নন্দিনীর রাতের স্বপ্ন
মৃত্যু নিয়ে কথা হচ্ছিল।
প্রিয়নাথ জোয়ারদারকে কাছে পেলেই কী করে যেন অলৌকিক অপার্থিব ঘটনার কথা চলে আসে। প্রিয়নাথের বাড়ি রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে। এ-পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িই বেশ পুরোনো। কোনও-কোনও বাড়ি পলেস্তারা খসে-পড়া চেহারার, অথচ দু-মহলা। কোনও বাড়ির দালানে রয়েছে গৃহদেবতার মন্দির, কোনও বাড়ি থেকে কাক-ভোরে শোনা যায় স্তোত্রপাঠ, আবার কোনও বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কলি। এসব বাড়ির আনাচে-কানাচে কার্নিশে গোলাপায়রার রমরমা।
এ-ধরনের পুরোনো পাড়ায় যেমন রোয়াক-কালচার রয়েছে তেমনই আছে বৈঠকি আড্ডার আসর। সুপ্রকাশ পালিতের বৈঠকখানায় এরকমই এক নিয়মিত আসর বসে। সন্ধেবেলার এই আসরে সবরকম বিষয় নিয়েই চর্চা হয়। কিন্তু প্রিয়নাথ হাজির থাকলেই কেমন এক ঘোরালো- প্যাঁচালো পথে আলোচনা শেষ পর্যন্ত ভূত-প্রেত অশরীরী-অলৌকিকে গিয়ে দাঁড়ায়।
আজ সেই সকাল থেকেই আকাশ মেঘভাসি। তারপর দুপুরবেলা ধারাপাতের প্রথম পাতার শুরু। যতই সময় গড়িয়েছে বৃষ্টির দুঃখ ততই বেড়েছে। তাই হাঁটুজল ঠেলে সুপ্রকাশ পালিতের বৈঠকখানায় মাত্র চারজন এসে হাজির হয়েছেন। রাস্তায় জমে থাকা জলের ওপরে খই-ফোটানো ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ পরিবেশটাকে একটু যেন অন্যরকম করে দিয়েছিল।
সুপ্রকাশ পালিতের চোখে হাই-পাওয়ারের চশমা। বেশ কিছুদিন আগে ছানি কাটিয়েছেন। বয়েস যত-না হয়েছে তার তুলনায় মুখে ভাঁজ পড়েছে অনেক বেশি। একটু মোটাসোটা জমিদারি চেহারার মানুষ। গাল দুটো ভারী হওয়ার মুখের দুপাশে সামান্য ঝুলে পড়েছে। মাথার চুল এখনও পুরোপুরি সাদা হয়ে যায়নি। নাকটা বেশ বড়, সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে। নীচের ঠোঁটটা খানিকটা ওলটানো। গায়ের রং মাজা হলেও ঠোঁটের রং অস্বাভাবিকরকম গোলাপি।
হঠাৎ সুপ্রকাশ পালিত মন্তব্য করলেন, ‘ভূতনাথকে আজ সরাসরি একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেব।’
প্রিয়নাথ সিগারেটের ধোঁয়ায় বুঁদ হয়ে ছিলেন, হেসে বললেন, ‘কী চ্যালেঞ্জ?’
চ্যালেঞ্জ মানে একটা স্ট্রেট কোশ্চেন করব—তার স্ট্রেটকাট জবাব চাই। যদি স্পষ্ট জবাব না দিতে পারেন তা হলে ধরে নেব আপনি হেরে গেছেন।’
বরেন মল্লিক পান চিবোচ্ছিলেন। জড়ানো গলায় কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার! কী ব্যাপার! ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।’
বরেন মল্লিকের লন্ড্রি আছে। তাই বর্ষা-ভেজা কাদা প্যাচপেচে দিন খুব পছন্দ করেন। পানের দারুণ ভক্ত। প্রায়ই বলেন, ‘পান আর বর্ষা আমার বড় ভরসা। পান নইলে জীবন বৃথা, আর বর্ষা নইলে লন্ড্রির ব্যবসা ঢিলে—ক্যাশবাক্স ঠনঠন গোপাল।’
বিজন সরকার এ-পাড়ার শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। পাড়ায় সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। ছিপছিপে ফরসা চেহারা। পঞ্চাশ ছুঁতে-না-ছুঁতেই মাথার চুলে মন্বন্তর শুরু হয়ে গেছে। সবসময় হাসিখুশি মেজাজে থাকেন। সুপ্রকাশ পালিতের সঙ্গে পাড়ার ব্যাপারেই কী একটা দরকার ছিল বলে এই বৃষ্টি মাথায় করেও এসেছেন। তারপর আড্ডায় জমে গেছেন।
বিজন সরকার হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার, সুপ্রকাশদা! একেবারে খেপে গিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন!’
বৃদ্ধ জগৎ শ্রীমানী হাতের বিড়িতে ঘন-ঘন টান দিচ্ছিলেন। ভাঙা ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলে উঠলেন, ‘কী স্ট্রেট কোশ্চেন, সুপ্রকাশ? আমার বউ ফুলশয্যার রাতে ইয়ের সময় যে-কোশ্চেন করেছিল সেরকম নয় তো।’ ফিকফিক করে হেসে উঠলেন জগৎ শ্রীমানী। হাসির দমক থামলে বিড়িতে জুত করে একটা টান দিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘অবশ্য প্রিয়নাথবাবুর ভয় বা লজ্জার কিছু নেই। উনি সাত্ত্বিক ব্যাচিলার মানুষ। তোমার কোশ্চেন যদি নো-বল বা ওয়াইড বল না হয় তা হলে উনি ঠিক স্ট্রেট ব্যাটে খেলে দেবেন।’
জগৎ শ্রীমানী চেহারায় ছোটখাটো। যথেষ্ট বৃদ্ধ মানুষ। আদিরসের রসিকতার জন্য পাড়ায় বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত। ঈশ্বরভক্ত মানুষ অথচ মজা করে বলেন, ‘ভগবান আমাকে টেনে নেয় নিক, কিন্তু আমার গোবেচারা বউটাকে নিয়ে কেন টানাটানি করছে বলুন তো! ভগবানসাহেবের কি বউ নেই!’
জগৎবাবুর স্ত্রী কয়েকবছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছেন। ভদ্রমহিলা বলতে গেলে মরে গিয়েও বেঁচে রয়েছেন।
প্রিয়নাথ হাতের সিগারেটে একটা জোরালো টান দিয়ে বললেন, ‘করুন আপনার কোশ্চেন।’
‘ভূত আছে, না নেই?’ গলাখাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে জানতে চাইলেন সুপ্রকাশ।
প্রিয়নাথ হেসে বললেন, ‘কী আর বলব! ভূত আছে ভাবলে যাঁদের সুবিধে হয়, তাঁরা বলেন ভূত আছে। আর, ভূত নেই ভাবলে যাঁদের সুবিধে হয়, তাঁরা বলেন ভূত-টুত কিছু নেই।’
উত্তর শুনেই প্রতিবাদ করে উঠলেন সুপ্রকাশ পালিত : ‘এ কেমন উত্তর হল, ভূতনাথ! এ তো এড়িয়ে যাওয়া জবাব হল। আমি ভূতে বিশ্বাস করি। কিন্তু ভূত আছে ভাবলে আমার তো কোনও সুবিধে হয় না।’
প্রিয়নাথ হেরে যাওয়া হাসি হাসলেন। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা গুঁজে দিলেন অ্যাশট্রেতে। তারপর খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘ঠিক আছে। একটা স্ট্রেটকাট জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
বরেন মল্লিক, বিজন সরকার আর জগৎ শ্রীমানী চনমনে হয়ে বসলেন।
হঠাৎই বাজ পড়ার শব্দ হল। শব্দের রেশ অনেকক্ষণ ধরে ছুটোছুটি করল মেঘলা আকাশে।
সকলের মুখের ওপরে আলতো করে চোখ বুলিয়ে প্রিয়নাথ বললেন, ‘আপনারা সকলেই তো একসময় জ্যামিতি পড়েছেন। তাতে বিন্দুর সংজ্ঞা মনে আছে? যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা বেধ নেই, কিন্তু অবস্থিতি আছে—তাকেই বলে বিন্দু! কী অদ্ভুত সংজ্ঞা। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা বেধ নেই, অথচ আছে। অর্থাৎ, মাপা যায় না, কিন্তু তার অস্তিত্ব আছে। এটাই আপনার স্ট্রেট কোশ্চেনের স্ট্রেটকাট জবাব, সুপ্রকাশদা। ভূত হল জ্যামিতির ওই বিন্দুর মতো। বিজ্ঞান দিয়ে মাপা যায় না, অথচ অস্তিত্ব আছে।’
প্রিয়নাথের কথা শুনে সকলেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেলেন। বৃষ্টির একঘেয়ে শব্দ স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল। ঘরে অদ্ভুত এক অনুভব নেমে এল যেন।
ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা বড়সড় তক্তপোশ—সবুজ-কালো চেক কাটা চাদরে ঢাকা। আর একটা হাতলওয়ালা বড় চেয়ার। চেয়ারের রং-পালিশ সবই মলিন হয়ে গেছে।
ঘরের এক দেওয়ালে একটা অ্যানসনিয়া পেন্ডুলাম-ঘড়ি। তার পাশেই একটা বড় মাপের পুরোনো ফটোগ্রাফ। ফটোয় সার বেঁধে অনেকে দাঁড়িয়ে। সময়ের আঁচড়ে ফটোর নানা জায়গায় ক্ষয় ধরেছে, কালো রং বাদামি হয়ে গেছে।
ঘরের ডানদিকে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কারুকাজ করা একটা প্রাচীন আলমারি। আলমালির পাল্লা কাচের। মলিন কাচের ওপিঠে কিছু বইপত্র আর টুকিটাকি জিনিস। একেবারে ওপরের তাকে দুটো পেতলের কাপ—কোনওকালে সুপ্রকাশ পালিতের কোনও পূর্বপুরুষ হয়তো প্রাইজ পেয়েছিলেন।
পুরোনো বিড়ি শেষ করে নতুন একটা বিড়ি ধরালেন জগৎ শ্রীমানী। সস্তা লাইটারটা পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে-রাখতে মাথা নেড়ে তারিফের সুরে বললেন, ‘বেড়ে বলেছেন, প্রিয়নাথবাবু। ভূত নেই, অথচ আছে। কিংবা আছে, অথচ নেই।’
বরেন মল্লিক পানের পিক ফেলতে দরজার কাছে উঠে গেলেন। ফিরে আসতে আসতে বললেন, ‘এ-বৃষ্টি আরও ঘণ্টাখানেক চলবে।’ তারপর তক্তপোশে গুছিয়ে বসে মন্তব্য করলেন, ‘বোঝা গেল ভূত হচ্ছে বর্ডারলাইন কেস।’
বিজন সরকার মন দিয়ে সকলের কথা শুনছিলেন, আর কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছিলেন। সামান্য ফাঁক পেতেই বেশ সিরিয়াস মুখে প্রিয়নাথকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, প্রিয়নাথবাবু, ভূত আর দুঃস্বপ্ন কি একই?’
প্রিয়নাথ ভুরু কুঁচকে বিজন সরকারের দিকে তাকালেন। আলো পড়ে তাঁর টাকের একটা দিক চকচক করছিল।
‘কেন, এ-কথা বলছেন কেন?’ প্রিয়নাথ জিগ্যেস করলেন।
‘যেহেতু দুটো দেখেই আমরা ভয় পাই। আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পাই। যদিও জানি ওগুলো স্বপ্ন, মিথ্যে—তা হলেও আমি ভয়ে কুলকুল করে ঘামতে থাকি। এটা কেন হয়?’
