ভয় পাওয়া মানুষ

ভয় পাওয়া মানুষ

চিৎকারটা শুনেই প্রিয়নাথ জোয়ারদার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চিৎকারটার মধ্যে যেন হিম বরফকুচি মেশানো ছিল। চিৎকারটা যতক্ষণ ধরে চলছিল ততক্ষণের জন্য করিডরের আলোটা যেন মলিন হয়ে গেল—হঠাৎ ভোল্টেজ কমে গেলে যেমন হয়। তারপর, সেই ভয়-পাইয়ে-দেওয়া চিৎকারের রেশ শেষ হলে, বালবটা আবার তেজ ফিরে পেল।

বিনোদনারায়ণ প্রিয়নাথের সামনে দু-এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছিল। মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে নিয়ে নরম গলায় বললেন, সুনীত। ওর কথাই আপনাকে বলছিলাম। তেতলায় পেছনের দিকটায় ও থাকে।’

প্রিয়নাথ চিৎকারটার কথাই ভাবছিলেন। এমন চিৎকার বুকের ভেতর পর্যন্ত আঁচড় টেনে দেয়। খুব নীচু পরদায় শুরু হয়ে ধাপে-ধাপে ওপরে উঠছে। যেন ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে কেউ আইফেল টাওয়ারের মাথায় পৌঁছোতে চাইছে। আর যতই ওপরে উঠছে, গলার স্বর ততই চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

মৃত্যুকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে কেউ হয়তো এরকম চিৎকার করে। হয়তো ভাবে, এই চিৎকারটা তাকে বাঁচিয়ে দেবে। যত উঁচু পরদায় চিৎকার করতে পারবে, তার বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।

চিৎকারটা শেষ হওয়ার পর কয়েক সেকেন্ড যেন আলপিন-নিস্তব্ধতা। তারপর বিনোদনারায়ণ কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রিয়নাথের কানে ভয়ঙ্কর চিৎকারটার রেশ তখনও বাজছিল। পুরোনো যত চিৎকার বা আর্তচিৎকার প্রিয়নাথ শুনেছেন সুনীতের চিৎকার এক পলকে সব মুছে দিয়েছে।

বিনোদবাবু বলেছিলেন, ওঁর ছোট ভাই সুনীতনারায়ণ মাঝে-মাঝে অদ্ভুতভাবে চিৎকার করে ওঠে। সেই সঙ্গে আরও কিছু-কিছু বিচিত্র কাজ করে। প্রিয়নাথ যদি এ-ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারেন তা হলে ভালো হয়। কারণ, ডাক্তার বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জবাব দিয়ে দিয়েছেন।

বিনোদনারায়ণ প্রিয়নাথের খোঁজ পেয়েছেন লতায়-পাতায়। তারপর একদিন বিকেলবেলা ওঁর নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন। প্রিয়নাথকে খুলে বলেছেন নিজের সমস্যার কথা। তারপর কাতরভাবে অনুনয় করে বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করেছেন।

‘কী করে আপনি বুঝলেন আপনার ভাইয়ের প্রবলেমটা কোনও ভূতুড়ে ব্যাপার?’ সিগারেটে কড়া টান দিয়ে জানতে চাইলেন ভূতনাথ।

কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে ইতস্তত করে বিনোদনারায়ণ বললেন, ‘লোকমুখে শুনেছি, বিজ্ঞান যেখানে শেষ সেইখান থেকে আপনার এলাকা শুরু। সুনীতের জন্যে ডাক্তার-সাইকিয়াট্রিস্ট করে-করে আমি বিজ্ঞানের পুঁজি শেষ করে বসে আছি। তাই নিরুপায় হয়ে আপনার কাছে এসে হাত পেতেছি। আমার ছোট ভাইটাকে যে-করে হোক বাঁচান। ওর কষ্ট আর সইতে পারছি না। এত হাসিখুশি টগবগে জোয়ান ছেলেটার এই প্যাথেটিক অবস্থা ভাবা যায় না…।’

কথা বলতে-বলতে বিনোদনারায়ণের চোখে জল এসে গিয়েছিল। প্রিয়নাথ লক্ষ করেছিলেন, ছোট ভাইয়ের কথা বলার সময় বড় ভাইয়ের মুখে-চোখে পিতৃস্নেহ ফুটে উঠেছিল—যা আজকের দিনে প্রায় দেখাই যায় না।

প্রিয়নাথ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলেন। একমনে সিগারেটে টান দিয়ে গেলেন। তারপর ছোট্ট করে বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি একবার চেষ্টা করে দেখি। কবে আপনাদের বাড়ি যাওয়া যায় বলুন…।’

‘যেদিন আপনি বলবেন।’

বিনোদনারায়ণদের বাড়ি বসিরহাটে। ওঁদের পিন্পুরুষ জমিদার ছিলেন। তাই জমিজমা-পুকুর-দিঘির কোনও হিসেব ছিল না। এখনও নয়-নয় করে যা অবশিষ্ট আছে তাও অনেক। পুরোনো আমলের বিশাল বাড়িতে ওঁরা তিন ভাই থাকেন। বিনোদনারায়ণ, প্রমোদনারায়ণ, আর ছোট ভাই সুনীতনারায়ণ।

বিনোদনারায়ণ যখন সবে কিশোর থেকে যুবক হয়ে উঠছেন তখন ওঁদের বাবা সাপের কামড়ে মারা যান। শ্রাদ্ধ-শান্তি ক্রিয়াকর্ম ইত্যাদি মিটে গেলে ইঠাৎই একজন সন্ন্যাসী ওঁদের বাড়িতে আসেন। সকলের হাত দেখে ভাগ্যচর্চা করে তিনি বলে যান, এ-বংশের পুরুষদের অপঘাতে অকালমৃত্যু হবে। এটা নিয়তির অভিশাপ।

তার পরই সুনীতের জন্ম হয়।

এক কয়েক বছর পর বিনোদনারায়ণের মা ম্যালেরিয়ায় মারা যান। প্রমোদ আর সুনীত তখন খুবই ছোট। বিনোদনারায়ণ ওঁদের কোলে-পিঠে করে আগলে রেখে বড় করেন। অভিশাপের ভয়ে তিনি বিয়ে করেননি। সারাটা জীবন সম্পত্তি দেখাশোনা আর ধর্ম-কর্ম নিয়ে থেকেছেন। মনে-মনে ভেবেছেন, নিশিদিন ঈশ্বর-সাধনায় মগ্ন থাকলে অভিশাপ ধীরে ধীরে কেটে যাবে। কালো ছায়া সরে গিয়ে আবার আলো দেখা দেবে।

‘…কিন্তু এমনই ভবিতব্য দেখুন, সুনীত এই অদ্ভুত বিপদে পড়ল।’ মলিন মুখে বললেন বিনোদনারায়ণ, ‘জানি না, এটা সেই অভিশাপের কোনও ছায়া কি না।’

আপনার কি মনে হয় কোনও প্রেতাত্মা সুনীতের শরীরে বাসা বেঁধেছে?’ প্রিয়নাথ প্রশ্ন করলেন।

‘কী করে বলব!’ হতাশভাবে জবাব দিলেন বিনোদবাবু, ‘প্রমোদ তো বলছিল সেটাই হয়েছে। ওর চেনা একজন কাপালিক আছে। তাকে নিয়ে এসে কীসব তন্ত্র-মন্ত্র করলেই নাকি সুনীত ঠিক হয়ে যাবে। তা আমি ওর কথায় রাজি হইনি।’

‘কেন?’

‘প্রমোদ বহুকাল ধরেই কেমন বাউন্ডুলে গোছের। বাড়ির দিকে মন নেই। সুযোগ পেলেই সাধু সন্ত তান্ত্রিকদের পেছনে ছুটে বেড়াত—এখনও তাই। মাঝে-মাঝেই রাতে বাড়ি ফেরে না। যখন-তখন ছাইপাঁশ গিলে বসে থাকে। ওকে ভাই বলে পরিচয় দিতে আমার খুব লজ্জা করে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিনোদনারায়ণ : ‘আসলে দোষ আমারই, প্রিয়নাথবাবু—ওকে আমি শত চেষ্টা করেও মানুষ করতে পারিনি। তাই ওর প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। বরং ওর মুখোমুখি হলেই আমি কেমন একটা অপরাধবোধে ভুগি। নিজের ব্যর্থতার কথা মনে পড়ে যায়। এটা আমার…।’

বিনোদনারায়ণের গলার স্বর কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। মাথা নীচু করে তিনি নিজেকে আড়াল করতে চাইছিলেন।

প্রিয়নাথ ওঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ, আপনি আপসেট হবেন না। আমরা যা চাই সবসময় কি তা হয়!…আচ্ছা, প্রমোদবাবু বিয়ে করেননি?’

‘না।’ একটু থেমে তারপর : ‘ও যদি নিজে কখনও বিয়ে করে করবে—আমি বড় ভাই হিসেবে কখনও কোনও ইনিশিয়েটিভ নিতে পারব না।’

‘ছোট ভাইয়ের ব্যাপারে প্রমোদবাবু দুঃখ পাননি?’

‘পেয়েছে। ওকে আমরা ভীষণ ভালোবাসি। ও আমাদের গর্ব। এলাকার সবাই ওকে পছন্দ করে। লেখাপড়ায় জুয়েল ছেলে। খেলাধুলোতেও দারুণ। ওর অনেক বন্ধু-বান্ধব। সবাই মিলে হইহই করে ট্যুরে যায়, সোশাল ওয়েলফেয়ারের কাজ করে—মানে, করত। সুনীতকে সবাই একডাকে চেনে। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই তখন যদি কেউ বলে, ওই যে, সুনীতের বড়দা যাচ্ছে, তখন আমার খুব আনন্দ হয়।’

সাদা শার্টের পাশপকেট থেকে রুমাল বের করে চোখে বুলিয়ে নিলেন বিনোদবাবু। একটু কেশে গলাটা স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন, ‘আপনি একবার চলুন। নিজের চোখে সব দেখুন। তারপর…আপনি আমাদের শেষ ভরসা।’

প্রিয়নাথ হাতের সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘আমি প্রেতসিদ্ধ বা ওঝা নই। তবে ভূত-প্রেতের খোঁজ করে বেড়ানো আমার নেশা। চেষ্টা করে দেখি আপনাকে কোনওরকম হেল্প করা যায় কি না। আচ্ছা, সুনীত যে চিৎকার করে সেটা ঠিক কী ধরনের?’

‘বলে বোঝাতে পারব না, প্রিয়নাথবাবু। আপনি বরং নিজের কানে শুনেই বিচার করবেন।’

প্রিয়নাথ লক্ষ করেছিলেন, কথাগুলো বলার সময় বিনোদনারায়ণের মুখে কেমন যেন অসহায় ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছিল।

এখন, সুনীতের চিৎকার নিজের কানে শোনার পর, প্রিয়নাথ সেই ভয়ের কারণ বুঝতে পারলেন। এই অপার্থিব চিৎকারে বুকের রক্ত যেন জমে বরফ হয়ে যায়।

‘চলুন—ওপরে চলুন।’

বিনোদনারায়ণের কথায় প্রিয়নাথ সংবিৎ ফিরে পেলেন। ভাঙা ক্ষয় ধরা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ওঁরা ওপরে উঠতে শুরু করলেন।

সিঁড়ির বাঁকের মুখে দেওয়ালে বসানো কারুকাজ করা জাফরি। জাফরির ওপরের দিকে তিনটে ছোট-ছোট হরিণ। সময়ের প্রকোপে জায়গায়-জায়গায় রং চটে গেছে।

জাফরির ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছিল। বাতাসে নদীর ঘ্রাণ প্রিয়নাথ টের পাচ্ছিলেন। একইসঙ্গে শীতের কামড়।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই উষ্ণতা ওঠা-নামা করছিল। শীত যেন লাজুকভাবে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপর উষ্ণতা নামতে শুরু করেছে। শীতও আনুষ্ঠানিকভাবে জাঁকিয়ে বসেছে।

গায়ে উলিকটের গেঞ্জি ও সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও প্রিয়নাথ সামান্য কেঁপে উঠলেন।

ঘন-ঘন বাঁক নেওয়া সিঁড়ি বেয়ে ওঁরা ওপরে উঠছিলেন। প্রিয়নাথ লক্ষ করছিলেন, সরু-চওড়া নানান ধরনের অলিন্দ বাড়িটার নানান দিকে চলে গেছে—অনেকটা ভুলভুলাইয়ার মতন। আলোর ব্যবস্থা বলতে বেশিরভাগই বালব। দু-এক জায়গায় টিউব লাইট যে চোখে পড়ছে সেসব নতুন সংযোজন।

দেওয়ালে-দেওয়ালে ড্যাম্পের ছাপ চোখে পড়ছিল। সেইজন্যই হয়তো শীতের সঙ্গে একটা বাড়তি ঠান্ডা যোগ হয়ে গিয়েছিল।

তিনতলায় উঠে দুটো তালাবন্ধ ঘরের দরজা পেরিয়ে সুনীতের ঘরের দিকে এগোলেন ওঁরা দুজন। বিনোদনারায়ণ তালাবন্ধ দরজা দুটো পেরোনোর সময় বললেন, ‘এত বড় বাড়িতে তিনটে মাত্র প্রাণী। একতলায় আমি, দোতলায় প্রমোদ, আর তেতলায় সুনীত। তাই বাড়তি ঘরগুলো তালাবন্ধই পড়ে থাকে। প্রায় বিশ বছর ওগুলোর দরজা খোলা হয়নি। খুললে হয়তো দেখব ইঁদুর, বাদুড়, আর চামচিকে আস্তানা গেড়েছে।’

প্রিয়নাথ কিছু বললেন না।

সুনীতের ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। বিনোদবাবু সামান্য ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।

ঘরের ভেতরের আলো প্রিয়নাথের চোখ ধাঁধিয়ে দিল, অলিন্দের আলো মুছে দিল। আর একইসঙ্গে ঘরের দৃশ্য প্রিয়নাথকে ধাক্কা দিল।

ঘরের এক কোণে সুন্দর ধপধপে বিছানা। সেখানে শুয়ে আছে বছর চব্বিশ-পঁচিশের এক যুবক। ফরসা রোগা চেহারা। বুকের কাছ পর্যন্ত লেপ টানা। একটা হাত লেপের বাইরে বলেই রোগা চেহারাটা স্পষ্ট করে আন্দাজ করা গেছে।

সুনীতের মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল। নাক ঠোঁট সুন্দর। ঠোঁটের ওপরে চওড়া গোঁফ। চোয়ালে দু-একদিনের দাড়ি।

সুনীতের চোখজোড়া প্রিয়নাথ দেখতে পেলেন না—কারণ, সাদা কাপড়ের পটি দিয়ে ওর চোখ ঢাকা।

প্রিয়নাথ বেশ অবাক হয়ে বিনোদনারায়ণের দিকে তাকালেন। বিনোদনারায়ণ ইশারায় ওঁকে অপেক্ষা করতে বললেন।

সুনীতের খাটের কাছে টুলে একজন বয়স্কা মহিলা বসে ছিলেন। রোগা ময়লা চেহারা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা, পরনে নীল পাড় সাদা শাড়ি। দেখে আয়া বলে মনে হয়।

বিনোদনারায়ণ তাঁকে বললেন, ‘মাসি, আপনি একটু নীচে গিয়ে বসুন। ডাক্তারবাবু কলকাতা থেকে এসেছেন—ছোড়দাকে দেখবেন।’

ভদ্রমহিলা উঠে চলে যাচ্ছিলেন, বিনোদনারায়ণ জিগ্যেস করলেন, ‘ওকে ঘুমের ওষুধটা খাইয়ে দিয়েছেন?’

ছোট্ট করে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে মহিলা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই প্রিয়নাথ জিগ্যেস করলেন, ‘সুনীতের চোখ বাঁধা কেন?’

উত্তর দিল সুনীত, ‘অন্ধকারে ঘুমোতে আমার ভয় করে। তাই ঘরের আলো জ্বেলে রেখে চোখ বেঁধে ঘুমোতে চেষ্টা করি।’

চোখ ফিরিয়ে সুনীতের দিকে তাকিয়েছিলেন প্রিয়নাথ। ও গায়ের লেপ সরিয়ে বিছানায় উঠে বসেছে। বাঁ-হাতে টান মেরে সরিয়ে দিয়েছে চোখের পটি।

ওর নিষ্পাপ সুন্দর চোখজোড়া প্রিয়নাথকে মুগ্ধ করল।

বিনোদনারায়ণ ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। তারপর ছোট ভাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘লেপটা গায়ে দে—ঠান্ডা লেগে যাবে।’

বসা অবস্থাতেই সুনীত লেপটা গায়ে জড়িয়ে নিল। তারপর কৌতূহলী গলায় ভূতনাথকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কীসের ডাক্তার? বডির, না মাইন্ডের?’

ওর প্রশ্নের ধরনে প্রিয়নাথ বেশ মজা পেলেন। বিনোদনারায়ণ একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটায় না বসে আয়া-মাসির ছেড়ে যাওয়া টুলটায় গিয়ে বসলেন প্রিয়নাথ। তারপর চোখের চশমাটা সামান্য নেড়েচেড়ে মজার সুরে পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার অসুখটা কীসের—বডির, না মাইন্ডের? ”তুমি” করে বললাম—কিছু মাইন্ড কোরো না?’

বিনোদনারায়ণ সুনীতের পায়ের দিকটায় খাটের এক কোণে বসে পড়লেন। বললেন, ‘সুনীত, ইনি হলেন প্রিয়নাথ জোয়ারদার। অনেক রিকোয়েস্ট করে কলকাতা থেকে ওঁকে ধরে এনেছি। আমাদের বাড়িতে ক’দিন থাকবেন…তোকে হেল্প করার চেষ্টা করবেন। তোর সব কথা তুই ওঁকে খুলে বলতে পারিস।’

সুনীত বারদুয়েক কাশল। লেপটা আরও ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল। তারপর মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল।

বিনোদনারায়ণের সঙ্গে প্রিয়নাথের চোখাচোখি হল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রিয়নাথ আগের প্রশ্নটাই আবার করলেন, ‘তোমার অসুখটা কীসের—বডির, না মাইন্ডের?’

আচমকা মুখ তুলে তাকাল সুনীত। বলল, ‘বডিরও না, মাইন্ডেরও না। অন্য কিছু…।’

বিনোদনারায়ণকে অবাক করে দিয়ে সিরিয়াস গলায় ভূতনাথ বললেন, ‘আমি সেই অন্য কিছুর ডাক্তার।’

পলকে ঘরের আবহাওয়া যেন পালটে গেল। বিনোদনারায়ণ উসখুস করতে লাগলেন। সুনীত কেমন চোরাচাউনিতে ভূতনাথকে দেখতে লাগল।

প্রিয়নাথ অফিসের ওপরওয়ালার সুরে বললেন, ‘শোনো, সুনীত—তোমার কী হয়েছে আমি বলছি। তুমি ভীষণ ভয় পেয়েছ। কেমন করে তা জানি না। তবে সেই ভয় তোমাকে ধীরে-ধীরে শেষ করে দিচ্ছে। তুমি যদি আমাকে সব খুলে বলো, তা হলে আমি তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করব। তোমার জন্যে দুশ্চিন্তা করে করে তোমার বড়দা-মেজদাও তো শেষ হয়ে যাচ্ছেন।’

সুনীত হঠাৎ কেঁদে ফেলল। কাঁদতে-কাঁদতেও বলল, ‘কী করে বলব! সে-কথা তো কাউকে বলা বারণ। কাউকে বলামাত্রই সর্বনাশ নেমে আসবে।’ একটু থেমে তারপর : ‘…তবে যদি কেউ নিজে গিয়ে দেখে আসে তা হলে আলাদা কথা…।’

প্রিয়নাথ বিনোদনারায়ণের দিকে তাকালেন। বিনোদনারায়ণ ইতস্তত করে বললেন, ‘সুনীতের ফটোগ্রাফির শখ আছে। মাঝে-মাঝেই ও ফটো তোলার ঝোঁকে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ত। মাসদুয়েক আগে ও সমস্তিপুরের দিকে গিয়েছিল। সঙ্গে ওর এক বন্ধু—পরেশ—ছিল। কিন্তু রওনা হওয়ার পাঁচদিন পর পরেশ বাড়ি ফিরে আসে। কারণ, বাড়িতে এস. টি. ডি. করে জানতে পেরেছিল ওর বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুনীত ফিরে আসে তার ছ’দিন পর। তারপর থেকেই ওর এই অসুখ। আমি ওকে বহুবার জিগ্যেস করেছি, কিন্তু ও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি—অথবা, বলতে চায়নি। শুধু ”নেহা” আর ”সদরিয়া”—এই দুটো শব্দ ওর মুখ থেকে বারবার শুনতে পেয়েছি—তার বেশি কিছু নয়।’

বিনোদবাবু থামলেন।

সুনীত তখনও মাথা নীচু করে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল দেখে বিনোদনারায়ণ উঠে ছোট ভাইয়ের কাছে গেলেন। পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতে চাইলেন।

প্রিয়নাথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই সুনীত মুখ তুলে তাকাল বড়দার দিকে। করুণ গলায় বলল, ‘সেই ফটোটার কথা বললে না!’

‘ওহ-হ্যাঁ। ওর তুলে আনা দু-রিল ফটোগ্রাফের মধ্যে আটটা ছবি ব্ল্যাঙ্ক। মানে, ডেভেলাপ করে কিছু পাওয়া যায়নি। তবে একটা ফটো উঠেছে ভারী অদ্ভুত। সেটা আপনাকে দেখাচ্ছি…।’ বলে বিনোদনারায়ণ ঘরের একটা তাকের দিকে এগিয়ে গেলেন।

সেদিকে তাকালেন প্রিয়নাথ।

সুনীতের ঘরটা বেশ আধুনিক ধাঁচে শৌখিনভাবে সাজানো। দেওয়ালে সুন্দর তাক তৈরি করে টেপ রেকর্ডার, ক্যামেরা, বই সুচারুভাবে রাখা। দুটো বইয়ের ফাঁক থেকে একটা খাম বের করে নিলেন বিনোদনারায়ণ। তারপর প্রিয়নাথের কাছে এগিয়ে এসে খামটা প্রিয়নাথের হাতে দিলেন।

খামের ভেতর থেকে একটা ফটো টেনে বের করলেন প্রিয়নাথ।

ফটোর সবটাই ঘোর কালো এবং ঘন নীল মেশানো একটা অন্ধকার। তারই মাঝে সরষের মাপের অনেকগুলো লাল ফুটকি এলোমেলোভাবে ছড়ানো।

এই সাদামাঠা ফটোগ্রাফের কী মানে থাকতে পারে প্রিয়নাথ ভেবে পেলেন না।

বিনোদনারায়ণ বললেন, ‘এই ছবিটার মধ্যে যে কী আছে কে জানে! এটা দেখলেই সুনীত ভীষণ ভয় পেয়ে আপসেট হয়ে যায়। ও কোথাও গিয়ে কোনও কিছুর ন’টা ছবি তুলেছিল। তার মধ্যে আটটা ব্ল্যাঙ্ক, আর ন’ নম্বরটা এই…।’

অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ফটোটা দেখার পর প্রিয়নাথ সুনীতকে জিগ্যেস করলেন, ‘এসব ছবি তুমি কোথায় গিয়ে তুলেছিলে?’

সুনীতের বোধহয় ঘুম পাচ্ছিল। ও ঝিম-ধরা চোখে প্রিয়নাথকে জরিপ করছিল। বোধহয় দেখতে চাইছিল ফটোটা দেখার পর প্রিয়নাথের কীরকম প্রতিক্রিয়া হয়। সেরকম কোনও প্রতিক্রিয়া হল না দেখে একটু যেন হতাশই হল।

প্রিয়নাথের প্রশ্নে ও অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘সদরিয়া…নেহা…।’

প্রিয়নাথ একটা সিগারেট ধরালেন। অন্যমনস্কভাবে কিছুক্ষণ সিগারেট টান দিয়ে গেলেন।

বিনোদনারায়ণ চুপচাপ খাটের কোণে বসে পড়লেন, প্রিয়নাথকে লক্ষ করতে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর প্রিয়নাথ মুখ খুললেন। গম্ভীর গলায় বললেন ‘সুনীত, তুমি বোধহয় বাঁচতে চাও না। নইলে সব কথা আমাকে অন্তত খুলে বলতে আমি কথা দিচ্ছি—কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’

সুনীত করুণ গলায় বলল, ‘ওরা কাউকে বলতে বারণ করেছে। কাউকে বলা যাবে না। কাউকে না। কেউ যদি নিজে দেখে আসে…।’

‘আমি যাব!’ জোরালো গলায় বললেন প্রিয়নাথ, আমি নিজে গিয়ে দেখে আসব। ওদের কাউকে আমি ভয় পাই না।’

‘আমি ভয় পাই…।’

‘তুমি বলো কী করে সেখানে যেতে হয়।’

‘জানি না।’ ঘুম-জড়ানো গলায় বলল সুনীত, ‘…সদরিয়া…নেহা…।’

প্রিয়নাথ হাতের ফটোটা সুনীতের চোখের সামনে মেলে ধরলেন : ‘বলো, ‘কী আছে এই ছবিতে? বলো!’

চোখের পলকে সুনীতের মুখ আতঙ্কে ভেঙেচুরে গেল। ও বিশাল হাঁ করে ঘণ্টাদেড়েক আগের সেই হিমেল চিৎকার শুরু করল।

প্রিয়নাথদের কানে তালা লেগে গেল। ঘরের জানলার শার্সি ঝনঝন করে কাঁপতে লাগল। এক ভয়ঙ্কর অনুনাদ ঘরের আবহাওয়াকে পাগল করে দিল।

বিনোদনারায়ণ লাফিয়ে উঠে ছোট ভাইকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন।

প্রিয়নাথ টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর তীব্র চোখ সারাক্ষণ সুনীতকে লক্ষ করছিল।

আয়া-মাসি ভেজানো দরজা ঠেলে তাড়াহুড়ো করে ঘরে এসে ঢুকলেন। তাঁর মুখে-চোখে উদ্বেগ।

সুনীত হাঁফাচ্ছিল। ওর চোখ আধবোজা মতন হয়ে গেছে। বিনোদনারায়ণ ওকে ধীরে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। মাসিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘মাসি, আপনি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিন। আমরা যাচ্ছি—।’

প্রিয়নাথ আর বিনোদনারায়ণ সুনীতের ঘর ছেড়ে অলিন্দে বেরিয়ে এলেন। উজ্জ্বল আলো থেকে স্তিমিত আলোয় আসায় প্রিয়নাথের দেখতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। তিনি বিনোদনারায়ণকে বললেন, ‘ফটোগ্রাফটা আমার কাছে থাক। কাল সকালে আমি সুনীতের সঙ্গে কথা বলব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’

‘আপত্তি!’ মলিন আলোয় বিনোদনারায়ণের হাসিটা কেমন যেন দেখাল। নরম গলায় তিনি বললেন, ‘সুনীতকে সুস্থ করে তোলার জন্যে কোনও কিছুতেই আমার আপত্তি নেই।’

ওঁরা সিঁড়ি ঘুরে দোতলায় নেমে এসেছিলেন। তখনই কানে এল জড়ানো গলায় গান: ‘…কারণ সেবায় বারণ করো, জানতে পারি কারণটা কী…?”

‘প্রমোদ।’ চাপা গলায় বললে বিনোদবাবু, ‘এসব নাকি ওর তন্ত্র সাধনার অঙ্গ। হুঁঃ!’

প্রিয়নাথ কোনও কথা বললেন না।

‘রাত অনেক হল চলুন, হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নেওয়া যাক।’

প্রিয়নাথকে একতলার খাওয়ার ঘরের দিকে নিয়ে চললেন বিনোদনারায়ণ।

জাফরির ফাঁক দিয়ে বাতাস আসছিল। সেদিকে তাকিয়ে প্রিয়নাথ বুঝতে পারলেন, বাইরে অন্ধকার আর শীতের রেষারেষি শুরু হয়ে গেছে।

টিনের বাক্স লাগানো সাইকেল-ভ্যান নিয়ে যারা পাঁউরুটি আর বিস্কুট দোকানে-দোকানে জোগান দেয় তাদের কথা মনে পড়ল প্রিয়নাথের। পাঁউরুটি আর বিস্কুটের বদলে যদি বেশ কিছু কাচের মার্বেল সেই বাক্সে ভরে ভ্যানটাকে সদ্য ধান-কাটা কোনও চাষ-জমির ওপর দিয়ে চালানো হয়, তা হলে যেরকম ঝাঁকুনি ও শব্দ হবে তার সঙ্গে এই বাসটার চলার দারুণ মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন তিনি।

সমস্তিপুরে নেমে সরু লাইনের টেনে চড়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পথ চলার পর তিনি নেমেছিলেন কামনিতাল স্টেশনে। সেখান থেকে বাস ধরেছেন—তবে বাসটাকে দোমড়ানো-তোবড়ানো ক্যানেস্তারা বলাই ভালো। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় ছুটে চলা বাসের শব্দ আর ঝাঁকুনি প্রিয়নাথকে প্রায় কাহিল করে দিচ্ছিল। যদিও বাসের নাম ‘উড়ন খটোলা।’

আশার কথা একটাই। এই বাস তাঁকে সদরিয়া নিয়ে যাবে! তারপর… সেখানে নেমে…খুঁজে বের করতে হবে নেহাকে।

জানলার বাইরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসে গেছে। স্তিমিত রোদে ছুটে চলা গম-ভুট্টা-জওয়ারের খেত আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। সামান্য খোলা কাচের জানলার ফাঁক দিয়ে ছুটে-আসা বাতাস ক্রমে আরও ঠান্ডা হচ্ছিল। প্রিয়নাথ জ্যাকেটের চেন গলা পর্যন্ত টেনে দিলেন, মাফলারটাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলেন।

ভিড়ে ঠাসা বাসের ভেতরে অনেক যাত্রীই বিড়ির নেশায় ব্যস্ত। বোধহয় ‘নো স্মোকিং’ কথার ‘নো’-টা বাসের দেওয়াল থেকে মুছে গেছে বলে।

খানিক ইতস্তত করে অস্বস্তি কাটিয়ে প্রিয়নাথ একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর সুনীত নারায়ণের সমস্যার দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলেন।

হঠাৎ তাঁর মাথায় ভেতরে সুনীত হাড়-কাঁপানো ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল।

