৬
নেম চন্দন চক্রবর্তী, ফাদার’স নেম হরিপদ চক্রবর্তী, ডেট অফ বার্থ টেনথ মার্চ, ১৯৯০…এক্সপেরিয়েন্স…কী লিখবে? এক মাসের অভিজ্ঞতা কি কোনও অভিজ্ঞতা? প্রেজেন্ট জব…হ্যাঁ, ওটা লেখা যায়। একটা জব তো করে। বেকার তো নয়। কিন্তু কী জব? পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অফ এ? অফ এ কী? অফ এ প্রোমোটার? না-না এটা লেখা যায় না। বিজনেস ম্যান। মন্দ না। যার চেয়ে ভালো পিএ টু ডাইরেক্টর অফ এ বিজনেস হাউজ। গুরুপদর কয়েকটা প্যাড আছে। জি কে এন্টারপ্রাইজ হল এক নম্বর। জি কে শব্দটা শুনলেই জেনারেল নলেজ মনে হয় চানুর। আসলে হল গুরুপদ কর্মকার। আর একটা প্যাড আছে ইউনিক বিল্ডার্স, একটা আছে মা তারা কনস্ট্রাকশন। সমাজবন্ধু কো-অপারেটিভও আছে, ওটা ওর ভাই চালায়, কিন্তু কলকাঠি ওরই হাতে। এছাড়া মধ্যমগ্রাম স্টেশনের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট আছে মুম্বাচুম্বা। এটার মানেটা জিজ্ঞাসা করেছিল চানু। জি কে বলেছিল—মানে নাই, অথচ মানে আছে, জিৎ গাঙ্গুলির গানের মতো। কথাটা শুনতে কেমন? র্যাস্টুরেন্টটা ইয়ংদের জন্য তো, মুম্বা কথাটার মধ্যে মুম্বাই ইন আছে আর চুম্বার মধ্যে…বোঝোই তো। গুরুপদকে চানু স্যার ডাকে। এই ডাকটাই ওর পছন্দ। আরে ওর বাবা কিংবা দিদির কাছে যখন গল্প করে, তখন জি কে বলে। জি কে লোকটার পেটে বিদ্যে বেশি নেই, কিন্তু বুদ্ধি প্রচুর। লোকে বিদ্যে-বুদ্ধির কথাটা একসঙ্গে উচ্চারণ করে। যাদের বিদ্যে আছে, তাদেরই বুদ্ধি আছে এটাই পাবলিক ভাবে। কিন্তু অনেক লোক আছে যাদের প্রচুর বুদ্ধি কিন্তু বিদ্যে কম। জি কে খুব রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ভক্ত। ‘ঠাকুর’ কথাটা মুখে এসে যায়, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত। বলে—রামকৃষ্ণ কি বেশি দিন ইস্কুলে গেছিলেন? না, রবীন্দ্রনাথের রেফারেন্সটা দেন না। এই ল্যাপটপটা এখন চানুর। না-না, গিফট নয়, ফর অফিসিয়াল ইউজ। ওর ছেলেকে মেল পাঠাতে হয় দু-একদিন পর পর। ওর ছেলে শেষ অবধি ওই স্কুলেই আছে। ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে, আর হবে না বলেছে, ফাইন দিয়েছে, একটা মোটা টাকা জরিমানা দিয়েছে জি কে। ওর ছেলে জয়কে রোজ একশোবার করে ক্রশ চিহ্ন আঁকতে হয় বুকে, আর ডায়েরিতে ‘রিপেন্ট’ করে সেই ডায়েরি ওদের টিচারদের দেখাতে হয়। তা ছাড়া রোল কল-এর সময় ওর নাম সবার শেষে ডাকা হয়। জি কে ওর ছেলেকে যেটা লিখতে চায়, সেটা বাংলায় বলে দেয়, চানু ওটা যা হোক কোনওকম ইংরিজি করে লেখে। যেমন—জি কে বলছে, লেখ, চিন্তা করিও না, আজ তুমি ব্ল্যাক, হোয়াইট হইতে কতক্ষণ লাগে? আকাশের ম্যাঘ ব্ল্যাক, এক বৃষ্টির পরই হোয়াইট। শরীরের যত্ন নিবে, স্বাস্থ্যই সম্পদ। টাকা পয়সা বুঝিয়া খরচ করিও। বহুত কষ্ট করিয়া টাকা কামাই করি। বগলা মন্ত্রটি, প্রত্যহ একুশবার জপ করিতে ভুলিও না। চিকেন খাইবার আগে বিপত্তারিণীর ডোরটি খুলিয়া লইতে ভুলিও না। এই সব কথা ট্রানস্লেশন করে লেখা কম ঝকমারি নাকি? ও আগে ‘ওয়ার্ড’-এ লিখে নিয়ে মেল-এ কপি পেস্ট করে। ওয়ার্ডে লিখলে বানানটা কম্পিউটারই ঠিকঠাক করে দেয়। যেমন ডোন্ট ওয়ারি মাই বয়। ওয়ারি বানানটায় দুটো আর না একটা আর? ডিকশনারি দেখার দরকার হয় না। ইউ মেবি ব্ল্যাক টুডে ইউ উইল বি হোয়াইট ভেরি সুন। লিখেই কেমন যেন লাগল। যেন ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিজ্ঞাপন। কিন্তু এর বেশি কিছু হচ্ছে না, এতেই চলবে। ডোন্ট ফরগেট টু পুট অফ বিপডত্তারিনি’জ থ্রেড বিফোর ইটিং চিকেন লিখে মনে হল খুলে ফেলা ইংরিজি পুট অফ তো? নাকি পুট অ্যাওয়ে লিখবে? এ ডব্লু এ ওয়াই। পুট আউট নয়তো! ও-হো…পুট আউট মানে তো আগুন নেভানো, টেক অফ হবে। না-না-না, টেক অফ তো আবার এরোপ্লেনের মাটি ছাড়া বোঝায়। যাক গে—মরুক গে…টেক আউট হবে, টেক আউট। তাই করে চানু। বেশি চিন্তা করা ভালো দেখায় না। ওর ছেলে ঠিকই বুঝে নেবে। বাবা ছেলের ফোনেই কথা হয়, তবে মেলও করে। পুত্রের প্রতি পিতার পত্র-র নিয়মটা তো বহুদিন ধরেই চলে এসেছে, এটাও তাই, মূলত উপদেশ। টাকাপয়সা বেহিসাবি খরচ করিও না কথাটা প্রায় প্রতি চিঠিতেই থাকে। আগে লিখত ডোন্ট ওয়েস্ট মানি। কিছুদিন আগে একটা ভালো ইংরিজি শিখেছিল স্কোয়ান্ডার। লিখেছিল ডোন্ট স্কোয়ান্ডার মাই মানি। ইংরিজি কাগজে দেখেছিল গভর্নমেন্ট ইজ স্কোয়ান্ডারিং পাবলিক মানি। ক্লাবগুলোকে টাকা দেওয়া নিয়ে লিখেছিল। তার উত্তরে ছেলে লিখেছিল—মাইন্ড ইয়োর ল্যাংগুয়েজ ড্যাড। হোয়াট ব্যাড ওয়ার্ড ইউ হ্যাভ ইউজড—স্কোয়ান্ডার। হু ইজ দি গাই হু রোট ইট? ডিকশনারি খুলে চানু দেখেছিল স্কোয়ান্ডার মানে অপব্যয়, যথেচ্ছ খরচ, অযথা ব্যয়। বুঝেছিল ‘ওয়েস্ট’-এর চেয়ে এটা খারাপ। দরকার নেই কায়দা করার। চানু যেমন পারে তেমনই লেখে, ওতেই ভালো কাজ চলে।
কখনও-কখনও বস-এর স্ত্রী আসেন। বস পুংলিঙ্গ। মহিলা বস হলে বসানী হয়? হয় না। মাস্টার তো ইংরিজি শব্দ। মাস্টারের স্ত্রীলিঙ্গ মাস্টারনি। মহিলা বসও বস। বসের স্ত্রী ম্যাডাম। ম্যাডাম মাঝে মাঝে অফিসঘরে আসেন। একটু খ্যারখ্যারে টাইপের গলা। বরানগরের অনন্যা সিনেমা হল-এ কিছু মেয়ে টিকিট ব্ল্যাক করত, অনেকটা ওদের মতন গলা। কিন্তু ভ্রূ প্লাক করা, মুখের চামড়াটা কখনও চকচকে কখনও আবার খরখরে। চুল কখনও ছাড়া, কখনও বাঁধা। আবার চোখে কখনও জল, কখনও কাজল। চানু জানে ম্যাডামের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হয়। ম্যাডাম এসে বলে—চানু, আমিও একটা চিঠি লিখব। পুত্রের প্রতি মাতার পত্র। এটা কিন্তু ইংরিজি অক্ষরে বাংলাতেই লেখা হয়। চানু মেল খুলে দিলে ম্যাডামই শুরু করেন। ম্যাডাম টাইপ করেন। এএমএআর এসও এনএ। আমার সোনা। কখনও এরসঙ্গে এমওএনআই জুড়ে যায়। সোনামণি হল। আশা করি লেখার পর ঈশ্বরের কৃপায় ভালো আছে লিখতে হলে বলে—চানু, এবার তুমি লেখ, কারণ ঈশ্বরটা বেশ খটমট। ঈশ্বরকে বাদ দেবার প্রস্তাবটা চানুই দিয়েছিল। আশা করি ভালো আছ, এদিকে খুব গরম পড়েছে এরকম কিছু লেখার পর একটু ঝামেলা প্রায়ই থাকে, তখন চানুকে লিখতে হয়। যেমন বিদ্যাদেবীর কাছে প্রার্থনা করি যেন সব বিষয়ে ভালোভাবে উত্তীর্ণ হও। ছেলের চিঠিও পড়ে দেয় চানু। একবার ছিল কত দিন দেখিনি, একটা ছবি পাঠাও। ম্যাডাম বলেছিল, তোমার মোবাইলে ক্যামেরা আছে চানু? তা হলে একটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দাও না। চানুর ফোনে ক্যামেরা নেই। তাছাড়া, থাকলেও কি তুলত? বসের তো ভালো ক্যামেরা আছে ওর মোবাইলে।
চানু বলেছিল—স্যার তুলে দিক, আমি পাঠিয়ে দেব। ম্যাডাম বলেছিল—স্যার কি আর আমার ছবি তুলবে? স্যারের বয়ে গেছে। সেদিন বস কিন্তু তোলেনি ম্যাডামের ছবি।
স্যার বলেছিল—মোবাইলে ক্যামেরা নাই? ঠিক আছে, একখান ক্যামেরাআলা মোবাইল গিফট দিমুনে। আজ আমি তোমারে গিফট দিচ্ছি, কাল তুমিই অন্যরে গিফট দেবা। রোজগার করাটা কিছু না। খালি, মনের ভিতরে একটা প্যারেক ঢুকাইয়া রাখা লাগে, যে প্যারেক সর্বক্ষণ খোঁচা দেয়—রোজগার করো, টাকা কামাও। দুই পাঁচ লাখ ব্যাঙ্কে আছে, আর চিন্তা কী—এরকম ভাবলেই ঘেচু। পাঁচ কী করে পঁচিশ হবে, পঁচিশ কীভাবে পঞ্চাশ হবে এই ইয়েটা, মানে, জোশ, জোশ, সেইটাই আসল। ইউ আর এ গুড বয়। যদি থাক আমার সঙ্গে ঠিক বুঝতে পারবা, লাইনও ধরাইয়া দিমু। বোঝলা, এক চ্যানেলে হয় না, এই যে রাস্তার ড্রেন, এই ড্রেনে সব ঘরের জল আসে, তাতেই তো ড্রেনে জল হয়। ও আচ্ছা, ড্রেন শুনতে খারাপ লাগে? তাহলে নদী? এই নদী, সেই নদী নানা নদীর জলেই না নদী চওড়া হয়। নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ—না হিমালয়ের মাথা হইতে। হিমালয়ের মাথায় কতটুকু জল? সেই জলে ডায়মন্ডহারবার নদী এত চওড়া হয়?
একটা ডায়েরি দিল বস। বলল—যত টিক মারা অ্যাড্রেস আছে, কম্পিউটারে ঢুকাও। সামনে ঈদ, দুর্গাপূজা, তারপর আসবে দেওয়ালি। সবাইরে গ্রিটিং পাঠাব। ঠিকানাগুলি একদম ছাপা থাকবে কাগজের মধ্যে, প্রিন্টারের ভিতর থেকে ফুরফুর করে ঠিকানা বাইর হবে, তারপর কাইটা-ফাইটা খামের ওপর বসাবা। আগে হাতেই লিখতাম, গতবার ওই ছেলেটা হাতে লিখে দিয়েছিল। এবার তোমায় এটা করতে হবে।
সেই কাগজটাই করছিল চানু, ডায়েরিতে ঠিকানা তো আছে অনেক। কাঠমিস্ত্রি তারক, হেলাবটতলা, সরকার পাড়া, বারাসাত। বড়মাসি মধুবালা দাসি, তেগাছা, হরিসভার পিছনে পিন…। এধরনের নামের পাশে টিক চিহ্ন নেই। টিক চিহ্ন আছে ডা. অধীর ঘোষ, আইডিয়াল নার্সিংহোম, চাঁপাডালি, বারাসাত। ত্রিলোকেশ্বর সর্ববিদ্যা, তান্ত্রিকাচার্য্য, কেশব দাস লেন, আড়িয়াদহ। তমাল দে, সভাপতি, ১৪ নং ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস। বিমল নন্দী, সভাপতি, উত্তর চব্বিশ পরগনা, তাহের হোসেন তালুকদার, প্রধান আলাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত, কমরেড ষষ্ঠী ধর সামুই, চরবেড়িয়া—এরকম অনেক নাম, বেশ কয়েক জন এমএলএ এমনকী দুজন মন্ত্রী। আরিব্বাস। মন্ত্রীর বাড়ির ঠিকানা? তাহলে তো এই লোকটা হেবি লোক। চানু ভাবে ওর তো তাহলে এখানেই ভবিষ্যৎ। এই গুরুপদ কর্মকার তো এমনি এমনি লোক নয়, এর হাত বিরাট লম্বা। লোকটার সঙ্গে সেঁটে থাকলে ওর কিছু একটা হিল্লে হবেই হবে। এই নামগুলো কম্পিউটারে ঢোকানো মানে হল একটা ডেটাবেস তৈরি করা। ও ডেটাবেস তৈরি করতে থাকে। তখন হঠাৎ মনে হয় ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ায় দরখাস্ত পাঠাবার শেষ দিন এসে গেল। ওটা পাঠানো উচিত। দরখাস্তটা অন লাইনে করতে বলেছে। চানু অনলাইনে দরখাস্তটা করছিল। এক্সপেরিয়েন্স-এর ঘরে গিয়ে এতক্ষণ আটকে ছিল। এবার ঘরটা ভরতি করল। পিএ টু দি ডাইরেক্টর অফ এ বিজনেস হাউজ। নেম অ্যান্ড অ্যাড্রেস অফ দি অর্গানাইজেশন-এ ঘরে লিখে দিল জি কে এন্টারপ্রাইজ। ঠিকানাটা কী লিখবে? নফরগঞ্জ? এটা কেমন খেলো খেলো লাগছে। মধ্যমগ্রাম তবু ভালো। সেটাই লিখল।
কম্পিউটার স্লো হয়ে গেছে। বিএসএনএল-এর কানেকশন নয়। একটা ভালো কোম্পানির ডেটা কার্ড ঢুকিয়ে ইন্টারনেটের কাজ করা হয়। থ্রি জি। কিন্তু বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্নিং দিচ্ছে। ভাইরাস ঢুকেছে নাকি? চানু হিস্ট্রিটা চেক করল। দেখল গত এক মাসে বহুবার দেশি গার্ল ডট কম, মস্তি ডট কম, ব্ল্যাক বডি ডট নেট, নটি নটি ডট কম এইসব সাইট খোলা হয়েছে। এ সব সাইটে তো নোংরা নোংরা ছবি আসে। ব্লু। জীবনে দুবার এসব দেখেছে। দেখলে গা রিরি করে, আবার পরে একটা লোভও হয়। এখন ওইসব দেখে হট করে একটা সাইটে ক্লিক করে দিল। ঝাঁপিয়ে পড়ল দুটি মেয়ে একটা লাল থকথকে একটা বাথটবে। উঠে এল। ওটা কি টম্যাটোর সস ভরতি গামলা? দুটো ব্যাটা ছেলে, কালো রং, চাটতে লাগল ওই লাল রং জিভ দিয়ে। চানুর ভয় করল। সরে গেল না, কক্ষনো নয়। কিন্তু বস এসব দেখে? বস যে ভালো করে কম্পিউটার অপারেট করতে পারে না বলে। তা হলে এগুলো? কেউ হয়তো বলে দিয়ে গেছে, শিখে নিয়েছে। বেশি কিছু তো কারিকুরি নেই এর মধ্যে। এবার বোঝা গেল গতকালই গুরুপদ চানুকে বলেছিল, একটা নতুন ল্যাপটপ দরকার শুধু তোমার। তুমি এটা ইউজ করবা। দরকার হয়তো বাড়িতেও নিতে পারবা। অনলাইনে নাকি কমসম-এ পাওয়া যায়, একটা অর্ডার দিয়া দাও। গতকালই একটা অর্ডার দিয়েছে চানু ফ্লিপকার্ডে। ওটা আসুক, বাড়ি নিয়ে যাবে। একটা ব্যাগ কিনবে চানু, পিঠে ঝোলানো, আইটির ছেলেরা যেমন। একটা ভালো জুতো।
দরখাস্তটা শেষ করে ‘সেন্ড’ করার আগে মাউসটার গায়ে হাত দিয়ে কপালে ঠেকালো হাত। তারপর ক্লিক করল। সেন্ড হয়ে গেল। জয় দুর্গা জয় দুর্গা। আগে মা দুর্গা দুর্গা করলে চানু বলত—ধুস। এখন নিজেই করে। ওর নিজেকে দমশেষ হয়ে যাওয়া স্প্রিং-এর পুতুলের মতো মনে হত। এখন আর কথায় কথায় ধুস বলে না চানু। ও বেশ বুঝতে পারছে ওর মনের ভিতরে গুটিগুটি মেরে শুয়ে থাকা তেলের বিজ্ঞাপনের সাপটা মাথা ওঠাচ্ছে।
আবার ডেটা বেস তৈরি করতে থাকে। ট্যারা নিমাই, দুই নম্বর গেট, অশোকনগর। ট্যারা নিমাই নামটা কি খামের উপর সাঁটা যায় নাকি? পাশে একটা চিহ্ন দিয়ে রাখে চানু। স্যার এলে ভালো নাম জেনে নেবে। এই কাজটা হয়ে গেলে একটা মেল করতে হবে মানস দস্তিদার সাহেবকে। এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টের সাহেব। মুম্বাচুম্বা রেস্টুরেন্ট বার-এর পারমিশন পেয়েছে। এটা তো দস্তিদার সাহেবের জন্যই হয়েছে। দস্তিদার সাহেবকে দেখেছে চানু। একদিন এসেছিল, চানুকে চোখের ইশারায় ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল বস। তারপর ওরা বেশি নয়, মিনিট পনেরো ছিল। বস বলে গেছিল—লিখবা—রিসিভ গুড নিউজ, দিস ইজ ডিউ টু ইয়োর মার্সি—মানে আপনার দয়ায় লাইসেন্সটা হয়েছে—এই আর কী! আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। এই কথাটাই একটু সুন্দর করে, অলঙ্কার-টলঙ্কার দিয়া…বুঝলা না? ঘাড় নাড়িয়ে ছিল চানু। এখন ভাবছে আপনার দয়াতেই লাইসেন্সটা হয়েছে এটা কী লিখবে? মার্সি কথাটা কেমন যেন। হ্যাড দি লাইসেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গো’জ টু ইউ…বাঃ ইংরিজিটা কিন্তু শিখতে পারছে। কিন্তু অলঙ্কার? আই বিলিভ উইদাউট ইউ ইট কুট নট বি ডান…বাঃ।
এমন সময় ফোন এল একটা । বস। শোনো, শোনো চানু…দস্তিদারকে মেলটা পাঠিয়ে দিয়েছ নাকি?
বোধহয় ব্যাপারটা সিরিয়াস—নইলে এই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছেন কেন?
—না স্যার। লিখছিলাম। লেখা শেষ হয়নি।
—বাঁচাইলা।
মানে রিল্যাক্সড, নিজের ভাষা ফিরে এসেছে।
শুনো, পাঠাইও না। যেটা লিখছ, মুইছ্যা দাও। তোমার বউদিরে বলা আছে। গেলেই বুঝবে। একখান বাক্স দিবে। তার মধ্যে সোনার গয়না আছে। সেইটা চিকিমিকি কাগজে প্যাক করবা।
বাক্সের ভিতরে লিখবা—এইদিন বারবার ফিরে আসুক। বাংলায়। তারপর মধ্যমগ্রাম বৈদ্যপাড়ার নাড়ুরে দিয়া আসবা। নাড়ুর নাম ডায়েরিতে নারায়ণ ঘোষ। যে এরিয়ায় আমার মুম্বাচুম্বা, সেই এরিয়ার কাউন্সিলার নাড়ু। নাড়ুর বাড়িতে গিয়া বলবা আমি একটা বই পাঠালাম। স্বামী বিকেকানন্দর বই। বাক্সটা এমন মুড়ে দেবে—যে বইয়ের মতো লাগে। আজ ওদের বিবাহের দিন। আর একটা কথা। একটা মেয়ে আসার কথা বেলা এগারোটায়। ও দুটা ছবি দিয়া যাবে। ছবিতে কারিকুরি থাকে। তুমি মোবাইলে একটা ছবি তুলে রাখবা, আমি দেখব। মেয়েটা গানটান গায়, নাচেটাচে। আমার বার-এ একজন সিঙ্গার ড্যান্সার রাখব। আমি দুইটা নাগাদ ফিরব। কাজগুলি ঠিকঠাক করবা।
কাজগুলি ঠিকঠাক করতে লাগল চানু। গয়নার বাক্সটা কাগজে মুড়িয়ে নিল। বইয়ের মতোই লাগছে। স্বামী বিবেকানন্দর বই। অফিস ঘরে স্বামী বিবেকানন্দ, নজরুল আর নেত্রীর ছবি আছে। ক’দিন আগে পাড়ায় রসুন হল। মানে রবীন্দ্রনাথ-সুকান্ত-নজরুল। গান-আবৃত্তি। রানার। দেশলাই কাঠি। অনেক নেতা এসেছিল। কত চাঁদা দিয়েছিল বস,—চানু জানে না। এগারোটা নাগাদ একটা মেয়ে এল। হাতকাটা কুর্তি। ওড়না নেই। চুল কিছুটা কালো—কিছুটা বেগুনি। বলল—গুরুবাবু আসতে বলেছিলেন, কালুদা পাঠিয়েছেন। চানু বলল—স্যার জরুরি মিটিংয়ে কলকাতায় গেছেন।
মেয়েটাকে বলল—বসুন। মেয়েটা একটা চেয়ারে বসল, ওর সামনে। নিজেকে অন্যরকম লাগছে। ও যদি মেয়েটাকে উঠতে বলে, উঠবে। বলল, একটু দাঁড়ান তো…। মেয়েটা দাঁড়াল। আচ্ছা, বসুন। মেয়েটা বসল। মেয়েটি বলল, হাইট দেখলেন? ওয়ান ফরটি এইট সি এম, মানে ফাইভ ফুট, থ্রি ইঞ্চি। চানু বলল ওকে, অ-ও-কে।…গুরু…নিজেকেই বস লাগছে…মনে-মনে বলে, পুলকিত হয়। পি এ টু এ বিজনেস ম্যান। মেয়েটা নাচবে। চাঁদবদনী। সোহাগ চাঁন্দ বদনী ধনি নাচতো দেখি। সোহাগ।
—কী নাম?
—পাপিয়া।
পাপিয়া একটা পাখির নাম,—এটুকু জানে চানু। কখনও পাপিয়ার ডাক শোনেনি চানু। দুষ্টু পাপিয়া বলে পিয়া পিয়া…পিয়াপিয়া। চানু গন্ধ পাচ্ছে। দারুণ। হায় কী যে করি এই মন নিয়া…।
ছবি এনেছ?
মেয়েটা বলল…ইয়েস স্যার।
উঃ…স্যার বলল…এই প্রথম কেউ সামনাসামনি।
মোবাইলে বলে—ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারে। কিন্তু এক্কেবারে সামনে থেকে…
মেয়েটা ঝুঁকে ব্যাগটা খুলছে। ওঃ! এই যে ছবি।
—আপ্লিকেশন?
—ওটা লাগবে নাকি! কালুদা বলেনি তো…
—আচ্ছা-আচ্ছা, ওকে। নাচের এক্সপেরিয়েন্স আছে?
—হ্যাঁ-হ্যাঁ। আছে তো ডান্স বাংলা ডান্স-এর অডিশনে পাশ করেছিলাম, কিন্তু চান্স দেয়নি, কৃষ্টি টিভিতে নেচেছি সিনেমাতেও নেচেছি, এই তো, ফান্দে পড়িয়া বগা-তে শুভশ্রীর সঙ্গে।
—ওকে, ওকে। আবার একটু উঠে দাঁড়ান, একটা ছবি তুলব।
ছবি দিলাম তো, ফুল বডি, বাস্ট, ব্যাক, সাইড…।
—না, স্যার বলে গেছে আমাকে নিজে একটা তুলতে। মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। চানু ছবি তোলে। চানু সেভ করে।