ছায়াবন্দি খেলা
মিস্টার জোয়ারদার, আপনার কাছে কোনও অলৌকিক সমস্যা নিয়ে আমি আসিনি। ভূত-প্রেতের ব্যাপারে কোনও সাহায্যও চাইতে আসিনি।’ একটু থামলেন ভদ্রলোক। বোধহয় পরের কথাগুলো মনে-মনে গুছিয়ে নিতে চাইছিলেন। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে ঘন-ঘন তিনটে টান দিয়ে শেষ টুকরোটা খুব সাবধানে অ্যাশট্রের গায়ে ঘষে নিভিয়ে দিলেন। তারপর সেটা অ্যাশট্রের গর্তে ফেলে দিয়ে কুলকুল করে ধোঁয়া ছাড়লেন। ঘরে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি হয়ে গেল।
সেই মেঘের দিকে মুখ তুলে অবশ চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি। যেন অপূর্ব এক রামধনু তাঁকে মুগ্ধ করে দিয়েছে।
মেঘ ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে মিলিয়ে গেল। তখন ভদ্রলোক আনমনাভাবে বিড়বিড় করে বললেন, ‘বলতে গেলে এরকমই এক ধোঁয়ার গল্প আপনাকে আমি শোনাতে এসেছি। তবে সেটা সাদা ধোঁয়া নয়—কালো ধোঁয়া। ঘন কালো ধোঁয়ার মেঘও বলতে পারেন।’
প্রিয়নাথের কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছিল।
ভদ্রলোকের নাম অশেষ শিকদার। এয়ারপোর্টে চাকরি করতেন— বছরচারেক হল রিটায়ার করেছেন। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে রনিত বিদেশ সঞ্চার নিগম লিমিটেড-এ করণিক। প্রায় আট বছর হল বিয়ে করেছে। তিন-সাড়ে তিন বছরের একটি মেয়েও আছে।
অশেষবাবুর মেয়ে প্রমিতা পাস কোর্সে বি. এসসি. পাশ করে বসে আছে। ঘরকন্নার কাজে মাকে সাহায্য করে আর গোটাচারেক টিউশনি করে।
ওঁরা সবাই থাকেন কৈখালিতে। রিটায়র করার পর অশেষবাবু সেখানে বাড়ি করেছেন। মোট ছ’জন মানুষ নিয়ে ওঁদের পরিবার বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু গত অগ্রহায়ণের এক অমাবস্যার রাত থেকে ওঁদের জীবনের ছকটা পালটে গেছে। ওঁদের সুখ-শান্তির সাজানো ঘুঁটিগুলো কেউ যেন কাঠের একটা কৌটোয় ভরে পাগলের মতো ঝাঁকিয়ে তারপর এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছত্রখান করে দিয়েছে।
অশেষ শিকদার ক’দিন ধরেই প্রিয়নাথকে ফোন করে দেখা করতে চাইছিলেন। কিন্তু ওঁর কথাবার্তার ধরন খুব স্বাভাবিক মনে না হওয়ায় প্রিয়নাথ দেখা করতে চাননি—বরং এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন।
কিন্তু একদিন ভদ্রলোক টেলিফোনে এমন একটা কথা বললেন যে, প্রিয়নাথ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। সেই কথাগুলো এই মুহূর্তেও প্রিয়নাথের কানে অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি তুলছিল।
অশেষবাবু আহত গলায় বলেছিলেন, ‘প্রিয়নাথবাবু, বুঝতে পারছি আপনি আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন। কারণ, আমার কথাবার্তা বোধহয় খুব একটা নরমাল নয়। আপনাকে একটা কথা বলতে পারি—আমি পাগল নই। কিন্তু আমার জীবনে যে-ঝড় বয়ে গেছে তাতে যে-কোনও মানুষই পাগল হয়ে যেত। আমি যে কেন হইনি সেটাই আশ্চর্যের।’ বিষণ্ণ হাসি হেসেছিলেন ভদ্রলোক। তারপর : ‘বোধহয় আপনাকে সেই ঘটনাগুলো বলার জন্যেই আমি এখনও সুস্থ অবস্থায় বেঁচে রয়েছি। নইলে বহুদিন আগেই তো আমার শেষ হয়ে যাওয়ার কথা! যাই হোক, এটুকু আপনাকে হলফ করে বলতে পারি, এরকম বিচিত্র ঘটনা আপনি জীবনে কখনও শোনেননি…।’
সেই বিচিত্র ঘটনা শোনার জন্যই প্রিয়নাথ শেষ পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন এবং শুক্রবার সন্ধ্যায় ওঁকে বাড়িতে আসতে অনুরোধ করেছেন।
অশেষ শিকদার যখন এসে হাজির হলেন তখন সওয়া ছ’টা মতন হবে। ভূতনাথ ওঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আজ একটু আগেভাগেই সন্ধেবেলার পুজো আর্চার কাজ সেরে নিয়েছিলেন। তারপর অগোছালো বসবার ঘরটাকে একটু-আধটু ঠিকঠাক করে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মেঝেতে ঢলে পড়া বইপত্র আর ম্যাগাজিনগুলো যতটা সম্ভব থাকে-থাকে সাজিয়ে নিয়েছেন।
ব্যাচিলারদের ঘরের একটা বিশেষ চরিত্র থাকে। সেটা অনেকটা যেন ছন্নছাড়া স্বাধীনতার ছাপ। আর যারা সংসারী, তাদের সংসার পরিপাটি সাজানো-গোছানো হলেও কোথায় যেন একটা পরাধীনতার রেশ থেকে যায়। অন্তত প্রিয়নাথ তাই মনে করেন। তাই নিজের ঘরটাকে তিনি কখনও খুব ছিমছাম করে সাজান না—পাছে তার মধ্যে পরাধীনতার ভেজাল ঢুকে পড়ে।
অশেষবাবু এসে প্রথমেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন, তারপর বংশলতিকার অল্পবিস্তর বিবরণ দিয়েছেন। প্রিয়নাথ তাতে বিরক্ত হননি। কারণ, আসল রসের সন্ধান পেতে হলে অনেকটা নীরস পথ পেরোতে হয়—প্রিয়নাথের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে। সুতরাং তিনি শুধু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন। অশেষবাবুকে একটানা কথা বলার সুযোগ দিচ্ছিলেন। আর মানুষটাকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।
চেহারা রোগার দিকে হলেও স্বাস্থ্য খারাপ নয়। গায়ের রং ময়লা। গাল সামান্য বসা। কাঁচা-পাকা সরু গোঁফ। মাথার চুল ছোট-ছোট করে ছাঁটা আর তার বেশির ভাগটাই সাদা। কপালে একটা শিরা উঁচু হয়ে রয়েছে। ওপর-ওপর দেখে ব্লাড সুগারের রুগি বলে মনে হয়। তবে সবচেয়ে লক্ষ করার মতো জিনিস হল চশমার কাচের আড়ালে ওঁর চোখ দুটো। সরু লম্বাটে মুখে অস্বাভাবিক বড়-বড় দুটো চোখ যেন ভীষণরকম বেমানান। তার ওপর ভয়ে কিংবা কৌতূহলে চোখের মণি দুটো সবসময়েই অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। আবার হঠাৎ করেই কোনও কিছুর দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চল হয়ে যাচ্ছে।
ছোট করে বারতিনেক কাশলেন অশেষবাবু। তারপর বলতে শুরু করলেন ওঁর বিচিত্র কাহিনি।
আমার বাড়িটা কৈখালির দশদ্রোণ এলাকায়। দু-কাঠা জমির ওপরে ছোট্ট একতলা বাড়ি। জমির ফাঁকা জায়গাটায় কয়েকটা সুপুরি গাছ আর একটা পেয়ারা গাছ আছে। পেয়ারা গাছটায় ভোরের দিকে কিংবা বিকেলের দিকে দু-চারটে পাখি-টাখি আসে—বসন্তবৌরি, বুলবুলি, কাঠঠোকরা—এ ছাড়া শালিক-চড়ুই তো আছেই।
বাড়ি আমার হয়তো কোনওদিনই করা হয়ে উঠত না, যদি-না হঠাৎ করে লালটুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে যেত। লালটু ওই এলাকারই ছেলে—’ত্রিবেণী এন্টারপ্রাইজ’ নামে ওর একটা কোম্পানি আছে— কন্সট্রাকশনের কাজ করে। ওর সঙ্গে রয়েছে এক ঝাঁক তরতাজা যুবক বিশ্বজিৎ, বাচ্চু, পলটু, দেবাশিস, আরও অনেকে। এলাকায় কোনও উৎসব হলে ওরা সবার আগে হইহই করে মেতে ওঠে। আবার কারও অসুখ-বিসুখ বা বিপদ-আপদ হলে সবার আগে ওরাই ঝাঁপিয়ে পড়ে—ঝড়-বৃষ্টি রাত-বিরেতের তোয়াক্কা করে না।
লালটু আমাকে ধারে জমির মালিক হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, ধারে বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে। আমি কোনওরকমে টাকার জোগাড় করে ওকে কিস্তিতে-কিস্তিতে শোধ দিয়েছি। বাড়িতে আমি আছি আজ চারবছর, কিন্তু ওর ধার এখনও শোধ করতে পারিনি—সামান্য কিছু বাকি আছে। আমি মনে-মনে জানি, ওর টাকা হয়তো আমি শোধ করে দেব, কিন্তু ওর ঋণ সারা জীবনেও শোধ করতে পারব না।
লালটুর কথা এত করে বলছি তার কারণ, আমার এই বিপদেও ও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ওর বন্ধুবান্ধবের দল নিয়ে প্রাণপথ লড়াইয়ে মেতে উঠেছিল—কিন্তু পারেনি। বোধহয় পারা সম্ভব ছিল না বলেই।
গত বছর অগ্রহায়ণ মাসের এক বিকেলে আমি বাড়ির বারান্দায় চুপচাপ বসে ছিলাম। শিবানী, মানে বউমা, ওর মেয়ে মুনমুনকে নিয়ে পেয়ারা গাছের নীচটায় বসে ছিল। আমার স্ত্রী বনানী বাড়ির ভেতরে টুকিটাকি কাজ সারছিল। ছেলে রুনু তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। সাধারণত ও সাতটা নাগাদ ফেরে। আর প্রমি বাড়ি ছিল না—টিউশানিতে গিয়েছিল।
পাখি দেখাটা আমার শখ। তাই পেয়ারা গাছটার ডালপালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দুটো বুলবুলি সেখানে খেলা করছিল।
সূর্য একটু আগে ডুবে গেছে। সময়টা গোধূলি মতন। শীতের বাতাস সবে হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করেছে। তা ছাড়া আমার বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা বড় পুকুর আছে। সন্ধের পর সেদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসে। সেদিন বাতাসটা একটু যেন বেশিই ঠান্ডা ছিল।
হঠাৎই আমার চোখে পড়ল একটা ছোট মেঘের টুকরো যেন আমার বাড়ির দিকে ভেসে আসছে।
সাধারণ মেঘের মতো হলে ব্যাপারটা আমার চোখ টানত না। কিন্তু ওটার ভেতরে একটা কিছু ঘুরপাক খাচ্ছিল। যেন কালো মেঘের ভেতরে একটা আরও কালো মেঘের ডেলা খাঁচায় বন্দি বাঘের মতো অস্থিরভাবে পাক খাচ্ছে আর ফুঁসছে।
পশ্চিমের আলো একপাশ থেকে এসে ওটার ওপরে পড়েছিল। তাতে মেঘটাকে আরও অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।
অদ্ভুত বলতে কীরকম? কালীপুজোর সময় আকাশে হাউই ওড়ে দেখেছেন? একরকম হাউই আছে যেগুলো আকাশে গিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর কয়েকটা উজ্জ্বল সাদা আলোর কণা ঝিকমিক করে জ্বলতে থাকে, আর হাওয়ার ভাসতে ভাসতে নামতে থাকে নীচের দিকে।
এই মেঘটার ভেতরেও সেরকম কিছু একটা হচ্ছিল। ওটার ভেতরে যেন অসংখ্য বিদ্যুতের কণা জ্বলছিল আর নিভছিল।
মেঘটা ভাসতে-ভাসতে আমার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে এসে পড়ল। তারপর পেয়ারা গাছটার ডালপালা-পাতার ভেতরে ঢুকে পড়ল।
দিনের আলো মরে আসছিল। তাই মেঘটাকে আর স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে হঠাৎই নজরে পড়ল, একটা বুলবুলি পাখি নেই। চঞ্চল হয়ে এ-ডাল সে-ডাল করতে-করতে কখন যেন উড়ে পালিয়েছে। আপনি তো জানেন, বুলবুলি পাখি জোড়ায়-জোড়ায় থাকে। তাই ভাবলাম, অন্য বুলবুলিটা এখনই উড়ে চলে যাবে সঙ্গীর কাছে।
কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বরং একটা চিৎকার কানে এল—কোনও পাখির কর্কশ চিৎকার। বেড়াল পাখির ছানা চুরি করতে এলে মা-পাখি যেমন কর্কশ চিৎকার করে অনেকটা সেইরকম। আর তারপরই দেখলাম, অন্য বুলবুলিটা গাছ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। গাছটাকে ঘিরে পাগলের মতো এলোমেলোভাবে উড়তে লাগল, আর ডাকতে লাগল।
সে-ডাক আমি চিনি। কারণ, আমি খুব খুঁটিয়ে পাখি দেখি, পাখির আচার-আচরণ লক্ষ করি। হারানো সঙ্গীর খোঁজে বুলবুলি অনেক সময় এরকম করে।
শিবানী মুনমুনকে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে আসছিল, আর মুখ তুলে বুলবুলিটার অদ্ভুত আচরণ দেখছিল।
বাড়িতে ঢোকার সময় শিবানী আমাকে বলল, ‘দেখেছেন, বাবা, পাখিটা কেমন করছে!’
আমি ছোট্ট করে ‘হুঁ’ বললাম।
ওরা ভেতরে চলে যাওয়ার একটু পরেই পাখিটা উড়ে কোথায় চলে গেল। অন্ধকার ঘন হয়ে আসায় কালো ধোঁয়ার মেঘটাকেও আর ঠাহর করতে পারলাম না।
দার্জিলিঙে বেড়াতে গিয়ে এরকম ভেসে থাকা ছোট-ছোট মেঘের টুকরো দেখেছি। অবশ্য ওগুলো মেঘ নয়—কুয়াশা। গায়ের ওপর দিয়ে চলে গেলে কেমন স্যাঁতসেঁতে ভাব টের পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে একটু বাড়তি শীত। এই কালো মেঘের টুকরোটা আমাকে দার্জিলিঙের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
এমন সময় আমি একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব টের পেলাম। আচমকা একটা শীত আমাকে কাঁপিয়ে দিল। আমি তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে উঠে ঘরে চলে এলাম। তখন বুঝিনি, আমার পিছু-পিছু আরও একজন কেউ ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতরে।
সেটা বুঝলাম পরদিন রাতে।
সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি। রাত তখন ক’টা হবে? এগারোটা-সওয়া এগারোটা। রুনু, শিবানী, প্রমিতারা সব শুয়ে পড়েছে। বনানী তখন রান্নাঘর শেষবারের মতন গুছিয়ে নিচ্ছে। ও প্রমিতার কাছে শোয়। আমি ড্রইং কাম ডাইনিং স্পেসে হালকা বিছানা পেতে শুই। তো চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেট টানতে-টানতে ডাইনিং স্পেসের সিলিং-এর দিকে আমার চোখ চলে গিয়েছিল। তখনই খেয়াল হল, সিলিং-এর এক কোণে যেন একটুকরো কালচে ধোঁয়া জমাট বেঁধে রয়েছে। ধোঁয়া বা মেঘ বা ছায়া যা-ই বলুন, ওটার কোনও নির্দিষ্ট শেপ ছিল না। দেওয়ালের কোণে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে কেমন যেন লেপটে ছিল। অনেকটা ড্যাম্পের ছাপের মতন।
আমি সিগারেট ফেলে দিয়ে ঘরে চলে এলাম। ছায়াটার ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে ওটাকে পরীক্ষা করার চেষ্টা করলাম। না, তেমন কোনও ব্যাপার আমার নজরে পড়ল না। শুধু মনে হল, দেওয়ালের গায়ে লেপটে ওটা যেন সামান্য নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে—ঠিক আমিবার মতন।
বনানী আমার বিছানা পাততে এল। ওকে ব্যাপারটা বললাম, আঙুল তুলে দেখালামও।
ও খুব একটা আমল দিল না। আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে ওটার কাছে এগিয়ে গিয়ে একপলক কী দেখল ও-ই জানে। তারপর বলল, ‘ও কিছু নয়, ঝুলের দাগ পড়েছে। তোমাকে বললাম রান্নাঘরে একটা একজস্ট ফ্যান লাগাও, তা আমার কথা শুনলে না। ও পরে একদিন আমি সন্ধ্যার মাকে নিয়ে ঝুলঝাড়ু দিয়ে সাফ করে দেব। এখন শোবে এসো।’
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু খচখচানিটা মন থেকে গেল না। কেমন যেন মনে হল, কাল সকালে উঠে ওই কালচে ছোপটাকে ওখানে আর দেখতে পাব না।
পরদিন সকালে উঠে দেখলাম, আমার ভাবনা অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি হয়ে গেছে।
এতে আমার স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে অস্বস্তিটা বেড়ে গেল। ছায়াটা এবার কোথায় কীভাবে দেখা দেবে সে-নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম।
ঠিক পাঁচ দিন পর ছায়াটা সাঙ্ঘাতিকভাবে জানিয়ে দিল, ও আছে। চলে যাওয়ার জন্যে ও আমার বাড়িতে এসে ঢোকেনি। কিন্তু আমার বাড়িটাই কেন যে ওর পছন্দ হল! পরে অবশ্য বুঝেছি, শুধু আমার বাড়িটা নয়—আমাকেও ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমাকে ছেড়ে ও কিছুতেই যাবে না। কেন তা জানি না।
আমাদের বাড়ির রোজকার নোংরাগুলো পলিথিনের প্যাকেটে করে সামনের সরু একটা রাস্তায় ফেলা হয়। ওখানে আরও দু-চারটে বাড়ির আবর্জনা এসে পড়ে। সেগুলো ফেলামাত্রই পাড়ার দুটো বেড়াল আর একটা নেড়ি কুকুর সেখানে এসে হাজির হয়। তারপর প্যাকেটগুলো নিয়ে টানহ্যাঁচড়া করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে কাঁটা-কুটো খায়।
হঠাৎ লক্ষ করলাম, আবর্জনা প্যাকেটগুলো জায়গা মতো আর পড়ছে না। কিংবা বলা যায়, পড়ার পরই ওগুলো নিয়ে কেউ চম্পট দিচ্ছে। এ-নিয়ে কাউকে কিছু বলার আগেই আর-একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করলাম।
আমার বাড়ির পেছন দিকটায় একটা তেঁতুল গাছ আছে। তার পাশ ঘেঁষেই আমার সেপটিক ট্যাঙ্ক। তো মাঝে-মাঝেই আমি বাড়ির চৌহদ্দি ঘুরে তদারকি করি, সাফসুতরো করি। সেদিন করতে গিয়ে দেখি তেঁতুল গাছটার গোড়ায় একরাশ আবর্জনা ছড়ানো। প্যাকেট ছিঁড়ে কেউ ওগুলোর মধ্যে থেকে পাগলের মতো খাবার খুঁজে বেড়িয়েছে। সন্দেহ করলাম, এ হয়তো কাকের কাণ্ড। আবার বেড়াল-কুকুরও হতে পারে। কিন্তু লক্ষ করলাম, ছড়ানো আবর্জনায় মাছের কাঁটা বা মাংসের হাড় এক কণাও নেই। বরং ভাত-তরকারি আর রুটির টুকরো অল্পবিস্তর পড়ে আছে। কাক-বেড়াল-কুকুর হলে মনে হয় না, এগুলো পড়ে থাকত। তা ছাড়া এ-জায়গাটায় কখনও আবর্জনা ফেলা হয় না বলে ওরা বোধহয় এদিকটায় আসেনি।
ব্যাপারটা নিয়ে সামান্য দুশ্চিন্তা যে হয়নি, তা নয়। তবে খুব বেশি আমল দিইনি। এর দিনতিনেক পরে ঘটে গেল সেই অদ্ভুত ঘটনা।
সেদিন রাত আটকা নাগাদ লালটু ওর বন্ধু দেবাশিসকে নিয়ে এল আমার বাড়িতে। আমিই আসতে বলেছিলাম—হাজার দশেক টাকা শোধ করব বলে।
আমরা তিনজনে ড্রইং কাম ডাইনিং-এ বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছি, মুনমুন হঠাৎ আমার কাছে এল। ওর পেছন-পেছন ঢুকে পড়ল একটা বেড়ালছানা। ধবধবে সাদা এই ছোট্ট বেড়ালটা দিন কুড়ি-পঁচিশ ধরে আমাদের সঙ্গী হয়েছে। মুনমুন ওকে শুধু খাওয়াতে চায়। বেড়ালছানা ঘাঁটে বলে বউমা মাঝে-মাঝেই ওকে বকুনি লাগায়।
মুনমুন আমার কাছে এসেই ‘দাদান, ম্যাঁওকে খেতে দাও’ বলে সামনের প্লেট থেকে থাবা দিয়ে একটা বিস্কুট তুলে নিল। বেড়ালছানাটা তখন লালটু আর দেবাশিসের প্লাস্টিকের চেয়ার ঘিরে লাফাচ্ছে, ছুটোছুটি করছে।
লালটু মুনমুনকে কোলে নেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছিল। মুনমুন পাকা বুড়ির মতো হাত তুলে ওকে অপেক্ষা করতে ইশারা করে বলল, ‘আগে ম্যাঁওকে খেতে দিই…।’
ঠিক তখনই শিবানী মেয়েকে ডাকতে-ডাকতে ঘরে এসে ঢুকল।
আমি চোখের কোণ দিয়ে একটা নড়াচড়া লক্ষ করলাম। সেদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি, টিভির টেবিলের নীচের অন্ধকার থেকে একটা অন্ধকার ছায়া গড়িয়ে আসছে আমাদের দিকে। মেঝেতে যেভাবে জল গড়ায় ঠিক সেইভাবে তরল কালো মেঘটা মোজেইক করা মেঝের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে আসতে লাগল।
লালটুদের আমি ওই ছায়া বা মেঘের ব্যাপারটা বলিনি। কারণ, বললেও হয়তো ওরা বিশ্বাস করত না। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, ওটা এভাবে দেখা দেবে আমি ভাবিনি।
কথা বলতে-বলতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। লালটু সেটা লক্ষ করে জিগ্যেস করল, ‘কী হল, অশেষদা?’
আমি কোনও শব্দ না-করে আঙুল তুলে ইশারা করলাম কালো ছায়াটার দিকে।
লালটু আর দেবাশিস সেদিকে তাকাল কিন্তু ঠিকমতো কিছু ঠাহর করতে পারল না।
লালটু শুধু বলল, ‘আপনার মোজেইকটা ওই জায়গায় কেমন কালচে হয়ে গেছে…।’
আর ঠিক তখনই খেলতে-খেলতে বেড়ালছানাটা ওই কালো ছায়াটার ওপর লাফিয়ে পড়ল।
একটা কালো চাদর হঠাৎ করে গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার মতো অন্ধকার ছায়াটা বেড়ালছানাটাকে চোখের পলকে সাপটে নিল।
শিবানী ভয়ে চিৎকার করে উঠল। দেবাশিসের হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে পড়ল মেঝেতে। লালটু চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর চোখ এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে যে-কোনও ধরনের একটা হাতিয়ার খুঁজছিল।
আর আমি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম।
কারণ, বেড়ালছানাটাকে আর দেখা যাচ্ছিল না। তবে ওর ‘ওঁয়া-ওঁয়া’ মরণ-চিৎকার আমাদের সকলের কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল।
আমার বুলবুলি পাখিটার কথা মনে পড়ে গেল। পাখিটার উধাও হওয়ার রহস্য সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। আজ, এই মুহূর্তে, হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পারছিলাম।
শুধু এই ভয়ঙ্কর সত্যিটুকু ছাড়া আর কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথা কাজ করছিল না। রেল-লাইন দিয়ে মেল ট্রেন ছুটে গেলে লাইনের দু-ধারের বাড়ির জানলা-দরজা যেরকম খটাখট করে কেঁপে ওঠে, আমার হাত-পা ঠিক সেইরকম কাঁপছিল। তবে পা দুটো মেঝেতে অসাড় হয়ে গেঁথে গিয়েছিল। আর শিবানীকে কিছু একটা বলতে চেয়ে আমি উদভ্রান্ত হাত দুটো শূন্যে উঁচিয়ে নাড়তে চেষ্টা করছিলাম।
শিবানীর ভয়ানক চিৎকার শুনে রুনু, প্রমি আর বনানী ছুটে এসেছিল এ-ঘরে। কিন্তু তখন মেঝের ওপরে শুধু একটা কালো ধোঁয়ার তাল পাক খাচ্ছে।
লালটু কোনওরকম হাতিয়ার খুঁজে না পেয়ে ধোঁয়ার তালটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দেবাশিস ‘লালটু! লালটু সরে আয়—’ বলে ওকে হাত বাড়িয়ে থামাতে চেষ্টা করেছিল। খামচে ধরেছিল লালটুর জামা। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। লালটুর জামার খানিকটা অংশ ছিঁড়ে রয়ে গেল দেবাশিসের হাতে। আর লালটুর শক্তপোক্ত দেহটা মেঝেতে আছড়ে পড়ার শব্দ হল। ও যন্ত্রণায় ‘উঃ’ শব্দ করে উঠল।
দেবাশিস আর রনিত লালটুকে ধরে তুলল। ততক্ষণে ছায়াটা ফিকে হয়ে গিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।
আমরা অতগুলো মানুষ কিছুই করতে পারলাম না। বেড়ালছানাটার চিৎকার কমজোরি হতে-হতে হঠাৎই থেমে গেল। ওটার শরীরের এক কণাও আর চোখে দেখতে পেলাম না।
ঘরটা মুহূর্তের মধ্যে শ্মশানের মতো চুপচাপ হয়ে গেল। শুধু মায়ের শাড়িতে মুখ গুঁজে মুনমুন ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
অনেক—অনেকক্ষণ পর রনিত আমার কাছে এসে দাঁড়াল। প্রায় ফিসফিসে গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার, বাবা? এসব কী হল?’
আমি বড়-বড় শ্বাস টেনে হাঁফাচ্ছিলাম। এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে বললাম, ‘জানি না।’
বনানী আমাকে এক গ্লাস জল এনে দিল। লালটু আর দেবাশিস আমাকে ঘিরে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শিবানী মুনমুনকে কোলে তুলে নিল।
নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার পর ওদের ছায়ার ব্যাপারটা বললাম।
প্রথমদিনের সেই বুলবুলি পাখির ঘটনা। তারপর আবর্জনা থেকে মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় উধাও হওয়ার ব্যাপার। আর বললাম বাড়ির আনাচেকানাচে ওটার ঘাপটি মেরে বসে থাকার কথা।
ওরা সবাই শুনল। কিন্তু তক্ষুনি কেউ কোনও কথা বলতে পারল না।
কিছুক্ষণ পর লালটু বলল, ‘অশেষদা, আপনি বিপত্তারিণীর পুজো দিন।’
আমি আর বনানী ধর্মভীরু মানুষ—দেব-দ্বিজে যথেষ্টই ভক্তি আছে। তাই লালটুর প্রস্তাবে সায় দিলাম।
দেবাশিস বলল, ‘অশেষদা, দিনের বেলায় ছায়াটাকে একবার খুঁজে দেখলে হয় না!’
‘কেন, খুঁজে পেলে কী করবি?’ লালটু জানতে চাইল।
দেবাশিস মাথা খাটাতে বেশি ভালোবাসে। ভেবেচিন্তে ধীরে-ধীরে কথা বলে। আর লালটু মাথাও খাটায়, সেই সঙ্গে শরীরও। ও সবসময়েই কিছু একটা করার জন্যে এক পায়ে খাড়া।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেবাশিস বলল, ‘খুঁজে পেলে ওটার ওপরে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেব।’
আমি মনে-মনে ভাবছিলাম : যাকে ধরা-ছোঁয়া যায় না, তাকে কি আগুনে পোড়ানো যায়!
লালটু বলল, ‘পেট্রল ঢেলে কিছু করা যাবে কি না জানি না—তবে খুঁজে দেখা যেতে পারে!’
দেবাশিস জিগ্যেস করল, ‘অশেষদা, কালো মেঘটা ঠিক কোনদিক থেকে ভেসে এসেছিল বলতে পারেন?’
‘পুকুরের দিক থেকে।’
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকার পর লালটু বিড়বিড় করে বলল, ‘ওদিকটায় প্রায় মাইলদেড়েক দূরে একটা কবরখানা আছে। এই ধোঁয়ার সঙ্গে লড়াই করে কিছু করা যাবে না। অশেষদা, আপনি বিপত্তারিণীর পুজো করুন—তারপর দেখুন কী হয়।’
আরও খানিকক্ষণ জল্পনা-কল্পনার পর লালটুরা চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, কাল দুপুরে দল বেঁধে ওরা ছায়াটাকে খুঁজতে আসবে।
সে-রাতে আমি আর ঘুমোতে পারলাম না। কানের কাছে শুধু বেড়ালছানাটার ‘ওঁয়া-ওঁয়া’ চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে বেড়ালছানাটার বদলে ওটা মুনমুনের কান্নাও হতে পারত। ঈশ্বর মুনমুনকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
এ-কথা ভাবতেই আতঙ্কের একটা হিম প্রবাহ আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। মনে হল, কালো ছায়াটার সঙ্গে আমরা পেরে উঠব না।
পরদিন দুপুরে লালটুর দলবল এল আমার বাড়িতে। তন্নতন্ন করে কালো ছায়ার দলাটাকে খুঁজল ওরা। কিন্তু সমস্ত খোঁজাখুঁজিই সার হল। ওটার কোনও হদিস পাওয়া গেল না।
ওরা চলে যাওয়ার অনেক পরে, সন্ধে ছ’টা-সাড়ে ছ’টা নাগাদ, ছায়াটাকে আমি দেখতে পেলাম। ওটা কোথায় লুকিয়ে ছিল জানেন! শুনলে আপনার গা ঘিনঘিন করে উঠবে।
আমি তখন বাথরুমে গিয়েছিলাম। হঠাৎই দেখি পায়খানার প্যানের গর্ত থেকে এক দলা কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে বেরিয়ে আসছে। গাঢ় কালো ধোঁয়াটার ভেতর থেকে যেন একটা চাপা রাগ ফুটে বেরোচ্ছিল। আর বাথরুমের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, ওটার ভেতরে বিন্দু-বিন্দু কয়েকটা আগুনের ফুলকি বালির কণার মতো চিকচিক করছে।
সাপের ছোবল মারার ভঙ্গিতে ধোঁয়ার একটা অংশ সরু হয়ে আমার দিকে ছিটকে এল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে বাথরুম থেকে একরকম পালিয়েই এলাম।
রথের পরে শনিবার বা মঙ্গলবার দেখে সাধারণত বিপত্তারিণীর পুজো হয়। কিন্তু আমার মনে হল, সেইদিনের জন্যে অপেক্ষা করতে হলে পুজো আমাদের বোধহয় আর করাই হবে না। তাই পাড়ার এক ঠাকুরমশাইকে ধরে জোর করে একটা দিন ঠিক করে বিপত্তারিণীর পুজো করলাম। কিন্তু অবস্থা একটুও বদলাল না। ছায়াটাকে মাঝে-মাঝেই দেখা যেতে লাগল।
রণিত, প্রমিতা, বউমা—ওরা সবাই মিলে আমাকে চাপ দিতে লাগল। বলল, বাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু চাকরি-জীবনের পয়সা তিলতিল করে জমিয়ে ধার নিয়ে, বহু কষ্টে বহু পরিশ্রম করে এ-বাড়ি আমি তৈরি করেছি। সে-বাড়ি এক কথায় বেচে দেব! তা ছাড়া এখন এই অভিশপ্ত বাড়ি কিনবেই বা কে!
আমি ওদের কথায় রাজি হতে পারলাম না। ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমার চাপা মন কষাকষি চলতে লাগল। রাতের ঘুম দিনের শান্তি—সব উবে গেল। আমার উদভ্রান্ত অবস্থা দেখে, কষ্ট দেখে, বনানীও খুব মনমরা হয়ে পড়ল। ঠাকুরকে প্রাণপণে ডাকতে লাগল, আর মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদতে লাগল। আমি ভেতরে-ভেতরে শেষ হয়ে যেতে লাগলাম।
এরপর একদিন আর-একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হল।
বিকেল গড়িয়ে সবে সন্ধে হচ্ছে। শিবানী রান্নাঘরে চা করছিল। বনানী মুনমুনের একটা ছেঁড়া জামায় ছুঁচের ফোঁড় দিচ্ছিল। মুনমুন আমার সঙ্গে ড্রইং কাম ডাইনিং-এ বসে টিভি দেখছিল। আর প্রমি আমাদের সামনেই মেঝেতে বসে একগাদা অডিয়ো ক্যাসেট নিয়ে তার কী একটা লিস্ট তৈরি করছিল।
হঠাৎই শিবানীর ভয়ঙ্কর চিৎকারে আমরা আপদমস্তক কেঁপে উঠলাম। ও যেন অন্ধ আতঙ্কে পাগল হয়ে একটানা মরণ-চিৎকার করে চলেছে। তারই মধ্যে বাসনপত্র ছিটকে পড়ার শব্দ হল। কিছু কাপ-প্লেট বোধহয় ভাঙচুর হল।
প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিতে আমাদের কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। তারপরই আমরা ছুট লাগলাম রান্নঘরের দিকে।
গিয়ে যা দেখলাম সেটা সংক্ষেপে গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
দোলের সময় কালো রং মেখে ভূত হলে যেমনটি দেখতে হয় শিবানীর অবস্থা অনেকটা সেইরকম। ওর ফরসা শরীরে, শাড়িতে, ব্লাউজে, সর্বত্র হতচ্ছাড়া কালো ছোপ। তবে ও নিজের পায়ে ভয় করে দাঁড়িয়ে ছিল না। শূন্যে ওর দেহটা পাক খাচ্ছিল, লাট খাচ্ছিল, আর ও হাত-পা ছুড়ছিল। সাঁতার না-জানা মানুষ সাগরে ভেসে গেলে বাঁচার চেষ্টায় যেভাবে হাত-পা ছোড়ে ঠিক সেইরকম। সোজা কথায়, ওই ভয়ঙ্কর কালো ধোঁয়ার তালটা শিবানীকে সাপটে ধরে যেন চেটেপুটে গিলে খাচ্ছিল।
আমাদের সবায়ের চিৎকারে এক কানফাটানো হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। আমি, বনানী, আর প্রমি শিবানীর শাড়ি-জামাকাপড় হাত-পা খামচে ধরে পাগলের মতো এলোপাতাড়ি টানতে শুরু করলাম। ওরই মধ্যে প্রমি আর বনানী হাউমাউ করে কাঁদছিল, আর মুনমুন ভয়ে নীল হয়ে গিয়ে ‘মা! মা!’ বলে চিৎকার করছিল।
কালো ছায়াটার শরীর থেকে একটা হিসহিস শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি এতটুকুও ভয় পাইনি। বরং আমার ভেতরে একটা বেপরোয়া রাগ আর জেদ টগবগ করে ফুটছিল।
রান্নাঘরের বদ্ধ জায়গায় তুমুল লড়াইয়ের পর শিবানীকে আমরা বাঁচাতে পারলাম।
কালো ছায়াটা আচমকা শিবানীকে ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে চম্পট দিল। শিবানীর শরীরটা হাতদুয়েক ওপর থেকে খসে পড়ল মেঝেতে। ওর নাকের ডানদিকের ফুটো দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। বেশবাস অগোছালো। দু-চোখ ভয়ে বোজা। ও বড়-বড় শ্বাস ফেলছিল আর থরথর করে কাঁপছিল।
প্রমি আর বনানী ওর ওপরে ঝুঁকে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছিল আর ওকে বারবার ডাকছিল : ‘বউদি! বউদি!’, ‘শিবানী, শিবানী!’
আমি বনানীকে চেঁচিয়ে বললাম, ‘মুনমুনকে ধরো! শিবানীর চোখে-মুখে-মাথায় জল দাও। আমি এক্ষুনি বীরেন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসছি!’
ডাক্তার-ওষুধ করে প্রায় তিনদিনের চেষ্টায় শিবানীকে ভালো করে তুললাম। ও বলল, চা-পাতা রাখার কৌটোর ঢাকনা খুলতেই ভেতরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা কালো-ছায়াটা ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কথাটা শুনে আমি হঠাৎই কেমন শিউরে উঠলাম।
শিবানীর দুর্ঘটনার পর থেকেই আমাদের সংসারে চিড় ধরে গেল। সেদিন রুনু অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর শিবানীর অবস্থা দেখেশুনে একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল। আমাকে ও সাফ জানিয়ে দিল শিবানী একটু ভালো হয়ে উঠলেই ওরা আমার অভিশপ্ত বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবে না।
চার-পাঁচদিন ধরে বাড়িতে প্রচণ্ড অশান্তি চলল। আমি একেবারে নির্বিকার নির্লিপ্ত হয়ে গেলাম। কেউ একশোটা কথা বললে হয়তো একটা কথা বলি। আমার আর কিছুই যেন ভালো লাগছিল না। বাঁচার ইচ্ছে একেবারে উবে গিয়েছিল।
একদিন সকালবেলা রনিত ওর বউ আর মেয়েকে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
আমি খবরের কাগজ পড়ছিলাম, মুখ তুলে তাকালাম। দেখি ওরা স্নান-টান সেরে সেজেগুজে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে।
‘বাবা, আমরা চলে যাচ্ছি।’ মেঝের দিকে তাকিয়ে আলতো গলায় বলল রুনু। তারপর একটু থেমে সময় নিয়ে : ‘তোমারও চলো। মা-কে বলেছি—মা, প্রমি—ওরা রাজি আছে…।’
‘তা হলে তুমি ওদের নিয়ে চলে যাও—।’
এ-কথা বলে আমি আবার খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলাম।
প্রমি আর বনানী বোধহয় পরদার আড়াল দাঁড়িয়ে ছিল। আমার জবাব শুনে সামনে বেরিয়ে এল।
বনানী আমার কাছে এসে খবরের কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিল। আমার হাত দুটো চেপে ধরে কান্না-ভাঙা গলায় মিনতি করে বলল, ‘তুমি কেন ছেলেমানুষের মতো জেদ করছ! এ-বাড়িতে থাকলে আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব। ওই শয়তান ছায়ার সঙ্গে লড়ে আমরা কেউ পারব না। তোমাকে কত করে বোঝাচ্ছি….তুমি কি কিছুতেই নিজের ভালো বুঝবে না!’
আমি পাথরের মতো বসে রইলাম। জানলা দিয়ে বাইরের গাছপালা আর আকাশ দেখছিলাম।
এবার প্রমিতা আমার কাছে এগিয়ে এল।
‘বাবা!’
আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখে-মুখে একটা জেদি ছাপ। ও আমার ধাত পেয়েছে।
‘বাবা, মরতে আমি ভয় পাই না। তবে এভাবে মরার কোনও মানে হয় না। এখানে থাকলে আমাদের সবার ক্ষতি হবে। তুমি কি তাই চাও?’
আমি এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ালাম : ‘না—চাই না। তাই তো বলছি, তোমরা সবাই চলে যাও—এ-বাড়িতে আমি একা থাকব। আমি এর শেষ দেখে তবে ছাড়ব।’
প্রমিতা বোধহয় বুঝতে পারল আমার সঙ্গে কথা বলে আর লাভ নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বনানীকে বলল, ‘মা, চলো—আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।’
বনানী জল-ভরা চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘না রে, আমার আর যাওয়া হবে না। তোরা যা—।’
অনেক টানাপোড়েন আর কান্নাকাটির পর ওরা চলে গেল। শুধু বনানী ওর একগুঁয়ে স্বামীটাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে রইল। আমরা দুটি প্রাণী ওই বাড়িতে রয়ে গেলাম। আর ছায়াটাও রয়ে গেল।
বনানী ঠাকুর-দেবতা নিয়ে সময় কাটায়। আর সুযোগ পেলেই আমার মেজাজ বুঝে পুরোনো অনুরোধটা করে : চলো, এ-বাড়ি ছেড়ে আমরা চলে যাই।’
নতুন ধরনের দুর্ঘটনা আর না হলেও একটা ব্যাপার লক্ষ করছিলাম। ছায়াটা সবসময় আমার কাছাকাছি থাকে। যখন-তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখা দেয়। আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে। যেন কিছু একটা করতে চায়। সেটা করবে না কি ভাবছে। তখনও বুঝিনি ওর মতলবটা কী। যখন বুঝলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বাইরের বাগানে দু-একটা পাখি মাঝে-মাঝে উধাও হচ্ছিল। মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় আগের মতোই গা-ঢাকা দিচ্ছিল। তবে এইসব ছোটখাটো ব্যাপারগুলো আমার গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। ছায়াটাকে আমরা বন্দি করতে চাইতাম বটে, তবে তার কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আমি আর বনানী পাড়ার লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ছোট্ট বাড়িটায় আমরা দুজনে মুখ বুজে দিন কাটাই। প্রমিতা বা রনিতদের কখনও আসতে বলি না। ওরা কেউ ফোনে খবর নিলে দায়সারা ঠান্ডা উত্তর দিই।
এরকম একটা অবস্থা যখন চলছে, তখন এক অমাবস্যার রাতে ছায়াটাকে আমি বন্দি করতে পারলাম। বনানী ব্যাপারটা দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। পরে, ধীরে-ধীরে, ব্যাপারটাকে সইয়ে নিয়েছে। আমিও সইয়ে নিয়েছি। ধরে নিয়েছি, এটাই আমার নিয়তি।
একদিন রেডিয়োতে আপনার একটা ইন্টারভিউ শুনলাম। আমার খুব ভালো লাগল। তখনই মনে হল, আপানাকে আমার ব্যাপারটা আমি জানিয়ে যাব। অন্তত একজন ব্যাপারটা জানুক, যে এটা আগাপাস্তলা বিশ্বাস করবে।
তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আপনার ফোন নাম্বার জোগাড় করেছি।
এরপর তো আপনি সব জানেন!
অশেষ শিকদারের মুখটা ভীষণ বিষাদগ্রস্ত আর করুণ দেখাচ্ছিল। কাহিনি শেষ করে তিনি যেন কোনও কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
প্রিয়নাথ সিগারেট ধরিয়েছিলেন। অশেষবাবুও। ওঁদের দুজনের ধোঁয়া ঘরের মধ্যে কুয়াশা তৈরি করছিল। প্রিয়নাথ কালো ছায়াটাকে চোখের সামনে দেখতে চাইছিলেন। তাই মনে-মনে ধোঁয়াটার রং কালো করে দিলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘শেষের ব্যাপারটা তো আপনি ঠিক খুলে বললেন না! ছায়াটাকে কী করে আপনি বন্দি করলেন?’
অশেষ শিকদার মলিনভাবে হাসলেন। হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে অ্যাশট্রেতে ফেলে দিলেন। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, ‘ছায়াটাকে আমি ঠিক বন্দি করিনি। বরং বলতে পারেন, ওটা নিজেই ধরা দিয়েছিল…’ কথা বলতে-বলতে চোখের চশমাটা খুললেন অশেষবাবু, টেবিলে নামিয়ে রাখলেন : ‘আপনাকে ব্যাপারটা দেখাই, তা হলে বুঝতে পারবেন…।’
পূর্ণ দৃষ্টি মেলে প্রিয়নাথের দিকে তাকালেন অশেষ শিকদার। ওঁর বড়-বড় চোখ দুটো ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে গেল। তারপর একটা গাঢ় কালো ছায়া কোথা থেকে এসে ওঁর চোখ দুটো ঢেকে দিল।
অবাক হয়ে প্রিয়নাথ দেখলেন, একটা মানুষ—অথবা, মানুষের ধ্বংসস্তূপ—কুচকুচে কালো রঙের দুটো আয়ত চোখ মেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে-চোখের সবটাই চোখের মণি—সাদার ছিটেফোঁটাও কোথাও নেই।
প্রিয়নাথ ভেতরে-ভেতরে কেঁপে উঠলেন।
অশেষবাবু এবার হাঁ করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে জমাট কালো ধোঁয়া ওঁর মুখের গহ্বর থেকে পাক খেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল। সেই ধোঁয়ার ভেতরে বালির কণার মতো চিকচিক করছে কয়েকটা সাদা আলোর ফুলকি।
‘বুঝতেই তো পারছেন। শেষ পর্যন্ত আমার শরীরের ভেতরে আস্তানা গেড়েছে ওই কালো ছায়াটা। আমাকে ছেড়ে ও কিছুতেই কোথাও যাবে না। হয়তো এভাবেই তিলতিল করে আমাকে শেষ করবে।’ অশেষবাবু কপাল চাপড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। কান্না জড়ানো গলায় বললেন, ‘আপনার কাছে কোনও সাহায্য আমি চাইতে আসিনি, মিস্টার জোয়ারদার। আমার অবস্থা এখন সব সাহায্যের বাইরে চলে গেছে। শুধু—শুধু আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা আপনাকে শোনাতে এসেছিলাম। আমি হলফ করে বলতে পারি, এরকম ঘটনার কথা আপনি কখনও শোনেননি—দেখেননি।’
অশেষবাবুর কথার তালে-তালে ওঁর মুখ থেকে কালো ধোঁয়ার ঝলক বেরিয়ে আসছিল। কালো ধোঁয়ার প্রকাণ্ড বেলুনটা তখন প্রিয়নাথের মাথার ওপরে ভাসছিল, দুলছিল। অশেষ শিকদার কালো চোখ মেলে সেই বেলুনটাকে দেখছিলেন।
প্রিয়নাথ জোয়ারদার জীবনে এই প্রথম ভয় পেলেন।