অকাল বসন্ত

অকাল বসন্ত

অবশেষে একটা ঠাঁই পাওয়া গেল। বর্ষার শেষ, শরতের শুরু। যাই যাই করে তবু বর্ষা এখনও যেতে পারেনি। তার কালো মুখের ছায়া টুকরো টুকরো মেঘের আকারে ছড়িয়ে আছে আকাশে। পড়ন্ত বেলার সোনালি আলো পড়েছে সেই মেঘের গায়ে। হঠাৎ লজ্জা পাওয়া মেয়ের মুখের মতো লাল ছোপ ধরে গেছে সেই মেঘে। উড়ে চলেছে দিক হতে দিগন্তের এই মফস্বল শহরের কারখানা ইমারত ও অসংখ্য বস্তির ঢেউয়ের উপর দিয়ে।

অনেক অলিগলি পেরিয়ে ভেলো অর্থাৎ ভালরাম আর একটা রুদ্ধশ্বাস কানা গলির মধ্যে ঢুকল। সঙ্গে তার অভয়পদ। প্রৌঢ় ভোলা এখানকার স্থানীয় লোক। কাজ করে একটা সামরিক যানবাহনের কারখানায়। অভয় তার কারখানার কর্মী, ভারী ট্রাকের ড্রাইভার। কিন্তু বিদেশি। ভেলো তাকে একটা ঘরের সন্ধান দিয়েছে তাই সে চলেছে তার নতুন বাসায়। সামগ্রী বলতে হাতে তার একটা টিনের সুটকেশ ও ছোট বিছানার বাণ্ডিল। গলিটাতে দিনের বেলাও অন্ধকার। দু পাশে ঘন টালি ও খোলার চালা গলির মাথায় আর একটা দীর্ঘ চালার সৃষ্টি করেছে। আকাশ দেখা যায় না, এক ফালি রুপোলি পাতের ঝিলিকের মতো মাঝে মাঝে দেখা দেয়। গলি পথটাকে পথ বলার চেয়ে নর্দমা বলাই ভাল। দু পাশের বস্তির যত ক্লেদ এসে জমেছে সেখানে। নর্দমা থাকলে ময়লা বেরুবার একটা পথ থাকত। কিন্তু তা নেই। সারা গলিটার মধ্যে একটা টিউবওয়েল। সেখানে মেয়ে পুরুষ ও শিশুর ভিড় ও পাতি হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁকানির মতো পাম্পের শব্দ শোনা যায়। সেই সঙ্গেই ঝগড়ার চিৎকার ও হট্টগোল। গলিটার ঢোকবার মুখে একটা বাতি আছে, ইলেকট্রিক বাতি। সেটা এখনও জ্বলছে। সব সময়েই জ্বলে। গলিটা যে স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির আন্ডারে, ওই বাতিটাই তার প্রমাণ।

ভেলোর সঙ্গে অভয়কে দেখে গলির লোকগুলি সবাই একবার করে দেখে নিচ্ছে। ভাবখানা যেন কোনও আপদ এসে জুটেছে পাড়ায়।

অভয়ের গায়ে সবজেটে জাপানি খাকির জামা ও ঢলঢলে লম্বা প্যান্ট। মাথায় একটা চাষাদের টোকার মতো দীর্ঘবেড় টুপি। পায়ে ভারী বুট। চেহারাটা তার সাধারণ বাঙালির তুলনায় অনেক লম্বা। মাথাটা চালার গায়ে ঠেকে যাওয়ার ভয়ে ঘাড় গুঁজে চলেছে সে। যেন কোনও দলছাড়া সৈনিক চলেছে ট্রেঞ্চের ভেতর দিয়ে। কিন্তু মুখে তার এখনও কোমলতার আভাস। চোখে এখনও স্বাস্থ্যের ঔজ্জ্বল্য। ঠোঁটের কোণে একটা হাসির ঢেউ তাকে খানিকটা সহজবোধ্য করে তুলেছে, নয়তো দুর্বোধ্য।

সে আর না ডেকে পারল না, ভেলো খুড়ো।

 ভেলেকে ওই নামেই সবাই ডাকে কারখানায়। বলল, ভাবছ কেন। তুমি বামুনের ছেলে, ভালরাম কি তোমাকে মিছে কথা বলবে। পাকা দাড়ি, যাকে বলে ইটের গাঁথনি, খুঁটে খুঁটে দেখে নিয়ো, বুঝেছ?

বুঝেছি, কিন্তু এই বস্তির ভিড়ে পাকা বাড়ির কোনও ইশারাও যে চোখে পড়ে না। ভেলো গোঁফের ফাঁকে হেসে আবার বলল, কিন্তু যা বলছিলুম, একটু সাবধানে থেকো, বুঝলে দাদা। মানে, আইবুড়ো ছেলে তুমি। আলোর আর কী বলো, মরে তো শালার বাদলা পোকাগুলান।

তার মানে, আমিও মরব? অভয়ের গলায় যেন বিরক্তির ঝাঁজ।

ভেলো বলল, ওই, চটলে তো? ওটা একটা কথার কথা। সেখেনে কি আর পেতনি আছে যে ঘাড় মটকাবে। মানুষ খুব ভাল, জানলে। তবে মানুষের প্রাণ..

মানুষের প্রাণ! ভেলোর কথার রেশ টেনে বলল অভয়, খুড়ো, একদিন মানুষ ছিলাম। এখন ও সব বালাই নেই। বলতে বলতেই দাঁড়াল দু জনে। সামনেই একটা চালাঘর যেন ঠেলে এসে পথ রুখে দাঁড়িয়েছে। তার পাশ দিয়ে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে অবিশ্বাস্য রকম একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ল তারা। সামনেই একটা মুচকুন্দ গাছ। বড় বড় শালপাতার মতো অজস্র কালচে কালচে সবুজ পাতা আর ছাগলবাটি লতার বেষ্টনীতে ঝুপসি ঝড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। তলা ঘেঁষে পাকার হয়ে আছে আধলা ইটের রাশি। তার আড়ালে একটা ভাঙা বাড়ির ইশারা জেগে রয়েছে। তারও পেছনে যেন ঘন অরণ্যের বিস্তৃতি, মাঠ ও রেল লাইনের উঁচু জমি।

ভেলো বলল, ওই যে তোমার বাড়ি।

বাড়ি। বাড়ি কোথায়? বস্তির গায়েই এই হঠাৎ অবাধ উন্মুক্ত জায়গাটা নির্বাক বিষণ্ণতায় গা এলিয়ে পড়ে আছে। লোকজন দেখা যায় না একটাও। এ নির্জন নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রতিমুহূর্তে যেন একটা নিরাকার অস্থিরতা অদৃশ্যে ছটফট করে মরছে। এর মধ্যে বাড়ি কোথায়।

ভেলো বলল, এসো।

বলে সে মুচকুন্দ গাছটার তলা দিয়ে একটা পুকুরের ধার ঘেঁষে এগুল। পুকুরটায় কচুরিপানার ঘন বিস্তার। পুষ্ট লকলকে ডগাগুলি মাথা উঁচিয়ে রয়েছে কালকেউটের ফণার মতো। তার মধ্যে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে ভাঙা ইট বসিয়ে ঘাট করা হয়েছে। ঘাটের কোলে কালো জল, গভীর ও নিস্তরঙ্গ।

পুকুরটার দক্ষিণ পাড়েই আবার থমকে দাঁড়াতে হয়। একটা ভাঙা বাড়ি। পোড়ো বাড়ির মতো। বাড়িটাতে ঢোকবার দরজা নেই, একটা ছিটে বেড়ার আড়াল রয়েছে। দেয়ালের ইট চোখে পড়ে না। সর্বত্রই গোবর চাপটির দাগ। বোঝা যায়, এক সময়ে দোতলা ছিল, এখন ভেঙে গিয়েছে। বট অশ্বত্থের চারা আর বনকমলির লতা নীচে থেকে উপরে অবাধে জড়িয়ে ধরেছে সর্বাঙ্গ। সামনের ঘরটার জানলায় গরাদ নেই। পোকা খাওয়া পাল্লা দুটো আছে। ফাটল ধরা ভাঙা বারান্দায় ছড়িয়ে রয়েছে ছাগলনাদি। বারান্দার নীচেই কৃষ্ণকলি গাছের ঝাড়, ফাঁকে ফাঁকে কালকাসুন্দের বন। বন সেজেছে। অন্ধকার রাত্রের আকাশে খই ফোটা নক্ষত্রের মতো ফুটেছে কালকাসুন্দের ফুল, হলদে আর লাল কৃষ্ণকলি।

ভেলো বলল, কী গো, পছন্দ হয় কি না হয়? ফুল বাগান, পুকুর…

অভয় বাধা দিয়ে বলে উঠল, পাকা বাড়ি। খুঁটে আর দেখব কী, এ তো খাসা ইটের বাড়ি। তবে পোষাবে না ভেলো খুড়ো, চলো কেটে পড়ি। ও আমার ঘিঞ্জি বস্তিই ভাল, সাপের কামড়ে প্রাণ দিতে পারব না।

ভেলো হা হা করে হেসে উঠল। বলল, সাপ কোথায়, এখেনে মানুষ বাস করে। কলকারখানার বাজারে একটু হাঁফ ছাড়তে পারবে। আর…

কথা শেষ হওয়ার আগেই ছিটে বেড়ার আড়াল থেকে একটি মুখ বেরিয়ে এল। একটি মেয়ের মুখ। রংটা মাজা মাজা, হঠাৎ ফরসা বলে মনে হয়। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের কম নয়, কিন্তু সিঁদুর নেই কপালে। আঁট করে বাঁধা চুল। মুখে হাসি। কিন্তু সামনে মানুষ দেখে হাসিটা মিলিয়ে বিস্মিত জিজ্ঞাসায় বেঁকে উঠল ভ্রূলতা। অভয়পদের টুপি পরা বিদঘুঁটে চেহারার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলছ ভেলো খুড়ো?

বোঝা গেল, ভেলো এ সারা অঞ্চলের সকলেরই খুড়ো। বলল, কে বিনি ভাইঝি! বলছি, তোর মাকে একবারটি ডেকে দে, সেই লোকটি এসেছে ঘরের জন্যে।

বিনি একবার আড়চোখে অভয়কে দেখে ভেতরে ঢুকে গেল।

অভয় বলে উঠল, খুড়ো এ যে একেবারে বিয়ের যুগ্যি।

 ভেলো বলল, বে-র কেন, হলে অ্যাদ্দিনে ককণ্ডা হত, তাই বলো।

তা হলে বোঝো, এর উপরে একজন, নীচে আর একজন। তা বে কে দেবে বলল। বাপ থাকতেই খেতে জোটেনি, এখন তো বেধবা মা। আর জাতেও যদি শালা বামুন কায়েত হত একটা কথা ছিল, জাত যে তোমার ভেলো খুড়োর, মানে সৎচাষা। আর মা ষষ্টি দিলে দিলে, তিনটেই মেয়ে দিলে। একে বলে কপাল।

অভয়পদের নিজেরই বুকে যেন উৎকণ্ঠার কাঁটা ফুটল। বোধ হয় তার নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ছে, নিজের অবিবাহিতা বোনটির কথা। কিন্তু সে হতাশ গলায় বলল, কিন্তু খুড়ো, এখেনে তো আমি থাকতে পারব না।

ভেলো অবাক হয়ে বলল, ওই নাও, তোমার তাতে কী? দেখে শুনে একটা বামুনের ছেলে নিয়ে এলুম বলে, যাকে তাকে তো আর এনে তুলতে পারিনে। আর মেয়েমানুষগুলো একলা থাকে, একটা সাহসও তো পাবে। তারপরে তুমি তোমার ওরা ওদের।

অভয়ের আবার আপত্তি ওঠার আগেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল বাড়ির মালিক, বিধবা বুড়ি। দু-হাতে গোবর মাখা। গায়ে কোনওরকম কাপড়টা জড়িয়ে দেওয়া। এল হাঁ করে দাঁতশূন্য মাড়ি বের করে। মুখে অজস্র রেখা পড়েছে যেন জট পাকানো সুতোর দলার মতো। গলার চামড়া গলকম্বলের মতো ঝুলে পড়েছে। কাঁপছে থরথর করে। বেঁকে পড়েছে খানিক শরীরটা।

চোখে বোধ হয় ভাল ঠাওর পায় না। কয়েক মুহূর্তে অভয়কে দেখে বলল, ভেলো, লোকটা বাঙালি তো।

ভেলো হেসে ফেলল, তবে কি পাঞ্জাবি। তোমাকে তো বলেছিলুম সব।

বুড়ি আর দ্বিরুক্তি না করে অমনি আবার ফিরল, না তা বলছিনে। চেহারাটা যেন কেমন ঠেকল। চোখের মাথা তো খেয়েছি। তা এসো, থাকো। ঘর আমার বেশ বড়সড়। একটু পুরনো, তা.. হঠাৎ চোপসানো ঠোঁট কেঁপে উঠে গলাটা বন্ধ হয়ে এল বুড়ির। চোখের কোলে জল এসে পড়ল। বলল, ফিসফিস করে, আমি যে জম্মো পাপিষ্ঠা। আমার গলায় বুকে শুধু কাঁটা। সে মানুষটা যদ্দিন ছিল ভাড়া দিইনি, এখন কেউ নিতেও চায় না। তা থাকো।

চোখ মুছে ডাকল, অ নিমি ঘরটা খুলে দে।

অভয় তাকাল ভেলোর দিকে। ভেলো ঠোঁট উলটে চাপা গলায় বলল, উঠে পড়ো। দুনিয়ার সব জায়গাই সমান, থাকা নিয়ে কথা। বলে বুড়ির পেছন পেছন অভয়কে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল সে। বাড়ি মানে, বেড়াটার আড়ালে একটা গলি। গলির দু-পাশে দুটি ঘর। ভেতরে দেখা যায় একটা উঠোন। উঠোনের উত্তরে একটা পাঁচিলের ভগ্নাবশেষ। ওপারে সেই মুকুন্দ গাছ ও ইটের স্তূপ। নজরে পড়ে বস্তির খোলার চালা আর মোড়ের সেই লাইট পোস্টটা। বাতিটা জ্বলছে তেমনি।

অভয়ের ভারী বুটের শব্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠল গলিটার মধ্যে।

 নিমি এসে বাঁদিকের ঘরের দরজাটা খুলে দিল। নিমি বিনিরও বড়। সে বোধকরি বিনির চেয়ে ফরসা। কেননা, অন্ধকার গলিটাতে তার মুখটা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। তারও চুল আঁট করে বাঁধা। দোহারা গড়ন। চোখে তার শান্ত বিষণ্ণতা। বয়স প্রায় তিরিশের কাছাকাছি।

দরজাটা খুলে দিয়ে সে সরে দাঁড়াল। তার পেছনেই দাঁড়িয়েছে টুনি, সকলের ছোট। বিনির মতোই একহারা ছিপছিপে গড়ন তার। চোখের কালো তারায় খর চাউনি, বিস্ময়ের ঝিকিমিকি। অভয়ের চেহারা দেখেই বোধ হয় তার ঠোঁটের হাসিটুকু ব্যঙ্গ হয়ে উঠেছে। তার চুল খোলা। হয়তো বেঁধে ওঠার অবসর হয়নি।

ভেলোর পেছনে ঘরে ঢুকে সুটকেশ ও বিছানা নামিয়ে অভয় একবার ভাল করে ঘরটার চারদিক দেখে নিল। মেঝেটার অবস্থা মুখে বসন্তের দাগের মতো। সিমেন্ট উঠে গিয়েছে এখানে সেখানে। দেয়ালের অবস্থাও তাই। পলেস্তারার প নেই, সর্বত্রই নোনা ইট বেরিয়ে পড়েছে। তবে ঘরটার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে সেটা বোঝা যায়। ঘরটার কোলেই সেই বারান্দা, কৃষ্ণকলি ও কালকাসুন্দরের ঝাড়, তারপরে পুকুর।

ভেলো বলল, নাও, ঘর দোর সাজিয়ে বসো, এবার আমি চললুম। ভাড়ার কথা বলাই আছে।

বলে ভেলো লোম ওঠা ভ্রূ-সংকেতে ইশারা করল, সব ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, চললুম গো বউঠান, এবার তোমরা বুঝে পড়ে নিয়ে।

বলে সে চলে গেল। একে একে সবাই অদৃশ্য হয়ে গেল, নিমি, বিনি, টুনি। বুড়ি বলল, ওই পুকুরে নাইবে ; খাবে তো তুমি হোটেলে। না যদি খাও, বাড়িতে আলগা উনুন নিয়ে এসো, বেঁধে বেড়ে খেয়ো। আর..।

কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা মেয়েলি গলার উচ্ছ্বসিত খিলখিল হাসি যেন তীরের মতো এসে বিঁধল এ ঘরের দুটো মানুষের বুকে। একজনের জিভ আড়ষ্ট, চোখে শঙ্কা, কুঞ্চিত লোল চামড়া আবৃত জড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর একজনের ঠিক ভয় নয়, তবু যেন ভয়। আর একটা নাম-না-জানা তীব্র অনুভূতিতে নিশ্বাস আটকে রইল বুকের মধ্যে।

তারপর হাসিটা নিশ্বাসের দমকে দমকে হারিয়ে গেল, মিলিয়ে গেল, নিঃশব্দ জলের বুকে বুদবুদের শব্দের মতো। ঈষৎ হাওয়ায় শিউরে উঠল কৃষ্ণকলির ঝাড়।

লাল মেঘের বুকে পড়েছে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া। এ নৈঃশব্দ্যের ফাঁকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অন্ধ গলিটার হট্টগোল।

বুড়ি হঠাৎ অভয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে, বুকের দু-পাশ ও গলাটা দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই বুকে আর গলায় করে আগলে রেখেছি। কোথাও ফেলতে পারিনে, রাখতেও পারিনে। বিষ নয়, মধুও নয়। ভাবি, যেদিন আমি থাকব না।

বলেই সে যেন আগুনের হলকার জালায় দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল। ঝোল-ঝাব্বা পরা অভয় একটা অতিকায় ভূতের মতো নির্জন ঘরটার অন্ধকার কোলে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবল, এ কোন হতভাগা জায়গায় এনে তুলল আমাকে ভেলো খুড়ো। যে নিশ্বাসটা আটকে ছিল বুকের মধ্যে সেটা আর বেরিয়ে আসবার পথ পেল না। বুকের মধ্যেই ছটফট করে মরতে লাগল।

বোধ করি, সেই নিশ্বাসটা ফেলবার জন্যেই অভয় সেই ভোর বেলা বেরিয়ে যায়, ফেরে সেই রাত্রে। আসবার সময় রোজই শুনতে পায় পাশের ঘরটায় খস খস কাগজের শব্দ। যে মুহূর্তে গলিটাতে তার বুটের শব্দ হয়, তখন থেকে কয়েক মুহূর্ত শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় সেই সঙ্গে বেলোয়ারি চুড়ির রিনিঠিনি। একটু বা ফিসফিস, কিংবা চাপা হাসির সঙ্গে কোনও গলার একটা মৃদু শব্দ।

অভয় শুনেছে ভেলোখুড়োর মুখে, ওরা তিন বোন কাগজের ঠোঙা আর পিসবোর্ডের বাক্স তৈরি করে। ওটাই ওদের প্রধান উপজীবিকা।

কিন্তু অভয়ের শরীরটা তখন অসহ্য ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে। সারাদিনে ভারী ট্রাকের হুইলের কাঁপুনি আর বিরাট হাতির মতো বডিটার ঝাঁকুনি গায়ের মাংসপেশিতে ছুঁচ ফোটার মতো ব্যথা ধরিয়ে দেয়। চোখ দুটো জ্বালা করে। নাকের মধ্যে ভারী শ্লেষ্মার মতো ধুলো জাম হয়ে থাকে।

কোনও রকমে লম্ফটা জ্বালিয়ে বিছানা পেতে বিড়ি ধরিয়ে লম্ফ নিভিয়ে শুয়ে পড়া। খাওয়া হয়ে যায় সন্ধ্যার একটু পরেই। তারও অনেক পরে শোনা যায় হয়তো নিমি ডাকছে বিনিকে কিংবা বিনি টুনিকে। ওদের খাওয়ার সময় হল। খাওয়ার পর গলিটার বুকে ওদের পায়ের টিপটিপ শব্দ শোনা যায়, ভীত চকিত মানুষের বুকের দুরু দুরু যেন। আবার সেই চুড়ির রিনিঠিনি। রাত্রির নৈঃশব্দ্যে আবার সেই চাপা চাপা গলার আভাস। পুকুর ঘাটে শোনা যায় বাসন ধোয়ার আওয়াজ।

তিন বোনের গলা আলাদা করতে পারে না অভয়। শুধু শোনে, কেউ বলে, উঃ পায়ে কী ব্যথা হয়েছে রে। কেউ বলে, তাড়াতাড়ি কর, বড্ড ঘুম পেয়েছে। কেউ বা, সেই মুখপোড়া সাউটা সাত সকালেই মাল নিতে আসবে, বাক্সের গায়ে তো এখনও লেবেল আঁটা হল না।

অন্ধকারে যতই ঝিম মেরে পড়ে থাকুক, অভয়ের কান দুটো যেন হাঁ করে থাকে। তারপর হঠাৎ কী কারণে তীব্র মিষ্টি গলার খিলখিল হাসিতে শিউরে ওঠে রাত্রি। যেন একটা অসহ্য গুমোট। অস্থিরতার মধ্যে হাসিটা মুক্তির সন্ধান খোঁজে। কিন্তু হাসিটা শেষ হয়ে আবার সেই অস্থিরতাই দলা পাকিয়ে ওঠে।

অভয় অশরীরী সাক্ষীর মতো উত্তরের খোলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। দেখা যায় মুচকুন্দ গাছে ঝুপসি আর মোড়ের সেই বাতিটা। তার এক চোখের নিষ্পলক দৃষ্টিটা যেন বিদ্রূপ করে বলতে থাকে অভয়কে, আমি জেগে আছি বহুদিন, এবার তুইও জাগছিস।

পুকুর থেকে ফেরার পথে ওদের হাতের আলোটা কী করে উঁচু হয়ে ওঠে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ে অভয়ের ঘরে, তার গায়ে। সে ছেলেমানুষের মতো মটকা মেরে পড়ে অনুভব করে তিন জোড়া চোখের দৃষ্টি ফুটছে তার গায়ের মধ্যে।

তারপর আবার নিঃশব্দ ও অন্ধকার। শুধু দৃরের কারখানার বয়লারের ধিকিয়ে চলার একটা ঘুস ঘুস শব্দ।

সেদিন রাত্রে ফিরতে গিয়ে কৃষ্ণকলির বনে থমকে দাঁড়াল অভয়। কে যেন কাঁদছে। এখনও বস্তিতে হট্টগোল, টিউবওয়েলের প্যাঁকপ্যাঁকানি। তার মধ্যে এখানকার নিরালায় কান্নার শব্দ।

অভয় কান পাতল। ভুল হয়েছে। কান্না নয়, গান গাইছে। দুটি গলার মিলিত সরু গলার গান। গাইছে দুই বোন।

বনের আগুন সবাই দেখে,
মনের আগুন কেউ না দেখে,
সে পোড়াতে হয়েছি অঙ্গার।

সে গানের টানা সুরের লহরীতে রাত্রি দুলছে না, আড়ষ্ট ব্যথায় থমকে দাঁড়িয়েছে। শরতের আকাশে আধখানা চাঁদ, অসংখ্য অপলক চোখের মতো তারা। নীচেও তারার মতোই রাত্রির নিরালায় ঘোমটা খোলা কৃষ্ণকলি।

কিন্তু হাসি নেই, সুপ্তির আরাম নেই। চাপা আগুনের পোড়ানিতে যেন এ বিশ্বসংসার দিশেহারা, তবুও নির্বাক নিরেট।

ধিকিধিকি আগুন জ্বলে যেন অভয়ের বুকেও। ভাবে, পেছুবে। কিন্তু পেছিয়েও সামনেই এগোয়। গানটা থেমে গেছে। তবুও আবার থামতে হয়। শোনা যায়, একজন বলছে, না এখনও আসেনি।

আর একজন, কে সেই মিলিটারি তো?

 মিলিটারি নয়রে, ভোলা খুড়ো বলছিল, মোটরের মিস্তিরি।

অভয় নিজের অজান্তেই আরও উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। শোনে, মাইরি, লোকটা যেন কী। আমাদের বোধ হয় ভয় পায়।

আর একজনের তীব্র বিদ্রুপাত্মক গলা শোনা যায়, ভয় নয়, ঘেন্না করে। ভাবে, ধুমসি পেতনিগুলো কোনদিন দেবে ঘাড় মটকে।

তারপর একটা হাসির উচ্ছ্বাস উঠতে গিয়েও মাঝ পথেই ট্রাকের অ্যাকসিলেটর চাপার মতো সেটা থেমে যায়। শব্দ ওঠে কাগজের খসখস।

অভয়ের গায়ে যেন আগুন লাগে। নিজেকে কিছু জিজ্ঞেস করেও জবাব না পাওয়ায় বোকার মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর খট খট শব্দ তুলে ঝনাৎ করে শিকল খুলে ঘরে ঢোকে।

কিন্তু পরদিন শরৎ আকাশের রংবাহারি পড়ন্ত-বেলায় অবিশ্বাস্য রকমে অভয়ের বুটের শব্দ শোনা যায় গলিতে। শব্দটা অভয়ের নিজের কানেই অদ্ভুত ঠেকে। মনে হয়, কী একটা মহাপাপ করে ফেলেছে সে।

ওদিকে তিন বোনের কী একটা গুলতানি চলছিল। ওরাও একেবারে চুপ হয়ে গেল।

 ওদের বুড়ি মাও আশেপাশেই আছে কোথাও। বুড়ি সারাদিন ওই মুচকুন্দ গাছের মোটা গোড়া থেকে শুরু করে এখানে সেখানে ঘুঁটে দিয়ে ও গোবর কুড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু লক্ষ করলেই চোখে পড়ে, না বিষ না মধু সেই অমূল্য বস্তুগুলির প্রতি তার নিয়ত সতর্ক দৃষ্টির প্রহরা ঘুরছে।

অভয় এই মুহূর্তের সংকোচ ও আড়ষ্টতাকে কাটিয়ে তোলার জন্যেই যেন দুপদাপ শব্দে ঢোকে, খাকি ঝাল-ঝোব্বা খোলে। গামছা কাঁধে নিয়ে হুস হুস করে পুকুরে ডুব দিয়ে ঘরে এসে বসে। অনেকদিন পরে বিকালের দিকে শরীরটা ক্লেদমুক্ত হয়ে একটু আরাম পায়। কিন্তু মনের মধ্যে থাকে একটা বিষের খচখচানি।

একটু পরেই কৃষ্ণকলির বনে তিন বোনের মূর্তি ভেসে ওঠে। খালি গায়ের উপর কাপড় জড়ানো। তিনজনই সদ্য বাঁধা মস্ত খোঁপায় দিয়েছে চন্দনের বিচির মতো লাল মটর দেওয়া শস্তা কাঁটা। সেগুলি যেন কুণ্ডলীপাকানো কালসাপিনীর চোখের মতো জ্বল জ্বল করে। আর আশ্চর্য। এতখানি বয়সেও ঘোচেনি কারও লালিত্য। যৌবনের জোয়ারে ধরেনি ভাঁটার টান। জোয়ার যেন বাধা পেয়ে উদ্দাম হয়ে উঠেছে। বঙ্কিম ঢেউ উদ্ভাসিত সুউচ্চ রেখায়।

তবু যেন মনে হয় একটা ক্লান্তিকর বিষণ্ণতা ঘিরে রয়েছে তাদের। নিমি যেন এক ছেলে মরা মা, বিনি মন-গোমরানো বউ, টুনি প্রেমিকা কিশোরী।

তিন বোন যেন তিন সই। মিটি মিটি হাসে, আড়ে আড়ে চায়। তবু চাইতে পারে না। তিনজনে গায়ে গায়ে গিয়ে নামে পুকুরের জলে। ঢেউয়ে দোলে কুচরিপানা ফণা তোলা কালনাগিনীর মতো।

অভয় চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারে না। জানলা থেকে সরে আসব আসব করেও সময় বয়ে যায়। না দেখতে চেয়েও দেখে ছপছপ শব্দে গা ধুয়ে ফিরে চলেছে তিনজনা। না হাসি না হাসি করেও ফিক করে হেসে উঠে মোহাচ্ছন্ন করে রেখে যায় সমস্ত জায়গাটা।

তারপর হঠাৎ দীর্ঘশ্বাসে চমকে ওঠে অভয়। পেছনে দেখে বুড়িমা। ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণের আকাশের দিকে। থরথর করে কাঁপছে অতিকায় গিরগিটির মতো গলার চামড়া। অভয় ফিরে তাকাতে ফিসফিস করে বলে, বুকের মধ্যে ধুকধুক করে, গলায় ধড়ফড় করে। কোথা রাখি, যাই কোথা। খালি তরাসে তরাসে মরি। বলেই বুড়ি বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে যায়। অভয়ের মনে হয় সে পাথর হয়ে গিয়েছে। বুকের মধ্যে এক বিচিত্র অনভূতি নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বস্তির গণ্ডগোল হাসি ও হল্লা। ঢোলক অথবা খঞ্জনির বাজনা।

এমনি চলে কয়েকদিন। রোজই অভয় ফিরে আসে বিকালের ছুটির পর। আসব না করেও আসে।

কয়েকদিন পর, বিকেলে পুকুরে ডুব দিয়ে ঘরে ঢুকে অভয় থমকে দাঁড়াল। চোখের সামনে যেন এক অবিশ্বাস্য বস্তু দেখে চমকে উঠল। দেখল অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে খয়েরি রং-এর ধূমায়িত চা। চা? চা-ই তো, হ্যাঁ। মনে হল গেলাসটা সাগ্রহ চুমুকের প্রত্যাশায় ব্যাকুল সংশয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকিয়ে আছে জোড়া জোড়া চোখে।

অভয় একবার ভাবল, পেছন ফিরে দেখে। কিন্তু দেখে না। যেন কিছুই হয়নি, এমনিভাবে ধীরে সুস্থে চায়ের গেলাসটি নিয়ে চুমুক দেয়। ঢোঁকে ঢোঁকে উষ্ণতাতে বুকের মধ্যে একটা দরজা খুলে যায়। মনটা ভোর হয়ে আসে।

তারপর শুন্য গেলাসটা রাখতে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়। গেলাস নিয়ে গলিটা পেরিয়ে একেবারে ভেতরের উঠোনে এসে পড়ে। শুন্য উঠোন। কেউ নেই। ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল তিন বোন মাথা নিচু করে কাজে ভারী ব্যস্ত।

অভয় বারান্দায় উঠে এসে দাঁড়াল। কিছু বলবে মনে করেও কথা আসে না মুখে। কয়েক মুহূর্ত এমনি চুপচাপ।

হঠাৎ টুনিই বলে, তুই দিয়ে এসেছিলি বুঝি।

 নিমি বলে, আমি কেন, বিনি তো।

বিনি বলে, ওমা, কী মিথ্যুক। আমি কেন বামুনের ছেলেকে চা দিতে যাব।

অভয় দেখে কালো চোখের চোরা চাউনিতে হাসির চকমকানি। হাসিটা তারও মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বলে, না হয় গেলাসটা হেঁটে হেঁটেই গেল, তাতে বামুনের জাত যাবে না। বামুন আর কোথায়, একেবারে জাত ড্রাইভার। সারাদিনের খাটুনির পর বিকেলে এ রকম, মানে একটু চা পেলে…, আচ্ছা আমি না হয় চা চিনিটা…। বলে সে হেসে ফেলে।

ততক্ষণে তারা তিন বোন উচ্চ হাসিতে ঢলে পড়ে এ ওর গায়ে। টুনি বলে, বিনি, তুই না হয় চা-টা দিস।

বিনি বলে, নিমি, তুই তাহলে দুধটা দিস?

নিমিও বলে, চিনিটা তাহলে টুনির।

তারপরে আবার হাসি। এবার অভয়ও না হেসে পারে না। এই ভাঙা বাড়ির বুকে মেয়ে পুরুষের মিলিত গলার উচ্ছ্বসিত হাসি বোধ হয় এই প্রথম। যেন এখানকার চাপা পড়া দুঃসহ অস্থিরতা একটা মুক্ত দ্বার দিয়ে অবাধে বেরিয়ে এল।

কিন্তু মুহূর্ত পরেই হাসিটা থেমে এল বুকে ফিক ব্যথা লাগার মতো। ফিরে এল সেই রুদ্ধ অস্থিরতা।

নিমি বলে, বিনি, মা কোথা?

বিনি বলে, মাঠের ধারে গোবর কুড়োতে গেছে। পালের গোরু ফিরবে এবার।

তবুও কেউই চাপতে পারে না একটা ছোট্ট নিশ্বাস। তিনজনের মধ্যে মূর্তি ধরে ওঠে হতাশা।

পথের মাঝে বেগড়ানো গাড়ির বেয়াকুব ড্রাইভারের মতো অবাক ও মুগ্ধ হয়ে ওঠে অভয়।

কিন্তু এমনি করেই আড় ভেঙে যায়। খুলে যায় সেই রুদ্ধ দ্বার। বাধামুক্ত জোয়ার এগোয়। কখনও সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে, কখনও এড়াবার সুযোগ পাওয়াও যায় না।

প্রথমেই তিন বোনের অসীম কৌতূহল, কোথায় বাড়ি, কে কে আছে।

অভয় বলে, কে আবার থাকবে। ছোট ছোট ভাই বোন আর বিধবা মা। ছেলেবেলা থেকে সবাই আমার পোষ্য।

আর বিয়ে?

বিয়ে কে দেবে আর কে করবে? কথায় বলে, নিজের জোটে না, আবার শঙ্করাকে ডাকে।

তারপর এ পক্ষ থেকে প্রশ্ন ওঠে, তোমাদের রোজগার কী রকম?

নিমি বলে, ছাই! খেতে জোটে না।

বিনি বলে, তিনজনের খাটনিতে রোজ কুল্লে দু-টাকার বেশি নয়।

টুনি বলে, আর মা ঘুঁটের পয়সা জমিয়ে রাখে।

 কেন?

কেন? আমাদের বিয়ে দেবে বলে। বলে তারা তিনজনেই তীব্র বিদ্রূপ ভরে হেসে ওঠে। হাসিটা অভয়ের মর্মস্থলে গিয়ে বেঁধে। কিছুক্ষণ কথা বেরোয় না তার মুখ দিয়ে। পরে বলে, যেন খানিকটা আপন মনে, হবে না কেন, হবে।

হবে! যেন এমন বিচিত্র কথা তারা কোনওদিন শোনেনি, এমনি উৎসুক স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে তিন বোন তাকিয়ে থাকে অভয়ের দিকে।

একটু পরেই টুনিই বলে, আমরা তো শঙ্করী। নিজের না জুটলে কে আমাদের ডাকবে?

অভয়ের জিভ আড়ষ্ট, বুকে পাথর চাপা। সত্যি, কে ডাকবে, কেমন করে ডাকবে। এ বিশ্ব সংসারে সকলের গলা চেপে রেখেছে যেন কোনও অদৃশ্য দানব। বুকের মধ্যে এত গুলতানি, মুখ দিয়ে ফোটে না।

ফোটে না, তবু ফোটে। রাত্রির নিরালা অন্ধকারে ফুল ফোটার মতো সে নিঃশব্দে ফোটে। এখানে গড়ে ওঠে আর এক নতুন সংসার। তিন মেয়ে আর এক ছেলের বিচিত্র সংসার।

যাকে বলে ডেয়ো ঢাকনা, তাই একে একে জড়ো হয় অভয়ের ঘরে। আলগা উনুন আসে, কিনে আনে হাতা, খুন্তি, হাঁড়ি, থালা, গেলাস।

আর দশটা বাড়িতে যা সম্ভব হয়ে ওঠে না, এখানে তাই হয়। সকাল বেলাই ভাত খেয়ে কাজে যায় অভয়। ভোর রাত্রে উনুন ধরে। মোটর মিস্তিরি কেন এ সব পারবে। পালা করে আসে তিন বোন। আসে ভোর রাত্রের আবছায়ায়, বাসি খোঁপা এলিয়ে, বিচিত্র বিস্রস্ত বেশে, ঠোঁটের কোণে তাজা হাসি নিয়ে। আবার আসে সন্ধ্যাবেলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে। এসে অভয়কে সরিয়ে নিজেরা বসে রান্না করতে। এক সঙ্গে নয়, পালা করে আসে। ঘরে নিজেদের কাজ আছে, তা ছাড়া সেই সতর্ক সন্ধানী দৃষ্টির খবরদারিও আছে।

তবু আজ আর বাঁধ মানে না। অভয়কে ঘিরে এ তিনজনের আর এক নতুন চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে।

অবারিত হয়ে খুলে যায় চাপা প্রাণের দরজা। অভয়ের রান্না খাওয়া, আর জামা কাপড়টুকু পর্যন্ত নিজেরা কেচে দেয়। সবটুকু করেও তাদের তৃষ্ণার্ত গুপ্ত সাধ মিটতে চায় না। এত আছে যে, দিয়েও প্রাণ ভরে না।

জাত-বেজাতের বাধা ডিঙিয়ে ভাত বেড়ে দিয়ে বসে খাওয়ায় তারা অভয়কে।

নিমি খেতে দিয়ে অভয়ের সর্বাঙ্গ আঁতিপাঁতি করে দেখে। চোখে তার মমতা, ঠোঁটের কোণে বেদনার হাসি।

অভয় বলে, কী দেখছ?

নিমি বলে, দেখছি তোমাকে। জাত মারলুম মিস্তিরি, তবু তোমার শরীরটা ভাল করে তুলতে পারছি না।

অভয় হেসে বলে, তোমার খালি ওই ভাবনা। আর কত হবে। ড্রাইভার কি দুধগোলা পুরুষ হবে।

নিমিও হাসে। মন বলে, হ্যাঁ, দুধগোলা পুরুষ হবে। ঢল ঢল কান্তি, গোরাচাঁদ হবে অভয়। আর নিমি সবই ফেলে দেবে সেই গোরাচাঁদের পায়ে।

ভাবতে গিয়ে নিমির বুকের শিরা-উপশিরায় টান পড়ে। মনে হয় শরীরটা টলছে। তার শুধু বুক নয়, শূন্য কোলটাও হাহাকার করে ওঠে।

অভয় সেই স্বপ্নাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেও স্বপ্নাতুর হয়ে ওঠে। বলে, কী হয়েছে নিমি?

 নিমি মুখ নামিয়ে নিঃশব্দে হাসে।

এমনি বিনিও আসে। সে যেন একটু রহস্যময়ী। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে সে খালি অভয়কে বলে, এটা দাও, সেটা দাও! তারপরে, আজকে বাজার থেকে এই এনো, সেই এনো। খেতে গিয়ে, অভয়ের আপত্তি থাকলেও যা প্রাণ চাইবে, তাই দেবে। না খেলে মাথার দিব্যি দেবে আর নিঃশব্দে কেবলই কাছে বসেও আড়ে আড়ে চেয়ে টিপে টিপে হাসবে। যেন মনের তলার গুরু কথা তার ঠোঁটের কোণে ঝিকিমিকি করে।

তা দেখে এই হাসিটার মতোই অভয়ের বুকটা ধিকিধিকি জ্বলে। জ্বলুনিটা লাগে এসে রক্তস্রোতে। ডাকে, বিনি।

বিনি তাকায়, তার অপলক হাসি চোখে বিচিত্র ইশারা। সুগঠিত ঘাড়ের কাছে মস্ত খোঁপা। চাপা গলায় বলে, বলো।

কিছু বলছ?

তেমনি তাকিয়ে বিনি বলে, কী আবার। একটু থেমে আবার বলে, তুমি না থাকলে বাড়িটা খাঁ খাঁ করে।

বলতে পারে না, তাদের মন খাঁ খাঁ করে। সেটুকু কান পেতে শোনে বিনি। শোনে, বুকের মধ্যে রক্তের ঢেউ তোলে পাড়চাপা গুমরানি। তাকিয়ে দেখে অভয়ের বুকটা।

অভয় বলে, আমার কাজে মন বসে না। মনটা যে কোথায় থাকে। যেন না জানার জন্যেই দু জনে চোখে চোখ তাকিয়ে হাসে।

আর টুনি যেন এক দজ্জাল কিশোরী বউ। তার ক্ষণে হাসি, ক্ষণে রাগ। তার হাসি অবাধ, আবার রাগও করবে। ছুটে ছুটে কাজ করবে। কাজের কী হল না হল তা দেখবে না। দিশেহারা কাজের মধ্যে সার হয় অভয়ের সঙ্গে খুনসুটি করা। মনের মতোটি না হলে ধমকাবে।

অভয় তার কাছটিতে বসে বলে, এই তবে রইলুম বসে, থাকল মিলিটারি কারখানা আর চাকরি। টুনি অমনি খিলখিল করে হাসে। কখনও এলোচুলে, কখনও খোঁপা নেড়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসবে। দেখবে আঙুলের ফাঁক দিয়ে আর থর থর কাঁপবে বাঁধাভাঙা শরীর।

অভয়ও মেতে ওঠে তার সঙ্গে। হাসে, রাগ করে। হয়ত আলগোছে টুনির ঘাড়ের কাপড় মাথায় তুলে ঘোমটা করে দেয়।

টুনি অমনি যেন সত্যি তীব্র অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ বাঁকিয়ে চায়। চোখের কোণে বকুনি ও কান্নার ঝিলিমিলি খেলে।

অভয় বলে, কী হল টুনি?

 কী হল তাই ভাববার চেষ্টা করে টুনি। কিছু টের পায় না, শুধু চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, অবশ হয়ে আসে সমস্ত শরীর ; নিজেকে দেখে, সে যেন অভয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে আছে।

ভাবতে গিয়ে হঠাৎ অসহ্য লজ্জায় বিচিত্র রূপে রূপবতী হয়ে ওঠে টুনি। বলে, কী জানি কী হয়, জানিনে ছাই।

তারা কেউ জানে না তাদের কী হয়েছে। চারজনে ডুবে আছে আকণ্ঠ। নতুন গড়া এক ভরা সংসারের তারা চারজন মানুষ।

অভয় না থাকলে সত্যি বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। সময় যেতে চায় না। তিনজনের বুকে একই তাল। চোখে একই জিজ্ঞাসা। তিনজনেই সারাদিন কান পেতে শোনে পদশব্দ। এই সুযোগে তাদের চাপাপড়া প্রাণের অস্থিরতাটা যেন ফিরে আসতে চায়। টুনি হয়তো গুন গুন করে ওঠে :

আর রইতে নারি হয়ে নারী
তোমার বাঁশি শুনে গো।
আর চলতে নারি হয়ে নারী
একি বিষম দায় গো।

বিনি তাতে গলা দেয়, নিমি সব ভুলে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তারপর আবার বেজে ওঠে সেই পদশব্দ। বাজে যেন হৃৎপিণ্ডের মধ্যে।

অভয় তিনজনকে আলাদা করে ভাবতে পারে না। একজনকে ভাবতে গেলে আর একজন আসে। কেউ কাউকে ছাড়া নয়। এর মমতা, ওর হাসি, তার অভিমান। তিনে মিলে যেন একটাই।

তবু একটা নয়। এ সংসারের বিচিত্র নিয়মের মতো তিন বোনের আলাদা সত্তা যেন তলে তলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। তাদের প্রাণের আর একটা গোপন দরজা ধীরে ধীরে খুলতে। থাকে। অভয়কে তারা তিনজনে তিন রকমে টানে।

.

এমনি সময় একদিন বেলা দশটায় অসময়ে গলিতে বেজে উঠল বুটের শব্দ। অসময়ে কেন। একে একে সব ফেলে ছুটে এল তিন বোন। দেখল শিকল দেওয়া বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে অভয় যেন ভেঙে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

তিনটে বুক উৎকণ্ঠায় ভেঙে পড়ে। কী হয়েছে, অসুখ? বাড়ির দুঃসংবাদ?

অভয় তাকায় তিনজনের দিকে। ফিক ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে যায় বুক। বলতে গিয়ে কথা ফোটে না মুখে। চোখের দৃষ্টি নেমে আসে। ভাবে, যাক বলব না। সব যায় যাক, তবু পারব না ছেড়ে যেতে, পারব না এমনি করে ভাসিয়ে দিতে।

কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে পড়ে মায়ের কথা, ভাই বোনগুলির বুভুক্ষু শুকনো মুখ। ওদের যে আর কেউ নেই। সে বলে, যেন চেপে আসা গলায় কোনও রকমে বলে, ট্রান্সফার, মানে বদলি করে দিলে, পানাগড় ডিপোতে!

বদলি! সামনে তিন মেয়ের মুখ নয়, তিনটি প্রাণহীন মৃত মুখ। শিরায় শিরায় রক্তপ্রবাহ বন্ধ, চলৎশক্তিহীন। যেন বুঝেও বোঝেনি সমস্ত ব্যাপারটা।

হু হু করে হাওয়া এল গলিটার অন্ধ সুড়ঙ্গে। ফাল্গুনের মাতাল হাওয়া। কবে এসেছে বসন্ত কে জানে। বসন্ত এসেছিল সেই শরতেই মেঘলাভাঙা রোদে, হেমন্তের কুয়াশায়, শীতের রুক্ষতায়।

অভয় বলল, যেতে হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেতে হবে। কালকেই জয়েন করতে হবে।

যেতে হলে নয়, যেতে হবে। দুরন্ত হাওয়ায় সেই কথাটি যেন মর্মে মর্মে এসে বলে দিয়ে যায়।

নিমি, বিনি, টুনি–তিন বোন। ওদের চোখে বৈধব্যের গাঢ় হতাশা। রক্তক্ষয়ী চাপা কান্না থমকে রয়েছে চোখে। বুকের মধ্যে কী যেন ঠেলে আসছে।

অভয়ও আর তাকাতে পারে না। বুকটা মুচড়ে তারও গলাটা বন্ধ হয়ে আছে। কোনও রকমে দরজাটা খুলে সে ঘরে ঢুকে পড়ে।

ফিরে আসে সেই অস্থিরতা। অদৃশ্যে সে যেন তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে ঘরে বাইরে। ছটফট করে মরে রুদ্ধ যৌবনের দ্বারে দ্বারে।

সব গোছগাছ হয়ে যায়। সেই সুটকেশ আর বিছানা।

তিন বোন বুক চেপে দেখে উনুন, কড়া, খুন্তি, হাঁড়ি। সেগুলিও যেন তাদেরই মতো রুদ্ধ যন্ত্রণায় নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের গড়া ঘর। খেলা ঘর। যাকে ঘিরে এই খেলা ঘর সে চলে যায়, এগুলি পড়ে থাকে তাদেরই মতো।

তারপর অভয় আবার দাঁড়ায় তিন বোনের মুখোমুখি। পুরুষের শক্ত বুক ফাটে, ঠোঁট বেঁকে ওঠে। খালি শোনা যায়।

যাচ্ছি, যাচ্ছি তবে। 

এই তিনজনের বুকের মধ্যেও হাহাকার করে উঠল বিদায় দেওয়ার জন্যে। ঠোঁট কাঁপল, বন্ধু বিদায়ের হাসি হাসতে চাইল। পারল না। হাত বাড়িয়ে বুঝি ছুঁতে চাইল, পারল না।

হাওয়া এল। শূন্য ঘর। ছড়ানো সংসার। ফুল নেই, শুকনো কাঠির মতো শীর্ণ পাতাহীন কৃষ্ণকলির ঝাড়। কালকাসুন্দের বন। পোড়া পোড়া পাঁশুটে কচুরিপানা।

একদিন যেমন এসেছিল, আজ তেমনি পোশাকে, তেমনি ঠেকে ঠেকে হাতে আর ঘাড়ে বোঝা, চলেছে অভয়। কিন্তু চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সবই ঝাপসা।

মুচকুন্দ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আবার তাকাল।

সেখানে এসেছে তিন বোন, ভাঙা পাঁচিলের ধারে। কিন্তু চোখ অন্ধ হয়ে এসেছে, সামনে অন্ধকার।

অন্ধকার কানা গলিটাতে ঢুকে পড়ল অভয়। মোড়ের বাতিটা তাকিয়ে আছে এই দিকেই, এক চোখে।

তারপর হঠাৎ একটা চাপা তীব্র গুমরানি শুনে তিন বোন ফিরে দেখল, দেয়ালের নোনা ইটে মুখ চেপে কাঁদছে বুড়ি মা। কেন, তা কেউ জানে না, বুঝবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *