২
আসলে, বাড়িটার নাম ইন্দ্রবাটি।
প্রমোটার ব্যাঁকা সাহা নিশ্চয়ই এই নাম রাখতে যায়নি। ওর মাথা থেকে ‘ই’ দিয়ে কোনও ভালো নাম বেরোচ্ছিল না। ওর জ্যোতিষী রাশি-নক্ষত্র-গণ হিসেব করে গুনে বলে দিয়েছিল ফ্ল্যাটের নাম ‘ই’ দিয়ে রাখলেই সাকসেস। ই দিয়ে কী হয়? ইংলিশ নামটা মনে এসেছিল। আসবেই। আগে বাংলা খেত, পরে ইংলিশ। স্কচও ইংলিশ-এর মধ্যেই পড়ে। ইংলিশ আবাসন চলে না। তারপর ভাবতে ভাবতে ইজ্জত। খেয়ে গেল পাবলিক। প্রথম প্রজেক্ট ‘ইজ্জত অ্যাপার্টমেন্ট’। পরের প্রজেক্ট ‘ইস্পাত অ্যাপার্টমেন্ট’। এরপর আর নাম খুঁজে পাচ্ছিল না ব্যাঁকা সাহা। ইঁচড়, ইতর, ইলেকট্রিক এসব নাম মনে পড়ছিল। তখন ইস্পাত আবাসনের এক ইস্কুল স্যার ইন্দ্রবাটি নামটার কথা বলে। ইন্দ্রবাটিই রাখা হয়েছিল, কিন্তু এখনকার বিহারি রিকশওয়ালাগুলোই নাম পালটে দিয়েছে।
এলাকাটা মধ্যমগ্রাম আর সোদপুরের মাঝামাঝি। ওল্ড ক্যালকাটা রোডের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া একটা রাস্তার ওপর। মধ্যমগ্রাম স্টেশন তিন কিলোমিটার, সোদপুর দু-আড়াই। এখানে একটা জুটমিল ছিল, বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর আগে। বেকার বিহারি শ্রমিকদের অনেকেই সাইকেল রিকশ চালায়। কেউ কেউ ভাত-রুটির হোটেলও করেছে। ইন্দ্রকে ওরা ইন্দর বলে। ইন্দরের ইঁদুর হতে কতক্ষণই বা লাগে? ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা সহজে ইঁদুর হতে চায়নি। প্রতিরোধ করেছিল। ফ্ল্যাটের সামনে ছোট হরফে লেখা ইন্দ্রবাটি ছাড়াও স্টিলের বড় বড় হরফেও লিখে রেখেছিল বাড়ির গায়ে। কোনও লাভ হয়নি। ভাষাতত্বে ‘সামাজিক সম্মতি’ নামে একটা কথা আছে। অনেক ভালো ভালো শব্দ সমাজ বাতিল করে দেয়, আবার অনেক খারাপ খারাপ শব্দকেও বরণ করে নেয়। যেমন ‘ঝি’র মতো কন্যা পাচক শব্দটাকে ছেড়ে দিয়ে কাজের মেয়ের মতো খারাপ শব্দকে মেনে নিন। বিহারি রিকশওয়ালারা ‘ইন্দর বাড়ি’ শুরু করার পর বাঙালি রিকশওয়ালারা ইন্দর নামের কোনও মানে খুঁজে না পেয়ে অর্থময় ইঁদুর করেছে।
হরিপদ আগে থাকত বরাহনগরে। ইশ, সেই বাড়িটা আর নেই, সেই পুরানো বাড়িটা, কুঠিঘাটের কাছে। ডাচদের কুঠিটা আজও আছে।
বরানগরের চারদিকে ছিল তাঁতিদের গ্রাম। খুব ভালো জাতের বাফতা কাপড় হত। ডাচ মানে ওলন্দাজরা বাফতা কাপড়ের লোভে এখানে কুঠি করে। সদরঘাটে জুতোর ভিতরে প্যান্ট গোঁজা সাহেবরা বসে বসে তামাক খেতে খেতে গল্প করত। কুঠিঘাট থেকে বরানগর বাজার পর্যন্ত যে রাস্তাটা, ওখানে কয়েকটা গুদাম ছিল। এরকমই কয়েকটা গুদাম কী করে কী করে রায় পরিবারের দখলে গিয়েছিল। রায় পরিবার হল ওই অঞ্চলে বিখ্যাত জমিদার। রতনবাবুর ঘাট ওঁরাই করেছিলেন। রায় পরিবারের একটা নিজেদের শ্মশান ছিল। ওদের বাড়ির একটা ছেলে বাড়ির নিজের অংশের মেঝের মার্বেল খুলে নিয়ে বিক্রি করে দিত। রায়বাড়িতে এখন আর রায়বাড়ির ছেলেরা তেমন কেউ নেই। ও বাড়িতে এখন লেদ কারখানা, একধারে সাইনবোর্ড লেখা হয়। গেঞ্জিকল, প্লাস্টিকের চিরুনিচামচ তৈরির কারখানা। অন্দর মহলের দিকে মেসাজ পার্লার, ‘পুরুষ বা মহিলা দ্বারা ফুলবডি মেসাজ হয়’। সিংহদরজার সিংহের গলায় দড়ি বেঁধে লুঙি-টুঙি শুকোয়, ফোয়ারাতলা নামটা আছে, ওখানে গাঁজার ঠেক। ফোয়ারা-টোয়ারা নেই বহুদিন, কিন্তু হরিপদ ওর ছোটবেলায় ফোয়ারা দেখেছিল, জল ছিল না যদিও। ছোটবেলায় রায়বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখেছে। রায়বাড়িরই কোনও রায় হরিপদ চক্রবর্তীর প্রপিতামহকে বরাহনগরে এনেছিল। আগে বর্ধমানে কোথায় যেন ছিল। দেশের বাড়ির কথা ভুলে গেছে হরিপদ, যায়নি তো, ছোটবেলা থেকেই তো বরানগরে। যে বাড়িটায় থাকত, ওটার নাম ছিল বড়বাড়ি। কেন বড়বাড়ি নাম হরিপদর জানা নেই। বড়বাড়িটার নাম পোড়োবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। ডাচ আমলের গুদামের ছাদের ওপর কতগুলো ঘর বানানো হয়েছিল। ওখানে দুটো ঘর নিয়ে থাকত ওরা। জন্মের পর থেকেই। শেয়ালের ডাক শুনেছে, জয় তারা, ব্যোম কালী হাঁক মেরে লাল কাপড়ের কাপালিক দেখেছে চিত্তেশ্বরী কালীবাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ছোটবেলায় হরিপদ সাহেবদের কথাও শুনেছে, সাহেবদের দেখেনি কখনও। সাহেবরা নাকি ঘোড়ায় চড়ে আলমবাজার, বনহুগলি, কাশীপুরে ঘুরে বেড়াত। নটীপাড়া নামে একটা জায়গা ছিল, বড়রা বলত ওপাড়ার সামনে দিয়ে চলাফেরা করতে নেই। কয়েকজন বুড়ি বুড়ি মেয়েছেলেকে সেজেগুজে বসে থাকতে দেখেছে, ওখানে নাকি এক সময় মেমসাহেব বেশ্যাও ছিল, ওলন্দাজরা এনেছিল ওদের প্রয়োজনে। একটা ছোট চার্চ, কাছেই স্যামুয়েল গড়। কে স্যামুয়েল? কোনও বড় ওলন্দাজ? তাসের যুদ্ধের কথাও শুনেছিল ছোট