১
হরিপদ একজন বেঁটেখাটো ছোটমোটো লোক। হোয়াটস অ্যাপ, টুইট এসব শব্দ কানে আসে, মানে বোঝে না। দেব, জিৎ, অঙ্কুশ, কোয়েল, শুভশ্রী এদের নামও জানে, কিন্তু কোনটা কে চেনে না। দেবকে চিনতে পারে, ভোটে দাঁড়িয়েছে, এম পি হয়েছে, কতবার কত রকমের ছবি দেখেছে ওর, মেট্রো স্টেশনে খোকা ৪২০, তা ছাড়া খোকাবাবু যায় লাল জুতো পায়…তারপর কী যেন…বড় বড় মেয়েরা সব উঁকি মেরে চায়…এই গানটা তো প্রায় মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল।
এখন হরিপদর বগলে একটা ইংরেজি কাগজ ভাঁজ করা। এক হাতে বাজারের থলে, পুঁই ডগা উঁকি মারছে, অন্য হাতে একটা পলিথিনে হলুদ গেন্দা ফুল। বেলপাতা, তুলসীপাতা, দূর্বা এসবও আছে। বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে এই ফুলটুকু কিনতে পেরেছে। বেস্পতিবার ফুলের হেবি চাহিদা। হরিপদ পাঁচ টাকার ফুল নেয় ফি বেস্পতিবার। লক্ষ্মী পুজো দেয় বউ। পাঁচ টাকা ফুলের খদ্দেরকে ফুলওয়ালা পাত্তাই দেয় না। সব বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ টাকার ফুল কেনে। মা কালীর জন্য জবার মালা, শিবঠাকুরের জন্য আকন্দর মালা, গুরুদেবদের জন্য সাদা মালা—এরকম সব নিয়ম আছে। হরিপদর বাড়িতে গুরুদেবের ছবি নেই। বাবার একটা ছবি আছে, ওতে প্লাস্টিকের মালা ঝুলছে, পালটাবার দরকার নেই। ‘খড় পচে খড়কে পচে কথা পচে না, আর পেলাস্টিকের মালা পচে না।’ ট্রেনের হকার এটা বলতে-বলতে প্লাস্টিকের মালা বিক্রি করছিল, এক জোড়া কিনে নিয়েছিল। একটা জন্মদাতা বাবার গলায় আর একটা ভোলাবাবার গলায় দু-বছর ধরে ঝুলছে। ইংরেজি খবরের কাগজটাও ফি বেস্পতিবার কেনে হরিপদ। কারণ এই দিনটায় চাকরির খবর থাকে। দু-পাতা ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ বের হয়। পুত্রশ্রী চানু আজকাল আর ইংরেজি কাগজ-টাগজ কিনতে চায় না। বলে—’ধুস’। হরিপদ তবু কেনে। পুত্রস্নেহে কেনে। ইংলিশ পড়ার প্র্যাকটিস থাকাটা ভালো। চাকরির দরখাস্ত আজকাল আর করতে চায় না। সব জায়গায় নাকি কম্পিউটারে দরখাস্ত পাঠাতে হয়। বাড়িতে কম্পিউটার নেই, কিনে দিতে পারেনি, কম্পিউটারের কাজকর্ম করার দোকানে গিয়ে এসব করতে হয়, ওইজন্য আবার টাকাও দিতে হয়। এরকম একটা দোকান দিয়েছে পরিতোষের ছেলে। এই দোকানটার নাম জানত সাঁইবাবার কাফে। দোকানে সাঁইবাবার ছবি লাগানো, পরিতোষ খুব সাঁইবাবার ভক্ত। পরে জেনেছে ওসব দোকানের নাম সাইবার কাফে। সাইবার মানে কে জানে কী, আর কাফে তো চায়ের দোকান। শেয়ালদায় একটা দোকান ছিল কেষ্টো কাফে। কম্পিউটারের কাজকর্মের দোকানের নাম কী করে চা দোকানের নামে হয় কে জানে। কত কী হচ্ছে। বিস্কুটের নাম হচ্ছে পারলে মারি। গুজিয়ার দাম হচ্ছে পাঁচ টাকা পিস। কোনও মানে হয়? বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর জন্য নকুলদানার বদলে মাঝে-মাঝে একটু স্পেশাল দিতে চায় চানুর মা। গুজিয়া তিন টাকা করে ছিল—এক লাফে পাঁচ? হরিপদ প্রশ্নটা ছুড়ল বটে, গলায় জোর ছিল না। ওধার থেকে উত্তর এল—খুচরোর সমস্যা। বাতাসা সাইজের সন্দেশও পাঁচ টাকা। সন্দেশই ভালো। ছোট্ট একটা বাক্স ফুলের পলিথিনে ভরল। ওই দোকানেই আর একজন একটা মোটা বাক্স পলিথিনে ভরেছে। ওর হাতেও ফুল ভরা, মালা ভরা ভারী পলিথিন। লোকটা হরিপদর কাঁধে টোকা দিল। হরিপদর কাঁধে অনেকেই অনেক সময় টোকা দেয়, খামচায়, ধাক্কায়। হরিপদ একজন বেঁটেখাটো ছোটখাটো লোক। লোকটা বলল—ও দাদা, একটু দাঁড়ান না।
লোক, নাকি ছোঁড়া? ছোঁড়া বলা যায় না, মোটাসোটা গড়ন, ফুলপ্যান্ট আর কলারওলা সবুজ গেঞ্জিতে ভুঁড়িটা পুরো ঢাকেনি। গলায় ঝুলছে সোনার চেন, চোখের কালো চশমার কাচে রাস্তার গাড়ি পিছলে যাচ্ছে, ওই চশমার কাচে হরিপদ নিজের মুখটাও এক ঝলক দেখতে পেল। লোকটা বলল—এই যে দাদা, শুনছেন?
এই ধরনের লোক দেখলে কেন যেন একটু ভয় ভয় করে হরিপদর। বাজারে, হরিপদ হয়তো উবু হয়ে বসে মাঝারি সাইজের তেলাপিয়া বাছছে, তখন এই ধরনের লোকরাই তো ঝাঁঝিয়ে বলে সেই থেকে কী পিটিস পিটিস করছেন—সরুন তো, চিংড়ি তুলব। এরাই লাইন ছাড়াই অটোতে বসে পড়ে। এই টাইপের লোকরাই কালীপুজোর সময় পাড়ার ছেলেদের নিয়ে দমাদ্দম বোম ফাটায়।
হরিপদ দাঁড়ায়। লোকটা কাছে আসে। আস্তে আস্তে বলে—ওটা ইংলিশ?
কোনটা?
বগলে চাপা খবর কাগজটা টোকা মারে লোকটা, বলে এটা ইংলিশ পেপার না?
হরিপদ বলে, হ্যাঁ।
লোকটা বলে—একটু কথা আছে দাদা এদিকে আসুন, একটু গ্যাঞ্জামের বাইরে যাই। লোকটা কয়েক পা এগিয়ে একটা বটগাছতলায় দাঁড়ায়। কালো চশমা উঁচু করে মাথায় রাখে। কাদের যেন এরকমই চশমা থাকে। ডুবুরি না যেন মহাকাশচারী?
লোকটা বলে—দাদা একটু হেল্প করেন না আমায়…।
লোকটার কথাটা একটু বেমানান লাগছে যেন…। এত নরম করে কথা বলে কেন? হরিপদ কিছু না বলে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। সবুজ গেঞ্জির ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে লোকটা। বলে—আপনাকে তো আমি চিনি, দেখি তো, কাছে ধারেই থাকেন। এইটা একটু পড়ে দেন তো, ছেলের মেইল। সব্বাইরে তো বলা যায় না। ছেলে দার্জিলিঙে থাকে, ইয়ে, কনভ্যান্টে পড়ে। দেন, ব্যাগ দুটো আমায় দেন, ফুলটা গাছতলায় রাখতে পারেন, এখানে শিব আছে, কেউ ছ্যাপ-থুতু ফালায় না। দেখেন তো কী কইতে চায় অ্যালায়…।
হরিপদ মেলটা পড়ে। ডিয়ার ড্যাড, লেট মি কনভে এ ফ্যান্টা নিউজ। আই হ্যাভ বিন সিলেকটেড…
থামিয়ে দেয় লোকটা। বলে মোদ্দা কথাটা কী, কী চায় সে? হরিপদর ব্যাগটা ফুটপাথে রেখে সিগারেট ধরায় লোকটা।
হরিপদ বলে—বলছে ওদের ইস্কুলের ভলিবল টিমে চান্স পেয়েছে, গ্যাংটক যাবে খেলতে। ওর খেলার ভিডিও তুলে আপনাদের দেখাতে চায়। একটা ভিডিও ক্যামেরা কেনার টাকা এক্ষুনি ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে…
ট্রান্সফার-এর বাংলাটা ভাবছিল হরিপদ।
লোকটাই বলেছিল—ঢুকাইয়া দিতে হইব, তাই তো?
মাথা নাড়ে হরিপদ।
লোকটা রেগে গেছে। সিগারেটে ঘনঘন টান মারে বার কয়েক। বলে—শুয়োরের বাচ্চা কেবল টাকা চায়। নানা ছলছুতায় টাকা চায়। ভাবছেটা কী, ওর ড্যাডির কি টাকার গাছ আছে নাকি? হরিপদ বুঝতে পারে না এখন ওর কী ভূমিকা হওয়া উচিত। মুখে একটা সহানুভূতির চুকচুক করাটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? পৃথিবীর নিয়মটা হল—বড় মানুষরাই ছোট মানুষদের আহা-উহু করবে, সহানুভূতি-সান্ত্বনা এসব দেবে। ছোট মানুষেরা বড় মানুষদের এসব করে না। হরিপদ মাথা চুলকায়, বলে আপনার ছেলে বুঝি খেলায় খুব ভালো?
লোকটার নাক থেকে জোরে হাওয়া বের হল। রামদেব টিভিতে ‘কপালভাতি’র কায়দা দেখানোর সময় নাক দিয়ে এরকম একটা আওয়াজ করেন। ওটা খুব পবিত্র আওয়াজ কিন্তু, লোকটার নাক দিয়ে যে শব্দটা বের হল—হুঃ টাইপের, সেটা তাচ্ছিল্যের। হরিপদ কাগজটা ফেরত দেয় লোকটাকে। লোকটা সবুজ গেঞ্জিতে কাগজটা ঢোকায়। পুত্রের পত্র।
—দাদার থাকা হয় কোথায়?
—ইঁদুর বাড়ি।
—ও কাছেই তো। ব্যাঁকা সাহার ফ্ল্যাট?
—হ্যাঁ।
—কবে কিনেছেন দাদা?
হরিপদ ওটা কেনেনি। পেয়েছে। পেয়েছে মানে বলতে গেলে আদায় করেছে। কিছু টাকা অবশ্য দিয়েছে, সে অনেক কথা। এখন এর কাছে এতসব বলার দরকার নেই। হরিপদ বলল, এই মাস ছয়েক হল।
লোকটা বলল—দেখেশুনে কিনতে পারতেন, বহুত বাজে কনস্ট্রাকশন। তিন নম্বরি ইট, বিশ এম এম রড…।
হরিপদ চুপ করে থাকে।
লোকটা বলে আমিও রিয়েল এস্টেটের কারবার করি। এক নম্বর মাল দি।
হরিপদ রিয়েল এস্টেট মানে আগে বুঝত না। রিয়েল মানে ‘সত্যি’। এস্টেট মানে তো স্টেট। স্টেটকে বলার সময় এস্টেট-ই তো বলে লোকে। যেমন এস্টেট বাস। স্পেশালকে এসপেশল। স্টেট মানে রাষ্ট্র। তাহলে রিয়াল এস্টেট মানে দাঁড়ায় সত্যিকারের রাষ্ট্র। এখন অবশ্য আসল মানেটা বোঝে হরিপদ।
লোকটা বলল, চা খাবেন? হরিপদর সম্মতি না নিয়েই হেঁকে দিল অ্যাই নাড়ু, দুইটা চা দিয়া যা। শিবের চাতালে বসে গেল লোকটা। হরিপদ উসখুস করছে, ওর হাতে ফুল কিনা, চা খেলে হাত এঁটো হয়, এঁটো হাতে ফুল ধরলে ফুল অপবিত্র হয়। হরিপদ বলেই ফেলল সত্যি কথাটা। ঠাকুরের ফুল আছে তো…চা খেলে হাতটা ইয়ে হয়ে যাবে না…।
লোকটা বলল ধুর, নো পব্লেম। ফুল তো আমারও আছে। হাতটা ধুয়ে নিলেই তো…। এ্যাই নাড়ু, চা আনার সময় মগে এট্টু জল নিয়ে আসিস…।
এরপর তো না করা যায় না। এরা হল মানী লোক। —না, না, মানী লোক কেন, পয়সাওলা লোক। ওহো, তাহলেই তো মানী লোক। মানি মানে তো পয়সাই হয়।
লোকটা বলল—আমায় চিনেন না বোধহয়, আমি গুরুপদ কর্মকার। গুরু নামেই সবাই চেনে। এই এলাকার আদি লোক। যখন ধানখেত ছিল এধারে, কাশবন, হোগলাবন, তখনকার লোক, এইসব রাস্তাঘাট, ফ্ল্যাট-ম্যাট সব চোখের সামনে হল। সেবেনটি ওয়ানে বরিশাল থিকা আমার ঠাকুরদাদা এধারে আসে, বোঝলেন, কাজিপাড়ার হাটে কামারশালা করল, আমার বাবাও কামারের কাজ করেছে। এখন পারে না, বাপ-মারে এখন সেগুন কাঠের পালঙ্কে শোয়াই, ডানলোপিলোর গদি, শাস্ত্রে আছে পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম…বাপ-মা’র আশীর্বাদে এখন আমার কাজ-কারবার। ছেলেটারে পাঠাইলাম বোর্ডিং-এ। কনভ্যান্ট। বউ-এর শখ। টাকার শ্রাদ্ধ। কী ভুল করলাম। এধারেও ইংলিশ মিডিয়াম ছিল। জুলিয়েন ডে ছিল, ক্যাম্বিস, সরি, ক্যাম্ব্রিজ ছিল। দার্জিলিং-এর ইস্কুলে পড়ে সব হাই হাই বিজনেসম্যানের ছেলেপুলেরা। ছেলেটাও ঢ্যামনা টাইপ, ওরাও বলে, ছেলেও গলে। টাকা দাও। কোনও মিস-এর জন্মদিন, কোথায় ভূমিকম্প, কার ব্লাড ক্যানসার, টাকা দাও। নানা বাহানা। ফোন করে, ফোনে হয় না, মেল করে। আমার ল্যাপটপ-ফ্যাপটপ নাই। পরিতোষের দোকানে পাঠায়। আর সত্য কথাই কই, পড়াশুনা বেশি করি নাই। একটু খারাপ সংসর্গে পইড়া গেছিলাম—আর কী। যাক গিয়া, থ্যাংকিউ, আমারে মাঝে মধ্যে একটু হেল্প করা লাগবে। একটা ছেলে রাখা আছে। সে বড় কামাই করে। আপনার ফ্ল্যাট আমি জানি, আপনারেও তো দেখি, আপনার নামটা…
—আমার নাম হরিপদ চক্রবর্তী।
—আপনিও পদ, আমিও পদ। ইভিনিং-এর দিকে বাড়ি থাকেন তো?
—আসতে-আসতে রাত হয়। প্রাইভেট চাকরি তো…।
—সানডে?
—হ্যাঁ। রবিবারে থাকি।
—তাহলে দরকারে এট্টু যাব। ইঁদুর বাড়ির কোন ফ্লোর?
—একতলায়।