মদনের স্বপ্ন

মদনের স্বপ্ন

মদন চলেছে শহরে। মফস্বল শহর। লোকে বলে কলবাজার। মানে অনেক কলকারখানা রয়েছে সেখানে।

ভোর রাত্রে ঝিমোতে ঝিমোতে চলেছে ট্রেনটা। ন্যারো গেজ গাড়ি, কুল্লে চারটে বগি। ঘণ্টায় প্রায় আট মাইল গতিতে ঝুকঝুক করে চলেছে। তাও গদাইলস্করি চালে, হেলেদুলে চলেছে। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়ো। গাড়ির শব্দ কী! যেন বিশ্ব কাঁপিয়ে চলেছে।

এখনও অন্ধকার। হেমন্তের আকাশে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা। কুয়াশায় ঘষা চোখের মতো তারার উঁকিঝুঁকি। উত্তরে হাওয়াটাও বেশ মেতেছে। পাড়ার ছেঁচতলা, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে রেললাইনটার দু-পাশে গাছ-গাছালির ভিড়। উত্তরে হাওয়া সব রস টেনে নিয়ে পাতাগুলি একটা একটা করে খসিয়ে ছাড়ছে।

কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উগরে গাড়িটা চলেছে। কামরাগুলি সবই অন্ধকার আর বেশির ভাগ দরজাই বন্ধ। যাত্রীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়, তবে মালের ভিড় খুব। চুপড়ির উপর বস্তা, বস্তার উপর চুপড়ি, নয়তো বাঁকের সঙ্গে চুপড়ি ঝুলানো। বেশির ভাগই সবজি। নতুন পালং, মুলো, বরবটি, কচু, পলতা, শুলফো আর ধনেপাতা, পেঁপে এই সব। যাত্রীও বেশির ভাগ শহুরে পাইকের দোকানি। এসেছিল কাল সন্ধ্যায়, ভোরবেলা গিয়ে বাজারে বসবে সবাই। তা ছাড়া দু-চারজন চাষিও আছে। মাল নিয়ে চলেছে শহরের বাজারে। সংখ্যায় খুব কম। দু-চারজন এরকম বেচনদার চাষিও আছে। শহর বাজারের দরটাও জানা যায়, আর শহরে মাঝে মাঝে আসাও ভাল, মনটাও চায়।

এমনি একটা অন্ধকার কামরার এক কোণে কাপড় মুড়ি দিয়ে বসে আছে মদন। চলেছে শহরে। পালিয়ে যাচ্ছে। না গিয়ে উপায় ছিল না। অনেক সহ্য করেছে, অনেক অত্যাচার আর উৎপীড়ন। এখনও গায়ে ব্যথা, মাথার চুলের গোড়ায় ছুঁচ ফুটছে। কেন, কী করেছে মদন। জোয়াল কাঁধে বলদের মতো সারাদিন খেটেছে। কী না করেছে! বেড়া বাঁধবে কে? না, মদন। মাঠের কাজে যাবে কে? না, মদন। গোরু চরাবে, তাও মদন। মায় ঘরকন্নার কাজ পর্যন্ত। অপরাধ কী? না, মদনের বাপ নেই। লোকে বলে, মায়ের চেয়ে সংসারে কেউ আপনার নেই। আপনার না ছাই। মা তার শত্রু। দুটো বছর হয়নি বাপ মরেছে, যেন মায়ের আপদ বিদেয় হয়েছে। সদা বোষ্টমই এখন তাদের সংসারের কর্তা। লোকেও কম গাল দেয় না তার মাকে। সদা বোষ্টমই নাকি তার মাকে খারাপ করেছে। ব্যাটা বোষ্টম না আর কিছু, বকধার্মিক। কী হয়েছে? না মদনের বাপ কিছু টাকা ধারত সদা বোষ্টমের কাছে। তাইতে সে ঘর বউ ছেলে, সব কিছুর মালিক হয়ে গেল।

হতে পারে মদন কাঁচা ছেলে। তাও কি, চোদ্দো বছর বয়স হল। নেটো দিগারের ব্যাটা অনন্ত এই বয়সে বিয়ে করেছে। বেচা এই বয়সে ঘরের কর্তা। চরণ তো যাত্রাদলের কেষ্টঠাকুর। মদনও কি কিছু কম বোঝে। পাঁচ বিঘের উপর তাদের জমি, দুটো গাই গোরু, দশ বারো কাঠা জমির উপর বাড়ি। হলই বা সে খড়ো ঘর। গোটা সাতেক আমগাছ, গোটা তিনেক নারকোল। তা ছাড়াও আছে অন্যান্য রকমের গাছ। আর এই তো সময়। পালং মুলোও যা হয়েছে মন্দ নয়। আউশটাও কিছু কম পাওয়া যায়নি। ও সব হিসেব মদনের নখদর্পণে।

বাপের এত থাকতেও মদন ফকির। সবকিছু তদবির তদারক করে সদা বোষ্টম। তাদের যাবতীয় সংসারের ব্যাপার এবং তার মায়েরও। আর ধরে ধরে মারে মদনকে। যার শিল যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া। মদন কিছু বোঝে না বুঝি? মারবে আবার আধপেটা খেতে দেবে। হেই ভগবান, কতদিন ঢেঁকিশালে তাকে সদা বোষ্টম পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রেখেছে। তার উপরেও আবার তার মা নাকে কেঁদে কেঁদে নালিশ করেছে, এই পাপের মড়া কবে মরবে। আপদ কবে বিদেয় হবে গো!

কেন, আজ মদন কেন আপদ হল তোর। রাক্ষুসী, তোর ওই পেটে কি জন্মায়নি মদন। আজ তুই কী পেলি যে, পেটের ছা তোর পাপের মড়া হল। কেন সে তোর চক্ষুশূল হয়েছে। কী মন্ত্র তোকে পড়াল ওই সদা বোষ্টম। তোরই সামনে দাঁড়িয়ে সদা বোষ্টম মদনকে ফেলে ঠ্যাঙায়, চুল টানে, লাথি মারে। নাহক মারে। আর মা হয়ে তুই তখনও বলিস কিনা, তুই মর!

ট্রেনের অন্ধকার কামরার কোণে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মদন। লোকে টের পাবে ভেবে কাপড় গুঁজে দেয় মুখে। চোখের জল বাঁধ মানে না। মরবে, কিন্তু কী করে সে মরবে। একটা অসুখ-বিসুখ নেই, হুট করে ওলাউঠা ভেদবমি হলেও না হয় মরতে পারে। মরতে তো সে চায়। মরে না যে! নকু বউয়ের মতো গলায় দড়ি দেবে! তা সে পারবে না। ভয় করে।

তার দুঃখে পাড়ার মানুষ কাঁদে। মদনের মনে হয়, নির্জন ঝোপের ওই পাখিগুলো কুরর কুরর করে ডাকে, তারই দুঃখে। হাওয়ার বুকেও সে শোনে তার কান্না।

এ তো আর সহ্য হয় না, তাই সে চলেছে শহরে। বড় ভয় ছিল শহরকে। ওই কলবাজারকে। কুলি-মজুর-চোর-ছ্যাঁচড়-বদমায়েশদের জায়গা। লোক ঠকে সেখানে পদে পদে। কিন্তু ভয় করলে আর চলে না। ভয়ের মুখে ছাই দিয়ে এসেছে সে। হ্যাঁ, শহরে সে রোজগার করবে। আঁটঘাট বেঁধে আবার ফিরে যাবে গাঁয়ে। দেখবে একবার সদা বোষ্টমকে। এক কণা ধান, একটা পাইও সে ছাড়বে না। সেও মুকুন্দ চাষার ব্যাটা মদন। তাকে ঠকাবে কে?

যেন মনের জেদে জোরে জোরে চোখের জল মোছে সে। কোমরে হাত দিয়ে একবার আঁচ করে নেয় টাকার পুঁটুলিটা। এখনও কুড়ি টাকা আছে তার। চার মন ধান বেচে দিয়েছে সে। সদা বোষ্টম বা তার ওই পেটে ধরা ডাইনি মা টেরও পায়নি। পেলেই বা। নিজেরটা, বাপেরটা বিক্রি করেছে সে।

ফরসা হয়ে আসছে আকাশ। এবার আসবে জংশন স্টেশন। তারপর আবার বড় লাইনের গাড়ি। সেই গাড়িতে করে একেবারে শহরে। শহর। গাঁয়ের থেকে শহরে আসে লোকে পয়সা রোজগার করতে। আরে বাপরে। কী পয়সার আমদানি। তবে খবরদার, কাছাটি ঢিলে করেছ তো গেল। ট্যাঁকে যেটি আছে, সেটিও যেতে কতক্ষণ। মায় গায়ের জামাটিও গায়ে থাকবে না।

তবে হ্যাঁ, দু দিন থাকলেই চড়কো হয়ে যাবে। এক কুড়ি নিয়ে চলেছে মদন। একে সে দু কুড়ি, তিন কুড়ি, চার কুড়ি, একেবারে দশ কুড়ি না করে আর ফিরছে না। খালি রোজগারের পন্থাটা একবার দেখে নেওয়া। চাই কি, দুচার বিঘে জমি নিজেই কিনে ফেলবে সে। তার ট্যাঁকের কড়ি সে সহজে খসাচ্ছে না।

কামরার মধ্যে কে একজন আর একজনকে ভাঙা ভাঙা চাপা গলায় বলছে, এই যে তোমার বিষ্টিটে হল, আর দু দিন হলে অবশ্য খুবই ক্ষতি হত, কিন্তুন মুলো বেগুনের দামটা বাজারে খুব চড়ত। মালটা ঠিক মতো রাখতে পারলে বাজারে একেবারে শালা ঘুঁগড়োবান ডাকিয়ে ছাড়ত। জবাবে একজন হুঁ দিয়ে কেশো গলায় হাসল একটু। ও সব মদনও জানে। মাল কম হলে দাম তো চড়বেই। কম মাল দিয়ে বেশি পয়সা পেলে কার না আনন্দ হয়।

গাড়ি বদলে আধঘণ্টার মধ্যেই মদন শহরে এসে পড়ল। শহর দেখে অবাক হওয়ার মতো কিছুই ছিল না। মদন এর আগে এখানে কয়েকবার ঘুরে গেছে। শহর আর কী। খালি কলকারখানা। ঘিঞ্জি বাড়ি আর অজস্র টালি খোলা ছাওয়া বস্তির ভিড়। আর লোকের পেছনে কাটি দেওয়ার জন্যে কতগুলি শহুরে বদমাইশের মেলা। পয়সা লুফে নেওয়ার জন্যে বাড়িয়ে আছে হাত। কোথায় বাড়িয়ে আছে, নজর রাখতে না পারলেই গেল। সদা বোষ্টম শহুরে হলে যা হত আর কী!

অতএব, খুব হুঁশিয়ার। বাপের দেওয়া সুতি-কোটটি একেবারে ছোট হয়ে গেছে। সেটিও মদন টেনে আরও চেপেচুপে নেয়। সন্তর্পণে একবার অনুভব করে ট্যাঁক। তারপর বেরিয়ে আসে স্টেশন থেকে।

এবার কাজ। কাজ কোথায় পাওয়া যায়। কাকে বলা যায়! কারখানার গেটগুলি দেখলেই তো পিলে চমকে ওঠে। তার উপর ভেতরে নাকি সব গোরা সাহেব। কথা বলাই তো দুষ্কর। একটা ভাল বাবু জোগাড় হলেই সবচেয়ে ভাল। কেঁদে ককিয়ে পড়লে একটা হিল্লে হয়েও যেতে পারে। আর হিল্লে একবার হলে–। থামল মদন। ঝুন ঝুন করে কাঁচা পয়সার শব্দ শোনা যাচ্ছে কোথায়! সে উৎকর্ণ হয়ে উঠল। অমনি নজরে পড়ল একটা লোক তার দিকেই তাকিয়ে আছে যেন। হুঁ! সুমুন্দির পো নির্ঘাত পকেটমার। কিন্তু পয়সার শব্দটা কোথা থেকে আসছে! দান-ধ্যান হচ্ছে নাকি কোথাও। শহর তো! হলেই হল।

পয়সার শব্দটা লক্ষ করে যেতে গিয়েও মদন দেখল, সেই লোকটা এখনও যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা তো ভাল নয়। মদন আড়চোখে ভাল করে নজর করে দেখল। ও হো! লোকটা আসলে ট্যারা। তাকিয়ে আছে দূরের একটা ভিখিরি মেয়েমানুষের দিকে।

সামনেই একটা গলির মধ্যে পয়সার ঝনাৎকার শুনে সেখানে ঢুকে পড়ল সে। দিনের বেলাও গলিটা অন্ধকার। একটা সুড়ঙ্গের মতো পশ্চিমে চলে গেছে গলিটা। দু পাশে বেঁকে দুমড়ে এঁকে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে খোলার ঘর। সুদীর্ঘ চালার সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে আলো। খানিকটা রাবিশের ডাঁই। তার ঢালু নীচেই চকচক করছে হেমন্তের গঙ্গার জল।

গলিটাতে ঢুকেই ডানদিকে খানিকটা খোলা জায়গায় অনেকগুলি মানুষ দেখে চমকে দাঁড়াল মদন। খোলা জায়গাটা উঠানের মতো দেখতে, আসলে বেওয়ারিশ। সমস্তটাই সমুদ্রের মতো দিগন্ত বিস্তৃত ঘন বস্তির সমাবেশ। সমুদ্রের উপর আকাশ আছে, এখানে তা নেই। সমুদ্রের তলার মতো শ্বাসরোধী অন্ধকার। আর মানুষগুলি সবই প্রায় মদনের মতো কম বয়সের মানুষ। দু একটা বড় মানুষও আছে আর আছে একটা মেয়ে। ছোট মেয়ে। লক্ষ্মী পিসির বারো-তেরো বছরের মেয়ে বিমলির মতো ডানপিটে মনে হচ্ছে।

তারা সবাই ঝুঁকে পড়েছে গোল হয়ে। সে ব্যূহের ভেতর থেকেই আসছে পয়সার শব্দ আর একটা চাপা মোটা গলা, আপনা তকদির, নসিব কিসমত তুহার বেটা। যেতনা ফেকেগা, উসকো ডবল মিলেগা। যত দেবে ডবল মিলবে। দু পয়সায় চার পয়সা, দু আনায় চার আনা, এক রুপেয়াতে দু-রুপেয়া। জুয়া! সিঁটিয়ে গেল মদন। তবু এক পা এক পা করে এগুল সে। কী রকম! মানে, দিলেই পাওয়া যায় নাকি? তবে তো মা চণ্ডীর নাম নিয়ে…। কিন্তু বড় টিপ টিপ করছে বুকের মধ্যে। কোমরটা শক্ত করে ধরে এগুল সে। চিল-চোখো কটা কটা মেয়েটা চেঁচাচ্ছে, রোখ যা, রোখ যা বেটা। আর উরুত চাপড়াচ্ছে, ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে নাক ঝাড়ছে। কাপড়টা বেঁধেছে গাছকোমর করে, গায়ে একটা ছেড়া হাফ-শার্ট। হাট করে খোলা বুকটা। রাক্ষুসীর মতো চুলগুলি হয়েছে শণনুড়ি।

তার পাশে আরও তিনটে ছেলে, বোধ হয় একই বয়সী। বারো-তেরোর উপরে নয়। চেহারা দেখে বয়স বোঝবার জো নেই। কারও কানে কারও মুখে বিড়ি। খড়ি ওঠা লিকলিকে হাত-পা। গায়ের জামাগুলি আর জামা নেই, এক তরো। পরনে হাফ নয়তো ফুল প্যান্ট, গলায় আবার রুমালের মতো ন্যাকড়া বাঁধা। দাঁড়াবার ভঙ্গিটা দেখে মনে হয় ভারী ওস্তাদ আর বাহাদুর ছোকরা সব। মাথার চুলগুলি কচুরিপানার শুকনো শিকড়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছে কপালে। তারাও চেঁচাচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে, একজন বাদে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, বয়সকে বলে, ওদিকে থাক। তার চেয়ে দেখেছি বেশি, জেনেছি অনেক। খুব গম্ভীর মুখে, চোখ কুঁচকে সে দেখছে মেয়েটাকে।

মদন ভাবল, পাকা বদমাইশ সব কটা। নির্ঘাত পকেট মেরে বেড়ায়। ঠিক সে রকমই দেখতে। দেখে খুব ওস্তাদ মনে হচ্ছে। যেন যমেরও অরুচি।

বাদবাকি ছোঁড়াগুলি মজা দেখছে এদেরই ঘিরে। কয়েকটা বয়স্ক লোকও। অদূরে একটা ঘরের রক থেকে চেঁচাচ্ছে একটা আধবুড়ি মেয়েমানুষ ফের খেলবি তো শোরের বাচ্চা, তোর গলায় পা দেব। কিন্তু কেউ সেদিকে কান দিচ্ছে না। কে একজন খালি বলছে, শালা এবার ঠিক সেপাই এসে পড়বে।

সেপাই! মানে পুলিশ। বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল মদনের। তাকেও যদি ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এক টাকায় দু টাকা। আর যদি সে তার এক কুড়িই রাখে তবে দুকুড়ি উঠে আসবে। চাই কী, সেই দু-কুড়িতে আবার চার কুড়ি। ওরে বাবা, তার মানে একদিনেই দশ কুড়ি নিয়ে গাঁয়ে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। আর নিজেই সে জমি কিনে বসতে পারে।

তাকে লক্ষ করছে কয়েকটা ছেলে। বিশেষ, ওই তিন ছোকরার মধ্যে সবচেয়ে গম্ভীর চালাক ওস্তাদ ছোঁড়াটা।

কিন্তু ইতিমধ্যে জুয়ার গোল প্লেটে ঘড়ির কাঁটার মতো ভাগ্যের কলটা ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এসে দাঁড়াল, সেই ঘরে কেউই কিছু পয়সা রাখেনি। ফলে, পয়সাটা উঠল জুয়াওয়ালার পকেটে।

এক মুহূর্তের একটা হতাশা। পরমুহূর্তেই আর একটা জেদ চেপে বসল। এই জেদের উত্তেজনাটা সকলের মুখেই ফুটে উঠেছে। কেবল সেই ছোঁড়াটা আরও রেগে উঠেছে। কী সব বিড়বিড় করছে। বলছে, ফের? দুনি ফের?

কিন্তু দুনি তার কোমরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে ঠোঁট আর চোখ ফেটে এসেছে জল। বাকি ছেলেদুটোর অবস্থাও তাই। তারা তিনজনেই আবার প্লেটে পয়সা রাখল।

শুধু গম্ভীর চাপা গলায় হেঁকে চলেছে জুয়াওয়ালা, যেতনা ফেকেগা, ডবল মিলেগা, ডবল কে দেবে, দিয়ে দাও, আখেরি চানোস।

কী করবে মদন। দেবে নাকি? শঙ্কিত মুরগির মতো পায়ে পায়ে সকলের মধ্যে চলে এল সে।

আবার কল ঘুরল। সেই ছেলেটা বেরিয়ে গেল দল থেকে। গিয়ে একটা কোণে যেখানে কতগুলি বস্তা, চুপড়ি আর লোহার খুন্তি জড়ো হয়ে আছে সেখানে বসে পড়ল। আর লক্ষ করতে লাগল মদনকে। মদনের চোখ পড়তেই ছোঁড়াটা সদা বোষ্টমের চেয়ে কড়া গলায় খেঁকিয়ে উঠল, ভাগ শালা! প-সা কুট কুট করছে বে পাকিটে। দেবে শালা একেবারে ঢিলে করে!

ধ্বক করে উঠল মদনের বুকের মধ্যে। ড্যাকরাটা টের পেয়েছে ঠিক, তার পকেটে টাকা আছে। নইলে…। কিন্তু ভাগিয়ে দিতে চাইছে কেন? মারবে নাকি? বিশ্বাস কী। সরে পড়া যাক।

তবু সে সাহস দেখাবার জন্যে মুখের একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল। তারপরে হঠাৎ বলে ফেলল, কোথায় পয়সা, আমি তো দেখছি।

ঘর কোথায় তোর?

ঘর! ছেলেটার গলাটা রূঢ় কিন্তু আরও কিছু ছিল। মদনের ঘরছাড়া শোক উথলে উঠল হঠাৎ। তার মুখে চোখে ফুটে উঠল একটা শান্ত অসহায় চাষি ছেলের দুঃখের ছাপ।

আবার একটা চিৎকার উঠল, রোখ, যা, রোখ যা বেটা। ওই ছেলেদুটো বলছে। আর দুনি ঢোঁক গিলছে। কান্না চেপে চোখের জল মুছছে।

সেই ছেলেটা আবার উঠে এল। কিন্তু এবারও ভাগ্যের কল বেজায়গায় দাঁড়াল।

দুনি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তবু আবার কোমরে হাত ঢুকিয়ে দিল। অন্য ছেলেদুটো কাঁদতে পারছে না। কিন্তু লজ্জায়, ভয়ে ও ব্যথায় বোকার মতো তাকিয়ে রয়েছে দুনির দিকে।

দুনি পয়সা বার করতে যাবে এমন সময় সেই ছেলেটা এসে খপ করে তার চুলের মুঠি টেনে ধরল। ধরে টেনে নিয়ে গেল বাইরে।

একটা হট্টগোল চিৎকার উঠল। মেয়েটা চিলের মতো চেঁচাচ্ছে, ছোড়দে, ছোড়দে, শুয়ারকা বাচ্চা জুয়াওয়ালাকে আমি ছাড়ব না। ছোড়, ছোড়। ছেলেটা ওকে টেনে এনে ফেলল একেবারে চুপড়িগুলির উপরে। বলল, ফের? শালা ঘরের পসা নষ্ট করবি? হারামজাদি খাবি কী?

দুনি তবু চিৎকার করে কাঁদছে। বাকি ছেলেদুটো ভীত কুকুরের মতো সেঁটে গেছে এক কোণে। জুয়াওয়ালা প্লেট ঘাড়ে করে সরে পড়ছে তাড়াতাড়ি।

মদন দিশেহারা হয়ে গেছে। কী ব্যাপার। সত্যি পুলিশ এল নাকি?

হা ভগবান! জয় মা কালী। তাহলে কী করবে মদন। মেয়েটাকে মারছে কেন? চুরি করেছে নাকি? নাকি ওই ছোঁড়াটার বোন?

দুনি পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করছে সারাটা জায়গা জুড়ে। আর ছেলেটা একটা কালো হনুমানের মতো দাঁত বের করে চেঁচাচ্ছে, দ্যাখ দ্যাখ বানচোত্ এখন ওর মায়ের ভয়ে এরকম করছে। কে তোকে জেদ করে প-সা খরচা করতে বলেছে অ্যাাঁ? ফের কাঁদবি, মারব লাথি। ওঠ ওঠ বলছি।

বাদবাকি সকলে ততক্ষণে চুপড়ি বস্তা খুন্তি নিয়ে ছুটে চলেছে গলির সুড়ঙ্গটা দিয়ে। দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেদুটো। পুনিয়া আর কালু।

পুনিয়া স্তিমিত গলায় বলল, বাচ্চা, জলদি চল।

জলদি চল! সেই ছেলেটা খেঁকিয়ে উঠল। নাম তার বাচ্চা। বোঝা গেল সে এ দলের শিরোমণি। বলল, তোরাই তো শালা আগে খেলতে লেগেছিস।

কালু আর পুনিয়া চুপ হয়ে গেল। বেশি কিছু বললে বাচ্চা খেপে যাবে। বাচ্চাও খেলে। তবে, আজ ওর পকেট খালি। তা ছাড়া বাচ্চা খেলে খুব কম।

দুনি অর্থাৎ দুনিয়া চিল-চোখে জল নিয়ে তখন হেঁচকি তুলছে। দেখে বাচ্চার শির-ওঠা চিমড়ে-খাওয়া মুখটাতে অবিশ্বাস্যরকম হাসি ফুটে উঠেছে। সে হঠাৎ কোমর দুলিয়ে নেচে নেচে গান ধরে দিল,

এক আনাতে দু-আনা, দু-আনাতে চার আনা,
মারের চোটে কেঁদে কেঁদে আনা আনা করো না।

দুনি আরও জোরে কেঁদে উঠল। হেসে উঠল পুনিয়া আর কালু। তারপর বাচ্চা দুনিয়ার হাত ধরে টেনে তুলে বলল, চ জলদি, এ বেলার মধ্যে পয়সাটা উশুল করবি।

দুনি বলল, মা পিটবে।

 পিটবে তো কী, মরে যাবি? বলে, পিটুনি খেয়ে শালা শক্ত হয়ে গেলি, তোর আবার পিটুনি। চল্ চল্।

তারা চারজনেই বস্তা খুন্তি নিয়ে উঠল। বাচ্চা ফিরে তাকাল মদনের দিকে। মদন তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয় থাকলেও একটা কৌতূহল তাকে আটকে রেখেছে। এরা নিশ্চয়ই কোথাও পয়সা রোজগার করে। হয়তো চুরি করে কোথাও। যদি জানা যায়, যদি কোনওরকমে একটা পন্থা মিলে যায়।

বাচ্চা তার সামনে এসে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল। তাচ্ছিল্য ভরে জিজ্ঞেস করল, গাঁয়ের থেকে এসেছিস, না?

মদন ঘাড় নাড়ল।

বাচ্চা মুখটাকে বিকৃত করে আবার জিগগেস করল, এবার ভিখ মাঙবি শহরে, না?

মদন সন্দেহান্বিত চোখে তাকিয়ে রইল বাচ্চার দিকে। তারপর করুণ হয়ে উঠল তার চোখ দুটো। বলল, তা নইলে খাব কী?

কালু বলে উঠল, এঃ, আবার কোট পরেছে।

মদনের বুকের মধ্যে একটা ভয়ানক কিছুর জন্য ধুকধুক করছে। বাচ্চা তার হাতের বস্তা আর খুন্তিটা মদনের হাতে তুলে দিয়ে বলল, চল্ আমাদের সঙ্গে, চল্।

মদন বলল, কোথা?

দুনি ভেংচে বলল, যমের বাড়ি। যাবি তো চ। বলে তারা সবাই গলি ধরে পশ্চিমে চলল।

লক্ষ্মী-পিসির মেয়ে বিমলির কথা মনে পড়ছে দুনিকে দেখে। তবে দুনি আরও সাংঘাতিক। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবে তাকে। যদি কেউ মারে কিংবা পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। আর গেলে কি রোজগার করা যাবে। রোজগার করতে এসেছে মদন। তারও জমি চাই। খালের ধারে, সোনার মতো মাখনের মতো জমি।

বাচ্চা খেঁকিয়ে উঠল, আয় না। পেটে খাবি তো খাটবি। চলে আয়।

মদন ভয়ে কৌতূহলে আর লোভে খুব সন্তর্পণে এগুল। ট্যাঁকের কড়ি হুঁশিয়ার। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে গেলেও খসাব না। দুঃখের অত্যাচারের শোধ নেব, তবে ছাড়ব।

অন্ধকার গলিটার ভেতর দিয়ে তারা এসে পড়ল গঙ্গার ধারে।

হেমন্তের ভাটাপড়া গঙ্গা টলটল করছে। গান গাইছে ছলছল করে। সকাল বেলার আকাশে ঝকঝক করছে রোদ।

এই গঙ্গায় স্নান করার জন্য মদনের গাঁয়ের মানুষেরা পাগলের মতো ছুটে আসে। ভগবতী গঙ্গা। কিন্তু এখানে কী হবে।

বাচ্চাদের দলটা এগিয়ে চলেছে উত্তর দিকে। মদন তাকিয়ে দেখল, অদুরেই একটা বিরাট কালো পাহাড় উঠে গিয়েছে আকাশের দিকে। আর সেই পাহাড়ের গায়ে অজস্র মেয়েপুরুষ বাচ্চা বুড়োর ভিড়।

কী ব্যাপার। কী আছে ওখানে। মদন জিগগেস করল, কী হয়েছে ওইখেনে?

বাচ্চা বলল, কয়লা কুড়োচ্ছে। আমরাও কুড়োব। বিজলি কারখানার বয়লারের ঘেঁষ ওগুলো, বুঝলি। বেছে বেছে কয়লা তুলবি, আর পাড়ায় পাড়ায় বেচবি।

মদন অবাক হয়ে বলল, কয়লা তুললে কেউ কিছু বলবে না? মানা তুলতে দেবে?

হ্যাঁ, মাগনা।

পয়সা পাওয়া যায়?

তবে কি এমনি? যে যেমন তুলতে পারবে। চার আনা, আট আনা, এক টাকা।

সত্যি! মদনের বুকের মধ্যে উল্লাসের বান ডাকে। যত খুশি তোলা, তত খুশি বেচা! সারাদিন, সারারাত তুলবে মদন। খাটতে ভয় পায় না সে। বলদ পিটে মাঠে লাঙল দিতে পারে, কাঠা কাঠা জমি কোপাতে পারে। আর পয়সার জন্যে কয়লা তুলতে পারবে না!

সত্যি, এদের তুলনায় তার শরীর এখনও শক্ত সুঠামও বটে। যতই দুশ্চিন্তা থাক তার চোখে একটা আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন ঝকঝক করছে। তাহলে তার দশ কুড়ির স্বপ্ন ফলবে। সত্যি, কিন্তু খুব সামলে। কেননা, এদের বিশ্বাস নেই।

ঘেঁষের পাহাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে এদের সঙ্গে। বাচ্চা তার কয়লা তোলা ক্ষতবিক্ষত হাতজোড়া দিয়ে দেখিয়ে দিল কীভাবে কয়লা তুলতে হয়। কোনটা কয়লা, কোনটা ঘেঁষ, কোনটা পাথর আর কোনটা ইট। দুনিয়া নিজে কয়লা তুলে তুলে দিল মদনের বস্তায়।

সবাই হন্যে হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কোলের শিশু পাশে রেখে কয়লা কুড়োচ্ছে মা। কারও কাপড় আধখোলা। কিন্তু সোনার সন্ধানে পাগল হয়ে উঠেছে সব। কয়লা নয়, পোড়া ছাইয়ের মধ্যে ছোট ছোট সোনার ড্যালা যেন।

মদনের হাত অব্যর্থভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কয়লা তুলছে। চিনে ফেলেছে সে। বুঝে ফেলেছে ব্যাপারটা। দুনি-পুনিয়া-কালু বাচ্চা, সবাই হাসছে। রোদের তাত ফুটেছে। তারা ঘেমে উঠছে। মুখগুলি পোড়া ছাই হয়ে উঠেছে। তবু তারা খিলখিল করে হাসছে মদনকে দেখে। বাঃ বাহাদুর মদন। তোল তোল।

বস্তা ভরে উঠতে উঠতে হেমন্তের সূর্য একটু ঢল খেয়ে গেল। এবার বিক্রি। মদনকে নিয়ে তারা চারজন উঠে পড়ল। কীভাবে চেঁচাতে হবে, কী রকম দাম চাইতে হবে আর শেষ পর্যন্ত কী দামে বিক্রি করতে হবে, সব শিখিয়ে দিল মদনকে। খবরদার, কম দামে বেচলে পরের ক্ষতি। তবে হ্যাঁ, একেবারে না বিক্রি হলে তখন দেখা যাবে।

তারপর পাড়ায় ঘোরা। কয়লা! কয়লা চাই! মদনের খদ্দেরই আগে জোটে। তার বোরাটা একটু বেশি ভারী দেখা যাচ্ছে, একটু বেশি মোটা। কত? এক টাকা। ভাগ! আট আনা দিবি? না। দশ আনা? না, এক টাকা। এক টাকা। তারপর বারো আনায় রফা।

বারো আনা। একটা আধুলি আর একটা সিকি চকচক করে উঠল মদনের হাতের চেটোয়। তার মানে এক কুড়ি বারো আনা। এইভাবে সে কুড়ি কুড়ি তুলে ফেলবে। কুড়ি কুড়ি!

সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসছে। তারা আবার এসে বসল গঙ্গার ধারে। কালো হয়ে আসছে গঙ্গার জল।

বাচ্চা বলল, হাঁপিয়ে পড়েছি, চল একটু জিরিয়ে নিই। কিছু খেতে হবে।

জিরিয়ে! মদনের হাত নিশপিশ করছে। কেন, জিরোব কেন? তবে হ্যাঁ, বড় খিদে পেয়েছে। কিন্তু খেলে তো পয়সা খরচ হয়ে যাবে। আর খাবার কিনলে ওরাও যদি চায়।

একটা ফুলুরিওয়ালা হাঁকছে। রাস্তার ফুলুরিওয়ালারা এসেছে। রাস্তার চেয়ে এখানেই এখন বিক্রি বেশি। ফুলুরির পাত্রের সঙ্গে কেরোসিনের জ্বলন্ত ডিবে বসানো। যেন একটা মশাল ঘুরছে।

বাচ্চা হাঁকল, এই ফুলুরি, এই, এদিকে আয়।

নিজের পয়সা দিয়ে চার আনার কিনে ফেলল সে। নির্বিকারভাবে ছাইমাখা হাতে ভাগ করে দিল সবাইকে। সবাই খেতেও লাগল নির্বিকারভাবে। কেবল মদনের অস্বস্তি লাগল। খাবে। খেলে আবার খাওয়াতেও হয়। কিন্তু খাওয়ালে তার চলবে কী করে?

বাচ্চা খেঁকিয়ে উঠল, খা-না। উ, বাবুর আবার সরম হচ্ছে।

কালু বলল, আর না খাস তো দে, দিয়ে দে শালা।

আবার তারা সবাই হেসে উঠল খিলখিল করে। ছোঁড়াটা একেবারে পেঁয়ো ভূত। একেবারে ভালমানুষপনা। গাঁয়ের ছেলে কিনা!

বাচ্চা জিগগেস করল, মদন, কে কে আছে তোর ঘরে?

মদনের ঘরে! সন্ধার গাঢ় ছায়া চেপে এল মদনের চোখে। টন্ করে উঠল বকুটা। বলল, মা আছে।

দুনি বলল, মা! মাকে ছেড়ে চলে এসেছিস?

হ্যাঁ। পালিয়ে এসেছে সে। কিন্তু কেন? তার ফেলে-আসা জীবন, তার মৃত বাবা, তার মায়ের পীড়ন, সদা বোষ্টমের অত্যাচার সব মনে পড়ে গেল একে একে। হঠাৎ চোখ ফেটে জল এল তার। সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেক সয়েছে সে। প্রাণটা তার ছটফট করে উঠল। সে সব-কথা বলে গেল এদের কাছে। কেমন তার মা। কত মার খেয়েছে সে।

হয়তো এই দুর্বিপাক, এই পীড়ন বাচ্চাদের কাছে খুব বড় কিছু নয়। তবু তাদের বুকগুলি টনটন করে উঠল। সন্ধ্যার গাঢ় ছায়া–গঙ্গার তীরে বসে যেন ডুবে গেছে বেদনার অতলে।

বাচ্চা হাত দিয়ে মদনের ঘাড় ধরে তাকে কাছে টেনে নিল। বালিকা দুনিয়া মায়ের মতো ছাইমাখা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিল মদনের চোখ। পুনিয়া বলে উঠল, তোর মা-টা তো বড় খচ্চর।

কালু বলল, মাইরি, ওই সদা বোষ্টম শালাকে রাস্তায় ন্যাংটো করে দিতে হয়।

দুনিও গর্জে উঠল, সত্যি, মাইরি।

গঙ্গার ধারটা নির্জন হয়ে এসেছে। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে বাচ্চার গলাটা গম্ভীর বুড়োটে শোনাল, এ শালার জগতটা বড় অদ্ভুত। নিজের মাও বিগড়ে যায়। মদন, তুই আর ফিরে যাসনি।

দুনির বড় ভাল লেগে গেছে ভালমানুষ গেঁয়ো মদনকে। সে বলল, আমাদের ঘরে তুই থাকবি, আমার মা তোকে কিছু বলবে না। বাচ্চাও আমাদের ঘরে থাকে, আমার মা ওকে খুব পেয়ার করে। ওর কেউ নেই কিনা!

কিছুক্ষণের জন্যে মদন সত্যি তার টাকার কথা ভুলে গেল। এত ভালবাসা, এত বন্ধুত্ব সে আশা করেনি। সে ভাবতে পারেনি একদিনের মধ্যে কেউ কাউকে এতখানি আপন ভাবতে পারে। এত কাছে টানতে পারে।

তার সংশয়ান্বিত সংকীর্ণ মনটা শহরের ছাইগাদার এ রূঢ় পরিবেশেও ভিজে উঠল। সে খুলে দিল তার মনটাকে। বলে ফেলল তার গোপন আকাঙ্ক্ষার কথা, সে কী চায়। সে চায় জমি। তার নিজস্ব জমি। তা নইলে এ জীবনে বেঁচে থেকে তার সুখ নেই।

অদ্ভুত! ছাইগাদার বাচ্চারা অবাক। তারাও বোধ হয় ভাববার চেষ্টা করে নিজস্ব খানিকটা জমির কথা। কিন্তু ভাবাই যায় না। নিজের বলতে যাদের কিছুই নেই, তারা হবে জমির মালিক। তাদেরই সমবয়সী এক ছেলের কাছ থেকে তারা যেন এক কল্পলোকের গান শুনছে। সত্যি, মদন যদি জমি পেয়ে যায়, তবে কী অদ্ভুত ব্যাপার হবে। তারা সকলেই মহাভাবিত হয়ে পড়ল। পাওয়া চাই, কিন্তু টাকা! অত টাকা কোত্থেকে আসবে! মদনকে দেওয়ার মতো তো টাকা তাদের নেই। আচ্ছা, আনকা রোজগার হলে সেটা তারা মদনকে দিয়ে দিতে পারে।

মদনকে ঘিরে তাদের চার বন্ধুর একটা নতুন বাসনা মূর্ত হয়ে উঠল। মদন তাদের আর একজন। তারা পাঁচজন।

মদন সব বলেছে। বলেনি এক কুড়ির কথা। বলতে নেই। তাহলে তো সবই ফাঁস হয়ে গেল। আরে বাপরে, চোর-ছ্যাঁচড়ের জায়গা। মানুষ ঘুমিয়ে থাকলে তার শরীরটাও চুরি হয়ে যেতে পারে এখানে।

এখন কয়লা বাছা। কিন্তু তাকে আরও নতুন পন্থা বেছে নিতে হবে। আরও বেশি রোজগারের ফন্দি আঁটতে হবে।

ছাই-পাহাড়ে আগুন লেগেছে। মশাল জ্বলছে এখানে সেখানে। নেমে এসেছে রাতের অন্ধকার। আকাশে ফুটেছে নক্ষত্রের বাঁকা ঝিলিক।

ছাইগাদার মানুষগুলিকে আর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। যেন কতগুলি ঘাপটি-মারা জন্তু নুয়ে পড়ে কবর খুঁড়ছে। মশালগুলি দেখে মনে হচ্ছে, অন্ধকার জঙ্গলের বুকে নিশাচর ডাকাতেরা আক্রমণের আয়োজন করছে।

একটা মশাল এগিয়ে আসছে গঙ্গার ধারে। একটা আধবয়সী বুড়ি আর কতগুলি কালো কুতকুতে বাচ্চা আসছে এদিকে। বুড়িটা চিৎকার করছে, দুনি, হারামজাদি দু-নি-রে।

দুনির মা ডাকছে। দুনিরা সবাই উঠে গেল। এবার শেষ চুপড়ি ভরতে হবে। আজকের মতো শেষ। হাজার হাজার পায়ের ছাপ ও গর্ত নিয়ে একটা বিশালকায় কালো জন্তুর মতো সারারাত পড়ে থাকবে ছাইগাদাটা। আবার কাল ভোরে শত শত শেয়ালের মুলোর মতো হাত পড়বে!

মদন এদের সঙ্গে ফিরে এল বস্তিতে। ঘর নয়, একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ল সে দুনি আর বাচ্চার সঙ্গে। সেখানে দুনির মা, আরও কতগুলি বাচ্চা। তারা সকলেই কয়লা কুড়োয়। অথচ দুনির বাপ নেই।

দুনির মা রাগ করল না মদনকে দেখে। সন্দেহ করল না একটুও। খালি বলল, খবরদার বাপু, জুয়াওয়ালার খপ্পরে পড়িসনে কখনও।

মদন দেখল, ঘরটার অর্ধেক জুড়ে বাছা কয়লার স্তূপ জমে উঠেছে। প্রায় চালার মাথায় গিয়ে ঠেকেছে। এত কয়লা। কেন এ তো প্রায় দশ কুড়ি টাকার মতো মাল হবে। চকচক করে উঠল মদনের চোখ জোড়া।

বাচ্চা বলল, এগুলি তাদের সঞ্চয়। যখন ছাইগাদায় আর একটিও কয়লা থাকবে না, যখন কন্ট্রাক্টরের লরি ঘেঁষ ফেলতে যাবে আরও দুচার মাইল দূরে ; তখন তারা এ কয়লা বিক্রি করবে। আর পথে পথে কুড়োবে কাগজ, ভাঙা কাঁচ, ফেলে-দেওয়া লোহার টুকরো।

মদনের বুকের মধ্যে কলকল করে আশার জোয়ার। শহরের ধূলিকণাটুকুও ফেলা যায় না। তার ভাবনা কী। তবু যদি একটা কাজ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়। মানে, আরও টাকা পাওয়া যায় কোথাও।

রাত্রে সে খেল এদের সঙ্গে শুকনো রুটি, পেঁয়াজ কুচো আর লঙ্কা দিয়ে। রুটি খাওয়া মদনের ধাতে সয় না। তবু তৃপ্তি করে খেল সে। পয়সা রোজগার করতে হলে কত কী করতে হয়।

তা ছাড়া, এরা তার কাছে এখনও পয়সা চাইল না তো। চাইবে না নাকি। এমনি খাওয়াবে রোজ? কিন্তু পয়সাগুলো সে রাখবে কোথায়? যদি টের পেয়ে যায়, তাহলে তো গেল।

বাতি নিভে গেল। বাতি মানে, একটা লোহার কৌটোর মধ্যে খানিকটা তেল ফেসো। যতক্ষণ জ্বলে, ততক্ষণই লাভ। মদনের পাশ ঘেঁষে শুয়েছে বাচ্চা। দুনি ওর মার কাছ থেকে গড়াতে গড়াতে চলে এসেছে মদনের কাছে। অন্ধকারে মদনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সে। যেন সে মদনের স্নেহাশীলা মা। বাচ্চা তার কানে ফিসফিস করে বলল, মদন, কাঁদিসনে কিন্তু।

না, কাঁদবে না মদন। কিন্তু এই বিদঘুটে ঘরটার মধ্যে শুয়ে তার ঘুম আসছে না। এর চেয়ে তাদের ঢেঁকি ঘরটাও অনেক ভাল। আর ঘুম আসছে না তার টাকার জন্যে। যদি ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে দেয় টাকাটা। হঠাৎ সে বলল, আচ্ছা বাচ্চা, যখন তোরা ঘরে থাকিস্ না, তখন যদি কেউ ঘরের কয়লা চুরি করে নিয়ে যায়?

এক মুহূর্ত নিঃশব্দ। তারপর বাচ্চার কঠিন চাপা গর্জন শোনা গেল, শালার টুটি ছিঁড়ে ফেলব না।

দুনিও ফুঁসে উঠল, সে কুত্তার মাংস কামড়ে খাব।

শুনে মদনের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল।

কিন্তু তার পরদিন থেকে খাবারের পয়সা দিতে হল মদনকে। সে দেখল, বাচ্চা, দুনিয়া, সবাই রোজ সব পয়সা তুলে দেয় মায়ের হাতে। মদন দেয় না। না দিয়েও তার অস্বস্তি হয়। প্রাণ ধরে পয়সা সে কেমন করে দেবে! কাকে বিশ্বাস করবে সে।

কিন্তু এরা তাকে সেজন্যে কিছুই বলে না। পয়সা বেশি রোজগারের জন্যে মদন সারাদিন ছল খোঁজে। কিন্তু পারে না বাচ্চা আর দুনির জন্যে। পারে না পুনিয়া আর কালুর জন্যে। তারা আছে সারাদিন তার সঙ্গে সঙ্গে। কিশোর মদন টাকার ভাবনায় কুটিল হয়ে উঠেছে। তার আকাঙ্ক্ষা পাগল করে তুলেছে তাকে।

সে এদের সঙ্গে কয়লা তুলতে তুলতে হঠাৎ পালিয়ে যায়। আর একটা বোরা নিয়ে চলে যায়—ছাই-পাহাড়ের আর এক পিঠে। সেখানে আলাদা কয়লা তোলে সে। বিক্রি করে দিয়ে আসে ভিন পাড়ায়। বাচ্চারা কেউ জানতে পারে না।

বাচ্চা জিজ্ঞেস করে, কীরে শালা, কোথা ছিলি?

দুনি উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে, নুকিয়ে নুকিয়ে কাঁদছিলি বুঝি?

হ্যাঁ, কান্নাই তো পায় মদনের। এখনও আর এক ঝুড়িও পুরে ওঠেনি তার। সে যত সহজ ভেবেছিল, তত সহজ তো নয়। কিন্তু তার চাই। দিবানিশি তাকে গাঁয়ের হাঠ-মাঠ ডাক দিয়ে ফিরছে। শহরের ধুলোমুঠি থেকে সোনা খুঁজতে এসেছে সে।

কিন্তু এবার পয়সা হচ্ছে তার। লুকনো রোজগারের সবটাই জমছে। অবস্থাই মদনকে চতুর করে তুলছে আরও। সে দিব্যি মিছে কথা বলে দেয়, বসেছিলাম। শরীরটা খারাপ। জানিস, আমি বমি করেছি।

বমি! হ্যাঁ, এক একদিন এক একরকম বলে সে। আর তার এই চার কিশোর-কিশোরী বন্ধু ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়ে।

কিন্তু পুনিয়া সারাদিনই বারে বারে তেতো জলের মতো বমি করে।

সে বলে, আরে, বমি তো আমিও করি।

দুনি অমনি পাকা গিন্নীটির মতো ধমকে ওঠে, তোর তো কতকাল ধরেই হয়। ওর তো নতুন। গাঁয়ের ছেলে, মরে যায় যদি!

বাচ্চা সেটা অনুমোদন করে। সত্যি, মরে যায় যদি। তা ছাড়া মদন তাদের অতিথি বন্ধু।

কিন্তু এদিকে মদনের মাল তোলায় কম পড়ে। পড়লেও সেটা পুষিয়ে দেয় তার চার বন্ধু। পুষিয়ে দেয়, তা ছাড়া নিজেরা আরও বেশি খেটে ভর্তি করে দেয় মদনের বোরা।

আঙুলের কড় গুনে হিসেব করে মদন। তাহলে এখন তার দেড় লাভ। খাওয়ার পয়সাটা ছাড়া সবটাই বাঁচে। আর এক কুড়ি পুরেছে। আর এক কুড়ি পুরতে চলেছে।

মদনকে এখন আর চেনা যায় না গাঁয়ের ছেলে বলে। তবু তার চোখে অবিশ্বাস্যরকম আলোর ঝলকানি। একটুও টসেনি তার শরীর। মনের গোপন ফুর্তি ও আনন্দ একটা দৃঢ় খুঁটির মতো খাড়া করে রেখেছে তাকে।

মাঝে মাঝে ওরা অভ্যাসবশে জুয়া খেলে জিতলে পয়সাটা মদনকে দেয়। হারলে তো কথাই নেই। কিন্তু মদনকে তারা খেলতে দেয় না। সেদিক দিয়ে বাচ্চার নজর কড়া।

কোনও কোনওদিন রাত্রে ওরা বেরিয়ে পড়ে সবাই দল বেঁধে। সারা শহর ঘুমিয়ে পড়লে ওরা দেয়াল থেকে সিনেমার পোস্টারগুলো ছিড়তে আরম্ভ করে। টের পেলে পুলিশ ঠ্যাঙাবে।

কারও কাঁধে উঠে দুনি যখন ফ্যাঁস ফাঁস করে পোস্টার ছেড়ে, মদন তখন দূরের কোনও অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকে। বুকের মধ্যে ভয়ে ধুকপুক করে তার। ওরে বাপরে, যদি পুলিশ এসে পড়ে।

আস্ত পোস্টার ছ-আনা সের। ছেড়াগুলোর দাম কম। এ পয়সাটাও বেশির ভাগ দিন মদন পায়। পুনিয়া আর কালু রুষ্ট হয় মাঝে মাঝে! কিন্তু বাচ্চা আর দুনির জন্যে কিছু বলতে পারে না।

মদনের লোভ দিন-দিন উগ্র হয়ে ওঠে আরও। লোভ তাকে বিশ্বাস ও ভালবাসা ভুলিয়ে দেয়। ক্ষিপ্ত করে তোলে তাকে। কাজ পাওয়ার আশা তাকে ছাড়তে হয়েছে। নতুন কোনও পন্থা না ধরলে আর চলে না। প্রায়ই এদিক ওদিক চুরির কথা শোনা যায়। মদনের চোখ চকচক করে ওঠে, আপশোস হয়। ইস্! যদি সে নিজেই ওরকম করতে পারত। কিন্তু বাচ্চারা কোনও সময়েই সে রকম কিছু করতে চায় না!

গঙ্গার ধারে ঘেঁষ-গাদায় কয়লা ফুরিয়ে আসছে। বসন্তকাল এসে পড়েছে। তার ঘূর্ণি হাওয়ায় শুধু ছাই ওড়ে এখন গঙ্গার ধারে। সবাই কন্ট্রাক্টরের লরির পেছনে ছুটছে। যত দূরই হোক। মদনরাও যায়। কিন্তু মদনের নজর পড়েছে এবার ঘরের সঞ্চিত কয়লার দিকে। এবার এই অনায়াসলভ্য লোভ হাতছানি দিল তাকে।

মনে পড়ে বাচ্চার গর্জন, ফোঁসানি। হ্যাঁ, তারই চোখের সামনে যখন সদা বোষ্টম তাদের গাইয়ের দুধ খেত, তরকারি বিক্রি করে টাকা নিত, তখন তারও ইচ্ছে হত ওর গলাটা টিপে দেয়। তবু নিজেকে সামলাতে পারল না সে।

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রথমদিন সে চুরি করে ফেলল এক বোরা। তারপরে সহজ হয়ে এল। নিষ্ঠুর হয়ে উঠল তার মন। যদি তার টুটি ছিঁড়ে ফেলে, তবুও তার চাই। না হলে যে তার স্বপ্ন ফলবে না। যুগযুগান্ত কার মুখ চেয়ে সে বসে থাকবে। তবে একটু সামলে, সাবধানে।

এ ঘরে খাওয়া কমে গেছে। বিকালে আর কেউই কিছু খায় না। অসহ্য কষ্ট হয় মদনের। সে ফাঁকতালে লুকিয়ে দুচার পয়সার কিছু খেয়ে নেয়। কিন্তু খেতে গিয়ে কেন যেন এক এক সময় গলায় আটকায় তার। খালি বাচ্চার আর দুনির উপোসী শুকনো মুখটা মনে পড়ে যায়। কিন্তু না খেয়ে যে সে পারে না! ওরা না খেয়েও হাসে, ঝগড়া করে। এমনকী, এ অবস্থাতেও দুটো কি চারটে পয়সা জুয়ার প্লেটেও ঢেলে দেয়। বলে, একবার লাক টেস্ হয়ে যাক।

লাক টেস্। ভাগ্য পরীক্ষা। জয় মা কালী! মদনের ভাগ্য ঠিক আছে। শহরের একটা শিব-মন্দিরে গিয়ে মদন সোজা চারটে পয়সা ছুঁড়ে দেয়। দিয়ে একমুহূর্ত ভাবে। আবার দুটো পয়সা দেয়। দেবতার দয়া পেয়েছে সে। বাচ্চা ওরা একবারও ভগবানকে ডাকে না। কেন? সেই জন্যেই ওদের ভাগ্য ফেরে না। কিন্তু মদন গোপনে গোপনে নিয়ত ডাকছে ভগবানকে। ভাবে, শিব-মন্দিরের পয়সাটা দিয়ে ওদের খাইয়ে দেয়। কিন্তু দেবতা বিরূপ হলে! ওরে বাপরে হ্যাঁ, পেতে হলে দানধ্যানও নাকি করতে হয়। শিব-মন্দির থেকে বেরুবার সময় একটা কি দুটো ফুটো পয়সাও দিয়ে দেয় ভিখিরিকে। দিতে হয়।

রাত্রের খাওয়াও কমে গেছে। আধপেট খেয়ে দুনি শুয়ে থাকে মদনের পাশ ঘেঁষে। আর একপাশে বাচ্চা। বাচ্চার নিশ্বাস লাগে গায়ে। ঘুমন্ত দুনি তার ছোট্ট মুঠি দিয়ে ধরে রাখে মদনের হাত। অদ্ভুত দুনি। যেন ধরে না রাখলে মদন চলে যাবে। বিমলির চেয়েও ভাল দুনি। ইচ্ছে করে, দুনিকে সে তার সব কথা বলে দেয়। কিন্তু বাচ্চা! দুনি ঠিক বাচ্চাকে বলে দেবে। বাচ্চাকে তার বড় ভয়। বড় ভয়ংকর মনে হয় এক এক সময়। রাগলে ও কী না করতে পারে। বাচ্চা যেন তার বাপের মতো। অথচ তার চেয়েও রোগা, তার চেয়েও চেহারায় খাটো।

কিন্তু সে তো চলে যাবেই। অনেক সয়েছে সে। পীড়ন ও অপমান, ক্ষুধা ও মার। তার শোধ তুলবে। সে জমি কিনবে। সে চাষার ছেলে। জমি না হলে তার কিছুই নেই।

কত জমেছে তার। কত! গোনে সে, এক কুড়ি, দু-কুড়ি, তিন, না তিন পুরো হয়নি। তবু এতগুলো টাকা। জীবনে দেখেনি সে। বাপের জন্মে হাতে তোলেনি একসঙ্গে এতগুলো। আর এ সব তার নিজের।

কিন্তু আরও চাই। সমস্ত ঘুমন্ত বস্তির মধ্যে সে যেন একটা অশরীরী আত্মার মতো ছটফট করে ওঠে দুনি আর বাচ্চার মাঝখানে। আরও চাই।

ওরা টের পেয়ে গেছে। টের পেয়েছে, কয়লা কমে যাচ্ছে। যেন সেই রূপকথার রাক্ষসীর প্রাণ-ভ্রমরের ডানায় হাত পড়েছে। আঁই মাঁই কাঁই শত্তুরের গন্ধ পাই। কয়লা কেন কম?

কম? মা, ছোট ছোট শিশু, দুনি, বাচ্চা এমনকী পুনিয়া কালুরও চোখ জ্বলে উঠল। কিন্তু কে নেবে? কখন নেবে? নিশ্চয়ই বস্তির কেউ নিয়েছে। লাট্টু পাগলা? রামুর নানী বুড়ি? কে?

কিন্তু মদনের কথা তাদের একবারও মনে আসেনি। ভাবতে পারেনি।

তবু মদন ধরা পড়ে গেল। নিঝুম দুপুর। এ সময় বস্তিতে একটা কাক পক্ষীরও সাড়া পাওয়া যায় না। মদন কয়লা পুরছে বোরার মধ্যে। ঘরের দরজাটা ভেজানো। মদন সোনা তুলছে। শব্দটাও কী অদ্ভুত। ছোট ছোট কয়লার একটা অদ্ভুত ধাতব শব্দ আছে। বাচ্চা ওরা প্রায় দু-মাইল দূরে গেছে কয়লা তুলতে।

দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল। বাচ্চা আর দুনি। দুটো বাচ্চা বাঘ আর বাঘিনী!

একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মদন সেঁটে গেল কয়লার গাদায়। ভয় পেয়েছে, তবু আত্মরক্ষার জন্যে চকচক করে উঠল তার চোখ।

দুনি আর বাচ্চার মুখে কথা নেই। তারা প্রথমটা বুঝতেই পারল না। একেবারে হতভম্ব হয়ে মদনের দিকে তাকিয়ে রইল।

বাচ্চা বলল, তুই?

মদন অসম্ভব জোরে চিৎকার করে উঠল, কী? আমি কী?

এই চিৎকারটা বাচ্চার চোখের সামনে যেন পর্দা খুলে দিল। চোখের নিমেষে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল মদনের উপর। –শালা চোট্টা, জান চুরি করছি? কুত্তা, জমি কিনবি?

মদনের চুলের ঝুঁটি ধরে সে ধপাস করে মাটিতে পড়ল। মদন ককিয়ে উঠল। আশ্চর্য! দুনি দলা দলা থুথু ছিটিয়ে দিতে লাগল মদনের গায়ে মুখে। তার ছাই-ধুলোঘাটা মুঠি দিয়ে দুম দুম করে কষিয়ে দিল ঘুষি, শালা, ঘর চৌপাট করবি?

মদন প্রাণপণে বাচ্চাকে ঠেলে উঠে, কেঁদে চিৎকার করে উঠল। তার চুল ছিঁড়ে গেছে। জামাটাও ফালি ফালি হয়েছে। বাচ্চা চিৎকার করে উঠল, যা শালা, ভাগ ভাগ এখান থেকে।

তখনও মদনের হাতে বোরাটা ধরা ছিল। সেটা ফেলে দিয়ে মার-খাওয়া কুকুরের মতো একবার তাকিয়ে দেখল বাচ্চা আর দুনিকে। বাচ্চা আর দুনি। তার দুপাশে শুয়ে থাকত ওরা। ওদের ঘুমন্ত বুকের ধুক ধুক এখনও তার সর্বাঙ্গে বাজছে। কিন্তু তার স্বপ্ন! চোখের জলে ঝাপসা পথটা কাঁপছে। কোমরে ন্যাকড়ার ফালিতে বাঁধা তার সেই টাকা, যখ দেওয়া টাকা, যেন কোমরে সাপের প্যাঁচ দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বাচ্চার চোখ দুটো কী ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, ও এখন খুন করতে পারে।

সে স্টেশনে গিয়ে উঠল, তার পেছনে পেছনে এল ক্রুদ্ধ ও বিস্মিত বাচ্চা আর দুনি, তারা বিচিত্র কৌতূহলে ও ঘৃণায় মদনকে দেখতে লাগল, যেন একটা কুৎসিত জানোয়ার দেখছে। গাড়ি আসছে, মদন এগিয়ে গেল প্ল্যাটফর্মের দিকে, কিন্তু মারের চেয়েও একটা অসহ্য যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠছে তার বুকটা, তার ছেড়া জামা ঢাকা পিঠে বিঁধছে দু-জোড়া চোখের জ্বলন্ত খোঁচা। বাচ্চা আর দুনি, যাদের সে ঠকিয়েছে। যাদের ঘুমন্ত উপোসী বুকের মাঝে সে ভরা পেটে মটকা মেরে পড়ে থেকেছে।

কিন্তু ওদের যদি সে গাঁয়ে পেত, তবে কত কিছু খাওয়াতে পারত।… কিন্তু তার গ্রাম! তাদের গ্রামের দিকে মুখ ফিরে তাকাল সে দূর রেল লাইনের দিকে, সেখানে তো তার সেই মা, সেই সদা বোষ্টম, সেই সংসার, জোয়াল আর বলদ। আর এই ট্যাঁকের অপুরন্ত তিন কুড়ি, এই নিয়ে তার সেই স্বপ্ন-রাজ্য, তার জমি।

গাড়িটা এল আর তার কিশোর বুক ভেঙে একটা অসহ্য কান্নার বেগ ঠেলে এল হু হু করে। বাচ্চা দুনিদের ঠকানো তার এই কটা টাকা, আর তার সাধ, তার সব কিছু সদা বোষ্টমের বিদ্রূপভরা হাসি ও নিষ্ঠুর মারে যেন ভেঙে পড়ল। তার অনেক বোঝার পরিণতি নিজেকেই বিস্মিত ভীত হাস্যম্পদ করে তুলল, এ অবাস্তবতা ও ব্যর্থতা তার মনের সমস্ত কল্পনাকে আচমকা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলল। এক মুহূর্তে ধ্বসে গেল তার বালির বাসনা সৌধ, তার অপুরন্ত তিন কুড়ি।

তার বাসনা-সৌধ চূর্ণবিচূর্ণ করে গুম গুম করে ছেড়ে গেল গাড়িটা, হাওয়ার ঝাপটায় পতপত করে উড়তে লাগল তার ছেঁড়া জামার ফালি, ঝাঁপিয়ে পড়ল চুলের গোছা, এঞ্জিনের ছেড়ে যাওয়া ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল তার মূর্তিটা আর ছাই-ধুলো মাখা চোখের জলের কালো দাগে ভরে উঠল গালদুটো।

বাচ্চা ছুটে এসে চিৎকার করে উঠল, শালা গেলিনে?

মদন তার লাল করুণ চোখ-দুটো দিয়ে কোনওরকমে একবার ওদের দু জনকে বাঁকিয়ে দেখল, বলল, না।

না? খেঁকিয়ে উঠল বাচ্চা।

মদন কোমর থেকে টেনে খুলে ফেলল থলিটা, ফুলে-ওঠা বাঁকা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ভাঙা গলায় খালি বলল, আমি যাব না।

তারপরে টাকার থলিটা মাটিতে ফেলে দিয়ে ওইখানে ঘাড় গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।

বাচ্চা এক মুহূর্ত চুপ থেকে ফিসফিস্ করে বলল, শালা উল্লুক কাঁহি কা।

আবার একটা গাড়ির ঘণ্টা বেজে উঠল। চৈত্র-দুপুরটা মেতে উঠল হাওয়ায় হাওয়ায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *