ড. মারদ্রুসের বাগান
ড. মারদ্রুসের বাগান নিয়ে কত যে গল্প শুনেছি। লোকমুখে রটতে রটতে সেসব গল্প বিচিত্র ডালপালা ছড়িয়েছে। কত মিথ, কত কিংবদন্তি।
ড. মারদ্রুসের বাগান নাকি রাতের বেলা জেগে ওঠে। প্রতিটি পাতা, ফুল-ফল থেকে আলোর আভা বের হয়। বাতাস বয়ে গেলে এই বাগান এমন করে ফিসফিস করে ওঠে, যেন জগতের সব গুপ্তকথা ফাঁস করে দিচ্ছে। এই বাগান জীবন্ত।
এখন দোতলার জানালা দিয়ে আমি সেই বাগানের দিকে তাকিয়ে আছি। সবই গুজব বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আবার এ-ও টের পাচ্ছি, জানালাপথে চোখের সামনে জেগে ওঠা এই বাগিচা খুব চেনা কিছুও নয়। জগতের কোনো বাগান এ রকম হতে পারে না। দূর থেকে গাছগুলো পরিচিত লাগছে বটে, তবে ভালো করে তাকালে বোঝা যায়, একটি গাছও চেনা নয়। খুবই অনিয়মিত সেগুলোর পত্রবিন্যাস, কাণ্ড থেকে ডালপালা বেরিয়ে আসার ক্রমের মধ্যে কোনো সংগতি নেই। ফুলগুলো যেভাবে পাপড়ি ছড়িয়েছে, তাতে নেই কোনো প্রতিসাম্য। তা ছাড়া মাটি থেকে কাণ্ডগুলো এমন অপরিচিত ভঙ্গিতে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছে, দেখতে অস্বস্তি লাগে।
একর দেড়েক জমিতে বিশাল এক উদ্যান। সবুজ ঘাসের গালিচায় পাথর ফেলে পায়ে চলা পথ বানানো হয়েছে। দুপাশে আধচেনা গাছের ফাঁকে কিছু গুল্মও আছে। বাগানের মাঝামাঝি একটা অর্কিডের শেড। এখানে-সেখানে মর্মর পাথরের ফোয়ারা, কাঠের বেঞ্চ। প্রাচীন কোনো প্রাসাদ-উদ্যান বলে ভুল হয়। এক কোনায় একটা গ্রিনহাউসের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, গাছের ডালপালায় ভালো করে চোখ পড়ে না।
তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, কেন এই বাগান একটা নিষিদ্ধ। জগৎ, কেন বাইরের বিশ্বের কাছ থেকে এটি লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
‘কারণ এই বাগানের টিকে থাকা না-থাকার ওপর নির্ভর করছে গোটা মানবজাতির অস্তিত্ব। এটাই আমাদের সভ্যতার প্রাণভোমরা,’ ড. মারদ্রুস বললেন। তিনি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি।
আমি চমকে ফিরে তাকাই। আমার চিন্তা হয়তো চেহারায় অনেকটাই ফুটে উঠেছে।
‘কীভাবে? একটা সামান্য বাগান কী করে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?’
‘এটা কোনো সামান্য বাগান নয়। আসুন ঘুরে দেখাই, তাহলে বুঝতে পারবেন।’
.
একটা আপেলগাছের নিচে বেঞ্চে আমরা দুজন বসেছি। আমি আর ড. মারদ্রুস।
আপেলগাছ বললাম বটে, তবে বলা উচিত, আপেলগাছের মতো দেখতে একটা গাছ। খুব বড় গাছ নয়। ডালগুলো নুয়ে পড়া। তাতে যেসব ফল ধরে আছে, দেখতে আপেলের মতোই।
‘কী গাছ এটা, বলতে পারেন?’
‘আপেল।’
‘কোন জাতের আপেল? গ্যালা, ফুজি নাকি গ্র্যানি স্মিথ?’
‘আমি আপেলের জাত চিনি না।’
ড. মারদ্রুস বেঞ্চ ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। হাত বাড়িয়ে একটা আপেল ছিঁড়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন। একটা লাল গোলাকার পুরুষ্টু আপেল।
‘নিন। খেয়ে দেখুন। এটা আসলে রেড ডেলিশাস। খেয়ে স্বাদটা কেমন বলবেন।’
ড. মারদ্রুসের বাড়িয়ে ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে এক মুহূর্ত স্নোহোয়াইটের সেই বিখ্যাত দৃশ্যটার কথা মনে পড়ল।
‘নিন। চেখে দেখুন। ভয়ের কিছু নেই। এতে বিষ মেশানো নেই।’
আমি আপেলটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। কামড় বসালাম না। ড. মারদ্রুস আমার কাণ্ড দেখে একটু হাসলেন। বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।
‘এক হিসেবে আপনার এই অস্বস্তি খুব অমূলক নয়। যে জিনিসটা আপনি হাতে ধরে আছেন, সেটা বাইরে থেকে দেখতে আপেলের মতো বটে। কিন্তু এটা আপেল নয়। বলতে কি, এটা আসলে কোনো ফলই নয়।
‘তাহলে এটা কী?’
‘বললে বিশ্বাস করবেন? এটা শেক্সপিয়ারের একটা সনেট।’
‘মানে?’
‘হ্যাঁ, শেক্সপিয়ারের সনেট। একটা নয়, শেক্সপিয়ারের সবগুলো সনেট। শুধু সনেট না, এটা শেক্সপিয়ারের সব ট্র্যাজেডি ও কমেডি এবং এলিজাবেথান পিরিয়ডে লেখা সব নাটক, ওই সময়ের সব চিঠি এবং এমনকি জমি-জায়গা কেনাবেচা-সংক্রান্ত সব দলিল-দস্তাবেজ।’
আমি অবাক হয়ে মারড্রসের দিকে তাকালাম।
‘আর ওই যে ওখানে নিমগাছটা দেখছেন, ওটা সংস্কৃত কবি কালিদাসের লেখা সবগুলো কাব্য নাটক– কুমারসম্ভব, শকুন্তলা, মেঘদূতম। বাতাসে নিমের পাতাগুলো কীভাবে কাঁপছে দেখুন। মন্দাক্রান্তা ছন্দে কাঁপছে বলে মনে হচ্ছে না?’
লোকটা পাগল নাকি?
আমার মুখের ভঙ্গি দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন মারদ্রুস।
‘বুঝিয়ে বলব। আপনি এই বাগানের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। একদিক থেকে দেখলে আপনি হবেন এটার মালি। প্রতিদিন গাছগুলোর যত্ন নেবেন আপনি, পানি দেবেন, সার দেবেন, আগাছা ঘেঁটে দেবেন, কলম করবেন, বীজ সংগ্রহ করবেন। ফলে আপনাকে বুঝিয়েই তো বলতে হবে।’
‘যতই বুঝিয়ে বলুন, একটা আপেলের শেক্সপিয়ারের সনেট হয়ে ওঠার গল্প কোনো দিনই আমার কাছে বোধগম্য হবে না।’
‘আপেল তো শেকসপিয়ারের সনেট হয়নি। বরং শেকসপিয়ারের সনেটই আপেল হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা খুব সরল। আপনি একজন বোটানিস্ট। জেনেটিক্স পড়া আছে আপনার। ফলে আপনি আরও সহজে বুঝতে পারবেন।’
ড. মারদ্রুস একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। ঘণ্টা তিনেকের একটা ক্লাস লেকচার বলা যায়। তাঁর বক্তৃতা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। কেউ একজন একে একে বাগানের গ্যাসবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। আমি অনড় হয়ে বসে থাকলাম আপেলরূপী সনেটগাছের তলায়। যা শুনলাম, তা এখনো ঠিকমতো হজম হচ্ছে না। তবু ওই বক্তৃতার একটা সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরছি।
.
‘উইকিপিডিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে আপনার? সারা বিশ্বের শতসহস্র ভলান্টিয়ার মিলে একটু একটু করে গড়ে তুলছে বিশাল এক অনলাইন জ্ঞানভান্ডার। উন্মুক্ত। অসীম। যে কেউ চাইলেই এটায় নতুন ভুক্তি যোগ করতে পারে, পুরোনো ভুক্তি সম্পাদনা করতে পারে। ক্ল্যাসিক্যাল যুগের এনসাইক্লোপিডিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হবে, এটা অসীমসংখ্যক ভলিউমের, অসীমসংখ্যক পৃষ্ঠার এক মহাগ্রন্থ। সমস্যা হলো, অসীম হলেও এটা অনন্তকালের নয়। উইকিপিডিয়া স্বল্পায়ু নিয়ে জন্মেছে।
‘উইকিপিডিয়া কাগজে প্রিন্ট দিয়ে বই আকারে বের করার একটা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল কিছুদিন আগে। যারা নিয়েছিলেন, তাঁরা শিগগিরই টের পেলেন, এটা অসম্ভব একটা কাজ। পুরো প্রকল্প দেউলিয়া হয়ে যাবে, তবু প্রিন্ট দেওয়া শেষ হবে না। এ মুহূর্তের কথাই ধরুন। উইকিপিডিয়ায় এখন ৪ কোটি আর্টিকেল আছে, ২২৯টি ভাষায়। আর প্রতি মুহূর্তে সেটা হু হু করে বাড়ছে। গত বছর ফরাসি ভলান্টিয়াররা তর্ক তুলেছেন, রেসিপি বা রন্ধনশৈলী কেন উইকিপিডিয়ার আর্টিকেলভুক্ত হবে না। মানে ব্যাপার হলো, দুনিয়ার যেকোনো কিছু উইকিপিডিয়ার বিষয় হতে পারে।
‘কাগজের পৃষ্ঠায় উইকিপিডিয়া প্রিন্ট দিয়ে রাখার প্রকল্প বাতিল হয়ে গেছে। আর এইখানেই মূল বিপদটা লুকানো। সংরক্ষণের বিপদ। উদ্যোক্তারা টের পেতে শুরু করলেন, উইকিপিডিয়া ক্রমশ বাড়তে থাকা এমন এক জ্ঞানভান্ডার, যেটা ডিজিটাল ফরম্যাটে ছাড়া অন্য কোনো ফরম্যাটে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তার মানে এই ফরম্যাটের স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করছে পুরো উইকিপিডিয়ার অস্তিত্ব।
‘ডিজিটাল জগতে তথ্য কীভাবে সংরক্ষিত হয়? তা কতটা সুরক্ষিত? আপনি বিশাল বিশাল সব সার্ভারে উইকিপিডিয়া কপি করে রাখছেন। কিন্তু সেই সার্ভারগুলো রাখছেন কোথায়? ধরা যাক, এক বিশাল ভূমিকম্পে একসঙ্গে সব সার্ভার ধ্বংস হয়ে গেল? পরদিন আপনি যে পৃথিবীতে জেগে উঠবেন, সেখানে কোনো উইকিপিডিয়া থাকবে না। শুধু উইকিপিডিয়া কেন, কোনো এনসাইক্লোপিডিয়াই থাকবে না। কারণ উইকিপিডিয়া অন্য সব ফিজিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়াকে আগেই বিদায় করে দিয়েছে।
‘উইকিপিডিয়া কর্তপক্ষ কিছুদিন ধরেই ভাবছে, কিছ সার্ভার তারা চাঁদের পিঠে নিয়ে গিয়ে সেখানে মাটির তলায় পুঁতে রাখবে। পৃথিবী যত বড় দুর্যোগেই পড়ুক, চাদে লুকানো স্টোরেজ থেকে ডাউনলোড করে নিলেই চলবে।
‘ও রকম কোনো একটা মহাদুর্যোগের কথা যদি বাদও দেন, আরেকটা বিপদ কিন্তু গোকুলে বাড়িছে। ডিজিটাল জগতের নিজস্ব চরিত্রের ভেতরেই সেটার জন্ম। ব্যাপারটা পদ্ধতিগত। লক্ষ করবেন, ডিজিটাল জগতে কোনো ফরম্যাটই চিরস্থায়ী নয়। ডেটা স্টোরেজ ব্যবস্থার কথাই ধরুন। ফ্লপি ডিস্কের জগৎ কীভাবে চোখের পলকে মিলিয়ে গেল! সিডি ডিস্ক আজ কোথায়! আপনি নিশ্চিন্তে ডেটা স্টোর করে রাখছেন। কিন্তু যে ফরম্যাটে সেটা রাখছেন, সেই ফরম্যাট রিড করার যন্ত্রই ধরুন আর থাকল না। তখন ভূমিকম্প হওয়া না-হওয়া একই কথা।
‘কোনো ডিজিটাল স্টোরেজ সিস্টেমই খুব দীর্ঘস্থায়ী নয়। কিছুদিন ফেলে রাখলে ওটা মৃত্যুঘুমে তলিয়ে যায়। আর জাগতে চায় না।
‘আমি উইকিপিডিয়ার প্রসঙ্গটা তুলেছি একটা উদাহরণ হিসেবে, আমাদের কালে জ্ঞান ও তথ্য উৎপাদন এবং সংরক্ষণের বৃহত্তর ছবিটা বুঝতে যাতে সুবিধা হয়। তথ্য বা জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে নেওয়ার এই সংকট মানবসভ্যতাকে চিরকালই ভুগিয়েছে। সম্রাট অশোকের মতো পাথরের গায়ে খোদাই করে আপনি অনুশাসন লিখে রাখতে পারেন বটে, কিন্তু জগতের সব পাহাড়ের গা সয়লাব করে ফেললেও আপনি এক টেরাবাইট তথ্যও উল্কীর্ণ করতে পারবেন না। সমকালীন জ্ঞান সমকালেই হারিয়ে যায়। গ্রিক পণ্ডিতদের কথা চিন্তা করুন। অজস্র পণ্ডিত গিজগিজ করত। তাদের কার লেখা আজ আর টিকে আছে? আমরা শুধু অন্যের অনুবাদ ও রেফারেন্স থেকে তাদের কথা জানি। মধ্যযুগের মুসলিম পণ্ডিতেরা আরবি ভাষায় অনুবাদ করে না দিলে আজ অ্যারিস্টটল কোথায় থাকতেন? লাতিন সাহিত্যের কথাই ধরুন। বিপুলসংখ্যক নারী সাহিত্যিক ছিলেন রোমান যুগে। একজনের লেখাও আজ টিকে নেই। মধ্যযুগের সাহিত্যের শুধু সেগুলোই টিকেছে, যেগুলো কেউ হাতে লিখে কপি করেছে। আমরা জানি কেন এবং কারা পিরামিড বানিয়েছিল। কিন্তু আমরা কি জানি, প্রাচীন মিসরীরা কীভাবে দুপুরের খাবার রান্না করত? কতটা লবণ দিত ডালে? মিসরীয় বাদ্যযন্ত্রের চেহারা আমরা দেখেছি। কিন্তু ওইসব যন্ত্রে বাজানো সুরের নোটেশন কি টিকে থেকেছে? থাকেনি। হারিয়ে গেছে।
‘মানুষের সভ্যতা আসলে তার লব্ধ জ্ঞানের যোগফল ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সমস্যা হলো, মানুষের স্মৃতিকোষ ডেটা স্টোরেজের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নয়। মানুষ চিরকালই তার সামগ্রিক স্মৃতি ও জ্ঞানরাশিকে জমিয়ে রেখেছে তার মগজের বাইরে, কোনো ভৌত কাঠামোর মধ্যে। রাক্ষস যেভাবে তার প্রাণ লুকিয়ে রাখে ভোমরার মধ্যে। জগতের সব লাইব্রেরির সব বই আজ পুড়িয়ে ফেলুন, আগামীকাল সূর্যোদয়ের আগেই মানবসভ্যতা অন্ধকার যুগে ফিরে যাবে।
‘ডিজিটাল যুগে জ্ঞানভান্ডার আপনি কাগজের বইয়ের মধ্যে সীমিত রাখতে পারেননি। রাখা সম্ভব নয়। কারণ এই জ্ঞানভান্ডারের আকার প্রায় অসীমের কাছাকাছি। সেখানেই বিপদ অসীম আর শূন্যের মধ্যে ভেদরেখা অতি সামান্য। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ডিজিটাল প্রযুক্তির জোরে আপনি প্রায় অতিমানব। হয়ে উঠেছেন ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে গুহামানব হয়ে পড়ার ঝুঁকিও ডেকে এনেছেন।
‘রোমানরা ভাবত, তাদের সভ্যতা অক্ষয়। রোমান সম্রাটরা ভাবতেন, তারা এমন এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন, যা চিরকাল টিকে থাকবে। আমরাও একই রকম আত্মপ্রসাদে ভুগছি।
‘প্রশ্নটা এক বা দুই দশক বা শতাব্দীর নয়। প্রশ্নটা হলো, বর্তমান ডিজিটাল জ্ঞানভান্ডারকে কী করে পরবর্তী দশ বা বিশ হাজার বছর পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যাবে। এমন নির্ভরযোগ্য ডেটা স্টোরেজ পদ্ধতি কোথায় মিলবে। এই প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আমার এই বাগানের যোগ আছে। কিংবা বলতে পারেন, এই বাগানই মানুষের সেই প্রশ্নের জবাব।
‘আমরা একদল লোক বলতে চাইলাম, মানুষকে এই প্রশ্নের জবাব বাইরের দিকে না খুঁজে, খুঁজতে হবে ভেতরের দিকে। মধ্যযুগের সুফি-সাধকেরা যেভাবে মানুষের ভেতরেই অনন্ত জগৎ খুজতেন, আমরাও প্রায় সেভাবেই বললাম, প্রতিটি মানুষ নিজে সহস্র কোটি তথ্যের এক বিশাল ভান্ডার বয়ে নিয়ে চলেছে নিজের ভেতরে। বিবর্তনের পথে এই তথ্য লুকানো আছে তার জিনের মধ্যে, ডিএনএ বিন্যাস-কাঠামোয়। প্রকৃতির রাজ্যে ছয়টি বর্ণে লেখা হচ্ছে অনন্ত এক গ্রন্থ। অক্ষয় সেই কিতাব। আজও যদি আপনি বরফের নিচে চাপা পড়া প্রাচীন কোনো ম্যামথের মৃতদেহ খুঁজে পান, বা পেয়ে যান গাছের আঠার মধ্যে আটকে পড়া কোনো প্রাগৈতিহাসিক মশা, তাহলে সেটার পাকস্থলীর মধ্যে পাওয়া ডিএনএ থেকে আপনি ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনতে পারবেন। কোটি কোটি বছরেও নষ্ট হয় না ডিএনএর কাঠামোর মধ্যে থাকা তথ্য-উপাত্ত।
‘ডিজিটাল ডেটা সংরক্ষণের এই যে অভিনব প্রযুক্তি আমরা উদ্ভাবন করলাম, সেটার নাম দেওয়া হলো ডিএনএ স্টোরেজ। কৌশলটা খুব সহজ। ডিএনএর যে ছয়টা বেজ সিকোয়েন্স আছে, সেগুলো ব্যবহার করে কোড় করা হয় তথ্য। তারপর এই ডিএনএ কাঠামোটিকে রেখে দিতে হয় একটা শীতল কোনো জায়গায়। পরে যখন খুশি চাইলেই এই ডিএনএর তথ্য রিট্রিভ করা যাবে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং মেশিনের সাহায্যে।
‘এই পদ্ধতির সুবিধা হলো, বিপুলসংখ্যক তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায় খুব অল্প জায়গার মধ্যে। ধরা যাক, এই মুহূর্তে বিশ্বের সব পারসোনাল কম্পিউটারে এবং সব সার্ভারে যা কিছু তথ্য আছে ডিজিটাল ফরম্যাটে, তা সবই যদি ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করা যায়, তাহলে তা একটা ছোট্ট কাভার্ড ভ্যানের মধ্যে এঁটে যাবে।
‘বছর বিশেক আগে আমরা দুনিয়ার সব তথ্য ডিএনএ স্টোরেজ করার প্রক্রিয়া শুরু করি–সব তথ্য–এফবিআইয়ের গোপন নথিপত্র থেকে শুরু করে মুদির দোকানের ফর্দ পর্যন্ত, সবকিছু। আর তা করতে করতে দ্বিতীয় একটা চিন্তা আমাদের মাথায় আসে। আমি বলব, চিন্তাটা আমারই মাথায় আসে প্রথম। আর আমার নেতৃত্বে শুরু হয় গোপন আরেকটা প্রকল্পের কাজ। আমাদের কথা হলো, একটা নির্জীব ফ্রিজারের মধ্যে এসব ডিএনএ সিকোয়েন্স সংরক্ষণ করে রাখার দরকার কী? তার চেয়ে প্রকৃতির নিজস্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কী সমস্যা? ভেবে দেখুন, প্রকৃতি কীভাবে তার নিজস্ব ডিএনএ বা জিন সিকোয়েন্স সংরক্ষণ করে? প্রকৃতি সেটা করে জীবদেহে। একটা জীবদেহ বা প্রাণিদেহ তো আসলে জিনের একটা বাহক বা ক্যারিয়ারমাত্র। আমি বলব, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ক্যারিয়ার। ফলে আমাদের যেটা করতে হবে, তা হলো ডিজিটাল কোডবাহী ডিএনএ বা জিনগুলোকে কোনো জীবদেহের জিনতন্ত্রের মধ্যে স্থাপিত করতে হবে। আমরা সেটা শুরু করি উদ্ভিদের মধ্যে। বিভিন্ন উদ্ভিদের জিনতন্ত্রের মধ্যে আমরা আমাদের কোডেড ডিএনএগুলো ইমপ্ল্যান্ট করতে শুরু করি। ওই উদ্ভিদ প্রজাতি যত দিন টিকে থাকবে, তত দিন টিকে থাকবে এসব কোডেড তথ্য। এইভাবে আমাদের তথ্যভান্ডার ফুলে-ফলে প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই বাগানে। মানুষের জ্ঞান লালন পালনের ভার প্রকৃতির হাতে তুলে দেওয়া হলো।
‘কিন্তু এখানে একটা সমস্যা দেখা দিল। প্রকৃতি জিনের মধ্য দিয়ে তথ্য বহন করে বটে। কিন্তু প্রকৃতি সেই তথ্য অবিকৃত রাখে না। জিনের মিউটেশন হয়ে ক্রমাগত নতুন নতুন সিকোয়েন্স তৈরি হয়। ফলে এখানে এই বাগানে নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি হতে শুরু করে। আমরা এটাকে বাধা দিইনি। চলুক না। তথ্যের সঙ্গে তথ্য মিশে, তথ্যের কী কী নতুন মিউটেশন দাঁড়ায়, সেটাও তো এক নতুন পরীক্ষা।
‘বলতে পারেন, এই পদ্ধতিতে আমরা আমাদের মানব সভ্যতার পাশাপাশি প্যারালাল কী কী সভ্যতা হতে পারত, বা হতে পারে, সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।
‘ফলে এ মুহূর্তে যে আপেলগাছের নিচে আপনি বসে আছেন, বলেছি যে সেটা আসলে শেক্সপিয়ারের সব সনেট, কিন্তু আদতে এত দিনে সেটা আর শেকৃপিয়ারের সনেট নেই। বলা যেতে পারে, শেকসপিয়ার যেসব সনেট লিখতে পারতেন, কিন্তু লেখেননি, এগুলো সেই সব সনেটে পরিণত হয়েছে।’
.
ড. মারদ্রুস উঠে চলে যাওয়ার পরও আমি অনেকক্ষণ আপেলগাছের নিচে বেঞ্চে বসে থাকলাম।
গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে লোকটা, তাকে আবার দেখতে পাচ্ছি। লোকটা একটা নষ্ট লন মোয়ার যন্ত্র সারাই করার চেষ্টা করছে। আমি তাকে ভালো করে লক্ষ করার চেষ্টা করলাম। কেননা ড. মারদ্রুসের শেষ কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে।
‘আপনাকে একটা কথা না জানিয়ে পারছি না। জগতের জ্ঞানভান্ডার উদ্ভিদের জিনতন্ত্রে ইমপ্ল্যান্টের মধ্যে আমরা এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করে। দেখবেন। মোজার্টের গানের স্বরলিপি থেকে শুরু করে ওয়ালমার্টের শপিং লিস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য আপনার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে।’