বাগানের বাঘ
মুকু, নমু, দীপু, মঞ্জু আর প্যাঁচাবাবুর সঙ্গে তোমাদের এখনও পরিচয় হয়নি বোধহয়? এরা হচ্ছে ভাই-বোন। দীপু আর প্যাঁচা হচ্ছে ভাই, মুকু, নমু আর মঞ্জু হচ্ছে বোন।
সবচেয়ে ছোটো হচ্ছে প্যাঁচা আর মঞ্জু, কিন্তু সবচেয়ে ডানপিটে হচ্ছে তারা দুজনেই। দুষ্টুমি বুদ্ধিতে দাদা-দিদিরা তাদের কাছে থই পায় না।
তাদের জ্বালায় দাদু বেচারার ঘুমিয়েও শান্তি নেই। মঞ্জু চুপি চুপি গিয়ে ঘুমন্ত দাদুর নাকের ভেতরে করবে নস্যির ডিবে খালি, আর কাঁচি নিয়ে প্যাঁচা দেবে দাদুর গোঁফজোড়া কচ করে হেঁটে। দাদুকে শাস্তি দেওয়ার এমনি নিত্য-নতুন ফন্দি আবিষ্কার করতে তাদের জুড়ি নেই।
মুকু, নমু আর দীপু অতটা দুষ্টুমি করে না বটে, কিন্তু দাদু যখন ভয়ানক হাঁচতে হাঁচতে জেগে উঠে ঠোটে হাত দিয়ে শখের গোঁফজোড়া আর খুঁজে পান না, তখন তাদের একটুও দয়া হয় না, উলটে তারা খিলখিল করে হেসেই খুন হয়। দাদু যদি রেগে ওঠেন তবে তারাও আরও জোরে হেসে ওঠে।
রাগ করলেও যেসব নাতি-নাতনির হাসির ধুম বাড়ে, তাদের নিয়ে কী আর করা যায় বলো? দাদু তখন নাচার হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন, আচ্ছা দাদু, আচ্ছা, দিদি, তোমরা কি আমাকে একটু ঘুমোতেও দেবে না?
নমু ঘাড় নেড়ে বলে, না, আমাদের সামনে ঘুমটুম চলবে না।
মুকু গম্ভীর মুখে বলে, দাদু হলে ঘুমোতে নেই।
দাদু বলেন, তা হলে আমায় কী করতে হবে শুনি?
দীপু বলে, খালি গল্প বলতে হবে।
অর্থাৎ জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে হবে? বেশ! এখন হুকুম করো, কী গল্প শুনতে চাও? দীপুর বড়ো শখ, বাঘ শিকার করবে। সেইজন্যে সে একটা এয়ারগানও কিনেছে। দুই চোখ পাকিয়ে বলল, বাঘের গল্প।
দাদু কোনওরকমে গোঁফের শোক সামলে বাঘের গল্প শুরু করলেন।
নস্যির ডিবে আর কচি নিয়ে মঞ্জু আর প্যাঁচা চক্ষুলজ্জার খাতিরে ঘরের বাইরে পালিয়ে গিয়েছিল। গোঁফ-ছাঁটা দাদু হাঁচি থামিয়ে গল্প শুরু করেছেন শুনেই তাদের সমস্ত চক্ষুলজ্জা একেবারেই ছুটে গেল। গুটি গুটি ঘরে ঢুকে দাদুর পিছনে এসে ভিজেবিড়ালের মতো শান্তভাবে গল্প শুনতে বসল।
দাদু সেই পুরোনো বই কঙ্কাবতীর গল্প বলতে লাগলেন। বনের ভেতরে একরকম শিকড় পাওয়া যায়, যার গুণে মানুষ নাকি বাঘের রূপধারণ করতে পারে। বলা বাহুল্য, গল্পটা জমে উঠল রীতিমতো।
গল্প শেষ হলে পর দীপু বললে, আচ্ছা দাদু, বাঘরা তো ঝোপে জঙ্গলে থাকে?
তা নয় তো কী?
প্যাঁচা বললে, আমাদের খিড়কির বাগানে তো অনেক ঝোপঝাপ আছে। সেখানে দিনের বেলায় রোজ আমরা খেলা করি, কিন্তু বাঘ-টাঘ তো দেখিনি, দাদু!
প্যাঁচাই যে তার গোঁফজোড়াকে বলি দিয়েছে, দাদু এটা বুঝতে পেরেছিলেন, কাজেই তাকে ভয় দেখাবার জন্যে তিনি বললেন, দিনে ওখানে বাঘ থাকে না বটে, কিন্তু রোজ রাতে আসে। এবার দুষ্টুমি করলেই তোমাদের ধরে নিয়ে যাবে।
প্যাঁচা হচ্ছে বিষম ছেলে, ভয় পাওয়ার পাত্রই নয়। বলল, ইস, গুলতি ছুড়ে বাঘের মাথা ফাটিয়ে দেব!
দাদু ভয়ে ভয়ে বললেন, গুলতি ছুড়ে বাঘের মাথা ফাটাতে চাও ফাটিয়ে, কিন্তু দেখো। ভাই, ও জিনিসটি নিয়ে বুড়োদাদুর টাকের দিকে যেন টিপে কোরো না।
সেইদিনই সন্ধ্যার আগে দাদা-দিদিদের পরামর্শ সভার এক গোপনীয় অধিবেশন হল। সভাপতিরূপে দীপুবাবু এই ছোট্ট বক্তিতাটি দিলেন।
দাদুর মুখে শোনা গেল, যেখানে জঙ্গল, ঝোপঝাপ থাকে সেইখানেই রাতের বেলায় বাঘেরা বেড়াতে আসে। আমাদের বাড়ির পিছনের বাগানে ফুলগাছের চেয়ে ঝোপঝাপই বেশি। দিনের বেলায় আমরা সবাই স্বচক্ষে দেখেছি, তার ভেতরে গিরগিটি থাকে, বেজি থাকে, হেলে সাপ থাকে, ভঁশ-মশা থাকে, সুতরাং রাত্তিরে সেখানে বাঘেরাই বা আসবে না কেন? আমার এয়ারগান আছে, আর প্যাঁচার আছে গুলতি। আজ আমরা বাঘ শিকার করব।
একখানা গিনি-চকোলেট চুষতে চুষতে মুকু বললে, কিন্তু দাদুর গল্পে শুনলি তো, সে বাঘ মানুষ-বাঘও হতে পারে।
দীপু বললে, তুমি আর হাসিয়ো না দিদি! মানুষ কখনও বাঘ হতে পারে? ওসব হচ্ছে। গল্পের কথা।
নমু বললে, কিন্তু রাত্তিরে যে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি?
–আজ আর কেউ ঘুমোব না। বাবা-মা ঘুমোলেই আমরা পা টিপে টিপে ঘর থেকে পালিয়ে আসব।
কিন্তু দীপু, রাত্তিরে বাগানে বাঘ ছাড়া আরও কেউ কেউ তো বেড়াতে আসতে পারে?
আবার কে আসবে?
ভূত আর পেতনি? আমাদের দেখতে পেলে তারা কী বলবে?
এইখানেই দীপু মস্ত ধাঁধায় পড়ে গেল। সে বাঘ শিকার করতে পারে, কিন্তু ভূতপেতনির সঙ্গে দেখা করতে রাজি নয়। বাপ রে, তাদের পায়ের গোড়ালি নাকি সামনের দিকে। যদি কঙ্কাবতীর ঘাঘো, নাকেশ্বরী প্রভৃতির উদয় হয়, তবে তাদের সামলানো তো। বড়ো চারটি-খানিক কথা নয়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দীপু মাথা চুলকোতে লাগল।
প্যাঁচা বললে, ভাবছিস কেন দাদা, বাগানে না গিয়েও তো বাঘ শিকার করা যায়! ১ কেমন করে?
বাগানের ওপরেই তো আমাদের হলঘর। জানলার পাল্লাগুলো একটুখানি ফঁক করে ভেজিয়ে রেখে আমরা লুকিয়ে বাগানের দিকে নজর রাখব। ভূত-পেতনিরা আমাদের দেখতেও পাবে না, কিন্তু বাঘ দেখলেই আমরা বন্দুক আর গুলতি ছুড়তে পারব।
প্যাঁচা বয়সে ছোটো হলে কী হয়, তার পদ্ধতিটিই যে উদ্যানবাসী প্রেতাত্মাদের হাত থেকে নিস্তার লাভ করবার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ, সভ্যদের মধ্যে এ সম্বন্ধে মতভেদ হল।
না।
কিন্তু মঞ্জু প্রতিবাদ করে বললে, বা রে, আমার বন্দুকও নেই গুলতিও নেই, আমি কী নিয়ে বাঘ শিকার করব?
দুই দিদিই একসঙ্গে মাথা নেড়ে বলে উঠল, মেয়েরা বাঘ শিকার করে না, মেয়েরা খালি দেখে।
কিন্তু এই কচি বয়সেই মঞ্জুর মনের মধ্যে নারীজাতির অধিকার সম্বন্ধে একটা বিশেষ ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে-ও প্রবল মাথা-নাড়া দিয়ে বললে, ওসব হবে-টবে না, বাঘ শিকার আমি করবই!
বুদ্ধিমান প্যাঁচাই আবার মঞ্জুকে ঠান্ডা করবার জন্যে বললে, হ্যা রে মঞ্জু, তুইও শিকার করবি বই কি! কিন্তু সবাই একরকম অস্তর নিলে চলবে কেন? তুই কতগুলো বড়ো বড়ো ইট-পাথর নিয়ে আয়, বাঘ দেখলেই দমাদ্দম ছুড়ে মারবি।
রাত এগোরাটার পর প্যাঁচা লেপের ভেতর থেকে উঁকি মেরে দেখলে, মা আর বাবা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। প্যাঁচা নিজের মনেই বললে, বাবার সঙ্গে মা রোজ ঝগড়া করেন, তার নাক নাকি ডাকে না। হুঁ, এই তো আমি নিজের কানে শুনছি, মা-র নাক দস্তুরমতো ডাকে! রোসো, কাল বাড়িসুদ্ধ সব্বাইকে বলে দিচ্ছি।
তারপর প্যাঁচা চিমটি কেটে আর সব ভাইবোনকে জাগিয়ে দিলে। সকলে একে একে হলঘরে গিয়ে জুটল।
হলঘরের একটা জানলায় গুলতি নিয়ে প্যাঁচা, আর-একটা জানলায় বন্দুক নিয়ে দীপু, আর-একটা জানলায় মঞ্জু গিয়ে দাঁড়াল—তার সামনে রাশিকৃত ইট-পাথর, এমনকি দুটো ভাঙা বোতল পর্যন্ত। মুকু আর নমু দুজনে একসঙ্গে আর-একটা জানলায় গিয়ে আশ্রয় নিলে, তারা নিরস্ত্র কারণ শিকার করবার নয়, কেবল শিকার দেখবারই শখ তাদের আছে।
ভেজানো জানলার ফাক দেখা গেল, বাগানে আবছা চাঁদের আলো এসে চারদিক করে তুলেছে ছায়ামায়াময়। কোথাও জনপ্রাণী নেই—শব্দের মধ্যে শোনা যাচ্ছে কেবল গাছে গাছে বাতাসের কান্না আর ঝোপেঝাপে ঝিঝিদের একঘেয়ে ডাক। বাঘের দেখা বা সাড়া নেই।
কিন্তু তাদের মনের ভেতরে তখন বাসা বেঁধেছে শিকারির ধৈর্য, কাজেই অন্ধকার ঘরে সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
হলঘরের বড়ো ঘড়িতে যখন বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত বেজে গেল এবং বাঘের আশায় তারা যখন দিয়েছে জলাঞ্জলি এবং নমু ও মুকু যখন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই চোখ মুদে ঘুমোবার চেষ্টা করছে, তখন প্যাঁচার মনে হল, ছায়ার মতন কী একটা বড়ো মূর্তি সাঁৎ করে এ ঝোপ থেকে ও ঝোপে গিয়ে ঢুকল। দীপুও দেখেছিল, মঞ্জুও দেখেছিল।
ঝোপ থেকে মূর্তিটা আবার যেই আত্মপ্রকাশ করলে, অমনি দীপু ছুড়লে হাওয়ার বন্দুক, প্যাঁচা ছুড়লে গুলতি এবং মঞ্জু ছুড়লে ভাঙা বোতল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক আর্তনাদ বাপ রে, মা রে, মরে গেছি রে!
এ যে মানুষের গলা! ওগো, মাগো, ভূত গো! বলে চেঁচিয়েই নমুদিদি দিলে তিরবেগে সে ঘর থেকে চম্পট! দীপুদাদার শিকারের শখ উপে গেল, ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তৎক্ষণাৎ সে বন্দুক ত্যাগ করলে। মুকুদিদির তো লেগে গেল দাঁতকপাটি। ভূতের জন্যে তারা কেউ প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু প্যাঁচা ভয় কাকে বলে জানে না, মঞ্জুও তাই। প্যাঁচা বললে, মঞ্জু, ছোড়, ইট, আমি ছুড়ি গুলতি। ওটা মানুষ-বাঘ, ওটাকে মেরে ওর কাছ থেকে শেকড় কেড়ে নিতে হবে! ঝোপের ওপরে ফটাফট গুলতির গুলি আর ধপাধপ ইট বৃষ্টি হতে লাগল। কিন্তু বাঘের আর সাড়াই নেই।
নমু যখন নিজেদের ঘরে ঢুকে বিছানার ওপরে ঝাপ খেয়েছে, তখন গোলমালে তার মা-বাবার ঘুম গেছে ভেঙে। বাবা বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে নমু, কী হয়েছে?
ও বাবা, বাগানে একটা ভয়ানক ভূত এসেছে—বলেই সে সোজা লেপের ভেতরে ঢুকে গেল, কারণ সে জানত লেপের ভেতরে একবার ঢুকতে পারলে আর ভূতের ভয় থাকে না। নমুর বাবা লাঠি নিয়ে তখনই বাগানে ছুটলেন।
বাগানের ঝোপের ভেতরে পাওয়া গেল একটা হতভাগ্য চোরের অচেতন দেহ। তার রগে লেগেছিল গুলতির গুলি। এর দেহও ইট আর ভাঙা বোতলের চোটে রক্তাক্ত। কী অশুভক্ষণেই সে আজ এ বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল। তার অবস্থা দেখে তাকে থানায় পাঠিয়ে হাসপাতালেই পাঠানো হল।
কিন্তু দাদুর অবিচারটা দ্যাখো! কোথায় এইসব বীর নারী ও বীর পুরুষকে অভিনন্দন দেবেন, না তিনি কিনা ফস করে বলে বসলেন, আজকেই ও সর্বনেশেদের এয়ারগান আর গুলতি কেড়ে নিয়ে নিরস্ত্র করা হোক! আমার গোঁফ ওরা কেটে নিয়েছে, এইবারে ওদের নজর পড়বে আমার টাকের ওপরে।
দাদুর সন্দেহ সত্য কি না জানি না, কিন্তু মুকু, নমু, দীপু, প্যাঁচা আর মঞ্জুকে তোমরা চিনে রাখো, কারণ ভবিষ্যতে ওদের সঙ্গে তোমাদের আবার দেখা হলেও হতে পারে।