আর প্রিয়নাথের সাতদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল বসিরহাটের কথা। ঘোরালো প্যাঁচালো অলিন্দ আর সিঁড়িতে জট পাকানো প্রকাণ্ড বাড়িটার কথা।

সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পর প্রিয়নাথের চোখে ঘুম আসেনি।

দোতলার একটা ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। বিছানায় বসে নোটবই আর পেন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নানান মন্তব্য লিখেছেন প্রিয়নাথ। সুনীতের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য, বিনোদনারায়ণের কাছ থেকে শোনা কিছু জরুরি কথা, আর নিজের মতামত। সেইসঙ্গে লিখে নিয়েছেন, এরপর তাঁকে কী-কী কাজ করতে হবে।

লেখা-টেখার কাজ শেষ হলে পর প্রিয়নাথ ঘর অন্ধকার করে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। ঘরের সব জানলা-দরজা বন্ধ করে শুলে তাঁর কেমন যেন দম আটকে আসে। তাই পায়ের দিকের একটা জানলার পাল্লা অর্ধেকটা খুলে রেখেছিলেন। সেটা নিশ্চয়ই পুব দিক—কারণ, চাঁদের একটা টুকরো দেখা যাচ্ছিল।

বহু চেষ্টা করেও ঘুম আসছিল না। বিছানায় উসখুস করছিলেন। হঠাৎই জড়ানো গলায় গানের কলি শুনতে পেলেন : ‘নৃমুণ্ডমালিনী তারা/ মুণ্ডমালা কোথায় পেলি…।’

প্রমোদনারায়ণ। দোতলার বাসিন্দা—প্রিয়নাথের প্রতিবেশী।

রাতে খাওয়ার সময় প্রমোদনারায়ণের দেখা পাননি প্রিয়নাথ। এখন ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলে নিলে কেমন হয়!

বাইরে বেরিয়ে দেখলেন চওড়া বারান্দার শেষ প্রান্তে, খানিকটা চাতাল মতো জায়গায়, একজন ছায়া-মানুষ বসে আছে। তার শরীর অন্ধকার আর চাঁদের আলোয় মাখামাখি।

পায়ে-পায়ে কাছে এগিয়ে গেলেন প্রিয়নাথ। আলতো করে ডাকলেন, ‘প্রমোদবাবু—।’

ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন প্রমোদনারায়ণ।

একমুখ দাড়ি, ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল, কপালে লাল তিলক—চাঁদের আলোয় কালো দেখাচ্ছে। আর গভীর চোখদুটো নিশাচর প্রাণীর মতো অন্তর্ভেদী, উজ্জ্বল।

ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরদিকে তাকালেন প্রমোদনারায়ণ : ‘ও, ভূতনাথবাবু! আসুন…বসুন। মায়ের চরণ-ধোওয়া চাঁদের আলো…এর কোনও জবাব নেই।’

চাতালে সতরঞ্চি পাতা ছিল। ভূতনাথ তার ওপরে বসে পড়লেন। খোলা জায়গায় বেশ শীত করছিল। গায়ের শাল আরও ঘন করে জড়িয়ে নিলেন।

অন্ধকারে বেশ কিছু গাছের মাথা আর দু-একটা বাড়ি চোখে পড়ছে। একটা প্যাঁচা নিঃশব্দে উড়ে গেল। কয়েকটা জোনাকি আলোর ফুটকি জ্বেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। প্রিয়নাথের মনে পড়ে গেল সুনীতের ফটোটার কথা।

শীতের বাতাস যেমন-তেমন বইছিল। প্রিয়নাথের নাকে মদের গন্ধ ভেসে আসছিল।

‘শুনেছি, আপনি সুনুকে সারিয়ে তোলার জন্যে কলকাতা থেকে এসেছেন।’ প্রমোদনারায়ণ কথা বললেন, ‘আমিও ওকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। কিন্তু দাদা এমন ঝামেলা করে! কিছুতেই বোঝে না ধম-কর্ম এক জিনিস আর তন্ত্র আর-এক জিনিস। আমার সাধনায় বারবার বিঘ্ন ঘটায়…।’ বেশ বিরক্ত-ভাবে কথা শেষ করলেন প্রমোদবাবু।

প্রিয়নাথের কৌতূহল হল। ওঁকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি কীভাবে সুনীতকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন একটু বলবেন?’

‘বললাম যে—তন্ত্র দিয়ে। সবাই জানে, তন্ত্রশাস্ত্র চিরন্তন—প্রত্যক্ষ ফল দেয়। তন্ত্র স্বয়ং মহেশ্বরের মুখনিঃসৃত বাণী। একে কেউ কখনও অবজ্ঞা করে!’ একটু থেমে প্রমোদনারায়ণ বললেন, ‘সুনীতের জন্যে আমি ভূত-প্রেত ভয়নাশক যন্ত্র প্রয়োগ করেছি।’

‘সেটা কী জিনিস?’

‘চলুন—আমার ঘরে চলুন—দেখাচ্ছি।’

প্রমোদনারায়ণ চাতাল ছেড়ে উঠে পড়লেন। গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে ঘরের দিকে রওনা দিলেন।

প্রিয়নাথ ওঁকে অনুসরণ করলেন।

ঘরটা যথেষ্ট প্রাচীন, আর মাপে বেশ বড়। মেঝে পর্যন্ত লম্বা-লম্বা জানলা। ঘরের সিলিং-এ কড়ি-বরগা।

ঘরের দেওয়ালে নানা ধরনের ছবি আর ছক আঁকা। শিব ও কালীর বড়-বড় দুটো ফটো মালা দিয়ে সাজানো। ঘরের মেঝের এককোণে বইয়ের গাদা। তার পাশে চারটে তাকও বইয়ে ঠাসা।

ঘরের ডানদিক ঘেঁষে অগোছালো ময়লা বিছানা। বিছানার পাশে টেবিলে মদের বোতল, গ্লাস আর চশমা।

সব মিলিয়ে ঘরটায় কেমন যেন অগোছালো উচ্ছৃঙ্খল ছাপ।

হাতওয়ালা একটা চেয়ারে প্রিয়নাথকে বসতে বললেন প্রমোদনারায়ণ। তারপর টেবিল থেকে চশমাটা চোখে দিয়ে খাটের তলায় কী যেন খুঁজতে লাগলেন।

অবশেষে খুঁজে পেয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে লাঠির মতো গোল করে পাকানো একটা কাগজ। সেটা ভূতনাথের সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘এই দেখুন—ভূত-প্রেত ভয়নাশক যন্ত্র।’

ভূতনাথ দেখলেন, একটা ভূর্জপত্রে ছক কেটে কয়েকটা সংখ্যা

লেখা :

প্রমোদনারায়ণ বললেন, ‘দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে অষ্টগন্ধ দিয়ে লিখে রেখেছি। দাদাকে লুকিয়ে সুনীতের ঘরের দেওয়ালে—খাটের নীচে—সিঁদুর দিয়ে এই যন্ত্র লেখা আছে। এ ছাড়া শ্মশানে গিয়ে কিছু ক্রিয়াকর্ম করার চেষ্টা করছি। একটু-একটু কাজ হচ্ছে…আরও হবে। আসলে সুনু যে কোনওরকম হেল্প করছে না।’

প্রমোদনারায়ণের হাত থেকে যন্ত্রটা নিয়ে প্রিয়নাথ খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর সেটা ওঁকে ফিরিয়ে দিতে-দিতে বললেন, ‘আচ্ছা, সুনীত যে বারবার ”সদরিয়া” আর ”নেহা” শব্দ দুটো বলছে, তার অর্থ কী?’

প্রমোদবাবুর কপালে ভাঁজ পড়ল। ছোট্ট একটা ঢেকুর তুলে বললেন, ‘আমি ওকে বহুবার জিগ্যেস করেছি। তাতে আমার যা মনে হয়েছে, সদরিয়া কোনও জায়গার নাম—সমস্তিপুর থেকে যাওয়া যায়। আর নেহার ব্যাপারে জিগ্যেস করলে সুনু বলছে সেটা ওখানে গেলেই বোঝা যাবে…বলা যাবে না।’

রাতের আকাশে কুকুরের কাতর চিৎকার শোনা গেল।

প্রিয়নাথ চুপ করে ছিলেন। প্রমোদনারায়ণকে দেখছিলেন।

প্রমোদনারায়ণ বললেন, ‘আপনি কাল সকালে ওকে একবার জিগ্যেস করে দেখুন। যদি নতুন কোনও তথ্য পান…। ওর কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছে না…।’

শেষ কথাটা বলার সময় তন্ত্রসাধক মানুষটার গলা ভারী হয়ে এল। প্রিয়নাথ টের পেলেন, লোকে যা-ই বলুক না কেন, মানুষটার ভেতরে এখনও একটা স্নেহশীল মেজদা অবশিষ্ট আছে।

ওঁকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এলেন ভূতনাথ। বিছানায় গা ঢেলে দিতেই ঘুম দু-চোখে আসন পেতে বসল। ঘুমের ঘোরে সুনীতের তোলা ফটোগ্রাফটাকে স্বপ্ন দেখলেন। তবে ফটোর লাল ফুটকিগুলো জোনাকির মতো জ্বলছিল-নিভছিল।

বাসের প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি প্রিয়নাথের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিল। কন্ডাক্টর দেহাতি ঢঙে হাঁক পাড়ল : ‘সদরিয়া! সদরিয়া!’