‘কারণ, স্বপ্ন দেখার সময় আমরা স্বপ্নটাকে সত্যি বলে ভাবি। ওটা যে স্বপ্ন, সেটা বুঝতে পারি ঘুম ভেঙে সচেতন হওয়ার পর। তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বপ্নটা আমাদের মনে থাকে না। অনেকসময় টুকরো-টুকরো মনে থাকে। গোটা স্বপ্নটা মনে রাখতে পারে এমন মানুষ খুবই কম। কোনও-কোনও স্বপ্ন কোন এক অজানা কারণে মনে থেকে যায়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর দেখা একটা স্বপ্ন সাঁইতিরিশ বছর পরেও স্পষ্ট মনে রাখতে পেরেছিলেন। এটা খুবই রেয়ার ক্যাপাসিটি। এর ব্যাখ্যা কেউ এখনও দিতে পারেননি। তা ছাড়া, স্বপ্ন যে আমরা ভুলে যাই তার ব্যাখাও বেশ জটিল।’
সুপ্রকাশ পালিত বিড়বিড় করে বললেন, ‘ভূতের মতোই…স্বপ্নও বড় রহস্যময় ব্যাপার। মৃত মানুষরা স্বপ্নেও অনেক সময় দেখা দেয়। আমার এক খুড়তুতো ভাই আটাশ বছর আগে বাস চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। আমি তখন কলকাতার বাইরে ছিলাম। ওকে শেষ-দেখা দেখতে পারিনি। অথচ ওর অ্যাকসিডেন্ট হওয়া ডেডবডিটা আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতে পাই। আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম।’
বৃষ্টি হঠাৎ জোরে শুরু হল। বাজ পড়ার শব্দ শোনা গেল আবার।
প্রিয়নাথ চোখ থেকে চশমা খুলে চশমার কাচ দুটো রুমাল দিয়ে মুছতে-মুছতে বললেন, ‘যদি আপনাদের হাতে সময় থাকে তা হলে একটি মেয়ের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার গল্প আপনাদের শোনাই। মেয়েটি বারবার করে বলেছিল, তার অসুখের কথা আমি যেন কাউকে না বলি। তাই ওর আসল নাম আপনাদের বলছি না। ও আমার কাছে ওর অসুখের ব্যাপারে কনসাল্ট করতে এসেছিল। আমি ওকে কয়েকটা সাজেশন দিয়েছি। তাতে কিছু-কিছু কাজও হয়েছে।’ চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসালেন প্রিয়নাথ : ‘তবে গল্পটা বলার পর কেউ আমাকে কোনও প্রশ্ন করতে পারবেন না। সুপ্রকাশদা, আপনিও যেন আবার নতুন কোনও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবেন না!’
একটু চুপ করে থেকে প্রিয়নাথ শুরু করলেন তাঁর কাহিনি।
‘ধরা যাক, মেয়েটির নাম নন্দিনী…।’
ঘরের তেরছা আলোয় নন্দিনীর মুখে ভয়ের ছাপ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ও অসহায় চড়ুইপাখির চোখে ডক্টর মল্লিকের চোখে তাকিয়ে রইল। অনেক আশা নিয়ে ও ডক্টর মল্লিকের চেম্বারে এসেছে। মনের চিকিৎসার ব্যাপারে ওঁর খুব নাম। অফিসের এক কোলিগের কাছে নন্দিনী ডক্টর সুনয়ন মল্লিকের খোঁজ পেয়েছে।
ডক্টর মল্লিকের কপালে অসংখ্য ভাঁজ—ভাঁজের সংখ্যা কখনও কমছে, কখনও বাড়ছে। গদি আঁটা রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ ছোট করে তিনি সাতাশ-আটাশের সুন্দরী মেয়েটির দিকে তাকালেন। একটা ছোট্ট ‘হুম’ শব্দ করে ভারী গলায় বললেন, ‘রক্তের দাগ? আপনি শিওর?’
নন্দিনী আমতা-আমতা করে বলল, ‘আমার তো সেরকমই মনে হয়েছে। আপনি হয়তো দেখলে বলতে পারবেন—।’
ডক্টর মল্লিক সোজা হয়ে বসলেন। তারপর পেশাদারি সুরে বললেন, ‘এইভাবে বললে ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে ঠিক ক্লিয়ার হচ্ছে না। কেমন যেন এলোমেলো…খাপছাড়া শোনাচ্ছে। আপনি বরং একটু গুছিয়ে বলুন…।’
নন্দিনী চেয়ারে একটু জড়সড় হয়ে বসল। তাঁতের শাড়ির আঁচলটা ডান কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে ঠিকঠাক করে নিতে চাইল। তারপর বারকয়েক ঢোক গিলে মিষ্টি গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, প্রথম থেকে গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি…।’
নন্দিনী প্রায় প্রত্যেক রাতে একটা ভয়ের স্বপ্ন দ্যাখে। স্বপ্নটা সত্যি-সত্যি ভয়ের কি না ও জানে না, তবে স্বপ্নটা দেখে ও ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। একই ভয়ের স্বপ্ন রোজ দেখতে দেখতে ভয়ের মাত্রা ক্রমশ কমে আসা উচিত, কিন্তু ওর বেলায় সেটা হয়নি। বরং উলটে ওর ভয় বেড়ে গেছে।
‘ডাক্তারবাবু, প্রায় এক বছর ধরে আমি একটা স্বপ্ন দেখি—একই স্বপ্ন—কিন্তু ওটা দেখলেই আমি ভয়ে পাথর হয়ে যাই—।’
ডক্টর মল্লিক লাইটার জ্বেলে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর ঠাট্টার মেজাজে বললেন, ‘আপনার মুখ-চোখ দেখছি শুকিয়ে গেছে। স্বপ্নটা আমাকে বলতে গেলেও কি আপনার ভয় করবে না কি! নিন, চটপট শুরু করুন…।’
‘সল্টলেকের আট নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে একটা ছোট বাড়িতে আমরা থাকি। আমরা মানে, আমি আর আমার মা। মায়ের অনেক বয়েস হয়েছে…নানান রোগে একেবারে শয্যাশায়ী। আমার বাবা মারা গেছেন প্রায় আট বছর আগে। মোটরবাইকে করে বাড়ি ফেরার সময় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। তারপর থেকে ওই বাড়িতে শুধু আমরা দুজন। আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে স্টেনোগ্রাফারের চাকরি করি। সেই সময়টা একজন আয়া মায়ের দেখাশোনা করে। মায়ের ঘর দোতলায়, আর আমারটা একতলায়। বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্যে এরকমভাবে শুতে হয়। তবে মায়ের ঘর থেকে আমার ঘরে কলিংবেলের ব্যবস্থা আছে—যদি কোনওরকম ইমার্জেন্সি হয়, তাই। মা রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোন। ফলে রাতে কখনও জাগেন না। এতে আমিও বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে পারি।
‘রাতে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে শুতে-শুতে আমার প্রায় এগোরোটা মতন হয়। তারপর একটু গল্পের বই-টই পড়ি। মোটামুটি আধঘণ্টা বই-ম্যাগাজিন পড়ার পর ঘুম। আর ঘুমোলে পরই আমি স্বপ্নটা দেখতে শুরু করি।’
কথা বলতে-বলতে নন্দিনীর গলার স্বর কেমন যেন ফিসফিসে হয়ে যাচ্ছিল। ওর ফরসা মুখে বিনবিন করে ঘাম ফুটে উঠল।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ডক্টর মল্লিকের ভীষণ মায়া হচ্ছিল। সিগারেটে তৃপ্তির টান দিয়ে তিনি মমতা মাখানো গলায় নন্দিনীকে তাড়া দিলেন: ‘থামলেন কেন, বলুন—।’
‘হ্যাঁ, বলছি—।’ একবার ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করল নন্দিনী, ‘আমার ঘরের একপাশে দেওয়াল ঘেঁষে একটা কাঠের প্যাঁচা আছে। খুব দুষ্প্রাপ্য কোনও কিউরিয়ো নয়—নেহাতই সাধারণ জিনিস। অনেক আগে রাজস্থানে বেড়াতে গিয়ে বাপি—মানে, আবার বাবা—ঘর সাজানোর জন্যে ওটা নিয়ে এসেছিলেন। আমার স্বপ্নটা শুরু হয় ওই প্যাঁচাটা দিয়ে—তবে ওটা তখন আর কাঠের প্যাঁচা থাকে না।
‘স্বপ্নের মধ্যে হঠাৎই আমি দেখতে পাই ওই প্যাঁচাটা সবুজ রঙের বরফের চোখে একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও ওর ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই আমি। কখনও-কখনও ওটা মুখ ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকায়। তারপর আবার রক্ত-হিম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘তখন আমার ভীষণ শীত করতে থাকে। ঠান্ডায় শরীরে কাঁটা দেয়, বুকের ভেতরটা আকুল হয়ে কাঁপতে থাকে। আর সেই সময়েই শুরু হয়ে যায় শিসের শব্দ। সুরেলা শিস দিয়ে কেউ যেন আমাকে ডাকছে—অনেকটা নিশির ডাকের মতো।
‘আমার বিছানার মাথার দিকে একটা জানলা আছে। তবে বারোমাসই ওটা আমি বন্ধ করে শুই। কিন্তু স্বপ্নের ভেতরে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, ওটা কে যেন খুলে দিয়েছে, আর খোলা জানলা দিয়ে হিম-বাতাস কুলকুল করে ঢুকে পড়ছে ঘরে।
‘ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, আমার খাটের নীচে কেউ যেন লুকিয়ে রয়েছে। বিছানায় শুয়ে-শুয়েই অলৌকিক এক ক্ষমতায় ব্যাপারটা আমি টের পেলাম। আর একইসঙ্গে একটা দুর্গন্ধের ঢেউ আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল। সাগরে যখন ঘুর্ণিঝড় ওঠে তখন কখনও-কখনও জলস্তম্ভ তৈরি হয়ে যায়। সেই জলস্তম্ভ যখন সাগরের বুকে আছড়ে পড়ে তখন তার ঝাপটায় অনেক সময় বড়সড় জাহাজও তলিয়ে যায়। এই দুর্গন্ধের ঝাপটা যেন তার চেয়েও কিছু বেশি। আমি একেবারে তলিয়ে গেলাম। আমার ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষমতা পলকে অসাড় হয়ে গেল।
‘বিছানা থেকে না-নেমেই আমি বিছানার চারপাশটা দেখতে পেলাম…।’
নন্দিনী দম নেওয়ার জন্য একটু থামল। খসখসে গলায় বলল, ‘একটু…একটু জল দেবেন?’
ডক্টর মল্লিকের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে তিনি টেবিলে রাখা একটা জলের জাগ এগিয়ে দিলেন নন্দিনীর দিকে। ঢকঢক করে জল খেল নন্দিনী। কয়েকটা বড়-বড় শ্বাস নিল। তারপর আবার শুরু করল ওর স্বপ্নের গল্প।
‘…দেখলাম, আমার বিছানার চাদরটা নাটকের ড্রপসিনের মতো মেঝের দিকে অনেকটা করে ঝুলে রয়েছে। আর কোন এক অলৌকিক হাওয়ায় চাদরটা কেঁপে-কেঁপে উঠছে। চাদরের পেছনে কিছু একটা নড়ছিল। এ-ও বুঝতে পারছিলাম, দুর্গন্ধের দমকা ঢেউটা বিছানার নীচ থেকেই বেরিয়ে আসছে। তা হলে কি দুর্গন্ধ ছড়ানো কোনও প্রাণী ওখানে লুকিয়ে থেকে আমাকে ভয় দেখাতে চাইছে! তখনই দেখলাম, চাদরের গায়ে রক্তের দাগ!
‘বিছানায় শুয়ে-শুয়েই আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম, টের পাচ্ছিলাম। আর ভয়ে সিঁটিয়ে কাঠ হয়ে যচ্ছিলাম। ওই শিসের শব্দ, প্যাঁচার ডানা ঝাপটানি, আর ওই গন্ধ আমাকে ধীরে ধীরে পালটে দিচ্ছিল। তার ওপর ওই রক্তের দাগ…।
‘হঠাৎই খেয়াল করলাম, আমার সারা গা লোমশ হয়ে উঠছে, দাঁতগুলো ঠোঁটের আড়ালে আর থাকতে চাইছে না। একইসঙ্গে আমার হাত আর পায়ের নখ কালচে লম্বা হয়ে বেড়ে উঠল। আর আমি পাগলের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে বিছানাটাকে দাঁতে নখে চিরে ফালাফালা করে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম।
‘অন্ধকারেই আমি সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু দূরে রাখা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে হঠাৎই নজর পড়েছিল আমার। দেখি, সেখানে আমার মুখের ছায়া পড়েছে। কিন্তু এ কার মুখ! সারাটা মুখ ওই প্যাঁচাটার চোখের মতো গাঢ় সবুজ, গাল দুটো বসা, চোখের জায়গায় দুটো অন্ধকার গর্ত। ঠিক তখনই একটা হিংস্র গর্জন শুনতে পেয়েছিলাম আমি। তারপর আর ভালো করে কিছু মনে নেই…।’
স্বপ্ন শেষ করে নন্দিনী থামল। ছোট রুমাল মুখে বুলিয়ে ঘাম মুছে নিতে চাইল।
ডক্টর মল্লিক কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর মাথায় আলতো করে হাত চালিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘স্বপ্নটা দেখে আপনার খুব ভয় করে নিশ্চয়ই?’
নন্দিনী শুকনো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ—।’
‘স্বপ্নের ঠিক কোন জায়গাটা আপনার কাছে সবচেয়ে ভয়ের বলে মনে হয়?’
একটু ইতস্তত করে নন্দিনী বলল, ‘বলব? শুনলে আপনি হাসবেন না তো!’
‘আরে না, না—আপনি নির্ভয়ে বলুন। আই অ্যাম ড্যাম সিরিয়াস।’
‘স্বপ্নের কোনও বিশেষ জায়গা নয়—গোটা স্বপ্নটাই আমার কাছে ভীষণ জীবন্ত আর সত্যি বলে মনে হয়—এটাই সবচেয়ে ভয়ের, ডাক্তারবাবু।’
ডক্টর মল্লিক হঠাৎই হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসির দমকে তাঁর ভারী শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘মিস রয়, আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না। আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের নানা ধরনের অবসেশন থেকে, মনের চাহিদা থেকে। অনেক সময় ছোটবেলার কোনও ঘটনার জন্যে অপরাধবোধ বহু বছর পর্যন্ত স্বপ্নের ভেতরে তাড়া করে ফিরে বেড়ায়।’ ডক্টর মল্লিকের কপালে ভাঁজ পড়ল। গলার স্বর নামিয়ে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘ছোটবেলায় আপনার সঙ্গে কোনও বাজে ব্যাপার হয়েছিল?’
‘বাজে ব্যাপার মানে?’ নন্দিনীর মুখে সরল বিস্ময় ফুটে উঠল।
‘মানে, ইয়ে, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কোনও ব্যাপার…।’
‘না-না, সেরকম কিছু হয়নি।’
‘তা হলে আপনার চিন্তার কিস্যু নেই। হয়তো কোনও আজগুবি ভয়ের গল্প পড়ে আপনার স্বপ্নে তার ছায়া পড়েছে। আপনি স্বপ্নটাকে কোনও গুরুত্ব দেবেন না। দেখবেন, ধীরে ধীরে আপনার স্বপ্নটা ঝাপসা হয়ে এসেছে।’
ডক্টর মল্লিকের আশ্বাসে নন্দিনী বোধহয় তেমন ভরসা পেল না। আমতা-আমতা করে বলল, ‘আমি গল্পের বই পড়ি বটে, তবে এই স্বপ্নটার মতো ঘটনা কোনও বইয়ে পড়িনি। আমার স্বপ্নটা ভীষণ জীবন্ত, আর সত্যি…।’
‘ওটা আপনার কল্পনা, মিস রয়। স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না—স্বপ্ন স্বপ্নই। আমরা যখন জেগে থাকি তখন নানান ঘটনায় অংশ নিই—তারই ছাপ কখনও-কখনও স্বপ্নে দেখা যায়। তার বেশি কিছু নয়। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যান। টিভি-তে একটু সিনেমা-টিনেমা দেখুন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারুন, প্রেম করুন, মায়ের সঙ্গে গল্প করুন—লিড আ নরমাল লাইফ। তা হলেই দেখবেন সব প্রবলেম সলভ হয়ে গেছে। আমার কাছে আর আসতে হবে না। আপনি আমাকে ওয়ান ফিফটি দেবেন।’
ডক্টর মল্লিক একটানা সুরে এমনভাবে শেষ কথাটা বললেন যে, নন্দিনী প্রথমটা বুঝতে পারেনি উনি ভিজিটের কথা বলছেন। তারপরই মাথা নীচু করে ব্যস্তসমস্তভাবে ব্যাগ হাতড়ে ভিজিটের টাকাটা বের করল, ডক্টর মল্লিকের হাতে দিল।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নন্দিনী, আলতো সুরে বলল, ‘আপনি বলছেন, সত্যিকারের সব ঘটনার ছায়া স্বপ্নে দেখা যায়। এর উলটোটা কি হয় না? মানে, স্বপ্নের ব্যাপারটা কি সত্যি হতে পারে না? বিশ্বাস করুন, আমার স্বপ্নটা এত জীবন্ত…।’
‘ডোন্ট টক রাবিশ, মিস রয়।’ নন্দিনীকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন ডক্টর মল্লিক, ‘সবকিছুর একটা লিমিট থাকা দরকার। বললাম তো, আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান—।’
নন্দিনী হাসল—কেমন যেন অস্বাভাবিক হাসি। তারপর মিষ্টি করে বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করছেন না তো! আমার স্বপ্নটা তা হলে আপনাকে দেখাই…।’
সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ ঘরের ভেতরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।
নন্দিনীর চোখে এক অলৌকিক আলো জ্বলে উঠল। ঘরের আলো স্তিমিত হয়ে গিয়ে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এল। একইসঙ্গে ঘরের উষ্ণতা কমতে-কমতে বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছে গেল। বিচিত্র এক হিম-বাতাস ঘরের ভেতরে পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে লাগল। শুরু হয়ে গেল এর সুরেলা শিসের শব্দ।
হঠাৎই একটা বিকট দুর্গন্ধের ঢেউ ডক্টর মল্লিকের চেতনা অসাড় করে দিল। একটা অদৃশ্য পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। আর অন্ধকারেই স্পষ্ট দেখতে পেলেন, সুন্দরী মেয়েটির কমনীয় হাত দুটো লোমশ হয়ে উঠছে, হাত আর পায়ের নখ মাপে বড় হয়ে বঁড়শির মতো বেঁকে গেছে, গাল দুটো বসে গিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে, চোখের জায়গায় দুটো কালো গর্ত—আর তারই মাঝে দুটো সবুজ আলোর বিন্দু।
নন্দিনীর মুখের রং ক্রমেই গাঢ় সবুজ হয়ে উঠছে, দাঁতের দিকে ভয়ে তাকানো যাচ্ছে না।
ডক্টর সুনয়ন মল্লিক আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলেন, তাঁর গায়ে কাঁটা দিল। বুঝতে পারলেন, তিনি শেষের খুব কাছে পৌঁছে গেছেন।
ভয়ংকর কর্কশ পুরুষালি গলায় নন্দিনী বলে উঠল, ‘এবার আমার স্বপ্নটা বিশ্বাস হল তো!’