মনোরমা – তৃতীয় খণ্ড – পাহাড়ে মেয়ে

তৃতীয় খণ্ড – পাহাড়ে মেয়ে

Pll Tell thee what my friend,
He is very serpent in my way;
And wheresoe’er this foot of mine doth tread.
He lies before me-Dost thou understand me?
Shakespear-’KING JOHN.’

প্রথম পরিচ্ছেদ – শূন্যগৃহে

প্রভাতে দেবেন্দ্রবিজয় বাড়ি ফিরিলেন। তখন প্রভাত-সূর্য্যের পরিপ্লব স্বর্ণ-কিরণ চতুর্দ্দিকে বিস্তৃত হইয়াছে।

গৃহদ্বারে উপস্থিত হইলে কি এক অমঙ্গলাশঙ্কায় তাঁহার মন অত্যন্ত বিচলিত হইল। বাটীমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন—কোন শব্দ তাঁহার কর্ণগোচর হইল না; সকলই নীরব—একান্ত নীরব। সেই নীরবতা জনপ্রাণীর অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করিতেছে। তখন তিনি দ্রুতপদে একেবারে উপরিতলে উঠিলেন—শয়ন-কক্ষে যাইয়া একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন; কেহ তথায় নাই। উচ্চরবে ডাকিলেন, “রেবতি—রেবতি! মনোরমা—মনোরমা!” কোন উত্তর পাইলেন না। প্রতিধ্বনি ব্যঙ্গস্বরে শূন্যকক্ষে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করিল মাত্র।

দেবেন্দ্রবিজয় আপন মনে বলিলেন, “আশ্চর্য্য! কোথায় গেল সব?” শয়নকক্ষ-পার্শ্বস্থ বারান্দায় যাইলেন; যাইয়া দেখিলেন, যথাকার যে সামগ্রী—তথায় ঠিক সেই ভাবেই পড়িয়া আছে। প্রাঙ্গণে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল—যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার মস্তক বিঘূর্ণিত হইল; একখানি রক্তসিক্ত গাত্রমার্জ্জনী প্রাঙ্গণের একপার্শ্বে পড়িয়া রহিয়াছে; সে গাত্রমার্জ্জনী তাঁহার পত্নীর—রেবতীর। কী ভয়ানক! তদৃষ্টে তিনি চমকিত হইলেন—তিনি জীবনের মধ্যে এই প্রথম আত্মহারা হইয়া পড়িলেন। আর কখনও তাঁহার হৃদয় এতদূর উদ্বেলিত হইয়া উঠে নাই। তখন অধীর হইয়া পড়িলে যে সমধিক অনিষ্ট ঘটিবে, তাহা তাঁহার ন্যায় বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুঝিতে বিশেষ বিলম্ব হইল না। তখনই তিনি বুক বাঁধিয়া আপনার কর্ত্তব্য নির্ণয় করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এখন তাঁহার কার্য্যে তাঁহার ভবিষ্য ইষ্টানিষ্ট নির্ভর করিতেছে; এখন তাঁহাকে সকল কাজ সত্বর অথচ বিশেষ বিবেচনার সহিত সমাধা করিতে হইবে; নতুবা যে সকল দস্যু গতরাত্রের এই দুর্ঘটনার মূল, তাহাদের গ্রেপ্তার করা দুর্ঘট হইয়া উঠিবে। যাহা ঘটিয়াছে, তাহা তিনি তখনই বুঝিতে পারিলেন; কিন্তু এই দুর্ঘটনায় গূঢ়রহস্য ভেদ করা তাঁহার এখন একান্ত প্রয়োজনীয়।

এই ক্ষণেক সময়ের মধ্যে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখভাব পরিবর্ত্তিত হইল। তাঁহার মুখমণ্ডলে প্রদৃপ্তভাব প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল।

তিনি যে কুজবৃদ্ধ বেশে শচীন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা এক্ষণে ত্যাগ করিলেন। অদ্য এই প্রথম দেবেন্দ্রবিজয়ের মনের উৎকণ্ঠা মুখমণ্ডলে প্রতিফলিত হইতে দেখা গেল। তাঁহার কুঞ্চিত ললাটফলকে গভীর চিন্তার রেখা সকল প্রকটিত হইয়া উঠিল। এক্ষণে তাঁহার অধরৌষ্ঠ এমন দৃঢ়রূপে মিলিত যে, দেখিয়া অনুভব হয়, তদুভয়ে লেশমাত্র রক্ত নাই— যেন শ্বেতপ্রস্তর-বিনির্ম্মিত। তাঁহার বৃহচ্চক্ষুদ্বয় হইতে প্রতি মুহূর্ত্তে অতি তীরবেগে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিনির্গত হইতেছে; তখন তাঁহার মুখভাব গম্ভীর হইলেও—বিকৃত, নিতান্ত শোকার্ডের ন্যায়— অতিশয় ম্লান।

তিনি আপনা-আপনি নিজেকে বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয়—ধৈর্য্য ধর, অধীর হ’য়ো না—কাৰ্য্য নষ্ট হবে। অপেক্ষা কর—একটু অপেক্ষা কর—মুহূর্ত্তের অপেক্ষা—তার পর তোমার এ বিপদ তুমিই দূর করবে। কেন কাতর হচ্ছ? থাম, বাপু—অধীর হ’য়ো না—যদি তোমার পূর্ব্বের সেই সতর্কতা, পূর্ব্বের সেই চাতুর্য্য, পূর্ব্বের সেই নৈপুণ্য, পূর্ব্বের সেই বুদ্ধিমত্তা, পূর্ব্বের সেই তেজস্বিতা ফিরে পেতে চাও—একটু অপেক্ষা কর। যে পর্য্যন্ত না, তোমার সঙ্গে তোমার মনের ঐক্য হয়—ততটুকু অপেক্ষা মাত্র।”

বর্ত্তমান হৃদয়োৎকণ্ঠা দূর করিতে তখন তিনি আপনাকে এই প্রকারে প্রবোধ ও সান্ত্বনা দান করিতে লাগিলেন। অবশেষে তাঁহার নিজের অজ্ঞাতে—নিজের মুখ দিয়া অতিশয় রুক্ষ্মস্বরে এই কথাগুলি বাহির হইল, “পাষণ্ড দস্যুরা এখানে এসেছিল, অসহায়া স্ত্রীলোকদিগের প্রতি অত্যাচার ক’রে বড়ই বাহাদুরী নিয়েছে; এর প্রতিশোধ আমি লইবই—তবে আমার নাম দেবেন্দ্র- দেবেন্দ্রবিজয়। আমি যাদের ভালবাসি–আমি যাদের স্নেহ করি—তাদের অপহরণ ক’রে দস্যুরা আমার হৃদয়ে যে রোষাগ্নি জ্বেলেছে, তা’ হ’তে কেহই নিস্তার পাবে না। পাষণ্ডেরা নিজেদের বিড়ম্বনা নিজেরাই ডেকেছে। দেবেন্দ্রবিজয় সহজ লোক নয়—পাষণ্ডেরা, সাবধান হ’–সাবধান হ’।”

তাহার পর তিনি শয়নকক্ষ সম্পূর্ণরূপে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “যখন দস্যুরা আক্রমণ করে, তখন রেবতী আর মনোরমা এই গৃহে এক সঙ্গেই শয়ন করেছিল; তাদের নিদ্রিত অবস্থায় পাপিষ্ঠেরা সহজেই তাদের স্থানান্তরিত করেছে; কিন্তু এ রক্তমাখা গাম্‌ছা কোথা হ’তে এল?”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – সংবাদ

ক্ষিপ্রপদে ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয় ভৃত্য শিবুর নিকটে চলিলেন। বাড়ির পশ্চাদ্ভাগে একটি ক্ষুদ্র গৃহ শিবুর জন্য নিৰ্দ্দিষ্ট ছিল। সেই ক্ষুদ্র গৃহের একপার্শ্বে শিবু রন্ধন করিত; অপর পার্শ্বে একটি কম্বলাচ্ছাদিত শয্যা ছিল, তাহাতে সে শয়ন করিত।

দেবেন্দ্রবিজয় সেই ক্ষুদ্র কক্ষে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, শিবু শয্যায় শায়িত। তাহার হস্তপদ এরূপভাবে আবদ্ধ যে, তাহার নড়িবার ক্ষমতাও তিরোহিত হইয়াছে। তাহারই মলিন গাত্রমার্জ্জনী ছিন্ন করিয়া তাহার মুখবিবর সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করা হইয়াছে—চিৎকার কি—কোন শব্দ করিবার কোন উপায় নাই। তখন সর্ব্বাগ্রে দেবেন্দ্রবিজয় তাঁহার ভৃত্যের বন্ধন মোচন করিয়া দিলেন।

এই দুরবস্থায় ভৃত্য অৰ্দ্ধ-সংজ্ঞাশূন্য হইয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বাহিরে টানিয়া আনিলেন—অতি দ্রুতস্বরে জিজ্ঞাসিলেন, “শিবু, ব্যাপার কি? বল, শীঘ্র বল—”

শিবু বলিল, “আমি কিছুই জানি না, বাবু।”

দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “কোথায় তোমাকে তারা প্রথম আক্রমণ করে?”

শিবু উত্তর করিল, “এই ঘরে; আমি তখন বিছানায় শুয়েছিলাম।”

দেবেন্দ্র। কখন এ ঘটনা ঘটে?

শিবু। তখন রাত তিনটে বেজে গেছে।

দে। হা ভগবান্! আর যদি দু’ ঘণ্টা আগে আমি বাড়িতে ফিরতেম! (শিবুর প্রতি) আচ্ছা, তাদের তুমি দেখেছ? তা’রা কয়জন?

শি। চারজন।

দে। সকলেই পুরুষ?

শি। না, একটা মেয়েলোক ছিল।

দে। তুমি তার মুখের চেহারা কেমন, আমায় ঠিক ক’রে বলতে পার?

শি। না—আমি তার মুখ দেখিনি— দেখতে পাইনি; মস্ত লম্বা ঘোমটায় মুখখানা একেবারে ঢাকা ছিল।

দে। আর তিনজন, তাদের কারও মুখ তুমি দেখেছ? এখন দেখলে আমায় চিনিয়ে দিতে পার? শি। সে তিনজনের মুখ চাদরে ঢাকা ছিল।

দে। লোক তিনটা লম্বা না বেঁটে?

শি। একজন মস্ত লম্বা—আর দুইজন মাঝারী।

দে। তাদের গলার আওয়াজ শুনেছ? চেনা-চেনা বোধ হয় কি?

শি। না, তারা কথা কয় নি; কেবল সেই মেয়েমানুষটা কথা কয়েছিল—তাও শুধু একবার। আমাকে দেখিয়ে দিয়ে সে অপর তিনজনকে চাপা গলায় বলে, “শীঘ্র শীঘ্র বুকে ছোরা বসাও বেশি হাঙ্গামে দরকার কি, সহজেই কাজ মিটবে।”

দে। সেই স্ত্রীলোকটাই তবে তাদের সর্দ্দারণী, কেমন?

শি। হাঁ, তাই মনে হয়।

দে। তোমাকে বেঁধে—তার পর তারা আর কি করলে? আর কি দেখেছ তুমি?

শি। তারপর সেই মেয়েটা ছোরা-হাতে লাফিয়ে এসে আমার মুখের কাছে ঝুঁকে দাঁড়াল। আমি ভাবলেম, সে তার লোকদের আগে যে ছোরা চালাবার কথা বলেছিল, সে নিজেই বুঝি তাই করতে চায়; কিন্তু তা’ সে করলে না—আমাকে চুপি চুপি অথচ খুব চাপা রাগের গলায় বললে, ‘তোর মনিব এলে তাকে বলিস, আমাদের মানব-মৃগয়ার এই প্রথম লক্ষ্য—তার পর দ্বিতীয় লক্ষ্য অতি শীঘ্র তার প্রাণের উপরেই হবে; আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, যে কোন প্রকারে পারি, তাকে হত্যা করবই করব।’

দেবেন্দ্রবিজয় মৃদুগুঞ্জনে স্বগত বলিলেন, “এখন তা’রা এসে আমার উপরে তাদের বল-বিক্রম প্রকাশ করে—তাই ত চাই আমি।” প্রকাশ্যে শিবুকে জিজ্ঞাসিলেন, তাদের আমি অনুসন্ধান ক’রে বা’র করতে পারি, এমন কোন বিশেষ চিহ্ন তাদের মধ্যে দেখেছ?”

“কিছুই না।”

“তুমি কি এখন চলতে পারবে? তা হ’লে তোমাকে দিয়ে আপাততঃ আমার কাজের একটা বিশেষ সুবিধা হয়।”

“কেন পারব না, বাবু? কি করতে হবে বলুন?”

“তুমি এখনই খিদিরপুরে যাও—গঙ্গার ধারেই আনন্দ-কুটীর নামে একটা প্রকাণ্ড বাড়ি দেখতে পাবে; তেমন বড় বাড়ি সেখানে আর নাই; বাড়িখানার চারিদিকে বাগান। সে বাড়িতে যে করিমবক্স নামে একজন গাড়োয়ান আছে, গোপনে তার সঙ্গে দেখা করবে।”

“যে আজ্ঞা, বাবু।”

“সে করিম—আমাদেরই শচীন্দ্র, বুঝেছ?”

“আজ্ঞে হাঁ, আপনার নফর আমি—এটা যদি না বুঝতে পারব, তবে আমার-

(বাধা দিয়া) “তার কাছে বেশ ক’রে খবর নেবে—গতরাত্রে আনন্দ-কুটীরে কে কে অনুপস্থিত ছিল—কে কে রাত্রে উপস্থিত হয়েছে। সকলেরই উপরে যে’ন সতর্ক দৃষ্টি রাখতে কোন ত্রুটি না করে। যাও—যাও, ছুটে যাও—আর সময় নষ্ট ক’রো না; তার কাছে যত খবর পাও—সব জানবে—স্মরণ রাখবে। সময়ে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব।”

“যে আজ্ঞে, আমি এখনই যাচ্ছি। একটা কথা—মা’র উপরে তারা কোন অত্যাচার করেছে?”

“জানি না শিবু, বিষম বিভ্রাটে পড়েছি। মনোরমার সঙ্গে তাকেও তা’রা নিয়ে গে’ছে। ঈশ্বর জানেন, আমি যতক্ষণ না তাদের উদ্ধার করতে পারি, তাদের অদৃষ্টে ততক্ষণ না জানি, কী ভীষণ যন্ত্রণাভোগ আছে! যাও শিবু, যাও—”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নন্‌কু সিংহ

শিবু প্রস্থান করিলে দেবেন্দ্রবিজয় সত্বর বাটীর পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হইলেন। তথায় কিঞ্চিৎ জমি খালি পড়িয়া থাকায় প্রাচীর-বেষ্টিত। প্রাচীরের উপরিভাগে ধারাল কাচ বসানো। দেবেন্দ্রবিজয় তথায় যাইয়া প্রথমেই দেখিতে পাইলেন, সেই প্রাচীরের উপরে একখানি কম্বল রহিয়াছে। প্রাচীর হইতে সেটা নামাইয়া লইয়া দেখিলেন, সেখানি সাত-আট ভাঁজে ভাঁজ করা। বুঝিতে পারিলেন, কোন দুর্বৃত্ত পূর্ব্বে ইহারই সাহায্যে বাটী মধ্যে প্রবেশ করিয়া সম্মুখদ্বারের অর্গল উন্মোচন করিয়া দেয়। প্রাচীরের কাচখণ্ডগুলি কম্বলাচ্ছাদিত হওয়ায় প্রাচীরো-লঙ্ঘনকারীর কোন অনিষ্ট করিতে পারে নাই। ভাবিলেন, এ সকল কৌশলের মূল—সেই রমণী। কে সে? আমার প্রাণ সে চায়; পারে লইবে। এ সকল কার্য্য-কৌশলের রমণীই নিয়ন্তা—আর সেই পুরুষেরা তারই হাতের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি। আমি যে বাড়িতে উপস্থিত ছিলাম না, এ কথা কি প্রকারে তাহারা জানিল! তারা অগ্রে এ সংবাদ উত্তমরূপে পাইয়াছে যে, আমি অনুপস্থিত আছি তাই তারা স্বচ্ছন্দে সিংহগহ্বরে প্রবিষ্ট হইয়াও পরিত্রাণ পাইয়াছে; নতুবা কখনই তাহাদের এতদূর সাহস হইত না।

যে পর্য্যন্ত তিনি সেই দস্যুত্রয়ের আর সেই সুন্দরী পিশাচীর সন্ধানের কোন সূত্ৰ না পাইতেছেন, সে পৰ্য্যন্ত তাহাদিগের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইবেন না, স্থির করিলেন। সূত্রের মধ্যে সেই এক রক্তাক্ত গাত্রমার্জ্জনী—তাহাতে নির্ভর করা বিড়ম্বনা। আর যাহা তিনি শিবুর মুখে শুনিয়াছেন, তাহাও সুবিধাজনক নহে।

* * * * *

অনেক চিন্তার পর দেবেন্দ্রবিজয় নিকটস্থ থানায় উপস্থিত হইলেন। তথাকার উর্দ্ধতন কর্ম্মচারীকে ডাকিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাদিগের পাড়ার ঘাঁটাতে কাল রাত তিনটা পর্য্যন্ত কোন্ পাহারাওয়ালার চৌকি দিবার ভার ছিল?”

যাঁহাকে তিনি এই প্রশ্ন করিলেন, তাঁহার নাম রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। তিনি বয়ঃক্রমে চল্লিশটি বৎসর অতিক্রম করিয়াছেন। তিনি দেবেন্দ্রবিজয়কে উত্তমরূপে চিনিতেন; তখনই তিনি সেই পাহারাওয়ালাকে হাজির করিয়া দিলেন—পাহারাওয়ালার নাম নন্‌কু সিংহ।

.

নন্‌কু সিংহকে বাহিরে ডাকিয়া দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “কাল রাত তিনটার সময়ে তুমি কোথায় ছিলে?”

সে উত্তর করিল, “আপনারই বাড়ির দক্ষিণ সীমানায়।”

অপহরণকারীরা নিশ্চয়ই তাহাদের কার্য্যের সুবিধার নিমিত্ত একখানা গাড়ি সঙ্গে আনিয়া থাকিবে, এই অনুমানে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার বাড়ির সামনে যে একখানা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল—সে গাড়ির বিষয়ে তুমি কিছু জান?”

“কিছুই জানি না, তবে একখানা গাড়ি থাকতে দেখেছি বটে।”

“কখন দেখেছ? তখন রাত কত হবে?”

“রাত তখন তিনটে হবে।”

“কতক্ষণ গাড়িখানা আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল?”

“তা’ আমি ঠিক বলতে পারি না, গাড়িখানা থাকতে থাকতেই আমার পাহারা দিবার সময় ফুরায়—আমি থানায় ফিরে আসি।”

“গাড়ি থেকে যে লোক নামে, তুমি তা’কে দেখেছ?”

“দেখেছি, একটা মেয়ে লোক।”

“কি রকম দেখতে?”

“আমি তার মুখ দেখতে পাই নি; মুখখানা ঘোমটা-ঢাকা ছিল।”

“সে গাড়ি থেকে নেমেই আমার বাড়ির ভিতরে যায়। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল?”

“না।”

“গাড়িখানা কি রকম? ভাড়াটে গাড়ি, না বাড়ির গাড়ি?”

“ভাল গাড়ি— চমৎকার দেখতে—ভাড়াটে গাড়ি নয়, ছক্কর নয়—বড়লোকের গাড়ি।”

“যখন গাড়িখানা আমার বাড়ির সামনে থাকে, তখন তুমি কি মনে করেছিলে?”

“মনে আর করব কি? বুঝলেম, তত রাত্রে আপনার একজন বড় দরের মক্কেল জুটে গেল।”

“বড়দরের মক্কেল বটে! দুর্ভাগ্যবশত আমি কাল রাত্রে বাড়িতে ছিলাম না—তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটল না। আর তিনিও নিজের নাম, ধামের কোন ঠিকানা রেখে গেলেন না। “

(সদুঃখে) “আহা—হা—এমন মক্কেল আপনার হাতছাড়া হয়ে গে’ছে; বোধ হয়, কোথাকার রাণী হবে।”

“রাণী, বল কি!”

“মস্ত রাণী, গায়ে গয়না কত! পোষাক কী! আমি ত দেখে অবাক হ’য়ে গেলাম।” আমার সেই হাত-লণ্ঠনের আলোটা যেমনি একবার তাঁর দিকে ফিরিয়েছি, তাঁর গায়ে সমস্ত হীরামুক্তার গহনাগুলা ঝক্‌ক্‌ ক’রে উঠে আমার চোখদুটা যেমন ঝল্সে দিল।”

“সে গাড়িখানায় একজন কোচম্যান, আর দুইজন সহিস ছিল কি?”

“না, দু’জন কোচম্যান—একজন সহিস। কোচম্যান দু’জন কোচবাক্সে ছিল। সহিসটা গাড়ির পিছনে নিজের জায়গায় ব’সে ছিল। গাড়িখানা যখন আপনার বাড়ির সামনে এসে থামল—তড়াক্ ক’রে সহিসটা নেমে এসে বাড়ির দরজাটা খুলে ফেলে একপাশে দাঁড়াল—আর সেই মেয়ে লোকটি গাড়ি থেকে নেমেই সরাসর আপনার বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল।”

“সে গাড়ির ঘোড়া দুটো কেমন—কি রঙের?”

“একটা পাকিলে—আর একটা কাল তেজিয়ান ঘোড়া।”

“কোন্ দিক থেকে গাড়িখানা আসে?”

“পূর্ব্বদিকের রাস্তা দিয়ে।”

“কোন্ দিকে চ’লে যায়?’

“সে সব আমি জানি না—তখন আমার বদ্‌লী লোক এসে পড়াতে আমি থানায় চ’লে আসি।” তোমার সে বলী লোককে সে গাড়ি সম্বন্ধে তখন কোন কথা বলেছিলে? তোমার বলী পাহারাওয়ালা কে? নাম কি তার?”

“রঘুবীর পাঁড়ে— সে থানায় ফিরেছে।’ “বেশ, তাকেই আমার এখন দরকার।”

“গোয়েন্দাবাবু, কিছু ত খারাপি ঘটেনি?”

“না—না—কিছু না।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – রঘুবীর পাঁড়ে

নন্‌কু সিংহকে বিদায় দিয়া, দেবেন্দ্রবিজয় রঘুবীর পাঁড়েকে তথায় ডাকাইয়া আনিলেন। তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, “যখন তুমি আমাদের পাড়ায় শেষ রাত্রে পাহারা দিবার জন্য বদলী হও, তখন আমার বাড়ির সামনে একখানা গাড়ি দাঁড়িয়েছিল কি?”

রঘুবীর উত্তর করিল, “হাঁ মহাশয়, ছিল বটে একখানা। আমি সেই গাড়ির পাশ দিয়ে চ’লে এসে আপনাদের বাড়ির পাশের রাস্তার মোড়ে দাঁড়াই।”

দেবেন্দ্র। গাড়ির উপরে দু’জন কোচম্যান ছিল?

রঘু। একজনও না। একটা ছোঁড়া ঘোড়া দুটোর লাগাম ধরে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়েছিল।

দে। তাকে তুমি কোন কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে?

র। হাঁ, আমি গাড়োয়ানের কথা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেম; সে বললে, বাড়ির ভিতরে গেছে। তার পর আমি একচক্র চৌকী ঘুরে আবার আপনার বাড়ির রাস্তায় আসি।

দে। ফিরে এসে তুমি আর কিছু দেখেছ?

র। আমি ফিরে এলেম, গাড়িখানাও পূর্ব্বদিককার রাস্তা দিয়ে চ’লে গেল।

দে। তখন তুমি কি সে গাড়িতে দুজন কোচম্যান আর একজন সহিসকে দেখেছিলে?

র। কই, সহিসকে দেখিনি—দু’জন কোচম্যান ছিল।

দে। যে ছোঁড়া আগে ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়েছিল, তাকে তুমি চেন? তাকে তুমি দেখিয়ে দিতে পার?

র। যখন বলবেন, তখনই আমি তাকে আপনার কাছে হাজির করে দিব।

দে। শুনলেম, এইমাত্র তুমি ঘাঁটি হ’তে ফিরে আসছ, এখন কি ঘুমাবেনা তার বদলে দুটা টাকা নেবে? তা’. যদি নিতে চাও, তবে এখনই আমার সঙ্গে এস—সেই ছোঁড়াটাকে দেখিয়ে দাও।

র। চলুন।

তৎপরে ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয় সেই পাঁড়েজীকে সঙ্গে লইয়া থানা হইতে বহির্গত হইলেন। পথে তাহার হস্তে দুইটি টাকা দিলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – শ্রীশচন্দ্র রায়

যে বালক গতরাত্রে অশ্বরজ্জু ধরিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যে পাঁড়েজী তাহাকে উপস্থিত করিল। সে তাহার নিদ্রাতুর চোখ দুটি দুই হাতে রগড়াইতে রগড়াইতে দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখীন হইল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, “তোমার নাম কি, বাপু?”

শ্রী। শ্রীশচন্দ্র রায়।

দে। এখন কি তুমি ঘুমুচ্ছিলে?

শ্রী। হাঁ মশাই, ঠিক বলেছেন, কাল অনেক রাত্রে শুয়েছি—আপনারা আমাকে কাঁচা ঘুমে ডেকেছেন।

“এতে তোমার ঘুম ছুটবে কি?” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তাহার হাতে একখানি পাঁচ টাকার নোট দিলেন।

শ্রী। (শিহরিয়া) খুব ছুটবে—বোধ হয়, আর তিন রাতের ঘুম কাছে ঘেঁসবে না।

দে। এখন ওখানা ট্যাকে গুঁজে আমার কথাগুলির উত্তর দাও দেখি। তুমি কি কাল রাত্রে একখানা গাড়ির ঘোড়ার লাগাম ধ’রে দাঁড়িয়েছিলে?

শ্রী। হাঁ মশাই, ঠিক বলেছেন।

দে। কতক্ষণ তুমি সে ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়েছিলে?

শ্রী। প্রায় আধঘণ্টা।

দে। কে তোমাকে ঘোড়া ধরতে বলে? তখন রাত কত হবে? শ্রী। সেই গাড়ির গাড়োয়ান। রাত তখন তিনটে হবে।

দে। এত রাত্রে তুমি কোথা থেকে আসছিলে?

শ্রী। মামার বাড়ি গিয়ে ফিরতে রাত হ’য়ে যায়।

দে। দু’জন গাড়োয়ান আর একজন সহিস সে গাড়িতে ছিল কি?

শ্রী। হাঁ মশাই, ঠিক বলেছেন।

দে। তুমি যখন তাদের কথায় গাড়ির ঘোড়া ধ’রে দাঁড়ালে, তখন তারা কোথায় গে’ল? শ্রী। যে বাড়ির সামনে গাড়িখানা দাঁড়িয়েছিল, সেই বাড়ির ভিতরে তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল।

দে। তাদের যে পোষাক পরা ছিল— সে পোষাক বদলে অন্য পোষাক পরে তারা কি বাড়ির ভিতরে যায়?

শ্রী। না, সেই পোষাকেই।

দে। তাদের কারও হাতে কাপড়ের বুচকী ছিল কি?

শ্রী। হাঁ হাঁ, ঠিক বটে, একজনের হাতে বুচকীর মতন কি একটা ছিল বটে।

দে। যখন তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, কি কি তারা নিয়ে আসে?

শ্রী। আগে একজন এসেই আমাকে বাড়ি যেতে বলে।

দে। তারপর কি তুমি তার কথায় সেখান থেকে বাড়িতে চলে এলে?

শ্রীশচন্দ্র কোন উত্তর না করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে নীরবে চাহিয়া রহিল। দেবেন্দ্রবিজয় তখন মৃদুহাস্যে বলিলেন, “বুঝেছি, তুমি বাড়িতে যাও নাই, তুমি তফাতে দাঁড়িয়ে তার পরের ব্যাপার সবই দেখেছ, কেমন? কি হ’ল তার পর?”

“তারপর তারা বাড়ির ভিতর থেকে সকলেই একে একে বেরিয়ে এল।”

“তারা ফিরে আসবার সময়ে কিছু সঙ্গে নিয়ে আসে?”

“হাঁ, একটা মেয়েমানুষকে। তারপর তারা আবার বাড়ির ভিতরে গিয়ে আর একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে আসে।”

“সেই মেয়েমানুষ দু’টাকে যখন তুলে নিয়ে আসে, তখন তারা চিৎকার করে নি?”

“দু’জনের একজনও না। মড়া—মড়া—মরামানুষ আবার চিৎকার করবে কি?”

“মড়া! কে বললে? কি ক’রে জানলে তুমি?”

“দেখেই বুঝতে পারলুম। তাই দেখে আমার আত্মাপুরুষ উড়ে গে’ল—তত রাত—দু-দুটো মড়া— মেয়েমানুষ মড়া—নিশ্চয় পেত্নী—আর কি শর্ম্মারাম সেখানে থাকে—ভোঁ দৌড়। রাম নাম করতে করতে এক নিঃশ্বাসে একেবারে বাড়ি।”

“পালিয়ে গেলে?”

“তা’ নয় ত আর কি? আমি কি ভয় করবার ছেলে?”

“শ্রীশ, যদি তুমি তখন সেই গাড়িখানার পিছু নিয়ে গাড়িখানা যেখানে যায়, সে সন্ধান রাখতে পারতে, তা’ হ’লে আজ তোমার আরও অনেক লাভ হ’ত; যাক্, সে কথা এখন থাক্, এখন তুমি ভাল ভাল কাপড়, জামা, উড়ানী আরও একখানা দশটাকার নোট পকেটজাত করতে চাও কি?”

“আমি কি স্বপ্ন দেখছি—আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে সব কথা ভেঙে বলুন। আপনার কথা শুনে আমার আরও ভয় হচ্ছে।”

“একদিন কি দুইদিনের জন্য তুমি আমার কাজে নিযুক্ত থাকবে, আমি যখন যা’ বলব, তখন তাই করবে।”

“আজ থেকেই?”

“এখন থেকেই।”

“বেশ, যখন আপনি আমাকে আপনার কাছে যেতে বলবেন, তখনই গিয়ে হাজির হ’ব।”

“এখনই তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।”

“কোথায়?”

“অনেক জায়গায়। “

“না মশাই, আমার বড় ভয় করছে- শেষে কি বিঘোরে প’ড়ে এ অল্প বয়সে পৈত্রিক প্রাণটা খোয়াব?”

“ভয় কি?” (পার্শ্বস্থিত পাহারাওয়ালাকে দেখাইয়া) “তুমি এই পাহারাওয়ালাকে চেন কি?”

“হাঁ, চিনি বৈকি—এর নাম রঘো পাঁড়ে।”

“তবে আগে ওকে জিজ্ঞাসা করতে পার, তারপর আমাকে বিশ্বাস করো।”

“না মশাই, বিশ্বাস-অবিশ্বাস কি, ভদ্রলোক আপনি।”

“এখনই তুমি আমার সঙ্গে যেতে রাজী আছ?”

“হাঁ, এখনি।”

“তবে চ’লে এস।”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – উকিলের মুহুরী

শ্রীশচন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় আবাসে ফিরিলেন। এইখানে সেদিন শ্রীশচন্দ্রের আহারাদির বন্দোবস্ত হইল। সন্ধ্যার সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় নিজেকে এবং বালক শ্রীশচন্দ্রকে ছদ্মবেশে সাজাইলেন; সে সজ্জা নূতন রকমের। তাহার পর তিনি শ্রীশচন্দ্রকে তখন যাহা জানাইবার, যাহা শিখাইবার আবশ্যক, সকলই বলিয়া দিলেন।

সেদিন রবিবার। সন্ধ্যার পর দেবেন্দ্রবিজয় শ্রীশকে সঙ্গে লইয়া অন্ধের সাজে বাহির হইলেন। এবার ছদ্মবেশে মাথায় পরচুলার বারি, মুখে কৃত্রিম দাড়ি গোঁফ, চোখে গাঢ় নীল রঙ্গের চশমা, গায়ে একটি কাল রঙ্গের কোট, পরণে চওড়া কালাপাড় ধুতি। শ্রীশ ত তাহার হস্ত ধারণ করিয়া অগ্রে অগ্রে চলিল। শ্রীশের বেশভূষারও বিশেষ পারিপাট্য ছিল।

সেই বেশে, সেই ভাবে শ্রীশকে সঙ্গে লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় এক প্রকাণ্ড দ্বিতল অট্টালিকামধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। সেই দ্বিতল বাটী অন্যূন দ্বিশত ব্যক্তির আশ্রয়। তন্মধ্যে অল্প মাহিনার কেরাণী ও স্কুলের ছাত্র অধিক, আর জনকয়েক ডাক্তার, কতিপয় উকিল ও মোক্তার সেই বাটীতে আবশ্যকমত দুই-একটি ঘর ভাড়া লইয়া অবস্থিতি করেন। বিশেষত সেই বাড়িটা অনেক ভয়ানক লোকের নিরাপদ আশ্রয়।

চারি মহল বাটী—চারি মহলের চারিটি প্রাঙ্গণও অতি বৃহৎ। তেমন বড় বাড়ি বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না; একটা ক্ষুদ্র গ্রাম বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তন্মধ্যে এক ব্রাহ্মণের এক হিন্দু হোটেল। তথাকার প্রায় সকল লোকই সেই হোটেলে ভোজন করিয়া থাকে। হোটেলের অধিকারীর একটি ব্রাহ্মণীও (?) আছেন; রন্ধন-বিদ্যায় নাকি তাঁহার অপরিসীম অভিজ্ঞতা— সকলেই তাঁহার প্রস্তুত ব্যঞ্জনাদির বড়ই সুখ্যাতি করে। বিশেষত আমাদের উকিল তুলসীদাস বসু তাঁহার হাতের ব্যঞ্জনাদি অতীব তৃপ্তচিত্তে তথায় প্রত্যহ আহার করিয়া থাকেন। দৈবাৎ তিনি বাটীর অন্নব্যঞ্জন মুখে তুলিতেন।

.

এখানেই উকিলবাবু নিজের জন্য তিনটি ঘর ভাড়া লইয়াছেন। একটি ঘর উপরিতলে, নিজে সেই ঘরে বসেন—সেই ঘরেই নিজের মক্কেলদিগের সহিত পরামর্শ করেন। আর দুইটি ঘর নিম্নতলে—একটি তৃতীয় মহলের অপরটি চতুর্থ মহলের শেষপ্রান্তে। যে ঘরটি তৃতীয় মহলে, সেটিতে উকিল বাবুর মুহুরী থাকে; লেখাপড়া যাহা কিছু সেইখানেই হয়। চতুর্থ মহলের ঘরটি উকিল বাবুর বিশ্রামাগার। সেই বিশ্রামাগারের অভিপ্রায় অন্য—কেবল বিশ্রামেরই জন্য তাহা ব্যবহৃত হইত না—তাহাতে তাঁহার মক্কেলদিগকে তিনি নিশ্চিন্তে, নির্ব্বিঘ্নে আবশ্যকমত গূঢ় ও কূট-পরামর্শ দিতেন।

.

নিজকক্ষে বসিয়া উকিল বাবুর মুহুরী অতি ব্যস্তহস্তে একখানা দলিলের নকল করিতেছে। ছদ্মবেশী দেবেন্দ্রবিজয়ের সহিত হাত ধরিয়া শ্রীশচন্দ্র সেখানে আসিয়া দাঁড়াইল; দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিল, “এই যে এখানে উকিল বাবুর মুহুরী আছেন।”

তখন দেবেন্দ্রবিজয় মুহুরীকে বলিলেন, “মহাশয়, উকিল বাবু যদি এখন এখানে উপস্থিত থাকেন, অনুগ্রহ ক’রে তাঁকে বলুন গিয়ে, ক্রিশ্চান পাড়া থেকে অন্ধ রামগোপাল বাবু এসেছেন বিশেষ বরাৎ; একবার দেখা করতে চান।”

মুহুরী বলিল, “মহাশয়, এখন তিনি বড় ব্যস্ত আছেন।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ব্যস্ত আছেন—হ’তে পারে। পাঁচ মিনিটের জন্য আমি একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, তাতে আর তাঁর ব্যস্ততার বিশেষ কোন ব্যাঘাত হবে না। পাঁচ মিনিটের বেশি নয়, আমি নিজেও খুব ব্যস্ত আছি; তাঁকে বলুন—বিলম্ব করবেন না।”

মুহুরী উকিল তুলসীদাসকে এ সংবাদ দিতে চলিল। যে ঘরটি মুহুরীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল, সে ঘরের দুইটি দ্বার—একটা তৃতীয় মহলের প্রাঙ্গণ সম্মুখে, অপরটি চতুর্থ মহলের প্রাঙ্গণ-প্রান্তে শেষোক্ত দ্বার দিয়াই মুহুরী উকিল বাবুর সমীপস্থ হইতে চলিল। ইহারই সম্মুখেই চতুর্থ মহলের অপরপ্রান্তে উকিল বাবুর বিশ্রামাগার অথবা গুপ্তগৃহ। যখন মুহুরী প্রবেশকালে সেই গুপ্ত গৃহের দ্বার ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল; তখন সেই অল্প সময়ের মধ্যে সেই উন্মোচিত দ্বারপথ দিয়া শ্রীশচন্দ্র ও দেবেন্দ্রবিজয়ের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি উকিলবাবুর বিশ্রামাগারে পড়িল। শ্রীশচন্দ্র যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, তথা হইতে সে কেবল উকিলবাবুকে দেখিতে পাইল। দেবেন্দ্রবিজয় যথায় ছিলেন, তথা হইতে উকিল বাবুকে দেখা যায় না—তিনি এক অপরিচিত-মুখ লক্ষ্য করিলেন। পূৰ্ব্বে সে মুখ তিনি কখনও দেখিয়াছেন বলিয়া মনে হইল না; কিন্তু শচীন্দ্রের বর্ণনানুসারে বুঝিতে পারিলেন, সেই মুখ যেন অনেকটা নবীন ডাক্তারের মত।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – মুহুরীর প্রতি

শ্রীশচন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের কানে চুপি চুপি বলিল, “তাদের একজনকে আমি দেখতে পেয়েছি।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ঠিক চিনতে পেরেছ কি?”

শ্রীশচন্দ্র বলিল, “ঠিক—ঠিক—নিশ্চয়। ঠিক চিনতে পেরেছি! সে না হ’য়ে যায় না—সেই দু’জন গাড়োয়ানের একজন। যখন গাড়োয়ান সেজেছিল, তখন নিশ্চয়ই দুইগালে এক জোড়া পরচুলের গালপাট্টা দাড়ি এঁটেছিল। আঁটলে হবে কি, নাকের পাশে, ঠিক চোখের কোণের কাছে সুপারীর মত যে আবটি আছে, সেটি ত লুকোবার যো নাই; যখন যেমন সাজে সাজুক, ঐ আবটিতে ঠিক মালুম হ’য়ে যাবে।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “চিনেছি, আর বলতে হবে না।”

এমন সময়ে ক্ষিপ্রচরণে মুহুরী দেখা দিল। “মহাশয়, একটু অপেক্ষা করুন—এখনই তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন; বসুন আপনি।” এই বলিয়া নিবিষ্টচিত্তে মস্তক নত করিয়া পুনশ্চ দলিলের নকল লিখিতে লাগিল।

তাহার অলক্ষ্যে দেবেন্দ্রবিজয় তাহার পশ্চাতে নিঃশব্দে যাইয়া দাঁড়াইলেন। এবং চশমা জোড়া চোখ হইতে টানিয়া খুলিয়া ফেলিয়া মৃদুমধুরবাক্যে মুহুরীকে বলিলেন, “সুহৃদ্বর! আমার হাতে কি দেখতে পাচ্ছ?”

মুহুরী তখন মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, নিজের নাসিকার দুই ইঞ্চি তফাতে তাহারই লক্ষ্যে একটা উদ্যত পিস্তল। ভয়ে প্রাণ উড়িয়া গে’ল। কাঁপিতে কাঁপিতে জড়িতকণ্ঠে বলিল, “হাঁ— হাঁ—একি মহাশয়! “

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “চুপ কর, যদি নিজের প্রাণটাকে কিছুমাত্র মূল্যবান ব’লে বোধ কর—বাঁচাতে চাও—চুপ কর; আমি যা’ বলি, তা’ শোন, কোন কথা ক’য়ো না। বিনা বাক্যব্যয়ে আমাকে তোমার উকিল বাবুর গুপ্তগৃহে একবার যেতে দাও।”

মু। কেন মহাশয়, তিনি ত নিজেই এখানে আসছেন।

দে। না, তাঁকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না; তিনি সে কষ্ট নিজে নেবেন, এমন আমার ইচ্ছা নয়। যদি প্রাণের উপরে মায়া থাকে, কোন গোল ক’রো না—আমার কাজে বাধা দিয়ো না।

দেবেন্দ্রবিজয় ও শ্রীশ উভয়ে মিলিয়া মুহুরীর মুখ ও হাত-পা বাঁধিয়া ফেলিয়া ধরাতলে শায়িত করিলেন।

শ্ৰীশচন্দ্ৰকে সঙ্গে লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় তথা হইতে বাহিরে আসিলে শ্রীশচন্দ্রকে মুহুরীর কক্ষের উভয় দ্বারে শিকল লাগাইতে বলিলেন।

মুহুরী বদ্ধ অবস্থায় অবরুদ্ধ রহিল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – রমণীর সাহস

পরে দেবেন্দ্রবিজয় উকিলবাবুর গুপ্তগৃহের সন্নিকটস্থ হইয়া বহির্ভাগে নীরবে কিয়ৎকাল দাঁড়াইয়া রহিলেন। ভিতরে কথোপকথনের ফুস্ ফুস্ শব্দ তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল; কিছুই স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন না। তখনই তিনি সশব্দে পিস্তলহস্তে সেই কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। পশ্চাতে শ্ৰীশচন্দ্ৰ।

সেখানে তিনজন উপস্থিত ছিল—তিনজনই দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া চমকিতচিত্তে লাফাইয়া উঠিল। তথাকার সেই ব্যক্তিত্রয়—উকিল তুলসীদাস—কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদ—ডাক্তার নবীনচন্দ্র ব্যতীত আর কেহই নহে।

উকিল গৰ্জ্জিয়া উঠিলেন, “একি ব্যাপার! কে তুমি? এখানে কেন? মতলব কি? চ’লে যাও—দূর হও—দূর হও, এ সবের মানে কি?”

রোযারক্তনেত্রে উকিল তুলসীদাসের মুখের দিকে চাহিয়া, হস্তস্থিত পিস্তল প্রদর্শন করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বজ্ররবে বলিলেন, “এর মানে—’আমি পুলিস-কৰ্ম্মচারী, তোমরা এখন আমার বন্দী; এ ছাড়া আর কিছুই নয়। যে যেমন আছ, ঠিক থাক;এক পা উঠে যেতে গেলে চিরকালের জন্য ‘পপাত ধরণীতলে’ হবে।”

তুলসীদাস বলিলেন, “আমি জানতে চাই কে তুমি?” তাঁহার এক পদ অগ্রসর হইতে সাহসে কুলাইল না।

দে। আমি।

তু। কার এত স্পদ্ধা—তুলসীদাসের অপমান করতে চায়? কে তুমি? কি নাম?

দে। দেবেন্দ্রবিজয়।

ডিটেক্‌টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের সদর্পোক্তিতে তাঁহাদের মুখমণ্ডল বিশদরূপে ম্লান হইল। পরিহাসের হাসি হাসিয়া খলশ্রেষ্ঠ, মিষ্টভাষী নবীন ডাক্তার বলিলেন, “আপনি দেবেন্দ্রবিজয়! নাম শুনেছিলেম, আপাতত দেখে ধন্য হলেম। মহাশয়ের ন্যায় বিচক্ষণ সি আই ডির এ কাজটা উপযুক্ত হয় নি।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “উপযুক্ত কি না, গত রাত্রের কথা স্মরণ ক’রে দেখলে সেটা বুঝতে বড় বিলম্ব হবে না।“

নবীন। (সাশ্চর্য্যে) গত রাত্রি! কি হয়েছে? আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

দে। এখন না বুঝতে পারেন, একটু পরে বুঝতে পারবেন।

নবীন। ভেঙে বলুন—আপনার অভিপ্রায় কি?

দে। অভিপ্রায় সাংঘাতিক! শ্রীশ, এদিকে এস—সামনে এসে দাঁড়াও।

শ্রীশচন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের আদেশ পালন করিল—তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

দে। শ্রীশ, এই তিনজন লোকের মধ্যে কে কে তোমার চেনা লোক, বল দেখি?

শ্ৰী। দু’জন—ঐ যে দু’জন লোক এক জায়গায় বসে আছে।

দে। আমি এখন যার সঙ্গে কথা কচ্ছি—এ লোক নয়?

শ্ৰী। না।

নবীন। আমাদের উপরে আপনি কোন্ অপরাধের চার্জ এনেছেন? দে। অপহরণ, চুরি।

ন। অপহরণ, চুরি।! গুরুতর বিষয় বটে! ওয়ারেন্ট এনেছেন কি? দে। এক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট আবশ্যক করে না।

তু। তা’ বললে কি চলে, চাঁদ? ওয়ারেন্ট চাই—অবশ্যই সেটা নিয়ে আসা আবশ্যক ছিল।

দে। মৃগবাটীতে গিয়ে ওয়ারেন্ট দেখো। যদি হিত চাও— লৌহকঙ্কন ধারণ করতে কিংবা অয়সবটীকা ভক্ষণ করতে সাধ না থাকে— যে দুজন স্ত্রীলোককে তোমরা তাদের অসহায় অবস্থায় নিয়ে এসেছ, তাদের মুক্তি দাও; নতুবা নিশ্চয় জেনো, দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে তোমাদের কারও মুক্তি নাই।

তু। আমরা এ সকল ব্যাপারের কিছুই জানি না।

দে। মিথ্যাকথা।

নবীন। আমার না আপনার? আমরা এ সম্বন্ধে কিছুই জানি না।

পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বজ্ররবে বলিতে লাগিলেন, “জান না? আমি নিশ্চয় জানি, তোমরাই গতরাত্রে আমার বাড়িতে গিয়াছিলে। তোমাদের তিনজনের দুইজন কোচম্যান আর একজন সহিস সেজেছিলে। তোমাদের নেত্রী একজন রমণী, তাকেও আমি জানি—সেই এখন আনন্দ-কুটীরের মনোরমা। তারই পরামর্শে যে তোমরা এ কাজ করেছ, তা’ আমি এখন বেশ বুঝতে পেরেছি; এতে তোমাদের যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা আছে। তোমরা নিশ্চয়ই আমার স্ত্রীকে আর আসল মনোরমাকে তাদের অজ্ঞাতসারে ক্লোরাফরম ক’রে নিয়ে এসেছ। শেষে, পাছে আমার ভৃত্য শিবু তোমাদের অনুসরণ করে—কোথায় তোমরা যাও, সে সন্ধান রাখে— এই ভয়ে তাকেও তোমরা তার ঘরে হাত-পা, মুখ বেঁধে ফেলে রেখে এসেছ; বেশ চালাকির কাজই সব হয়েছে; তবে এটা স্মরণ রাখলে ভাল হত যে, দেবেন্দ্রবিজয়ের কাছে কোন চালাকিই খাটবে না। এ পর্যন্ত কেউ খাটাতে পারে নি; পরে যে পারবে, তা’ আমার ধারণাতে আসে না। আমাকে জানাতে শিবুকে যে কথা তোমরা ব’লে এসেছ—যে ভয় আমায় দেখিয়ে এসেছ, তাও আমি তার কাছে শুনেছি। তোমাদের সে প্রতিজ্ঞা অতি স্পর্দ্ধার; এখন আমি এখানে উপস্থিত আছি, পার যদি তোমাদের সেই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ কর। আমি সেজন্য যখন-তখন, যেখানে-সেখানে, এখন এখানেও প্রস্তুত আছি—সৰ্ব্বদা থাকবও; প্রতিজ্ঞা পূর্ণ কর—তোমাদের শত্রু তোমাদের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করাতে তোমাদের গৃহেই উপস্থিত; এ অবসর ত্যাগ করা নিতান্ত ভীরুতা। আর তোমাদের সেই কৃপাণকরা রমণী এখন কোথায়? যে আমার ভৃত্য শিবুর বুকে ছোরা চালাতে গেল—সে এখন কোথায়? তাকেও আমার বিশেষ প্রয়োজন।”

“প্রয়োজন? এইখানেই উপস্থিত আছি—প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হ’ক” বলিয়া পার্শ্ববর্তী গৃহের রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত করিয়া একটি অৰ্দ্ধাবগুণ্ঠিতা স্ত্রীলোক সত্বর বাহির হইয়া পশ্চাদ্দিক হইতে দেবেন্দ্রবিজয়ের কটি বেষ্টন করিয়া বক্ষে শাণিত কিরীচ-ফলক্ বসাইয়া দিল। সেই স্ত্রীলোকটির বেশভূষা মাড়োয়ারী স্ত্রীলোকদিগের মত। দেবেন্দ্রবিজয় বক্ষে দারুণ আঘাত পাইলেন; তখনই তাঁহার সৰ্ব্বাঙ্গ অবসন্ন হইয়া আসিল। বোধ হইল, তাঁহার সমস্ত শরীর যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হইল। প্ৰত্যেক ধমনীর রক্তপ্রবাহ এককালে রুদ্ধ হইয়া আসিল; দেখিতে দেখিতে তিনি সেই শত্রুমণ্ডলীর মধ্যে একান্ত নিঃসহায় হইয়া পড়িলেন।

সেই নিমেষ তাঁহার বৈরিগণের প্রশস্ত সময়। নবীন ডাক্তার চেয়ার তুলিয়া মারিতে গে’ল, গোবিন্দপ্রসাদ লাঠি উঠাইল, এইরূপে চারিদিক হইতে আক্রান্ত হইয়া দেবেন্দ্রবিজয় যেমন পশ্চাদ্দিকে মুখ ফিরাইবেন—উকিল তুলসীদাস তাঁহার মস্তক-লক্ষ্যে একটা মদের শূন্য বোতল নিক্ষেপ করিলেন; লক্ষ্য ব্যর্থ হইল না–তখনই দেবেন্দ্রবিজয় বিগতচৈতন্য হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেলেন।

তাহার পর সকলে শ্রীশচন্দ্রের দিকে ধাবিত হইল। সে তখন প্রাণভয়ে প্রাণপণে পলায়নে প্রবৃত্ত। যখন সে রাস্তায় আসিয়া পড়িল, তখন অত্যুচ্চস্বরে চিৎকার করিতে লাগিল, “কে কোথায় আছ—শীঘ্র এস—সর্বনাশ—খুন—ছোরা মেরেছে, খুন—খুন—খুন —

সেই অবগুণ্ঠিতা রমণী দেবেন্দ্রবিজয়ের দেহ নির্দ্দেশ করিয়া নবীন ডাক্তারকে জিজ্ঞাসিল, “দে’খ আগে, মরেছে কি না।”

“দেখ, দে’খ বোধ হয় মরেছে। আমায় এখন অন্য জায়গায় যেতে হবে—কাজ আছে— দেখ তুমি।” তাহার প্রশ্নের এইরূপ উত্তর দিয়া নবীন ডাক্তার রঙ্গভূমি পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল। সেই ভয়ঙ্কর স্থানে সংজ্ঞাবিলুপ্ত দেবেন্দ্রবিজয়ের পার্শ্বে সেই রমণীকে একাকী রাখিয়া তুলসীদাস ও গোবিন্দপ্রসাদ নবীনের অনুসরণ করিল।

অতিশয় তীক্ষ্ণস্বরে সেই রমণী বলিল, “ভীরু, কাপুরুষ তোমরা!” তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয়ের দেহ পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, “না—এখনও মরেনি। মরেনি? এইবার মরবে—দেবেন্দ্রবিজয়ের মৃত্যুই আমার মূলমন্ত্র। সেই মূলমন্ত্র-সাধনের আজ এই স্বর্ণ-সুযোগ। এমন সুবিধা আর ঘটবে না। দেবেন্দ্র যমালয়ের অর্দ্ধপথে গিয়েছে, অৰ্দ্ধপথ বাকী, তাও আমি এখনি পৌঁছে দিচ্ছি। দেবেন্দ্রের মৃত্যু হ’লে আর আমি কা’কেও ভয় করি না। দেবেনের হাতে মুক্তি পেলে এ সব উকিল, ডাক্তার কবিরাজের হাত থেকে আমি সহজেই নিজেকে মুক্ত করতে পারব। এদের জন্য একতিল ভাবি না—ভয়ও করি না। যে ভয়—ভয়ই বটে—সেই ভয় এখন দূর করি—নিজেকে চিরকালের জন্য নিরাপদ করি।”

এই বলিয়া সেই তরুণী বস্ত্রাঞ্চলমধ্য হইতে একখানি তীক্ষ্ণমুখ অনূজু কিরীচ বাহির করিল। দীপালোকে তাহা চাকচিক্যময় হইল; তমূলভাগে খচিত হীরকাদি জ্বলিয়া উঠিল। অতি সন্তর্পণে একবার চারিদিকে চাহিয়া সেই নির্ভীক রমণী কিরীচের তীক্ষ্ণাগ্রভাগ দেবেন্দ্রবিজয়ের কণ্ঠে রোপণ করিতে উদ্যত হইল। এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে কে বলিল, “ব্যাপার কি! কি হয়েছে—কি হয়েছে? গোলমাল কিসের এত?”

শুনিবামাত্র তখনই সেই রমণী চকিতে সেই কিরীচ লুক্কায়িত করিল। যেন সে নিতান্ত ভীত, বিস্মিত ও সঙ্কটাপন্ন হইয়াছে, এইরূপ ভাব দেখাইয়া নিরুপায়ের ন্যায় চিৎকার করিয়া বলিল, “ওঃ! কে মহাশয় আপনি? সৰ্ব্বনাশ, শীঘ্র আসুন—শীঘ্র—শীঘ্র।” বলিয়াই অলক্ষ্যে অতি সত্বর কিরীচখানি কটির বসনাভ্যন্তরে প্রবেশ করাইয়া দিল; তাহার পর চঞ্চলকরে অবগুণ্ঠন ঘুচাইয়া দিল। কী সুন্দর মুখমণ্ডল, মরি! মরি! এমন সৌন্দর্য্যে এ কদর্যতা কোথা হইতে আসিল! সুধায় গরল! কুসুমে কীট! গোলাপে কণ্টক! বিশালায়ত লোচনদ্বয়ে কী মনোমুগ্ধকর চঞ্চলদৃষ্টি। অপ্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসিকা, ঈষল্লোহিতাভ কপোল, তৎপার্শ্বে সুনিবিড় অতিকৃষ্ণকেশতরঙ্গমালা—যেন কৃষ্ণ জলদান্তবর্ত্তী অৰ্দ্ধপ্রকাশিত পূর্ণচন্দ্র। এই সুচারু মুখমণ্ডলে আর মনোরমার মুখমণ্ডলে তিল- পার্থক্য নাই।

সে মুখ এমন সৌন্দর্য্যময়—এমন লালসাময়—এমন শ্রীযুক্ত যে, যে ব্যক্তিটি তথায় তখন উপস্থিত হইয়াছিল, সে তথাকার সে দৃশ্যের সেই ভীষণতা, সে বিভীষিকা ভুলিয়া নির্নিমেষলোচনে, সবিস্ময়ে নিতান্ত বিমুগ্ধের ন্যায় সেই মুখখানি দেখিতে লাগিল। তাহার চেতনা হইতে ক্ষণকাল অতিবাহিত হইল। তাহার পর সে রমণীকে জিজ্ঞাসিল, “কি হয়েছে? এখানে এত গোলমাল কেন?”

পূর্ব্ববৎ রুদ্ধশ্বাসে রমণী বলিল, “দেখুন—এই দেখুন। বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সেই ভূতলাবলুণ্ঠিত, শোণিতসিক্ত শায়িত দেহ নির্দেশ করিল। তাহার পর হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিল, “এইখানে একজন ডাক্তার থাকেন—আমার স্বামীর বড় ব্যারাম—আমার আত্মীয় কেহ না থাকায় আমি নিজেই তাঁকে সে সংবাদ দিতে এসেছিলাম। যেমন আমি গাড়ি থেকে নেমে বাহিরের দরজায় পা দিয়েছি, চারজন লোক এইদিক থেকে ছুটে বেরিয়ে গে’ল; তাদের মধ্যে একটা ছোঁড়া, তার হাতে একখানা প্রকাণ্ড ছোরা ছিল, তাই ঘুরাতে ঘুরাতে সে বেরিয়ে গেল। আর তিন জন লোক তারই পিছনে’খুন—খুন’ ব’লে চিৎকার করতে করতে, লাফাতে লাফাতে চ’লে গে’ল। আমি তখনই ছুটে এদিকে আসি, একটা গোঙানি শব্দও শুনতে পেলেম; তাই শুনেই আমি তাড়াতাড়ি এই ঘরে এসে দেখি, এই ব্যাপার। আর কিছু না—আর কিছু জানি না; খুন— ভয়ানক খুন! এই লোকটাকে এইভাবেই এখানে পড়ে থাকতে দেখি। দেখুন, আপনি এসেছেন, আমার ভরসা হয়েছে—হতভাগ্য বেঁচে আছে কি না দেখুন, মরে নাই ত?”

আগন্তুক দেবেন্দ্রবিজয়ের পার্শ্বে উপবেশন করিয়া নাসিকায় একটি অঙ্গুলী ধরিয়া বলিল, “না, অল্প অল্প নিঃশ্বাস পড়ছে।”

“আঃ বাঁচলেম! ভগবান রক্ষা করেছেন—বিপন্নের সহায় তিনি—দুঃস্থের সহায় তিনি মরণাপন্নের সহায় তিনি! আপনি এখানে থাকুন, যে ডাক্তারের কাছে আমি এসেছি, তিনি প্রবীণ লোক, তাঁকেই আমি ডেকে আনি; ও মহলে তাঁর বাসা, যেতে বিলম্ব হবে—ছুটে যাই আমি।” এই বলিয়া সেই রমণী এমন চঞ্চল-চরণে এত সত্বর—বিদ্যুদ্বেগে সেই গৃহ পরিত্যাগ করিল যে, আগন্তুক তাহাকে বাধা দিবার নিমেষমাত্র সময় পাইল না; রমণী তথা হইতে অন্তর্হিত হইলে সে চিৎকার করিয়া বলিল, “থাম—থাম—দাঁড়াও—যেয়ো না—একটু অপেক্ষা কর।”

তখন সেই রমণী বাহিরের আঁধারে মিশিয়া গিয়াছে। লোকটা মনে মনে ভাবিল, “স্ত্রীলোকটি যেমন সুন্দরী—তেমনি কোমলস্বভাবা—বড়ই ভয় পেয়েছে, দেখছি।” সে দেবেন্দ্রবিজয়ের শুশ্রূষায় মনোযোগ দিল।

নবম পরিচ্ছেদ – এ রমণী কে?

রমণী কোথায় গে’ল? সে বাহিরে আসিয়া ভাবিল, “এখন এ বাড়ি হইতে বাহির হইতে গেলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। ছোঁড়াটা এতক্ষণে পুলিসের লোক ডেকে নিয়ে আসছে—তার সম্মুখে পড়িলে নিস্তার নাই; যে কোন প্রকারে হ’ক—যে কোন ছলে এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে; পরে ছোঁড়াটা সেই হত্যাগৃহে প্রবেশ করলে, আমিও তখন সহজে যথাস্থানে চ’লৈ যেতে পারব। আপাতত এখানে কোথায়ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।” এইরূপ স্থির করিয়া রমণী প্রথম মহলের দ্বিতলে উঠিল; তথায় এক ডাক্তার থাকিতেন, তাঁহার প্রকোষ্ঠে প্রবিষ্ট হইয়া অবগুণ্ঠন উন্মুক্ত করিল।

সুন্দরীর মুখের দিকে বিস্মিতনেত্রে ডাক্তার অনেকক্ষণ নিষ্পলকে চাহিয়া রহিলেন। রমণী তাঁহাকে কল্পিত নাম ও ঠিকানা দিয়া পরিচয় দিল। হিন্দীতে বলিল, তাহার স্বামীর বড় ব্যারাম— বিসূচিকা রোগাক্রান্ত—অন্য কেহ আত্মীয় না থাকায় সে নিজেই তাঁহার নিকটে আসিয়াছে। সে এমনভাবে ডাক্তারের নিকটে নিজের অমূলক বিপত্তির পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করিল যে, তাহার কল্পিত দুর্ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বর্ণন করে, তখন সত্যই তাহার বিশালায়তলোচনে দরবিগলিতধারে অশ্রু বহিতে লাগিল; তাহার স্বর সংক্ষুব্ধ, ভগ্ন, ভাব আত্মহারা, জ্ঞানশূন্য, উন্মাদের, অস্থির; সুতরাং ডাক্তার মহাশয়কে সেই সময়ের জন্য ব্যথিত ও অনুগ্রহশীল হইতে হইল। আহারাদি সমাপন করিয়া শীঘ্রই তাহার স্বামীকে দেখিতে যাইবেন বলিয়া তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন। এইরূপে অন্যূন অৰ্দ্ধঘণ্টা উত্তীর্ণ হইলে রমণী ডাক্তার বাবুকে তাহার মিথ্যা ঠিকানা দিয়া ভিন্নপথে স্বস্থানোদ্দেশে প্রস্থান করিল।

ডাক্তার বাবুর আহার্য্য্যাদি প্রস্তুত ছিল। অন্য দিবসাপেক্ষা ক্ষিপ্রহস্তে, ক্ষিপ্রদন্তে ক্ষিপ্রজিহ্বায় আহার-কার্য্য সমাধা করিয়া তখনই সেই ঠিকানা অভিমুখে একখানি পাল্কি ভাড়া করিয়া চলিলেন সেদিন তাঁহার একটিবারও কোন স্থানে ডাক্ হয় নাই; রাত্রে দ্বিগুণ ভিজিট মিলিবে, এই আশা তাঁহার হৃদয়ে বদ্ধমূল হইল। যে ঠিকানা সেই স্ত্রীলোকটি দিয়া গেল সে ঠিকানায় একজন মুসলমানের বাড়ি। সেই বাড়ির সম্মুখে পাল্কি হইতে অবতরণ করিবামাত্র ডাক্তার বাবুকে বহির্ব্বাটীর লোকেরা তাঁহাকে তাঁহার শুভাগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিল। ডাক্তারবাবু তাহাদিগের নিকটে সকল বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। তাহাতে তাহারা আকাশ হইতে পড়িল; ডাক্তারবাবু অতিশয় অপ্রতিভ হইলেন। শেষে ভগ্ন ও নিরাশ-হৃদয়ে বাসায় ফিরিলেন। পাল্কি ভাড়াটা দণ্ড ছিল, স্বব্যয়ে তাহা মিটাইয়া দিলেন; কিন্তু এ নির্বুদ্ধিতার কথা তিনি কখনও ভুলিতে পারেন নাই—আজীবন তাঁহার স্মরণ ছিল।

দশম পরিচ্ছেদ – সংজ্ঞালাভে

দেবেন্দ্রবিজয় যখন চক্ষুরুন্মীলন করিলেন—দেখিলেন, তাঁহার চারিদিকে মহা জনতা। পাঠক মহাশয়কে আমরা পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, সেই অট্টালিকাটি একটি ক্ষুদ্র গ্রাম বিশেষ। এক মহলে ডাকাতি হইলেও অন্যান্য মহলে সে সংবাদ সত্বর উপস্থিত হইত না। সে জনতার অধিকাংশ সেই মহল নিবাসী—যাঁহারা সংবাদ পাইয়াছিলেন, অন্যান্য মহলের দুই-চারিজন—শ্রীশচন্দ্র ও কতিপয় পুলিস-কৰ্ম্মচারী।

যদিও কিরীচের আঘাত তেমন সাংঘাতিক হয় নাই; কিন্তু তুলসীদাসের নিক্ষিপ্ত বোতলের আঘাতেই দেবেন্দ্রবিজয়কে তখন সংজ্ঞাশূন্য হইতে হইয়াছিল। যখন তাঁহার চৈতন্য হইল, তখন তাঁহার বক্ষের একপার্শ্বে যে কিরীচ বিদ্ধ হইয়াছিল, তাহা স্মরণ হইল না। কোন ব্যক্তি যখন তাঁহাকে তাহার শরীরলিপ্ত ও ভূলিপ্ত শোণিত দেখাইয়া দিল, তখন তিনি হাসিয়া সে কথা উড়াইয়া দিয়া বলিলেন, “বটে, সত্যই ত! এ কিছুই নয়, দেবেন্দ্রের শরীরে এখনও অনেক রক্ত আছে, এই সামান্য রক্তপাতে তার শক্তির কিছুমাত্র হ্রাস ঘটে না।”

মুহুরী যে কক্ষে আবদ্ধ ছিল, অধিক দূর নয়—নিকটে; একটি মাত্র উন্মুক্ত-প্রাঙ্গণ ব্যবধান। সে সকলই শুনিতে পাইয়াছিল, জনিতেও পারিয়াছিল। এখন ভয়ে তাহার মুখ কালিমাচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে; হস্তপদ পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর ন্যায় শিথিল হইয়া আসিয়াছে; চিৎকার করিতে সাহস হইতেছে না।

যখন দর্শকমণ্ডলী একে একে স্বস্থানে প্রস্থান করিল, তখন দেবেন্দ্রবিজয় মুহুরীকে মুক্ত করিতে শ্রীশচন্দ্রকে অনুজ্ঞা করিলেন। শ্রীশচন্দ্র শিকল খুলিয়া দিল—মুহুরী বাহিরে আসিয়া হাঁপ্ ছাড়িয়া বাঁচিল।

দেবেন্দ্রবিজয় মুহুরীকে বিদায় দিয়া শ্রীশচন্দ্রকে বলিলেন, “শ্রীশ, তুমি চালাক ছোক্রা, বেশ বুদ্ধি আছে; তুমি যদি আমার কাছে চাকরী কর, আমি তোমাকে কিছু বেতনও দিতে পারি; এরপর তোমার উন্নতি হ’তে পারে। কালে তুমি একজন সুদক্ষ গোয়েন্দা হ’তে পারবে। যাক্, এ কথা এখন থাক্— সে সময় এখন নয়।”

শ্রীশচন্দ্র জিজ্ঞাসিল, “এখন কি করবেন? “

“এখন তুমি চেলায় যাও, সেখানকার খেয়াঘাটে অপেক্ষা করবে।”

“বেশ, এখনই তবে আমি চললেম।”

“দাঁড়াও, কি দরকারে যাবে বল দেখি?”

“এই সব বদমায়েস লোকের সন্ধানে।”

“হাঁ, কিন্তু তাদের এখানে আরও দুই-একটা আড্ডা আছে—যেখান থেকে তারা ছদ্মবেশ ধরতে পারে।”

“যেমন ছদ্মবেশ ধরুক না কেন, আমার চোখে পড়লে আমি তাদের ঠিক চিনে নিতে পারব।”

“তাই চাই—তারা এখন খিদিরপুরের দিকে যাবে। সেখানে তাদের প্রধান আড্ডা। সেই আড্ডায় আজ তারা একবার সকলে মিলে জটলা ক’রে নিজেদের মধ্যে একটা পরামর্শ করবে। যদি তারা দক্ষিণের পথ ধ’রে গিয়ে থাকে, তা’ হ’লে চেৎলার খেয়াঘাট পার হ’য়ে খিদিরপুরের দিকে যাবে। আর যদি পশ্চিমের পথ ধরে গিয়ে থাকে, তা’ হ’লে আলিপুরের রাস্তা দিয়া তাদের যেতেই হবে। আলিপুরের পোলের উপর থাকব। এই দুই পথের একপথ তাদের অবলম্বন করতেই হবে—আর পথ নাই।”

তখন উর্দ্ধশ্বাসে দুইদিকে দুইজন ছুটিলেন;

একাদশ পরিচ্ছেদ – সেই অবগুণ্ঠন-রহস্যময়ী

ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয় আলিপুরের পোলে উপস্থিত হইলেন। সেতুর একপার্শ্বে লুক্কায়িত রহিলেন। তাঁহার মস্তকে যে স্থানে আঘাত লাগিয়াছিল ও বক্ষের যে স্থানে কিরীচ বিদ্ধ হইয়াছিল, তথায় অসহ্য জ্বালা অনুভব করিতে লাগিলেন। সহ্য করিলেন, গ্রাহ্য করিলেন না। পত্নীর বিপন্ন অবস্থা স্মরণে তাঁহার হৃদয়ে যে হতাশা উপস্থিত হইয়াছিল, সে মানসিক ক্লেশের নিকটে সে শারীরিক জ্বালা-যন্ত্রণা তুলনায় তখন কিছুই নহে।

কিয়ৎকাল উত্তীর্ণ হইলে একখানি গাড়ি সেতু অতিক্রম করিয়া চলিল। দেবেন্দ্রবিজয় সেই গাড়ির পশ্চাদ্ভাগে নিঃশব্দে উপবেশন করিলেন।

গাড়ির উভয় দ্বার বন্ধ। পশ্চাতে খড়খড়ির মধ্য দিয়া দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, শকটারোহী দুইজন মাত্র, একজন বৃদ্ধ—অপরটি বৃদ্ধা। বৃদ্ধের মুখে চুরুট—যখন সেই চুরুটে টান পড়িতেছে, তখন সেই গাড়ির ভিতরে ঈষদালোক সঞ্চিত হইতেছে। সেই আলোকে দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন—অনুমানে বুঝিলেন, সেই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা ছদ্মবেশী। বৃদ্ধ —নবীন ডাক্তার; আর বৃদ্ধা – সেই অপরিচিতা—অবগুণ্ঠন-রহস্যময়ী।

দেবেন্দ্রবিজয় ভাবিলেন, “এখন ইহারা এই পথ দিয়াই আনন্দ-কুটীরের দিকেই যাইতেছে। তুলসীদাস আর গোবিন্দপ্রসাদ চেৎলার পথ ধরিয়া থাকিবে। অবশ্যই শ্রীশচন্দ্র তাহাদের সন্ধান নিতে পারবে। পারে—ভাল; না পারে ক্ষতি নাই। যাদের বিশেষ প্রয়োজন—আমি তাদের এখন পেয়েছি।”

দেবেন্দ্রবিজয় আরোহীদিগের কথোপকথন শুনিতে চেষ্টিত হইলেন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – অনুসরণে

অনেকক্ষণ সেই স্ত্রীলোকটি ও নবীন ডাক্তার কোন কথা কহিল না। পোল পার হইয়া যখন গাড়ি অনেকদূর গিয়া পড়িল; তখন দেবেন্দ্রবিজয় নবীন ডাক্তারকে বলিতে শুনিলেন, “এখন একটি কথা আমি তোমার কাছে জানতে চাই?”

“চু–উ—উ—প্।” রমণী চাপা গলায় এই উত্তর করিল।

“এখন আর আমাদের ভয় কি? আমরা ত আনন্দ-কুটীরের নিকটেই এসে পড়েছি।”

“বেশ, তা’ আমি জানি; একটু অপেক্ষা কর—যতক্ষণ না আমরা আনন্দ-কুটীরে উপস্থিত হচ্ছি, ততক্ষণ চুপ কর—চুপ করে থাক।”

“তখন ঠিক সময়েই তুমি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলে। লোকটাকে হাতে পেয়ে নিকেশ করেও নিকেশ করতে পারলে না—বড়ই দুঃখের বিষয়!”

“চুপ করবে কি? কথা শুনবে না?”

“আর একটা কথা আছে— সেই কথাটির উত্তর দাও, তা’ হ’লেই চুপ করব—আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করব না।”

“কি কথা, বল?”

“লোকটাকে যেরূপ আঘাত করা হয়েছে, তার বুকে যেমন তুমি সাংঘাতিক কিরীচ বসিয়েছ, তাতে তাকে আপাতত কিছুদিন শয্যাশায়ী হ’তে হবে কিনা?”

“হাঁ, নিশ্চয়ই।”

কিয়ৎকাল উভয়ে নীরব। ছদ্মবেশী নবীন ডাক্তার জিজ্ঞাসিল, “এখন আমাদের প্রথম কাজটা কি?”

“জান না কি তুমি?”

“হাঁ―হাঁ জানি বৈকি।”

“তবে জিজ্ঞাসা করছ?”

“তেমন সুন্দরী স্ত্রীলোক দুটিকে হত্যা করবে?”

“চুপ।”

“হাঁ, স্বীকার করি তারা সুন্দরী বটে; কিন্তু তুমি যেমন সুন্দরী—তোমার যেমন রূপ তেমন নয়।”

“দেখছি, তুমি হঠাৎ আমার মন যোগাতে বসলে; কিন্তু নিশ্চয় জেনো, আজ তাদের শেষ দিন; শুধু সেই সুন্দরী দুটির নয়, আরও দু’-একজনের।”

“অ্যাঁ! আবার দু’-একজন কে?”

“তুলসীদাস আর গোবিন্দপ্রসাদ। “

“আজ রাত্রেই?”

“এই রাত্রেই—তা’ ছাড়া আর সুবিধা হবে না।”

“কেন?”

“নিশ্চয়ই কাল তাদের নামে ওয়ারেন্ট বের হবে। তা’ হলেই তারা দেশ ছেড়ে পালাবে; এখানে থাকতে তাদের সাহস হবে না। এর ভিতরে আমার একটু কারচুপি না থাকলে, এতক্ষণ তারা সরে পড়ত।”

“জুমেলিয়া! তুমি যাদুমন্ত্র জান, নিশ্চয়ই তোমার কোন মোহিনী শক্তি আছে।”

“জুমেলিয়া!” দেবেন্দ্রবিজয় এই নাম শ্রবণে চমক্তিচিত্তে ভাবিতে লাগিলেন, “ওঃ! বটে! হ’তে পারে; যখন আমি আমার শিক্ষাগুরু অরিন্দমের সাহচর্য্য করি, তখন এই জুমেলিয়াই আমাকে একবার আহত করেছিল, আজও আমাকে মরণাপন্ন করেছিল—শক্ত মেয়ে বটে, যেমন শঠ-শিরোমণি ফুলসাহেব—জুমেলিয়া তেমনি তার উপযুক্ত উপপত্নী। আবার নবীন ডাক্তারের বশ্যতা স্বীকার করেছে। জুমেলিয়াকে দমন করা বড় সহজ ব্যাপার নহে। জুমেলিয়া! বেশ, বেশ জুমেলিয়া, তোমায়-আমায় আবার সাক্ষাৎ হবে।”

নবীন ডাক্তার কিছুক্ষণের নিমিত্ত নীরব থাকিয়া জুমেলিয়াকে জিজ্ঞাসিল, “আজ রাত্রের মধ্যেই তুমি কি সকল কাজই সমাধা করে উঠতে পারবে?”

জুমেলিয়া বলিল, “কেন? কে বলিল পারব না?”

নবীন। তা’ আমি জানি, তোমার সেই মৃগীরোগ ব্যাপারের সকল তত্ত্বই আমি রাখি; কিন্তু এক- আধটা নয়, একেবারে চার-পাঁচটার মৃগীরোগ। অসম্ভব কথা যে, জুমেলা?

জু। না, এবার মৃগীরোগ নয়, এবারে ব্যাপার গুরুতর। এবারের প্রক্রিয়ায় শতসহস্র প্রাণ একরাত্রে সহজেই নষ্ট করা যায়।

ন। হাঁ, পার তুমি। তোমার কাছে যে অনেক রকম সাংঘাতিক জিনিষ আছে, তা’ আমার অজানা নয়। অনেক দ্রব্যগুণ তুমি ভাল রকমে জান। অনেক মন্ত্রতন্ত্রও জান, তাও আমি জানি। কিন্তু আজকার ব্যাপারের—

জু। (বাধা দিয়া) চুপ কর। আমার কাজ আমি যাতে সহজে হাঁসিল করতে পারি, সে বন্দোবস্ত ঠিক ক’রে রেখেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *