বাবা মুস্তাফার দাড়ি
বিমল ও কুমার হচ্ছে নিছক অ্যাডভেঞ্চারের ভক্ত, সাধারণ গোয়েন্দাগিরি নিয়ে তারা কোনওদিন মাথা ঘামাত না। কিন্তু গোয়েন্দার প্রধান প্রধান গুণ, অর্থাৎ পর্যবেক্ষণশক্তি, চিন্তাশীলতা আর নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা তাদের দুজনেরই ছিল যথেষ্ট। এইসব কারণে তারা মাঝে মাঝে খুব সহজেই এমন সব শক্ত মামলারও কিনারা করে ফেলতে পারত বড়ো বড়ো পেশাদার গোয়েন্দারাও যাদের মধ্যে তল খুঁজে পায়নি। এই রকমেরই একটি ঘটনার কথা আজ তোমাদের কাছে বলতে চাই।
ড্রাগনের দুঃস্বপ্নের গল্প যাঁরা শুনেছেন, বিমল ও কুমারের সঙ্গে কী করে ইনস্পেকটার সুন্দরবাবুর প্রথম পরিচয় হয়, এরই মধ্যে তারা নিশ্চয়ই তা ভুলে যাননি।
ওই ঘটনার কিছুদিন পরের কথা। বিমল ও কুমার একদিন সকালে বেড়াতে বেড়াতে অকারণেই সুন্দরবাবুর থানায় গিয়ে হাজির হল।
একটা টেবিলের ধারে সুন্দরবাবু চিন্তিত মুখে মাথার টাকে হাত দিয়ে বসেছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখে বললেন, এই যে হুম! একেবারে যুগলে উদয়, ব্যাপার কী?
কুমার হেসে বললে, কিছুই নয়। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম, ভাবলুম আপনার সঙ্গে দুটো গল্পগুজব করে যাই।
সুন্দরবাবু হতাশভাবে বললেন, আর গল্প করব! পোড়া অদৃষ্টে কি সে সুখ আছে? একটা বিচ্ছিরি মামলা নিয়ে মহা-ঝাটে পড়া গেছে ভাই! তবু এসে যখন পড়েছেন, দুকাপ চা খেয়ে যান।
বিমল চেয়ার টেনে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলে, মামলাটা কী, শুনতে পাই না?
সুন্দরবাবু বললেন, শুনে কোনোই লাভ হবে না ভায়া, এ মামলার কিনারা করা অসম্ভব।
তবু শুনতে দোষ কী?
তাহলে শুনুন …দিন কয় আগে আমারই এলাকায় এক রাত্রে হরেনবাবু নামে একটি ভদ্রলোক খুন হয়েছেন শুনে সকালে তদন্ত করতে গেলুম। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, ঘরময় বইছে রক্তের ঢেউ, আর চারদিকে ছড়ানো কতকগুলো জিনিসপত্তর। তারই মাঝখানে হরেনবাবুর দেহ পড়ে রয়েছে। তার মুখে, কাঁধে আর বুকে তিনটে গভীর ক্ষত, সেগুলো ছোরার আঘাত বলেই মনে হল। ঘরের অবস্থা দেখে ঋলুম, হত্যাকারীর সঙ্গে হরেনবাবু রীতিমতো যোজাযুঝি করেছিলেন। মেঝেতে একটা মাঝারি আকারের ঘড়ি পড়ে রয়েছে, ঘড়িটা রাত বারোটা বেজে বন্ধ হয়ে গেছে দেখে বোঝা গেল, ঠিক ওই সময়েই ঘটনাটা ঘটেছে। রক্তের মধ্যে পাওয়া গেল কতকগুলো নিখুঁত জুতোের ছাপ!
হরেনবাবুর সঙ্গে ওই বাড়িতেই তার ছোটোভাই সুরেন বাস করে। হরেনবাবু বিপত্নীক আর নিঃসন্তান। সুরেন এখনও বিবাহ করেনি। বাড়িতে ওরা দুজন ছাড়া আর একজন প্রায় কালা বুড়ো চাকর থাকে, ঘটনার সময়ে সে একতলার ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। তার কানে কোনও গোলমালই ঢােকেনি। বাড়ির সদর দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ ছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, হত্যাকারী কোনও জিনিসই চুরি করেনি।
বাড়ি খানাতল্লাশ করতে করতে সুরেনের ঘরে পাওয়া গেল একজোড়া রক্তমাখা জুতো। সে জুতো তারই, আর সেই জুতোর সঙ্গে হত্যাকারীর পদচিহ্ন অবিকল মিলে গেল। খুব সহজেই মামলার কিনারা হল ভেবে আমি তখুনি সুরেনকে গ্রেপ্তার করলুম। কিন্তু সুরেনকে বোধহয় আবার ছেড়ে দিতে বাধ্য হব।
বিমল বিস্মিত স্বরে বললে, কেন?
সুরেন বলে ঘটনার রাত্রে সে তার এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে গিয়েছিল। অনেক রাত পর্যন্ত খেটেখুটে সে সেইখানেই শুয়ে পড়ে। তার পরদিন সকালে বাড়িতে ফিরে সেই-ই প্রথমে হত্যাকাণ্ড আবিষ্কার করে। সুরেনের এই বন্ধুর বাপ হচ্ছেন কলকাতা পুলিশেরই আর এক ইনস্পেকটর, তার নাম অবনীবাবু। বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়িটা দেখে আমরা জেনেছি, হত্যাকাণ্ড হয়েছে রাত বারোটার সময়ে। শবব্যবচ্ছেদ করে ডাক্তারও সেই মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইনস্পেক্টার অবনীবাবু বলেন, সুরেন সে রাত্রে তার বাড়ি ছেড়ে এক মিনিটের জন্যেও বাইরে যায়নি। কেবল অবনীবাবু নন, বিবাহ সভায় যারা উপস্থিত ছিল, তারা সকলেই একবাক্যে এই সাক্ষ্য দিয়েছে। তারপরেও আর সুরেনকে ধরে রাখি কী করে? বিশেষ, তার সপক্ষে আর একটা মস্ত প্রমাণ রয়েছে।
কী প্রমাণ?
মৃত হরেনবাবুর হাতের মুঠোর মধ্যে গাছকয় পাকা চুল পাওয়া গিয়েছে। চুলগুলো নিশ্চয়ই হত্যাকারীর, ধস্তাধস্তি করবার সময়ে হরেনবাবু যে হত্যাকারীর চুল চেপে ধরেছিলেন, তাতে আর সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু সুরেনের মাথায় একগাছাও পাকা চুল নেই।
বিমল বললে, চুলগুলো একবার আমাকে দেখাবেন?
কেন দেখাব না? এই নিন বলে সুন্দরবাবু ছোট্ট একটি কাগজের মোড়ক এগিয়ে দিলেন।
মোড়কটা খুলে বিমল বললে, একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিতে পারেন?
তা যেন দিচ্ছি, কিন্তু অতটা খুঁটিয়ে দেখবার কিছুই নেই। ওগুলো পাকাচুল, আর সুরেনের মাথার চুল সব কালো। আপাতত এইটুকুই যথেষ্ট।
বিমল ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে চুলগুলো পরীক্ষা করে বলল,-এই চুলগুলো কী প্রমাণ দিচ্ছে জানেন? হত্যাকারীকে মৃত হরেনবাবু চিনতেন, আর খালি তার মাথার লম্বা পাকাচুল নয়, মুখেও দাড়ি গোঁফ ছিল।
সুন্দরবাবু ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন, কী করে জানলেন আপনি?
পরে তা বলব। আপনি আর নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেননি?
না। তবে হরেনবাবুর মৃত্যুর দিন দশেক পরে প্রকাশ পেয়েছে, তার এক আত্মীয় মরবার সময়ে উইল করে তাদের দুই ভাইকে এক লক্ষ টাকা দান করে গিয়েছেন। কিন্তু এই উইলের খবর তারা কেউ জানতেন না, কারণ হরেনবাবুর মৃত্যুর মোটে চার দিন আগে ওই আত্মীয়টি মারা পড়েন। এখন অ্যাটর্নি বাড়ি থেকে এই খবর সবে প্রকাশ পেয়েছে।
বিমল অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, হরেনবাবুর অবর্তমানে এখন সুরেনই সব কর মালিক হবে তো?
হ্যাঁ! কিন্তু সুরেনও যদি ফাঁসিকাঠে ঝোলে, তাহলে তাদের সব সম্পত্তি যাবে হরিহরের হাতে।
হরিহর আবার কে?
হরেন আর সুরেনের খুড়তুতো ভাই। ঠিক পাশেই তার বাড়ি।
সেখানে কিছু খোঁজ নিয়েছেন?
তা আবার নিইনি, আমি কি তেমনি কাচা ছেলে হে? কিন্তু হরিহর সমস্ত সন্দেহের বাইরে। কারণ প্রথমত, খুনের সময়ে সে উইলের ব্যাপার জানত না, আর জানলেও সুরেন থাকতে তার সম্পত্তি লাভের কোনও সম্ভাবনাই নেই। দ্বিতীয়ত, তার পায়ের জুতো হত্যাকারীর জুতোর দাগের চেয়ে আধ ইঞ্চি ঘোট। তৃতীয়ত, তায়ও মাথায় পাকাচুল নেই। চতুর্থত, সে পাবলিক থিয়েটারের অভিনেতা। ঘটনার দিনে থিয়েটারে এক বিশেষ অভিনয় ছিল, অর্থাৎ সারারাত্রিব্যাপী অভিনয়। তিন-তিন খানা নাটকে তার পার্ট ছিল। আমি থিয়েটারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, হরিহর ঘটনার পরদিন ভোর সাড়ে ছটায় বাড়িতে ফিরেছে। বিমলবাবু, আপনাদের সঙ্গে গল্প করব কী, আমি এখন অকূল পাথারে ভাসছি,-হুম, গল্প করতে আমার একটুও ভালো লাগছে না!
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আপনার দুরবস্থা দেখে আমার ভারী দুঃখ হচ্ছে! আচ্ছা, আজ
আর বেশিক্ষণ আপনার সময় নষ্ট করব না, কেবল একটি কথা জিজ্ঞাসা করে বিদায় হব।
কী কথা?
ঘটনাস্থলের কাছে, মাঝরাতে সেদিন যে পাহারাওয়ালা রাস্তায় পাহারায় ছিল, তাকে একবার ডেকে দিন।
পাহারাওয়ালা এল।
বিমল শুধোলে, তোমার নাম কী?
চন্দর সিং।
আচ্ছা চন্দর সিং, যে বাড়িতে খুন হয় তার কাছ থেকে কত তফাতে তুমি পাহারায় ছিলে?
পাঁচ-ছ খানা বাড়ির পরেই।
খুন হয়েছে রাত বারোটার সময়ে। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়োনি তো?
চন্দর সিং আহত কণ্ঠে বললে, পাহারা দিতে দিতে কোনওদিন আমি ঘুমোইনি, হজুর!
বেশ, বেশ, তুমি দেখছি অসাধারণ পাহারাওয়ালা! তাহলে রাত বারোটার সময় তুমি কি কোনও আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলে?
না হুজুর!
এখন শীতকালের রাত। বারোটার সময়ে পথে খুব কম লোক চলে। ঘটনাস্থলের কাছে রাত বারোটার সময়ে তুমি কি এমন কোনও লোক দেখেছিলে, যাকে দেখলে সন্দেহ হয়?
তিন-চার জন লোককে দেখেছিলুম, কিন্তু কারুর ওপরে আমার সন্দেহ হয়নি!
এমন কোনও লোকই দ্যাখোনি, যার মাথায় ছিল লম্বা পাকা চুল, আর মুখে ছিল পাকা গোঁফ-দাড়ি?
চন্দর সিং অল্পক্ষণ ভেবেই বলে উঠল, হা হুজুর, দেখেছিলুম। একটা বুড়ো বাঙালিমুসলমান রাত বারোটার খানিক পরেই আমার সামনে দিয়ে হনহন করে চলে গিয়েছিল, বটে।
কী করে জানলে, সে বাঙালি মুসলমান?
তার পরনে ছিল বাঙালির মতো আলোয়ান, ধুতি আর পিরান, কিন্তু পশ্চিমা মুসলমানদের মতো তার মাথায় ছিল লম্বা পাকা চুল আর মুখে ছিল লম্বা পাকা গোঁফ-দাড়ি।
তাকে দেখে তোমার কোনও সন্দেহ হয়নি?
সন্দেহ হয়নি বটে, তবে একটা কথা মনে হয়েছিল। তার মাথার চুল আর মুখের গোঁফ-দাড়ি বেজায় বুড়োর মতন ধবধবে সাদা, কিন্তু সে হনহন করে হাঁটছিল খুব জোয়ান লোকের মতোই!
শাবাশ চন্দর সিং! এতটা তুমি লক্ষ করেছিলে? সত্যিই তুমি অসাধারণ পাহারাওয়ালা। আচ্ছা, আমার আর কিছু জানবার নেই।
সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো বললেন, কী আশ্চর্য বিমলবাবু, এই বুড়ো বাঙালি মুসলমানটিকে আপনি আবার কোথা থেকে আবিষ্কার করলেন? আমরা পেয়েছি কেবল গাছকয়েক লম্বা পাকা চুল, কিন্তু দাড়ি-গোঁফই বা আপনি কেমন করে দেখতে পেলেন?
বিমল সহাস্যে বললে, মানস চক্ষু আর কল্পনা শক্তি ব্যবহার করলে অনেক কিছু দেখা যায় সুন্দরবাবু! আমার মত কী জানেন? হত্যাকারীকে হরেনবাবু চিনতেন, তাই সে ছদ্মবেশ পরে খুন করতে গিয়েছিল। খালি পাকা চুলে মুখ লুকোনো যায় না, গোঁফ-দাড়িরও দরকার হয়।
তাহলে আপনি বলতে চান, খুনির মাথায় পাকা চুলের তলায় ছিল কঁচা কালো চুল? আমরা যে সুরেনকে ধরেছি, তার মাথাতেও কালো চুল আছে। তবে কি সুরেনই—
বাধা দিয়ে বিমল বললে, শীঘ্রই আবার দেখা হবে, তখন সব বলব। এই বলে সে কুমারের হাত ধরে থানা থেকে বেরিয়ে গেল।
সুন্দরবাবু চেয়ারের ওপরে আড় হয়ে পড়ে মুখভঙ্গি করে বললেন, হুম! বিমলবাবু একটি আস্ত পাগল! খালি আস্ত নয়, মস্ত পাগল!
পরদিন প্রভাতে থানায় আবার বিমল ও কুমারের আবির্ভাব! তখন সুন্দরবাবুর সঙ্গে একটি যুবক অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে জোরে সিগারেটে দম মারতে মারতে হাত-মুখ নেড়ে কথা কইছিল। বিমল লক্ষ করলে, যুবকের মাথায় বাবরি-কাটা চুল, মুখে পাউডারের চিহ্ন, গায়ে ফুলদার পাঞ্জাবি, পরনে জরিপাড় দিশি কাপড়, পায়ে বাহারি লপেটা,হা, লোকটি রীতিমতো শৌখিন বটে!
সুন্দরবাবু বললেন, আরে, আসুন—আসুন, নমস্কার! আবার এক নতুন কাণ্ড দেখুন, জাল-পুলিশের মামলা! এখুনি আবার হন্তদন্ত হয়ে তদন্তে ছুটতে হবে! যত বদমাইশ জুটেছে কিনা আমারই এলাকায়!
বিমল বললে, জাল-পুলিশের মামলা!
হ্যাঁ এই ভদ্রলোকেরই নাম হরিহরবাবু, হরেনবাবুর খুড়তুতো ভাই। ইনি সক্কালবেলায় থানায় অভিযোগ করতে এসেছেন, কাল দুপুরে পুলিশের লোকরা নাকি ওঁদের থিয়েটারে। গিয়ে গোলমাল করে আর ওঁর সাজঘরে গিয়ে জিনিসপত্র তছনছ করে এসেছে! অথচ সত্যিকথা বলছি বিমলবাবু, আমরা এর বিন্দুবিসর্গও জানি না!
বিমল হাসিমুখে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, নমস্কার হরিহরবাবু! আপনি নিজেই থানায় এসেছেন দেখে সুখী হলুম, কারণ, নইলে আমাদেরই এখুনি আপনার বাড়িতে ছুটতে হত!
হরিহর বিস্মিত ভাবে ফ্যালফেলে চোখে বললে, মশাইকে তো এ জন্মে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।
উহুঁ, এ জন্মেও দেখেননি, গেল-জন্মেও দৈখেননি বোধহয়। আপনি আর আমরা এক জগতে বাস করি না তো! কিন্তু আমাকে না চিনলেও আপনি এই চুল-গোঁফ-দাড়িকে চেনেন কি? বলেই বিমল একরাশ পরচুলা বার করে তুলে দেখালে।
হরিহরের মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল। তার পরেই সামলে নিয়ে সে বললে, ওগুলো কার, আমি জানি না।
জানেন না? বেশ, বেশ, তাহলে ভালো করে বসুন, ধীরে সুস্থে একটা ছোট্ট গল্প শুনুন। এ গল্পেরও পাত্রদের নাম হরেন সুরেন দুই সহোদর, আর তাদের খুড়তুতো ভাই হরিহর। হরেন-সুরেনের নামে এক আত্মীয় এক লক্ষ টাকা দিয়ে গেলেন। কিন্তু তারা সে সৌভাগ্যের কথা টের পাওয়ার আগেই, অ্যাটনি-বাড়ির কেরানি সুবোধের মুখ থেকে হরিহর খবরটা জেনে ফেললে, কারণ তারা দুজনেই এক থিয়েটারে অভিনয় করত।
হরিহর দেখলে, রাতারাতি বড়োলোক হওয়ার এ একটা মস্ত সুযোগ! উইলের কথা এখনও কেউ জানে না, এই অবসরে হরেন আর সুরেনকে পথ থেকে সরাতে পারলেই লাখ টাকা তার হাতের মুঠোয়! হরিহর মূখ হলেও বোকা নয়, চট করে একটা শয়তানি ফন্দি এঁটে ফেললে।
সে রাত্রে তাদের থিয়েটারে বিশেষ অভিনয়, তিন-তিনটে পালা শেষ হতে রাত কাবার হয়ে যাবে। প্রথম পালা কণ্ঠহার শুরু হল সন্ধ্যার মুখে। তারপর আরম্ভ হল চন্দ্রগুপ্ত, রাত এগারোটার সময়ে। এ পালায় হরিহর সাজলে আলেকজান্ডার। মিনিট পনেরোর মধ্যে তার পার্ট শেষ হয়ে গেল। তার পরে শেষ পালা আলিবাবায় তার বাবা মুস্তাফা সাজবার কথা, অর্থাৎ মাঝে তার একটানা ঘন্টা-পাঁচেক ছুটি। হরিহর সবাইকে জানালে, নে থিয়েটারের ওপরের একটা ঘরে এই সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবে।
কিন্তু সে ঘুমোত গেল না। থিয়েটার থেকে তার বাড়ি মিনিট পনেরোর পথ। হরিহর লুকিয়ে বাড়িতে গিয়েই হাজির হল, কারণ সে জানে থিয়েটারের সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকবে, তার পার্টের সময় না হলে কেউ তাকে খুঁজবে না।
হরিহর বাবা মুস্তাফার পাকা চুল আর দাড়ি-গোঁফ সাজঘর থেকে লুকিয়ে সঙ্গে এনেছিল। নিজের বাড়িতে এসে সেইগুলো সে পরে নিলে, কারণ এবারে তাকে পাশের বাড়িতে যেতে হবে, সেখানে সবাই তাকে চেনে!
হরিহর নিজের বাড়ির ছাদ থেকে পাশের বাড়িতে গেল। সে জানত, সুরেন আজ বিয়েবাড়িতে থাকবে। প্রথমে সে সুরেনের শূন্য ঘরে ঢুকে জুতো চুরি করলে। তারপর অন্য ঘরে গিয়ে হরেনকে আক্রমণ করলে। হরেন তাকে বাধা দিতে গেল, পারলে না, কেবল হরিহরের মাথায় একগোছা পরচুলা রইল তার হাতের মুঠোয়!
ধস্তাধস্তির সময়ে ঘরের টেবিলের ওপর থেকে ঘড়িটা যে মাটিতে পড়ে ঠিক রাত বারোটায় বন্ধ হয়ে গেল, এটাও সে জানতে পারলে না। জানলে নিশ্চয়ই সাবধান হত।
খুনের পর হরিহর সুরেনের জুতো পরে রক্তের ওপরে পায়ে হেঁটে চলে বেড়াল। তারপর সরে পড়বার আগে জুতোজোড়া যথাস্থানে রেখে দিয়ে গেল।
হরিহর বুঝলে, ভ্রাতৃহত্যার অপরাধে ধরা পড়ে সুরেনের ফাসি হবেই। তখন লাখ টাকা ভোগ করবে সে একলা। এক ঢিলে মরবে দুই পাখি।
ঘণ্টা-দেড়েকের মধ্যেই হরিহর থিয়েটারে ফিরে ওপরের ঘরে ঢুকলে। কিন্তু থিয়েটারে পালিয়ে আসবার সময়ে সে যে তাড়াতাড়িতে নিজের ছদ্মবেশ খুলে ফেলতে ভুলে গিয়েছিল, পাহারাওয়ালা চন্দর সিংহের মুখে আগেই আমরা সেটা জানতে পেরেছি।…ওদিকে থিয়েটারে আলিবাবার সময়েও তাকে স্টেজে না দেখে ড্রেসার ওপরে এসে হরিহরের কপট নিদ্রা ভঙ্গ করলে। সে যে থিয়েটারেই শুয়েছিল, তারও একজন সাক্ষী রইল।
হরিহর বাবা মুস্তাফার পরচুলা পরে সে রাত্রে যখন যখন অভিনয় করতে নামল, তখন দুটি সত্য জানতে পারেনি। প্রথমটি হচ্ছে, মৃত হরেনের মুঠোর চুলের সঙ্গে মুস্তাফার মাথার ছেড়া পরচুলা মেলানো সম্ভবপর হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাবা মুস্তাফার দাড়ির এক অংশে হরেনের রক্ত লেগে আছে।
সে নির্ভাবনায় পরচুলা সাজঘরেই রেখে গেল। এই হচ্ছে সেই পরচুলা। হরিহর নিজেই একবার পরীক্ষা করে দেখুক।
কিন্তু কে পরীক্ষা করে দেখবে? হরিহর তখন চেয়ারের ওপরে বসে-বসেই দারুণ আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেছে!
সুন্দরবাবু কিছুক্ষণ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে থাকবার পর বললেন, হুম! আপনি কি তন্ত্রমন্ত্র শিখেছেন বিমলবাবু? এত অসম্ভব কথা জানলেন কী করে?
বিমল বললে, আপনিও যদি আমার মতো যত্ন করে হরেনের মুঠোর চুলগুলো পরীক্ষা করতেন তাহলেই বুঝতে পারতেন, ওগুলো রুক্ষ মরা চুল, অর্থাৎ পরচুলা। তাইতেই সর্বপ্রথমে আমার সন্দেহ হল, হত্যাকারী নিশ্চয়ই সকলকার পরিচিত লোক, তাই ছদ্মবেশ পরে খুন করতে যায়। তারপর যখন শুনলুম হরেন-সুরেনের অবর্তমানে লাখ টাকার মালিক হবে হরিহর, তখনই আমার কড়া নজর পড়ল তার ওপরে। সে থিয়েটারের অভিনেতা শুনে আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হল। কারণ কে না জানে, অভিনেতারাই পরচুলা নিয়ে নড়াচড়া করে? এই একটা ছোট্ট সূত্র আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল বলেই আপনি গোলকধাঁধায় পথে-বিপথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
সুন্দরবাবু নিজের গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, স্বীকার করছি, আমি হচ্ছি মস্ত হাঁদা-গঙ্গারাম! কিন্তু, তারপর?
তারপর আর কী, পথ খুঁজে পেয়েই আমি থিয়েটারে ছুটলুম। জাল-পুলিশ সেজে খোঁজখবর নিতে লাগলুম। হ্যা, ইতিমধ্যে অ্যাটর্নি-বাড়িতেও গিয়ে খবর পেয়েছি, ওখানকার কেরানি সুবোধও হরিহরের সঙ্গে অভিনয় করে, আর লাখ টাকার উইলের গুপ্তকথা তার কাছে থেকেই হরিহর সব আগে জানতে পারে। থিয়েটারে গিয়ে প্রথমে আমি খোঁজ নিলুম, ঘটনার রাত্রে হরিহর কখন কোন নাটকে অভিনয় করেছিল। হিসাব করে দেখলুম, রাত এগারোটার পর প্রায় পাঁচঘণ্টা তাকে সাজতে হয়নি, আর সেই সময়টার মধ্যে কেউ খোঁজও নেয়নি যে, সত্যসত্যই সে থিয়েটারে আছে কিনা! তারপর আমার কাজ খুবই সোজা হয়ে গেল। এর ওপর সাজঘরে খানাতল্লাশ করে যখন বাবা-মুস্তাফার ছেড়া চুল আর রক্তাক্ত দাড়ি পাওয়া গেল, তখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। বাকি গল্পটা আমি আন্দাজে রচনা করেছি, কিন্তু তা যে মিথ্যা নয়, সেটা আপনারা সকলেই দেখছেন তো?…আচ্ছা। সুন্দরবাবু, আমার কাজ ফুরোল, এখন আমরা সরে পড়ি, কী বলেন?
সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে মহা-উৎসাহে বিমলের হাত চেপে ধরে বললেন, সে। কী, বিলক্ষণ! আমার ঘাড় থেকে এতবড়ো বোঝা নামিয়ে দিলেন, অন্তত কিছু মিষ্টিমুখ করে যান…ওরে, কে আছিস রে! শিগগির এক টাকার ভালো সন্দেশ-রসগোল্লা নিয়ে আয় তো!