সিট ছেড়ে উঠে বাঙ্ক থেকে সুটকেসটা নিলেন প্রিয়নাথ। প্রায় ধস্তাধস্তি করে ভিড় ঠেলে বাস থেকে নেমে পড়লেন রুক্ষ রাস্তায়।

এটা যে সদরিয়া নয় সেটা প্রিয়নাথ খোঁজখবর করে অনেক আগেই জেনেছেন। তবে এখান থেকে টাঙা পাওয়া যায়। টাঙা নিয়ে যায় গণ্ডক নদীর পাড়ে। সেখান থেকে খেয়া পার হয়ে আবার টাঙায় চড়ে বেশ খানিকটা গেলে তবে সদরিয়ার দেখা পাওয়া যাবে।

এতসব কাণ্ড করে প্রিয়নাথ যখন সদরিয়ার পা রাখলেন তখন অন্ধকার এবং শীত জাঁকিয়ে বসে পড়েছে। কুয়াশা ঠেলে একটা চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালেন।

দোকানে চার-পাঁচজন মানুষের জটলা। ওরা সব মুড়ি দিয়ে বসে কাঠের আগুন ঘিরে তাপ নিচ্ছে। গায়ে চাদর অথবা কম্বল। মাথায়-গলায় মাফলার, নয় গামছা।

 দোকানে ঢুকে উনুনের কাছাকাছি একটা ভাঙা কাঠের বেঞ্চে বসলেন প্রিয়নাথ। ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে এক গ্লাস চা আর দুটো বিস্কুট দিতে বললেন।

প্রিয়নাথ দোকানে ঢোকামাত্রই দোকানের লোকজন কথাবার্তা থামিয়ে চুপ করে ওঁকে দেখছিল। প্রিয়নাথের চেহারা ও পোশাকে ভিনদেশি ভাব কটকট করছে। প্রিয়নাথের মনে হল, ওরা কেমন সতর্ক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। কোনও কিছুর জন্য যেন অপেক্ষা করছে।

ঠিক এইরকম সতর্ক দৃষ্টি সুনীতনারায়ণের চোখেও দেখেছেন প্রিয়নাথ। প্রমোদনারায়ণের সঙ্গে কথা বলার পরদিন সকালে সুনীতের ঘরে গিয়ে আর-এক দফা চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তাতে বিরাট কিছু লাভ হয়নি। ‘সদরিয়া’ আর ‘নেহা’ শব্দ দুটো আলোচনায় এসে পড়তেই প্রিয়নাথ জানতে চেয়েছেন, ‘তুমি সদরিয়ায় গিয়েছিলে না?’

‘হ-হ্যাঁ…মানে…।’

‘কী করতে গিয়েছিলে?’ তীব্র স্বরে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ভূতনাথ।

‘ফ…ফটো তুলতে…ঘুরতে…।’ কেমন যেন ঘুম-জড়ানো গলায় বলল সুনীত।

‘সমস্তিপুর থেকে সদরিয়া কেমন করে যেতে হয়?’

হঠাৎই ভয় পেয়ে গেল সুনীত। ওর মুখটা চোখের পলকে রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কাঁপা গলায় ও বলল, ‘না, না—ওখানে যাইনি। ওখানে কেউ যায় না। আসল জায়গাটা আরও ভেতরে…কেউ সেখানে যায় না…আমাকে বলতে বারণ করেছে।’

‘কে বারণ করেছে?’

ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো কেঁপে উঠল সুনীত। প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ‘ওরা…ওরা বারণ করেছে। নেহা…নেহা…।’

‘নেহা মানে কী?’ সুনীতের হাত চেপে ধরে ওর মুখের ওপরে একরকম ঝুঁকে পড়লেন প্রিয়নাথ ‘কে নেহা? কী নেহা?’

সুনীত মাথা নীচু করল। ভয়ে কাঁদতে শুরু করল। গোঙানির স্বরে বলল, ‘জানি না। আর কিছু জানি না। আমাকে ছেড়ে দিন…প্লিজ… প্লিজ…।’

প্রিয়নাথ ওর অনুনয় আর কান্নাকে পাত্তা দেননি। নাছোড়বান্দার মতো বলেছেন, ‘তুমি কাকে ভয় পাচ্ছ? এখন তো দিনের আলো…এখন কীসের ভয়!’

সুনীত কান্না থামিয়ে ভূতনাথের দিকে সরাসরি তাকিয়েছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তারপর বলেছে, ‘না, এখন ভয় নেই। কিন্তু দিনের পর তো রাত আসবেই…তখন? তখন ওরাই সব…ওদের গোপন কথা আমি ফাঁস করতে পারব না। কেউ যদি নিজে থেকে জানতে পারে তা হলে ঠিক আছে। আমি কিছু বলতে পারব না—।’

এরপর সুনীত মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে।

এখন এই কুপির আলোয় বসে থাকা শীতে ঘেরা মানুষগুলোও যেন সুনীতের মতো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। অপেক্ষা করছে।

ধোঁয়া-ওঠা চায়ের গ্লাস প্রিয়নাথের হাতে এগিয়ে দিল দোকানদার— সঙ্গে দুটো বিস্কুট। চায়ে চুমুক দিতে-দিতে দোকানদারের সঙ্গে একরকম জোর করেই আলাপ জুড়ে দিলেন প্রিয়নাথ। এই শীতের রাতে একটা আশ্রয় না পেলে তিনি থাকবেন কোথায়!

বহু চেষ্টা করে যেটুকু জানা গেল তা হল : রাতে থাকার জায়গা পাওয়া মুশকিল। অচেনা মানুষকে কেউ এখানে আশ্রয় দেয় না। সেইজন্যই সন্ধের সময় বাঙালিবাবুকে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেছে। তবে এখনও সময় আছে। টাঙা নিয়ে বাস-রাস্তায় গেলে সাতটার লাস্ট বাসটা ধরা যাবে। সেটাই বাবুজির পক্ষে ভালো হবে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে পথে নামলেন প্রিয়নাথ। সুনীত কি এখানে সত্যিই এসেছিল? রাতে কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল ও? যদি রাতে কোথাও থাকার জায়গা না পাওয়া যায়…।

এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে প্রিয়নাথ কাঁচা সড়ক ধরে টাঙা-স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছিলেন, হঠাৎই কানে এল মলের ছমছম শব্দ।

ঘুরে তাকালেন প্রিয়নাথ।

বছর তেরো-চোদ্দোর একটি ফুটফুটে কিশোরী। পরনে ঘাগরা, চোলি, চাদর, ওড়না। পোশাক-মলিন। তবে রূপ আছে। রাস্তার আলো কম— কিন্তু তা সত্ত্বেও মেয়েটির রূপ আড়াল করা যায়নি।

প্রিয়নাথ নানা জটিল ভাবনায় ব্যস্ত ছিলেন। মেয়েটি ওঁর চোখে তাকিয়ে এমন সরল সুন্দরভাবে হাসল যে, সব দুশ্চিন্তা কোথায় মিলিয়ে গেল।

মেয়েটি বাঁ-হাতে ঝুলছে অ্যালুমিনিয়ামের একটা তোবড়ানো ক্যান। আর ডান হাতের মুঠোয় বোধহয় পয়সা।

ওর হাসিতে কেমন একটা ভরসা ছিল, প্রচ্ছন্ন আবাহনও ছিল যেন। হয়তো সেই কারণেই প্রিয়নাথ ওকে জিগ্যেস করে বসলেন এখানে রাতে থাকার কোনও জায়গা পাওয়া যাবে কি না।

প্রিয়নাথের জোড়াতালি দেওয়া ভাষা মেয়েটি দিব্যি বুঝতে পারল। মিষ্টি হেসে জবাব দিল, ‘কিঁউ নহী! জরুর মিলবে। হামার ঘর হ্যায় উধর—।’ আঙুল তুলে পশ্চিমদিকের অন্ধকার দেখাল মেয়েটি।

দুশ্চিন্তা নিমেষে মুছে গেল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই প্রিয়নাথ ভীষণ ক্লান্ত বোধ করলেন। ভ্রমণের ধকল তাঁকে মুহূর্তে যেন কাবু করে দিল।

মেয়েটি তাঁকে ডাকতেই প্রিয়নাথ ওর পিছু নিলেন।

মলিন আলোয় এবড়োখেবড়ো পথ ধরে শীত আর কুয়াশা ভেদ করে দুটি প্রাণী এগিয়ে চলল।

একটু এগোতেই রাস্তার আলো আর চোখে পড়ল না। ভাঙা চাঁদের ঘোলাটে আলোই একমাত্র ভরসা।

গোলোকধাঁধার মতো পথ ঘুরে-ঘুরে অবশেষে একটা বাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। আবছা আলো-আঁধারিতে বাড়িটাকে ভূতুড়ে অবয়ব বলে মনে হচ্ছিল।

যতটুকু বোঝা যায়, টিনের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি। বাড়ি ঘিরে উঠোন। উঠোনে বেশ কয়েকটা কলা গাছ, পেঁপে গাছ আর সুপুরি গাছ। উঠোনের একপাশে ধুনির আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। কুয়াশার স্তর ভেদ করে আগুনটাকে ঝাপসা দেখাচ্ছে।

সামান্য বাতাস বইছিল। বাতাসে গাছের পাতা নড়ে সরসর শব্দ হচ্ছিল।

প্রিয়নাথের মনে হল, ঘুমিয়ে নিথর একটা গাঁয়ের শেষ প্রান্তের শেষ বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বাড়িটার চারপাশে অনেকটা করে ফাঁকা জমি। আর আলো বলতে মাথার ওপরে চাঁদ, আর বাড়ির একটা জানলা দিয়ে ভেসে আসা লণ্ঠনের আলো।

প্রিয়নাথের শীত করছিল। মাফলারটা আরও ভালো করে গলায় জড়িয়ে নিলেন।

‘এই আমাদের ঘর, বাবুজি।’ মেয়েটি আলতো গলায় বলল।

প্রিয়নাথের হঠাৎই মনে হল, ওদের বাড়িতে আশ্রয় নেবেন অথচ এখনও ঠিকমতো আলাপ করা হয়নি। মানে, মেয়েটির নামে জিগ্যেস করা হয়নি।

‘তোমার নাম কী?’ প্রিয়নাথ জানতে চাইলেন।

তাঁর দিকে ঘাড় তুলে তাকিয়ে মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, ‘নেহা— নেহাকুমারী—।’

প্রিয়নাথ ওই শীতার্ত আঁধারে দাঁড়িয়ে সুনীতনারায়ণের ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনতে পেলেন। তাঁর পা ফেলার ছন্দে গরমিল হয়ে গেল। সুটকেসটাও হাত থেকে পড়ে যেতে চাইছিল। সময়মতো সর্তক না হলে সেটাকে সামাল দেওয়া যেত না।

কাঁচা উঠোন পেরিয়ে সামনের ঘরটায় ঢুকতেই উষ্ণতার ওম পেলেন প্রিয়নাথ। ঘরের হ্যারিকেনের আলোয় নেহাকে ভালো করে দেখলেন। এই মিষ্টি মেয়েটা কি সুনীতের ভয়ের কোনও হদিস দিতে পারবে!

ঘরে একটা ভাঙা চেয়ারে একজন বৃদ্ধ বসেছিলেন। চাদর মুড়ি দেওয়া শরীরে শুধু মাথার সাদা চুল, সাদা গোঁফ আর ছানি-পড়া ঘোলাটে চোখ নজর টানে।

নেহা পরিচয় করিয়ে দিল, বলল, ওর বাপুজি। তারপর দেহাতি ভাষায় ওর বাবাকে কী যেন বলল। উত্তরে বৃদ্ধ মানুষটি আলতো করে বারকয়েক ঘাড় নাড়লেন।

নেহা প্রিয়নাথকে বসিয়ে ছুটে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেল। একটু পরেই একজন বৃদ্ধা ও একজন তরুণকে একরকম হাত ধরে টানতে-টানতে নিয়ে গেল। নেহার মা ও দাদা।

বৃদ্ধার মুখের চামড়ায় অকালে বড় বেশি ভাঁজ পড়েছে। তবে চোখ দুটোয় মায়ের মমতা মাখানো। নাকে রুপোর নোলক, কানে দুল। মাথায় চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে।

নেহার দাদার রোগা কালো চেহারা। চোখ দুটো কেমন যেন শূন্য, দৃষ্টিহীন। কপালে লম্বা একটা কাটা দাগ। মাঝে-মাঝেই কেশে উঠছে—বোধহয় ঠান্ডা লেগেছে।

একটা অদ্ভুত গন্ধ প্রিয়নাথের নাকে আসছিল। অনেকটা বুনো ফুলের গন্ধের মতো।

আলাপের পালা শেষ হলে নেহা প্রিয়নাথের ভেতরদিকের একটা ছোট ঘরে নিয়ে গেল। বলল, ‘এ-ঘরেই আপনি থাকবেন। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে নিন, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

নেহা হাত-পা নেড়ে কথা বলছিল। ওর ভাষা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও ওর অঙ্গভঙ্গি ভূতনাথকে বুঝতে সাহায্য করছিল। নেহার সঙ্গে আলাদা কথা বলার জন্য ভূতনাথের আর তর সইছিল না।

সুটকেস খুলে দরকারি জিনিসপত্র বের করে খাটিয়ার ওপরে চাদর মুড়ি দিয়ে বসলেন ভূতনাথ। নেহার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

একটু পরেই নেহা চা নিয়ে এল। প্রিয়নাথের হাতে চায়ের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে মেঝেতে চাটাই পেতে বসে পড়ল। বুনো ফুলের গন্ধটা আবার প্রিয়নাথের নাকে এল।

‘বাবুজি এখানে কী কাজে এসেছেন?’

‘এই একটু-আধটু ঘুরে বেড়াতে…ফটো তুলতে।’ একটু থেমে আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন প্রিয়নাথ, ‘আচ্ছা, মাস দেড়-দুই আগে কোনও ছোকরা বাবু তোমাদের বাড়িতে এসেছিল? বাবুর খুব ফটো তোলার শখ ছিল…।’

নেহা সরলভাবে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, এসেছিল। বড় রাস্তায় এদিক-ওদিক ঘুরছিল, আমিই ডেকে নিয়ে এসেছি। আমাদের বাড়িতে দু-চারদিন ছিল। এখানে আনজান আদমিকে কেউ বাড়িতে থাকতে দেয় না। কিন্তু আমরা কোনও মেহমানকে কখনও ফেরাই না। মাঝে-মাঝেই আমাদের বাড়িতে মেহমান আসে। আমি ডেকে নিয়ে আসি।’

‘সেই ছেলেটির নাম কী ছিল? সুনীত?’ প্রিয়নাথ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে গাঢ় টান দিলেন।

‘নাম তো জানি না, বাবুজি।’ নেহা হাসল ফিক করে, বলল, আপনার নামও কি জানি?’

প্রিয়নাথ নিজের নাম বললেন। বললেন ফটো তোলার শখের কথা। তারপর শহরের টুকটাক গল্প শোনাতে লাগলেন। চা-সিগারেট শেষ হয়ে গেল।

হঠাৎ গল্পের মাঝে লাফিয়ে উঠে পড়ল নেহা। বলল, ‘এখন যাই, বাবুজি। দেরি হয়ে গেছে।’

ফুটফুটে প্রাণবন্ত কিশোরীটির মুখের দিকে তাকালেন প্রিয়নাথ। কীসের দেরি হয়ে গেছে! প্রিয়নাথের কপালে ভাঁজ পড়ল।

নেহা প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

একটু পরে থালা আর বাটিতে নিয়ে এল রুটি ও সবজি। প্রিয়নাথের ‘ডিনার’।

মেঝেতে থালা-বাটি সাজিয়ে কাঁসার গ্লাসে জল দিয়ে গেল নেহা। সঙ্গে একটা বাড়তি হ্যারিকেন। কিন্তু সেই আলোয় মলিন ঘরটা যেন আরও মলিন হয়ে উঠল। প্রিয়নাথের অন্তত তাই মনে হল।

নেহা যাওয়ার আগে বলে গেল, খাওয়া হয়ে গেলে বাসনগুলো দরজার বাইরে রেখে দিতে। আর বাবুজি যেন বাইরের উঠোনে গিয়ে হাত ধুয়ে নেন।

নেহা খুব ব্যস্তভাবে চলে গেল। বলল, ‘এখন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ুন—আবার কাল দেখা হবে।’

ঘড়িতে এখনও আটটা বাজেনি, অথচ শীত, অন্ধকার, আর নির্জনতা ঘড়ির কাঁটা যেন তিন-চার ঘণ্টা এগিয়ে দিয়েছে।

খাওয়াদাওয়া সেরে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় এসে জুত করে বসলেন প্রিয়নাথ। একটা সিগারেট ধরালেন। হ্যারিকেন দুটো নিভু-নিভু করে দিয়েছেন। ফলে সিগারেটের আগুনটাই বেশ জোরালো মনে হচ্ছে।

আষ্টেপৃষ্ঠে কম্বল মুড়ি দিয়ে নানান কথা ভাবছিলেন। দু-মাস আগে এখানে এসে সুনীত ঠিক কী-কী করেছিল? প্রিয়নাথ কি এখন সেই ভূমিকায় হুবহু অভিনয় করে যাচ্ছেন? টিভিতে দেখা অ্যাকশন রিপ্লের মতো?

নেহাদের চাপা কথাবার্তা কানে আসছিল। ওরা কি এখনও শোয়নি? নেহা তা হলে অমন ব্যস্তভাবে চলে গেল কেন?

একটু পরে সিগারেট শেষ করে শুয়ে পড়লেন প্রিয়নাথ। ওঁর ক্লান্ত শরীর খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরবেলা বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল প্রিয়নাথের।

আড়মোড়া ভেঙে দিন শুরু করতে গিয়েই বেশ অবাক হয়ে গেলেন। নেহারা কেউ বাড়ি নেই!

ওরা চারজন এই সক্কালবেলায় গেল কোথায়!

গোটা বাড়িটাই চক্কর মেরে দেখলেন প্রিয়নাথ! কেউ কোথাও নেই! সবক’টা দরজাই হাট করে খোলা। অথচ আসবাবপত্র, রান্নার জায়গা ইত্যাদি দেখলে মনে হয় ওরা আবার যে-কোনও মুহূর্তে ফিরে আসবে।

এককাপ চায়ের জন্য মনটা আনচান করছিল। তাই মোটামুটি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন প্রিয়নাথ। সঙ্গে নিলেন ক্যামেরা আর কম্পাস।

কুয়াশা কম থাকায় সূর্যের দাপট নেহাত মন্দ নয়। সামান্য ঘোলাটে দিনের আলোয় এলাকাটা আরও ভালো করে দেখলেন।

নেহাদের বাড়িটা বলতে গেলে একেবারে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে। চাষজমি আর পুকুর পেরিয়ে আরও যে-দু-চারটে মাটির বাড়ি চোখে পড়ে সেগুলোতে কেউ বাস করে বলে মনে হল না। আর দুরে তাকালে শুধু ধূ-ধূ মাঠ আর বড়-বড় গাছপালার দল। মনে হয় যেন নেহাদের বাড়িটাই লোকবসতির শেষ সীমানা।

প্রিয়নাথ আন্দাজে ভর করে এগোলেন। খানিক দূর গেলে হয়তো কাল রাতের ঘর-বাড়ি দোকানপাট চোখে পড়তে পারে।

পথে বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন। পকেট থেকে কম্পাস বের করে মাঝে-মাঝেই উত্তরদিকটা দেখে নিচ্ছিলেন। হঠাৎই দেখলেন, বেশ দূরে মেঠো পথ ধরে তিনজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে।

প্রিয়নাথ তাড়াতাড়ি পা চালাতে শুরু করলেন। একটু পরেই ওদের ধরে ফেললেন। একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। তার মধ্যে একজনের বয়েস এত কম যে, অনায়াসে ‘মেয়ে’ বলা যায়। আর পুরুষটির হাতে একটা সুটকেস।

প্রিয়নাথ হাঁফাতে-হাঁফাতে পুরুষটিকে জিগ্যেস করলেন, ‘কোনদিকে গেলে খাবার-দাবারের দোকানপাট পাওয়া যাবে বলতে পারেন?’

লোকটি প্রিয়নাথের পোশাক-আশাক চেহারা খুঁটিয়ে মেপে নিল। তারপর বলল, ‘চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি। আমরা টাঙা-স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি —পথে দোকানপাট পড়বে।’

মেঠো পথ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে লোকটির সঙ্গে আলাপ করলেন প্রিয়নাথ।

ওর নাম মহাবীর সাউ। সঙ্গে ওর বউ অমলাদেবী, আর ছোট মেয়ে হিরাকুমারী। ও দ্বারভাঙ্গার সিধৌলি গাঁয়ে থাকে। সদরিয়ায় এসেছিল বউয়ের জড়িবুটি চিকিৎসার জন্য। এদিকে একজন ধন্বন্তরী সাধুবাবা বসেন, তাঁর কাছে। ফেরার পথে লহরিয়াসরাই-এ একটু কাজ সেরে ফিরবে—তাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়েছে।

মহাবীরের কাছ থেকে এদিকটার খুব একটা বিশদ খবর পাওয়া গেল না। তবে ও প্রিয়নাথকে একটা চায়ের দোকানে পৌঁছে দিল। প্রিয়নাথ ওদের তিনজনের ফটো তুললেন। ওরা হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

প্রিয়নাথ চায়ের দোকানে ঢুকে এক গ্লাস চা নিয়ে বসলেন। ঠিক করলেন, আজ সারাটা দিন নেহাদের সম্পর্কে, সুনীতের ব্যাপারে খোঁজ নেবেন। এখানকার মানুষজন কথাবার্তায় এত সহজ সরল, অথচ অচেনা মুসাফিরকে কিছুতেই আশ্রয় দেয় না। কেন? সে কি ভয়ে? তা হলে সবাই যে-ভয় পায় নেহারা সেই ভয় পায় না কেন! বরং নেহার কথা অনুযায়ী ‘আমরা কোনও মেহমানকে কখনও ফেরাই না। মাঝে-মাঝেই আমাদের বাড়িতে…।’

সারাটা বেলা নানা জায়গায় ঘুরে-ঘুরে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছবি তুলে কাটালেন প্রিয়নাথ। কিন্তু তাঁর অনুসন্ধান এতটুকুও এগোল না। নেহাদের কেউ চিনতেই পারল না। ওদের বাড়িটা কোন দিকে সেটা আন্দাজ করে বলা সত্ত্বেও কোনও লাভ হল না। সবাই ঠোঁট উলটে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল, আর প্রিয়নাথকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।

সুতরাং, একরকম ব্যর্থ হয়েই, বেলা দেড়টা নাগাদ নেহাদের বাড়িতে ফিরলেন প্রিয়নাথ। তবে ফেরার কাজটা মোটেও সহজ হয়নি। বহু লোককে জিগ্যেস করে নানান গাছ আর বাড়ির নিশানা দেখে অবশেষে ফিরতে পেরেছেন।

কিন্তু আশ্চর্য। নেহাদের বাড়িটা সেই সকালের মতোই একা-একা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা এখনও বাড়ি ফেরেনি।

খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা প্রিয়নাথ পথেই সেরে এসেছিলেন। এখন কোনওমতে স্নান সেরে নিয়ে নিজের ঘরে আস্তানা গড়লেন। নোটবই বের করে তাতে আধঘণ্টা ধরে নানারকম মন্তব্য লিখলেন।

প্রিয়নাথ যখনই কোনও অভিযানে বেরোন তখনই সঙ্গে নেন তাঁর বিশেষ সরঞ্জামের থলে। এবারও সেটা সঙ্গে এনেছেন। তাতে আছে ক্যামেরা, টর্চ, প্রচুর ব্যাটারি, মোমবাতি, মার্কার, থার্মোমিটার, কম্পাস আর পেন্ডুলাম।

হঠাৎ কী মনে হওয়াতে সুটকেস খুলে থলে থেকে পেন্ডুলামটা বের করে নিলেন। সুতো ধরে ঝুলিয়ে ওটাকে দোলাতে লাগলেন। দুলুনিটা সামান্য এলোমেলো হচ্ছে বলে প্রিয়নাথের মনে হল। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। ঠান্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিল।

প্রিয়নাথ পেন্ডুলামটা রেখে দিলেন। দরজা বন্ধ করে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন খাটিয়ায়। মনে-মনে ঠিক করলেন, এখানে দু-একদিনের বেশি তিনি আর থাকবেন না। সুনীতের ভয় পাওয়ার রহস্যের কাছে হয়তো শেষ পর্যন্ত তাঁকে হার মানতে হবে।

সন্ধের আঁধার নেমে আসতেই প্রিয়নাথ হ্যারিকেন জ্বেলে নিয়েছেন। মনে-মনে ভেবেছেন, নেহারা যদি নিতান্তই আর না ফেরে তা হলে ওদের রান্নার জায়গা হাতড়ে যা পাবেন তাই দুটো মুখে গুঁজে দিয়ে কোনওরকমে রাতটা কাটিয়ে দেবেন। তারপর ভোর হলেই মহাবীরের চিনিয়ে দেওয়া পথ ধরে সোজা চম্পট।

কিন্তু তার আর দরকার হল না।

সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ নেহাদের কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেলেন প্রিয়নাথ।

 বেশ অবাক হয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাবেন, তার আগেই চঞ্চল পায়ে নেহা ঘরে এসে ঢুকল।

‘বাবুজি, ভালো আছেন?’ ওর মুখে সেই একই নিষ্পাপ হাসি।

‘তোমরা হুট করে কোথায় চলে গিয়েছিলে!’

মাথা নীচু করল নেহা। তারপর অপরাধীর চোখে প্রিয়নাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবুজি, রাগ করবেন না। রোজ আমাদের ওরকম চলে যেতে হয়। রাত পেরোনোর আগেই আমরা চলে যাই…আবার অন্ধেরা নেমে এলে ফিরে আসি।’

‘কোথায় যাও? কী দরকার সেখানে, যে রোজ যেতে হয়!’ প্রিয়নাথ একটু যেন বিরক্তই হলেন।

‘আপনার জন্যে চা নিয়ে আসি। এসে সব বলছি—।’ বেণী দুলিয়ে নেহা চলে গেল।

মিনিটপাঁচেক পরেই নেহা ফিরে এল। হাতে গরম চায়ের গ্লাস।

প্রিয়নাথের হাতে গ্লাসটা দিয়ে কাল রাতের মতোই মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর খানিকটা যেন বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘রোজ আমাদের যেতে হয়, বাবুজি। কেন যেতে হয় সেটা…আপনি আজ আমাদের সঙ্গে যাবেন?’

নেহার প্রস্তাবটা এত আচমকা এল যে, প্রিয়নাথ সঙ্গে-সঙ্গে কোনও জবাব দিতে পারলেন না।

নেহা আপনমনে বিড়বিড় করে বলে চলল, ‘আমাদের বাড়িতে যেসব মেহমান আসে তাদের আমরা সঙ্গে নিয়ে যাই। আমরা…ওখানে গেলে আপনি ফোটো খিঁচতে পারবেন।’ শেষ কথাটা নেহা বেশ উৎফুল্ল ঢঙে বলল। উৎসাহ নিয়ে তাকাল ভূতনাথের দিকে।

প্রিয়নাথের মধ্যে কেমন একটা মরিয়া ভাব জেগে উঠেছিল। তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘সুনীতবাবু তোমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন…ছবি তুলতে…?’

‘হ্যাঁ, গিয়েছিলেন।’ ঘাড় নেড়ে বলল নেহা। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল, ‘ওই বাবুর নাম তো জানি না—।’

‘আমি আজ তোমাদের সঙ্গে যাব।’

চাটাই ছেড়ে উঠে পড়ল নেহা। খুশির গলায় বলল, ‘যাই, মা আর পিতাজিকে বলে আসি। রাতে আপনার খাওয়া হলেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।’

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে গাঢ় আঁধার ও শীতের মধ্যে প্রিয়নাথ যখন ওদের সঙ্গে বেরোলেন তখন রাত সাড়ে ন’টা।

শীতের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে প্রিয়নাথের চেহারা মাপে প্রায় সুমো যোদ্ধাদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। সঙ্গের ঝোলা ব্যাগে ক্যামেরা ছাড়াও নিয়েছেন টর্চ, টর্চের ব্যাটারি, কম্পাস, থার্মোমিটার, আর পেন্ডুলাম।

অন্ধকারে কুয়াশা ভেদ করে আরও অন্ধকার পাঁচটা ছায়া এগোচ্ছিল। সকলের আগে প্রিয়নাথ আর নেহা। পিছনে বাকি তিনজন। কারও মুখে কোনও কথা নেই। যেন শবানুগমনে চলেছে সবাই।

প্রিয়নাথ হঠাৎই হোঁচট খেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে টর্চ জ্বাললেন। নেহা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আলো নিভিয়ে দিন, বাবুজি। আমি আপনার হাত ধরছি।’

অন্ধকারে প্রিয়নাথের হাত ধরল নেহা।

স্পর্শে সম্মোহন করা যায় কি না প্রিয়নাথ জানেন না। আর প্রিয়নাথের যেরকম মন এবং বয়েস তাতে কিশোরী নেহাকে নিয়ে কোনওরকম অন্যায় কল্পনা তাঁর কাছে নেহাতই হাস্যকর। কিন্তু তবুও কোন এক রহস্যময় কারণে নেহার হাত ছুঁতেই প্রিয়নাথ কেমন এক অলৌকিক ভরসা পেলেন।

আকাশ মেঘলা, চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। প্রিয়নাথদের ঘিরে রেখেছে গাঢ় কুয়াশার স্তর। বেশি দূর নজর চলে না। ঠান্ডা বাতাস যেন বাতাস নয়—বরফ। প্রিয়নাথ জ্যাকেটের ওপরে শাল জড়িয়েছেন। সেটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছেন শরীরে। আড়ষ্টভাবে সাবধানে পা ফেলছেন। অথচ নেহার চলা কত সহজ-স্বাভাবিক! এ পথ নিশ্চয়ই ওর অনেক চেনা।

বেশ কিছুক্ষণ পথ হাঁটার পর প্রিয়নাথের সময়, দিক, সবই গুলিয়ে গেল। অকারণেই একটা ভয় তাঁর মনের ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইল। তিনি লড়াই করে সেটাকে চৌকাঠের বাইরে আটকে রাখলেন।

সেইরকম একটা মনের অবস্থাতেই তিনি চাপা গলায় নেহাকে জিগ্যেস করলেন, ‘নেহা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘একটু পরেই দেখতে পাবেন—’ নেহা এত অস্পষ্ট গলায় কথাটা বলল যে, বেশ চেষ্টা করে ওর কথা শুনতে পেলেন প্রিয়নাথ।

মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর নেহা আবার কথা বলল।

‘যেখান দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছি, বাবুজি, বহত দিন পহেলে এখানে একটা গ্রাম ছিল। সে-গাঁয়ের নাম ছিল তিনকাহানি। তিনকাহানির শেষে ছিল বড়-বড় মাঠ, খেত। তারপরে সদরিয়া। তিনকাহানি আর সদরিয়ার বর্ডারে আমরা থাকতাম…।’

থাকতাম! তার মানে!

‘নেহা!’ প্রিয়নাথ ডেকে উঠলেন। নেহার হাতটা হঠাৎই শীতের চেয়েও ঠান্ডা মনে হল।

‘ভয় পাবেন না, বাবুজি।’ বলেই নেহা প্রিয়নাথের হাতটা ছেড়ে দিল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ওর ছায়া-শরীরটা কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।

‘নেহা!’ প্রিয়নাথ ডেকে উঠলেন আবার। পিছন ফিরে তাকালেন।

যে-তিনজন এতক্ষণ ধরে নিঃশব্দে ওঁদের অনুসরণ করছিল তারা কেউ নেই। সেখানে শুধুই কুয়াশা।

প্রিয়নাথ টর্চ জ্বাললেন। সেই আলোয় কম্পাসটা বের করে দেখলেন। উত্তরমুখী কাঁটা দক্ষিণদিকে মুখ করে স্থির হয়ে আছে!

‘আলোটা নিভিয়ে দিন, বাবুজি।’

নেহার গলা!

হতবুদ্ধি প্রিয়নাথ টর্চ নিভিয়ে দিলেন। কিন্তু চারপাশে কাউকে দেখতে পেলেন না।

টর্চ আর কম্পাস ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতেই নেহা আবার কথা বলল।

‘দাঁড়াবেন না, বাবুজি, চলুন—আমি আপনার পাশে-পাশেই আছি।’

‘তোমার পিতাজি-মাজি ওঁরা কোথায় গেলেন?’

অন্ধকার ভেদ করে নেহার গলা ভেসে এল : ‘ওঁরা এগিয়ে গেছেন। একটু পরে আমরাও সেখানে পৌঁছে যাব।’

আন্দাজে ভর করে পা ফেলতে লাগলেন প্রিয়নাথ। তিনি পোড়খাওয়া মানুষ। তা সত্ত্বেও কিন্তু বেশ নাড়া খেয়ে গেছেন। সুনীতনারায়ণের বয়েস অনেক কম। ওর অবস্থাটা কী হয়েছিল তিনি সেটা মনে-মনে আঁচ করার চেষ্টা করলেন।

হঠাৎই শীতটা যেন বেড়ে গেল। সামনেই দেখা গেল একটা বিশাল পুকুর। এই গাঢ় আঁধারেও জলের কোথাও কোথাও প্রতিফলন চোখে পড়ছে। বাকি অংশটা এক অদ্ভুত কুয়াশায় ঢাকা।

পুকুরটা পেরোতেই কুয়াশা যেন ফিকে হয়ে এল। কয়েকটা ছোট-বড় গাছ চোখে পড়ল প্রিয়নাথের। গাছগুলো এপাশ-ওপাশ দুলছে। অথচ বাতাস তেমন জোরে বইছে না। আর তখনই গাছের ওপরে গাঢ় আকাশে একটা নীল আভা দেখতে পেলেন প্রিয়নাথ। অনেকটা মা-কালীর গায়ের গাঢ়-নীল রঙের মতো।

‘নেহা—!’ ডেকে উঠলেন প্রিয়নাথ।

‘আমি আপনার পাশেই আছি, বাবুজি।’ কেমন যেন ব্যথা-পাওয়া গলায় নেহা বলল। মনে হল, ওর ভেতরে একটা কষ্ট হচ্ছে।

এমন সময় একটা গুনগুন শব্দ শোনা গেল। যেন অনেকে মিলে চাপা গলায় সুর করে গান গাইছে।

খুব নীচু পরদায় শুরু হয়ে সেই সমবেত ‘গান’ উঁচু পরদায় উঠতে শুরু করল। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও প্রিয়নাথ সেই অদ্ভুত ভাষার অর্থ বুঝতে পারলেন না। তবে সেই কোরাস ক্রমশ আকাশ-বাতাস ছেয়ে ফেলছিল।

হঠাৎই সামনে তাকিয়ে হকচকিয়ে গেলেন প্রিয়নাথ।

দূরের মাঝারি গাছের মাঝে কোথা থেকে এসে যেন হাজির হয়েছে প্রকাণ্ড এক মহীরুহ। তার ঝাঁকড়া মাথা থেকে ঝুরি নেমে এসেছে নীচের দিকে। কেমন অদ্ভুতভাবে হেলে গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর গাছের অন্ধকার শরীরে জোনাকির মতো জ্বলছে অসংখ্য লাল আলোর বিন্দু।

ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করলেন প্রিয়নাথ। অদ্ভুত গাছটা তাক করে শাটার টিপলেন। আর তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল সুনীতের তোলা ফটোগ্রাফটার কথা। এই সেই ফটোর রহস্য! কিন্তু এই গাছ দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে!

ক্যামেরা ব্যাগে রাখতেই অদৃশ্য নেহার গলা শোনা গেল। ‘ছবি দেখে সবকুছ মালুম হবে না, বাবুজি। আরও নজদিক চলুন—।’

সন্মোহিতের মতো এগোতে লাগলেন প্রিয়নাথ। হঠাৎই একটা বাতাসের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গেলেন যেন। বরফের মতো বাতাস তাঁকে ঘিরে মাথা খুঁড়ে মরতে লাগল। প্রিয়নাথের হাত-পা ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় যেন বুঝতে পারলেন, এখানে কম্পাস বা পেন্ডুলাম বের করে কোনও লাভ নেই। তিনি এক অন্য জগতে অন্য ঠিকানায় পা রেখেছেন।

 কোরাস গান এখনও বেশ জোরালো ঢঙে শোনা যাচ্ছিল। উঠছে, নামছে। যেন কয়েকশো মানুষ প্রাণপণে গলা মিলিয়ে সুর ধরেছে। সঙ্গে কোনও যন্ত্র-অনুষঙ্গ নেই।

হঠাৎই আকাশের নীল আভাটা নেমে এল সেই অলৌকিক গাছের গায়ে। আর তখনই প্রিয়নাথ—এতক্ষণ যা দেখতে পাননি তাই দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়নাথের হাত-পা অবশ হয়ে এল। ভয়ঙ্কর শীতেও কুলকুল করে ঘেমে গেলেন। ভয়ে চিৎকার করার জন্য হাঁ করলেন, কিন্তু কোনও শব্দ বেরোল না।

অসংখ্য মানুষ জড়াজড়ি করে গাছটা তৈরি করেছে। গাছের ডালপালা নিছকই ওদের হাত-পা। নেমে আসা ঝুরি ওদের হাত, হাতের বাঁকানো আঙুল, মহিলাদের লম্বা ঝুলে পড়া চুল। উল দিয়ে বোনা সোয়েটারের মতো ওরা নিজেদের শরীর দিয়ে বুনে ফেলেছে এই প্রকাণ্ড গাছ। ওদের সমবেত শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে-সঙ্গে গাছটা ফুলে উঠছে, চুপসে যাচ্ছে। আর হাপরের মতো ফোঁস-ফোঁস শব্দে নিঃশ্বাসের ঝড় উঠছে। সেই ঝড়ে প্রিয়নাথের চাদর উড়ছে, চুল উড়ছে।

মানুষগুলোর চোখের কোটরে ভয়ঙ্কর তীব্র এক লাল আলো জ্বলছে—যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো। এই চোখগুলোকেই দূর থেকে লাল আলোর বিন্দু বলে মনে হচ্ছিল। সুনীতের তোলা ফটোয় যেমন উঠেছে।

প্রিয়নাথ কখনও ভয়ের এত কাছাকাছি আসেননি। তাঁর শরীরের ভেতরটা কেমন করছিল। মাথা টলে যেতে চাইছিল বারবার।

কোরাস আর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল। সেই সঙ্গে গাঢ় নীল আলোর আভা, আর তার মাঝে উজ্জ্বল লাল বিন্দুর ঝাঁক যেন অলৌকিক এক সন্মোহন।

বহুদূর থেকে ভেসে এল নেহার গলা : ‘গাঁয়ে মড়ক লেগেছিল, বাবুজি। তাতে তিনকাহানির সবাই খতম হয়ে গেল। সব কাহানি খতম হয়ে গেল। সে বহত সাল পহেলে কি বাত। তারপর থেকে আমরা…ওই গাছেই একজোট হয়ে থাকি। রোজ রাতে এসে এই গাছটা আমরা তৈরি করি। দিনের বেলা আমাদের কেউ দেখতে পায় না। আর, রাতে আমরা ইচ্ছেমতন কাউকে দেখা দিই, কাউকে দিই না। মেহমানদের সেবা করতে আমরা ভালোবাসি। তাই পরদেশিবাবুদের মদত করি, দেখা দিই। আমরা যে রাতে এখানে এসে এমন করে থাকি সে কথা কাউকে বোলো না, বাবুজি। কিসিকো নহি বাতানা…।’

সমবেত কণ্ঠস্বর নেহার কথায় সুর মিলিয়ে ফিসফিসে গলায় বলে উঠল, ‘কিসিকো নহি বাতানা…কিসিকো নহি বাতানা…।’

সে-কথায় অলৌকিক শব্দের ঝড় বয়ে গেল যেন।

‘আমি এবার ওখানে যাই, বাবুজি? আমার মাজি, পিতাজি, বড়ে ভাইয়া, সবাই ওখানে ডালপালা হয়ে আছে। আমি যাই? ফির কভি মিলেঙ্গে…।’

ফিসফিসে কোরাস আকাশ-বাতাস মাতিয়ে বলে উঠল, ‘ফির কভি মিলেঙ্গে…ফির কভি মিলেঙ্গে…।’

প্রিয়নাথ আতঙ্কের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁর দমবন্ধ হয়ে যেতে চাইছিল, কোনও ইন্দ্রিয়ই যেন আর কাজ করছিল না। সেই অবস্থায় তিনি যে কেমন করে ছুটতে শুরু করলেন কে জানে!

দিগভ্রান্ত অবস্থায় পাগলের মতো ছুটছিলেন। কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ছিলেন। কখনও ধাক্কা খাচ্ছিলেন গাছের গুঁড়িতে। চশমা ছিটকে পড়ল কোথায়। হাতঘড়িটাও বোধহয় ভেঙে গেল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন সদরিয়ায়।

সমস্তিপুর থেকে ট্রেনে কলকাতা ফেরার সময় প্রিয়নাথ ভাবছিলেন, এবার সুনীতনারায়ণকে সারিয়ে তোলার কাজটা অনেক সহজ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *