খেয়েছেন। কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। “হাসপাতালে যাওয়া উচিত আমার।” বিড়বিড় করে বলেন তিনি। এ ধরনের শারীরিক অসুস্থতা তার জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন; কিন্তু এক দিনের জন্যও অনুপস্থিত থাকেননি। তার জন্য গর্বের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, অসুস্থতার জন্য একদিনও কামাই করেননি। ব্যথায় বিকৃত হয়ে যাওয়া তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। তার অবস্থা খুব খারাপ।
সে ছাতা নিয়ে রাস্তায় গেল আর একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে এল। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে ম্যানেজার তাকে বললেন, “আমি চাই রাত ঠিক আটটায় ৬০৪ নম্বর রুমে তুমি ডিনার নিয়ে যাবে। বেল বাজিয়ে শুধু বলবে, আপনার খাবার নিয়ে এসেছি’ খাবার রেখেই চলে আসবে।”
বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না। অতিথিরা আসছিল অনেকক্ষণ পর পর।
মালিকের খাবার তৈরি হয়ে গেলে সে ট্রলিটা এলিভেটরে নিয়ে তুলল আর সই করে চলে গেল ছ’তলায়। সাধারণ মাপের খাবার। আধা বোতল রেডওয়াইন, কফি, সেদ্ধ সবজির সঙ্গে মুরগির তরকারি, ডিনার রোল আর মাখন। খাবারের সুবাসে তখন এলিভেটর ভরপুর। বৃষ্টির ঘ্রাণের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। স্মৃতির ভেতর সে রুম নম্বর বার বার চেক করল। গলা পরিষ্কার করল, তারপর বেল টিপল। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বেল টেপার কথা ভাবল আর তখনই ভেতর থেকে হালকা-পাতলা এক বৃদ্ধ দরজা খুলে দিলেন। তিনি ওর চেয়ে চার-পাঁচ ইঞ্চি খাটো, পরনে কালো স্যুট আর নেকটাই।
“আপনার ডিনার এনেছি স্যার।” খানিকটা কর্কশ কণ্ঠে বলল সে, তারপর আবার গলা সাফ করল। কোনো রকম টেনশন হলেই তার গলার স্বর কর্কশ হয়ে ওঠে।
“ডিনার?”
“হ্যাঁ, স্যার। ম্যানেজার সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমি এনেছি।”
“ও তাই বলো।” যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন; তখনও তার হাত দরজার নবে।
“অসুস্থ, তাই বললে না?”
“হঠাৎ পেট ব্যথা শুরু হলে হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে, তার ধারণা ওটা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা।”
“তাই নাকি? সে তত ভাল কথা নয়।”
সে গলা পরিষ্কার করে বলল, “আপনার খাবার ভেতরে আনব স্যার?”
“হ্যাঁ নিয়ে এসো, অবশ্যই যদি তোমার মর্জি হয়, সেই তো ভাল আমার জন্য।”
যদি আমার মর্জি হয়? ভাবল সে। কী অদ্ভুত প্রকাশ ভঙ্গি। আমার আবার মর্জি কী?
বৃদ্ধ দরজাটা ভাল করে খুললে সে ট্রলিটা ভেতরে ঢোকাল। ঘরের প্রথম দিকটায় একটা বড় স্টাডি, যেন বসবাসের অ্যাপার্টমেন্ট শুধু নয় ওটা একটা কাজ করার। জায়গাও। জানালা দিয়ে টোকিও টাওয়ার নজরে আসছে। বৃদ্ধ সোফার সামনে রাখা প্লাস্টিকের টেবিলের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করলে সে ওই টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়ে দিল।
“খাওয়া শেষ হলে বাসন-কোসনগুলো বারান্দায় রেখে দেবেন দয়া করে, ঘন্টা খানেক পরে এসে নিয়ে যাব।”
“ঠিক আছে।”
“আর কোনো কিছু কি লাগবে স্যার?”
একটুখানি ভেবে তিনি বললেন, “মনে হয় লাগবে না কিছু।”
“ঠিক আছে স্যার, আমি তাহলে অন্য কাজ করি গিয়ে।”
“না, একটুখানি দাঁড়াও।” বললেন তিনি।
“কী স্যার?”
“তুমি কী পাঁচটা মিনিট সময় দেবে আমাকে? তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।”
ওই অনুরোধে এত নম্রতা ছিল যে, সে একটু লজ্জা পেল। “না না ঠিক আছে স্যার কোনো অসুবিধা নেই।” পাঁচ মিনিটের ব্যাপারই তো, তাই না? শত হলেও
পছ মানর ই, তিনি তার নিয়োগকর্তা। ঘন্টা চুক্তিতে মজুরি দিচ্ছেন। আর এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় না তিনি তার কোনো ক্ষতি করবেন।
তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, “সে যা-ই হোক, তোমার বয়স কত মেয়ে?”
“আমার বয়স এখন বিশ।”
“বিশ?” পুনরাবৃত্তি করে তিনি বললেন, “কখন থেকে বিশ বছর?” তিনি তার চোখ দুটো এমনভাবে সংকুচিত করলেন যেন কোনো ফাটলের ভেতর দিয়ে তাকাচ্ছেন।
“এই মুহূর্তে আমার বয়স বিশ। আজ আমার জন্মদিন স্যার।”
“তাই নাকি, আজ তোমার বিশতম জন্মদিন?”
সে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
“ঠিক বিশ বছর আগের এই দিনে পৃথিবীতে তোমার জীবন শুরু হয়।”
“ধ্রুব সত্যি কথা এটা।”
“বেশ বেশ। চমৎকার। হ্যাপি বার্থ ডে।”
“ধন্যবাদ স্যার।” তখনই তার মনে পড়ল সারাদিনে তিনিই শুধু তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ওইটা থেকে তার বাবা-মা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে থাকলে বাসায় ফিরে অ্যানসারিং মেশিনে দেখতে পাবে সে।
“তাহলে তো জন্মদিনটা উদ্যাপন করতে হয়,” বললেন তিনি, “এস একটু খানি রেড ওয়াইন পান করা যাক।”
“ধন্যবাদ স্যার, এখন তো সম্ভব নয়, এটা আমার কাজের সময়।”
“শুধু একটুখানি খেলে কেউ তোমার দোষ ধরতে যাবে না। উদ্যাপনের জন্য প্রতীকী পান, আর কিছু নয়!”
তারা গ্লাস ঠোকাঠুকি করলেন।
“জন্মদিনের শুভেচ্ছা,” তিনি বললেন, “তোমার জীবন ঋদ্ধ আর ফলপ্রসু হোক। সেখানে যেন কোনো অশুভ ছায়া না পড়ে।” সে নিজে নিজে কথাটার পুনরাবৃত্তি করল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে তিনি এ রকম অস্বাভাবিক বাক্য বেছে নিলেন কেন?
“বিশতম জন্মদিন মানুষের জীবনে একবারই আসে হে মেয়ে। দিনটি কখনো বদলানো যায় না। বুঝলে?”
সতর্কতার সঙ্গে সামান্য একটু মদ গলায় ঢেলে সে বলল, “জ্বি স্যার, আমি জানি।”
“আমার জীবনের এই বিশেষ দিনে হৃদয়বতী পরীর মতো আমার ডিনার নিয়ে এসেছ।”
“আমার কর্তব্য করছি মাত্র স্যার।”
“তারপরও…হে আমার তন্বী তরুণী।”
বৃদ্ধ লোকটি চেয়ারে বসে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আর সে বসে আছে একটা সোফার কিনারায়, হাতে ওয়াইনের গ্লাস। এক হাঁটুর ওপর আরেকট হাঁটু স্থাপিত। গলা পরিষ্কার করে সে তার স্কার্ট টেনে ঠিকঠাক করল। জানলার কপাটে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে। ঘরময় অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য।
“এটার একটা বিশেষ সমকেন্দ্রিকতা থাকা উচিত, না কী বল তুমি?”
কোনো মতেই দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে পারল না সে, তবে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। রঙ জ্বলে যাওয়া নেক টাই স্পর্শ করে তিনি বললেন, “সেই কারণে, আমি মনে করি তোমাকে একটা উপহার দেয়া আমার জন্য জরুরি। একটা বিশেষ জন্মদিন একটা বিশেষ স্মারক উপহারের দাবি রাখে।”
খানিকটা বিচলিত হয়ে মাথা নাড়ল সে। বলল, দয়া করে দ্বিতীয়বার আর ওকথা বলবেন না স্যার। ওদের হুকুম তামিল করতে আমি আপনার ডিনার এখানে নিয়ে এসেছি।”
বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার দু’হাতের পাতা তুলে বললেন, “এমন কথা বলো না মেয়ে। তোমার জন্য যে উপহারের কথা আমি ভেবেছি তা কোনো দৃশ্যমান বস্তু নয়। এমন। জিনিসও নয় যার গায়ে দাম লেখা থাকবে…।” তিনি টেবিলে হাত রেখে ধীরে ধীরে শ্বাস নিলেন, তারপর বললেন, “তোমার মতো সুন্দরী একটা মেয়ের জন্য আমি যা করতে চাই তা হলো- তোমার কোনো আকাক্ষা আমি পূর্ণ করব। যে কোনো ইচ্ছে,
যে কোনো সাধ, ধরে নাও এ ধরনের কোনো কামনা আছে তোমার।
“যে কোনো ইচ্ছে, যে কোনো আকাক্ষা?” গলা শুকিয়ে এল তার।
“যে কোনো ইচ্ছে, যাকে বাস্তবে রূপ দিতে চাও তুমি। তোমার যদি কোননা ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা থাকে বলো আমাকে। তবে একটি মাত্র ইচ্ছের কথাই বলতে। হবে, যা আমি পূর্ণ করব। শুধু একটি মাত্র ইচ্ছে, পরিবর্তন করতে পারবে না আর। ফিরিয়ে নেয়া যাবে না- এই আমার শর্ত।”
“কোনো কিছু পাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতে হবে আমাকে আর আপনি তা পূরণ করবেন তাই-তো?”
ওই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বৃদ্ধ মুচকি মুচকি হাসলেন। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আর স্বাভাবিকভাবে কাজটি করলেন তিনি।
“কী মেয়ে তোমার কোনো আকাক্ষা আছে? না নেই?” কোমল সুরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
.
“সত্যি তাই হয়েছিল, সে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বানিয়ে বলছি না কিন্তু।”
“না, তা বলবে কেন।” আমি বললাম। সে এমন মেয়ে নয়, যে হাওয়া থেকে পেয়ে একটা ফালতু গল্প ফেঁদে বসবে। “তা ইচ্ছেটা কি ব্যক্ত করেছিলে?”
সে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোট্ট একট শ্বাস ছাড়ল। “আমাকে ভুল বুঝো না,” সে বলল, “তার ওই কথা একশ ভাগ সিরিয়াসলি নেইনি আমি। বিশ বছর বয়সে তো কেউ কল্পনার রাজ্যে বাস করতে পারে না। ওটা যদি তার কোনো ঠাট্টা মস্করার আইডিয়া হতো তাহলে হয়ত আমি ওখানে বসেই বলে দিতাম। তিনি ছিলেন চৌকশ এক বুড়ো। চোখ দুটো পিট পিট করত। কাজেই তার সঙ্গে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যা-ই বল না কেন ওটা ছিল আমার বিশতম জন্মদিন। আমি চাইনি ও রকম একটা দিনে আমার জীবনে সাদামাটা কিছু ঘটুক। বিশ্বাস করা বা না করার ব্যাপার ছিল না ওটা।”
কিছু না বলে আমি মাথা নাড়লাম।
“বুঝতেই পারছ কেমন লাগছে আমার। বিশতম জন্মদিন শেষ হয়ে যাচ্ছে বিশেষ কোনো ঘটনা ছাড়াই। কেউ হ্যাপি বার্থডে বলে উইশ করছে না আর আমি হেরিং মাছের চাটনিসহ ‘টরটিলিনি’ নামক খাবার লোকের টেবিলে টেবিলে পৌঁছে দিচ্ছি।”
আমি আবার মাথা নেড়ে বলি, “ভেবো না, বুঝতে পেরেছি।”
“অতএব আমার ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেছি।”
.
বৃদ্ধ লোকটি কোনো কথা না বলে ওর দিকে শুধু তাকিয়ে থাকেন। হাত দুটি টেবিলে রাখা তখনও। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মোটা মোটা ফোল্ডার, হতে পারে হিসেবের খাতা, লেখার সরঞ্জাম, ক্যালেন্ডার আর সবুজ শেডঅলা একটা। ল্যাম্প। জানালার কাঁচে তখনও বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে। সাটার গলিয়ে ঢুকে পড়েছে টোকিও টাওয়ারের আলো।
বৃদ্ধ লোকটির কপালের ভাজ একটুখানি গম্ভীর হয়েছে। “তাহলে ওটাই তোমার ইচ্ছে।”
“হ্যাঁ, ওটাই…।”
তিনি বললেন, “ তোমার বয়সী মেয়ের জন্য ওটা অস্বাভাবিক। অন্য রকম কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম আমি।”
“থাক তাহলে, অন্য কিছু চাই আমি,” গলা পরিষ্কার করে সে বলল, “কিছু মনে করিনি আমি, অন্য কিছু না হয় কামনা করব, বুঝলেন কিনা?”।
হাত দুটো পতাকার মতো দুলিয়ে তিনি বললেন, “না না কোনো অসুবিধা নেই ওটাতে। বলছিলাম কী, এমন কিছু চাইতে পার না? এই যেমন তুমি আরও সুন্দরী বা স্মার্ট হতে চাও, কিংবা চাও অনেক ধনদৌলত। ও সব না চেয়ে ভালই করেছ, সাধারণ কোনো মেয়ে হয়ত ওরকম চাইত।”
সঠিক শব্দ চিন্তা করে বের করার জন্য খানিকটা সময় নিল সে। বৃদ্ধ নীরবে অপেক্ষা করছেন শুধু। তার হাত জোড়া টেবিলের ওপর।
“অবশ্যই আমি আরও সুন্দরী, আরও স্মার্ট আর ধনী হতে চাই। কিন্তু আমি জানি না ওগুলোর কোনো একটা সত্যি হলে আমার দশা কী হবে। হতে পারে তা আমার প্রত্যাশারও বেশি যা সামলানো সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। এখনও জানিনা কী আছে এই জীবনে আর তা কীভাবে চলে।”
“ও আচ্ছা।” নিজের এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলে জড়িয়ে এবং বের করতে করতে তিনি বললেন, “ও আচ্ছা।”
“তাহলে আমার ইচ্ছেটা ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই।”
বৃদ্ধ দ্রলোক হঠাৎ তার দৃষ্টি শূন্যে স্থাপন করলেন। তার কপালের ভাঁজ আরও গম্ভীর হলো। কপালের ওই ভঁজ গিয়ে পড়তে পারে তার মস্তিষ্কেও, কেননা এটা তার ভাবনায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
তিনি বললেন, “তোমার প্রত্যাশা মঞ্জুর হয়েছে। যা চেয়েছ তা-ই পাবে তুমি।”
“সত্যিই?”
“হ্যাঁ, কোনো সমস্যাই হয়নি তন্বী তরুণী। জন্মদিন শুভ হোক। এখন কাজে ফিরে যেতে পার। ভেবো না, তোমার ট্রলি আমি পাঠিয়ে দেবো।”
এলিভেটরে চড়ে সোজা রেস্তোরাঁয় নেমে এলো সে। বিরক্তিজনক হালকা অনুভব করছিল সে, যেন রহস্যময় নরম পেঁজা তুলোর ওপর দিয়ে হাঁটছে। তরুণ ওয়েটারটি তাকে দেখে বলল, “ঠিক আছেন তো আপনি? কেমন নেশাগ্রস্তের মতো লাগছে আপনাকে।”
দুর্বোধ্য একটা হাসি দিয়ে সে বলল, “তাই নাকি? কিন্তু আমি তো ভালই আছি।”
“আমাদের মালিক সম্বন্ধে কিছু বলুন। দেখতে কেমন তিনি?”
“সে তো জানি না, তার দিকে ভাল করে আমি তাকাইনি।” আলাপ সংক্ষিপ্ত করে বলল।
ঘন্টা খানেক পরে ট্রলিটা আনতে ওপরে গেল সে। রুমের বাইরে ছিল ওটা। বাসন-কোসনগুলো ওপরে রাখা। মুরগির তরকারি, সবজি এসব নেই। ওয়াইন আর কফির পাত্র খালি। ৬০৪ নম্বর রুম বন্ধ- নির্বিকার। একবার ঘরটার দিকে তাকাল সে। তার মনে হলো যে কোনো সময় দরজা খুলে যেতে পারে; কিন্তু খুলল না। সে এলিভেটরে করে ট্রলিটা নিচে নামিয়ে এনে ডিশওয়াশের কাছে রাখল।
.
“আমি আর কোনোদিন মালিককে দেখিনি,” সে বলল, “একবারও না। ম্যানেজারের অসুস্থতাটা ছিল সাধারণ পেট ব্যথা। হাসপাতাল থেকে ফিরে পরের দিন থেকেই তিনি মালিকের রুমে খাবার পৌঁছাতে শুরু করেন। নতুন বছরের সূচনালগ্নে আমি ওই চাকরি ছেড়ে দেই, আর কখনো ওখানে যাইনি। আমার মনে হয়েছে ওখানে না যাওয়াই ভাল। এক ধরনের পূর্বাশঙ্কার মতো ছিল ব্যাপারটা।”
নিজের ভাবনায় ডুবে থেকেই সে আবার বলল, “কখনো কখনো আমার মনে হয়, আমার বিশতম জন্মদিনে যা ঘটেছে তা ছিল এক ধরনের ভ্রান্তি বা মায়া। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, ওটা ঘটেছে আমাকে এই বোঝাতে যে, যা কিছু ঘটে তা সব সত্য নয়। তবে আমি নিশ্চিত যে, ওটা ঘটেছিল। এখনও আমি রুম নম্বর ৬০৪ এর প্রতিটি আসবাবপত্রের কথা স্পষ্ট মনে করতে পারি। যা কিছু ওখানে ঘটেছিল সব ছিল সত্য, আমার কাছে এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্থও আছে।”
নিজেদের ভাবনা ভাবতে ভাবতে আর নিজেদের পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে কিছুক্ষণ নীরব রইলাম আমরা দুজন।
“একটা জিনিস যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করি তাহলে মাইন্ড করবে তুমি?” আমি বললাম, “একটা কথা নয় ধরো দুটো ব্যাপার জানতে চাই।”
“ঠিক আছে জিজ্ঞেস কর। আমার অনুমান সেদিন আমি কী চেয়েছিলাম তা জানতে চাও তুমি। ওটি তোমার প্রথম জিজ্ঞাসা।”
“কিন্তু তোমার কথা থেকে মনে হচ্ছে ও কথা তুমি কাউকে বলতে চাও না।”
“তাই মনে হচ্ছে নাকি?”
আমি মাথা নাড়ি।
দূরের কোনো বস্তু দেখতে গিয়ে লোকে যেমন চোখ সংকুচিত করে তেমনি চোখ ছোট করে সে বলল, “ওই ইচ্ছের কথা কাউকে জানানো কি ঠিক।”
“ওসব তোমার কাছ থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার জানার বিষয় একটিই, ওটা বাস্তবে রূপ নিয়েছিল কিনা। আর যা তুমি চেয়েছিলে তা না চেয়ে অন্যকিছু চাওনি বলে তোমার দুঃখ আছে কিনা।”
“প্রথম প্রশ্নের জবাব হচ্ছে হ্যাঁ একই সঙ্গে না।… শেষে ব্যাপারটা কীভাবে সমাধান করা হবে তা আমাকে দেখানো হয়নি।”
“তার মানে এটা এমন ইচ্ছে যা বাস্তবায়নের জন্য সময়ের প্রয়োজন?” “তা বলা যেতে পারে।”
“নির্দিষ্ট কোনো খাবার রান্না করার মতো ব্যাপার?”
সে মাথা নাড়ল।
“আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর কী?”
“কী যেন ছিল ওটা?”
“যা চেয়ে ফেলেছ তার জন্য কোনো দুঃখ আছে নাকি?”
কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর সে বলল, “আমি এখন বিবাহিতা। আমার স্বামী আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। আমার দুটি সন্তান- একটি ছেলে, একটি মেয়ে। আমাদের একটা শিকারি কুকুর আছে। আমি একটা অডি গাড়ি চালাই। সপ্তাহে দু’দিন বান্ধবীর সাথে টেনিস খেলি। এই তো আমার জীবন এখন।”
“শুনতে খুব ভাল লাগছে আমার।” আমি বললাম।
“যদিও আমার অডি গাড়ির বাম্পারের দুটি জায়গা তুবড়ে গেছে।”
“ওহে, বাম্পার তো থাকে তুবড়ানোর জন্যই।”
“আচ্ছা একটা কথা বলে আমাকে, আমার জায়গায় তুমি থাকলে কী করতে?”
“বিশতম জন্মদিনের কথা বলছ তো?”
“আরে তা-ই তো।”
তার ওই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য কিছুটা সময় নিলাম; কিন্তু একটি মাত্র ইচ্ছে তালাশ করে পেলাম না।
“কোনো কিছুই ভাবতে পারছি না আমি; স্বীকার করে নিয়ে আমি বললাম, “বিশতম জন্মদিন থেকে আমি অনেক দূরে…।”
“আসলে কিছু ভাবাই সম্ভব নয় তোমার পক্ষে।” আমি মাথা নাড়লাম।
“কিছুই না?”
“না, কিছুই না।”
সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কারণ এর মধ্যেই তুমি তোমার ইচ্ছে ঠিক করে ফেলেছ।”