হরিপদ বড়দের কাছে। পলাশির যুদ্ধের পরে ইংরেজরা ওলন্দাজদের আর সহ্য করতে পারত না। এক বাঙালি মুনশিকে পাঠিয়েছিল ক্লাইভ ওলন্দাজদের কাছে, বলেছিল—কুঠি ছেড়ে চলে যেতে। একটা বার্তা লেখা ছিল একটা চিঁড়েতনের গোলামের টেক্কার গায়ে—’গেট আউট’। ওরা বলেছিল কেন গেট আউট? এতদিন আছি, বললেই হল গেট আউট? যাব না। মুনশি ক্লাইভকে গিয়ে বলেছিল—যাবে না বলছে, ক্লাইভ তখন কর্নেল ফোর্ডকে একটা অর্ডারে লিখলেন, ফোর্ড তিনশো সৈন্য নিয়ে বরানগর আক্রমণ করে ওলন্দাজদের তাড়িয়ে দিল। এটাই তাসের যুদ্ধ। একটা জায়গার নাম ছিল তাসের মাঠ। সেই যুদ্ধের স্মৃতি। মাঠ নেই। হরিপদ ছোটবেলাতে ওখানে মাঠ দেখেছিল, রামযাত্রা হত। বহুদিন হল মাঠটাও নেই। বাড়ি, বাজার, পাইস হোটেল। ওখানে আবার গোলাবারুদের শব্দ হয়েছিল, সেই সত্তরের দশকে। সেই বরাহনগরের বড়বাড়ি। বাইরের দিক থেকে ওঠা খাড়াই সিঁড়ি। একতলায়, যেখানে এককালে গুদাম ছিল, ওখানে পার্টিশন করে অনেক ছোট ছোট ঘর করা হয়েছিল, একটা মন্দিরও তৈরি হয়েছিল, হনুমান, রামসীতা। বেশ কিছু হিন্দুস্থানি থাকত।
একটা লোক আসত, অনেক আগে, পা টেনে হাঁটত, পায়ে গোদ ছিল কিনা, সে ছিল রায়বাড়ির ম্যানেজার। রায়বাড়ি তো ততদিনে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। সম্পত্তিও ভাগাভাগি হয়ে গেছে। বড়বাড়িটা যে রায়ের ভাগে, সে নাকি কবি। সেই কবি খুব নেশা করত, কম বয়সে মারা গেল, ওর সম্পত্তি বোধহয় ভাইয়েরা পেয়েছিল। কিন্তু পা টেনে হাঁটা ম্যানেজার বাড়ি ভাড়া নিত। বাড়ি ভাড়ার রসিদ দিত। অস্য অত্র শ্রী পুণ্ডরীক চক্রবর্তীর অমুক মাহিনার ঘরভাড়া বাবুদ ১৮।।০ গৃহীত হইল। পুণ্ডরীক হল হরিপদর পিতামহের নাম। ওর নামেই ভাড়া দিয়েছে হরিপদ। সেই ম্যানেজারটা আসা বন্ধ করে দিল। মারা গেলে আর আসবে কী করে। দুমাস পর থেকে ভাড়া নিতে এল রামপিয়ারি। দু-তিনজন সাকরেদ নিয়ে এল। বলল—এত দিন আপনারা ফোকটে থেকেছেন। দশ-বিশ টাকা ভাড়া দিয়েছেন। এবার একশো করে দিবেন, বেশি বুলব না, সিরিফ শ’ রুপেইয়া, ব্যাস। এক কেজি তিলাপিয়া কা ভাও মে এক মাহিনা রাহনা।
ভাড়াটেরা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল, কেউ নখ খুঁটছিল দাঁতে, কেউ মাথা চুলকোচ্ছিল। একজন বলেছিল, আপনাকে দেব কেন? আপনি কে? ও বলেছিল—আমি রামপিয়ারি আছি, অউর কুছ?
এটা পনেরো-ষোলো বছর আগেকার কথা। রামপিয়ারি একদিনই এসেছিল, এরপর থেকে ওর লোকজন আসত। একশো টাকা কোনও ভাড়াই নয়, ওখানে পেয়ারাবাগান বস্তিতে, ধাঙড় পাড়ার বস্তিতেও একটা খুপরির ভাড়া তখন চারশো টাকা।
হরিপদ দিয়ে দিত। ওর বাবা তখনও বেঁচে, বাবা বলেছিলেন, মগের মুলুক? আঠারো টাকা এক লাফে একশো? যদি বেশি ভাড়া দিতেই হয়, রায়দের দেব, ও ব্যাটাকে দিবি কেন হরি? হরিপদ বলেছিল— থাক, এ নিয়ে ঝামেলা কোরো না। রামপিয়ারিকে সবাই ভয় করে।
গুন্ডা বলতে যা বোঝে লোকে, রামপিয়ারি ওরকম নয়, গুন্ডাদের গোঁফ থাকে, ভালো চেহারা হয়, গায়ে জোর থাকে। গুন্ডাদের আগে ছিল পাইক-পেয়াদা, লেঠেল। ওরা লাঠি খেলত, মুগুর ভাজত। গুন্ডারা লাঠি খেলত না, ছুরি-ভোজালি চালাতে পারত, আর সোডার বোতল মারতে পারত। সোডার বোতল ছোড়ার একটা কায়দা ছিল, বোতলটা একটু ঝাঁকিয়ে ছুড়তে হত। ঝাঁকালে, ভেতরে গ্যাস তৈরি হত, মাটিতে পড়লে টুকরো টুকরো হয়ে কাচ ছড়িয়ে যেত। বোতলটা বোমার কাছে হেরে গিয়ে বিদেয় নিয়েছে। রামপিয়ারি নিজে হয়তো বোমা বানায় না, কিন্তু তুড়ি মারলে দু-ডজন বোমা মারার লোক হাজির হয়ে যেতে পারত। রামপিয়ারি এমনিতে লোক খারাপ নয়, ওর একটা হনুমান মন্দির আছে, হনুমান চতুর্থীর দিন সবাই বড় বড় লাড্ডু পায় ফ্রিতে, রামনবমীর দিন ঘি ভাত আর সবজি পাত পেড়ে, সবাই। রামপিয়ারি দেখতে ছোটখাটো হলে কী হবে, ও ছাড়া বরানগর জুট মিলে কোনও ডেলি মজদুর ঢুকতে পারে না। কোনও ট্যাক্সিওলা রামপিয়ারিকে মাসোহারা না দিয়ে দাঁড়াতে পারে না, নেতারা চাইলে, তুড়ি মেরে দু-ঘণ্টায় একশো লোকের বাইক মিছিল করে দিতে পারে। দু-বছর পরই রামপিয়ারির লোক বলল—একশো টাকা তো ফুটপাথে শুতে গেলে পুলিশকেই দিতে হয় মাসে। পাকা বাড়ি, ইলেকট্রিক জল নিয়ে এই টাকায় হয় নাকি, দেড়শো করে দিতে হবে। কেউ কেউ গাঁইগুঁই করল, কিন্তু হরিপদ কিছু বলেনি, বউ-ছেলে-মেয়ে, বুড়ো বাবা-মা নিয়ে সংসার, মেয়েটা তো বড় হচ্ছে, হরিপদ কোনও ঝামেলা করেনি। কিছুদিন পর দুশো। ব্যাস, এরপর আর বাড়ায়নি রামপিয়ারি। রামপিয়ারি গরিবের কষ্ট বুঝত। লাল পার্টির সঙ্গে যোগ ছিল কিনা। দু-তিন ঘর ভাড়াটে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, রামপিয়ারির লোক ওদের ঘরের ভিতরে জঞ্জাল ফেলে দিয়েছিল, সবাই মিলে পার্টি অফিসে গিয়ে নালিশ করাতে রামপিয়ারি নিজে এসে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিল। আর বলেছিল, কোনও জোর জবরদস্তি নয়, দুশো না পারলে দেড়শোই দেবেন। পঞ্চাশ টাকায় কী ফারাক হবে, আমি ম্যানেজ করিয়ে নেবে। কিন্তু ওর অসুবিধাও তো ‘কনসিডার’ করতে হবে। ও কতগুলো বেকার ছেলেকে ‘কাম কা বন্দোবস্ত’ করে দিয়েছে, ‘রোটি কা ইন্তেজাম’ করে দিয়েছে, ছেলেগুলোকে মাসে মাসে টাকা দিতে হয়, ওদের বাবা-মা আছে। ‘পিতা স্বরগ, পিতা ধরম’ হয়। ধরম করম করতে গেলে টাকা চাই। আমি সিটাই করি, আর উটাই আমার ধরম। আমি নিজে ডাল রোটি খাই, দাদাগিরি করি লেকিন রাজাগিরি করি না। হরিপদ রামপিয়ারির কথায় সায় দেয়।
হরিপদর আয় বেশি নয়। অনন্যা সিনেমা হল-এ সিট দেখানোর কাজ করত, হাতে টর্চ লাইট নিয়ে, সিনেমা হলটা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর বড়বাজারের একটা গদিতে। বিশ্বাসী লোক বলে নাম আছে। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় নানা কাজে। টাকাপয়সাও দিয়ে আসতে হয়, নিয়ে আসতে হয়। মালিক খুব বিশ্বাস করে, কিন্তু টাকাপয়সা দেয় না। মদনলাল সারোগি মারা গেছে, ওর ছোট ছেলে এখন এই কারবারটা দেখে, ওর আমলে রোজ দশ টাকা করে টিফিন খরচ পায়। যেদিন কামাই, সেদিন বাদ। মাঝে মধ্যে হরিপদকে দিয়ে চিকেন রোল বা মটন কাটলেট আনায়। ও দোকানে বসে আমিষ খায় না, দোকানের বাইরে গিয়ে খায়। যেদিন এসব আনায়, হরিপদর টাকাটাও দিয়ে দেয়। হরিপদ বেশির ভাগ দিনই খায় না, কাগজে মুড়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। মেয়েটা এসব ভালোবাসে যে। চাটুতে সেঁকে গরম করে নেয়। এক ধরনের বাক্স আছে, ওখানে খাবার ঢুকিয়ে দিলে সুইচ টিপে দিলে ভিতরে খাবারটা নাগরদোলার মতো পাক দেয় আর গরম হয়ে যায়। মালিকের চেম্বারে এটা আছে। বাড়ি থেকে আনা পরোটা, সবজি গরম করে খায়। এসব জিনিস হরিপদর ঘরে কোনওদিন ঢুকবে না।
দু-হাজার নয় সালে লোকসভার ভোট হল। রেজাল্ট বেরোলে রামপিয়ারির মাথায় সবুজ আবির, সরু পাজামা, সাদা পাঞ্জাবি, কলার তোলা। কিছু বোম ফাটল দুমাদ্দুম। রিকশওয়ালাদের দুটো স্ট্যান্ড হয়ে গেল, অটোওয়ালাদের মধ্যে একদিন মারপিট হল, ফুটপাথ দখল করে বানানো লাল ঝান্ডা লাগানো একটা টিনের ঘর ভেঙে ফেলাও হল, অশ্বত্থ গাছের ডালে ডালে জোড়াফুল ছাপা পতাকা উড়তে লাগল। উড়ুক গে। যা হচ্ছে হোক। হরিপদর তাতে কী। সবাই বলাবলি করছিল পরিবর্তন চাই, হরিপদও পরিবর্তনে ভোট দিয়েছিল। ও জানত, ওর কোনও পরিবর্তন হবে না। কিন্তু রামপিয়ারি যে সবুজ আবির মাখবে সেটা জানত না হরিপদ।
কিন্তু রামপিয়ারি সবুজ আবির মাখাতেই হরিপদর জীবনে এই পরিবর্তনটা হল। হরিপদ ফ্ল্যাট পেল, এখানে, ইঁদুর বাড়িতে।
রামপিয়ারি বলেছিল এই বাড়িটা আমি কিনে নিয়েছি। ছেড়ে দিতে হবে। এখুনি ছাড়তে হবে না, তিন মাহিনা টাইম। হরিপদ বলেছিল, কী সর্বনাশ, কোথায় যাব পিয়ারি ভাই…
পিয়ারি বলেছিল এবার বুঝুন এতদিন আমি আপনাদের জন্য কী স্যাকরিফাইস করিয়েছি। দেড়-দো শোতে থাকতে দিয়েছি। এবার ঘর ভাড়া নিন, দেখি কার অন্দরে কত রস আছে।
একজন মহিলা, ওর স্বামী মারা যাবার পর লোকের বাড়ি রান্না করে, সোজা রামপিয়ারির পায়ে পড়ে গেল। বলল, দুই মেয়ে নিয়ে ফুটপাথে কী করে থাকব। আপনিই আমাদের পার্টি অফিস, আপনি আমাদের তাড়াবেন না।
একজন বিহারি ছিল, খইনি বিক্রি করে রাস্তায়। সে বলল, হুজুর, আপ মেরা সরকার মালিক, মেরা বজরংবলী জেইসা…উদ্ধার কিজিয়ে।
রামপিয়ারি বলেছিল, ও যদি বাড়িটা না নিত, তাহলে মিউনিসিপালিটিই বাড়িটা ভেঙে দিত। তিনশো বছরের পুরানো বাড়ি, বাড়িতে বটগাছ গজিয়েছে। যখন তখন ভেঙে পড়বে, তখন সবাই মারা যাবে।
এটা ওরাও জানত। মাঝে মধ্যেই দু-চারটে চাঙড় খসে পড়ে। জানালাগুলোর কার্নিশ বলে কিছু নেই, গাঁথনির ইট থেকে চুন-সুরকির পলেস্তারা খসে গেছে, কাঁকড়াবিছের বাসা হয়েছে ইটের ফাঁকে। কাঁকড়াবিছের হুল ফুটলে কেমন লাগে ওবাড়ির অনেকেরই জানা। তবু ওই পোড়ো বাড়িতে ওপর-নীচ মিলে চোদ্দোটা পরিবার বাড়িটা ভেঙে পড়তে পারে জেনেও থাকত। হরিপদও থাকত, ওর তো অন্য কোনও উপায় ছিল না।
রামপিয়ারি কীভাবে বাড়িটার অধিকার পেল—সেটা জানার চেষ্টা করেনি হরিপদ। ওর কী দরকার এসব জেনে! রামপিয়ারি লোক ভালো। ইচ্ছা করলেই ওর লোকজন দিয়ে সবাইকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে দিতেও পারত, সেটা করেনি তো, সময় দিয়েছে। কাউকে কাউকে এক লাখ দু-লাখ টাকা দিয়েছে, কাউকে কাউকে নটীর বাগান বস্তিতে ঘরের ব্যবস্থা করেছে, হরিপদকে একটু বেশি খাতির করেছিল, বলেছিল—আপনি ব্রাহমণ আছেন, আপনি আমাকে আশীর্বাদ দিবেন, সেরেফ দো লাখ রুপেয়া দিয়ে দিন, আপনাকে একখানা ফ্ল্যাট দিয়ে দিব। দিয়েছিল হরিপদ, তিল তিল করে জমানো টাকা, মেয়ের বিয়ের জন্য রেখে দেওয়া ওর বউয়ের গয়না, সব উজাড় করে দু-লাখ জোগাড় করতে পেরেছিল। আজ ওর নফরগঞ্জে ফ্ল্যাট হয়েছে। দুটো ঘর, একটা ছোট বারান্দা, ওটাকে ব্যালকনি বলে। একটা ছোট কলঘর, ওটার নাম টয়লেট। আগে এক বাসেই বড়বাজার যেতে পারত, এখন গদিতে যেতে একটু সময় বেশি লাগে। সাইকেলে মধ্যমগ্রাম স্টেশন আধঘণ্টা, সাইকেল রেখে ট্রেনে শিয়ালদা, আবার বাস। পরিশ্রম হয়। হোক পরিশ্রম, নিজস্ব ফ্ল্যাট তো বটে। রামপিয়ারির জন্যই তো এটা হল। রামপিয়ারি সুখে থাক। বড় নেতা হোক। রামপিয়ারি জিন্দাবাদ। যুগ যুগ জিও।