মনোরমা – দ্বিতীয় খণ্ড – সন্ধান ও সংশয়

দ্বিতীয় খণ্ড – সন্ধান ও সংশয়

প্রথম পরিচ্ছেদ – উকিল তুলসীদাস

উকিল তুলসীদাস বসুর বাটী ভবানীপুর—কাঁসারীপাড়া। দেবেন্দ্রবিজয় ঠিক সুযোগমত তাঁহার সহিত সেই ছদ্মবেশে সাক্ষাৎ করিলেন। তখন তুলসীদাস একাকী ছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় তাঁহার সমীপস্থ হইয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়ের নাম কি তুলসীদাস উকিল?”

তুলসীদাস বলিলেন, “হাঁ, আমি উকিল; আমারই নাম তুলসীদাস বসু।”

দে। তবে ত ভালই হয়েছে, মশায়! আমি একটা বড় দরকারে আপনার শরণ নিতে এসেছি। আপনাকে দেখে আমার প্রাণের মধ্যে ভক্তি হচ্ছে—বড্ড ভক্তি হচ্ছে—আমি আমার একজন স্যাঙাতের কাছে আপনার অনেক সুখ্যেত্ শুনেছি।

তু। হ’তে পারে। তোমার নাম কি?

দে। আমার নাম পেলারাম সামন্ত। আমার নাম যদি পেলারাম সামন্ত হয়, আমার ঠাকুরের নাম ঈশ্বর খেলারাম সামন্ত—তা’ হ’লে আমার ঠাকুরদাদার নাম গয়ারাম সামন্ত—তা’ যদি হ’ল—তা’ হ’লে-

তু। (বাধা দিয়া) গয়াপ্রাপ্তি। যথেষ্ট হয়েছে; তোমার বংশাবলীর তালিকায় আমার কোন প্রয়োজন নাই।

দে। নাই? তবে আর ব’লে কি হবে? দরকার নাই—কি বলেন? তবে আর দরকার কি? যাই হ’ক, আপনিই না লোকজন পাগল হ’লে তার চিকিচ্ছার ব্যবস্থা ক’রে দেন? আপনার তাঁবে না একজন কে ভাল কোরেজ আছে—সে নাকি পাগল-রোগে বড় ওস্তাদ? অনেক পাগলকে নাকি আপনি তার কাছে পাঠিয়ে আরাম ক’রে দিয়েছেন? ধন্যি দয়া আপনার!

দেবেন্দ্রবিজয় এই কথাগুলি এমনভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, যেন তাহাতে ছলনার কিছুই নাই; তিনি যেন নিতান্ত সরল মনে উকিল বাবুকে এই প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি যেজন্য এরূপ প্রশ্ন করিলেন, তাহা তাঁহার প্রত্যক্ষ হইল। তাঁহার কথায় উকিলবাবু সহসা কেমন যেন একটু চমকিত হইয়া উঠিলেন।

উকিল বাবু তখন গৰ্জ্জন করিয়া উঠিলেন, “তাতে তোমার ইষ্টাপত্তি কি হে, বাপু?”

দে। ইষ্টাপত্তি আছে, মশাই! না থাকলে আর কি বলি! আমার একটি মেয়ে আছে, সে একেবারে বদ্ধ-পাগল—আমার স্যাঙাৎ দুগ্‌গোদাস ব’লেছিল, যে আপনি অনেক—

উ। (বাধা দিয়া) তুমি কোথায় থাক?

দে। মেটেবুরুজে। দুগ্‌গোদাসের মুখে শুনলেম—কোন্ একটা পাগলী মেয়ে এসে নাকি আনন্দ-কুটীরটা তার নিজের ব’লে দিনরাত এখানে সেখানে কেঁদে কেঁদে পথে পড়ে বেড়াত; আপনিই নাকি তাকে দয়া ক’রে সেই কোন্ ভাল কোরেজ, তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যদি মশাই, আমার কথা রাখেন—রাজলোক আপনি—আমার মেয়েটিকে যদি–

উ। (বাধা দিয়া) আমার দ্বারা কিছু হবে না।

দে। কিচ্ছু হবে না? পারবেন না আপনি, মশাই? কেন?

উ। ও কাজ আমার নয়।

দে। কে’ন, আমি দুগ্‌গোদাসের মুখে শুনলেম, এ আপনারই কাজ—এ দয়া আপনারই।

উ। তোমার দুগ্‌গোদাস ভুল বলেছে। তোমার যদি বিশেষ দরকার হয়, নিজে ডাক্তার ডাকতে পার; তারা তোমার মেয়ের রোগ সারাবার বন্দোবস্ত ক’রে দেবেন। আমি উকিল—আমি ও সকল কিছু বুঝি না।

দে। ওঃ! দুগ্‌গোদাস তবে ত আচ্ছা মিথ্যাবাদী—ভয়ানক মিথ্যাবাদী!

উ। নিশ্চয়ই

দে। তবে সে মেয়েটিকে কি আপনি মশাই—

উ। (বাধা দিয়া) আমি সে মেয়েটিকে কেন গারদে পাঠাতে যাব? আমি না; সে কথা ডাক্তারেরা জানেন। সেই মেয়েটি পাগল কি না, সেই বিষয়ে আমি সাক্ষী ছিলাম মাত্ৰ।

দে। সে পাগল কি না, তাই আপনি ঠিক করেছেন মাত্র। সে মেয়েটা কি সত্যি পাগল?

উ। (অন্যমনস্কে) না, পাগল নিশ্চয়ই নয়—তবে—

দে। তবে পাগল নয়? তবে আপনি তাকে কি ক’রে পাগল ব’লে সেনাক্ত করলেন?

উ। হাঁ—হাঁ—না—না—পাগল বৈকি। এখন তুমি যাও—আমি বড় ব্যস্ত আছি।

দে। তা’ত দেখতেই পাচ্ছি—আর একটা কথা, মশাই—

উ। কি, বলে যাও; এখন আমার সময় বড়ই কম।

দে। সে ডাক্তারদের নাম কি, আমায় যদি বলেন, আমার পাগলী মেয়ে ক্ষেন্তিকে নিয়ে আমি বড্ড নাস্তানাবুদ হচ্ছি।

উ। তা’ আমি কি করব? আমি সে ডাক্তারদের নাম জানি না।

দে। জানেন আপনি মশাই—গরীবের মা-বাপ আপনারা—

উ। তুমি বড়ই বাড়িয়ে তুলছ দেখছি, এখন বাজে নষ্ট করি, এমন সময় আমার নেই— এখন তুমি যাও।

দে। যাচ্ছি—তবে যদি—

উ। (সক্রোধে) তবে তোমার মাথা— বেল্লিক কোথাকার–বলছি আমার সময় নাই, এখনি এখান থেকে চলে যাও।

এই বলিয়া উকিল তুলসীদাস সদম্ভে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। উকিলটি আকারে অলৌকিক দীর্ঘ।

দে। এখনই যেতে হবে?

উ। হাঁ, এখনই—এই মুহূৰ্ত্তে।

দে। যাচ্ছি;এসে কতক্ষণ ধ’রে আপনার কাছে রয়েছি; কেমনই একটা মায়া ব’সে গেছে, তাই যেতে পারছি না, হঠাৎ চ’লে গেলে অভদ্রতা হবে যে—ক্রমে ক্রমে যাচ্ছি।

উ। এখন যদি তুমি এখান থেকে না যাও, গলাধাক্কা দিয়ে তোমাকে এখান থেকে দূর করে দেবো।

দে। একেবারে এত কড়া হবেন? গলাধাক্কা দেবেন? অপরাধ?

উ। আমি তোমাকে পঞ্চাশবার বলছি, এখন আমি বড় ব্যস্ত আছি—এখান থেকে স’রে পড়।

দে। বটে, এতক্ষণ গে’ছে—আর একটু থাকি—তাতে আপনার বড় ক্ষেতি হবে না!

উ। তবে তুমি স্ব-ইচ্ছায় যাচ্ছ না—গলাধাক্কাটা না দিলে তোমার মনঃপুত হবে না?

দে। গলাধাক্কাটা দিলে মশায়েরও বিপদ ঘ’টে যাবে।

উ। বিপদ! আমার বিপদ?

দে। হাঁ মশাই; আমার আবার মিরগীরোগ আছে; থাকি থাকি মুচ্ছো যাই। এর উপরে যদি আপনি আমায় ধাক্কাধুক্কি দেন; তা’ হ’লে একেবারে কেষ্ট পাবো।

“দূর হ–পাজী, বদমায়েস—দূর হ, এখান থেকে”, বলিয়া তুলসীদাস এক লম্ফে সবেগে দেবেন্দ্রবিজয়ের স্কন্ধে পড়িলেন! দেবেন্দ্রবিজয় অপ্রস্তুত ছিলেন না; যেমন উকিলবাবু তাঁহার গলদেশে হস্তার্পণ করিতে যাইবেন—তিনি তাঁহার সেই হাতখানি ধরিয়া তাঁহাকে বন্ বন্ শব্দে কয়েকবার ঘুরাইয়া ছাড়িয়া দিলেন; উকিলবাবুর দীর্ঘ দেহ ঘুরিতে ঘুরিতে গৃহের এক কোণে গিয়া পড়িল। মস্তক ঘূর্ণায়মান—সমগ্র পৃথিবী ঘূর্ণায়মান–উকিলবাবু উঠিতে প্রয়াস পাইলেন, পারিলেন না—আবার পড়িয়া গেলেন।

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমি ত মশাইকে আগেই বলেছি, আমার মুচ্ছোগত বায়ুরোগ আছে। যাকে আপনারা মিরগীরোগ বলেন—সেই মিরগীরোগও আমার আছে। বুঝেসুঝে কাজ করতে হয়—চাষা-ভূষা লোক আমরা—আমাদের সব লোক গোঁয়ার-গোবিন্দ—আসি তবে, নমস্কার।” চকিতে দেবেন্দ্রবিজয় গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। বাহির বাটীর প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে যখন দেবেন্দ্রবিজয় উপস্থিত হইলেন, তাঁহার পার্শ্ব দিয়া একটি রমণী বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল—রমণীর মুখমণ্ডল আনয়নবিলম্বী অবগুণ্ঠনে আবৃত।

দেবেন্দ্রবিজয়কে যাইতে দেখিয়া রমণী ভিতর বাড়ির দ্বারের দিকে অগ্রসর হইতে হইতে চিন্তান্বিত মনে বলিল, “তাই ত, দেবেন্দ্রবিজয় না? আশ্চর্য্য, এখানে কেন?”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অবগুণ্ঠনবতী কে?

সেই কৃতাবগুণ্ঠনা রমণী উকিল মহাশয়ের নিভৃতকক্ষে প্রবেশিয়া, সশব্দে দ্বারে অর্গলবদ্ধ করিয়া তুলসীদাসকে জিজ্ঞাসা করিল, “ কেউ এর মধ্যে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করেছিল?”

উকিলবাবু তখন নিজের সাহায্যে নিজে উঠিয়া হাঁপাইতেছিলেন; হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন, “হাঁ, একটি লোক এসেছিল বটে।”

রমণী। কে?

উ। চাষা-ভূষার মধ্যে একটা—মেটেবুরুজে তার বাড়ি।

র। আপনার কাছে তার কি দরকার ছিল?

উ। তার নাকি একটা পাগলী মেয়ে আছে—সেই মেয়েটির চিকিৎসার বন্দোবস্ত করবার জন্য; কিন্তু আমার মতে লোকটার মেয়ে যত পাগল হ’ক আর না হ’ক— লোকটা তার চেয়ে বেশি পাগল।

র। আমার মতে আপনি তাদের দুজনের চেয়ে আরও বেশি পাগল!

উ। কেন, এ কথা তুমি বলছ কেন?

র। সে কথা পরে বলছি; আগে আমার কথার উত্তর করুন—লোকটা প্রথমে আপনাকে কি বললে?

উ। এইমাত্র ত তোমাকে বললেম।

র। তার মেয়েকে কোন চিকিৎসকের নিকট রাখতে চায়, এই ত? সেজন্য আপনার কাছে এসেছিল কেন?

উ। তার এক বন্ধু তাকে পাঠিয়েছে। সে নাকি মনোরমার বৃত্তান্ত অবগত আছে।

র। আমিও তাই মনে করছিলাম। মোট কথা তোমার চাষা-ভূষা লোকটা আর কেউ নয়— স্বয়ং দেবেন্দ্রবিজয়।

তুলসীদাস স্তম্ভিত হইলেন। বিস্ময়, ভয়, সন্দেহ, ক্রোধ যুগপৎ তাঁহার মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইয়া উঠিল।

তুলসী। কি ক’রে জানলে তুমি?

র। জানলুম।

তু। কোথায় তাকে তুমি দেখলে?

র। এইমাত্র বার-বাড়ির উঠানে। আমি তাকে এই রকম ছদ্মবেশে থাকতে আর একদিন দেখেছি।

তু। তোমার ভুল হয় নি ত?

র। আমার আজ পর্য্যন্ত ত কোন ভুল হয় নি।

তু। বেশ, তুমি যদি তাকে দেবেন্দ্রবিজয় ব’লেই অনুমান ক’রে থাক, তা’ হ’লে সে নিশ্চয়ই তাই—নিঃসন্দেহ। তোমাকে সে জানে?

র। না।

তু। আমার কাছে কি দরকারে এসেছিল?

র। আপনার কাছে কি দরকারে এসেছিল, সে কথা কি আমি আপনাকে বলব? মন্দ নয়! আপনার মনে কি কিছুমাত্র সন্দেহ হয় নি? আচ্ছা, আমি কিন্তু আপনাকে সে দরকারের কথা বলতে পারি।

তু। বল, তোমার কথায় আমি স্তম্ভিত হ’য়ে গেছি।

র। বলছি। যদি আমি আর এক ঘণ্টা আগে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেম, তা’ হ’লে আপনি তার এখানে আসবার যে কি দরকার, তখনই তা বুঝতে পারতেন—নিজে নিজে সাবধানও হ’তে পারতেন।

তু। আমি ত কিছুই বুঝতে পারছি না।

র। সে আপনাকে যতদূর বোকা বানাতে হয়, তাই বানিয়ে গেছে।

তু। কি হয়েছে? ব্যাপার কি?

র। সে পালিয়েছে।

তু। কে?

র। মনোরমা।

তু। পালিয়েছে! কখন? কেমন ক’রে পালাল?

র। চার দিন হ’ল—বড়ই চালাকি খেলে পালিয়েছে।

তু। বিশ্বাস হয় না—কবিরাজ কোথায় ছিল?

র। ঘুমোচ্ছিল।

তু। অবশ্যই সে তাকে ধরবার চেষ্টা করেছে। ধরতে পারে নি?

র। না—এখনও ধরতে পারে নি—সন্ধান পেয়েছে মাত্র।

তু। কোথায়—সে কোথায় আছে?

র। এই ভবানীপুরে।

তু। আর আমাদের গোবিন্দ কবিরাজ?

র। ভবানীপুরে।

তু। কি রকম সন্ধান পেয়েছে?

র। কালীঘাটের এক চটীতে মনোরমার এক বুচকী পাওয়া গে’ছে—মনোরমাকে দেখতে পাওয়া যায় নি।

তু। তবে আর চিন্তা কি—সে নিশ্চয়ই তার বুচকী নিতে আবার সেইখানে ফিরে আসবে।

র। বিশ্বাস হয় না।

তু। বিশ্বাস না হবার কারণ?

র। কারণ? দেবেন্দ্রবিজয়ের এখানে আবির্ভাব।

তু। হ’লেই বা—তাতে হয়েছে কি?

র। উকিল আপনি—এইটুকু বুঝতে পারলেন না? সে এখন দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে গিয়ে পড়েছে। দেবেন্দ্রবিজয় তেমন কাঁচা লোক নয় যে, মনোরমাকে বুচকী আনতে সেখানে ফিরে পাঠাবে।

তু। তবে কি তুমি বোধ কর, দেবেন্দ্রবিজয় মনোরমার এ কেস্ নিজের হাতে নিয়েছে?

র। তাতে আর সন্দেহ আছে!

তু। মনোরমাকে লুকিয়ে রেখেছে?

র। হাঁ গো!

তু। কোথায়?

র। কোথায় আবার? তার নিজের বাড়িতে।

তু। কোথায় তার বাড়ি, জান?

“জানি” বলিয়া রমণী একবার মৃদু হাসিল; হাসিয়া বলিল, “আমার অজানা এখানে কি আছে? চারিদিক্কার খবর রাখতে পারি ব’লেই এখনও পর্যন্ত রাণীর হালে আছি; নতুবা এতদিন আমার জেলখানা-বাসের সুবন্দোবস্ত হত। দেবেন্দ্রবিজয় চক্রবেড়ে থাকে।”

“এখন কি করা যায়? উপায় কি?”

“এক উপায় আছে, তাকে সেখান থেকে টেনে বা’র ক’রে আনা।”

“বড়ই শক্ত ব্যাপার!“

“শক্ত ব্যাপার কি? দেখবেন ঐ মনোরমাকে আবার আমরা হস্তগত করবই করব; তারপর এমন জায়গায় তাকে পাঠাব, যেখান থেকে আর সে কখনও পালাতে পারবে না।“

“বহুৎ আচ্ছা! আচ্ছা, তুমি কি মনে কর, মনোরমা দেবেন্দ্রবিজয়কে নিজের বৃত্তান্ত বলেছে?”

“না বললে আর দেবেন্দ্রবিজয়ের সহসা এখানে আবির্ভাব হবে কেন?”

“লোকটা কিন্তু বড়ই ভয়ানক।”

“দেবেন্দ্রবিজয় চিরকালই ভয়ানক।”

“কিন্তু মনোরমাকে তার হাত থেকে একবার বা’র ক’রে আনতে পারলে আর তাকে ভয় করবার কারণ কি আছে?”

“হাঁ, যদি না তার খুনের বিষয়ে সে তদারক করে।“

“কার খুনের? মনোরমার? মনোরমাকে কি খুন করবে?”

“হাঁ, নতুবা দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে পরিত্রাণ নাই। যদি মনোরমাকে জীবিত রাখি, সে আবার যে কোন প্রকারে তাকে খুঁজে বার করবে। আমাদের আবার নানা বিপদে পড়বার সম্ভাবনা হবে। মনোরমা ম’রে গেলে সে কা’কে নিয়ে আর নিজের কাজ চালাবে? আমরা ত তখন আমাদের জাল গুটিয়ে খুব সতর্ক থাকব।”

“যদি না, মনোরমাকে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত থেকে বার ক’রে নিয়ে আসা হয়, তা’ হ’লে কি হবে?”

“আর এক উপায় আছে, সেই উপায়ে আমরা নিরাপদ হ’ব; কিন্তু সে বড় শক্ত ব্যাপার- বিশেষ বলবুদ্ধির দরকার করে।”

“কি, ভেঙে বল?”

“দেবেন্দ্রবিজয়ের মৃত্যু”।

উকিল তুলসীদাস সাশ্চর্য্যে আসন ত্যাগ করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন; বলিলেন, “হাঁ, তা’ যদি হয়, তবে আমরা নিশ্চিন্ত হ’তে পারি বটে; প্রতমত এখন তুমি কি করবে, স্থির করেছ?”

“প্রথমে মনোরমাকে হাতগত করতে চেষ্টা করব।”

“কেমন করে তাকে তুমি হাতগত করবে, আমি কি শুনতে পাই না?“

“আপাতত নয়; দরকার বুঝলে আমি নিজেই আপনাকে তখন জানাব”, বলিয়া রমণী উঠিয়া দাঁড়াইল।

“এখনই কি তুমি যাচ্ছ? আবার কখন দেখা হবে?”

“একঘণ্টার মধ্যে হ’তে পারে—কি এক সপ্তাহ না হতেও পারে। যাই হ’ক, এখন থেকে আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, অপরিচিত যে কোন লোকের সঙ্গে সতর্ক হ’য়ে, একটু বুঝে-সুঝে কথা বলবেন; লোক মাত্রকেই অবিশ্বাস করতে শিখুন।”

“কে’ন, এ অতি-সাবধানতার কারণ কি?”

“এ আর বুঝতে পারলেন না? যে কেউ হ’ক— মুসলমান, সাহেব, খোট্টা, মাড়োয়ারী যে কোন অপরিচিত লোককে দেখতে পান—সে দেবেন্দ্রবিজয় ভিন্ন আর কেউ নয় বুঝবেন; মনে থাকে যেন।”

“খুব মনে থাকবে। আপাতত কি তুমি নবীনের সাহায্য নেবে?”

“হাঁ, তা নিতে হবে বৈকি।”

ইতঃপূৰ্ব্বে সেই অবগুণ্ঠনবতীর সেই অবগুণ্ঠন একবারও মস্তচ্যুত হয় নাই। যাইবার সময়ে রমণী সেই অবগুণ্ঠন আরও একটু টানিয়া দিল। তাহার জন্য বাটীর বহির্দ্বারে একখানি গাড়ি অপেক্ষা করিতেছিল। রমণী সেই গাড়িতে উঠিয়া চতুৰ্দ্দিক বন্ধ করিয়া দিল। গাড়ি খিদিরপুর- অভিমুখে ধনুচ্যুত তীরের বেগে ছুটিল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – কবিরাজ গোবিন্দ-প্ৰসাদ

খিদিরপুর গঙ্গাতটে একখানি প্রকাণ্ড সুন্দর ত্রিতল অট্টালিকা বহু প্রকোষ্ঠে পূর্ণ। ইহারই নাম ‘আনন্দ-কুটীর’। চতুৰ্দ্দিকে উন্নত প্রাচীর-বেষ্টিত ফলোদ্যান।

যথাসময়ে সেই অবগুণ্ঠনবতী রমণীকে লইয়া গাড়িখানি এই বাটীর ফটকে আসিয়া দাঁড়াইল। রমণী অবতরণ করিয়া বাটীমধ্যে প্রবিষ্ট হইল; প্রথমেই একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কোন ভদ্রলোক এর মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?”

ভৃত্য বলিল, “হাঁ গিন্নীমা।”

‘কোথায় তিনি? আছেন, না চ’লে গেছেন? “

“উপরের বৈঠকখানায় ব’সে আছেন।”

“তাঁকে গিয়ে বল, আমি শীঘ্রই তাঁর সঙ্গে দেখা করছি।’

“যে আজ্ঞা”, বলিয়া ভৃত্য প্রস্থান করিল।“

তখন রমণী আপন শয়নকক্ষে যাইয়া শয্যায় শয়ন করিল। মুখ হইতে তাড়াতাড়ি ঘোমটা তুলিয়া দিল। অনন্যমনে কি চিন্তা করিতে লাগিল; ক্ষণকাল বিশ্রামের পর মন কিছু সুস্থির হইলে দ্বিতলস্থ বৈঠকখানায় আগন্তুকের সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিল।

* * * * * *

আগন্তুকের বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসর হইবে। বর্ণ কৃষ্ণ, দেহ বড়ই দীর্ঘ ও পৃথু। চক্ষু দুইটি অতি ক্ষুদ্র এবং রক্তাভ; সেইজন্যই বলিতে হইতেছে, সে চক্ষুর চমৎকারিতার সীমা ছিল না। নাসিকা অগ্রভাগে স্থূল। কৃষ্ণবর্ণ বদনমণ্ডলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরললোম ভূযুগলের অস্তিত্ব নির্ণয় করা তীক্ষ্ণদৃষ্টিরও দুঃসাধ্য। এই ব্যক্তির নামই কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদ সেন।

রমণী আসিয়া কবিরাজকে ঈষদ্ধাস্যে জিজ্ঞাসিল, “কি গো কবিরাজ মহাশয়, কোন শুভ-সংবাদ আছে কি? তোমার রোগীর কোন সংবাদ পেলে?”

কবি। না, কই আর পেলাম?

রমণী। চটী থেকে সে বুচকীটা নিতে কেউ আসেনি?

কবি। না, কই আর এলো।

রমণী। আমি জেনেছি, আর কেউ আসবে না। তোমার রোগী এখন কোথায় আছে তা’ কিন্তু আমি জানি।

কবি। তুমি তাকে দেখেছ?

র। চাক্ষুষ দেখি নি—তবে কোথায় লুকিয়ে আছে, জানি।

কবি। বল—বল, আমি এখনই তাকে গ্রেপ্তার করব।

র। কবিরাজ মশাই, বলতে সহজ—কাজে শক্ত দাঁড়াবে; বড় শক্ত জায়গায় সে আছে।

ক। যেথায় থাক, সে আমারই আছে—সে আমার রোগী; পাগল ব’লে ডাক্তারদের সেনাক্ত করাও আছে। এখন কার সাধ্য, কে আমার রোগীকে ধ’রে রাখে? রাজ-সরকার থেকে আমার কাছে কত পাগল আসে, রাজ-সরকারেও আমার খুব প্রতিপত্তি আছে। আমি কি কাকেও ভয় করি? কার সাধ্য আমার কাজে বাধা দেয়? আদালত আমার রোগীকে আমার হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য। সে যে পাগল, যে সকল সার্টিফিকেট আমি সংগ্রহ ক’রে রেখেছি, তাতেই সে মীমাংসা হবে। কিন্তু কোথায় সে?

র। দেবেন্দ্রবিজয়ের বাড়িতে।

ক। সে আবার কে?

র। তুমি তাকে জান না?

ক। জানি না—জানবার বড় দরকারও নাই—তবে সে কোথায় থাকে, আমি তাই এখন শুধু জানতে চাই।

র। তুমি তার বাড়িতে তোমার রোগীকে নিয়ে আসতে দাবী-দাওয়া করবে, স্থির করেছ; কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় কে জান? দেবেন্দ্রবিজয় এখানকার একজন পাকা নামজাদা গোয়েন্দা।

ক। সে একলা দশটা গোয়েন্দা হ’লেও ক্ষতি নাই।

র। তাই বটে—সে একাই দশটা গোয়েন্দা।

ক। যেই হ’ক সে—আমার রোগীকে আমি নিয়ে আসব। আমাকে তুমি তার বাড়ির ঠিকানাটা ব’লে দাও দেখি?

র। পদ্মপুকুর, চক্রবেড়ে। আর একটা কথা, যদি তুমি তোমার রোগীকে তার হাত থেকে নিয়ে আসতে পার, আরও হাজার টাকা অতিরিক্ত পুরস্কার পাবে।

ক। বেশ, কাল সকালেই এসে আমি পুরস্কার দাবী করব।

র। তখনই পাবে। তবে কি তুমি আজ এখন দেবেন্দ্রবিজয়ের বাড়িতে যাচ্ছ? যদি যাও, বোধ হয় কৃতকাৰ্য্য হ’তে পারবে না—পণ্ডশ্রম হবে। আমি দেবেন্দ্রবিজয়কে জানি।

ক। ভাল, আমিও না হয় তাকে একবার জানব।

র। কাল সকালে সংবাদ পাব কি? কাল দশটার সময়ে তুমি নিজে এখানে আসতে চেষ্টা করো।

ক। বেশ, আসি এখন।

র। এস।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – কবিরাজের উদ্যম

দেবেন্দ্রবিজয় স্বীয় শয়ন-প্রকোষ্ঠে শয্যায় অর্দ্ধশয়নাবস্থায় একখানি ইংরাজী সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলেন; এমন সময়ে বালক-ভৃত্য শিবু আসিয়া তাঁহার হাতে একখানি ক্ষুদ্র পত্র দিল।

দেবেন্দ্রবিজয় পত্রখানি পাঠ করিয়া তখনই উঠিয়া বসিলেন। মৃদু হাস্যে আপনা-আপনই বলিলেন, “কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদ সেন, বটে! সে নিজেই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে; মন্দ নয়—ভালই হয়েছে। আমাকে আর কষ্ট ক’রে মহাপ্রভুকে দর্শন করতে মহাপ্রভুর শ্রীমন্দিরে গমন করতে হ’ল না।”

গোবিন্দপ্রসাদের সহিত আগে দেখা না করিয়া, যেখানে বসিয়া রেবতী ও মনোরমা গল্প করিতেছিলেন, দেবেন্দ্রবিজয় তথায় উপস্থিত হইলেন; মনোরমাকে বলিলেন, “মনোরমা, কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদ সেন সশরীরে উপস্থিত।”

ম। (সভয়ে) গোবিন্দপ্রসাদ! কবিরাজ! কোথায়?

দে। আমার এখানে।

ম। এখানে! এখানে কেন? কী দরকার? অ্যাঁ!

দে। সম্ভব, তোমার জন্যই—তোমাকে নিতে এসেছেন।

ম। (সাতঙ্কে) অ্যাঁ! বলেন কি? আমায় রক্ষা করুন; আমি আপনার শরণাপন্ন—আমাকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি, তার হাতে আমাকে তুলে দেবেন না।

দে। সে ভয় নাই; সে যে এত শীঘ্র তোমার সন্ধান করেছে, তাতেই আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হচ্ছি। বোধ হয়, সে কালীঘাটে তোমার সেই বুচকীর সন্ধান পায়, তার পর সেই কাপড়ের বুচকী আনতে সেখানে তুমি না যাওয়াতে, সম্ভবত তোমার সন্ধানের জন্য একজন গোয়েন্দাও নিযুক্ত করেছে।

ম। না—তা আমার মনে হয় না।

দে। তুমি কি মনে করেছ?

ম। আমার শত্রুরা হয় নিজে-নিজেই আমার অনুসন্ধান ক’রে থাকবে, নয় তারা অন্য কোন উপায়ে জেনে থাকবে যে, আমি আপনার এখানে রয়েছি। তাদের এমন সাহস হবে না যে, আপনার ন্যায় গোয়েন্দার উপর গোয়েন্দাগিরি চালাতে আর কোন গোয়েন্দা নিযুক্ত করে।

“হ’তে পারে। এখন দেখা যাক, কবিরাজ মহাশয়ের কোন্ অভিপ্রায়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের এখানে শুভাগমন!” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বহিৰ্ব্বাচিনীর দিকে চলিয়া গেলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – উদ্যমের ফল

সদরবাড়ির বৈঠকখানায় কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদ অপেক্ষা করিতেছিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় তৎসমীপবর্ত্তী হইলে তিনি জিজ্ঞাসিলেন, “আপনি! আপনার নাম কি দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র?”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আজ্ঞে আমারই নাম দেবেন্দ্র। দেবেন্দ্রকে বলবার জন্য যা’ যা’ স্থির ক’রে এসেছেন, সে সব আমাকেই বলুন, তা হ’লে যথার্থ লোককেই আপনার বলা হবে।”

কবি। আপনি নাকি একটা পাগলী মেয়েকে নিজের বাড়িতে রেখেছেন।

দেবে। ওঃ! এই কথা?

কবি। হাঁ, এই কথা।

দে। কে আপনাকে এ সঠিক সংবাদ দিল?

ক। এ সংবাদ আমি নিজেই রাখি। আমি কবিরাজ, যে রোগীকে আপনি নিজের বাড়িতে রেখেছেন—সে আমারই তাঁবের।

দে। হ’তে পারে, সম্ভব; কিন্তু তাতে কি হয়েছে?

ক। হবে আর কি—আমার রোগীকে আমি নিতে এসেছি; তাকে ছেড়ে দিন।

দে। ব্যস্ত হবেন না; হচ্ছে। আপনার রোগীর নাম কি?

ক। তার নাম? অজ্ঞাত।

দে। কেমন ক’রে তবে তাকে আমরা চিনতে পারব?

ক। তার চেহারায়।

দে। আর তার পাগলামিতে কেমন?

ক। হাঁ, আর তার পাগলামিতে।

দে। তার পাগলামিটা কি?

ক। ঐ পাগলামি? যথেষ্ট। নিজে সে লোকের কাছে ব’লে ব’লে বেড়ায়, সে খিদিরপুরের আনন্দ-কুটীরের উত্তরাধিকারী—তার নাম মনোরমা।

দে। ওঃ ঠিক! ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝতে গেলে, এর ভিতরে কেমন একটা চক্রান্ত আছে ব’লে বোধ হয় না কি, কবিরাজ মহাশয়?

ক। আমি এখানে আপনার প্রশ্নের জবাবদিহি করতে আসিনি; আমি আমার রোগীকে নিয়ে যেতে এসেছি।

দে। সে যে আপনার রোগী, এমন কোন প্রমাণ-পত্র সঙ্গে এনেছেন কি?

ক। আছে—অনেক আছে; এনেছি।

দে। কই?

ক। আগে বলুন দেখি, সে এখানে আছে কি না?

দে। আছে; আপনি ঠিক সন্ধানই পেয়েছেন।

ক। আমি কোন বিশ্বাসী লোকের কাছে এ সন্ধান পেয়েছি।

দে। কে সেই বিশ্বাসী, লোকটি?

ক। যে বলেছে, সে স্বচক্ষে আমার রোগীকে এই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে দেখেছে।

দে। তবে সে-লোক সে রোগীকে জানে?

ক। হাঁ, জানে বই কি।

দে। কেমন ক’রে সে লোকের সঙ্গে আপনার রোগীর পরিচয় হ’লো?

ক। আমি আপনার এ সকল বাজে কথার উত্তর দিতে বাধ্য নই।

দে। আপনার রোগী যে আমার বাড়িতে আছে, এ কথা স্বীকার করতে তবে আমিও বাধ্য নই।

ক। যাতে মহাশয়কে বাধ্য হ’তে হয়, তা’ আমি করব।

দে। বেশ ত! কি প্রকারে, শুনতে পাই নাকি?

ক। আমাকে আইনের সাহায্য নিতে হবে।

দে। তাতে কিছু সময়ের আবশ্যক করে।

ক। তাতেই বা ক্ষতি কি?

দে। সে সময়ের মধ্যে আমি, যাকে আপনি নিজের রোগী বলে নির্দ্দেশ করছেন, তাকে এমন স্থানান্তরে লুকিয়ে ফেলতে পারি যে, আপনি সারাজীবনে তার আর কোন সন্ধান পাবেন না।

ক। তবে কি আপনি তাকে রক্ষা করবেন?

দে। কেনই-বা না করব, বলুন?

ক। যেখানেই লুকিয়ে ফেলুন—আমার হাত ছেড়ে সে কোথায় যাবে? আমার কবলে তাকে আসতেই হবে।

দে। হ’তে পারে। সে যে এখানে আছে, এমন কোন প্রমাণ আপাতত মহাশয়ের কবলে আছে কি?

ক। সে যে এখানে আছে, তা’ আমি জানি।

দে। জানেন আপনি? আমিও জানি, আপনি তা’ না জানেন, এমন নয়। সে কথা এখন ছেড়ে দিন; কোন প্রমাণ আছে কি? তা’ যদি থাকে, দেখান।

ক। যখন নিজের ক্ষমতানুসারে চলব, তখন দেখাব। এখন তাকে আপনি ছেড়ে দিবেন কিনা, বলুন?

দে। দুই দফা ভাল রকম প্রমাণ না পেলে বোধ হয়, আপনার আদেশ আমি পালন করতে পারব না। প্রথমত সে যে এখানে আছে—দ্বিতীয়ত সে প্রকৃত পাগল কি না?

ক। বেশ, এই কাগজ দু’খানা প’ড়ে দেখুন

দেবেন্দ্রবিজয় কবিরাজের হাত হইতে সেই কাগজ দুইখানি লইয়া সর্ব্বাগ্রে তাহাতে যে ডাক্তারদিগের নাম স্বাক্ষর ছিল, তাঁহাদের নাম নিজের পকেট-বুকে লিখিয়া লইলেন। পাঠ না করিয়া প্রমাণ-পত্র দুইখানি ফিরাইয়া দিলেন।

গোবিন্দ-প্রসাদ বলিলেন, “কই—প’ড়ে দেখলেন না?”

দে। না—আবশ্যক নাই। যা’ আমার আবশ্যক ছিল, তা’ দেখা হ’য়ে গেছে।

ক। ডাক্তারদের নাম? তা’ বেশ করেছেন। এখন আমার রোগীকে আমায় দিন।

দে। দিতে পারি যদি আপনি আমার কতকগুলি কথার যথার্থ উত্তর দেন।

ক। কি, বলুন?

দে। কে আপনাকে পাঠিয়েছে?

ক। এ কথার উত্তর আমি আপনাকে দিতে পারি না। কোন ভদ্রমহিলা, তার নাম প্রকাশ করা উচিত হয় না।

দে। বটে, ভদ্রমহিলা! যে ভদ্র-মহিলাকে আপনি এখন মনোরমা ব’লে জানেন, সেই ভদ্ৰ- মহিলা কি?

ক। না—আমি সে সব কিছু জানি না।

দে। আপনার এ রোগীর ব্যয়ভার কে বহন করে?

ক। সে কথায় আপনার আবশ্যক কি?

দে। আবশ্যক আছে বই কি। আবশ্যক না থাকলে মহাশয়কে জিজ্ঞাসা ক’রে কষ্ট দিতে যাব কেন, আর নিজেই বা হেন কষ্ট পাব কেন?

ক। আপনি যাঁর নাম করলেন—তিনিই।

দে। মনোরমা?

ক। হাঁ।

দে। আপনার রোগী যে এখানে আছে, এ কথা আপনি তাঁর মুখেই শুনেছেন?

ক। না—তিনি বলেন নাই; তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি।

দে। আপনি কি সত্যকথা বলছেন? সত্য বলুন।

ক। আপনি কি আমায় মিথ্যাবাদী মনে করছেন না কি?

দে। হাঁ, আপাতত আপনার কথায় তাই আপনাকে মনে হয়।

ক। (ক্রোধে) আমি মিথ্যাবাদী? আমাকে মিথ্যাবাদী বলা! যদি এটা তোমার নিজের বাড়ি না হত, তা’ হ’লে এখনই—

দে। (বাধা দিয়া) থামুন, কবিরাজ মহাশয়, থামুন—স্থির হ’ন, একেবারে এতটা উতলা হবেন না। এটা যদি আমার নিজের বাড়ি না হত, তা’ হ’লে মজাটা ভাল ক’রেই আপনাকে দেখাতেম। আমার বাড়িতে এসেছেন ব’লেই সে অবসর হ’ল না–পার পেলেন।

ক। আমার রোগীকে আপনি এখনই বার করুন।

দে। গায়ে-কাপড় দিন। জ্বালাবেন না। ও দাবী-দাওয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের কাছে খাটবে না।

ক। আপনি তবে একান্তই অস্বীকার করছেন?

দে। তা’ আর এখনও বুঝতে পারছেন না? একান্তই।

ক। কেন, এই ত আপনি স্বীকার করলেন যে, আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিলে আপনি আমার রোগীকে ছেড়ে দিবেন?

দে। আমি তা’ এমন কিছু ঠিক ক’রে বলি নি; দিলে দিতে পারি, এই কথাই বলেছিলেম; কিন্তু আপাতত যেমন দেখছি, তাতে আপনার রোগীকে আপনার হাতে দেওয়া আমার পক্ষে ঠিক হবে না।

ক। তুমি না দাও, আমি ছাড়ব না—আমি তাকে যে প্রকারেই পারি, নিয়ে যাব।

দে। আপনি? ক্ষমা করুন; কি উপায়ে গ্রহণ করবেন, যদি ভেঙে বলেন, বাধিত হই।

ক। যে প্রকারে পারি, তাকে নিয়ে যাবই।

দে। কখন মহাশয়?

ক। এখনই।

দে। এখনই! কোন্ উপায়ে।

ক। জোরের সহিত।

দে। আপনি কি তামাসা করছেন, কবিরাজ মশাই? আপনার কথা শুনে আমার যে হাসি পাচ্ছে। কবিরাজ ক্রোধের চরম সীমায় পৌঁছিয়া, গৰ্জ্জন করিয়া বলিলেন, “কোন কথা আর শুনতে চাই না; আমি চাই—আমার রোগীকে। দেবে কি না, শুনতে চাই?”

“না।”

“না দাও, এই নাও,” বলিয়া গোবিন্দপ্রসাদ হস্তস্থিত গুপ্তিনামক যষ্টির উপরিভাগ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের দ্বারা টিপিলেন; তমুহূর্তে তদগ্রে একখানি সুতীক্ষ্ণমুখ কীরিচ বাহির হইল—ভ্রমণযষ্টি বর্গাকারে পরিণত হইল। কবিরাজ তদ্দ্বারা দেবেন্দ্রবিজয়কে আঘাত করিবার নিমিত্ত উহা উর্দ্ধে তুলিলেন।

যদি সে আঘাত ব্যর্থ না হইত, তাহা হইলে দেবেন্দ্রবিজয়কে এতক্ষণ সংজ্ঞাশূন্য হইয়া ধূল্যবলুণ্ঠিত হইতে দেখা যাইত। দেবেন্দ্রবিজয় সহজ উপায়েই তাহা ব্যর্থ করিলেন। যেমন গোবিন্দপ্রসাদ তাঁহার মস্তক লক্ষ্য করিতে যাইবেন, দেবেন্দ্রবিজয় বসিয়া পড়িলেন। আঘাত ভিত্তিগাত্রে সশব্দে নিহিত হইল।

ইত্যবসরে দেবেন্দ্রবিজয়ের বজ্রমুষ্টি লৌহমুদ্‌রবৎ গোবিন্দপ্রসাদের মস্তকে পড়িল। কবিরাজ হতচৈতন্যের প্রায় ভূমিতলে পতিত হইলেন; তখনই উঠিলেন, বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একখানি সুতীক্ষ্ণ বৃহচ্ছুরিকা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে আক্রমণ করিবার উপক্রম করিলেন।

দেবেন্দ্রবিজয় তাঁহার এই আক্রমণের জন্য পূৰ্ব্বেই প্রস্তুত ছিলেন। তাঁহাকে নিজের সম্মুখে অগ্রসর হইতে দেখিয়া দুই পদ পশ্চাতে হটিয়া আসিলেন। করিলেন কি? পলায়ন? দেবেন্দ্রবিজয়ের জন্ম-পত্রিকায় তাহা লেখে না। তিনি দুই পদ পশ্চাতে হটিয়া কবিরাজের যে হস্তে ছোরাখানা ছিল, সেই হস্তের মণিবন্ধে সজোরে পদাঘাত করিলেন। সেই ভীম পদাঘাতে অস্ত্রখানা কবিরাজের দুর্ব্বল হস্তের শিথিল মুষ্টি হইতে বিচ্যুত হইয়া ঝন্‌ঝন্ শব্দে ভূচুম্বন করিল। তমুহূর্তে দেবেন্দ্রবিজয় কবিরাজের বিপুল বপুঃ জাপটাইয়া ধরিলেন; তাহাতে গোবন্দপ্রসাদের বোধ হইল, যেন তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ লৌহশৃঙ্খলাবদ্ধ হইল; নিজেকে মুক্ত করিবার জন্য অনেক যোঝাবুঝি করিলেন, বিফল প্রয়াস দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত হইতে মুক্তিলাভ করা বড় সহজ নয়!

ভৃত্য শিবু এই ক্ষুদ্র রণের শব্দ শুনিয়া তথায় ছুটিয়া আসিল। দেবেন্দ্রবিজয় শিবুকে বলিলেন, “শিবু, সদর দরজা বেশ ক’রে খুলে ফে’ল।”

শিবু আদেশ পালন করিল। দেবেন্দ্রবিজয় ভূতল হইতে কবিরাজকে শূন্যে তুলিয়া অগ্রসর হইলেন। তাঁহার বোধ হইল, তিনি যেন একটি বালককে ক্রোড়ে করিয়াছেন।

কবিরাজ মহাশয় ছট্‌ফট করিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য, গালাগালি বর্ষণ করিতে, চিৎকার করিতে, তর্জ্জন গর্জ্জন করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি প্রদর্শন করিলেন না।

দেবেন্দ্রবিজয় গোবিন্দ-প্রসাদের সেই বৃহদ্দেহ একটা কাপড়ের বুচকীর ন্যায় ছুড়িয়া সম্মুখের রাস্তায় ফেলিলেন; এবং তখনই সশব্দে বহির্দ্বার ভিতর হইতে অর্গলাবদ্ধ করিয়া দিলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – গ্রাম্যপথে

গোধূলি। সন্ধ্যা হইতে আর বড় বিলম্ব নাই। সুবৃহৎ স্বর্ণপাত্রের ন্যায় রবির অর্দ্ধাংশমাত্র প্রতীচী-পুলিনে দৃষ্ট হইতেছে। হেমাভরৌদ্রচ্ছটা বৃক্ষশিরে শিরে—বসন্তপ্রসূত নবচ্যুতপল্লবে পল্লবে—সৌধমালার দুগ্ধশ্বেত ভিত্তির উপরিভাগে—ছাদোপরিস্থিতা, বিমুক্তবেণী, সুবেশা নবীনা সুন্দরীদিগের বিসর্পিত তরঙ্গায়িত ভ্রমরকৃষ্ণ সান্ধ্য সমীরপ্রবাহে ঈষদচঞ্চল ঈষদ্বিকম্পিত অলকাবলীর উপরে—পক্কচুতোজ্জ্বল কপোল দেশে—তন্মধ্যবর্তী ঘোরারক্ত ওষ্ঠাধরে—মন্মথের স্বপ্নশয্যাসম প্রচুরায়ত লোচনে—সপ্তমীচন্দ্রবৎ ললাটে, আর গ্রামপ্রান্তে নিস্তরঙ্গ গঙ্গাবক্ষে অনন্ত বারিরাশির উপরে পড়িয়া সুন্দরভাবে সুন্দর সাজে বালিকা সন্ধ্যাকে অতি সুন্দর করিয়া সাজাইয়াছে।

ঈষদারক্তবদনা হেমাম্বুদকিরীটিনী শ্রীমতী গোধূলির এই মনোমোহিনী শোভা দেখিয়া এক অভিনবভাবাবেশে কাহার হৃদয় ও মন মোহিত না হয়?

দুর্নিবার্য্য-ঈর্ষাপরতন্ত্রা যামিনীদেবীর প্রাণে ইহা সহিল না। কিরূপে সহিবে? ইতোমধ্যে তাঁহার প্রিয়তম নিশানাথ আসিয়া গোধূলিবালার রূপশ্রী, তাহার লালসাবিকশিত, মদনরসে টলটলায়মান, মনোমদ, সুচারু, স্মিত আননমণ্ডল—অৰ্দ্ধপূর্ণশশাঙ্করশ্মিরুচির পঞ্চচূতোজ্জ্বল বর্ণবিভা— সেই কনককিরণপরিব্যাপ্ত, অত্যুজ্জ্বল, পরিপ্লব সৌন্দর্য্যরাশি দেখিয়া যদি রূপফাঁদে পড়েন, যদি যামিনীকে ভুলিয়া যান, যদি আর ফিরিয়া না চাহেন; যদি গোধূলি সুন্দরীর সৌন্দর্য্যে—প্রেমে— প্রীতিতে—সোহাগে—রূপে—বিভায়—বর্ণে– মেঘমধ্যে-বিদ্যুদ্দামসম লোলাপাঙ্গে ক্রূর অথচ অতি স্নিগ্ধ সুচঞ্চল কটাক্ষে—পরিহিত বসনের নীলালক্তক-প্রভারাশিতে মগ্ন হয়েন—মুগ্ধ হয়েন, এই ভয়ে যামিনীদেবী ইহার প্রতীকার করিতে শীঘ্র ব্যস্ত হইলেন। পর্ব্বত সকলের নিকটে ছুটিয়া গিয়া সাহায্য ভিক্ষা চাহিলেন। তাহারা যামিনীকে সাহায্য করিতে সম্মত হইয়া, নিজেদের গুহাগহ্বরে অনন্ত মসীময় অন্ধকারের প্রচুরাংশ বাহির করিয়া যামিনীর সাহায্যার্থ প্রেরণ করিল। যামিনী শ্রেণিবদ্ধ করিয়া সেই প্রচুর অন্ধকারের কতক অংশ ঝোপে-ঝোপে—কতক অংশ কূপের মধ্যে—কতক অংশ সঙ্কীর্ণ গলিপথে–কতক অংশ এখানে—ওখানে—সেখানে, যেখানে যেমন সুবিধা পাইলেন, লুকাইয়া রাখিলেন।

তাহার পর সুযোগক্রমে বর্দ্ধিতরোষা যামিনী এক-এক স্তূপ অন্ধকার লইয়া সুষমাময়ী কান্তিময়, নিরীহা, সরলা গোধূলির বরাঙ্গে প্রক্ষিপ্ত করিতে লাগিলেন। তাহাতে শোভনা গোধূলির কাঞ্চনকান্তি মসীময়ী হইতে লাগিল। গোধূলি ভয় পাইল। যামিনীর এই নিষ্ঠুর ব্যবহারে, তাহার মৰ্ম্মে মৰ্ম্মে আঘাত লাগিল; পলাইল—সাগরাভিমুখে এই কালিমা ধৌত করিতে অতি দ্রুত ছুটিল। তখন যামিনীর জয়, গোধূলির পরাজয় হইল।

যদি গোধূলি আবার এক্ষণে ফিরিয়া আসে, এই আশঙ্কায় বুদ্ধিমতী যামিনী অন্ধকারকে বিদায় দিলেন না; প্রস্তুত রাখিলেন। নিজে স্বামীর আগমন অপেক্ষায় রহিলেন। ইতিমধ্যে নিজ বেশভূষায় মনোযোগ দিলেন, কাননে কাননে যত পুষ্পকোরক ছিল ফুটাইয়া মালা গাঁথিলেন। পুষ্পহারে, পুষ্পমুকুটে, পুষ্পবলয়ে, পুষ্পনিৰ্ম্মিত বিবিধ অলঙ্কারে নিজের দেহ পরিশোভিত করিলেন— যামিনী পুষ্পরাণী সাজিলেন। প্রহরেক বেশ-ভূষায় অতিবাহিত হইল। তাহার পর প্রাণপতি চন্দ্ৰদেব হাসিমুখে দেখা দিলেন। প্রিয়াকে ফুলে-ফুলে ফুলময়ী দেখিয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া হাসির মাত্রা প্রচুর পরিমাণে বাড়াইলেন।

আশ্বস্তহৃদয়া যামিনী তখন অন্ধকাররাশিকে বিদায় দিলেন। স্বামীর সোহাগ লাভ করিতে, স্বামীকে হৃদয়ে ধরিতে ব্যস্ত হইলেন। মাধবী যামিনীর এক্ষণে সুখ আর ধরে না!

প্রফুল্লহৃদয়া যামিনী হাসিতেছেন—প্রফুল্লহৃদয় যামিনীনাথ চন্দ্র হাসিতেছেন। সেই দম্পতীর সেই মধুর হাসি কুসুমোদ্যানে কুসুম হাসিল—দিগ্বধুরা হাসিল—নব পল্লবাবলী হাসিল— লতিকাদল হাসিল—সরিদ্বক্ষে কাঞ্চন-মুকুট মাথায় ধরিয়া লহরীবালারা হাসিল—আর হাসিল সরসী-সলিলে দলে দলে জ্যোৎস্নামাখা কুমুদিনী, নীলিমা-ক্রোড়ে শুভ্রশ্বেত মেঘমালা। চারিদিকে হাসির মেলা পড়িল; যেদিকে নয়ন ফিরাও—সেইদিকে শুধু হাসি; যেদিকে কান রাখ—সেইদিকে হাস্যধ্বনি; এমন সময়ে কোন্ হতভাগ্যের বিষণ্ন অন্তর প্রফুল্ল না হয়? কে এমন সময়ে নীরবে বসিয়া নিজ দুরদৃষ্টের কথা ম্লানমুখে চিন্তা করে?

এমন সময়ে খিদিরপুরের আনন্দ-কুটীরের পশ্চাদ্ভাগে অপ্রশস্ত পথ ধরিয়া, এক কুব্জ ব্যক্তি হস্তস্থিত যষ্টিতে দেহভার অর্পণ করিয়া ধীরে ধীরে চলিতেছিল। লোকটি বয়সে অতি বৃদ্ধ মস্তকের কেশ, শ্মশ্রু, গুম্ফ সমস্তই পাকিয়া সাদা হইয়া গিয়াছে। পরিধানে একখানি মলিন, জীর্ণ ছিন্নবস্ত্র। বোধ করি, লোকটি কাসরোগগ্রস্ত—দুই চারিপদ চলিতেছে, আর খক্ খক্ করিয়া কাসিতেছে।

যখন সেই ব্যক্তি আনন্দ-কুটীরের পশ্চাদ্বর্ত্তী ফলোদ্যানের ক্ষুদ্রদ্বার সমীপাগত হইল, তখন সেই স্থানে ক্ষণেক দাঁড়াইয়া পূৰ্ব্বাপেক্ষা কিছু উচ্চশব্দে আরও দশবার খক্ খক্ করিয়া কাসিল।

তখনই ফলোদ্যানের ক্ষুদ্র দ্বার উদ্ঘাটিত হইল; তন্মধ্য দিয়া একজন মুসলমান যুবক ধীরে ধীরে বাহির হইয়া আগন্তুক কুব্জের নিকটস্থ হইয়া বলিল, “এই যে আপনি এসেছেন!”

কুব্জ অতি ধীরে ধীরে কহিল, “হাঁ, শচী।” এ কণ্ঠস্বর দেবেন্দ্রবিজয়ের। পাঠক, এই কুব্জ ব্যক্তি ছদ্মবেশে নিজে দেবেন্দ্রবিজয় ও ছদ্মবেশী মুসলমান যুবক আর কেহই নয়, দেবেন্দ্রবিজয়ের ভাগিনেয় শচীন্দ্র।

শচীন্দ্র বলিল, “আপনি এসে ভাল করেছেন; আপনাকে অনেক কথা বলবার আছে।”

কুব্জবেশধারী দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সময়ে শুনব, এখন চললেম—অপেক্ষা করবার সময় নাই। আমি এখন শিবপুরে কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদের বাড়িতে যাব।”

শচী। কখন আবার আমার সঙ্গে দেখা করবেন?

দেবেন্দ্র। শিবপুরের কাজ শেষ করে যখন ফিরব, তখন তোমার সঙ্গে এইখানে দেখা করব।

দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – শিবপুর

যখন দেবেন্দ্রবিজয় শিবপুরে উপস্থিত হইলেন, তখন রাত্রি অনেক হইয়াছে। পথে জনপ্রাণীর গতিবিধি নাই; সকলেই তখন নিদ্রাদেবীর শান্তিপদ ক্রোড়ে বিশ্রাম লাভ করিতেছে।

আকাশ নিৰ্ম্মল—নির্ম্মে—পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সেই বিরলনক্ষত্র নিৰ্ম্মল আকাশতলে নিষ্কলঙ্ক নীলিমাবক্ষে একপার্শ্বে চন্দ্র হাসিতেছে। দূরে থাকিয়া দুই-একটি নক্ষত্র জ্বলিতেছে। সময় বড়ই সুন্দর!

অনেক কষ্টে, অনেক অনুসন্ধানে দেবেন্দ্রবিজয় কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদের বৃহদট্টালিকা দেখিতে পাইলেন।

সেই প্রকাণ্ড বাটীর উপরিতলের কতিপয় কক্ষে আলো জ্বলিতেছে; কিন্তু সকলই সম্পূর্ণ নীরব। নিম্নতলেরও কয়েকটি কক্ষে আলো জ্বলিতেছে। সেই সকল আলোক-রশ্মিমালা গবাক্ষমধ্য দিয়া, বাহিরে আসিয়া চন্দ্রকিরণে মিশিয়াছে।

দেবেন্দ্রবিজয় রুদ্ধদ্বারে বারংবার করাঘাত করিতে লাগিলেন। কিয়ৎপরে একজন কৰ্ম্মচারী আসিয়া দ্বারোদঘাটন করিল।

তাহাকে দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “কবিরাজ মশাই আছেন?”

কৰ্ম্ম। না, তিনি বাড়িতে নাই।

দেবেন্দ্ৰ। কোথায় গেছেন, তুমি জান? আজ ফিরবেন কি?

কৰ্ম্ম। কোন রোগীকে দেখতে গিয়ে থাকবেন। ফিরবেন কি না, তা’ ঠিক বলতে পারি না।

দে। কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন?

ক। সন্ধ্যার আগে।

দে। তবে ত বড়ই বিপদে পড়লেম; এত কষ্ট ক’রে এসেও তাঁর সঙ্গে দেখা হল না! কী করি এখন—বুড়া মানুষ, এত রাত্রে যাই-বা কোথায়?

ক। আপনার কি দরকার বলুন—তিনি এলে আমি তাঁকে জানাব।

দে। দরকার আর কী বাপু, আমার একটি পাগলি মেয়ে কবিরাজের হাতে দিয়েছি; সেই মেয়েটি কেমন আছে, তাই জানতে এসেছিলেম।

ক। পাগলী মেয়ে? কই, এখন ত কেউ নাই।

দে। অ্যাঁ! বল কী বাবা! তবে কি মারা গেছে নাকি? অ্যাঁ! আমার মেয়ে কি তবে

ক। মেয়েটির নাম কি, বলুন দেখি?

দে। নাম? মেয়েটি আজন্ম পাগল—তাই তাকে আমরা পাগলী পাগলী বলে ডাকতেম, তার বড় চমৎকার চেহারা; বিশ-বাইশ বছর বয়স হবে; বয়সের সঙ্গে তার পাগলামী ক্রমেই বাড়ছিল দেখে, আমি কবিরাজকে তার চিকিৎসা করতে দিই।

ক। ওঃ বুঝেছি! সেই মেয়েটাই তবে হবে; সে আজ চার-পাঁচ দিন হ’ল পালিয়ে গেছে।

দে। পালিয়ে গেছে—অ্যাঁ! কোথায়? কেমন ক’রে? বল কী! তবে তার পাগলামী কি এতদিনেও কিছু সারে নি?

ক। সে মেয়ে কি আপনার? আহা, মেয়েটি বড় ঠাণ্ডা প্রকৃতির; কই একদিনও ত কোন পাগলামী দেখি নি, আপনি তার কী পাগলামী দেখে এখানে তাকে পাঠান, কিছুই ত বুঝতে পারি নি। সে মেয়ে যদি পাগল হয়, তবে তার চেয়ে আপনি পাগল-আমার মনিব পাগল—জগৎ সুদ্ধ পাগল—তেমন শান্ত স্বভাবের মেয়ে আমি কখন দেখিনি; পাগলামির মধ্যে সে কেবল মধ্যে মধ্যে নিজের দুঃখে কাঁদত; তা’ ছাড়া তার মুখে কথাটি ছিল না; যে যা বলত, তখনই শুনত। এমন লক্ষ্মী মেয়েকে আপনি বাপ হ’য়ে কেমন ক’রে পাগলী ব’লে এখানে ফেলে রেখেছিলেন? কী নিষ্ঠুর আপনি? বৃদ্ধ হয়েছেন—বার্দ্ধক্যে যে ভীমরথী ঘটে, তাই আপনার ঘটেছে।

দে। বাপু, এখন তামাসা করবার সময় নয়;এত বদমায়েস মেয়েকে শান্ত মেয়ে ব’লে আমাকে উপহাস করা তোমার উচিত নয়। তোমাদের এখন কাঁচা বয়স—মনের দম্ভ কত! তোমরা বুড়ো- বালক বেছে উচিত দরে কি আর কথা কহিবে? তবে আমি এখন চললেম। কাল কবিরাজ মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসব। তিনি এলে ব’লো, দেবেন্দ্রবিজয় তার পাগলী মেয়ের তথ্য নিতে এসেছিল। তা’ হ’লেই বুঝতে পারবেন, আমি কে, আর কি জন্য এখানে এসেছিলেম।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – নূতন সংবাদ

যখন দেবেন্দ্রবিজয় শিবপুর হইতে খিদিরপুরে শচীন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে ফিরিলেন, তখন প্রভাত হইতে অধিক বিলম্ব নাই।

পূর্ব্বাকাশের প্রান্তভাগ গাঢ়লোহিতরাগরঞ্জিত হইয়াছে। ঊষাদেবী ধীরে ধীরে পূর্ব্বগগনের স্বর্ণজলদসোপানে ধীর পাদবিক্ষেপে সহাস্যাননে উঠিতেছেন।

দেবেন্দ্রবিজয় আনন্দ-কুটীরের পশ্চাভাগে আসিয়া শচীন্দ্রের সহিত নিভৃতে দেখা করিলেন জিজ্ঞাসিলেন, “কোন বিষয়ে কিছু সন্ধান পেয়েছ?”

শচীন্দ্র বলিল, “হাঁ—অনেকটা সন্ধান পেয়েছি।”

দেবেন্দ্র। কি, বল দেখি?

শচী। রামগোলামের আর যে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে, সেই মেয়েটিকে যে ডাক্তার চিকিৎসা করেছিল, সে ডাক্তারকে দেখেছি।

দে। কে—কে? তার নাম কি? কোথায় থাকে?

শচী। নাম নবীনচন্দ্র, এই আনন্দ-কুটীরেই থাকে। এখন সেই নবীন ডাক্তারই এই আনন্দ- কুটীরের নবীন-কর্তা। যে এখন মনোরমা হ’য়ে এই বিষয় ভোগ করছে, তারই স্বামী।

দে। কতদিন তাদের বিবাহ হয়েছে, কিছু শুনেছ?

শ। প্রায় একমাস।

দে। তা’ হ’লে সম্প্রতি এই বিবাহ হয়েছে?

শ। সম্প্রতি বিবাহ হয়েছে বটে; কিন্তু উভয়ের মধ্যে এক তিল সম্প্রীতি নাই—সারাদিন তাদের বিবাদ-কলহে কেটে যায়।

দে। তুমি এ সংবাদ কি ক’রে পেলে?

শ। আমি এই বাগানের মালীর কাছে সব শুনেছি। নবীন ডাক্তারকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি; কিন্তু সে বড় সহজ লোক নয়—বকেয়া বদমায়েস—আকারে-প্রকারে প্রায় ডাক্তার ফুলসাহেব বললেই হয়।*

[* ডাক্তার ফুলসাহেবের অলৌকিক ঘটনাবলী “মায়াবী” নামক পুস্তকে লিপিবদ্ধ হইল। ফুল সাহেব যে কতদূর দুঃসাহস, শঠ ও প্রবঞ্চক ছিল, তাহার ঘটনাবলী পাঠে সকলকেই বিস্মিত হইতে হইবে।]

দে। আমার গুরু অরিন্দম যে-ফুলসাহেবের হাতে নাস্তানাবুদ হ’ন? ভাল, তার সঙ্গে তোমার কোন কথাবার্তা হয়েছে?

শ। হাঁ, সে-ই ত আমাকে তার গাড়ির গাড়োয়ান নিযুক্ত ক’রে রেখেছে। আমি এখন এখানে শচীন্দ্র নয়—করিমবক্স।

দে। হাঁ, এই ত চাই—বেশ কাজ গুছিয়েছ; চেষ্টা—কেবল চেষ্টা কর—তোমার বুদ্ধিমত্তায় আমি সম্পূর্ণ নির্ভর করি।

.

দেবেন্দ্রবিজয় তাহার পর নিজে যে-সকল সন্ধান ইতিমধ্যে পাইয়াছিলেন, শচীন্দ্রের নিকটে বলিলেন। সহকারীর নিকটে তিনি কোন কথা কখন গোপন রাখিতেন না।

যাইবার সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তুমি বেশ বুদ্ধির কাজ করেছ। আমিও মনে করেছিলেম যে, তুমি এখানে আনন্দ-কুটীরে হ’ক্—কি নিকটে কারও বাড়িতে যেমন ক’রে হ’ক্, নিজের একটা-না-একটা কাজ খুঁজে নেবে। যে পর্য্যন্ত আমার অন্য কোন আদেশ না পাও, এইখানে থাক। সৰ্ব্বদা চোখ চেয়ে অথচ মুখ বন্ধ ক’রে থাকবে, তবে শীঘ্র কার্য্যোদ্ধার হবে। কেবল ভিতরে ভিতরে “১৭ –ক” পুলিন্দার সন্ধান নিতে চেষ্টা করবে।”

“এখন কোথায় যাবেন?”

“নিজের বাড়িতে—ভাবগতিক দেখে বোধ হচ্ছে, সেখানে কোন বিভ্রাট ঘ’টে থাকবে।”

“কে’ন—মামাবাবু, এমন কথা আপনি বলছেন কেন?”

“তারা এখন মনোরমাকে হাত করতে বিশেষ চেষ্টা করবে। কবিরাজও বাড়ি ছেড়ে সন্ধ্যার সময় বেরিয়েছে, ফেরে নাই। নিশ্চয় তারা এক ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছে। তারা এখন মনোরমাকে হাতগত করবার জন্য মরিয়া হ’য়ে দাঁড়িয়েছে—কোন বিঘ্ন ব্যাঘাত বিপদ এখন গ্রাহ্যই করবে না।”

“সময়ে, সুযোগমত আপনি আর একবার আমার এখানে আসবেন।

“হাঁ, কেবল সন্ধানে থাক—কোথায় কি হয়, সর্ব্বদা খবর রাখবে; ব্যাপার বড় ভয়াবহ। আমি এখন চললেম।’

শচীন্দ্র সেই ক্ষুদ্র দ্বার দিয়া আনন্দ-কুটীরমধ্যে প্রবিষ্ট হইল। দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে অন্তর্হিত হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *