ধূলি মুঠি কাপড়

ধূলি মুঠি কাপড়

ফাল্গুন মাস। পথ চিনতে হয়নি, বঙ্গোপসাগরের বুকের বাতাস আপনি ছুটে এসেছে শহরের বুকে। দূর বন মাতিয়ে, অনেক ঝরাপাতা ঠোঁটে নিয়ে গুন গুন করতে করতে এসেছে প্রাসাদপুরীতে। নাম নিয়ে এসেছে নতুন ফুলের, কথা নিয়ে এসেছে নতুন গানের। অনেক ধুলো উড়িয়ে এসেছে ঝকঝকে আকাশের গায়ে। সেই ধুলোর গায়ে রৌদ্রকণা এঁকে দিয়েছে অনেক রঙের রংঝালর। ছাদের আলসেতে, কার্নিশে, খিলানে, জানলায় বাতাসের ফিসফিসানি কী এক গূঢ় খুশির কথা বলছে চাপা স্বরে।

জামা কাপড় পরতে পরতে পাশের ঘরে গুনগুন করছে অমলা। গুনগুন করছে ওর সেই প্রিয় গানখানি, ওহে সুন্দর, মরি মরি!

বেরুতে হবে, সময় হয়ে গেছে। এ ঘর থেকে প্রমথ তাড়া দিয়েছে অনেকবার। তাড়া দিয়ে এখন মোহমুগ্ধ শূন্য দৃষ্টিটা মোটা লেন্সের ভেতর থেকে মেলে দিয়ে চুপ করে গেছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অমলার গুনগুনানি শুনছে আর ফিসফিস করছে নিজের মনে তোমায় কী দিয়ে বরণ করি, ওহে সুন্দর! প্রমথর সারা মুখে একটা চাপা খুশির আবেগ ছড়িয়ে পড়ে। গানটি অমলার প্রিয় নয় শুধু। ওর ধ্যান সংগীত। সাত বছর ধরে ওই গানটি ছাড়া আর বুঝি কোনও গানই গায়নি অমলা। সাত বছর আগে, এক সভায় সভাপতি বরণ করেছিল অমলা ওই গানটি গেয়ে। রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি আসরের জ্ঞানীপুরুষ, অন্যদিকে লক্ষ্মীর বরপুত্র সেই সভাপতি। অথচ নিরহংকারী, আত্মভোলা, প্রশংসাকুণ্ঠিত সুপুরুষ। সেই সভাপতি প্রমথ পুরকায়স্থ। প্রমথ নিজেই।

হঠাৎ দমকা বাতাসে দরজার একটা পাল্লা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল।

প্রমথ একটু চমকে উঠল। বলল, কই, হল তোমার?

জবাব এল, যাচ্ছি গো! বড্ড যে হাওয়া!

 প্রমথ অবাক হয়ে বলল, হাওয়া! হাওয়া তো তোমার কী?

খুশি–চাপাগলায় কপট বিরক্তিভরা চাপা স্বর শোনা গেল, বড্ড জ্বালাতন করছে যে!

হাওয়ার জ্বালাতন? এ সব বিষয়ে প্রমথ অমলার তুলনায় একটু অপটু। তাই এক মুহূর্ত অবাক হয়ে পরমুহূর্তে হেসে উঠল। বলল, ভারী বেয়াদপ হাওয়া তো? যাব নাকি?

আর্ত কপট স্বর ভেসে এল, আজ্ঞে না মশাই, আসতে হবে না।

 প্রমথ বলল, তবে দক্ষিণের জানলাটা দাও না বন্ধ করে।

খুশির সুরে খানিকটা বিদ্রূপ চলকে উঠল অমলার গলায়, বয়ে গেছে। না হয় একটু বেসামাল হয়েই বেরুব।

বলতে বলতেই বেরিয়ে এল সে। একঝলক আলোর মতো। সন্ধ্যার ঘোরে একরাশ সন্ধ্যাকলির মতো। সাজেনি, সাজেও না সে কোনওদিন। কিন্তু অমলার রূপই অপরূপ। না সেজেও অনেক সাজে ভরা, সেটুকু আছে তার ষোলো আনা। অল্প দামের একখানি মাধবী রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছে। চুল বেঁধেছে এলো করে। নিরলংকার হাতে শুধু ছোট্ট একটি সোনার হাতঘড়ি। কানে দুটি ফুল। একহারা ছিপছিপে বলা যেত অমলাকে। হঠাৎ দেখলে তাই মনে হয়। কিন্তু ঈষৎ নম্রতা ও গুটি কয়েক বলিষ্ঠ ঢেউ তাকে ভারী ও ভরাট করে তুলেছে।

পাশে দাঁড়িয়ে প্রমথ। একটু মেদবহুল। সেটুকু তার দীর্ঘ দেহে মানিয়ে গেছে। মাজা মাজা রঙের উপরে তার সারাদেহ ঘিরে একটা সতর্ক বুদ্ধি উঁকি মেরে আছে যেন। চোখ দুটি একটু বেশি দীপ্ত, তীব্র, অনুসন্ধিৎসু। হাসলেও তার মুখের একটা বিচিত্র আড়ষ্টতা কখনও দূর হয় না। সেজন্যে তাকে ভাবুক বলে মনে হয় সবসময়।

বলল, কই, বেসামাল দেখছি না তো?

সামনে এসে যেন লজ্জিত হয়ে পড়ল অমলা। আড়চোখে তাকিয়ে একটু বিচিত্র হেসে বলল, দেখতে পাচ্ছো না, সে বুঝি আমার দোষ?

মোটা লেন্সের আড়ালে প্রমথর চোখ দুটি আরও দীপ্ত হয়ে উঠল। কাছ ঘেঁষে বলল, মনে মনে হয়েছ বুঝি?

ভাগ! বলে একটু নিঃশব্দে হাসল অমলা। সর সর করে এক ঝলক হাওয়া ঢুকল ঘরে। বলল, চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

প্রমথ যেন চমকে উঠল। বলল, হ্যাঁ চলো। একটা কথা, মজা দেখেছ? ফাল্গুন মাস পড়েছে, কপোরেশনের এখনও ঘুম ভাঙেনি। পকস হয়ে দু-চারটি মরলে, তারপর তারা ভ্যাকসিনেশন অভিযান শুরু করবে। তুমি ওটা একটু নোট করে নাও। পিতৃমাতৃহীন শিশু সংঘে যেন আগামীকালই সব ছেলেকে ভ্যাকসিনেট করা হয়, সেটা বলতে হবে। ভুলে না যাই।

এই খুশির গোধূলি-মুখে শ্রদ্ধার হালকা গাম্ভীর্য নেমে এল। প্রমথর দিকে এক মুহূর্ত বিস্মিত প্রশংসায় তাকিয়ে থেকে অমলা বলল, সত্যি, কী সজাগ মন তোমার। মন তোমার ওই সংঘের ছেলেদের কাছেই পড়েছিল দেখছি।

নোটবুকে টুকে নিয়ে নীচে নেমে এল তারা। মস্ত বড় বাড়ি। উনবিংশ শতাব্দীর এক বিশাল প্রমোদভবন। আজকে নিঃশব্দ এক জনহীন রাজপুরী। নীচের তলাটা খাঁ খাঁ করছে। দুটি চাকর। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না। বাগানটি একসময়ে হয়তো খুবই ভাল ছিল। এখনও ফুল আছে। অনেক টব আছে। পাম আর সুপারি দুলছে হাওয়ায়। কলমের আম লিচু ঘিরে আছে চারদিক থেকে। তবু যেন কেমন শ্রীহীন। ওদিকে বিশেষ নজর নেই প্রমথর।

গেট খুলে বেরুতে যাবে এমন সময় একটি ছেলে নমস্কার করে এসে দাঁড়াল। অপরিচিত। একটি চিঠি প্রমথর হাতে দিয়ে বলল, কুঞ্জদা পাঠিয়েছেন।

প্রমথ চিঠি খুলল। নমস্য কুঞ্জদা। রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবীণ নেতা। লিখেছেন, সর্বেশ্বরকে তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই? সে পাকিস্তানের জেলে রয়েছে এও জানো। তার স্ত্রী তার দুটি বাচ্চা নিয়ে এখানে এসেছেন। দায়িত্বটা আমার। তোমার আর অমলার আশ্রয়ে উনি আপাতত মাসখানেক থাকুন, এই আমার ইচ্ছে। তোমাদের মতামত জানাবে। সেই বুঝে কাল সকালেই ব্যবস্থা করব।

পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন, নিপীড়িত মা ও শিশুদের নিয়ে তোমার বক্তৃতাগুলি আমি সব শুনেছি, শুনছি। মায়েদের প্রতি তোমার এই অগাধ শ্রদ্ধা, শিশুদের প্রতি তোমার চওড়া শীতল বুকখানির স্নেহাশয় স্মরণ রেখে নারীরা তোমাকে চিরদিন আশীর্বাদ করবেন, ছেলেরা তোমায় মাথায় করে রাখবে চিরদিন। ধন্য ভাই! সত্যি বলতে কী, সর্বেশ্বরের স্ত্রী-পুত্রকে দেখে কেন যেন তোমার কথাই মনে হল আমার।

গৌরবের আনন্দে এবং কুণ্ঠায় লজ্জিত হয়ে উঠল প্রমথ। চিঠিটা বাড়িয়ে দিল অমলার হাতে। অমলা পড়ল। শেষের কথাগুলি পড়তে পড়তে প্রমথর দিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকাল সে। পড়া হয়ে গেলে দু-চোখ ভরে আবার দেখল সে প্রমথকে। বোধ হয় তার সেই প্রিয় গানটি গুঞ্জরিত হচ্ছিল মনের মধ্যে।

প্রমথ বলল, বলো।

অমলা বলল, বলব আবার কী। কুঞ্জদা লিখেছেন যখন, নিশ্চয় আসবেন।

প্রমথ বলল, আমিও তাই ভাবছিলাম। ছেলেটির দিকে ফিরে বলল, পাঠিয়ে দিতে বলবেন। কুঞ্জদাকে বলবেন, বেরুবার মুখে চিঠি লিখে জবাব দিতে পারলাম না।

ছেলেটি নমস্কার করে চলে গেল।

সভায় যাওয়ার মুখে কুঞ্জদার চিঠিখানি তাকে যেন নতুন করে সংবর্ধনা জানাল। অমলা জিজ্ঞেস করল, সর্বেশ্বরবাবু কে? কখনও শুনিনি তো?

প্রমথ বলল, বলছি, গলিটা পার হয়ে নিই।

গলিটা পার হওয়া সত্যি এক অদ্ভুত ব্যাপার। তারা যখন হেঁটে পার হয় গলিটা, তখন চারদিক থেকে এসে পড়ে অনেক উঁকি-ঝুঁকি। অনেক ফিসফিসানি গুঞ্জন করে দরজায় জানলায়। ঠাট্টা বিদ্রূপ করে নয়। সকলের কৌতূহল ছিল অনেকখানি, বিস্মিত শ্রদ্ধা ছিল তার চেয়ে বেশি। এ দম্পতিটির প্রেম নিয়ে, কার্যকলাপ ও আদর্শ নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হয় পাড়ার মধ্যে। ওদের কেউ কোনওদিন আলাদা, একলা বেরুতে দেখেনি। বেরোয় না ওরা। তার জন্যে কেউ কোনও মন্তব্য করে না। বরং সকলেই বেশ খুশি আর শ্রদ্ধা পোষণ করে। পাড়ার রকবাজ ছেলেবুড়োরাও চুপ করে যায় ওদের দেখলে। যাদের মন্তব্য শোনা থেকে কেউ নিস্তার পায় না। একলা একটা মেয়ে তো দূরের কথা, কোনও দম্পতিও নয়। ওরাও চুপ করে থাকে। আড়ালে বলাবলি করে, শালা একেই বলে বড়লোক।

মাইরি! লোকে যারে বড় বলে…

হ্যাঁ, জোড়া যদি বাঁধতে হয় তো, এই রকম।

এদিকে খুব টাকা! কিন্তু বোঝা যায়?

মেয়েরাও নানা রকম বলে। দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে বইকী।

প্রমথ গায়ে মাখে না। মাখলেও বুঝতে দেয় না। অমলার বড় লজ্জা করে। নতুন বিবাহিতার মতো সলজ্জ চাপা হাসি কাঁপতে থাকে ঠোঁটের কোণে। কুমারী মেয়ের মতো লোকচোখের আড়ষ্টতা জড়িয়ে ধরে ওর সর্বাঙ্গে। কোনও কোনও মেয়ে বউয়ের সঙ্গে তার আলাপ আছে। তাদের দিকেও সে তাকাতে পারে না চোখ তুলে। স্বামীর সঙ্গে যাওয়ায় লজ্জাটুকু কাটিয়ে উঠতে পারেনি আজও। পাড়াতে নয়, সভাতেও। তবুও ঘরে বাইরে তারা এক সঙ্গে। অথচ চার বছর কলেজে পড়া মেয়ে। ওহে সুন্দর, মরি মরি! গেয়ে সে একদিন মরেছিল। কিন্তু সেই কুমারী মেয়েটি ছায়ার মতো ফিরছে তার পিছে পিছে। তার এই সাতাশ বছরের সাত বছর ধরে। তার রক্তকোষের রঙের মালায় সে যেন আজও বাঁধা পড়ে আছে।

বড় রাস্তায় এসে পড়ল তারা। ফাল্গুনের সন্ধ্যায় ভিড়বহুল রাস্তা। গাড়িগুলিতে এখনও আপিস ফেরতাদের ভিড়। ভ্রমণবিলাসীদের ভিড় পথে ও স্টপেজে। দোকানে দোকানে আলো জ্বলছে এখন একটি একটি করে। মোড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দিশেহারা বাতাস।

অমলা বলল, বললে না সর্বেশ্বরের কথা?

 প্রমথ বলল, তবে চলো হেঁটেই যাই। তারপরে বলল অনেক কথা।

 সর্বেশ্বরের কথা।

বলল, কলেজে পড়ি তখন। সতেরো বছর বয়স। সর্বেশ্বরও পড়ে। সে আমাকে রাজনীতিতে দীক্ষা দিল। টেনে নিয়ে গেল একটা গুপ্ত দলে। আমাদের বাড়ির আবহাওয়া চিরকালই খুব খারাপ, তোমাকে বলেছি। একটা জঘন্যতম ফিউডাল পাপের বাসা ছিল বাড়িটা। বাবা সারাদিন বাড়ি থাকতেন, বাইরে থাকতেন সারারাত। মা সারাদিন মামাদের বাড়ি থাকতেন, রাত্রে ফিরে আসতেন মামাদের সঙ্গে। মামাদের দু-একজন বন্ধুও থাকতেন সঙ্গে। সকলে মিলে অনেক রাত্রি পর্যন্ত চালাতেন গল্প, তাস খেলা। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার এঁরা আবার সমাজে ছিলেন খুব গণ্যমান্য। এর মাঝে আমি! আমার ছিল পড়া, খাওয়া, স্কুলে যাওয়া, মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বেড়ানো, আর সমস্ত বাড়িটার উপর একটা অন্ধ বিদ্বেষ নিয়ে ভূতের মতো ঘোরা। তার থেকে আমাকে মুক্তি দিল সর্বেশ্বর। তারপর সর্বেশ্বরের সঙ্গে জেল খেটেছি বছরখানেক। জেল থেকে বেরিয়ে বারো বছর একসঙ্গে ছিলাম আমরা। রাজনীতি আর পড়া, দুটোই চলেছিল একসঙ্গে। বাড়িতে বাবা মা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চেষ্টা করেও তাঁরা আর সময় করে উঠতে পারেননি, এত ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের নিয়ে। এক বছরের মধ্যে মারা গেলেন দুজনেই।…বারো বছর পর সর্বেশ্বর চলে গেল ঢাকায়। বাড়ি ওর ওইদিকেই, রাজনীতির ক্ষেত্র হিসাবে ওইটাই বেছে নিল ও। সর্বেশ্বর চলে যেতে আমাকেও কাজের ক্ষেত্র পালটাতে হল। আর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। দল ভেঙে গিয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু নতুন অনেক দল হয়েছিল। বিশেষ কোনও দলে যাইনি আর। তবু কাজ করে চলেছি। আর… প্রমথ থামল। অমলা তাকাল সপ্রশ্ন ব্যথিত চোখে। ব্যথা তার প্রমথর জীবন সংগ্রামের কথা ভেবে। বলল, আর?

প্রমথ হঠাৎ অমলার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, পেলাম তোমাকে।

 বাতাসে আঁচল উড়ছে অমলার। চুল এলো হয়ে পড়েছে আরও। ফাল্গুনের রাস্তায় রাস্তায় ঘরবিমুখ মানুষের ভিড়।

অমলা বলল, অতি তুচ্ছ ঘটনা।

না, সব চেয়ে বড় ঘটনা। আর কিছু চাইনে, তোমাকে ছাড়া। গলার স্বরটা কেমন গোঙানির মতো শোনায় প্রমথর। চোয়াল ও চিবুকের মাংসপেশি কাঁপতে থাকে থরথর করে। কেমন অস্বাভাবিক আর উদ্দীপ্ত দৃষ্টি হয়ে ওঠে তার। ওই কথাটা এমনি করেই বলে সে। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে। কেন?

কেমন যেন লাগে অমলার। একটা চাপা কষ্ট হতে থাকে তার বুকে। আর এত ভালবেসে মরা বুকে নিজের অজান্তে একটি দরজা খোলে। খুব ছোট্ট দরজা। সে দরজাটা যেন প্রতিদিনের, প্রতি পলের ভালবাসা দিয়ে তৈরি রুদ্ধশ্বাস বেড়া থেকে একটু মুক্তি চায়। একটু একটুক্ষণের জন্যে। তার ভালবাসার সুখটুকু আকাশ ভরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে!

পরমুহূর্তেই আবার তা হারিয়ে যায়। কথা বলে তাড়াতাড়ি। নইলে কষ্টটা ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকাতে থাকে। বলে, মিছে কথা তোমার। আমাকে ছাড়াও তুমি কত কী চাও।

চমকে ওঠে প্রমথ। চমকায় সে একটু বেশি। তারপর হেসে ওঠে।

তেমনি আড়ষ্ট হাসি। বলে, আঁ?–হ্যাঁ–তা…

খুশি হয়ে ওঠে অমলা। খুশি হয়, এইটুকু চায় সে। প্রমথর তাকে ছাড়া আরও কিছু চাওয়া আর এমনি করে বলা। এটুকু যেন তারই প্রেমের জয়গান।

.

পরদিন বেলা প্রায় নটা। পড়ার ঘরে কাগজ পড়ছিল দু-জনেই অমলা আর প্রমথ। চা পর্ব শেষ হয়েছে। চাকর এসে সংবাদ দিল, নীচে একটি মহিলা এসেছেন। সঙ্গে দুটি বাচ্চা।

অমলা উঠল। তাড়াতাড়ি কাপড়টি একটু গোছ করে নীচে নেমে গেল। প্রমথও এল পিছনে পিছনে।

সিঁড়ির নীচেই অতি সাধারণ একটি মেয়ে। একহারা শ্যামাঙ্গী, মাথায় অল্প ঘোমটা দেওয়া। চোখগুলি বড় বড়। ঠোঁট দুটি অল্প ফোলা। হাসিটি ভারী মিষ্টি। মিষ্টি ও ব্যথিত। কোলের ছেলেটি মায়ের মতোই, কিন্তু বলিষ্ঠ। ঘাড় কাত করে তীব্র অনুসন্ধিৎসা নিয়ে তাকিয়ে আছে অমলা আর প্রমথর দিকে, আর পা দোলাচ্ছে। কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে। মেয়েটি ফরসা, মাথা ভরতি চুল। চোখ দুটি শান্ত। সব মিলিয়ে দৃশ্যটি বড় করুণ।

অমলা কাছে এসে বলল, আসুন। উপরে চলুন। কে নিয়ে এল।

সর্বেশ্বরের স্ত্রী বলল, একটি ছেলে। পৌঁছে দিয়েই চলে গেল।

ও। অমলা প্রমথর দিকে চেয়ে একটু হাসল। প্রমথ তার মোটা লেন্সের আড়ালে ডুবে যাওয়া চোখ দুটো নিয়ে যেন কোন শূন্যে তাকিয়েছিল। বোধ হয় ভাবছিল সর্বেশ্বরের কথা।

অমলা জিজ্ঞেস করল, আপনার নামটা কী ভাই, বলুন।

সলজ্জ হেসে বলল সর্বেশ্বরের স্ত্রী, আরতি।

আরতিদি! বলে অমলা হেসে উঠল। উভয়পক্ষেরই পরিচয়ের কোনও প্রয়োজন ছিল না। কেবল অমলা হেসে বলল, ইনি আপনার স্বামীর বন্ধু। বলে প্রমথকে দেখিয়ে আবার একবার হেসে। উঠে বলল, আগে আপনাদের থাকার বন্দোবস্ত করি। উপরে চলুন।

আরতি বলল, যাচ্ছি। কিন্তু আমার সব সময় নীচে থাকতে পারলে ভাল হয়।

অমলা অবাক হয়ে বলল, কেন?

সস্নেহ গলায় একটু কপট ঝাঁজ দিয়ে বলল, এই যে ছেলে, ভয়ঙ্কর শান্ত কি না। কখন পড়ে গিয়ে হাত-পাগুলি ভেঙেচুরে ঠিক করে রাখবেন, তার ঠিক কী।

ছেলেটির পা দোলানি একটু বাড়ল। আড়চোখে তাকাল অমলার দিকে। হেসে ফেলল অমলা। প্রমথর দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে?

প্রমথ বলল, ওঁর যে রকম সুবিধে হয়…

দু-এক কথার পর নীচে থাকাই সাব্যস্ত হল। প্রমথ অমলার উপর সব ভার দিয়ে উঠে গেল উপরে। আরতিকে নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমেই দক্ষিণমুখো ঘরে গিয়ে ঢুকল অমলা। খোকা ততক্ষণে কোলের মধ্যে অস্থির হয়ে উঠেছে নামার জন্যে।

আরতি বলল, আপনাদের কথা অনেকবার শুনেছি ওঁর মুখে।

ওঁর অর্থাৎ সর্বেশ্বরের মুখে। লজ্জিত হল অমলা। এদের কথা মাত্র কাল বলেছে তাকে প্রমথ। সে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন সর্বেশ্বরবাবু?

আরতি বলল, দু-মাস আগে দেখেছি। নানানখানায় ভুগছে। ওখানে কেউ দেখবার নেই, তাই চলে আসতে বললে। কষ্ট দেব আপনাদের!

একটু ম্লান হেসে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল আরতি। বলল, আপনাদের কথা কুঞ্জদার মুখেও শুনছিলাম। বলছিলেন, ওদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার অফুরন্ত, কিন্তু কেমন বড়লোক একবার দেখে এসো। আপনাদের দুজনেরই গুণগানে কুঞ্জদা একেবারে পঞ্চমুখ।

বলে সে অমলার চোখে চোখে তাকাল। মুগ্ধদৃষ্টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেড়াল অমলার সর্বাঙ্গে। বলল, সত্যি আপনি কী সুন্দর!

একটু রঙের ছোপ লেগে গেল অমলার মুখে। পরমুহূর্তেই আরতি চকিত চোখে অমলার আপাদমস্তক দেখে, কাছ ঘেঁষে বলে উঠল, একটা কথা ভাই কিছুই জানিনে, তাই জিজ্ঞেস করি নিই। ছেলেপুলে আছে তো?

রঙের ছোপ পেরিয়ে, চকিতে কী একটা চলকে যেন ছড়িয়ে পড়ল অমলার মুখে। মুখ থেকে কলকল করে ছড়িয়ে গেল সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভারী হয়ে উঠল চোখের পাতা। কোনও রকমে, নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জানাল, না।

না? যেন এর চেয়ে বিস্ময়ের আর কিছু নেই। তার সহজ জীবনযাত্রার এই বিস্ময়টুকুই রীতি। কয়েক মুহূর্ত অবাক থেকে বলল, সাত বছরেও নয়। কেন ভাই? এই বিশাল পুরীতে, লক্ষ্মীর এ অফুরন্ত ভাণ্ডারে–?

বুকের মধ্যে যেন খিল ধরে গেল অমলার। কেন কেন করে, কেন কাঁটায় কণ্টকিত হয়ে উঠল সর্বাঙ্গ। এক অভূতপূর্ব লজ্জায় ও অস্বস্তিতে আরতির দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারল না সে আর। কোনও রকমে আসছি বলে বেরিয়ে গেল। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে থমকে দাঁড়াল।

এ কী কথা! কী যে কথা! অমনি করে তার দিকে চেয়ে এমনি করে কোনও মেয়ে তো তাকে কোনওদিন বলেনি! সাত বছর, বিশাল পুরীতে, লক্ষ্মীর অফুরন্ত ভাণ্ডারে…। কেন? কেন, অমলা তার কী জানে? কোনওদিন কি মনে হয়েছে? কোনওদিন, কোনও কারণে! কী জানি! কোনওদিন, কীভাবে, কেমন করে, মনে এসেছে কি না সে জানে না।

একটা তীব্র খুশির লজ্জায় বিচিত্র ছিছিকার বেজে উঠল তারে তারে। তারই মধ্যে একটা কষে বাঁধা সরু তার বেজে উঠল টং টং করে। কী একটা যেন ছুটে বেড়াচ্ছে সারা গায়ে। নিজের নিটোল হাত দুটি তুলে এক মুহূর্তে দেখে ঢুকে গেল প্রমথর ঘরে। প্রমথই জানে সব।

প্রমথ মুখ তুলে তাকাতেই হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল অমলা। আশ্চর্য! কী লজ্জা যে করছে! সুপ্তোত্থিতের মতো জিজ্ঞেস করল প্রমথ, কী হয়েছে?

সারা মুখে রক্ত ছুটে এল নতুন করে। তাকিয়ে হেসে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল নিঃশব্দে। আলমারির কাচ ঘষতে লাগল ফিরে।

প্রমথর উদ্দীপ্ত চোখের মণি দুটো যেন ডবল হয়ে আটকে রইল লেন্সের গায়ে। মুখের কয়েকটা রেখা কেঁপে উঠে আড়ষ্ট হয়ে গেল। যেন হাসছিল সংশয়ের হাসি। সাত বছরের প্রথম বছরে এক রহস্য উন্মোচনে এমনি করে হেসেছিল অমলা। কাছে এসে বলল, কী হয়েছে অমলা?

অমলা প্রমথর মস্ত হাতখানি তুলে ঢেকে দিল নিজের মুখ। ফিসফিস করে বলল, কী যে বলেন আরতিদি।

যেন ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল প্রমথ, কী বলেন?

চকিত কটাক্ষে এক বিচিত্র ঝিলিক দিয়ে বলল অমলা, জানিনে যাও।

বলেই হেসে আবার লঘুপায়ে চলে গেল দরজার কাছে, আমি ওঁকে ডেকে নিয়ে আসছি উপরে চা খেতে।

ঘুরে আবার তরতর করে নেমে গেল নীচে। স্তব্ধ প্রমথ আধো-অন্ধকার লাইব্রেরি ঘরে মস্ত একটা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত পরে কুঁচকে উঠল ভ্রূজোড়া।

অমলা নীচে গিয়ে চাকরকে বলল, উপরের শোবার ঘরে সবাইকে চা দিতে। আরতির ঘরে ঢুকল মাথা নিচু করে। তাড়াতাড়ি খুকির হাত ধরে বলল, উপরে চলুন, আগে চা খেয়ে নেবেন।

অস্বস্তি হচ্ছিল আরতির। কী একটা অপরাধের কুণ্ঠাবোধ এসেছে তার মনে। অমলার এড়িয়ে যাওয়াটুকু চোখ এড়াল না তার।

 চায়ের আসরে কথা হল সর্বেশ্বরের, পাকিস্তানের অবস্থার। তারপরে স্নান-খাওয়া। গোছানো হয়েছে নীচের ঘর। যতটা সম্ভব বাসযোগ্য করে বিছানা পাতা হয়েছে।

সারাটা দিন বাড়ির বাগানে ঝিরিঝিরি শব্দে হাওয়া বইল। প্রমথ দেখল, এক বিচিত্রময়ীরূপে অমলা তার কাছ দিয়ে বার বার হেসে হেসে গেল। আরতি দেখল তার এড়িয়ে যাওয়া। আর অমলা রাশিকৃত লজেন্স বিস্কুট করল জড়ো। তা দেখে খুকি পেল লজ্জা। আর খোকা বলল, টুমি খুব ছুণ্ডল আল ভাল।..।

বিকেলে প্রমথ আর অমলা গেল নিখিল বঙ্গ মাতৃ ও শিশু সংঘের আপিসে। একজন সেক্রেটারি, অন্যজন কার্যকরী সমিতির সভ্যা।

পরদিন চায়ের পাট শেষ করে যখন আরতির সঙ্গে নীচে নেমে এল অমলা, তখন আরতি বলল, কালকে আমার উপর খুব রাগ হয়েছে না?

ভারী সুন্দর আর করুণ হয়ে ওঠে আরতির চোখ দুটো। সারাটি দিন কালকে আরতির দিকে চোখ তুলতে পারেনি অমলা। কুমারীর মতো এক নতুন লজ্জা বেড়াচ্ছিল লুকিয়ে। আজও তাই লজ্জায় লজ্জায় এসেছিল। অবাক হয়ে বলল, কেন?

আরতি বলল, জানতুম না, তাই জিজ্ঞেস করেছিলুম। কেমন ভারী আর সুন্দর চেহারাটি তাই। নষ্ট-টষ্ট হয়ে গেছে বুঝি?

আবার সেই কথা। লাল হয়ে উঠল অমলার মুখ। উষ্ণ তরঙ্গ কিলবিল করে এল কানের কাছে। এ কথায় বাধা দিতে চাইল একবার। পারল না। নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জানাল, না।

বুঝি চকিতে একটা কালো ছায়া ঘুরে গিয়েছিল অমলার মুখের উপর দিয়ে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আরতি বলল, একেবারেই নয়, না? বুঝেছি। তাই হয়। যেখানে অনেক আছে, সেখানে বুক খালি। যেখানে অনেক খালি, সেখানে বুক ভরা। বলে একটু হেসে নিজের ছেলেমেয়েকে সস্নেহ ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, এই দেখুন না। বুক ভরে পেয়েছি, রাখতে পারব কি না জানিনে। আবার বলল, প্রমথবাবুর কষ্টও কম নয়।

মনের মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল অমলা। আরতির কথার অন্তর্নিহিত অর্থ অমলা বন্ধ্যা। বন্ধ্যা! অদৃশ্য বিষধরের চকিত দংশনের মতো একটা তীব্র ব্যথা ধরে গেল বুকে। মনের মধ্যে নিঃশব্দে গুমরে উঠল, না না না। তবু মুখভাব অবিকৃত রেখে বলল, রান্নার কথা বলে আসি।

বলে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল উপরে। প্রমথর ঘরের দিকে বাঁক নিতে গিয়ে ছুটে গেল শোবার ঘরে। বিছানায় পড়ে হাঁপাতে লাগল। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল মুখে। এলো খোঁপা গেল খুলে। গলার কাছে যেন কী একটা ঠেলে আসতে লাগল।

একটু পরে এলোমেলো বেশে এসে দাঁড়াল আয়নার সামনে। দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল নিজেকে। যেন কোনওদিন দেখেনি এর আগে। দেখতে দেখতে একবার আঁচল খসাল, আবার জড়াল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল নিজের সর্বাঙ্গ। আর ফিসফিস করে উঠল, আছে, আছে অনেক আছে। দেখে দেখে হাসল, ঠোঁট কামড়াল। কিন্তু সেই বিষ দংশনের জ্বালাটা ধীরে ধীরে ছড়াতে লাগল কেবলই। দপদপ করে জ্বলতে লাগল রক্তকোষের মধ্যে।

কী আর এমন কথা! তবু কী যে কথা! তার জীবনের বাঁধা বীণার তারগুলি সব ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে কুঁকড়ে গেল যেন। তার অনেক বড় সাতরঙা মুখে যেন ছিটিয়ে দিয়েছে কালি। তার নারীত্বকে করুণা করেছে আরতিদি। ধনে মানে অনেক আছে, তবু বুক খালি। সাত বছর নষ্ট হয়নি। তবে? তার সব শূন্য। তার শূন্যতায় প্রমথর কষ্ট।

বিস্মিত ভয়ে তাকাল আবার আয়নার বুকে। তাকিয়ে চোখ বুজে হাসল। আবার চোখ খুলে হেসে উঠল ছোট্ট মেয়েটির মতো। চোখ ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ইস! নেই যেন! তবু জ্বালাটা তো জুড়োতে চায় না।

নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল প্রমথর ঘরে। নিঃশব্দে কিন্তু আশ্চর্য! প্রমথ যেন হাওয়ায় টের পেল। টেবিল থেকে মুখ তুলে তাকাল যেন ঘুমভাঙা চোখে।

খোলা চুল, এলানো বেশ অমলার। টিপে টিপে হাসছে অন্য দিকে চেয়ে। আবার লজ্জা এসে জড়িয়ে ধরছে। নতুন বেশ, নতুন রকম। সাত বছরের চেয়ে বিচিত্রতর।

দিবানিশি কাজ ও চিন্তার গৌরবে আঁকা প্রমথর মুখের রেখাগুলি কেঁপে গেল বারকয়েক। উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

ভ্রূ কাঁপিয়ে ফিরে তাকাল অমলা। আচমকা অভিমান স্ফুরিত ঠোঁটে, বিদ্যুৎ কটাক্ষে বিঁধিয়ে দিল প্রমথকে। আবার কোনও কথা না বলে ফিরিয়ে নিল মুখ। এগিয়ে গেল দরজার দিকে। প্রমথ ডাকল। ফিরল অমলা। গম্ভীর হয়ে উঠেছে প্রমথ। চিন্তার বাষ্পে ঢেকে গেছে প্রায় মুখটা। সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। যেন ধরাই পড়ল না আর অমলার এ বিচিত্রতর রূপ। একখানি কাগজ বাড়িয়ে বলল, সুইডেন থেকে চিঠি এসেছে, মার্চে ওদের মাতৃসংঘের মহাসম্মেলন। তুমি একটা অভিনন্দনপত্র খসড়া করে ফেলো, পাঠিয়ে দেব আজকের ডাকেই।

খচ করে লাগল অমলার বুকে। আর কিছু জিজ্ঞেস করল না প্রমথ। তার নীরব জিজ্ঞাসা ও চাউনিতে আর কোনও কৌতূহল নেই প্রমথর। কোন কৌতূহল, কোন কথা, একটু হাত ধরা? এ কি অবজ্ঞা, না অবুঝপনা! খচ করে লাগল, টনটন করে উঠল বুকের মধ্যে। কিছু সে বলত প্রমথর কাছে, তার গায়ে গায়ে লেপটে, ফিসফিস করে। কিন্তু মাতৃসংঘের কাজে কী অদ্ভুত বিভোর সে!

কাগজটা নিল সে হাত বাড়িয়ে। প্রমথর নির্দেশ সে অমান্য করবে, তেমন মন নয় তার। তেমন হৃদয় নয়। সে যে প্রমথ, তার সব শূন্যতাকে ভরে দেওয়ার মালিক।

তবু সাত বছরে, আজকের সবটাই নতুন। তার এমনি করে আসা। প্রমথর এমনি করে নির্বিকারে কাজ তুলে দেওয়া।

দুর্জয় অভিমানের বিদ্যুৎ কটাক্ষে প্রমথর দিকে তাকিয়ে কাগজ নিয়ে বসল সে। কাজ করতে করতে বারবার চোখ তুলে দেখল কাজে ডুবে যাওয়া প্রমথকে। আর চিঠি লিখল সুইডেনের মাতৃসংঘকে। অভিনন্দন জানাল শিশু সংঘের সম্মেলনকে। গুনগুন করে উঠল আপনমনে। ওহে সুন্দর মরি মরি!…সেই ধ্যান-সঙ্গীত।

বাতাস দুর্জয় হয়ে উঠতে লাগল। এতদিনের ঝিরিঝিরি বাতাসে একটা পাগলামির লক্ষণ দেখা দিতে লাগল। অনাদরে পড়ে থাকা বাগানটার লিচু গাছে ফল ধরতে লাগল, বোল ধরতে লাগল আমগাছে। বাদামগাছটা শূন্য হতে লাগল, আর একদিকে ভরতে লাগল নতুন পাতায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রমোদভবনটি দুলতে লাগল হাওয়ায়।

নীচের ঘরটায় সব সময় কিচির মিচির। মা ছেলেমেয়ের ছোট্ট সংসারটি সব সময় কলরবমুখর। আরতি কখনও উদাস হয়ে পড়ে। তার উদাস প্রাণের অথৈ জলে একলা খোকার দস্যিপনাই অনেকখানি। উদাস সে থাকতে পারে না।

দিন যায়। কাজ চলে ঠিক প্রমথর আর অমলার। কাজ চলে। প্রত্যহ জোড় বেঁধে বেরোয়। কিন্তু আশ্চর্য। সেদিনের ভাবটা আর দূর হল না। প্রমথ শুধু কাজের কথা বলে, অন্য কথা বলে। গানের কথাও বলে, আদর করে, ভালবাসে, অনর্গল ভালবাসা। শুধু একটি কথা বলে না। অমলা তেমনি অভিমানক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে প্রমথকে। দেখে তার বিশাল শরীরটা আর অন্ধকার মুখটা।

তবু কী একটা কথা, সেই কথাটি তারা কেউ বলে না। সেই কথা, যে কথা বাতাসে বাতাসে তাদের কানে কানে ফিরছে, ছড়িয়ে আছে চোখে মুখে। সেই কথা, যে না বলা কথা তাদের সাত বছরের সুরে বেসুর ধরিয়ে দিয়েছে। আলগা করে দিয়েছে, সরিয়ে দিয়েছে, ঘিরে দিয়েছে রুদ্ধশ্বাস। ধোঁয়ার বেষ্টনী দিয়ে।

এত যে বেসামাল হয়ে বেরুল অমলা, কোনও সামাল দিতে তো হেসে হেসে আসে না প্রমথ। নয়তো, যদি বা সে দিত দড়াম করে সেই দক্ষিণের জানলাটা বন্ধ করে। এ সব কি সেই নিজের অজান্তে খুলে যাওয়া বুকের ছোট্ট দরজাটি। নিরঙ্কুশ রুদ্ধশ্বাস প্রেমের আলিঙ্গন থেকে ছুটে গিয়ে খুশিটুকু ছড়িয়ে দেওয়া আকাশে আকাশে।

নীচে যায় অমলা। কম যায়। দেখা হয় আরতির সঙ্গে, কথাও হয় অনেক। ছেলেটা তাকে বলে, আমলামাছি। বলে, আমলামাছি তোমাল কোলে ঠাকবো।

খোকা কোলে ওঠে। বুকে পড়ে ধামসায়। ধামসায়, আরও কিছু চায়। ওর মায়েরটা ছাড়াও। অমলার মনে হয়, তারহীন তানপুরাটায় বাজে শুধু ঠক ঠক করে। সে পালায়, পালিয়ে বেড়ায়।

কখনও নীচে আসতে গিয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে সিঁড়ির কোণে। শোনে ওদের কথা। কখনও হয়তো আরতি পড়ায়, খোকা, বলতো, একে চন্দ্র…

একে চণ্ড।

 দুয়ে পক্ষ।

ডুয়ে পত্থ। পরমুহূর্তেই খোকার নতুন চৈতন্যোদয় হয়। বলে, একে চণ্ড কী মা?

আরতি বলে, একটা চাঁদ, ওই যে আকাশে থাকে।

খোকা বলে, টুই যে বলিছ, ছেই চাঁডটা আমি। আমি টো চাঁড।

হ্যাঁ, তুমি আমার চাঁদ।

আল ডিডি?

আমার ফুল।

আল কী?

আর? আমার পড়ে পাওয়া ধন।

খোকা হাসে খিল খিল করে। রক্তে রক্তে চোরা বান ডাকে অমলার। ঝিম ধরে যায় মাথায়, টলে সর্বাঙ্গ। বুকের থেকে একটা অসহ্য যন্ত্রণা ঠেলে ওঠে গলার কাছে।

কখনও খুকি অদ্ভুত কথা বলে, আমরা যদি না হতুম?

 তবে মরে যেতুম।

 তবে যে তুমি বলো, কেন আমরা এলুম।

 বলি, তোরা যে বড় হতভাগ্য।

খুকি বলে, অমলামাসীর ছেলে হবে না মা?

না।

কেন?

কী জানি।

তারপর একেবারে নীরব হয়ে যায় সব। তখন আরতি দুজনকে বুকে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে। অমলা নিঃশব্দে ছুটে যায় উপরে। কখনও বাগানে। কী যেন আছে শরীরের গুপ্ত কোষে কোষে। বাঁধা আছে, মুক্তি চায়।

প্রমথ দেখেও দেখে না। বলেও বলে না। তার সোহাগ সম্ভোগের পালে কখনও বাতাসের অভাব হয় না, ছেদ পড়ে না কাজে।

একদিন থমকে দাঁড়াল অমলা। স্ক্রু দিয়ে কে যেন এঁটে দিল পা দুটো সিঁড়ির নীচে, ঘরের কোণে।

খোকা বলছে, বল না মা, কী কলে পেলি আমাডের?

আরতি বলে, হেসে হেসে, কেঁদে কেঁদে..

খুকি বলে, সেই গল্পটা বলো না মা।

আরতি বলে, কোনটা? রাজকন্যের? আচ্ছা, চুপ করে শোন তবে।

ফিরতে গিয়েও দাঁড়াল অমলা। আরতির গলা শোনা গেল, এক রাজা, তার এক কন্যে। রাজকন্যের বড় অসুখ। খায় না, দায় না, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। রাজা ভাবে, রানি ভাবে, মন্ত্রী ভাবে, কোটাল ভাবে, রাজ্যময় সংবাদ রটে। ওঝা আসে, বদ্যি আসে, রাজকন্যের অসুখ আর সারে না। কী হল, কী হল? শেষে রাজা গিয়ে কন্যেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বলো মা, কী হলে তোমার অসুখ সারে। কী তোমার চাই। রাজকন্যে ফুঁপিয়ে বলল, আমার ধুলোমুঠি কাপড় চাই।…ও! ধুলোমুঠি কাপড় চাই? এই কথা? রাজা হাসে, রানি হাসে, রাজ্যময় সবাই হাসে। রোগ ধরা পড়েছে। দিকে দিকে ঘটক ছুটল, বাজনা বাজল। রাজকন্যের বিয়ে হল। লোকলস্কর, খাওয়া-দাওয়া কত কী! দশ মাস দশ দিন বাদে রাজকন্যের ছেলে হল, হামা দিতে শিখল। ছেলেনতুন কাপড় পরে ধুলোয় পড়ে খেলল, গড়াগড়ি দিল। সেই কাপড় বুকে নিয়ে রাজকন্যে বলল, এই যে আমার ধুলোমুঠি কাপড়, এতদিনে পেলুম। রাজকন্যে যে ছেলে চেয়েছিল!

শুনে হাসি ধরে না খোকা খুকির। ওইখানে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল অমলা। বুকে হাত দিয়ে নিঃশব্দে পালিয়ে গেল সে। নিশি পাওয়া রাত্রিঞ্চরীর মতো ছুটে গেল বাগানে দু-হাতে বুক চেপে বসল ঝোপে, তাকিয়ে দেখল নিজের কোলের দিকে। নিশিঘোরে চলে এল আবার উপরে। রাজকন্যা কাঁদছে বুকের মধ্যে। আয়নার সামনে একবার দাঁড়িয়ে চলে এল প্রমথর ঘরে।

সব বাধা পেরিয়ে, সব অভিমান ছেড়ে, সমস্ত লজ্জা ছাড়িয়ে এসে বসল প্রমথর কাছে, গায়ে গায়ে। রক্ত ছুটে এল প্রমথর মুখে। একটা ঠাণ্ডা হিম স্পর্শ কিলবিল করে উঠে এল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। কেমন যেন চাপা আতঙ্কে থম থম করে উঠল মুখটা। কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না।

অমলা ফিসফিস করে বলল, একটা গল্প শুনবে?

শ্বাসরুদ্ধ নির্বাক প্রমথ। লেন্সের আড়ালে চোখ দুটো শবের মতো নিষ্পলক।

অমলা ফিসফিস করে বলে গেল রাজকন্যার গল্প। বলল, রাজকন্যে ধূলিমুঠি কাপড় চেয়েছিল।

প্রমথর উত্তেজিত হাতের ঠেলা লেগে একটা ভারী শব্দ করে পড়ে গেল লোহার পেপারওয়েট। সে উঠে দাঁড়াল। লেন্স দুটো গগলসের মতো কালো দেখাল। সে যেন আততায়ীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ করল। চাপা তীব্র গলায় বলল, আমি চাইনে।

যেন জানত অমলা। তবু চিত্রার্পিতের মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল প্রমথর দিকে। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে উঠল মুখটা। সেই না বলা কথা বলাবলি করল তারা আজ পরস্পর। আর সাতটা বছর যেন ভেঙে পড়া পাহাড়ের মতো ধ্বসে গেল হুড়মুড় করে।

চোখ দুটো অন্ধ হয়ে এল অমলার। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, কেন, কেন গো?

একটুও ব্যথা লাগল না প্রমথর। চোখের জল কয়েক ফোঁটা অ্যাসিডের মতো জ্বালিয়ে দিল তার বুকটা। তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠল তার মুখে। আশ্চর্য! কোন অন্ধগুহায় সঞ্চিত ছিল এত ঘৃণা। বলল, চাইনে এ তুচ্ছ চাওয়া। এত বড় পৃথিবী, এত অসংখ্য চাওয়া, তার মধ্যে এ অপরিহার্য নয়।

 আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল প্রমথ। যেন তার সেই অযাচিত বস্তু ঘিরে ধরেছে তার সর্বাঙ্গ। বারবার তাকে ঝেড়ে ফেলার মতো করে বলল, চাইনে। ঘৃণিত…নোংরা…।

ঘৃণিত! নোংরা! অমলার কানে যেন তীক্ষ্ণ শলাকা খোঁচাতে লাগল। যেন তার জীবনকে, তার সমস্ত সত্তাকে, তার সমস্ত অধিকারকে আঘাতে আঘাতে ঝেড়ে ফেলতে লাগল প্রমথ। কেন? কী লজ্জা! কী ভয়ংকর লজ্জা, অবহেলা, অপমান! কেন বলতে গেল সে। কেন বলাবলি হল।

প্রমথ বেরিয়ে গেল। চারপাশ থেকে ঘিরে এল আলমারিগুলি। অনেক বই, অনেক রকম দর্শন, সমাজ, শিক্ষা, শাস্ত্র। তার মাঝে ধুলোমুঠি কাপড়কে ছিন্নভিন্ন করে সমস্ত বইগুলি যেন ব্যঙ্গ করে হাসছে। প্রমথর নাম-ছাপা বই। দেয়ালে হাসছে লন্ডনের শিশুদের একটা প্রকাণ্ড ছবি।

তবু রক্ত কণায় কণায় দোলা তো থামে না।

কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে ছেদ পড়ল না কোথাও। ভাঙন ধরল না কোনও রাত্রির বুকে। ফাল্গুন গিয়ে এল চৈত্র। পাগলা বাতাসে ঘূর্ণির লক্ষণ। চৈতালী ঘূর্ণি। এক মাস চলে গেছে। কুঞ্জদা লোক পাঠিয়ে অন্যত্র নিয়ে গেছেন আরতিকে। আশীর্বাদ করেছেন প্রমথ আর অমলাকে। আরতি যাওয়ার সময় কেঁদেছে। ছোট্ট মেয়েটি বিদায় নিয়েছে করুণ হেসে। ছেলেটি কোল ধামসেছে, আমলা মাছিকে সারা গায়ে আদর করে চুমো খেয়ে গেছে। রক্তের মধ্যে ধুইয়ে ধুইয়ে জ্বালাটা বাড়ছে, বড় হয়ে একটা মূর্তি ধরেছে।

একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে সারা বাড়িটা। এত নিঃসঙ্গ, এত ফাঁকা তো কোনওদিন ছিল না। ঝোড়ো হাওয়া যে এ বাড়িটার গায়ে এমন শব্দ করে মরে, তা তো আগে শোনা যায়নি।

রাতে শুতে যাওয়ার আগে অমলা তার সেই পুরনো স্বরটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল। বলল, বাড়িটা কী ফাঁকা!

প্রমথ জবাব দিল, হ্যাঁ, চিরদিনই ছিল।

 চিরদিনই থাকবে?

প্রমথ দৃঢ়স্বরে বলল, হ্যাঁ। এই তো আমি চেয়েছিলুম, তুমি আজ সব ভুলে যাচ্ছো।

কী চেয়েছিলে?

প্রমথ বলল, এই নিঝুমতা, আমার এই স্টাডিরুম, যে স্টাডিরুমের কথা বলাবলি করে সারা কলকাতার লোক। ফিউডাল ভাঁড়ামির শিকড় উচ্ছেদ করে আমি আমার এক জ্ঞানতপস্যার আশ্রম করতে চেয়েছিলুম এটা। যেখান থেকে এই সমাজের স্তরে ছড়িয়ে পড়ব আমি। আমার শিক্ষা, আমার কাজ…

আর আমি?

প্রমথ উত্তর দিল, তুমি আমার সঙ্গিনী, সহধর্মিণী।

তোমার কোন সঙ্গের, কোন ধর্মের?

আমার কাজের

আর তোমার দেহের।

স্তব্ধ হল প্রমথ। তার মুখের আড়ষ্ট রেখাগুলি তীক্ষ্ণ নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। একটু থেমে বলল, তাই। দেহকে তো বাদ দেওয়া যায় না।

কে যেন কালি ছিটিয়ে দিল অমলার মুখে। তীব্র গলায় বলল, বাদ দিতে হয় শুধু তার ফলকে। তোমার এই অফুরন্ত ভাণ্ডারে গলা টিপে মারতে হয় তাকে, অপমান করতে হয়।

বাষ্পরুদ্ধ হল অমলার গলা। প্রমথ বলল, না। কে না জানে, আমি আজ ছড়িয়ে আছি হাজারো শিশুকে নিয়ে, হাজারো মায়েদের নিয়ে। দেশের সেই ফলকে নিয়েই আমার দিবানিশি কাজ।

এতদিন এত করেও আজ অমলা বলল, তাতে আমার কী? আমি কী পেলুম?

যা আমি পেয়েছি।

অমলা বলল, তুমি যা পেয়েছ, আমি যে তার কিছুই বুঝিনে। আমি তোমাকে সব দিয়েছি। আমার সব নিয়ে তুমি আমাকে কিছুই দাওনি। তোমার আমার এই প্রতিদিনের নিষ্ফল দেহ কিছুই নয়, কিছুই দাওনি তুমি।

প্রমথ অস্থিরভাবে ঘৃণাভরে বলে উঠল, সবই দিয়েছি। ওটা দেওয়ার কিছু নয়।

ফিসফিস করে চাপা গলায় বলল অমলা, কেন নয়? তোমার মাতৃসংঘে আর একটি মা বাড়বে। তোমার শিশু সমিতিতে একটি নতুন নাম লেখা হবে।

না। তীব্র ঝাঁঝালো গলায় হিসিয়ে উঠল প্রমথ, এখানে আর কিছু থাকবে না। এখানে, এই বাড়িতে, এই ঘরে, তোমার আর আমার মাঝখানে–

–শুধু তোমার কাছে আমি…? কথাটা শেষ করতে পারল না অমলা। ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

.

বাইরে চৈত্র বাতাসের হাহাকার। রাত্রিটা কোথায়, কোন অন্ধকারে বুক চেপে কাঁদছে।

সমস্ত চৈত্ররাত্রিগুলি কেঁদেছে মাস ভরে। রাত্রে শোবার ঘরে প্রমথ পায়চারি করেছে একলা। দিনে দিনে তার মূর্তিটা যেন আরও বড়, বিশাল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ঘরের মধ্যে। ঘাড়ের পাশের মাংসপেশিগুলি হয়ে উঠেছে আরও সবল শক্ত। নিঃশব্দে ফুঁসছে কেবলই। পাশের ঘরের অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে থেকেছে অমলা। শীর্ণ হয়েছে। কালি পড়েছে চোখের কোলে। তবু অপমান কালো মুখ নিয়ে দিনের বেলা সে বেরিয়েছে প্রমথর সঙ্গে, কাজ করেছে, খেয়েছে। শুধু যে রাত্রির চেহারা করাল হয়ে উঠেছে তার কাছে, সেই রাত্রির কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারেনি। সাত বছরের সমস্ত রাত্রি তাকে ব্যঙ্গ করেছে। সাত বছর ধরে তার নারীত্ব মিটিয়েছে একটা বোবা ক্ষুধা। ক্লীব বাসরের অভ্যাসের দাসী হয়ে সে ফিরেছে এতদিন মহা আনন্দে। আশ্চর্য! কী অদ্ভুতভাবে আজ সমস্ত ব্যাপারটা তার আসল চেহারা নিয়ে দেখা দিয়েছে। তার চাওয়া, চাইতে যাওয়া এক ভয়াবহ লজ্জাকে শাড়ির ফাঁস দিয়ে হত্যা করতে চাইছে। অন্ধকারের মধ্যে সমস্ত বাড়িটা একটা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধরে এসে দাঁড়ায় তার সামনে। সেখানে ঘোরাফেরা করতে দেখে, তার না-দেখা প্রমথর বাবাকে, মাকে, মামা আর তার বন্ধুদের। তারপর চমকে আতঙ্কিত চোখে দেখে তার সামনে এক মূর্তি। তার চোখ নেই, মুখ নেই, মাথায় চুল নেই। শুধু বিশাল ভয়ংকর মূর্তি। অস্ফুট আর্তনাদ করে চেয়ে দেখে, সে মূর্তি প্রমথর। পোশাক বদলে এসেছে সেই পুরনো জীবটা। সে শুধু সর্বগ্রাসী আলিঙ্গনে অমলাকে নিঃশেষ করে দিতে চায়।

অন্ধকারে নিজের বুকে হাত বুলোয় অমলা। বুকে, পেটে, তার সর্বাঙ্গে। বিচিত্রানুভূতি জাগে তার শরীরে আর মনে হয়, সমস্ত রক্ত বুকে জমে বিন্দু বিন্দু হয়ে ক্ষরে পড়ছে।

প্রমথ প্রতীক্ষা করছিল আর জ্বলছিল তীব্র ঘৃণায়। সে আশা করছিল, তার যুক্তি ও পৌরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করবে অমলা। গাইবে তার বুকের কাছে এসে, ওহে সুন্দর! মরি মরি! কিন্তু প্রতীক্ষা যত দীর্ঘ হচ্ছিল, ততই বাঁধ ভেঙে পড়ছিল তার। নিষ্ফল আক্রোশে ফুলছিল।

বিকালে তৈরি হল না অমলা বেরুবার জন্যে। ঝিমিয়ে পড়া বাতাসের বৈশাখী বিকাল। গাছপালাগুলি সব থমকে গেছে। একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসছে চারদিক থেকে। গুমোট আর অন্ধকার ভিড় করে আসছে যেন।

প্রমথ অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ প্রত্যহের বিকালেও ছেদ পড়ছে।

হঠাৎ বাতাস উঠল। বড় রাস্তার ট্রামের ঘরঘরানি গোঁ গোঁ করে ধেয়ে এসে ধাক্কা দিল কানের কাছে। প্রমথ আক্রোশে অচৈতন্য অস্থির পায়ে এসে দাঁড়াল অমলার কাছে। বলল, বেরুবার সময় হয়েছে।

অমলা শান্ত গলায় জবাব দিল, জানি। তুমি যাও। আমি একলা যাব।

অসহ্য ক্রোধে ভয়ংকর হয়ে উঠল প্রমথর মুখ। বলল, না, তা যাওয়া হবে না।

 চকিতে দৃপ্ত ভঙ্গিতে মাথা তুলল অমলা, কেন?

কেন? কেন? চোখের লেন্স দুটো নীলচে ইস্পাতের মতো ঝকঝকিয়ে উঠল। কোনওদিন যাওনি। সাত বছরের প্রতিটি দিন, এই সন্ধ্যায়,–

সাত বছরের প্রতিটি দিন। কান্নাচাপা গলায় ফিসফিস করে উঠল অমলা, প্রতিটি দিন তুমি ভুলে গেছ, আমি একটা মেয়ে।

হ্যাঁ, নক্কারজনক, আদিম, ভালগার একটা মেয়ে।

কঠিন হয়ে উঠল অমলার মুখ। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে জোর করে নীরব রইল সে। প্রমথ তীব্র চাপা গলায় গর্জন করে উঠল, আজকের অযোগ্য, রুচিহীন। যখন মেয়েরা খুঁটে খেয়ে বাঁচতে চাইছে, বাঁচার জন্যে ছুটেছে–

হ্যাঁ, বাঁচার জন্যে। তীব্র গম্ভীর গলায় বলে উঠল অমলা, কিন্তু মেয়ে হয়ে একজন মেয়ের মতো করে। তুমি আমার সে অধিকারটুকুও মানোনি। বোলো না, বোলো না তুমি আজকের মেয়েদের কথা।

কিন্তু বিদ্বেষে অন্ধ প্রমথ বলে চলল, আর তুমি, খেয়ে, পরে, একটা পুরুষের সামনে নির্লজ্জের মতো…

কানে আঙুল দিয়ে তীব্র আর্তনাদ করে উঠল অমলা, বোলো না, বোলো না। বড় নির্লজ্জ। মেয়ে হয়ে এত লজ্জা আর সইতে পারিনে, পারিনে।

বলে সে তড়িৎপায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে স্তব্ধতার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ল বাইরের ঝড়ের শব্দ। ধুলোর ঝড় আর অন্ধকার। মেঘের গর্জন আর বাতাসের শাসানি। দুজনেই স্তব্ধ নির্বাক। বাকহীন প্রমথ, ভীত আতঙ্কিত লেন্স দুটো দিয়ে তাকিয়ে রইল অমলার দিকে। তার প্রতি রাত্রের সেই লালসাতৃপ্ত চোখ, যে চোখ ওই দেহ লেহন করতে না পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, আর যেন চিনতে পারছে না অমলাকে। বাতাস ঢুকছে ঘরে। লন্ডনের শিশুদের ছবিটা যেন খিলখিল করে হাসতে লাগল তার আর অমলার মাঝখানে এসে। দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে সে বলে উঠল, না, না, পারব না।

কী যেন বলল অমলা ফিসফিস করে। ছিটকে বাইরে গিয়ে দরজাটা টেনে দিল দড়াম করে। শব্দটা প্রতিধ্বনিত হল, তারপর হারিয়ে গেল হাওয়ায়।

সাত বছর আগে একদিন যে গান গেয়ে ঢুকেছিল এ বাড়িতে, সে গান গাওয়া তার শেষ হল না। ওহে সুন্দর, মরি মরি! সুন্দর থেকে সুন্দরতরকে চেয়েছিল সে। হে সুন্দর। কী সুন্দর।

কী সুন্দর তুমি।

দুরন্ত ঝড়, আঁধি বইছে। বাগানটা লুটোচ্ছে। হাট করে খুলে গেছে গেটটা। চাকরটা বড় বড় চোখে হাঁ করে চেয়ে দেখছে অমলাকে। উপরে সেই দরজাটায় একটুও শব্দ নেই। গলির রকে ছেলেগুলি দেখলে বলত, আরে শালা! জোড়া যে ভাঙা দেখছিরে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *