মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস
ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র নান্দনিক-এর বর্ষা সংখ্যায় শুয়োপোকার খোলসত্যাগ’ শিরোনামে সমালোচক সালাউদ্দীন তাবরেজির একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। দীর্ঘ, তথ্যবহুল এ নিবন্ধে সমালোচক আমাদের সময়কার রহস্যময় লেখক মইদুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। সালাউদ্দীন তাবরেজির পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। তাঁর গদ্য সুখপাঠ্য, যুক্তি ধারালো এবং অন্তর্দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তার পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত না হওয়ার অবকাশ কম। তবে নিবন্ধের শেষ দিককার কয়েকটি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাকে দ্বিমত পোষণ করতে হচ্ছে। আমি সেই জায়গাগুলো তুলে ধরে আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
মইদুল ইসলামের সাহিত্যকীর্তিকে তিনটি ধাপে ভাগ করেছেন। সমালোচক–প্রারম্ভিক পর্ব, মধ্য পর্ব (যেটিকে অনেকে তার নিরীক্ষাকাল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন) এবং চূড়ান্ত পর্ব। মইদুল ইসলামের শেষ তিনটি উপন্যাসকে চূড়ান্ত পর্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন সমালোচক এবং এগুলোকে তার সামগ্রিক লেখক জীবনের কালমিনেশন বা চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে এক দশক ধরে এ রকম বিশ্লেষণ একপ্রকার সাহিত্যিক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। যেকোনো মনোযোগী পাঠক এটা লক্ষ না করে পারবেন না। এসব সমালোচনা আসলে একই বক্তব্যের চর্বিত চর্বন। একটি লেখা থেকে আরেকটি লেখা আলাদা করা যায় না এবং এগুলো লেখক মইদুল ইসলাম বা তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমাদের নতুন কোনো তথ্য দেয় না।
শেষ তিনটি উপন্যাস সম্পর্কে আমি কেবল যে সমালোচক সালাউদ্দীন তাবরেজি এবং সেই সূত্রে অপরাপর সমালোচক ও বোদ্ধা পাঠকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি, তা-ই নয়, আমি খুব দৃঢ়ভাবে মনে করি, তারা বিভ্রান্ত। আর এই বিভ্রান্তির উৎস লেখক মইদুল ইসলামের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা। এটা অবশ্য পুরোদস্তুর সমালোচকদের দোষ নয়। কেননা জীবদ্দশায় লেখক মইদুল ইসলাম একপ্রকার নির্জন, নিভৃতচারী এবং সর্বোপরি তথ্যপ্রতিবন্ধক জীবন যাপন করে গেছেন। নিভৃতচারী বললে অবশ্য সত্যের অপলাপ হবে। তিনি অসামাজিক ছিলেন, এ কথা বলার অবকাশ নেই। তিনি আসলে শুধু সাহিত্যিক-সুধীজন পরিমণ্ডল সযত্নে পরিহার করে চলতেন। সমসাময়িক লেখক কবিদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল। তিনি কোনো সাহিত্যবোদ্ধা বা কননাইসারদের আড্ডায় যোগ দিতেন না। বাংলা উপন্যাসে ফার্সি শব্দের প্রয়োগ নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে একদা মৃদু বচসা এবং পত্রিকার পাতায় কয়েকটি চিঠি চালাচালি ছাড়’ আমরা সাময়িকপত্রে তার আর কোনো উপস্থিতি দেখতে পাই না তাঁর বাসাতেও কাউকে তিনি নিমন্ত্রণ জানাতেন না। মইদুল ইসলামের সংসারজীবন সম্পর্কে আমরা অল্পবিস্তর যা জানি, তা তার স্কুলের সহপাঠী এবং মায়ের দিককার আত্মীয় (সম্ভবত মায়ের ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে) মির্জা একরামুল বাশারের দিনশেষের রাঙা মুকুল নামে ৬৪ পৃষ্ঠার এক অপরিসর গ্রন্থের কল্যাণে। বৈঠকি ঢঙে লেখা এই ক্ষুদ্রায়তন পুস্তিকাটিকে কোনোভাবেই মইদুল ইসলামের অফিশিয়াল বায়োগ্রাফি বলার অবকাশ নেই, তবে এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না, অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে লেখা, দুর্বলভাবে সম্পাদিত, মুদ্রণপ্রমাদে ঠাসা, ‘পুষ্টিহীন’ (যেমনটা হুমায়ুন আজাদ এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন বলে শুনেছি) এই গ্রন্থটি প্রকাশের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠকের ক্ষুন্নিবৃত্তি। আর এটি মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনের অনেক অপ্রয়োজনীয় ডিটেইলের ওপর আলোকপাত করে বটে, তবে তার সৃজনকৌশল, পাঠরুচি, লেখার অভ্যাস বা তার অন্তর্জগৎ সম্পর্কে আমাদের প্রায় কিছুই জানায় না। অনুমান করতে দ্বিধা করছি না, লেখকের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে সমালোচক তাবরেজি মহাশয়ের জ্ঞানের দৌড় মির্জা একরামুল বাশারের চটি গ্রন্থটির বাইরে বিস্তৃত হওয়ার অবকাশ পায়নি।
লেখক মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে ডিটেইল তথ্য অবগত হওয়ার বিষয়টিতে আমি অশেষ গুরুত্ব দিতে চাই। তার কারণ এই নয় যে, নিও রিয়ালিস্টদের মতো আমিও বিশ্বাস করি, লেখকের সাহিত্যকর্ম তাঁর ব্যক্তিজীবনেরই একটি এক্সটেনশন। সে রকম নয়। আমার বিশ্বাস বরং এর বিপরীত কিছুই হবে। আমি যেটা জোর দিয়ে বলতে চাই, সেটা হলো, কেবল লেখক মইদুল ইসলামের ক্ষেত্রে তাঁর শেষ দিককার সাহিত্যকর্মগুলোর যথাযথ মূল্য বিচার করতে হলে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই কিছু তথ্য জানা থাকতে হবে। আমার সৌভাগ্য যে সেই তথ্যগুলো জানার সুযোগ আমার হয়েছে। কীভাবে হয়েছে, সেটা আমি যথাস্থানে বলব। এক্ষনে শুধু এটা বলে রাখি যে, এসব ব্যক্তিগত তথ্যই মইদুল ইসলামের শেষ তিনটি উপন্যাস প্রশ্নে সমালোচক সালাউদ্দীন তাবরেজির মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণে আমাকে বাধ্য করছে।
আমি খুব সংক্ষেপে কিন্তু স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব তাবরেজির সঙ্গে কেন আমি দ্বিমত পোষণ করি এবং আমার বক্তব্যের ভিত্তি কী।
সালাউদ্দীন তাবরেজি তার ১৫ পৃষ্ঠার নিবন্ধে এটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে মইদুল ইসলামের পূর্বেকার সকল সাহিত্যকর্মের পাশে তাঁর শেষ তিনটি উপন্যাসকে (গিরগিটি, বেহুলার বাসর এবং তারাশঙ্করের ডায়েরি) যতই সাজুয্যহীন বা বিসদৃশ দেখাক না কেন, বা তাঁর কট্টর ভক্তদের মধ্যে এগুলো যত হতাশা আর নেতিবাচক আলোড়নই তুলুকু না কেন, এ তিন উপন্যাস তার সাহিত্যিক বাঁক পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করছে। এবং এই বাঁক পরিবর্তনের ধারা আসলে আরও আগে থেকে শুরু হয়েছিল, বিশেষ করে তার অষ্টম উপন্যাস লুকের ছায়া থেকে আমরা এর ইঙ্গিত পেতে শুরু করি। আর এই ‘সিন্দাবাদীয় অভিযান’ পরিণতি পেয়েছে শেষ তিন উপন্যাসে এসে।
আমি বলব, এটি তাবরেজি মহাশয়ের কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। সাহিত্য আলোচনার একটি সুবিধাজনক দিক হলো, যেকোনো পূর্বানুমানের পক্ষে ভূরি ভূরি তথ্যপ্রমাণ সর্বদা হাতের কাছে হাজির পাওয়া যায়।
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মইদুল ইসলামের শেষ তিনটি উপন্যাস নিয়ে এত আলোচনার অবকাশ তৈরি হয়েছে মূলত দুটি কারণে; প্রথমত, ওই তিন উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কট্টর (আমি বলব ‘জেহাদি) ভক্তরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, একটি অংশ খুব আহত বোধ করেছে এবং তারা এটিকে তাদের প্রিয় লেখকের এত দিনকার র্যাডিক্যাল অবস্থানের প্রস্থানবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করেছে, দ্বিতীয় শ্রেণির ভক্তরা তাঁর লেখার এ আকস্মিক ও প্রবল বাঁক পরিবর্তনকে গ্রহণ করেছে হেনরি জেমস কথিত ‘লিটারারি ইনএভিটাবিলিটি হিসেবে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, ওই তিন উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা মইদুল ইসলামের মতো একজন কাল্ট লেখকের ক্ষেত্রে কেবল বিম্ময়করই নয়, অস্বাভাবিকও বটে। আমি শুনেছি, তার গিরগিটি উপন্যাসটি প্রথম বছরেই সাতটি এডিশন প্রকাশিত হয়েছিল।
মইদুল ইসলামের লেখনশৈলীর এই ‘জন আপডাইকিয়ান। উল্লম্ফন এবং তাঁর পাঠকপ্রিয়তা অর্জনের ঘটনাটি একই সঙ্গে ঘটেছিল। কাজেই এটা সহজে অনুমেয় যে লেখার ভঙ্গিমা বদলানোর কারণেই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এটাই অনিবার্য সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটাও ভুললে চলবে না যে এই জনপ্রিয়তা অর্জনের বিষয়টি তার পুরোনো কট্টর ভক্তদের কারও কারও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং তারা তখন থেকেই ঘটনাটির নানা রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর প্রয়াস চালিয়ে আসছেন। বলা বাহুল্য নয়, সালাউদ্দীন তাবরেজির সমালোচনা সেই প্রয়াসের একটি দৃষ্টান্তমাত্র। মইদুল ইসলামের জীবনের শেষ তিনটি উপন্যাসকে “হংস মাঝে বক” হিসেবে না দেখে লেখকের সুচিন্তিত এবং দীর্ঘমেয়াদী খোলস পরিবর্তন হিসেবে দেখা (যে কারণে নিবন্ধের শিরোনাম ‘শুয়োপোকার খোলসত্যাগ) এবং এই তিন উপন্যাসকে তার সাহিত্যিক পথপরিক্রমণের চূড়ান্ত পরিণতি প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বস্তিলাভ ঘটে।
আমি এই অবস্থান মেনে নিতে রাজি নই। ওই তিন উপন্যাস যত অস্বস্তিই তৈরি করুক না কেন, আমাদের এটা মানতে প্রস্তুত থাকতে হবে যে, মইদুল ইসলামের তাবৎ সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে এগুলো সাযুজ্যহীন। এগুলো গ্রহণ করার জন্য তিনি তাঁর পাঠককুলকে মোটেও প্রস্তুত করেননি, তাঁর লেখনী এগুলোর কোনো পূর্বাভাস বহন করে না। এর কেবল একটিই ব্যাখ্যা হতে পারে, এবং যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ছলচাতুরির আড়াল সরিয়ে। আমি সেটা অকপটে জোর গলায় বলতে চাই : ওই তিন উপন্যাস মইদুল ইসলামের লেখা নয়!!!!
আমি জানি, আমার বক্তব্য অত্যন্ত কর্কশ শোনাবে, অনেকের কাছে এটা খুবই রুচিহীন মনে হবে, তবে এ কথা বলার মধ্য দিয়ে আমি বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছি না। কোনো সাহিত্যিক কেলেঙ্কারির অনুপ্রবেশ ঘটানো আমার অভিপ্রায় নয়। আমি কেবল সেই কথাটিই স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করছি, যেটি গত এক দশক ধরে তার সীমিত অথচ নিষ্ঠ ভক্তদের মনে অবিরত গুঞ্জরিত হচ্ছে।
আমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে আমি মইদুল ইসলামের সাহিত্যকর্মকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে তুলনা টানব না। আমার স্বৰ্গত বন্ধু আবুল খায়ের সে কাজটি সুচারুভাবে করে গেছেন। আমি বরং মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনের কয়েকটি তথ্যের দিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে বলব। এই সব তথ্যের উৎস পরোক্ষ হলেও এগুলোর অথেনটিসিটির ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।
পশ্চিমের কাল্ট মুভির ধারণা ধার করে মইদুল ইসলামকে কাল্ট লেখক হিসেবে অভিহিত করেছেন মরমি কবি সুকুমার রায় (ছড়াকার সুকুমার রায় নন, ইনি বিক্রমপুর সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক)। আমার ধারণা, তার এ অভিধা সীমিত আকারে হলেও গ্রহণ করা যায়। এটা ঠিক যে, মইদুল ইসলামের লেখার ভক্ত পাঠককুল সংখ্যায় খুব সীমিত ছিল, তবে এরা তাঁর প্রতি ছিল মোহমুগ্ধ, রিলিজিয়াস কাল্টের মতো তাঁর ভক্ত পাঠকেরা নিজেদের মধ্যে একপ্রকার যোগাযোগ রক্ষা করত, একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব বোধ করত এবং তার লেখা নিয়ে তারা নিয়মিত আনুষ্ঠানিক আড্ডার আসর বসাত। এ রকম দুয়েকটি আসরে যোগদানের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল এবং সেগুলোর একটিতে আমি তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের অবতার হিসেবে। অভিহিত হতে দেখেছি। পাঠককুলের কাছ থেকে এ রকম একনিষ্ঠ ভক্তিভজনা উপভোগের ক্ষেত্রে মইদুল ইসলামকে অনায়াসে কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তবে কমলকুমারের মতো তাঁর গদ্য দুর্বোধ্য, দুর্গম ছিল না। তিনি বরং কিছুটা লিরিক্যাল গদ্য লিখতেন। অপরাপর কাল্ট লেখকের মতো তিনি বিরলপ্রজও ছিলেন না। মইদুল ইসলাম নিয়মিত লিখতেন এবং দু কি তিনটি নির্দিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা থেকে তাঁর বই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হতো। লেখার রহস্যময়তার কারণে অনেকে তাকে কাফকার সঙ্গে তুলনা করতেন, তবে আমার মনে হয় লেখনভঙ্গি আর বিষয়বস্তুর দিক থেকে মার্কিন লেখক ডোনাল্ড বার্থলমের সঙ্গেই তার বেশি মিল পাওয়া যাবে। একাধিক সূত্রে আমি শুনেছি, আমেরিকান লেখকদের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। তার লেখার টেবিলের একপাশের দেয়ালে ফিলিপ রথের একটি ছবি অ্যাডহেসিভ টেপ দিয়ে ঝোলানো পাওয়া গেছে বলে মির্জা একরামুল বাশারের বইয়ে উল্লেখ দেখেছি।
মইদুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিতে গিয়ে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার একটি বিষয় লক্ষ্য করতে প্রায় সকলেই ভুলে যান কিংবা আমার ধারণা বিষয়টি সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। আর সেটি হলো, শেষ জীবনে মইদুল ইসলামের গুরুতর অসুস্থতা। বিষয়টিকে আমি মামুলি বলে উড়িয়ে দিতে চাই না। কেননা, মইদুল ইসলামের অসুখটি জটিল ছিল, একটি বিরল প্রাণঘাতী রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং এটা লক্ষ না করার কোনো কারণ নেই যে, আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যে তিন উপন্যাস, তার সব কটিই অসুস্থাবস্থায় লেখা। এগুলো লেখার সময় তিনি শুধু যে শয্যাশায়ী ছিলেন, তা-ই নয়, প্রায় সব অর্থে তিনি ছিলেন অথর্ব।
পরিবারের দিক থেকে যত গোপনীয়তা অনুসরণের চেষ্টাই করা হোক না কেন, এ কথা এখন আর কারও অজানা নয় যে, ৪২ বছর বয়সে মইদুল ইসলাম অ্যামাইয়োটোপিক ল্যাটারাল স্কেরোসিস বা সংক্ষেপে এএলএস নামে বিরল এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এটি অত্যন্ত ভয়াবহ ধরনের নিউরো ডিজেনারেটিভ অসুখ। তবে কোনোভাবেই এটি বংশগত নয়। এ রোগের পরিণতিতে মইদুল ইসলামের স্নায়ুতন্ত্রের মোটর নিউরোন কোষ শুকিয়ে যেতে থাকে। তার দেহের সকল পেশী একে একে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। রোগ শনাক্ত হওয়ার তিন মাসের মাথায় মইদুল ইসলাম লক্ষ করেন, তিনি তার দেহের কোনো অঙ্গই আর নাড়াতে পারছেন না। তাঁকে স্থায়ীভাবে শয্যা নিতে হয়। তাঁর বাকশক্তি পুরোপুরি লোপ পায়। বিছানায় অনড়ভাবে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা ছাড়া তাঁর আর কিছু করার ছিল না। আর সকলে জানতেন যে, সেই মৃত্যু খুব দূরাগত নয়। কেননা এ রোগ শনাক্ত হওয়ার পর রোগীর খুব। বেশি দিন বাঁচার ইতিহাস নেই।
এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মইদুল ইসলাম যখন পুরোপুরি অথর্ব অবস্থায় স্থায়ীভাবে শয্যা নেন, সে মুহূর্তে তিনি তার ত্রয়োদশ উপন্যাস ফেরারির সপ্তদশ অধ্যায় লিখছিলেন, যেটি (আমরা এখন জানি) ওই উপন্যাসের পেনাল্টিমেট চ্যাপ্টার। এই অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে মইদুল ইসলামের শেষ অবদান হওয়ার কথা ছিল এবং এখানেই তার দীর্ঘ সাহিত্য জীবনের ইতি ঘটার কথা। কিন্তু তা হয়নি। ফেরারি উপন্যাসটি শুধু যে সমাপ্ত হয়ে ছাপা হয়ে বেরিয়েছে, তা ই নয়, এর পর আরও পাঁচটি উপন্যাস লিখেছেন মইদুল ইসলাম, বলাই বাহুল্য সব কটি ও রকম অথর্ব অবস্থায়।
এই বিস্ময়কর ঘটনার পেছনের মানুষটির নাম প্রণবেশ মাইতি। ইনি মইদুল ইসলামের লেখার জেহাদি ভক্তদের একজন। আশির দশকে ঢাকায় মইদুল ইসলামের ভক্তদের যে কটি পাঠচক্র গড়ে ওঠে, ইনি তার একটির উৎসাহী সংগঠক ছিলেন। অত্যন্ত উদ্যমী ধরনের এ মানুষটি পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য পশ্চিমে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তবে প্রবাসে থেকেও তিনি প্রিয় লেখকের লেখনীর নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন এবং শোনা যায়, যে-গুটিকয় ভক্ত মইদুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন, প্রণবেশ তাঁদের অন্যতম।
মইদুল ইসলামের এএলএস রোগ ধরা পড়া এবং তাঁর শয্যা নেওয়ার সময় পোসাম’ নামে একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরি করতেন প্রণবেশ। কেমব্রিজ-ভিত্তিক এই কোম্পানিটি ইলেকট্রনিক অ্যাসিসটিভ টেকনোলজি বা ইএটি ব্যবহার করে প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা রকম যন্ত্র তৈরি করে থাকে। এই সব যন্ত্র বাইরের জগতের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এখানে স্মরণ করিয়ে দিই, এই পোসাম কোম্পানির গবেষক ডেভিড ম্যাসন একদা এএলএস রোগে আক্রান্ত স্টিফেন হকিংকে একটি ইলেকট্রনিক ভয়েস সিনথাসাইজার বানিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেটি হকিং বহুদিন পর্যন্ত ব্যবহারও করেছিলেন। এই সিনথাসাইজারের শ্লেষ্মজড়ানো, ভৌতিক কণ্ঠস্বরকেই আমরা হকিংয়ের মহাজাগতিক কণ্ঠস্বর হিসেবে চিনি। পোসাম কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে ডেভিড ম্যাসনের অধীনে কাজ করতেন প্রণবেশ। এক আইরিশ বিধবার সঙ্গে যেদিন তিনি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন, সেদিন বিয়ের আসরেই টেলিফোনে তিনি প্রিয় লেখকের রোগের সংবাদ পান। বিবাহ মুহূর্তের রোমান্টিক পরিবেশের কারণে সে সময় সম্ভবত বেশ কিছুটা আবেগপ্রবণ ছিলেন প্রণবেশ। তিনি প্রতিজ্ঞা করে বসেন, মইদুল ইসলামের লেখনীর অকালমৃত্যু প্রতিরোধে তিনি তাঁর সকল শক্তি ও মেধা ব্যয় করবেন।
আমি মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেকখানি সরে এসেছি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার বক্তব্য অনুধাবনে এইসব অনুপুঙ্খ তথ্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলেই আমার বিশ্বাস। আশা করি পাঠক মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনবেন।
প্রণবেশ প্রথমটায় মইদুল ইসলামের জন্য একটি রেগুলার ভয়েস সিনথাসাইজার বানিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সে উদ্যোগ তাঁকে পরিত্যাগ করতে হয়। কেননা এই যন্ত্র ব্যবহার করতে হলে ব্যবহারকারীকে শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ (হাত বা পায়ের অন্তত একটি আঙুল) নাড়াতে সক্ষম হতে হবে। মইদুল ইসলামের সেই সক্ষমতাও ছিল না। তিনি সম্পূর্ণরূপে জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। বাকশক্তি হারানোর অল্প কিছুদিনের মধ্যে দৃষ্টিশক্তিও লোপ পেয়েছিল তাঁর। কেউ যেন সুসজ্জিত একটি ঘরের দরজা-জানালা এক এক করে বন্ধ করে দিচ্ছে। তবে তাঁর সব জানালা বন্ধ হয়ে যায়নি। মইদুল ইসলামের শ্রবণশক্তি শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল, যদিও সেটা জানা গিয়েছিল আরও পরে। সেই মুহূর্তে কেবল এটিই স্পষ্ট করে জানা গিয়েছিল যে কোনো এক অজ্ঞাত উপায়ে মধ্যবয়সী এই লেখকের মস্তিষ্কটি সম্পূর্ণ অনাহত আছে। তিনি স্বাভাবিক উপায়ে সবকিছু চিন্তা করতে পারছেন, এবং তাঁর স্মৃতিও অটুট আছে। প্রণবেশ এই তথ্যটি পেয়েছিলেন।
আজ থেকে ১১ বছর আগে প্রণবেশ মাইতি এক সংক্ষিপ্ত সফরে দেশে আসেন। সেটা শ্রবণ মাস ছিল। অঝর বৃষ্টিতে ঢাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। শাহজাহানপুর রেলগেটের এক কোনায় গাড়ি রেখে এক সহযোগী যুবককে সঙ্গে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু পানি ডিঙিয়ে প্রণবেশ এসেছিলেন মইদুল ইসলামের বাসায়। দুজনের হাতে প্যাকেটবদ্ধ ভারি কিছু যন্ত্রপাতি। তাদেরকে লেখকের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চারটি প্যাকেট খুলে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়া লাগিয়ে তাঁরা যে যন্ত্রটি দাঁড় করান, সেটি দেখতে একটি আইবিএম ডেস্কটপ কম্পিউটারের মতো।
শুনেছি এই পুরো সময়টা একজন বেতনভূক পেশাদারের নিবিষ্ট উদাসীনতায় কাজ করে গেছেন প্রণবেশ মাইতি। পাশেই শয্যায় শায়িত খাকিরঙা একটি সিল্কের শাল দিয়ে শরীর ঢাকা প্রিয় লেখকের দিকে তিনি একবার তাকিয়েও দেখেননি। তাঁর পাশে দুবার কফি রাখা হয়েছিল, তিনি স্পর্শ করেননি। অচল রোগীকে ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন দেওয়ার জন্য পাড়াতো ডিসপেনসারি থেকে ডেকে আনা একজন ভাড়াটে মেডিক্যাল অ্যাসিসট্যান্টের মতো নির্লিপ্তি ছিল তার কর্মকাণ্ডে।
যন্ত্রটি দাঁড় করিয়ে ঘরের এক কোনায় রাখা একটি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছিলেন পরিশ্রান্ত প্রণবেশ, তারপর জোরে নিশ্বাস ছেড়ে একটি অচেনা বিদেশি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। সম্ভবত ভেতরে ভেতরে তিনি কিছুটা উত্তেজিত থেকে থাকবেন। ঘরে আরও দুয়েকজন বয়স্ক লোকের উপস্থিতি ছিল। সকলের সামনে এভাবে সিগারেট ধরানো যে এ দেশে স্বাভাবিক রীতি-রেওয়াজের মধ্যে পড়ে না, সেটা তার না জানার কথা নয়। সিগারেট টানতে টানতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি। প্রিয় লেখকের দিকে নয়, নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে ছিলেন সেগুন কাঠের একটি তেপায়া টেবিলের ওপর রাখা সদ্য বানানো যন্ত্রটির টিকে। তারপর ঘরের সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইংরেজিতে বলে উঠেছিলেন, ‘নাউ হি ক্যান রাইট’।
এভাবে মইদুল ইসলামের ‘মূল্যবান’ লেখনীকে আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখার একটি বন্দোবস্ত হয়েছিল। আর সেটা হয়েছিল তার ভক্ত পাঠক প্রণবেশ মাইতির বানিয়ে দেওয়া যন্ত্রটির কল্যাণে।
.
যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করত, কীভাবে সেটা অথর্ব একজন লেখককে তার জড়জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিল, সেটার বিবরণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বিজ্ঞানের লোক নই। আমি কেবল এটির বহিরঙ্গের কিছুটা পরিচয় দেব।
মইদুল ইসলামের শয্যর পাশে একটি টেবিলে রাখা ছিল যন্ত্রটি : একটি এলসিডি মনিটর আর কালো প্লাস্টিকের কেসিংয়ে ভরা সিপিইউ সংবলিত যন্ত্রটিকে মামুলি ডেস্কটপ কম্পিউটার বলে মনে না করার কোনো কারণ ছিল না। তবে বলাই বাহুল্য, এটি সামান্য কোনো কম্পিউটার যন্ত্র ছিল না। এর সিপিইউর পেছন দিক থেকে বের হয়ে এসেছে চারটি ক্যাথোড় টিউব, যেগুলোর অপর প্রান্ত আঠা দিয়ে লাগানো ছিল মইদুল ইসলামের মাথার সঙ্গে। দুটি টিউব লাগানো ছিল লেখকের কপালের দুই টেম্পলে আর দুটি টিউব তার ব্রহ্মতালুর দুপাশে। এখানে বলে রাখি, এই ক্যাথোড টিউব লাগানো উপলক্ষে পূর্বেই মইদুল ইসলামের মস্তিষ্ক মুণ্ডন করা হয়েছিল এবং এ রকম মুণ্ডিত মাথায় তাকে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুঁকোর মতো দেখাচ্ছিল।
খুব সরলভাবে বললে যন্ত্রটির কাজের প্রকৃতি ছিল এ রকম : এটি মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের চিন্তাপ্রবাহ পড়তে পারত এবং এই চিন্তাপ্রবাহকে সেটি অজানা একটি ওয়ার্ড প্রসেসর ইন্টারফেসের মাধ্যমে মনিটরে লিখিত আকারে প্রকাশ করত। এভাবে বাক্যের পর বাক্য শুধু ‘চিন্তা করে’ মইদুল ইসলাম তার স্তব্ধ লেখনীকে আবার সচল করতে পেরেছিলেন। তবে এখানে বলে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না–এ প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিকভাবে সমাধা করা যতটা না কঠিন ছিল, তার চেয়ে কোনো অংশে কম কঠিন ছিল না মানসিকভাবে সমাধা করা। কেননা মইদুল ইসলাম আগে সুস্থ। অবস্থায় যেভাবে লিখতেন (শুরুতে ফুলস্কেপ কাগজে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে, পরে একটি জার্মান কোম্পানির টাইপরাইটারে ও আরও পরে একটি অ্যাপেল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে), তার সঙ্গে এবারের লিখন প্রক্রিয়ার কোনো মিল ছিল না। শব্দ ও বাক্য সুশৃঙ্খলভাবে চিন্তা করে একটির পর একটি সাজিয়ে একটি প্লটকে ফুটিয়ে তোলা খুব সহজ কাজ ছিল না। এই প্রক্রিয়ার জন্য মস্তিষ্ককে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে নেওয়ার ব্যাপার ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ কাজটি মইদুল ইসলাম অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর একটা কারণ, মইদুল ইসলাম গোড়া থেকেই গোছানো প্রকৃতির লেখক ছিলেন। একটা পূর্ণ বাক্য মনে মনে সাজিয়ে তারপর সেটি লিখতেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, একেকটি পর্বচ্ছেদ তার মাথায় আগে থেকেই সাজানো হয়ে থাকত। এ কারণে একবার একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তাকে খুব একটা সম্পাদনা করতে দেখা যেত না।
প্রণবেশের যন্ত্রটি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যেটি ছিল, সেটি হলো চিন্তা ফিল্টার করা। একজন লেখক সারাক্ষণ উপন্যাসের শব্দ আর বাক্য চিন্তা করেন না। প্রতি মুহূর্তে অজস্র চিন্তার হোত একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে যেতে থাকে। এর অধিকাংশ শুধু যে অপ্রয়োজনীয় দৈনন্দিনতা, তা-ই নয়, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের অন্ধকার ফ্রয়েডিয়ান কুঠুরিতে এমন বহু চিন্তা অনবরত পাক খেয়ে উঠে আসে, যেগুলোর প্রকাশ তার ও তার পরিপার্শ্বের জন্য ভয়ানক বিব্রতকর হয়ে উঠতে পারে। এই সমস্যাটির ব্যাপারে প্রণবেশ গোড়া থেকেই সচেতন ছিলেন। আর এ জন্য তিনি তার যন্ত্রে চিন্তা ফিল্টার করার একটি বাড়তি ফাংশন রেখেছিলেন। কোন চিন্তাটি বা একটি চিন্তার কোন অংশটি চূড়ান্তভাবে মনিটরে প্রকাশ পাবে, তা নিয়ন্ত্রিত হতো এই ফিল্টারের মাধ্যমে আর এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল লেখক মইদুল ইসলামের হাতে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, শুরুতে এই ফিল্টারের নিয়ন্ত্ৰণ মইদুল ইসলাম পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেননি, যার পরিণতিতে এক অসতর্ক মুহূর্তে পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ অল্পবয়সী আত্মীয়াকে ঘিরে মইদুল ইসলামের এমন সব চিন্তা মনিটরের পর্দায় প্রকাশ হয়ে পড়ে, যেটি তাঁদের পরিবারকে বেশ কিছুদিন আলোড়িত করে রেখেছিল।
যন্ত্রটি মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পর প্রণবেশ আরও তিন দফা এসে সামান্য কিছু সংস্কার করে দিয়ে যান। এ উপলক্ষে সপ্তাহখানেক তিনি দেশে অবস্থান করেন এবং তারপর তার কর্মস্থল কেমব্রিজে ফিরে যান। এর দুদিন আগে থেকে কম্পিউটারের মনিটরে মইদুল ইসলামের নতুন উপন্যাস লেখা হতে থাকে। প্রথমটায় এই লেখার গতি অনেক ধীর ছিল। সম্ভবত নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে মইদুল ইসলামকে বেগ পেতে হচ্ছিল। দিনের বড় একটা সময়জুড়ে কম্পিউটারের পর্দা অনড় থাকত। এ সময় মইদুল ইসলাম ঘুমাচ্ছেন নাকি চিন্তা করছেন, বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তার চোখের পাতা চব্বিশ ঘন্টাই ঘুমন্ত ব্যক্তির মতো মুদিত থাকত। বিকেলের দিকে তিনি সামান্য কিছু লিখতেন। একটানা ছয়-সাতটি বাক্যের বেশি এগুতো না লেখা। কখনো কখনো একটি বাক্যের মাঝামাঝি এসে তিনি থেমে যেতেন। হয়তো তার মস্তিষ্ক অবসন্ন হয়ে পড়ত, অথবা লেখক হয়তো সে সময় সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো চিন্তায় ডুবে যেতেন। হতে পারে, আসন্ন মৃত্যু ভাবনায় তার চিন্তার স্রোত মাঝে মাঝেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। এভাবে তিন সাড়ে তিন মাসে তৈরি হয় তার নতুন উপন্যাস ভেলভেট-এর পাণ্ডুলিপি।
এটা খুব অবাক হওয়ার মতো একটা বিষয় যে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক এক পরিস্থিতিতে, অত্যন্ত অপরিচিত-অনভ্যস্ত এক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে লেখা সত্ত্বেও মইদুল ইসলাম তাঁর লেখনীর শুদ্ধতা পুরোপুরি বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এই সব বাইরের বিষয়’ তাঁর লেখার শৈলী ও বিষয়বস্তুর ওপর কোনো প্রভাবই রাখতে পারেনি। তার সুস্থাবস্থার লেখনীর সঙ্গে এ নতুন লেখাকে কোনোভাবে আলাদা করার জো ছিল না। এটি হয়তো তার লেখকসত্তার শক্তিমত্তা আর দৃঢ়তারই পরিচয় বহন করে।
এটা খুব লক্ষ্যণীয় যে ১৮৬ পৃষ্ঠার উপন্যাস ভেলভেট প্রকাশ হলে তাঁর পাঠক সমাজের মধ্যে এটি পূর্বের মতো একই মাত্রায় সীমিত সাড়া ফেলে।
ভেলভেটএর পর কিছুদিন বিরতি দিয়ে মইদুল ইসলাম তার অসমাপ্ত উপন্যাস ফেরারীর অষ্টাদশ ও শেষ অধ্যায় লিখে ফেলেন। এরপর তিনি লেখেন মাতুলালয় নামে এক জটিল রাজনৈতিক উপন্যাস। দীর্ঘ, সুপরিসর এ উপন্যাসে বেশ কিছু আত্মজৈবনিক উপাদান আছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
এরপর কম্পিউটারের পর্দা আমাদের একে একে উপহার দেয়। গিরগিটি, বেহুলার বাসর ও তারাশঙ্করের ডায়েরি মইদুল ইসলামের শেষ এবং বিতর্কিত তিন উপন্যাস। এগুলো সম্পর্কে শুরুতেই কিছু কথা বলেছি। এ স্থলে আরও কিছু কথা যোগ করতে চাই।
প্রথম দুটি উপন্যাস গিরগিটি ও বেহুলার বাসর বের হওয়ার পরপরই আবুল খায়ের নামে এক বিদগ্ধ পাঠক এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, এগুলো মইদুল ইসলামের লেখা নয়। মইদুল ইসলামের বাক্যের গঠন, তার ক্রিয়াপদের ব্যবহার, উপমা প্রয়োগের প্রবণতা ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আবুল খায়ের ওই নিবন্ধে তার সিদ্ধান্তের পক্ষে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরেন। তবে আবুল খায়ের এটি কোথাও ছাপতে দেননি। এটি প্রকাশিত হলে সেটা যে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন কেলেঙ্কারির উপলক্ষ তৈরি করত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আবুল খায়ের ছিলেন মইদুল ইসলামের সেই ঘনিষ্ঠ ভক্ত চক্রের অংশ, যে চক্রটি তার প্রত্যক্ষ সাহচর্য লাভ করার সুযোগ পেত। প্রিয় লেখককে ঘিরে অযথা কোনো বিতর্কের জন্ম দেওয়া আবুল খায়েরের অভিপ্রায় ছিল না। তাই প্রথমটায় তিনি তার নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে আপত্তি তুলতে শুরু করেন। শিগগিরই বিষয়টা মইদুল ইসলামের ভেতরের সার্কেলের (পরিবার, প্রকাশক এবং তার অ্যাসিসট্যান্ট কাম-লিটারারি এজেন্ট) কানে যায় এবং এক আসন্ন কেলেঙ্কারির আশঙ্কায় তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা আবুল খায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টা স্থায়ীভাবে ফয়সালা করার প্রস্তাব দেন। তত দিনে মইদুল ইসলামের শ্রবণশক্তি অটুট থাকার তথ্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ জানা গেছে, বাইরের জগতের সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগহীন তিনি নন। কিছুটা পরোক্ষ হলেও তার সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনে যাওয়া সম্ভব। ফলে সাব্যস্ত হয়, মইদুল ইসলামের কাছ থেকেই এই সন্দেহের জবাব চাওয়া হবে।
এই অভিপ্রায়ে এক ঘোর বৃষ্টির দিনে মইদুল ইসলামের শিয়রের কাছে এসে দাঁড়ায় পাঁচটি প্রাণি–আবুল খায়ের, মইদুল ইসলামের প্রকাশক, তার অ্যাসিসট্যান্ট এবং পরিবারের দুই বুজুর্গ সদস্য, যাদের একজন মির্জা একরামুল বাশার (ইনিই পরবর্তীকালে মইদুল ইসলামকে নিয়ে একটি স্মৃতিকথা লিখবেন এবং সেটায় এই বিশেষ দিনটির প্রসঙ্গ পুরোপুরি চেপে যাওয়া হবে)। তাদের একজন, আমি জানি না কোনজন, কিছুক্ষণ গলা খাঁকারি দিয়ে মইদুল ইসলামের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, শেষ দুটি উপন্যাস তিনি লেখেননি বলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এই দুই উপন্যাস আসলেই তার লেখা কি না? শুনেছি, মইদুল ইসলাম এই প্রশ্নে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, সকলকে তিরস্কার করে তিনি ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এমন মৌন তিরস্কারের উদাহরণ আর আছে কি না সন্দেহ–তার স্নিগ্ধ ঘুমজড়ানো মুখমণ্ডলে এর কোনো ছাপ পড়েনি।
এই ঘটনার কিছুদিন পর তারাশঙ্করের ডায়েরি প্রকাশিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের পটভূমিতে রচিত এ ডিটেকটিভ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তৈরি হওয়ার পরপরই মইদুল ইসলামের শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটে। তিনি আর বেশি দিন বাঁচেননি।
আবুল খায়ের আর কখনোই তার আপত্তির কথা মুখ ফুটে উচ্চারণ করেননি। তবে তাঁর সন্দেহ থেকে তিনি মোটেও বিচ্যুত হননি। বরং তারাশঙ্করের ডায়েরি পড়ে তাঁর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এই ঘটনার বছর পাঁচেক পর আবুল খায়েরের সঙ্গে ঘটনাচক্রে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। মইদুল ইসলামের কথাসাহিত্য আমাদের মধ্যে হৃদ্যতার সেতু তৈরি করে থাকবে। আবুল খায়ের তার পুরোনো নিবন্ধটি আমাকে পড়তে দেন। মইদুল ইসলাম ও প্রণবেশ-সংক্রান্ত যেসব অনুপুঙ্খ বিবরণ এখানে আমি দিয়েছি, সেগুলো আবুল খায়েরের মুখ থেকে শোনা।
কোলন ক্যান্সারে আবুল খায়েরের মৃত্যুর পর তাঁর সিদ্ধান্তটি আমি বহুদিন ধরে বহুভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবেছি। যতই দিন গেছে, ততই তাঁর সঙ্গে আমি একমত হতে বাধ্য হয়েছি।
মইদুল ইসলামের নামে ছাপা হওয়া শেষ তিনটি উপন্যাস যে তার লেখা নয়, এ বিষয়ে কনভিন্সড হতে আবুল খায়েরের নিবন্ধটিই যথেষ্ট। আমি এটি আমার লেখার সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলাম।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে শেষ করব।
ওই তিন উপন্যাস যদি মইদুল ইসলামের না হয়ে থাকে, তবে সেগুলো কার লেখা?
এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। একবার সন্দেহটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জায়গা করে দিলে অনেকে এটির ওপর আলো ফেলতে পারবেন। তখন অনেকের আলোচনার ভেতর থেকে একটি নিশ্চিত সিদ্ধান্ত হয়তো বেরিয়ে আসবে।
এখানে আমি কেবল কয়েকটি সন্দেহের কথা বলতে পারি।
আবুল খায়ের নিজে মনে করতেন, এ তিন উপন্যাস আসলে প্রণবেশ মাইতির লেখা। প্রণবেশ তার যন্ত্রটিকে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন, যাতে তাঁর নিজের লেখাগুলো মইদুল ইসলামের লেখা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। এ কাজ করার পেছনে প্রণবেশের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, সেটার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা আবুল খায়ের আমাকে দিতে পারেননি। হতে পারে, সাহিত্যিক উচ্চাভিলাস ছিল তাঁর। কিন্তু নিজের লেখার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তার লেখাগুলোর প্রকৃত মূল্য যাচাই করার একটি কৌশল নিয়েছিলেন তিনি। আবুল খায়ের তার এ অনুমানের পক্ষে একটিই পরোক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে পেরেছিলেন। প্রথম জীবনে প্রণবেশ যখন লেখালেখিতে হাত পাকানোর চেষ্টা করছেন, সে সময়কার একটি গল্পের খসড়ায় ললিতা নামে একটি চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। মইদুল ইসলামের বেহুলার বাসর উপন্যাসের প্রধান চরিত্রটির নামও ললিতা। এটা এত সূক্ষ্ম একটা মিল যে দৈব ছাড়া আর কিছু বলে চালানোর উপায় নেই।
আমার নিজের অনুমান আরেকটু বিচিত্র। আমি মনে করি, প্রণবেশ মাইতির বানানো ওই যন্ত্রটিই আসলে শেষ তিন উপন্যাসের লেখক। হতে পারে, মইদুল ইসলামের প্রথম দুটি উপন্যাস এবং একটি উপন্যাসের শেষ অধ্যায় লিখে দেওয়ার সময় সেই যন্ত্রটি ফিকশন লেখার কলাকৌশল রপ্ত করে নিয়েছিল। তারপর শুরু করেছিল নিজে থেকে লিখতে।
সন্দেহ নেই এটি একটি উন্মাদ অনুমান। এটি সত্য হতে হলে নিজে থেকে চিন্তা করতে পারে–এ রকম একটি যন্ত্রের অস্তিত্ব কল্পনা করতে হবে আমাদের। বিজ্ঞানের লোক না হয়েও আমি জানি, এ রকম একটি ব্যাপারকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে ডাকা হয় এবং সে রকম কিছু আদৌ তৈরি করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানের রাজ্যে এখনো তর্ক শেষ হয়নি। বিশেষ করে প্রণবেশ মাইতির মতো কারও পক্ষে এ রকম একটি যন্ত্র বানানো যে সম্ভব ছিল না, সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে এটা তো ঠিক যে, মইদুল ইসলামের চিন্তা প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল যন্ত্রটি, এবং কোনো এক দুর্বোধ্য উপায়ে হয়তো এটি নিজেকে বিবর্তিত করে নিয়েছিল, সেই বিবর্তন জৈব বিবর্তনের নিয়ম মেনে হয়নি, হয়তো যন্ত্রের বিবর্তনের আলাদা কোনো কলাকৌশল থেকে থাকবে, অন্য কোনো ডারউইন যেটা একদিন আবিষ্কার করবেন। গোড়াতে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ছিল না যন্ত্রটির, মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের সঙ্গে এটির মিথস্ক্রিয়ায় কোথাও তৃতীয়। একটি মিথজীবী বুদ্ধিমত্তা তৈরি হয়ে গিয়ে থাকবে, মইদুল ইসলামের মস্তিষ্ক ছাড়া যেটির স্বাধীন সত্তা ছিল না এবং মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কটি এটির পোেষক দেহ হিসেবে কাজ করছিল, তার অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির ভান্ডার হয়ে উঠেছিল এটির খাদ্য। এ কারণে মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই মধ্যবর্তী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
আমার অনুমানের ওপর কিছুটা আলো ফেলতে পারতেন প্রণবেশ মাইতি। কিন্তু আমরা গত নয় বছরে তার কোনো খোঁজ পাইনি। শুনেছি, আইরিশ স্ত্রীর অবিশ্বস্ত আচরণ তাঁকে দিনে দিনে উন্মাদপ্রায় করে তুলেছিল এবং নিজ বিছানায় স্ত্রীর তরুণ প্রেমিককে হত্যা করে তিনি স্থায়ীভাবে গা ঢাকা দিয়েছেন। আমি মনে করি না, শেষ তিনটি উপন্যাসকে তার রচনাবলি থেকে সরিয়ে ফেললে বাংলা সাহিত্যে মইদুল ইসলামের এত দিনকার আসনের খুব একটা ব্যত্যয় ঘটবে। ওই তিন উপন্যাস ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু এখন তাঁর অন্য উপন্যাসগুলোকেও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা শুরু হয়ে গেছে এবং মইদুল ইসলাম তার কাল্ট খ্যাতির সীমা ডিঙিয়ে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর সমাদর পেতে শুরু করেছেন। আমার প্রস্তাব, তার রচনাবলির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় একটি বাড়তি খণ্ড প্রকাশ করা হোক, যেখানে এই তিন উপন্যাসকে জায়গা দেওয়া হবে এবং সেখানে মইদুল ইসলামকে এই উপন্যাসগুলোর সহ-লেখক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হবে। অপর সহ-লেখকের ঘরটি ফাঁকা রাখা হোক, তত দিন পর্যন্ত, যত দিন না মানব সমাজ এই মধ্যবর্তী সত্তাটির যথাযথ একটি নাম খুঁজে পাচ্ছে।