ভোম্বলদাসের ভাগনে
[ সত্য ঘটনা ]
।। এক ।।
শিকারের গল্পে আমরা বাঘ-ভালুক ও সিংহ-গন্ডারের অনেক কথাই পড়ি,কখনও হিংস্র পশু এবং কখনও-বা মনুষ্য বধের কথা। সেসব হচ্ছে দুঃসাহসিকতার ও ভীষণতার কাহিনি। কিন্তু মানুষের সঙ্গে যখন হিংস্র পশুর মুখোমুখি দেখা হয়, তখন সময়ে-সময়ে কীরকম হাস্যরসের অবতারণা হতে পারে, এখানে তার কিছু কিছু পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করব। সকলে মনে রাখবেন, এগুলি গালগল্প নয়, বিখ্যাত সত্য ঘটনা! প্রত্যেক ঘটনার বহু সাক্ষী আছে।
মার্টিন জনসনের Lion নামক পুস্তকে প্রথম গল্পটি আছে। ঘটনাক্ষেত্র হচ্ছে আফ্রিকা পশুরাজ সিংহের স্বদেশ। প্রথম ঘটনাটির নায়ক হচ্ছেন ভারতবাসী, তিনি ব্রিটিশ ইস্টআফ্রিকান রেলওয়ের একটি ছোটো স্টেশনের মাস্টার ছিলেন। ওই রেল লাইনে ভারতের আরও অনেক লোক চাকরি করত। কেবল ওখানে নয়, আফ্রিকার নানা প্রদেশে হাজার হাজার ভারতীয় লোক আছে।
স্টেশনের নাম কিমা। নির্জন স্থান, চারদিকে গভীর জঙ্গল।
হঠাৎ কোন খেয়ালে সেখানে বেড়াতে এসে একটা মস্ত সিংহ টের পেলে যে, এখানে খুব সহজেই মানুষ-খাদ্য পাওয়া যায়। সে রোজ সেখানে এসে হানা দিতে লাগল এবং কয়েকজন কুলিকে পেটে পুরে তার রাক্ষুসে খিদে আরও বেড়ে উঠল। যে-সিংহ বা যেবাঘ একবার মানুষের মাংসের স্বাদ পায়, সে আর কোনও পশুর দিকে ফিরেও তাকায় না।
এসব হাসিঠাট্টার কথা নয়,—চারদিকে ভয়ের সাড়া পড়ে গেল। মানুষরা আর ঘর থেকে বেরোয় না, সিংহের বড়োই অসুবিধা।
তখন সে স্টেশনে তদন্ত করতে এল। স্টেশনমাস্টার নিজের ঘরে বসে কাজকর্ম করছেন, হঠাৎ মুখ তুলে দেখেন, প্লাটফর্ম দিয়ে পশুরাজ আসছেন তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে।
বলাবাহুল্য, এরকম আলাপে তিনি রাজি হলেন না। একলাফে উঠে দমাদম দরজাজানলা বন্ধ করে দিলেন।
মানুষের অভদ্র-ব্যবহার ও অসভ্য অভ্যর্থনা দেখে পশুরাজের রাগ হল। হালুম বলে গর্জন করে সে একলাফে স্টেশনের ছাদের ওপরে গিয়ে উঠল।
ছাদটা ছিল করোগেটের! বড়ো বড়ো থাবা আর দাঁত দিয়ে সিংহ করোগেটের পাত টেনে খুলে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগল।
ঘরের ভেতর বসে সিংহের মতলব বুঝে স্টেশনমাস্টারের নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। পাঁচ-ছয় মন ওজনের মস্ত একটা সিংহের ভারে ও থাবার চোটে স্থানে স্থানে করোগেটের পাত ফাক হয়ে গেল! স্টেশনমাস্টার পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগলেন, কিন্তু কারুর সাড়া পাওয়া গেল না। যাদের সাহায্য করবার কথা, পশুরাজের আবির্ভাবে তারা চটপট অন্তর্হিত হয়েছে!
সিংহকে তাড়াবার আর কোনও উপায় নেই দেখে স্টেশনমাস্টার তখনই ট্রাফিক ম্যানেজারের কাছে এই চমৎকার টেলিগ্রাম পাঠালেন—সিংহ স্টেশনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। শীঘ্র সৈন্য প্রেরণ করুন—(Lion fighting with station, Send urgent succour)!
ভারতীয় স্টেশনমাস্টারের এক অপূর্ব টেলিগ্রাম আফ্রিকায় অমর হয়ে আছে। সেখানকার লোকেরা বিদেশি শিকারিদের কাছে আগে এই গল্পটি বলে।
উপসংহারে জানিয়ে রাখি, স্টেশনের সঙ্গে যুদ্ধ করে সিংহ সেবারে জয়ী হতে পারেনি।
।। দুই ।।
দ্বিতীয় ঘটনাটি পেয়েছি প্রসিদ্ধ শিকারি মেজর ডবলু রবার্ট ফোরান সাহেবের Kill or Be Killed নামক গ্রন্থে।
কেনিয়ার জঙ্গলে সিম্বা বলে ছোটো একটি রেল স্টেশন আছে—সেখানকারও স্টেশনমাস্টার হচ্ছেন একজন ভারতীয় বাবু!
ওদেশি ভাষায় সিম্বা বলতে সিংহ বোঝায়। সুতরাং সিম্বা স্টেশনে সিংহের যে অবাধ আধিপত্য, সেটা বোধহয় আর খুলে বলতে হবে না।
ভারতের নিরীহ বাবু অতশত খবর রাখতেন না, চাকুরির লোভে সেখানে গিয়ে পড়লেন তিনি মহাফ্যাসাদে। কারণ সিংহেরা সেখানেও রোজ স্টেশনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসতে লাগল! ভারতের বাবু, বাঘের কথাই জানেন, সিংহের বিক্রম দেখে প্রমাদ গুণলেন।
স্টেশনে ভারতীয় কুলিরা কাজ করত। খিদে পেলেই সিংহেরা এসে তাদের কারুকে-কারুকে মুখে তুলে নিয়ে চলে যেত। সিম্বা স্টেশন হয়ে দাঁড়াল সিংহদের খাবারের দোকানের মতো। হ্যাঁ, দোকানের মতো বটে, কিন্তু খাবারের জন্যে পয়সা লাগে না।
স্টেশনটি নতুন। তখনও সেখানে পাকা ঘর তৈরি হয়নি। কাজেই স্টেশনমাস্টারকে থাকতে হত তাবুর ভেতরেই।
তাঁবুর ভেতরে বাবু রাত্রে ঘুমোতে পারেন না। নিস্তব্ধ রাত্রের নীরবতা টুটে চারদিকে বনে বনে গন্ডার ঘোঁতঘোঁত করে, হায়েনা হা হা হাসে, হিপোপটেমাস ভয়ানক চাঁচায়, চিতেবাঘ খ্যাক-খেকিয়ে ওঠে এবং সবচেয়ে যারা ভয়ংকর সেই সিংহের দল মেঘের মতো গর্জন করে যেন বলে—মানুষের গন্ধ পাই, আজ কাকে খাই!
তাঁবুর আনাচে-কানাচে সিংহদের পায়ের শব্দ শোনা যায়, বাবু আঁতকে উঠে মনে মনে ইষ্টমন্ত্র জপ করতে থাকেন।
প্রতিদিনই এই কাণ্ড। প্রতিদিনই বাবুর মনে হয়, আজই তাঁর জীবনের শেষ দিন।
কুলিরা গাছে চড়ে রাত কাটায়। কিন্তু বাবুর সে ভরসাও হয় না, গাছে চড়ে ঘুমোবার অভ্যাস তাঁর নেই।
ভারতের বাবু, বুদ্ধি তো কম নয়। চট করে একটা উপায় আবিষ্কার করে ফেললেন।
স্টেশনের প্লাটফর্মের ওপরে পড়ে ছিল প্রকাণ্ড একটা জলের ট্যাংক, তার ভেতরে জল ছিল না।
বাবু ট্যাংকের ফোকরে মাথা গলিয়ে দেখলেন, কোনওরকমে ভেতরে তার ঠাঁই হতে পারে। খুশি হয়ে তিনি মনে মনে বললেন, সিম্বা স্টেশনের ধুম্বো সিংহ! আজ থেকে এর মধ্যে ঢুকে তোকে আমি সুবৃহৎ কদলী দেখাব! লোহার ট্যাংক তুই ভাঙতেও পারবি না, আর এই ছোট্ট ফোকর দিয়ে তোর অতখানি গতরও গলবে না! ওহো, কী মজা!
মজার কথাই বটে! বাবু তখনই কুলিদের হুকুম দিলেন, এই! ট্যাংকটাকে তোরা আমার তাঁবুর ভেতর টেনে নিয়ে যা
সে রাত্রে ট্যাংকের মধ্যে বালিশ ও বিছানা ফেলে দিয়ে বাবুও ঢুকে পড়লেন। ট্যাংকের ফোকরটা রইল ওপর দিকে। সে রাত্রেও সিংহরা মানুষের গন্ধ পাই বলে চাচাতে ও চতুর্দিকে টহল দিতে লাগল। বাবু মনে মনে হেসে বললেন, ততাদের আমি থােড়াই কেয়ার করি! আর তোরা আমাকে খুঁজে পাবি না। অনেক রাত পরে বাবু আজ নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রাদেবীর সেবা করলেন।
এক রাত, দুই রাত, তিন রাত যায়। বাবু রোজ প্রাণ ভরে ঘুমোন। স্টেশনের অন্যান্য লোক বাবুর সৌভাগ্যে হিংসায় ফেটে মরে। এমন মজার শয়ন-গৃহ সিম্বা স্টেশনে আর ছিল না। কেল্লার মতো দুর্ভেদ্য শয়ন-গৃহ, পশুরাজের জারিজুরি সেখানে খাটবে না।
চতুর্থ রাত্রে এক সিংহের ভারী খিদে পেলে। খাবারের দোকান সিম্বা স্টেশনে, কিন্তু সেখানে খাবারের গন্ধটুকুও নেই। জ্যান্ত খাবারগুলো ঝুলছে উঁচু উঁচু গাছের মগডালে, লাফ মেরেও নাগাল পাওয়া যায় না।
খাবার খুঁজতে খুঁজতে সিংহ গেল স্টেশনমাস্টারের তাবুর কাছে এবং গিয়েই মানুষের গন্ধ পেলে। থাবা মেরে তাবুর কাপড় ছিড়ে সে ভেতরে ঢুকল। সেখানেও খাবার নেই!
কিন্তু গন্ধ আছে। আর শোনা গেল সুখে নিদ্রিত বাবুর নাক-ডাকার আওয়াজ! সিংহ এক লাফে ট্যাংকের ওপরে আরোহণ করলে। ফোকরে নাক রেখে ভেঁস করে এক নিশ্বাস টেনে মনে মনে বললে, কী তোফা মানুষের গন্ধ! প্রাণ জুড়িয়ে গেল!
ততক্ষণে বাবুর ঘুম ভেঙে গিয়েছে এবং ফোকরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তিনি নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার মূর্তিমান কারণটিকে দেখতেও পেয়েছেন। এবং বুঝতে পেরেছেন, এই মজার শয়নগৃহের আসল মজাই হচ্ছে, এখান থেকে পালাবার কোনও উপায়ই নেই। বাইরে থাকলে ছুটে পালাবার পথ পাওয়া যেত, কিন্তু আজ তিনি মজার শয়নগৃহে থেকেই মজলেন।
সিংহ ফোকরের মধ্যে আঁকড়া চুলে ভরা হেঁড়ে মাথাটা গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে, কিন্তু গলল না। তখন লম্বা লম্বা নখগুলো বার করে একখানা থাবা ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে সে ঘন ঘন নাড়তে লাগল-পরমান্নের কড়ায় হাত দিয়ে লোকে যেমন করে নাড়ে!
বাবু আড়ষ্ট ও চিত হয়ে ট্যাংকের তলার সঙ্গে মিশিয়ে পড়ে রইলেন—নট নড়নচড়ন। নট কিছু! এবং তাঁরই দেহের কয়েক ইঞ্চি ওপরে ক্রমাগত বোঁ বোঁ করে ঘুরছে আর ঘুরছে। আর ঘুরছে পশুরাজের বিপুল থাবা! থাবা যদি আর এতটুকু নীচে নামে, তাহলেই বঁড়শিতে গাঁথা মাছের মতো বাবুর দেহ টপ করে উঠে পড়বে ট্যাংকের ওপরে! এমন দৃশ্য কেউ কল্পনা করতে পারেন?
প্রতি মিনিটেই সেই ভয়াবহ থাবা ট্যাংকের ভেতরে নতুন নতুন দিকে ঘুরতে থাকে, আর বাবুর চোখদুটো ছানাবড়ার মতো হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে চায় ও দাঁতে দাঁত লেগে ঠকাঠক করে আওয়াজ হয়! এই ব্যাপার চলল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে!
তারপর পশুরাজ থাবা তুলে নিয়ে ট্যাংকের ওপরে বসে আক্রমণের নতুন ফন্দি ঠিক করতে লাগল। বাবু অল্প একটু হাঁপ ছেড়ে স্বগত বোধহয় বললেন, হে মা সিংহবাহিনী, তোমার সিংহকে সুবুদ্ধি দাও মা, তাকে অন্য কোথাও যেতে বলো!
কিন্তু সিংহের সুবুদ্ধি হল না, খানিক জিরিয়ে নিয়ে অন্য কোনও উপায় না দেখে আবার সে ট্যাংকের ভেতরে বিষম থাবা নাড়া শুরু করলে। বাবু মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান হলে পর আবার চেয়ে দেখেন, সিংহের থাবা তখনও বোঁ বোঁ করে ঘুরতে ঘুরতে তাকে খুঁজছে। আবার অজ্ঞান হয়ে যান। থাবার এত কাছে এমন টাটকা খাবার দেখে ভোম্বলদাসের ভাগনের উৎসাহ কিছুতেই কমতে চায় না। সিংহ বা মানুষ, কেউ কখনও এমন মুশকিলে ঠেকেনি।
তাঁবুর বাইরে গন্ডার, হিপোপটেমাস, হায়েনা ও অন্যান্য সিংহদের কোরাস ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে একেবারে থেমে গেল। অরণ্যের অন্ধকার সরিয়ে অল্পে অল্পে ঊষার আলো ফুটতে লাগল। ভোরের পাখিদের গলায় জাগল নতুন প্রভাতের আশার গান।
তখন সিংহের মনে পড়ল, আর বাসায় না ফিরলে চলবে না। বিরক্ত মনে মুখের খাবার ফেলে সে ট্যাংক থেকে নেমে পড়ে সুড় সুড় করে আবার বনের ভেতরে গিয়ে ঢুকল।
কুলিরা তখন বৃক্ষশয্যা ত্যাগ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে মহা হইচই লাগিয়ে দিয়েছে। বাবু কই? বাবু কই? এখনও বাবুর দেখা নেই, তিনিও সিংহের ফলার হলেন নাকি?
একজন ভেবেচিন্তে বললে, মজার শয়নগৃহে শুয়ে বাবু এখনও মজায় নিদ্রা দিচ্ছেন। চল, তাকে জাগিয়ে দিই গে!
মজার শয়নগৃহে উঁকি মেরে দেখা গেল, বাবু একেবারে অচেতন! এবং তাঁবুর ভেতরে পশুরাজের পদচিহ্ন! তখন আসল ব্যাপারটা আন্দাজ করতে বিলম্ব হল না। তারপর বহু কষ্টে বাবুর মৃতবৎ দেহকে টেনে বার করে আনা হল। সেই এক রাত্রেই অসম্ভব আতঙ্কে বাবুর মাথার কালো চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।
অনেকক্ষণ পরে বাবুর জ্ঞান হল। তার দুর্দশার ইতিহাস শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বাবু ক্ষীণস্বরে বললেন, পরের ট্রেনে আমি এখান থেকে পালাব। পরের স্টিমারে আমি ভারতবর্ষে ফিরে যাব। আমার চাকরি চাই না, আপনি বাঁচলে বাপের নাম!
ভারতীয় কুলিরা বললে, সিম্বা স্টেশনে আমাদেরও আর থাকা পোযাবে না। গাছের ডালে বসে আর আমরা ঘুমোতে পারব না।
পরদিন থেকে সিম্বায় এল নতুন স্টেশনমাস্টার, নতুন কুলির দল। তাদের পরিণামের কথা ফোরানসাহেব বলেননি।
সিঙ্গির মামা ভোম্বলদাসকে কেউ দেখেনি। কিন্তু তার ভাগনেকে হাতের কাছে পেয়ে একবার একটি মানুষ কীরকম ঠকিয়ে দিয়েছিল, পৃথিবী বিখ্যাত শিকারি লেফটেনান্ট কর্নেল প্যাটার্সন সাহেবের কেতাবে তা লেখা আছে।
এ ঘটনাটিও ঘটেছিল আফ্রিকার পূর্বোক্ত রেলপথ নির্মাণের সময়ে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে হাজার হাজার কুলি কাজ করতে যেত বলে সিংহদের ভোজসভায় মহোৎসব পড়ে গিয়েছিল। এমন সুযোগ সিংহরা আর কখনও পায়নি।
সিংহ-ব্যাঘ্রদের কাছে মানুষের চেয়ে নিরীহ ও সহজ শিকার আর নেই। বনবাসী অধিকাংশ জীবেরই কামড়াবার জন্যে মস্ত ধারালো দাঁত, বা গুঁতোবার জন্যে লম্বা-লম্বা শিং, বা লাথি ছোড়বার ও পালাবার জন্যে খুরওয়ালা দ্রুতগামী পা, বা আঁচড়াবার জন্যে ভীষণ নখওয়ালা চারখানা ঠ্যাং আছে, কিন্তু মানুষ বেচারাদের সেসব কিছুই নেই। তুচ্ছ ভেড়াদেরও মতো তারা জোরসে টু পর্যন্ত মারতে পারে না এবং সাপের মতো বিষ ও পাখির মতো ডানা থেকেও তারা বঞ্চিত। মানুষকে ধরো, মারো আর গপ করে খেয়ে ফ্যালো,তারা
অতীব নিরাপদ সুখাদ্য।
সারাদিনের কাজকর্ম সেরে কুলি এবং অন্যান্য কর্মচারীরা তাঁবু খাটিয়ে অসাড়ে নিদ্রা যেত। সকালে উঠে প্রায়ই দেখত, দলের দুই-এক জন লোক কমেছে। ব্যাপারটা তাদের একরকম গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
এক রাত্রে তাঁবুর মধ্যে আরামে ঘুমোচ্ছিল এক গ্রিক। শীতের ঠান্ডা রাত, গ্রিক লোকটির সর্বাঙ্গ লেপে ঢাকা।
নিঝুম রাত, কিন্তু নিস্তব্ধ নয়। আফ্রিকার অরণ্য রাত্রেই বেশি করে শব্দময় হয়ে ওঠে, তার প্রত্যেক শব্দই ভয়াবহ!
একটা সিংহ নিঃশব্দে গ্রিকের তাঁবুর ভেতরে গিয়ে ঢুকল। সিংহরা যখন শিকার করতে চায় তখন টু শব্দটি করে না, তখন সে হয় মৃত্যুর মতন নীরব!
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে সিংহ গ্রিক লোকটিকে দেখতে পেলে না, কারণ সে তখন লেপের মধ্যে অদৃশ্য। কিন্তু নরখাদক সিংহরা জানে, শীতকালে মানুষরা থাকে লেপের তলাতেই। এ সিংহটারও সে বুদ্ধি ছিল, কাজেই অন্য কোনও গোলমাল না করে সে প্রকাণ্ড এক হাঁ করে লেপ ও বিছানা একসঙ্গে কামড়ে ধরে বাইরে টেনে নিয়ে গেল।
বলা বাহুল্য গ্রিক-বাবাজির ঘুম তখন ভেঙে গিয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে সে পড়েছে। সিংহের কবলে! কিন্তু উয়ে ভেবড়ে গিয়ে সে বোকার মতন চেঁচিয়ে উঠল না, একেবারে চুপটি মেরে রইল। সে যে জেগেছে সিংহ তা সন্দেহ করতেও পারলে না, সস্তা খোরাকের বস্তা নিয়ে মস্ত বনের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
বনের মধ্যে দিব্যি একটি নিরিবিলি জায়গা পেয়ে সিংহ তার মোট নামিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসল। মানুষের টাটকা রক্ত-মাংসে আজকের নৈশভোজটা সুসম্পন্ন হবে, তার মনে ফুর্তি। আর ধরে না!
থাবা মেরে একটানে লেপখানা সরিয়ে দিয়েই কিন্তু দুই চক্ষু তার স্তম্ভিত! লেপের তলায় খাবার নেই। ফোক্কা!
সে যখন হিড়হিড় করে লেপ ও বিছানা টেনে আনছিল, দুষ্টু মানুষটা সেই সময়ে কোন ফাঁকে মাঝখান থেকে চুপিচুপি হড়কে বেরিয়ে সরে পড়েছে, কিছুই টের পাওয়া যায়নি!