ভারী বুকে হঠাৎ তাজা শ্বাস

ভারী বুকে হঠাৎ তাজা শ্বাস

লাইন সুপারভাইজার মন্টু সিকদারের আজ কী হলো, নাসিমা নামে চম্পার কাছাকাছি বয়সি মেয়েটার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে বেদম গজর গজর করছে। ঠোঁটকাটা বলে নাসিমার নাম-ডাক আছে, মওকা পেলে তার মুখ চলে। কিন্তু এ সময় মন্টু সিকদারের কথায় রা কাড়ছে না। কাজে তার বড় একটা ভুলচুক হয় না। আজ মনে হয় কিছু একটা হয়েছে। চম্পার মতো সেও কিছু দিন হলো ওভারলক মেশিন ধরেছে। হঠাৎ ঘাড় তুলে চম্পাকে দেখামাত্র মন্টু সিকদারের গলা তার দিকে তেড়ে এলো, ‘কী ঘটনা, দুই দিন পাত্তা নাই! শিপমেন্ট সামনে, কোন আক্কেলে এই সময় কামাই দিলা! একজন এবসেন মানে একটা মেশিন বেকামা পইড়া থাকে! প্রোডাকশন লস। তখন সব দোষ আমার উপরে। এইটা কি খিয়ালখুশির জায়গা, মন চাইলে আসলা, না অইলে না!’ চম্পা কথা বলছে না দেখে, ‘খাড়ায়া থাকবা, না ওর মেশিনে সুতা ফিট করবা’ বলে নাসিমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘এত দিন মেশিন চালায়, সুতা কাটলে হাত গুটাইয়া বইসা থাকে। আকাম্মার দল।’

মন্টু সিকদারের চোখে-মুখে রাজ্যের বিরক্তি। চম্পা কিছু না বলে নাসিমার মেশিনের কাছে যেতে নাসিমা জায়গা ছেড়ে তাকে বসতে দিল। মেশিনে হাত দিয়েই চম্পা বুঝল ভিতরে কোনো লুপে সুতা গিঁট পাকিয়ে আছে। ওভারলক মেশিনে সুতা পরানো এক ঝামেলা। একের পর এক ছিদ্র দিয়ে সুতা টেনে জায়গায় জায়গায় প্যাচ খাইয়ে শেষমেশ জোড়া সুইয়ের মাথায় ঢোকানো। মিনিট তিনেকে কাজ সেরে চম্পা উঠল।

মন্টু সিকদারের কথার জবাব দেওয়া হয়নি ভাবতে তার মনে হলো এবার লোকটা তাকে জেরা করবে কেন আসেনি। কিন্তু তাকে সে সুযোগ না দিয়ে নাসিমা মুখ খুলল, ‘আকাম্মা কন ক্যান? কুন কামডা ঠিকমতো করি না! কামে খুঁত পাইছেন কুনুদিন! কথায় কথায় গাইল পাড়েন।’ মন্টু সিকদার পাল্টা ঝামটে উঠল, ‘চোপা না, একদম না। গাইল পাড়লাম কুন সময়? সুতা ফিট করতে পারে না, আবার চোপা করে! আকাম্মা কুনখানের।’ বলে চম্পা যেমন ভেবেছিল, লোকটা তার না আসা নিয়ে ফ্যাসাদ বাধাবে, তেমন কিছু না করে তাড়া দিল, ‘জলদি বইসা পড়ো, কাম ম্যালা জমছে। তিন-চাইর ঘণ্টা ওভারটাইম করা লাগব পুরা সপ্তা।’

মন্টু সিকদারের তাড়া, আশপাশে লাইনের পর লাইনে সার সার মেশিনের ঘ্যাসর ঘ্যাসর, মেশিনের ওপর মেয়েদের ঝোঁকানো ঘাড়-মাথা, নিচতলায় জেনারেটরের টানা গজরানো—চম্পা যেন এক বিপাকে পড়ল; রোজ রোজ এই পরিবেশে সকাল-সন্ধ্যা কাটালেও এ সময় সে খেই পাচ্ছে না। তার তো তিনতলার এই প্রোডাকশন ফ্লোরে আসার কথা ছিল না। ক্যাশ ডিপার্টমেন্ট দোতলায়, ওখানে সুধীরবাবুকে পায়নি বলে তিনতলায় উঠে এই বিপাকে। লাঞ্চ ব্রেকের আগে সুধীরবাবুকে পাওয়া যাবে না। কী করবে! নিচে এতক্ষণে গেট বন্ধ। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে মন্টু সিকদার চিল্লাপাল্লা জুড়ে দেবে। তার চেয়ে বরং লাঞ্চ পর্যন্ত মেশিনে বসে কাটানোই ভালো।

না জানিয়ে চলে যাবে ভাবতে চম্পার অস্থির অস্থির লাগছে। বিশেষ করে আজ এখানে এসে যখন ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। এভাবে চলে যাওয়া খুবই খারাপ, বিশেষ করে যেখানে নতুন মেশিনে বসানোর আগে তাকে ট্রেনিং পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী করা!

সামনে থেকে মন্টু সিকদার সরে যেতেই এপাশ ওপাশ থেকে চম্পার চেয়ে খানিকটা ছোট আসমা আর বীথি খিক করে হাসল। আসমা বলল, ‘তুমি দুই দিন নাই, ছাগলা মিয়া বহুত দিগদারি করছে। খালি চোটপাট। কী অইছিল, শরীল খারাপ?’ চম্পা মাথা নাড়ল।

মন্টু সিকদার ঠিকই বলেছে, প্রচুর কাজ। সধারণত বছরের শেষদিকে কাজ বাড়ে। নতুন মৌসুমের জন্য নতুন ডিজাইনের জামা-কাপড়ের অর্ডার বছর শেষ হওয়ার আগেই আসে আর কাজগুলো সময়মতো শেষ করতে চাপ বাড়ে। এবার কি বছরের মাঝামাঝিই কাজ বাড়তে শুরু করল? ফ্যাক্টরি যেহেতু বড় না, সব কাজ নিজেরা না করে বাইরে থেকে করানোর নিয়ম রয়েছে। ইদানীং সে নিয়মে নানা কড়াকড়ি, যেনতেন ফ্যাক্টরি থেকে কাজ তুলে আনলে হবে না। বিদেশ থেকে যেসব বড় বড় কোম্পানি সারা বছর জাহাজবোঝাই কাপড় কেনে তারা এখন কাজ কেমন হলো সেটাই না, কোথা থেকে কাজ করানো হলো তাও দেখে। ফ্যাক্টরির ভিতরে কাজের পরিবেশ কেমন, দুর্ঘটনা ঘটলে, বিশেষ করে আগুন লাগলে কী ব্যবস্থা, প্রোডাকশন ফ্লোরে লাইন সুপারভাইজারদের ব্যবহার কেমন, এমনকি বাথরুম-লেট্রিনের কী অবস্থা—এসবের হিসাব-নিকাশ করেই নাকি অর্ডার দেয়। এ ফ্যাক্টরি সেদিক দিয়ে অনেক ভালো। গত কয়েক বছরে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে কেবল কাজের পরিবেশ ভালো নয় বলে। বিদেশিরা নিজেরা এসে কোন ফ্যাক্টরির কী অবস্থা দেখেশুনে কী কী করা লাগবে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছে। যারা সেসব করতে পেরেছে তারাই টিকে আছে। এই ফ্যাক্টরিতে অবশ্য বেশি কিছু করতে হয়নি, দোতলা থেকে বয়লারটা নিচতলায় সরাতে হয়েছে আর পেছন দিকে একটা চওড়া সিঁড়ি কাটতে হয়েছে।

মেশিনে বসে চম্পার খেয়াল নেই কখন কাজে ডুবে গেছে। না ডুবে উপায়ও নাই, কাজ জমতে থাকবে, যতক্ষণ না শেষ করে সামনে থেকে সরাতে পারছে, ততক্ষণ অশান্তি। আজ অবশ্য ব্যাপারটা অন্যরকম। কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে এদিকে-ওদিকে চোখ চলে যাচ্ছে। যেন ফ্লোরজুড়ে এত মানুষ, তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, গায়ের গন্ধ, ঝলমলে আলো, এমনকি নানা জাতের মেশিনের, ফ্যানের টানা একঘেয়ে আওয়াজ সবই এক জোট হয়ে তাকে আনমনা করে দিচ্ছে। তবে এসবের মধ্যে যখনি মনে পড়ছে জবাকে বস্তির ঘরে না, আম্মার কাছে রেখে এসেছে, বুকের ভিতর একটা শান্তি-শান্তি হাওয়া টের পাচ্ছে। কাজটা আরও আগেই করা উচিত ছিল, তা হলে হয়তো জবার পড়াশোনাটাও চালু থাকত, আর আম্মার কাছে থাকা মানে যে দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় থাকা এ কথাটা কেন আগে মাথায় ঢোকেনি? আগারগাঁও বস্তিতে থাকার সময় জবার পড়াশোনার টান দেখে তার কষ্ট হতো। জানত, কদিনই-বা টিকবে বই-খাতার মায়া! হয়েওছিল তাই।

ক্যাশের সুধীরবাবু কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে তাকে দেখে মাথা ঝাঁকালেন। পানভরতি মুখ সামলাতে নিচের ঠোঁট দিয়ে খয়ের-জর্দায় উপচানো পিকে ঠেকনা দিতে দিতে বললেন, ‘বুজছি, ট্যাকা-পয়সার আর দরকার নাই, পাক্কা দুই দিন বাদে আমারে মনে পড়ল, না কি গো?’

চম্পা বলল, ‘অসুখ করছিল।’

‘আমি মনে করলাম বেতনের টাকা এইবার আমারে দিয়া দিছো। এখন সারছে তো?’

জবাবের অপেক্ষা না করে আবার কম্পিউটারের পর্দায় চোখ ওপর-নিচ করে তার দিকে ফিরে বললেন, ‘ওভারটাইম দেখি চল্লিশ ঘণ্টা। সারা মাস ওভারটাইম করছো নাকি?’

চম্পা হিসাব রাখেনি, তবে চল্লিশ ঘণ্টা হবে ভাবেনি। সুধীরবাবু ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে গুনতে শুরু করলে টাকার গায়ে তার আঙুলের চটপটে নড়াচড়া যেন চম্পাকে আবার অনমনা করে ফেলল। বেতন, ওভারটাইম মিলিয়ে প্রায় নয় হাজারের মতো। খাতায় দস্তখত করে টাকাগুলো নিতে গিয়ে টের পেল বুক ভারী ভারী লাগছে।

দুপুর পার করে চম্পা যখন দেখল সে তার মেশিনেই মাথা ঝুঁকিয়ে বসে, সে ভাবল এ ছাড়া অন্তত আজকের দিনে তার করার কিছু ছিল না। এমন কি হতে পারে, যত দিন না সে মান্তুর নজরে পড়ছে, এই মেশিনে ঝুঁকেই সকাল-সন্ধ্যা পার করবে! হঠাৎ সে আশ্চর্য কথা ভাবল–হোক না আগে মান্তুর সঙ্গে দেখা।

ভাবামাত্র সে চমকে উঠল। গতকাল সারাদিন গেল, রাতে শুয়ে ভেবে ভেবে কূলকিনারা পেল না, এমনকি আজ এখানে আসার পরও মনটা উড়ুউড়ু, একবারও এমন চিন্তা মাথায় আসেনি। এখন যে হুট করে ভেবে বসল, এ কি এতগুলো টাকার মায়ায়, না কি জবাকে আম্মার কাছে রেখে আসায় মনে জোর পাচ্ছে, তাই? চম্পা এসব নিয়ে আর ভাবাভাবিতে গেল না। তবে চমকে যে উঠল, আচমকা শরীর কাঁপিয়ে শিউরানি যে জাগল, এ যেন সহজে বিদায় হওয়ার নয়। চম্পা পরিষ্কার টের পাচ্ছে শিউরানিটা আছে, নড়েচড়ে উঠছে শরীরের খুব ভিতর থেকে। নিজের মধ্যে এই পরিবর্তনটা কোথা থেকে এলো ভাবতে ভাবতে চম্পা দ্বিতীয় দফায় নতুন করে চমকাল।

সুই-সুতার ক্যাথার্সিস

চম্পার কথায় নরম হব না আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ওকে তাই কোনো সুযোগই দিইনি। আমার এক কথা—পালাবে কেন? পালিয়ে যাবে কোথায়? ওর মা শেফালির পালানো আর ওর পালানো এক হতে পারে না। শেফালিকে যতই ওর পালানো নিয়ে গালমন্দ করি, এত দিন পর আমার মনে হচ্ছে, না পালিয়ে ওর উপায় ছিল না। ওর মতো হাজার হাজার মেয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। অনেকে পালিয়েছে, পরিচয় গোপন করে টিকে থাকতে চেষ্টা করেছে, পেরেছেও নিশ্চয় অনেকে। শেফালি পারেনি। ওর বীরাঙ্গনা পরিচয় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়াই এর কারণ। না জেনে না বুঝে শেফালি এত মার্কামারা হয়ে গিয়েছিল, পরিচয় লুকিয়েও টিকতে পারেনি, লোকজনের চোখে ধরা পড়ে যেত। শুধু চেহারা দেখে না, নাম ধরেও তাকে চিনে ফেলার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।

লেখক-ফটোগ্রাফার জাফর সাদেক যখন কাজটা করেছিল, সে নিশ্চয় কল্পনাও করেনি কী হতে পারে এর পরিণাম। জাফর সাদেকের সঙ্গে দেখা নাই বহু বছর। কোথায় আছে কে জানে! দেশে নিশ্চয় না। তবে এখন যদি সে শোনে শেফালির ছবি তুলে, ওর কথাবার্তা ভিডিও করে শুধু ওর জীবনটাই সে ছারখার করেনি, তার মেয়ে চম্পাও মায়ের দুর্ভোগের কাঁটা কপালে বিধিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তা হলে তার কৃতকর্মের জ্বালাটা তাকে কিছুটা হলেও পোড়াত। তবে এ কথাও ঠিক অনেক বছর আগে শেফালিকে নিয়ে সে যা করেছিল তাতে ঠিক অসততা ছিল না, যদিও আমি তাকে নানাভাবে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলাম। ইস্কাটনে কেন্দ্র চালু হওয়ার কয়েক মাস পরেই সে আমার পিছু নিয়েছিল মেয়েদের সঙ্গে যেন তার কথা বলার সুযোগ করে দিই। সে বড় রিপোর্ট করবে, দেশ-বিদেশের কাগজে ছাপাবে, ডকুমেন্টারি বানাবে। আমি সাড়া দিইনি। আমরা যতটা সম্ভব নীরবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সাংবাদিক ডেকে মেয়েদের মুখোমুখি বসাব এমন চিন্তা ঘুণাক্ষরেও আমাদের কারো মাথায় ঠাঁই পায়নি। জাফর সাদেক কথাবার্তায় চৌকস, চিন্তাভাবনায় আক্রমণাত্মক। মুক্তিযুদ্ধ, বিশেষ করে নির্যাতিত মেয়েদের বিচারের দাবিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওয়ার ট্রাইব্যুনালে দাঁড় করাতে সে তখন পত্রপত্রিকায় লিখছে, এমনকি একটা ক্যাম্পেইন গড়ে তোলারও চেষ্টা করছে। তাকে এক কথায় না বলা কঠিন, তাই চেষ্টা করেছি বুঝিয়ে-সুজিয়ে যদি হটানো যায়। বিষয়টা যে নাজুক এ নিয়ে সে তর্ক করেনি, তবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটা কথাই বলত—স্বাধীন দেশে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনাকে পাথরচাপা দিয়ে রাখা অন্যায়। এক পর্যায়ে যখন মনে হয়েছে সে নাছোড়, তাকে সাফ না বলা ছাড়া পথ ছিল না। তবে আমার যেটুকু সাধ্য ছিল তাতে কেন্দ্রে থাকাকালীন শেফালি বা অন্য কোনো মেয়ের কাছ ঘেঁষার সুযোগ সে পায়নি।

পরে যা হওয়ার কথা ছিল না তা-ই হয়েছে। মুভি ক্যামেরার মুখোমুখি কড়া চোখধাঁধানো আলোয় দিশেহারা শেফালির মাথায় কী রোখ চেপেছিল সে আড়াল-আবরুহীন কথা বলেছে। আলো ঠিকরানো তার মুখ, ডান ভুরুর ওপর ঘোর বাদামি জড়ুল আর দীর্ঘদিন টুটিচাপা কথা ও দীর্ঘশ্বাসের গুঞ্জরণে কুঞ্চিত, তীব্র চাউনি—মানুষ কী করে ভোলে সে মুখ! আর নামটাও যে শেফালি, শিশিরভেজা রত্তি-রত্তি ফুলের ঘ্রাণও যেন জেগে ওঠে নামের টানে।

জাফর সাদেকের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। শেফালির ভাগ্যে ছিল সে অগুনতি নির্যাতিত মেয়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠবে।

হাসপাতাল থেকে শেফালিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার পর আমার শুরু হয়েছিল অন্য যুদ্ধ। ওর সম্বন্ধে তখনো কিছু জানা ছিল না। নাম পর্যন্ত না। বাড়ি কোথায়, বিয়ে হয়েছিল কি না, বাবার কী নাম—হাজার চেষ্টাতেও এসবের জবাব মেলেনি। অনেক দিন লেগেছিল তার ব্যাপারে জানতে। অন্য মেয়েরা যারা ছিল তাদের সঙ্গে কিছু কিছু বিষয়ে কথাবার্তা বলা যেত। শেফালির মতো আরেকজন ছিল—ওরই বয়সি, উনিশ-বিশের মধ্যে বয়স, নাম মালতী যার কথা আগে বলেছি। মালতীও কথা বলত না, কেউ কাছে ঘেঁষুক একদম পছন্দ করত না। সে যে কামরায় থাকত সেখানে প্রায় সারাক্ষণ কোণের দিকে কম আলোয় একটা জায়গা বেছে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে নিথর বসে থাকত। ডাক্তারি পরীক্ষায় তার শরীরে কোনো অসুবিধা পাওয়া যায়নি। তবে তাকে নিয়ে ভয় ছিল, যতটা সম্ভব পাহারায় রাখা হতো। কিছু দিনের মধ্যে মালতীর ব্যাপারে খবর পাওয়া গিয়েছিল। ওকে আনা হয়েছিল মানিকগঞ্জ থেকে। বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাদের গ্রামের বাজারে আগুন দিয়ে হিন্দু খুঁজতে ওদের বাড়িতে ঢুকে বাবা-মা-ভাইদেরসহ পাঁচজনকে উঠানে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল। ঘরের ভিতরে মালতী অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, ওই অবস্থায়ই সৈন্যরা তাকে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পে। মালতীর খোঁজে এসেছিল ওর এক জ্ঞাতি কাকা। সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে সে হ্যাঁ-না কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, আর তখনকার মতো চলেও গিয়েছিল। তবে ফিরে এসেছিল মাসখানেক পর।

শেফালির খোঁজে অনেক দিন কেউ আসেনি। আসলে চুপিচুপি এসেছিল, আমাদের জানা ছিল না। তখনকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার নবীনগর থানার শ্যামপুর থেকে ওর বাবা শেফালির খোঁজে পুনর্বাসনকেন্দ্রে এসেও মেয়ের সামনাসামনি হতে সাহস পায়নি। শুধু জানতে পেরেছিল মেয়ে কেন্দ্রের হেফাজতে রয়েছে।

কথাবার্তা না বললেও শেফালি প্রায় সময়ই স্থির চোখে আমাকে দেখত। আমি যে তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি এ তো তার না বোঝার কথা নয়, তবে আমি নিজে যা বুঝতে পারতাম না—আমার মুখে তাকিয়ে সে কতটা নির্ভরতা পাচ্ছে, আদৌ কি পাচ্ছে? কোনো দিন জানতে চাইতাম কী দেখে, মুখে তার কোনো অভিব্যক্তির আভাস না পেয়ে হতাশ লাগত। এক বিকালে ওর পাশে বসে আছি, মনে হলো ওকে কিছু একটা করতে বলি। চিকন দাঁড়ের ছেলেদের একটা চিরুনি দিয়ে বললাম ঘন ঘন চুল আচড়াতে, এতে চুল বাড়বে। কথার কথা ছাড়া কী! কদমছাঁট চুলে নাঙ্গা মাথাটা ততদিনে চোখে সয়ে এলেও হঠাৎ হঠাৎ বিদঘুটে লাগত বলে একটা ওড়না দিয়েছিলাম মাথা ঢাকার জন্য। মাথা ঢাকাঢাকিতে তার গরজ দেখিনি, আমি নিজে ঢেকে না দিলে প্রায় সময়ই দেখতাম নারকেল খোলের মতো এইটুকু মাথাটা ঘাড়ের ওপর লটপট করছে। তো সেদিন চিরুনি হাতে গুঁজে দিতে আলগোছে মুখ খুলল। বলল নাম শেফালি। নামটা আগে অনেকবার জানতে চেয়ে জবাব পাইনি বলে সে যেন আমাকে দয়া করল। আরও কিছু বলবে ভেবে ওর মুখে তাকিয়ে মনে হলো না বাড়তি আর কিছু বলার আছে। যেন নামটাই যথেষ্ট, জানানোর মতো এর বেশি কিছু নাই। এও মনে হলো, নামটা যে বলল তা আমার সুবিধার জন্য, যাতে তাকে অন্তত নাম ধরে ডাকার সুবিধাটুকু পাই।

কথাবার্তা না এগোলেও সেই থেকে ওর সঙ্গে একটা নীরব যোগাযোগ গড়ে ওঠার লক্ষণ টের পেলাম। আমার মুখে তাকানোর ভঙ্গিতেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করতে লাগলাম। একদিন ঘাড়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম এভাবে চুপচাপ বসে না থেকে এঘরে ওঘরে যেন হাঁটাহাঁটি করে, অন্য মেয়েদের কাছে গিয়ে বসে, ওরাও তো ওরই মতো, সামনের খোলা বারান্দায় গেলেও পারে, রাস্তাঘাট, মানুষজন দেখলে ভালো লাগবে। শেফালি তখন দ্বিতীয়বারের মতো মুখ খুলল। শুনে অবাক হলাম, পুরনো কাপড় আর সুই-সুতা চাচ্ছে। সম্ভবত সেদিনই তাকে ঘর থেকে কয়েক টুকরা কাপড়সহ সুই-সুতা এনে দিয়েছিলাম। শেফালি মাথা ঝুঁকিয়ে খুবই অভ্যস্ত কায়দায় জিভে সুতা ঠেকিয়ে সুইয়ে সুতা পরিয়েছিল, তারপর হাতখানেক লম্বা কাপড়ের একটা টুকরা কোলে বিছিয়ে আস্তে-ধীরে দুই-তিনটা ভাঁজ করে এক মাথায় সুই বিঁধিয়ে একটা বড় ফোঁড় তুলতে তুলতে মুখটা কোলের ওপর আরও ঝুলিয়ে দিয়েছিল।

ভঙ্গিটা আমাকে ভীষণ চমকে দিয়েছিল, মনে হয়েছিল এই কি ওর কথা বলার ভাষা—নীরবে, প্রায় সংগোপনে বুক নিংড়ানো চাপা নিঃশ্বাসের মতো গাঢ়-গভীর ফোঁড় তোলা! এ ভাষা তো আমার জানা নাই। শেফালি ঝুঁকে পড়া মুখ, তার আঙুলের মৃদু-মন্থর ওঠা-নামা, একের পর এক ঢেউয়ের মতো সুইয়ের নুয়ে পড়া ও অব্যক্ত যন্ত্রণায় মাথাচাড়া দিয়ে জেগে ওঠা দেখে নিজের অসহায়ত্বই আমাকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিল। কী করে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হবে! ভাষাহীন হয়েও ও কী তীব্র ভাষাময়! আমি কী করব!

শেফালিই আমাকে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কয়েক দিন যেতে একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেছিল। নিজে থেকে বলত কম, কিছু জানতে চাইলে জবাব দিত আর বলার সময় মাথাটা আপনাআপনি নুয়ে পড়ত। আমি বলতাম, ‘মুখ তোলো, কথা বলার সময় চোখে চোখে তাকাতে হয়,

এমনিতে তো আমাকে দেখো, কী আছে আমার মুখে যে দেখো! কিন্তু কথা বলতে মুখ লুকাও কেন? এত সুন্দর মুখ তোমার!’ ওর চোখে-মুখে তখন রুক্ষতা দূর হয়ে এক অস্ফুট লাবণ্য একটু একটু করে চেহারাটাকে বদলে দিতে শুরু করেছে। মাথায় চুল বড় হচ্ছিল, যে জন্য মাথাটা আগের মতো ছোট লাগত না, আর বাড়ন্ত চুলের কারণেই যেন ওর প্রায়-ফরসা মুখে আলোময় দুটো চোখ দিনে দিনে ফুটে উঠছিল । ঘোর-কালো ভুরু ও ঘন পাপড়িতে মুখজুড়ে মনে হতো শুধুই চোখ–ঢুলুঢুলু, ঠান্ডা, আবার হঠাৎ হঠাৎ চকিত তরঙ্গবাহী। এক সময় শখ করে ছবি আঁকতাম, ল্যান্ডস্কেপ দিয়ে শুরু করলেও মানুষের মুখই আমাকে বেশি টানত। ছেড়ে দিয়েছিলাম অনেক দিন, তবু শেফালির মুখ আমাকে ঘোরে ফেলত, ইচ্ছা করত ওর সুন্দর চোখ বসানো মুখটা পেনসিল ঘষে কাগজে তুলি। কিন্তু তা হলে ওর সামনে বসে আনত মুখটাকে বারবার আমার দিকে তুলে ধরতে গিয়ে নিজের বিপন্নতাই হয়তো আমাকে ভোগাত।

শেফালির ধারণা ছিল গার্লস গাইডের আমরা যারা পুনর্বাসনকেন্দ্রে রয়েছি তারা সরকারি লোক। যখন বললাম আমরা ওর মতো মেয়েদের টানেই এসেছি, সে খুব অবাক চোখে তাকিয়ে অপেক্ষায় ছিল আর কী বলি। বললাম আমরা কেন্দ্রের মেয়েদের ভালোবাসি, ওদের টানেই ওদের সঙ্গে থাকি, আরও থাকব যতদিন মেয়েদের দরকার হবে। এও বললাম ওর জন্য আমার টানের চেয়ে মায়া বেশি। শেফালি কতকক্ষণ মুখ নামিয়ে কী ভেবে বলল আমাকে বুবু না আপা ডাকবে, আমি চাইলে অন্য কিছুও ডাকতে পারে। বললাম ওর মন যা চায়। শেফালি তখন কিছু বলেনি, হয়তো ভাবছিল কোন ডাকটা আমার মায়ার প্রতিদান হিসাবে জুতসই হতে পারে। আমি হেসেছিলাম, হেসে ওর মুখটা দুই হাতে গোল করে ধরে কাছে টেনে ডান ভুরুর জড়লে আঙুল ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওটা কি জন্ম থেকেই? কথা শুনে শেফালি সেই প্রথম স্বেচ্ছায় আমার বুকে ওর মুখ রেখে জোরে ঠেসে ধরেছিল। অনেকক্ষণ পরে বলেছিল জঙুলটা নাকি আগে খুবই ছোট ছিল, ভুরুতে ঢাকা পড়ে জড়ুল বলে বোঝা যেত না, ক্যাম্পে ভিমরুলের হুলে ফেটে গিয়ে দিনে দিনে বড় হয়েছে।

কাপড়ের টুকরা ভাঁজ করে অনবরত সুইয়ের ফোঁড় তোলাই হয়ে উঠেছিল শেফালির একমাত্র বিনোদন। কখনো মনে হতো সে মন দিয়ে সেলাইয়ে ব্যস্ত, কখনো দেখতাম অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সুই ধরা আঙুলের ডগা যন্ত্রচালিতের মতো উঠছে-নামছে। ছোট ছোট কাপড়ের টুকরা, ভাঁজ করায় আরও ছোট, আর আঁকাবাঁকা, কখনো সোজা টানটান রেখার মতো সুতার গাঁথুনিতে সেগুলোকে মনে হতো পুতুলের কাঁথা। সে কি তার পেটের বাচ্চার কথা মনে করেই কাঁথাগুলো সেলাই করছে—এত এত কাঁথা! মুখে সে কথা বলতে পারতাম না, জানতেও চাইতাম না ছোট ছোট কাঁথা দিয়ে কী হবে?

শেফালির শরীরে গর্ভধারণের নানা লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। বসা অবস্থায় পরিষ্কার বোঝা যেত বুক থেকে খানিকটা বাদে পেটটা পেটের সীমানা ছাড়িয়ে বাড়ছে। কেন্দ্রে তখন ষোলো-সতেরোজন মেয়ের মধ্যে ছয়-সাতজনের একই অবস্থা। তার মধ্যে মমতা নামে একজন ছিল, পঁচিশের মতো বয়স, সম্ভবত নেত্রকোনা থেকে আনা হয়েছিল। বাড়িতে তার স্বামী, দুই সন্তান। মমতার প্রসবের সময় তখন দ্রুত ঘনাচ্ছে। কেন্দ্রে আসা মেয়েদের মধ্যে মমতাই সবার আগে সন্তান জন্ম দেয়। কাজটা মোটেও নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। একে তো মমতা চেঁচামেচি করত, ফোলা পেটে কিল-ঘুষিও মারত, আর ডাক্তার-নার্স কাউকে সামনে পেলে চিৎকার জুড়ত, ‘এইটারে পেট ফাইড়া মাইরা থোন, আমারে এই আজাব থাইকা বাঁচান।’ সমাজসেবা দপ্তর থেকে ডাক্তার ফারহানা নামে একজন বয়স্ক সাইকিয়াট্রিস্টকে পাঠানো হয়েছিল গর্ভবতী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে। মহিলা গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন। তবে গৎবাঁধা কথা দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন ছিল। তিনি মেয়েদের বোঝাতে চেষ্টা করতেন তাদের যেমন বেঁচে থাকা জরুরি, তেমনি তাদের পেটের বাচ্চাদেরও—বাচ্চাদের কী দোষ, ওরা তো ফেরেশতা, ফেরেশতারাই বাচ্চা হয়ে তাদের পেটে এসেছে, জন্মানোর পর এরাই তাদের মা ডাকবে। কে শোনে কার কথা! মনে আছে মমতা একদিন তার মুখে জর্দার কৌটা ছুড়ে মেরে চিৎকার করে বলেছিল, ‘আপনেরে কুন ইবলিশে পাঠাইছে, আজাইরা প্যাচাল পাড়েন, পারলে আমারটা অহন খালাস করেন।’

মমতার প্রসবের ব্যবস্থা কোথায় করা হবে এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা ছিল। সে সময় সমাজসেবা দপ্তর একটা বড় কাজ করেছিল। হলি ফ্যামিলি ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছিল যেখানে প্রসবকালীন সময়ে কেন্দ্রের মেয়েরা থাকবে। মমতাকে পাঠানো হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যালে। আশ্চর্য ব্যাপার কিল-ঘুষি খেয়েও একটা সুস্থ-সুন্দর ছেলে হয়েছিল তার। তবে বাচ্চা দেখার পর মমতা কী করে এ নিয়ে ভয় ছিল। কিন্তু ছেলের কান্না শুনে মুখে দুধ দিতে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ঘটনা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম, আর এও ভেবেছিলাম বাচ্চা পেয়ে অন্য মেয়েরাও হয়তো মমতার মতো শান্ত হয়ে যাবে।

এক মমতাকে দেখে এমন ধারণা করা ছিল বোকামি। বাস্তবে বেশিরভাগ মেয়ে বাচ্চা হওয়ার পর অশান্ত হয়ে উঠত। বাচ্চার কান্না শুনে কানে হাত চাপাত, কেউ কেউ কেড়ে নিতে চাইত যেন তখনি আছড়ে মারবে, আবার এমন মেয়ে ও ছিল, মুখে কিছু না বললেও বাচ্চাকে কোলে নেওয়া বা দুধ দেওয়ার কথা বললে ঘেন্নায় নাক-মুখ বিকৃত করে ফেলত।

এমন সময় একদিন শেফালির বাবা-মা এসে হাজির। শেফালির বাবার মুখে শুনলাম মেয়ের খোঁজ করতে আগে একবার কেন্দ্রে এসেও কারো সঙ্গে দেখা না করে পালিয়ে গিয়েছিল। বলল সাহস পায়নি দেখা করতে, এমনকি মেয়ের সামনে যেতেও। শেফালির কাছে নিয়ে যেতে দুজন কান্নাকাটি করল কিছুক্ষণ, বোঝা যাচ্ছিল মেয়ের দিকে তারা তাকাতে পারছে না। শেফালি কিন্তু নিজেকে ধরে রাখল, তবে তাদের চমকে দিয়ে জানতে চাইল তারা কি তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছে? দুজনের তখন মহাসংকট, এ ওর দিকে তাকাচ্ছে—যেন ভাবছে এমন অদ্ভুত কথা শেফালি তাদের বলতে পারল!

শেফালিকে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের এক পরিত্যক্ত স্কুল ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, এর বেশি আমাদের জানা ছিল না। কয়েক মাস হয়ে গেলে ও সেখানে সে কিভাবে গেল, মিলিটারিরা তাকে পেয়েছিল কোথায় এসব নিয়ে শেফালিকে ঘাঁটাতে যাইনি, সেও কিছু বলেনি। শেফালির বাবার কাছে শুনলাম নবীনগর থানায় তাদের গ্রামে তারা মোটামুটি নিরাপদে ছিল, আশপাশে কসবা বা শ্রীরামপুরে মিলিটারির আনাগোনা থাকলেও শ্যামপুরে, যে গ্রামে তাদের বাড়ি, বিপদ-আপদের আঁচ সেখানে তেমন পায়নি। আগস্ট মাসের শেষ দিকে হঠাৎ পরিস্থিতি বদলে গেল। গ্রামে মুক্তিরা আস্তানা গেড়েছে এমন খবরে রাজকাররা মিলিটারিদের পথ দেখিয়ে এনে বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি শুরু করল। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে সরে পড়ল। ঘরে যুবতী মেয়ে, তার ওপর বাড়িতে তখন তার বোনের পরিবারও ছিল। এতজন নিয়ে কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে মেরাজ আলী ফকির, শেফালির বাবা, বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। তবে গুলি ছুড়তে ছুড়তে গ্রামে ঢুকতে থাকা মিলিটারিদের আওয়াজ পেয়ে সে ভুল করে ফেলেছিল। বলল, ভয়ে মাথা ঠিক ছিল না। গোলাগুলির আওয়াজ কাছাকাছি হতে সে সবাইকে নিয়ে বাড়ির অদূরে ধানখেতে নেমে পড়েছিল। তখন ঘোর বর্ষা, বৃষ্টি হতো প্রায় প্রতিদিন, খেতে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও বেশি।

খেতে নামার পর কে কোন দিকে গেছে তার খেয়াল ছিল না। মনে হচ্ছিল সবাই এক সাথে রয়েছে। আসলে শেফালি বাদে বাকিরা এক সাথেই ছিল। শেফালি হয়তো পানি দেখে খেতে নামেইনি, খেতের আইল ধরে ছুটে ছুটে কোথায় চলে গিয়েছিল মেরাজ ফকির জানতে পারেনি। মিলিটারি চলে যাওয়ার পর সারা গ্রাম তন্নতন্ন খুঁজেও যখন শেফালির হদিস মিলল না, তখন খবর পেল গ্রামের পশ্চিমে মাথাভাঙা কালী মন্দিরের পেছন থেকে রাজাকার তৈমুর তাকে ধরে নিয়ে গেছে। ছুটতে ছুটতে প্রায় মাইলখানেক পথ সে কী করে গিয়েছেল সে রহস্য ভেদ করতে না পারলেও শেফালি যে নেই বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না।

হা-হুতাশে কয়েক দিন যেতে আরও খবর মিলেছিল— শেফালিকে মিলিটারিদের তেরপলমোড়া গাড়িতে তুলতে দেখেছে বাজারে দোকানপাটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কেউ কেউ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে অনেক মেয়ের আটক থাকার খবর পাওয়া গিয়েছিল। মেরাজ ফকির ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু শেফালির ব্যাপারে কিছু জানতে পারেনি। পরে লোকমুখে শুনেছিল ময়নামতি থেকে কয়েকজন মেয়েকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় কোথায় বের করতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। পরে ইস্কাটনে পুনর্বাসনকেন্দ্রে এসে শেফালির ব্যাপারে নিশ্চিত হলেও তার সাহসে কুলায়নি মেয়ের সামনে যায়। শেফালি বেঁচে আছে এ খবরই ছিল বড়।

বাবা-মা তাকে বাড়ি নিতে এসেছে কি না, এ নিশ্চয় শেফালির কথার কথা ছিল; জবাবের অপেক্ষা সে করেনি, দ্বিতীয়বার এ নিয়ে কথাও বলেনি। তবে বাবা-মা তার মনোভাব ধরতে পারেনি, তারা কী বলবে বুঝতে না পেরে এক দৃষ্টিতে মেঝেতে চোখ গেঁথে বসেছিল। পরে আমি যা বলার বলেছিলাম। শেফালি আমাদের কাছে থাকবে, তবে ওরা যেন মাঝে মাঝে আসে, আর শেফালি কোথায় আছে সে খবর যেন চেপে থাকে।

কেন্দ্রে আমার দিন কাটছিল নানা ব্যস্ততায়। মমতা সে সময় তার ছেলেকে নিয়ে মহাব্যস্ত। প্রথম দিকে আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলেও কিছু দিন যেতে মনে হলো মমতা নিজের সাথে বোঝাপড়া করেই ছেলের দেখাশোনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। মমতার পর আরও কয়েকজনকে আমরা হাসপাতালে পাঠালাম— হলি ফ্যামিলিতে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এত সাবধানতার পরও একটা ঘটনা ঠেকানো যায়নি। রুবিনা নামের শান্ত ধরনের অল্প বয়সি মেয়ে এমন কাণ্ড ঘটাবে কারো মাথায় আসেনি। প্রসবের পর বাচ্চাকে কোলে নিতে সে যে আপত্তি করেছিল তা না, তবে কোলে নিয়ে দুধ দেওয়ার নাম করে বাচ্চার গলা চেপে বীভৎস কাণ্ড ঘটিয়েছিল। ঘটনাটা আমাদের সাংঘাতিক নাড়া দিয়েছিল, কেন্দ্রের মেয়েদের কাছে আসল ঘটনা চেপে গিয়ে বলেছিলাম রুবিনার মরা বাচ্চা হয়েছে।

আমার মনে তখন দুরুদুরু ভয়। দেখতে দেখতে শেফালির সময়ও ঘনাচ্ছিল। ওকে যে আমি অন্যদের থেকে নিজের অজান্তে আলাদা করে ফেলেছিলাম, ভয়টা সে কারণে। ততদিনে শেফালি খেলনা কাঁথা ছেড়ে বড় কাঁথা ধরেছে—সবে জন্মানো বাচ্চাদের উপযুক্ত কাঁথা। ওকে পুরনো শাড়ি বা কোরা ধুতির কাপড় এনে দেওয়া হতো, সে একমনে সেলাই নিয়ে থাকত। শেফালির সে সময়ের সেলাইরত কুঁজো ভঙ্গি আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণার জন্ম দিয়েছিল যা এত কাল পর আজও টিকে আছে—গ্রামের নিম্নবিত্ত মেয়েদের এক মনে কাপড়ে ঝুঁকে পড়ে সুই গাঁথা তাদের অনেক না বলা কষ্টের উপশম। এরই নাম ক্যাথার্সিস?

আজ কদিন ধরে কেন যে জাফর সাদেকের কথা মনে পড়ছে। কোনো পাত্তা নাই, গেল কোথায় লোকটা!

ইট ওয়াজ ওয়ার, ইউ রেপ দ্য উইমেন

সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের বরাত দিয়ে লন্ডনের ডেইলি মেইল পাকিস্তানি আর্মি অফিসারের সাক্ষাৎকারের যে ছোট উদ্ধৃতি ছেপেছে তা সেদিন সন্ধ্যায় ট্রেনে ফেরার পথে চোখে না পড়লে জাফর সাদেকের জীবনের পরের কয়েক বছর হয়তো অন্য খাতে বইত। এসেক্স থেকে সেন্ট্রাল লাইন ধরে শেফার্ডস বুশ আসার পথে ট্রেনের সিটে কারো ফেলে যাওয়া প্রায় দুমড়ানো পত্রিকার দুই পাতা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ছোট বক্স নিউজে দৃষ্টি আটকে যেতে জাফর সাদেক এতটাই চমকে উঠেছিলেন, মনে হয়েছিল তার জন্যই পত্রিকাটা কেউ ফেলে গেছে।

দেশের খবর লন্ডনে বসে যা পাচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল ব্রিটিশ মিডিয়া দ্রুত বদলে যাওয়া প্রাক্তন কলোনির ব্যাপারে মনোযোগী হতে গিয়ে নস্টালজিয়া এড়াতে পারছে না। পুরনো কলোনির দুই টুকরো ভেঙে তিনটা দেশ হয়েছে, তাতে প্রায় প্রতিদিনই নতুন খবর যেমন গজাচ্ছিল, তেমনি পুরনো আমলের নানা ঘটনারও ঢেঁকুর উঠছিল। কয়েক দিন আগে গার্ডিয়ানে র‍্যাডক্লিফ লাইন টানা যে মহামূর্খতা ছিল—তাও ভূগোল না জানা, ম্যাপ পড়তে না পারা এক লোককে দিয়ে—এ নিয়ে বড়সড় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া সাতচল্লিশে ধর্মভিত্তিক দেশ ভাগাভাগি যে হঠকারিতা ছাড়া কিছু ছিল না, চাইলে মাউন্টব্যাটেন ঠেকাতে পারতেন, এমন কিচ্ছাকাহিনি ফেঁদেও অনেকে সুখ পাচ্ছে। দেশের যুদ্ধের খবর ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকা বা বিবিসি ভালোই কভার করেছে, আর শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনকে ট্রানজিট বানানোয় নস্টালজিয়া আরও চাগাড় দিয়ে উঠেছিল। অনেকের ধারণা বন্দিদশা থেকে সদ্যস্বাধীন দেশে ফেরার আগে বাইরের দুনিয়ায় কে কী ভাবছে তার হালহকিকত বুঝতেই লন্ডনে যাত্রাবিরতি। প্রেস মিটিংয়ে প্রশ্ন-টশ্ন করার চেয়ে তাঁর ব্যাপারে সাংবাদিকদের কৌতূহলই বেশি ধরা পড়েছে। তাঁর স্ট্যানওয়েল আর্মি মাউন্ট পাইপ, এরিনমোর টোব্যাকো, এমনকি অলমোস্ট হ্যান্ডসাম চেহারার প্রসঙ্গও সুযোগ বুঝে নিউজ স্টোরিতে ঢুকে পড়েছে।

প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ নিয়ে খবরাখবর ছাপা হচ্ছিল। রিফিউজিরা দেশে ফিরছে, নানা জায়গায় গণকবরের খোঁজ মিলছে, রেডক্রস রিলিফ বিলিয়ে কূল পাচ্ছে না, ভারতীয় সেনাবাহিনী জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি ওয়ার প্রিজনারের নিরাপত্তা দিতে পেরেছে; এসবের পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী স্টেনগান-পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে, খাবার নেই, ওষুধপত্র নেই, দুর্ভিক্ষ হলে অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাবে—খবরের শেষ নেই। কিন্তু এটা কী?

It was war! You rape the women!

Sydney, March 12 (AP)-Doctor Geoffry Davis, a recent medical school graduate from Sydney, Australia visted Bangladesh as a volunteer to assist International Planned Parenthood. Geoffry went there to save women’s lives in Dacca, he also interviewed some of the perpetrators while they sat in prison. While interviewing soldiers in the Comilla prisons, he spoke frequently to Pakistani officers. They had no remorse. These men were unable to grasp the notion that they had done something wrong. When Davis reported and spoke about the international outcry after the rape camps had been discovered, the Pakistani officers asked him, ‘Why are they (Australian media ) getting so excited about it? It was war! You rape the women!’

রেপ ক্যাম্পের খবর কিছু কিছু কানে এলেও পরাজিত, বন্দি অফিসারদের কথাটা ট্রেন থেকে নামার পরও ঠাস্ ঠাস্ কানে বাজছিল। পত্রিকার পাতা দুটো হাতে করে প্ল্যাটফরমে পা দিয়ে ভেবেছিলেন ওই খবরটা ছাড়াও পত্রিকায় আরও কিছু পেলে পেতেও পারেন।

উনিশ শ বাহাত্তরের মার্চে জাফর সাদেকের বয়স তিরিশ পেরিয়েছে। কিছু দিন হলো শেফার্ডস বুশ মার্কেটের কাছে কাউন্সিলের একটা প্রায়-লজ্‌ঝড়ে বাড়িতে এসে উঠেছেন। রাস্তার দুই পাশে মলিন বাড়ির সারি, একটা থেকে অন্যটায় তফাত বড়জোর দুই-আড়াই হাত। জাফর সাদেকের থাকার জায়গা তেমনি এক বাড়ির দোতলায় ওঠার মুখে ছোট গেস্টরুমে–আসলে যা বক্সরুম। এক আফগান রেস্টুরেন্টের শেফ বাড়ির মালিক। লোকটা এক সময় কাবুলে না কান্দাহারে কিছু দিন ভেটেরিনারি স্কুলে পড়ার সুবাদে নামের আগে ডাক্তার জুড়ত—ডাক্তার বশির হামদানি। সেই বক্স-কাম-গেস্টরুমে সে রাতে আগাগোড়া পত্রিকা তন্নতন্ত্র ঘেঁটে বাংলাদেশ নিয়ে আর কোনো খবরাখবর মেলেনি। সান্ধ্য পত্রিকায় চটকদার খবরই থাকে। তবে ট্রেনে পড়া অংশটুকু যে বেডসাইড ল্যাম্পের ঝিমঝিমে আলোয় বারকয়েক পড়েছিলেন পরিষ্কার মনে আছে।

সময়টা তখন জাফর সাদেকের জন্য ঘোর দুর্যোগের। মাসখানেক হলো তাকে ফায়ার করা হয়েছে। চাকরি ছিল কমনওয়েল্থ সেক্রেটারিয়েটের পিআর সেকশনে। পনেরো দিন অন্তর একটা নিউজ লেটার বের করা মূল কাজ, সঙ্গে সহকর্মী তুখোড় ইংরেজি জানা দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে মালাকা। ছাঁটাই হতে পারেন এমন চিন্তা মাথায় না এলেও কড়া হুঁশিয়ারির একটা আশঙ্কা ছিল। এর জন্য দায়ী তিনি নিজে। কাজ-কর্মে মন বসত না, ডেস্কে জরুরি কাজ জমছিল, তাতে মালাকারও অসুবিধা হচ্ছিল, সে তার কাজ শেষ করে তার জন্য বসে থাকত। অফিসের কেউ কেউ জানত তিনি একটা ব্যাড প্যাচ পার করছেন, আইরিনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, থাকার জায়গা নেই, অফিসে এলেও সময়-টময়ের ঠিক নেই, কাজ পড়ে থাকছে। স্কটিস বস্ রয় টারনার যে তাকে কখনোই পছন্দ করত না, ঝোপ বুঝে কোপ বসিয়েছিল। তিন লাইনের টারমিনেশন লেটার হাতে ধরিয়ে বলেছিল, ‘গুড লাক এস্হোল।’

বিদায়ের সময় অভিনব উইশ। অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় টিপটিপ বৃষ্টিতে ছাতাহীন ভিজতে ভিজতে উইশটা থাপ্পড়ের মতো, ইংরেজরা যাকে বলে টাইট স্ল্যাপের মতো গালে চটচট করছিল। তবে মাসখানেক পরের সে রাতে ইট ওয়াজ ওয়ার, ইউ রেপ দ্য উইমেন নাকে-মুখে ঘুষির মতো লাগছিল। কত কাল আগের কথা!

তিন বছর এক সঙ্গে থাকার পরে হঠাৎ যে কেন আইরিনের কথায় বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন সেটা জাফর সাদেকের জীবনে বড় বিস্ময়। তার বেপরোয়া বোহেমিয়ান স্বভাবই আইরিনকে আকর্ষণ করেছিল, আর কিছু দিন মেলামেশার পরে তার মনে হয়েছিল কট্টর ইভানজেলিস্ট পরিবার থেকে এলেও আইরিন ভাবনা-চিন্তায় খোলামেলা। গৎবাঁধা জীবন, চাকরির নিরাপত্তা, সংসার, ছেলেমেয়ে এসবে তার আগ্রহ ছিল না। জাফর সাদেকের ফটোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক তাকে টানত, তার নিজেরও বেজায় আগ্রহ ছিল ফটোগ্রাফিতে। আর জাফর সাদেক তো প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হবেন বলে পরিবারের অমতে বিলেতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দেশে থাকতে বিএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, পড়াশোনায় মন ছিল না, তবু পাস করেছিলেন টেনেটুনে, একষট্টি সালে। তবে লন্ডনে এসে ফটোগ্রাফির ওপর মাস তিনেকের কোর্স করলেও কাজ জোটানো প্রায় অসম্ভব ছিল। খাওয়া- পরার দায় মেটাতে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ওয়েটারি, ট্যাক্সি চালানো, বুকস্টোরে দোকানদারি, চকোলেট ফ্যাক্টরিতে সাধারণ প্যাকার হিসাবে কুলিগিরি কিছুই বাদ যায়নি। বুকস্টোরে কাজ করার সময় আইরিনের সঙ্গে আলাপ। নরউইচের মেয়ে, পরিবার থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হবে বলে থাকত সস্তা এক কামরার ঘরে। কাজ আজ একটা ধরত তো কাল অন্যটা। আইরিনের বয়ফ্রেন্ড ছিল, কিছু দিন এক সঙ্গে থেকেওছিল, পরে আইরিনের ভাষায় ক্রিসের (বয়ফ্রেন্ডের নাম) একটা সমস্যা দেখা দেওয়ায় ঝগড়াঝাঁটি ছাড়াই তারা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আইরিন ক্রিসের ব্যাপারে দুঃখ করে বলত, ‘ওর মধ্যে একটা চাপা গে ইনস্টিংক্ট ছিল, ডরমেন্ট ছিল, যা ও নিজেই ভালোমতো বুঝত না—সেক্স এনজয় করত না।’

আইরিনের অকপট কথাবার্তা, গতানুগতিক জীবন থেকে মুক্তি আকাঙ্ক্ষা জাফর সাদেককে চমৎকৃত করেছিল। নিজের তার ছিল নিঃসঙ্গতা, কথা বলার মানুষ নেই, চেনা-জানা মানুষ থাকলেও বন্ধু বলতে কেউ না। আইরিনের সঙ্গে মেলামেশার এক পর্যায়ে দুজনেরই ফটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহের ব্যাপারটা বেরিয়ে পড়তে সম্পর্কটা গতিই পায়নি—জাফর সাদেকের মনে হয়েছিল, পরে আইরিনও স্বীকার করেছিল—লক্ষ্যমুখী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু কী সেটা এ নিয়ে জাফর সাদেকের মনে সংশয় ছিল; একবার একজনের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে এবার যদি আইরিন অন্য পথে এগোতে চায়? তা হয়নি। আইরিনই প্রস্তাব দিয়েছিল তাদের এক সঙ্গে থাকলে সুবিধা, খরচ বাঁচবে, কুলি-কামলাগিরি না করলেও চলবে, আর ছবি তুলতে এক সাথে দুনিয়া চষে বেড়ানো যাবে।

খবর ছড়াতে সময় লাগেনি, লন্ডনে কিছু আত্মীয়-স্বজন হয়ে দেশে পৌঁছতে। যারা জাফর সাদেককে কাছ থেকে জানত তারা খুব অবাক হয়নি, বিশেষ করে তার তখনকার বন্ধু বা সহপাঠীরা। তবে পরিবারে, বিশেষ করে মা ও বোনের জন্য ধাক্কাটা ছিল বড়। সেটা জাফর সাদেকের কারণে যতটা, তার চেয়ে বেশি আশপাশের মানুষের কানাঘুষায়। জাফর সাদেককে সেসব ছোঁয়নি।

ফটোগ্রাফিতে লন্ডনে বসে তখন ক্যারিয়ার গড়তে না পারলেও কে জানত নেশাটা তাকে তাড়িয়ে কোথায় নিয়ে যাবে! বাহাত্তরের মাঝামাঝি দেশে ফিরে জাফর সাদেকের তখন আরেক জীবন।

.

আইরিনের সঙ্গে থাকার সময় নিজের চালচলনে তেমন পরিবর্তন না হলেও, টাকা-পয়সা রোজগারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। পড়াশোনায় আগ্রহ না থাকলেও বাংলা-ইংরেজি দুটোই ভালো লিখতেন। একটা ভদ্র গোছের কাজের জন্য ইংরেজিকে আরও শানাতে ফ্রিহ্যান্ড একটা রাইটিং কোর্স পর্যন্ত করেছিলেন যাতে অন্তত বাংলিশ ব্যাপারটা লেখা থেকে দূর হয়। এতে লাভ হয়েছিল, বুঝতে পারছিলেন বাংলায় চিন্তা করে ইংরেজি লিখলে সেটা অন্য কিছু হয়, ইংরেজি না। কমনওয়েল্থ সেক্রেটারিয়েটে চাকরিটা পেয়েছিলেন ইংরেজি বিদ্যার জোরে। কাজটা এক্সাইটিং কিছু না হলেও আর্থিক নিরাপত্তার কারণে তার তখন মনে হতো এর চেয়ে ভালো আর কী জুটতে পারত। দেশ থেকে আসা বাঙালির মতো হাঁড়ি-পাতিল না মেজে হোয়াইট কলার জব করছে।

দেশে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে গেলে ছিলই না। সঙ্গী ও বন্ধু হিসাবে আইরিন মনেপ্রাণে তাকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বছর তিনেকের মাথায় কোন ফাঁকে যে তার মধ্যে সংসার করার লোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, জাফর সাদেক বুঝতে পারেননি। এও বুঝতে পারেননি তার ফেলে আসা পারিবারিক রক্ষণশীলতা তার মনে গুটি গুটি হানা দিতে শুরু করেছিল। সে জাফর সাদেকের পরিবার সম্বন্ধে নানা খুঁটিনাটি জানতে চাইত। সেই সাথে সে যে তার পরিবারবিচ্ছিন্ন হয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে এ কথাও বলত। জাফর সাদেক এসবকে প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তবে যেদিন পরিষ্কার বলে ফেলল তাদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকা উচিত, জাফর সাদেকের স্তম্ভিত হওয়ার পালা। কী বলছে আইরিন? নিজে না সে সব সময় বলত শর্তহীন, অমুখাপেক্ষী জীবন চায়! নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাই তার শেষ কথা, চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে অন্যের ভালো-মন্দে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া মূর্খতা। এ তো ছিল জাফর সাদেকেরও মনের কথা। তার নিজের কথা আইরিনের মুখে শুনেই এক সঙ্গে থাকার পরিকল্পনায় মন থেকে বাধা আসেনি। সেই মেয়ের হঠাৎ কী হলো!

কিছু দিন যেতে লক্ষ করছিলেন আইরিন আটঘাট বেঁধেই নেমেছে, এমনকি চাপও দিচ্ছে। শেষমেশ ঠিক আছে বলতে আইরিন খুশি তো হয়েই ছিল, সেই সাথে সে দ্রুত বদলে যেতেও শুরু করেছিল। ঘরকন্নায় এত মনোযোগী হয়ে পড়েছিল জাফর সাদেকের বিশ্বাস হতে চাইত না। নরউইচে পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ নতুন করে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। আইরিন তখন খুব চাইত ঢাকায় জাফর সাদেকও যেন তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটান। জাফর সাদেক এতে সাড়া দেননি। নিজে এত বছর যোগাযোগ রাখেননি, এখন হঠাৎ কীসের প্রয়োজন, তাও যে মেয়ের সঙ্গে তিন বছর লিভ টুগেদার করেছেন তাকে বিয়ে করার পর তারই উৎসাহে? দিনে দিনে তার মনে হতো আইরিন হঠাৎ করে অনেক ব্যাপারেই নেগিং। এমনও মনে হতো, হঠাৎ না একদিন তাকে উত্তর লন্ডনে ইভানজেলিস্ট চার্চে নিয়ে যেতে সাধাসাধি জুড়ে দেয়।

সম্পর্কটা আগের মতো নির্ভার ছিল না। জাফর সাদেক বুঝতে পারছিলেন বিয়েজনিত বন্ধন ও সেই সাথে নানা বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে চাপ তৈরি করছে। আর আইরিনকে জাপটে ধরে আছে এমন এক পিছুটান যা তাকে বিস্মিত করত।

এর কিছু দিন পর পূর্ব পাকিস্তানে গণ্ডগোল। বিলেতের কাগজে, রেডিও-টিভিতে বিস্তর খবর। দেশের রাজনীতি দ্রুত মোড় ঘুরছিল। প্রথমে গোটা ব্যাপারটা তার কাছে শেখ মুজিবের একরোখামি বলে মনে হতো। ইলেকশনে আওয়ামী লীগ একচ্ছত্র জয় পেলেও ছয় দফা বাস্তবায়নের ম্যানডেট কি পেয়েছিল? ছয় দফা মানে তো পাকিস্তান ভেঙে ফেলা, আলাদা কারেন্সির মতো একরোখা দফা ইয়াহিয়া খান মেনে নিলে ওর ঘাড়ে মাথা থাকবে! আইরিন সে সময় তাকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ঝগড়ার বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন করত। দায়সারা জবাবে সন্তুষ্ট হতো না, বলত, ‘তোমার দেশে অনেক কিছু ঘটছে, তুমি এত আনকনসার্ভ থাকো কী করে?’

ওর গায়ে পড়া কথাবার্তা দিন দিন বাড়ছিল। কখনো কখনো এমনও মনে হতো কারণে-অকারণে নানা ছুতায় আইরিন তাকে যাচাই করছে। কেন করছে, এর জবাব জাফর সাদেকের কাছে ছিল না। তবে কি আর পাঁচটা বিবাহিত মানুষের বেলায় যেমন মতের অমিল, খটোমটো লেগে থাকে তার বেলায়ও তা-ই ঘটতে চলেছে? আগে তো এসবের বালাই ছিল না। বিয়েটাই কি আইরিনকে এত বদলে দিল, না কি পার্টনার থেকে স্ত্রী সাজতে গিয়ে একটা ন্যায্য কর্তৃত্বের জায়গা থেকে সে এমন করছে, যে ন্যায্যতার অভাব থেকেই বিয়ের চাপ দিয়ে কাজটা হাসিল করে নিয়েছে? এমন তো জাফর সাদেক চাননি—এত গৎবাঁধা, মানডেন জীবন। খিটিমিটি বাড়ছিল।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় ঘটে যাওয়া পাকিস্তানি মিলিটারি ঠিক কী ঘটিয়েছিল সে খবর উড়ো উড়ো পাওয়া গেলেও ডেইলি টেলিগ্রাফ যেদিন সাইমন ড্রিংয়ের রিপোর্ট ছেপেছিল, সেদিন অফিসে মালাকা তাকে দেখামাত্র জানতে চেয়েছিল তিনি কি ঠিক আছেন? অবাক হয়ে মালাকার দিকে তাকাতে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ঢাকায় বা দেশে আত্মীয়-স্বজনের খবর পেয়েছেন? তিনি হ্যাঁ-না-র মাঝামাঝি একটা ভঙ্গি করায় মালাকা আর তাকে ঘাঁটায়নি। অফিসে প্রায় সব খবরের কাগজ থাকলেও সেদিনের কোনো কাগজ তার তখনো দেখা হয়নি। তবে কয়েক বছর আগে এক রেস্টুরেন্টে এক সঙ্গে কাজ করার সুবাদে পরিচিত এক বাঙালি তাকে সেদিন সকালে ফোনে বলেছিল টিক্কা খান ঢাকাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। গুজবে-হুজুগে পাগল বাঙালিদের সব কথায় কান দিতে নেই ভেবে তিনি বড় একটা কৌতূহল দেখাননি, সাড়া না পেয়ে ওপাশ থেকে যে কথা বলছিল, ফোন কাটার আগে বলেছিল, ‘আপনার কী, আপনার আবার দেশ, মেম নিয়া সুখে আছেন।’

লাঞ্চ ব্রেকে সেদিনের পত্রিকাগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ডেইলি টেলিগ্রাফের বড়সড় খবরটা পড়ে ঢাকায় ট্যাংক চালিয়ে রাতভর মানুষ মারা হয়েছে এ খবর কতটা বিশ্বাসযোগ্য এ নিয়ে প্রথমে বিপত্তিতে পড়েছিলেন। দেশে শেখ মুজিবের ডাকে ননকোঅপারেশন চলছিল। এটা থামাতে ট্যাংকের কেন দরকার পড়ল ভেবে পাচ্ছিলেন না। এদিকে যে রিপোর্টটা করেছে, সাইমন ড্রিং, সে নিশ্চয়ই দুর্দান্ত সাহসী ও করিৎকর্মা। পঁচিশে মার্চ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ছাদে লুকিয়ে মিলিটারির নজর এড়িয়ে নিজের চোখে ঘটনা দেখেছে, আর দুই দিন পর করাচি হয়ে ব্যাংককে গিয়ে রিপোর্ট ফাইল করেছে। অফিসে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ভারতীয়, পাকিস্তানি ছাড়াও শ্রীলংকান, আফ্রিকান সহকর্মী ছিল। ঢাকার অবস্থা নিয়ে তারা, বিশেষ করে ভারতীয়রা, কয়েক দিন ধরে কথাবার্তা তুললেও জাফর সাদেক শুনেই যেতেন। তাকে চুপ থাকতে দেখে হয়তো কেউ কেউ অবাক হতো, এমনও হয়তো ভাবত দেশ থেকে কোনো সমস্যায় পড়ে বিলেতে এসেছেন, ক্রাইম-ট্রাইমও বিচিত্র নয়। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ছেড়ে আসা প্রৌঢ় ভিভেক সান্দ্রা একদিন বলেছিলেন, ‘জাফর, ইয়োর কান্ট্রি ইজ ইয়োর্স, নো ম্যাটার হোয়ার ইউ লিভ—লাভ ইট অর হেট ইট।’ জাফর সাদেক চোখ তুলে তাকাতে তিনি কাঁচা-পাকা ভুরু নাচিয়ে বলেছিলেন, ‘আই লেফ্‌ট ইন্ডিয়া ফর গুড, বাট স্টার্ট মাই ডে উইথ অল ইন্ডিয়া রেডিও ব্রডকাস্ট, ইটস সুরোজিৎ সেন, মোস্ট ডেজ। হা হা।’

জাফর সাদেক বলার মতো কিছু খুঁজে পেতেন না। দেশের খবর তাকে টানত না, পরিবারের সঙ্গেই যেখানে সম্পর্ক নেই, সেখানে দেশ? দেশ বলতে তো সবার আগে পরিবার। তারপরও সত্তরের ইলেকশনের পর থেকে যেসব খবর কানে আসত তাতে খেই পেতেন না, দেশের চেনাজানা লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে তাদের কথাবার্তাও ঠিক বুঝতেন না, গোলমেলে মনে হতো। আর থিওরি তো একেক জনের একেক রকম। এদিকে ঘরেও যখন আইরিন তাকে দেশ নিয়ে খোঁচাত, ব্যাপারটা বিরক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।

ধাক্কা খেয়েছিলেন সাইমন ড্রিংয়ের রিপোর্ট পড়ে। আর দুই দিন না যেতে অন্যান্য পত্রিকায় আরও। অবজারভার ছেপেছিল কলিন স্মিথের রিপোর্ট, যা ছিল প্রথম কোনো ব্রিটিশ সাংবাদিকের লন্ডন থেকে ঢাকায় গিয়ে পাঠানো বিশাল প্রতিবেদন। আর কদিন পরে সানডে টাইমস বোমা ফাটিয়েছিল জেনোসাইড শিরোনামে অ্যানথনি মাসকারেনহাসের রিপোর্ট ছাপিয়ে।

ধাক্কার পর ধাক্কাগুলো যেভাবে আসছিল তাতে জাফর সাদেক অবাক হয়ে লক্ষ করতেন তার মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। এমন এক অস্থিরতা যা তাকে যখন-তখন ঝাঁকুনিই দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু এ নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করত না। সে সময় ভিভেক সান্দ্রার কথা মাথায় এলেও তিনি আমল দিতেন না। তিনি জাফর সাদেক, ভিভেক সান্দ্রা নন, দেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদেশে থাকব, আবার দেশের রেডিওর খবর শুনে দিন শুরু করব এমন রোমান্টিক আহম্মকি তার মধ্যে নেই।

কিন্তু অস্থিরতা বাড়ছিল। কৈশোরে, সবে তখন কলেজে উঠেছেন, সিদ্ধেশ্বরীতে তাদের পাড়ায় থাকত হলিক্রসে পড়া শান্তা, বয়সে কিছুটা বড় হলেও নাম ধরেই ডাকতেন, ক্যারম খেলতেন ওদের বাড়ির ছাদে, শীতকালে ওদেরই খোলা লনে ব্যাডমিন্টন। হুট করে একদিন শান্তার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হতে বুকভাঙা অস্থিরতার যে দশা হয়েছিল এ যেন অনেকটা সে রকম। শান্তা একে বয়সে বড়, পড়ত ওপরের ক্লাসে, তাকে নিয়ে কোনো দুর্বল মুহূর্তে ফ্যান্টাসিতে মেতেছেন মনে পড়ে না, তারপরও কী যে জ্বালাপোড়া, যেন তার নিজের সাজানো বাগান দৈত্য-দানব এসে ছারখার করে দিচ্ছে। দেশ কি মনের অজান্তে বাগান-টাগান গোছের কিছু, ছারখার হয়ে যাওয়ার পর বুকে হাঙ্গর ডিগবাজি খাচ্ছে? কী করা যায় ভেবে ভেবে ঢাকায় বাসার ঠিকানায় টেলিগ্রাম করেছিলেন : WIRE WELFARE. SHARP. তিনি দেশে থাকা পর্যন্ত বাসায় ফোন লাগেনি, ততদিনে লেগে থাকবে, তবে নম্বর জানার উপায় ছিল না। টেলিগ্রামের জবাব আসেনি। বাধ্য হয়ে চিঠি লিখতে বসেছিলেন। কাকে লেখেন—বোনকে না মাকে—দোটানায় পড়ে জীবনে প্রথম মাকে চিঠি লিখেছিলেন। হোঁচট খাচ্ছিলেন প্রতিটা বাক্য তৈরিতে, শব্দের পিঠে শব্দ বুনতে, আর শব্দের অন্তর চেরা, প্রায়-অচেনা স্বাদ-গন্ধময় আলোড়নে বিহ্বল কলম থেমে যাচ্ছিল। চিঠির জবাব পেতে রোজ লেটার বক্স ঘাঁটাঘাঁটি উত্তেজনাকর অভিজ্ঞতা হলেও সেটা এক সময় ঝিমিয়ে পড়েছিল। জবাব আসেনি। তখন শুনতে পাচ্ছিলেন ঢাকা থেকে মানুষ পালিয়ে যে যেদিকে পেরেছে চলে গিয়েছে, ইন্ডিয়াতে যাওয়াও বিচিত্র নয়। তবে বেঁচেই যদি না থাকে, যাবে কোথায়!

খবর পেয়েছিলেন পরে, তবে চিঠির জবাবে নয়, চেনা-জানা মানুষের সূত্রে।

নিজেকে নিয়ে সে সময় যা ঘটেছিল তার সরল-সোজা ব্যাখ্যা জাফর সাদেকের ছিল না। যেন দশ বছর একটা ঘোরে কাটিয়ে হঠাৎ জেগে উঠে অনেক কিছু অচেনা লাগছিল, নিজেকেও যেন চিনতে পারছিলেন না। কোনো পরিতাপ কি ছিল, ক্ষোভ বা দুঃখবোধ? অপরাধবোধ? তার বিবেচনায় কোনোটাই না, নিজ দায়িত্বে জেনে-বুঝে যা করার করেছেন। পরিবারের অমতে দেশ ছেড়ে দীর্ঘদিন যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন থাকা বা বিলেতে দেশি মানুষজনের সাক্ষাৎ এড়িয়ে তথাকথিত অসামাজিক জীবনযাপন বা আইরিনের সঙ্গে লিভ টুগেদার (যা পরে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েতে পর্যবসিত হয়ে দিন দিন ম্লান থেকে ম্লানতর হচ্ছিল) কোনো কিছুকেই নিজের কাছে হঠকারী ভাবার কারণ ছিল না।

তবে বিলেতে আসার পেছনে তার যে কোনো পরিষ্কার লক্ষ্য ছিল না ততদিনে বুঝে গিয়েছেন। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হওয়ার স্বপ্নে গলদ ছিল, ফটোগ্রাফি কোর্স করার পরই তা টের পেয়েছিলেন। ভাগ্যিস, কমনওয়েল্থ সেক্রেটারিয়েটে চাকরিটা মন্দ ছিল না, তবে তার আগে বেশ কয়েক বছর বাছবিচারহীন যখন যা জুটেছে করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিছু ছিল না। আইরিনের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতায় বৈচিত্র্যের স্বাদ পেয়েছিলেন এতে সন্দেহ নেই। অন্তত নিঃসঙ্গতা দূর হয়েছিল, তবে বছর কয়েকে, বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী সাজার পরে, আইরিনের সঙ্গে বনিবনায় ঝামেলা দেখা দিতে সেখানেও পাওয়ার কিছু ছিল না।

এমন সময় দিনের পর দিন দেশের খবরে, অবিশ্বাস্য সব খবরে হতভম্ব যে হয়েছিলেন তা তো সত্যি। আর এভাবেই ফেলে আসা, ভুলতে বসা দেশ যে একটা জায়গা নিয়ে নেবে—বুকে বা মাথায় কোথাও, আর হাঙ্গরের মতো করাত বসানো বিকট মুখ নিয়ে উল্টেপাল্টে ডিগবাজি খাবে এ কি ধারণায় ছিল! দিনের পর দিন ঢাকাসহ সারাদেশে আর্মির বর্বরতার খবরই শুধু না, পত্রিকার পাতায় ছবির পর ছবি। টিভিতে ছবিগুলো বুঝি নড়েচড়েও উঠত, আর এত চেনা লাগত। এ আবার কেমন ঘোর, চেনা লাগাটা ফ্যান্টাসি ছাড়া কী! নস্টালজিয়াকে প্রশ্রয় দেবেন তেমন মানুষ তো নন।

আইরিনের সাথে কাটাকুটি হয়ে গিয়েছিল। সম্পর্ক টেকাতে দুজনের কারোই আগ্রহ ছিল না। দিন তারপরও আটকে থাকেনি। ঘর ছেড়ে হোটেলে থেকেছেন কিছু দিন, তারপর সস্তায় লজার হিসাবে এখানে-ওখানে। শেফার্ডস বুশে বশির হামদানির বক্সরুমে ঠাঁই গেড়ে ভেবেছিলেন দেখা যাক। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো চাকরি থেকে ছাঁটাই। এদিকে বুকে বা মাথায় হাঙ্গর হয়ে হুটোপুটিরত দেশটাও ছিটকে বেরিয়ে স্বাধীন। পত্রিকার পাতায় দেশকে দেখতেন আর নিজেকে চমকে দিয়ে ভাবতেন যাবেন নাকি—দেখতে। দশ বছরে সেই প্রথম।

ডেইলি মেইলের ইভনিং এডিশনে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের খবরটা সেই যে মাথায় জোরে চাঁটি মেরেছিল, তার জের চলছিল—নিজেই মাথা পেতে চাঁটির পর চাঁটি, গাঁট্টার পর গাঁট্টা খেয়ে খেয়ে। দিনের পর দিন পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে খুঁজেছেন—আর কী, আর কী? যা পেয়েছিলেন তাতে যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানি সেনার জবানিই যেন তেড়েফুঁড়ে উঠছিল : ইট ওয়াজ ওয়ার, ইউ রেপ…

রেপ ক্যাম্প কথাটা আগে কখনো শুনেছেন মনে পড়ে না। কথাটা যখন-তখন মাথায় নড়েচড়ে উঠত। কত মেয়ে ছিল রেপ ক্যাম্পগুলোয়? মেয়েরা এখন কোথায়? তিন লাখের খবরটা গুনে গুনে কে বের করেছে? এ কি সম্ভব? ভাবতে ভাবতে মনে হতো তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কী আসে যায়! তিনি কোথাকার কোন জাফর সাদেক লন্ডনে এক আফগানির মুরগির খোঁয়াড়ের মতো খুপরিতে তিন লাখের হিসাব শুনে জবাই করা মুরগির মতো ঠ্যাং ওপরে তুলে যদি ছাদ ভেঙে পড়া ঠেকাতে চান, তা বড়জোর একটা বাচ্চার কাঁচা হাতের কার্টুন হতে পারে।

নাগপাশের আয়না

পরপর দুই দিন ফ্যাক্টরি গেটে হাজিরার লাইন থেকে সামনে-পেছনে চোখ ঘুরিয়ে মান্তুকে খুঁজল চম্পা। সেদিন দূর থেকে দেখামাত্র হাতে-পায়ে কাঁপুনি নিয়ে ভেগে গিয়েছিল, আর এ দুই দিন নিজেই খুঁজে না পেয়ে তার খটকা লাগল—ঠিক দেখেছিল?

জবা ছাড়া ঘরটা খালি-খালি। সারা দিন খাটনির পর ঘরে ফিরলে মা-মেয়ে রান্নাবাড়া সেরে টুকটাক গল্প-স্বল্প করত, আবার কোনো ছুতায় জবার ওপর চড়াও হতেও চম্পার সময় লাগত না। মোবাইলে আম্মার সঙ্গে চম্পা কথা বলেছে, জবার সঙ্গেও। ফুটপাথ থেকে চুরির মোবাইল কিনেছিল বছর দুয়েক আগে। কাজে লাগত না বলে প্রায়ই মরে পড়ে থাকত। এখন চার্জ দিয়ে পয়সাও ভরে রাখছে, অন্তত আম্মার সাথে যাতে নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। জবাকে আম্মা বই-খাতা কিনে দিয়েছেন, আর সন্ধ্যার পর কুলসুমের মা-র সঙ্গে হিন্দি-বাংলা সিরিয়াল নিয়ে সে মৌজেই আছে। আম্মাকে চম্পা বলেছে সে ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে, পাওনা টাকাও পেয়েছে, তবে মান্তুকে যে আম্মার কথামতো খুঁজেছে, পায়নি, সে কথা বলি-বলি করেও বলেনি।

ঘরে তালা মেরে কোথায় গিয়েছিল পড়শিদের কেউ কেউ জানতে চাইলে চম্পা দায়সারা জবাব দিয়ে পার পেলেও পাশের ঘরের মর্জিনার মা-র জেরার মুখে মেজাজ খারাপ করে বলল, ‘আইসাই তো পড়ছি, আর কী, মরলে তো খবর পাইতা না।’

কিন্তু জবাকে কোথায় রেখে এসেছে এ নিয়ে তার জেরার শেষ নাই। চম্পা যতই বলে ওকে ওর এক খালার কাছে রেখে এসেছে, এখন থেকে ওখানেই থাকবে, ইশকুলে যাবে, বুড়ির চোখে-মুখে অবিশ্বাস-সন্দেহ ততই ঘোঁট পাকায়, ‘খালা? তুই বইন পাইলি কই, তোর মাইয়ারে রাখব আর ইশকুলেও দিব! মিছা কতায় আমারে বুজ দিবার চাস?’

চম্পা রেগেমেগে বলল, ‘আমার কী ঠেকা তুমারে বুজ দেই, তুমি আমার কী লাগো বুজ দিমু?’

বুড়ি হতাশ হয়ে ‘হো, আমি কে, আমারে ক্যান কইবি কই থুইয়া আইছস, না কইলি’ বলে মনের ঝাল ঝাড়ল, ‘কচি মাইয়ারে বিয়া দিছস কইবি ক্যান? পুলিশে খবর পাইলে বাইন্দা লয়া যাইব।’

চম্পা থতমত খেয়ে বলল, ‘বালা করছি। হইছে, পরান ঠান্ডা হইছে তুমার?’ বুড়ি চুপ করে তাকিয়ে থাকলে চম্পা বলল, ‘খাইবা কিছু? মর্জিনা দেরি করতাছে ক্যান, মুড়ি দিমু?’

সে কথায় কান না দিয়ে বুড়ি গজর গজর করতে থাকল, ‘এগলা মানুষ আছিলো, ডাক পাড়লে পাইতাম, আমারে নানি-নানি ডাইকা কত মায়া করত, অহন আমার দিন কাটব ক্যামনে? কিরা কাইটা ক বিয়া দেস নাই?’

চম্পা হাসল, ‘খালা, তুমার মাথা খারাপ, এট্টুন মাইয়া, ওর বিয়ার বয়স হইছে! নেও কাটলাম কিরা, আল্লার কিরা, রাসুলের কিরা, আমার মরা বাপের কিরা, হইল?’

শেষে এটা কী বলল? চম্পা এতই চমকাল নিজের ঘরে ঢুকে কতক্ষণ থম ধরে বসে থাকল। মরা বাপ এক দিক দিয়ে ঠিক আছে, তার মা-ই তাকে ছোটবেলায় শিখিয়েছিল বাপ মারা গেছে কলেরায় তার জন্মের পরপর। তখন সে তা-ই বিশ্বাস করত, পরে তো আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু ঝোঁকের মাথায় মুখ থেকে এ কী বেরোল!

মান্তুকে খুঁজে না পেলেও তিন দিনের দিন সকালবেলা সেই হাজিরার লাইন থেকেই কে যেন চিল্লিয়ে ডাকল, ‘চম্পাবু’। এ ডাকে তাকে কেউ ওখানে ডাকার নাই জেনে গলাটা যে মান্তুর আর ডাকার পর লাইন ভেঙে ছুটে এসে যে তার গায়ের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল, সে যে মান্তু পরিষ্কার দেখতে পেয়েও চম্পা সাড়া দিতে একটু দেরি করল—যেন এত দিন পর মান্তুকে তার চিনতে কষ্ট হচ্ছে, যেন এই হাজিরার লাইনে মান্তু কী করছে এ ধাঁধার কিনারা করতেও সময় নিচ্ছে।

কিন্তু এ কাকে দেখছে চম্পা? সেদিন দূর থেকে এক নজর দেখেই চিনেছিল আর এখন এই যে তার গায়ে লেপ্টে, ঘাড়ে-গলায় নাক-মুখ ঠেসে দুই হাতে জাপটে ধরে আছে, একে চট করে চেনা তো মুশকিলই। রঙ-মরা কালচে গায়ের রঙ, চোখ দুটো ছোটই ছিল, এখন কালিমাখা গর্তে ঢুকে আরও ছোট, আর জোড়া ভুরুর মাঝ বরাবর তেরচা কাটা দাগটা যেন আগের চেয়ে লম্বা।

হাজিরার সময় দেরি করার উপায় নাই, চম্পা তারপরও লাইন ছেড়ে মান্তুকে নিয়ে খানিকটা সরে গিয়ে হাজারটা প্রশ্নের মধ্যে কোনটা ছেড়ে কোনটা করবে ঠিক করতে না পারলেও জানতে চাইল সে এ ফ্যাক্টরিতে কবে থেকে? কোন সেকশনে? এখানে তাকে এনে দিল কে? প্রশ্ন করতে হয় বলে করা, কিন্তু এতে কতটুকু জানা হয়! পরপরই তার মনে হলো মান্তুর কাহিনি জানতে অনেক সময় পাওয়া যাবে। আর মান্তুও যেভাবে গর্তে বসা চোখ দুটোকে টেনেটুনে ভালো করে দেখবে বলে তার দিকে তাকিয়ে আছে তাতে এ সময় কথাবার্তা না চালানোই ভালো। শুধু জেনে রাখল মান্তু চারতলায় প্যাকিংয়ে হেলপারের কাজে ঢুকেছে, তাও মাত্র চার দিন হয়েছে।

চম্পার আপাতত এটুকুতেই চলবে। মান্তুকে বলল দুপুরে সময় পেলে দেখা করতে চেষ্টা করবে, না হলে ছুটির পর সে যেন এ জায়গায়, ঠিক এ জায়গায় তার জন্য অপেক্ষা করে। অনেকটা জোর করে হাত ছাড়িয়ে মান্তুকে তার সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে চম্পা এতক্ষণে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মান্তুকে দেখার কায়দা পেয়ে লম্বা নিঃশ্বাস চাপল। ঠিক সুন্দরী না হলেও কী চটপটে, হাসি-খুশি ছিল, শরীর-গতরে টানটান—এখন এই বেগুনপোড়া চোখমুখ আর দলামোচা শরীর দেখে কেউ ভাবতে পারবে ওর হাঁটার তালে কোমর-পাছায় কেমন নাচন উঠত! মনে আছে গাঁয়ে ছেলেপেলেরা গান পর্যন্ত বাঁধত— দুলদুলি যায় গো, ঢেউ তুইলা যায় …। ওদের দোষ কী, তার নিজের জামাই আজগরেরও নজর ঠিক ছিল কি না কে জানে! ফাঁকতালে কোনো দিন চেপেচুপে ধরলে চম্পা কী করে জানবে, আর মান্তুই-বা তাকে কোন মুখে বলবে!

মেশিনে সবে জুত হয়ে বসেছে, সুপারভাইজার মন্টু সিকদারকে পাশ দিয়ে পা চালিয়ে যেতে দেখে চম্পা আজ একটু বাড়াবাড়ি করল। উঠে দাঁড়িয়ে সালাম তো দিলই, তাও বলতে গেলে লোকটার পথ আগলে, আবার ‘ছার বালা নি’ বলে আশপাশে একটা চাপা হাসির খোরাকও জোগাল। লোকটা সরে যেতে নাসিমা ফোঁস করে উঠল, ‘ব্যাটা মাইনষ্যেরে মাইয়ারাই খারাপ করে, সালাম দিয়া, ছার-ছার কইরা এই ছাগলার বাড় বাড়াইতেছো গো চম্পারানি। হেইদিন দূরে না তুমারে কইব লও ঘরে যাই, তুমার ভাবি তুমারে যাইতে কইছে। কথা কিন্তুক কইলাম, মনে রাখবা, এই তরা সাক্ষী’ বলে সামনে-পেছনে আসমা, বীথি, মরিয়মদের দিকে চোখ ঘোরাল। ওরা বয়সে ছোট, তবে মন্টু সিকদারকে নিয়ে নাসিমার মশকরায় কার না মজা লাগে! ওরা খিক্ খিক্ হাসল। চম্পাও গলা তুলে শামিল হলো। নাসিমা এবার চম্পার হাসি নিয়ে পড়ল, ‘আইজ যে বড় খুশি গো চম্পাফুল, ঘটনা কী? তুমি তো আবার মুখো খিল দিয়া থাকো, তলে তলে কিছু করবা না, খবরদার। যা করবা আওয়াজ দিয়া করবা। আমারে দেখো, একটা ছাইড়া মাস যায় নাই আরেকটা ধরছি, লুকাইছি কিছু! তুমি যে কুন সুখে আছো বুজি না! হইছে আর গুলতানি না, মন্টু মিয়া দেখলে আবার ক্যাটক্যাট শুরু করব।’

নাসিমা মন্টু সিকদারকে নিয়ে যত ইতরামিই করুক, চম্পার হিসাব পরিষ্কার। একা একা এত বছর নানা ঘাটে পানি খেয়ে সে একটা জিনিস ভালোই বোঝে, নিজের স্বার্থ আগে। মন্টু সিকদারকে যে তোয়াজ-তোষামোদ করে—খালি খালি? লোকটা ভালোই, মেজাজ বিগড়ালে মুখ খারাপ করে, তবে আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে নিয়ে ওর আকাম-কুকামের খবর শোনেনি। ছাগলা হোক, বেকুব হোক, লোকটা কাজ যেমন জানে, সময়মতো কাজ উঠাতেও ওস্তাদ। সেজন্য ওপরের দিকে ওর দাম আছে। চাইলে তার প্রোডাকশন লাইনে সে কাউকে নিয়ে নিতে পারে বা অন্য লাইনেও ঢোকানোর মুরোদ রাখে। লোকটাকে সে তোয়াজ করে জবার কথা চিন্তা করে, যদি সে চায় জবাকে একটা কিছুতে ঢোকানো কোনো ব্যাপার না। তবে আজ যে আগবেড়ে পথ আগলে সালাম দিল, ছার বলল এর পেছনে নতুন মতলব। মান্তুর মুখে শুনেছে সে প্যাকিংয়ে হেলপারি করছে। সারা দিন খালি হামকিদামকি আর মাস গেলে কয়টা টাকাই-বা পাবে। আজ মন্টু সিকদারকে দেখামাত্র মনে হয়েছে যদি লোকটাকে তোয়াজ করে মান্তুকে অপারেটরের কাজে ঢোকানো যায়। চম্পা জানে কাজটা সহজ হবে না। পয়লা তো মেশিন চালানো শেখা লাগবে, কিন্তু আজকাল মালিকরা আনাড়িদের ট্রেনিং দিয়ে খামোখা সময় নষ্ট করতে চায় না। দেশে আর যা-ই হোক, অপারেটরের আকাল নাই। তবে চম্পার মন বলছে মন্টু সিকদার চাইলে আজ হোক কাল হোক মান্তুর একটা গতি করতে পারবে। আর এর পেছনে চম্পার নিজের যে স্বার্থ সেটাকে মতলবই বলা যায়—এমন একটা উপকার করতে পারলে মান্তুর দিক থেকে তার বিপদের ভয় থাকবে না। কথাটা মাথায় এলো বলে খারাপও লাগল। শুধু নিজের মতলব হাসিলের জন্য সে মান্তুর উপকার করতে চায়, এ তো ঠিক না। না জানি কোন মুসিবতে পড়ে গার্মেন্টে ভিড়েছে।

দুপুরে খাওয়ার পর চম্পা বের হতে পারেনি। বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা। আজ থেকে তার ওভারটাইম করার কথা। জরুরি কাজের কথা বলে মাফ পেয়েছে, বলেছে কাল থেকে করবে। সকালে মান্তুকে যে জায়গায় দাঁড়াতে বলেছিল, বেরিয়ে দেখল সে ওখানে দাঁড়িয়ে। কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে কে জানে!

চম্পাকে দেখে মান্তু ছুটে কাছে এলো, তবে এবার আর জাপটাজাপটি না করে জানাল অনেকক্ষণ তার ছুটি হয়েছে, চম্পার কি রোজই দেরি হয়?

চম্পা বলল, ‘চল্।’

‘কই?’

‘আমি যেখানে থাকি, বেশি দূরে না। এদ্দিন বাদে তোরে পাইলাম, এইখানে খাড়াইয়া কতা কইলে অইব! উঠছস কুনখানে?’

‘কালাচান্দপুর।’

‘দূরে তো। ওইখানে কে আছে? বাদ দে, এখন এই সব প্যাচালে কাম নাই। ঘরে চল্। রাইতে থাকবি আমার লগে।

মান্তুর দোনোমনা দেখে ‘চল্ তো’ বলে হাতে টান দিতে কিছু না বলে মা তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। পথে ইচ্ছা করেই চম্পা ওর ব্যাপারে কোনো কথা তুলল না।

তালা খুলে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাতে মান্তু এক চক্কর চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘তুমার ঘরটা তো ভালা, জবা কই?’

‘জবারে মনে আছে?’

‘কী কও!’

‘জবা অন্য জাগায় থাকে। এখন গোসল কর আগে, ফ্যাক্টরি থাইকা ফিরা পয়লা কাম গোসল।

মান্তু নড়ল না, গলা নামিয়ে বলল, ‘তুমার লগে আর কেউ থাকে না?’

‘কে থাকব!’

‘আজগর ভাই খোঁজ করে না?’

‘তোরে না কইলাম গোসলে যাইতে, আয় দেখাইয়া দেই, আর কাপড় এইটা নে।’

মান্তু চম্পাকে মনে করিয়ে দিল চম্পা চলে আসার কিছু দিন আগে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বর মিনিবাস, টেম্পো যখন যা সুবিধা চালাত। বিয়ের পর বছরখানেক ভালোই ছিল। তবে বিয়ের সময় বরপক্ষের জোরাজুরিতে মান্তুর বাবা রাজি হয়েছিল জামাইকে ইজিবাইক কিনতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে। ওরা চেয়েছিল পুরো টাকা, দেড় লাখের মতো। কথার খেলাপ করার মানুষ ছিল না তার বাপ, ঠিকই দিত, কিন্তু বিয়ের মাস কয়েক বাদে তার মায়ের পেটে ক্যানসার ধরা পড়ল। প্রথমে এলাকার ডাক্তারের ওষুধবিষুধ, পরে ঘন ঘন ঢাকায় আসা-যাওয়া আর বছর দুয়েক হাসপাতালে টাকা ঢালা-ই সার হলো। মা মারা গেল, আর বাবা ফতুর হয়ে জামাইকে যৌতুক দেবে কী, নিজেরই তখন খাওয়া জোটে না। শ্বশুরবাড়িতে তখন তাকে নিয়ে নানা অশান্তি। এদিকে কোলে তখন আড়াই বছরের ছেলে। এ সময় হঠাৎ বাপও মারা যেতে কপাল পুড়ল। বেঁচে থাকলে জমাজমি বিক্রি করে হলেও বাপ হয়তো টাকা জোগাড় করত, কিন্তু ভাইয়েরা কেন তা করতে যাবে? অত্যাচার, মারধর সহ্য করে বছরখানেক টিকতে পেরেছিল, তারপর ফিরে এসেছিল বাপের বাড়ি, সেটা ততদিনে ভাইদের বাড়ি। ওদের নিজেদের সংসারই চলত না, তবু দাঁত কামড়ে পড়েছিল বছর তিনেক। ভাইদের বউরা উঠতে-বসতে কথা শোনাত। এমনও বলত তাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে না থেকে শহরে ইট ভেঙে খেলেও পারে। রাগের মাথায় কাউকে কিছু না বলে গ্রামের এক মহিলার সঙ্গে ঢাকায় চলে এসেছিল। আসার আগে একটা কাজ করেছিল, এলাকার মেম্বারকে ধরে ছেলেকে এতিমখানায় গছাতে পেরেছিল। ঢাকায় এসে যখন যা পেয়েছে করেছে, সব কিছু বলতে পারবে না, বাসাবাড়ির কাজ থেকে হাসপাতালে মেথরানিগিরি কিছুই বাদ দেয়নি। গার্মেন্টে ঢুকবে বলে অনেক চেষ্টা করেছে, পারেনি। সেলাই শিখেছে, তবে ভারী মেশিন না, প্লেন মেশিন মোটামুটি চালাতে জানে। শেষে যে বাসায় এক সময় কাজ করত সে বাসার গারো ড্রাইভার ফিলিপ বুদ্ধি দিল তার বউ যে গার্মেন্টে কাজ করে সেখানে খোঁজ নিলে পারে। ফিলিপের বউ অন্তির কারণেই চার দিন হলো প্যাকিংয়ে কাজ পেয়েছে। থাকছে কালাচান্দপুরে ফিলিপ আর অন্তির ঘরে।

‘খিরিস্তান মানুষ অত বালা আগে জানতাম না। রাইতে গেলাম না, ওরা চিন্তা করব।’

চম্পা বলল, ‘নম্বর ক, ফোন দেই।’

মান্তু নম্বর জানে না বলতে সে বলল, ‘আরে এই শওরে কেউ কাউর জইন্য চিন্তায় ঘুম হারাম করে না। অন্তি কইলি না নাম, চিনলাম না, কুন সেকশনে?’

মান্তু জানাল ঠিক বলতে পারবে না, তবে তিন তলায় ওর কাজ।

‘বুজছি, ফিনিশিংয়ে।’

নিজের কথা মান্তু এমনভাবে বলে যাচ্ছিল যেন চম্পা জানতে চাচ্ছে বলে বলেছে। কিন্তু চম্পা কী করে ওর আগের হাসি-খুশি মুখটা ভোলে! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘আমারে পাইয়া খুশি হইছস?’

এ কথায় মান্তু বেচারা মুখ করে বলল, ‘তুমি বাদে আমার আপন কেউ আছিল? তুমার লগে চাচা-চাচি আর আজগর ভাই যা করছে, এইডা ভাইবা দিন-রাইত কানছি। সেই সময় তো গেরামে আছিলাম না। তুমার লগে দেখা হইব কুনুদিন ভাবি নাই। এমনও মনো হইছে তুমি বাইচ্যা নাই। একবার খোয়াবেও দেখছি। আইজ সক্কালে তুমারে লাইনে দেইখা আমার যে কী হইছিল কইতে পারি না।’

‘কী মনো করছিলি ভূত দেখছস?’

মান্তু কথা বলল না, মুখটা আড়াল করল। একটু পরে বলল, ‘তুমি কেমন আছো?’

‘আমি তো ভালা। কইলি না আমার ঘরও ভালা।’

‘তুমার ঘটনা তুমি কুনুদিন আমারেও কও নাই।’

‘কইলে কী করতি?’

মান্তু কথা না বলে মুখ তুলে চোখ জোড়াকে টেনে বড় করে নামিয়ে নিল। চম্পা বলল, ‘ক কী কইবি?’

‘তুমার কী দুষ! তুমারে খেদাইয়া দিল।

‘আমারে খেদায় নাই, নিজে থাইক্যা চইলা আসছি। না যুদি আসতাম, খেদাইত। আর দুষ আমার না কস? বাপের ঠিক নাই, এইটা দুষ না!

‘আমি থাকলে তুমারে যাইতে দিতাম না। তখন খালি চিন্তা করছি জবারে নিয়া পথে-ঘাটে কই কই ঘুরতাছো। কী সংসার ছিল গো তুমার! দুই দিনে কত বড় মুরগির খামার করছিলা!’

কথায় কথায় রাত অনেক হলো। চম্পা গরম ভাত বেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘তুই এইখানে থাকবি। কাইলই কাপড়-চোপড় নিয়া আইবি।’

থালায় ভাত নাড়তে গিয়ে এই প্রথম চম্পা খেয়াল করল মান্তুর চোখে পানি। দেখেও না দেখার ভাব করে সে বলল, ‘পোলার নাম তো কইলি না।’

চম্পা জানে জবাব পেতে সময় লাগবে, চোখের পানি তো চোখই না, গলা- বুকও চুবিয়ে ছাড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *