কালো কফি, ফাহমিদা ও বালিশের ধোঁকা

কালো কফি, ফাহমিদা ও বালিশের ধোঁকা

এত ভালো কফি অ্যানমেরি যে কোথা থেকে জোগাড় করেন অফিসে ঢোকামাত্র কড়াগন্ধি টাটকা কফির সুবাসে মন তো বটেই, শরীরও বুঝি মৃদু টনকে দুলে ওঠে। কে যেন বলেছিল—কফি শুড বি ব্ল্যাক এজ হেল, স্ট্রং এজ ডেথ, সুইট এজ লাভ। এ সেই কফি, যা চুমুকে চুমুকে মাথার পরতে পরতে টোকা দিয়ে আড় ভেঙে দেয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-জড়তাকেও হটিয়ে দেয়। কথাটা ঠিক হলো না, টোকা দেয় ঠিক আছে, তবে কফি তো মাদক না যে নেশার ঘোরে দ্বিধা-জড়তাও দূর করে দেবে। তবে আজ যেন জাফর সাদেকের তাই হলো, না হলে দুম করে ফাহমিদাকে কী করে বলেন—বিয়ে করেননি কেন?

শুনে ফাহমিদার কী হাসি! ফাহমিদার নাদুসনুদুস মুখটা হাসতে গেলে যে ছোট দেখায়, এ সত্যি রহস্যের।

হাসির কী হলো জানতে চাইলে ফাহমিদা বললেন, ‘আপনি তো করেছিলেন, তাই হাসি পেল। আপনি বিয়ে করেছিলেন এটা সত্যি বিস্ময়কর।’

‘বিস্ময়কর, হ্যাঁ তাই।’

তা হলে আমাকে যে জিজ্ঞেস করলেন?’

‘আপনি তো আমি নন। যাক, ঢাকায় বসে এমন কফি খাচ্ছি এটা কপাল কী!’

‘খুঁজলে ঢাকায় আজকাল কী না পাওয়া যায়!

‘এটা বাজারে পাওয়া যায়?’

‘বলতে পারব না, অ্যানমেরি মনে হয় ডিপ্লোমেটিক ওয়ারহাউস থেকে আনেন। ‘তাই বলেন।’

‘আমার জন্য বেশি স্ট্রং, দুধ-চিনি ছাড়া খেতে পারি না। আপনার তো আলকাতরার মতো কালো আর ঘন না হলে চলে না। কী করে খান!

‘অভ্যাস। বাসায় একটা কফিমেকার আছে, কিন্তু এখানে কফি বিন কোথায় পাব গ্রাইন্ড করে বানাব। তাই ইনস্টান্ট কফিই খাই, তবে কালো অবশ্যই। অফিসে আসব মনে হলে এই কফিটা আমাকে সত্যিই টানে।’

‘আজ যে খোশমেজাজে! মনে হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের হিল্লে করে ফেলেছেন!’

‘পানি ঢালা আপনার গেল না। আমি আসলে কিছুটা ক্লাউনিশ হয়ে গেছি, তাই না?’

‘দূর, কী বলছেন! গত কয়েক দিন নানা জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করলেন, আমি সঙ্গে যেতে চাইলাম, বললেন পরে জানাবেন। তাই ভাবলাম যদি কোনো খবর থাকে।’

‘খবর আছে, সুখবর না কোনোটাই।’

‘আমি একটা ইনফরমেশন আপনাকে দিতে পারি, নতুন কিছু না, কিন্তু আমার জানা ছিল না।’

জাফর সাদেক কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ তুলে তাকালেন।

ফাহমিদা বললেন, ‘যুদ্ধের সময় আমাদের প্রোভিশনাল গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের যারা ওয়ার ক্রাইমে জড়িত ছিল তাদের ফেরত না দিতে ইন্ডিয়াকে বলা হয়েছিল। এখনো তো ফেরত দেওয়া হয়নি, ওরা ইন্ডিয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছে।’

‘ইন্ডিয়া কী বলেছে?’

‘অফিসিয়াল ভার্সন জানি না, মনে হয় বর্তমান সরকারকে বুঝিয়েছে এতে লাভ হবে না। কারা ক্রাইম করেছে তার সাক্ষী-প্রমাণ লাগবে।

‘আসল কথা এটা না, ওয়ার প্রিজনাররা এখন ইন্ডিয়ার বড় বারগেনিং চিপ। তিরানব্বই হাজার সার্ভিসম্যান, সোজা কথা না, জুলফিকার ভুট্টোর সরকার দেশের ভেতরে চাপে আছে–কেন ফেরত আনা হচ্ছে না? ইন্ডিয়া সেই সুযোগ নিচ্ছে। এ দেশে পাকিস্তানিরা যত ক্রাইমই করে থাকুক, সেদিকে নজর না দিয়ে পাকিস্তানের সাথে একটা লংটার্ম ডিল করা গেলে ইন্ডিয়ার জন্য অনেক বড় পাওনা। এই যে কয়েক দিন আগে সিমলা এগ্রিমেন্ট হলো, সেটাই হলো সেই পাওনা।’

‘পত্রিকায় দেখেছি। পড়া হয়নি।’

‘আমি পড়েছি। ওতে জম্মু ও কাশ্মীরে লাইন অব কন্ট্রোল নিয়ে দুই দেশের সিদ্ধান্ত রয়েছে, ইন্ডিয়া যেমন চেয়েছে তেমনই হয়েছে, আর আছে শত্রুতা ভুলে গিয়ে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাইলেটারেল সম্পর্কের উন্নয়ন। চমৎকার না?’

দুজনের কেউ কিছু সময় কথা বললেন না। শাপলার জার্নালের নতুন সংখ্যা বেরিয়েছে। নেড়েচেড়ে জাফর সাদেকের মনে হলো এবার জার্নাল হিসাবে ঠিক আছে। শ-খানেক পৃষ্ঠায় যেমন হৃষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছে, তেমনি ভেতরে মাল-মসলাও অনেক। বেশ কিছু ছবি রয়েছে যার অধিকাংশই তার নিজের তোলা, ছবিগুলো ছাপার পর এত ভালো ফুটবে ভাবেননি। শাপলার কাজকর্মের ওপর একটা বড় প্রতিবেদন রয়েছে, সঙ্গে থানাপাড়ার বিধবাদের নিয়ে তার নিজের লেখা—ভিলেজ অব উইডোজ।

ইংরেজি-বাংলায় গোছানো পত্রিকা দেখে অ্যানমেরি খুশি। বললেন, ‘জার্নালটা বড় হয়েছে দেখে ভালো লাগছে। ফান্ড আমরা যা পাই মন্দ না, জার্নাল বড় করতে অসুবিধা নেই, ভালো লেখার অভাবে আগে মনমতো করতে পারিনি। যাক, এবার হলো, থ্যাংক ইউ সো মাচ জাফর।’

জাফর সাদেক ফাহমিদাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমাকে থ্যাংকস দিচ্ছেন কেন, অনুবাদগুলো কার করা, আর প্রুফ রিডিং? ইয়োর প্রফেসর ডিজার্ভস মোর দ্যান মি। আর তারেকও অনেক খেটেছে।’

‘আই নো, দে আর ডেডিকেটেড সোলস। আমাদের মানিও অনেক খাটে। মানি কোথায়?’

মান্নি নামে ছোটখাটো দেখতে চুপচাপ ধরনের একটা মেয়েও কাজ করে শাপলায়। অ্যানমেরি ওকে ডাকেন মানি। মান্নি ছিল না অফিসে, জার্নালের প্রথম প্রুফ ও-ই দেখে দেয়। ফাহমিদা ওর প্রশংসা করেন, ওর নাকি চোখ ভীষণ শার্প।

অ্যানমেরি বললেন, ‘তার পর, কী অবস্থা? নতুন কিছু পেলেন?’

অ্যানমেরির চোখে কৌতূহল না কৌতুক ঠিক ধরতে পারলেন না। জাফর সাদেক জবাব না দিয়ে মৃদু ঘাড় ঝাঁকালেন। অ্যানমেরি বললেন, ‘বুঝতে পারছেন তো এখানে কাজ করা বেশ কঠিন। এত ক্যাওস চারদিকে, এ অবস্থায় একটা কিছুকে টার্গেট করে এগোনো সোজা কাজ না। বাট, ইউ মাস্ট নট গিভ ইন। এর মধ্যে কার কার সঙ্গে কথা হলো জানত পারি?’

‘কথা তো হয়েছে অনেকের সঙ্গেই। কেউ খুব একটা একসেস দিচ্ছে না।’

‘কীসের একসেস বলেন তো।’

জাফর সাদেক কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, ‘অনেকেই আমাকে ইন্টুডার ভাবে, যেন আমাকে ঢুকতে দিলে ক্ষতি হবে, বা বলা তো যায় না, এমনও ভাবতে পারে আমি কারো হয়ে কাজ করছি। আর আসল কথা, খুব যে গুরুত্ব দিয়ে শোনে তাও না।’

‘একটু ভেঙে বলবেন।’

‘আমি কয়েকজন সোশ্যাল ওয়ার্কার ও রাইটস এক্টিভিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি, এদের মধ্যে লিগ্যাল প্রফেশনের লোকজনও রয়েছেন। যা দেখলাম, আমার ব্যাপারটাকে অনেকে খেপামি বলে মনে করেন। মানে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, এটাই বড় এচিভমেন্ট, এখন ইকোনমি, ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস রেসটোর করাই প্রায়োরিটি, শত্রুতা বাড়িয়ে কী হবে! ইন্টারন্যাশনাল ডোনাররা কিভাবে আমাদের দেখছে সেটাও বড় কথা। সামনে প্যারিস কনসোর্টিয়ামের মিটিং, সেখানে যারা মেটার করে যেমন-আমেরিকা, ইইসি-র মেম্বাররা, তারা কিভাবে আমাদের অবজার্ব করছে এর ওপর দেশের ইকোনমি অনেকটা নির্ভর করবে। সুতরাং …’

‘এ ছাড়া আপনার কি মনে হয় না এ সময় ইন্ডিয়া ইজ আ বিগ ফ্যাক্টর? ইন্ডিয়া দশ মিলিয়ন রিফিউজিকে শেল্টার দিয়েছে, মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিয়েছে, দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছে, সে কারণে ইন্ডিয়ার পছন্দ নয় এমন কোনো মুভ আপনাদের সরকার নিতে চাইবে না।’

‘সে কথাই বলছিলাম ফাহমিদার সঙ্গে।’

‘কী বলছিলেন, আমি কি ঠিক বলছি?’ ঠিক, তবে এর ভেতরে কথা আছে।’

‘বলেন।’

জাফর সাদেকের কফি শেষ হয়ে এসেছিল, নতুন করে মগ ভরতি করে এসে বললেন, ‘এই কফিটার জন্য দিনে কতবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই ভাবতে পারবেন না, ইটস জাস্ট ম্যাজিক্যাল। শেষ হয়ে গেলে কী করব?’

‘চিন্তা করবেন না, কফির সাপ্লাই বন্ধ হবে না। হ্যাঁ, কী বলছিলেন?’

‘সরকার ইন্ডিয়াকে চটাতে চাইবে না, এ ঠিক কথা। এর পেছনে কারণও আছে। ওয়ার প্রিজনাররা ইন্ডিয়ার কাস্টোডিতে রয়েছে, জেনেভা কনভেনশন মেনে ইন্ডিয়া ওদের প্রটেকশন দিতে বাধ্য, দিচ্ছেও। এটা লিগ্যাল ইস্যু। কিন্তু আমার কথা হলো লিগ্যাল ইস্যুর বাইরে হিউম্যানিটারিয়ান ইস্যু কি থাকতে নেই? এটা আমি এখানে কাউকে বোঝাতে পারি না।’

‘সো দিস শুড বি ইয়োর সাবজেক্ট। এ নিয়ে লিখুন।’

জাফর সাদেক জবাব দিলেন না। কফিতে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরালেন। না তাকিয়েও বুঝতে পারলেন অ্যানমেরি তাকিয়ে আছেন তার মুখে

সেদিন বাড়িতে ফিরে কেন যেন মনে হলো একটা অস্বস্তি মাথায় কুটকুট করছে। খুব যে স্বস্তিতে আগেও ছিলেন তা তো না। ব্যাপারটা টেনশন না, একটা কাঁটা খোঁচাচ্ছে। সকালে অফিসে ফাহমিদার কি কথার জবাবে বলেছিলেন তিনি কিছুটা ক্লাউনিশ হয়ে গেছেন। চিন্তা-ভাবনা না করেই বলেছিলেন। এখন ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো না। যাদের সঙ্গেই যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কথা বলেন তারা কিছু সময় কথাবার্তা বলার বা শোনার পর কী রকম চোখে তাকে দেখে। এমনও মনে হয়, কেউ কেউ ভাবে এ বিষয়ে কথা বলার তার কী যোগ্যতা! আর যখন ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কারো সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন, অন্য পক্ষ থেকে তেমন সাড়া মেলে না। ভাবখানা—তুমি কে রে ভাই, ঘরের খেয়ে বনের মোষ-গন্ডার পোষার পাঁয়তারা করছো! ক্লাউনকে দেখে সব সময় মানুষ হাসে তা তো না, করুণাও করে।

আবার অনেকে পরামর্শও দেয়। দেশে আসার পর যে দুই-তিনজন পুরনো সহপাঠীর খোঁজ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন আকরাম, সাংবাদিক। যুদ্ধের সময় ওপারে ছিল, স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করেছে। সেই আকরামের কথায় সেদিন ধাক্কা খেয়েছিলেন, ‘এত যে ফট্‌ফট্ করো, তোমার কী লাভ! কেউ বলেছে এসবের পেছনে লাগতে? দেশে এখন করার মতো কত কিছু, ব্যবসা-ট্যাবসার ধান্দা করো। টাকা-কড়ি থাকলে বিদেশে না রেখে এখানে খাটাও, স্বাধীন দেশে বাঙালির স্বাধীন ব্যবসা, দশ হাজারের একটা মিল্কফুড বা সিআই শিটের ইমপোর্ট পারমিট বের করো, ঘরে এসে নগদ এক লাখে নিয়ে যাবে।’

এটা কি অস্বস্তির কারণ? নওশিন সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোর এই ছোটাছুটি দেখতে ভাল্লাগছে না। এত দিন পর এলি, কোথায় আমাদের একটু সময় দিবি, তা না।’

বাড়ির পরিবেশ এ কয়েক মাসে অনেকটাই তার আয়ত্তে। মা হয়তো বিশ্বাস করেননি তিনি থাকতে এসেছেন, নওশিনও সম্ভবত না। তবে এখন তারা কী ভাবছেন কে জানে!

দেশ ছাড়ার আগে বাবার সঙ্গে তো বটেই, মায়ের সঙ্গেও তেমন অন্তরঙ্গতা ছিল না। নওশিনের সঙ্গে এক সময় থাকলেও তার প্রেম ও বিয়েঘটিত ঘটনায় সম্পর্কে চিড় বা ফাটল তো না, রীতিমতো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সাইজের গিরিখাত তৈরি হয়েছিল যার অবশ্য কোনো কারণ ছিল না, অনেকটাই তার নিজের মনগড়া। ফিরে আসার পর নওশিনের সাথে সম্পর্ক মেরামত হলেও মায়ের ব্যাপারে এত দিনেও দূরত্ব তেমন ঘোচেনি। রাতে খাওয়ার টেবিলে দেখা হয়, খুচরা কথাবার্তাও চলে, কিন্তু এত বছর বিদেশে থাকলেন, কী করলেন, কেমন ছিলেন এসব শুনতে মায়ের বড় একটা আগ্রহ রয়েছে বলে মনে হয় না। তবে নওশিন তাকে আইরিনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আইরিনের নাম না জানলেও তাদের এক সাথে থাকার ঘটনা সে সময়ই নাকি শুনেছিলেন। জাফর সাদেক দু-চার কথায় জবাব দিয়ে বা না দিয়ে পাশ কাটিয়েছিলেন। নওশিনও আর ঘাঁটাঘাঁটিতে যাননি।

শেষমেশ মা-ই সেদিন তাকে অবাক করে জানতে চাইলেন, কী করতে চান? জীবন তো এভাবে কাটবে না। কথাটা বোঝেননি এমনভাবে তাকিয়ে থাকলে মা শান্ত গলায় বলেছিলেন, ‘তুমি কী করতে চাও তুমিই ভালো জানো। তোমার ভালো-মন্দে আমাদের কোনো দিনই থাকতে দাওনি, তোমার মতি-গতি দেখে আমরাও চাইনি তোমার কোনো কিছুতে জড়াতে। এখন কী ঠিক করলে—এখানে থাকবে, না আবার চলে যাবে? চলে গেলে বলার কিছু নাই, যদি থাকো, তা হলে …

তা হলে কী? চাকরি-ব্যবসা কিছু ধরতে হবে, নাকি সেই অগতির গতি বিয়ে-সংসারের দিকে ইঙ্গিত করছেন?

কথা না বুঝলেও, বোঝার জন্য পাল্টা প্রশ্ন করেননি। তাকিয়ে দেখছিলেন মায়ের বয়স হয়েছে, সঙ্গে নানা অসুখ-বিসুখ। হাই প্রেশার, ডায়াবিটিস ছাড়াও কিডনির সমস্যা আছে। প্রায়ই নওশিন নয় শফিক তাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যান। মাসখানেক আগে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল সপ্তাখানেক। জাফর সাদেক তখন ঢাকার বাইরে, ফিরে এসে শুনেছেন, ততদিনে মা বাড়ি ফিরেছেন। ঢাকায় ফেরার দিন রাতে বেশ কিছু সময় মায়ের ঘরের করিডরে হাঁটাহাঁটি করেও ভেতরে ঢোকেননি। মনে হয়েছে মা কী ভাববেন? আর দরজা ঠেলে মায়ের বিছানার কাছে গিয়ে তিনিই-বা কী বলবেন! অভ্যাস নেই।

নিজের ঘরে ফিরে অনেকক্ষণ ভেবেছেন কেন পারলেন না, অভ্যাস না থাকলেও মানুষ কিছু কিছু কাজ করে ফেলে। কোনো না কোনো তাড়না থেকে করে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনি, যতই এ নিয়ে ভেবেছেন মনে হয়েছে এ পরিবারে জন্ম নিলেও পরিবারের একজন তিনি কখনই ছিলেন না, বহিরাগত হিসাবে নিজেকে দেখেছেন। পেছনে কারণ হয়তো তার গোঁয়ার মনোভাব, কিন্তু এর পেছনেও নিশ্চয় কারণ ছিল যা এত দিন পরে মাথায় সাজিয়ে রাখার মানে হয় না। তারপরও কেন যেতে পারলেন না এ প্রশ্নের সদুত্তর পাননি। এক সময় মনে হয়েছে যদি যেতেন, মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বা মশারি সাবধানে সরিয়ে, আরও সাবধানে মাকে ঘুম থেকে জাগাতেন, বিনা শব্দে শুধু গায়ে হাত রেখে জাগাতেন, তা হলে কী হতো? মা-র বিস্মিত চোখ তাকে ভস্ম করে দিত, না কি গা ঝেড়ে তার হাত সরিয়ে দিতেন, না কি কিছু না বলে তার হাতে হাত রাখতেন?

এ পরিবারের কেউ যদি না-ই হবেন, এখানে কেন এসে উঠেছেন? দেশে ফেরা যখন পাকাপাকি ঠিক করলেন, তখন কেন এ বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার কথা মাথায় আসেনি?

মনে পড়ে না এভাবে চিরে চিরে নিজেকে কখনো প্রশ্ন করেছেন। পরের কয়েক দিন যখনি রাতে মায়ের ঘর থেকে ফিরে আসার ঘটনা মনে পড়েছে, আর সেটাকে অবাস্তব ভেবে যতই পাশ কাটাতে চেয়েছেন, মনে হয়েছে পারছেন না। কেন গেলেন না, না হয় একবারই যেতেন, গিয়ে দেখতেন কী হয়? এমনও তো হতে পারত, গিয়ে দেখতেন মা গাঢ় ঘুমে, সাবধানে মশারি সরানো বা সাবধানে গায়ে হাত রাখায় ঘুম তার ভাঙত না। তখন না হয় ফিরে আসতেন, নিজেকে বলতেন গিয়ে তো ছিলাম; না কি এসব বলা-টলার বিষয় নয়, গিয়েছেন বলে আরামে, শান্তিতে চোখভরে ঘুম নামত!

নওশিন তখন প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে আসতেন। মায়ের ঘরেই থাকতেন বেশিরভাগ সময়, তবে তাকে মায়ের অবস্থা জানাতেন, কিন্তু কখনই বলেননি তিনি মায়ের খোঁজ করেছেন কি না। বহিরাগত বলে?

আশ্চর্য যা, একদিন ইচ্ছা হয়েছিল নওশিনকে বলেন মায়ের ঘরে ঢুকবেন বলে দরজা পর্যন্ত গিয়েও ঢোকেননি, ঢুকতে পারেননি তা না। শুনে নওশিন কী করতেন, এও যেন এক বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিল। আবার এও মনে হলো যদি বলতেন, নওশিন হয়তো চুপচাপ তার মুখে তাকাতেন, আর এতে সেই আরামে, শান্তিতে চোখভরে ঘুম নামার মতো একটা অনুভূতি হতো। সত্যি হতো?

খটকা লাগে। যা-ই হোক, দেশে আসামাত্র শাপলার সঙ্গে যুক্ত হতে পারাটাকে ভাগ্য বলেই মনে হয়। ফাহমিদাকে আজ কথাটা বলা ঠিক হয়নি। সরাসরি কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো তার স্বভাবে নেই—ঠাট্টার ঢঙেও না। কথা শুনে ফাহমিদা হাসলেও, আচমকা প্রশ্নটা নিশ্চয়ই তাকে খুব অবাক করেছে।

দিন কয়েক আগে লন্ডনে মালাকাকে ফোন করতে সে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে জানাল সেক্রেটারিয়েটের অবস্থা ভালো না, তিনি চাইলেই ভালো পজিশনে ঢুকতে পারবেন, আগের বস রয় টার্নার যে তাকে ফায়ার করেছিল, নিজেই ফায়ার্ড হয়েছে, ও যে রেসিস্ট ওর কিছু কাজকর্মে এত দিনে পরিষ্কার ধরা পড়েছে। জাফর সাদেক চাইলে ম্যানেজমেন্ট তাকে এখন টিম লিডার করে আনতে রাজি হবে। কী বলবেন! মেয়েটা তাকে পছন্দ করত, তিনি নিজেও তার কাজ ও ব্যক্তিত্বকে সম্মান করতেন। মালাকাকে একথা সেকথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলেন। মালাকা খবর দিল সে বিয়ে করেছে, এও বলল জাফর সাদেক তার বরকে চেনেন। কে হতে পারে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারলেন না। মালাকা তাকে অবাক করে বলল, কেন সঞ্জীব রাঠোরকে কি তার মনে নেই, কমিউনিকেশনে ছিল। সত্যিই বিস্মিত হওয়ার পালা, মালায়াম মালাকার বর মারাঠি সঞ্জীব! আগুন ও পানি এক হবে কী করে! মালাকাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন দেশে কিছু কাজকর্মে ব্যস্ত আছেন। মালাকা তবু তার কথাতেই থাকল—আবার এক সঙ্গে কাজ করতে চায়।

ঘরের ভেতর ফ্যানের ঝড়ো বাতাস সত্ত্বেও গরম লাগছে, আবার ঝিমুনি ও পাচ্ছে। বাইরে শেষবিকালের রোদ। গলিতে রিকশা, গাড়ি চলাচলের আওয়াজ, তবে বাড়ির ভিতরে কারো সাড়াশব্দ নেই। মা হয়তো ঘুমাচ্ছেন, কাজের মহিলাকে কাছে পেলে কফি চাইতেন, ঝিমুনি কাটত। নওশিনের বাচ্চাদের নিয়ে আসার কথা সন্ধ্যায়, এখন বাজে সাড়ে পাঁচ। এলোমেলো ভাবনায় কোন ফাঁকে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খুলল মশার কামড়ে। বাইরে অন্ধকার। আর একি, পাশে গায়ে গা চেপে এ কে? তুলতুলে নাদুসনুদুস? ভালো করে চোখ খুলতে হাসি পেল—বালিশও এমন ধোঁকা দেয়! হাসি পেল বটে, তবে চমকেও উঠলেন

অন্দর থেকে সদর

কেন্দ্রে মেয়েরা কাজকর্ম ভালোই শিখছিল। আমার ইচ্ছা ছিল শেফালি সেলাই নিয়ে থাকুক, সেলাইয়ের দিকে ওর ঝোঁক তো প্রথম থেকেই জানতাম। কিছু দিন সেলাই, এমব্রয়ডারি শিখল, কিন্তু পরে বায়না ধরল বেতের কাজ ধরবে। আমি মানা করে বলেছিলাম, সেলাইটা যখন সে পছন্দ করে, নকশিকাঁথা তার হাতে সুন্দর ফুটবে, আর বাজারে চাহিদাও আছে। সে গোঁ ধরল বেতের কাজই নাকি তার ভালো লাগে, আমি বাধা দিইনি। চম্পার বয়স তখন দুই বছরের কিছু ওপরে। হালকা টিঙটিঙে শরীর, মায়ের চোখমুখ কিছু পায়নি, পাতলা ভুরুর নিচে কটা চোখ আর জোড়া থুতনিতে চেহারাটা রসকষহীন। তবে খুব মিশুক আর চঞ্চল, হাঁটা শিখেছিল বছর না পেরোতেই। নড়বড়ে পা দুটো ঠিক হতে যে কিছু দিন, তারপরই শুরু হলো ওর ছোটাছুটি। মুখে কথাও ফুটেছিল ওর বয়সি বাচ্চাদের আগে। আরও যে কয়েকটা বাচ্চা ছিল ওদের নিয়ে খেলত, তবে মনমতো কিছু না হলে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওদের মারত। সেই ছোট বয়সেই শেফালির কাছে মেয়ের নামে নালিশ আর নালিশ। আমাকে বেশ ভয় করত, ডাকলে কাছে এসে চুপচাপ বসে থাকত। একদিন কী কারণে যেন ধমক দিয়ে আমার ঝোলা ব্যাগ দেখিয়ে বলেছিলাম মারামারি করলে বস্তায় ভরে নিয়ে যাব—সেটা মনে করেই হয়তো ভয় পেত। আর শেফালিও আমার নাম করে ভয় দেখাত, বলত, ‘আসতেছে, বস্তায় ভইরা নিয়া যাইব।’ শেফালিকে বকতাম, ছোট মানুষ, ভয় দেখায় কেন, দেখায় তো দেখায়, আমার নামে! শেফালি হাসত, বলত, ‘ও মা, তুমার নামে ডর দেখামু না তো আর কারে পামু!

ততদিনে মেয়েদের জন্য নানা জায়গায় কাজ খোঁজা চলছে। এ সময় একটা সুযোগ পাওয়া গেল। বীরাঙ্গনা কোটায় সরকারি চাকরির। প্রথমে সুযোগ বলে মনে হয়েছিল, পরপরই চিন্তা করলাম কোটায় যে মেয়ের চাকরি হবে সে তো কপালে ছাপ্পা নিয়েই থাকবে। তার চেয়ে বরং অন্য জায়গায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ খোঁজা যেতে পারে। যিনি মালিক বা চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, শুধু তাকে বলতে হবে চাকরিটা কার জন্য। কয়েকজনের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছিল, এমনকি দুজনের সরকারি চাকরিও, তবে কোটার চাকরি না। এর মধ্যে সোনারগাঁওয়ে ক্র্যাফ্ট ভিলেজ করার একটা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সরকার রাজি ছিল, জায়গাও দিয়েছিল, কিন্তু কাজ এগোচ্ছিল না। প্রথমে আমাদের ধারণা ছিল ওখানে সবাইকে লাগিয়ে দেব। এক সাথে থাকবে, কাজ করবে। এতে ওদের সুবিধা তো হবেই, বড় কথা, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! বুঝতে পারছিলাম না, ক্র্যাফ্ট ভিলেজ আদৌ হবে কি না, হলে কবে?

কেন্দ্র ঠিক আগের মতো চলছিল না। টাকা-পয়সার টানাটানি। কত দিন চালানো যাবে এ নিয়ে আমাদের মধ্যেও নানা কানাঘুষা। দেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছিল, অভাবী মানুষ চারদিকে, রাস্তাঘাটে লাশ। সমাজকল্যাণ দপ্তরে তখন নতুন লোকজন, আগে যারা ছিলেন তাদের আমরা অনেক কথা সরাসরি বলতে পারতাম। পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম পুনর্বাসনকেন্দ্র নিয়ে সরকারের আগ্রহ পড়তির দিকে। মেয়েদের সংখ্যা কমে গেলেও তখনো ইস্কাটনের কেন্দ্রে জনা-পনেরো মেয়ে ছিল, সঙ্গে তিন-চারটা বাচ্চা। ঢাকার বাইরে জেলা শহরেরগুলো ধরলে মেয়েরা কয়েকশ। যারা পেরেছে চলে গেছে, যাওয়ার জায়গা না থাকলেও গেছে। যাদের কোনো উপায় ছিল না তারাই রয়ে গেছে। চাকরি দিয়ে কয়েকজনের ব্যবস্থা করা গেলেও বাকিদের কী হবে এ নিয়ে যেন কারো মাথাব্যথা নাই।

এ সময় পত্রিকায় একটা খবর দেখেছিলাম। সম্ভবত পাবনার পুনর্বাসনকেন্দ্ৰ থেকে একটা বিবাহিত মেয়েকে তার পরিবার নিয়ে গিয়েছিল। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মেয়েটা মাসখানেক ছিল বাপের বাড়িতে। তেমনই কথা ছিল, কিন্তু স্বামী যেদিন তাকে নিতে আসবে বলে খবর পাঠাল তার আগের দিন সে লাপাত্তা হয়ে যায়। কয়েক দিন পর নানা সূত্র ধরে পুলিশ তার খোঁজ পায় দৌলতদিয়া ঘাটের যৌনপল্লিতে। সেখানে সে এক দালালের খপ্পরে পড়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু তার ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই। এও নাকি বলেছে বাড়িঘরের চেয়ে ওখানে ভালো আছে, আরও জানিয়েছিল সে এমনি এমনি যায়নি, আগে থেকেই ওখানে তার মতো আরও কয়েকজন ছিল বলেই গিয়েছে। উড়ো-উড়ো এ রকম খবর আগেও আমার কানে এসেছিল, ঠিক বিশ্বাস করিনি। মেয়েটার নামসহ ছবি ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। সেই সাথে এও লিখেছিল বিভিন্ন পুনর্বাসনকেন্দ্রের দশ-বারোজন মেয়ে আগে থেকেই ওই পল্লিতে ছিল।

আমাদের কেন্দ্র থেকে যারা চলে গিয়েছিল তাদের অনেকেরই খোঁজ-খবর তখন জানা ছিল না। নিজেরা যে খোঁজ নেব তাতে অসুবিধা ছিল, খোঁজ নিতে যাওয়া মানে পুরনো ঘায়ে খোঁচা দেওয়া। সেজন্য কেউ কেউ যাওয়ার আগে বাড়ির ঠিকানা রেখে গেলেও ইচ্ছা করেই খোঁজ নিতাম না।

আমি তখন ভাবতাম যারা রয়ে গেছে তারা সারা জীবন কেন্দ্রে থাকবে না, কেন্দ্রও কবে উঠে যায়, এ অবস্থায় কোনো কাজটাজ জোগাড় করে না দিলে এদের কী অবস্থা হবে! ক্র্যাফ্ট ভিলেজ যখন হবে তখন, আপাতত যে কোনো কিছুতে ঢুকিয়ে দেওয়াই হবে কাজের কাজ।

এ সময় কার পরামর্শে একটা নারী সমবায় সংগঠনের জন্য যোগাযোগ করি। নতুন প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তারা সবাই মেয়ে। রাফিয়া নামে একজনকে পেলাম যে আমার সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। আমাকে দেখে রাফিয়া খুশি হলো, আমিও ভাবলাম দেখা যাক যদি কিছু মেয়েকে তাদের ওখানে ঢোকাতে পারি। তো বললাম কী চাই। তাদের সংগঠনের নামটা সুন্দর—দিশারি। নামেই সমবায়, সমবায়ের কোনো লক্ষণই তার কথাবার্তায় পেলাম না। রাফিয়া জানাল তারা আপাতত একটা ছোট শোরুম চালায় তেজগাঁওয়ে, একটা কারখানাও আছে নাখালপাড়ায় যেখানে শুধু মেয়েরাই কাজ করে। হাতে তৈরি পুতুল, নকশিকাঁথা, বেতের নানা জিনিস, ঝুড়ি, টেবিল ম্যাট, শিকা, শখের মোমবাতি এসব বানানো হয়। সবে শুরু করেছে, তবে বাজার ভালো, তারা জিনিসপত্রের রেঞ্জ বাড়াবে, ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে এক্সপোর্টে যাওয়ার। আমার কথা শুনে রাফিয়া বলল, টাকা-পয়সা সামান্যই দিতে পারবে, তবে মেয়েরা যেহেতু কাজ জানে বলেছি, সে দেখবে কী করা যায়। ঠিক আশ্বাস নয়, তবে আমার কেন জানি মনে হলো রাফিয়ার ব্যবসাবুদ্ধি পাকা, সে অল্প মজুরিতে কেন্দ্রের মেয়েদের নেওয়ার সুযোগটা নেবে। একদিন কেন্দ্রে এসে মেয়েদের কাজ দেখে মনে হলো সে যথেষ্ট সন্তুষ্ট। জিজ্ঞেস করল, কয়জন দিতে পারব। বললাম যে কয়জন নিতে পারে।

কেন্দ্রের অবস্থা যে দিন দিন পড়ে যাচ্ছে মেয়েরা টের পাচ্ছিল। তারপরও কেন্দ্র ছেড়ে যেতে হবে, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে, এ যেন অনেকের জন্য ধাক্কার মতো ছিল। তবে দু-তিনজন এক পায়ে খাড়া, যাদের মধ্যে শেফালি ছিল সবার আগে। রাফিয়া জানাল শুরুতে তারা চারজনকে নিতে পারবে, যারা কারখানায় কাজ করবে, তবে শোরুমের জন্য অন্তত একজনকে দরকার। কী কপাল শেফালির, সেই যে রাফিয়া কেন্দ্রে এসে কাজকর্ম দেখে গিয়েছিল, তখনি যে সে মনে মনে শেফালিকে শোরুমের জন্য ঠিক করে রেখেছিল কী করে জানব!

শেফালিসহ চারজনকে বাছাই করা গেল। ঠিক হলো আপাতত তারা কেন্দ্রেই থাকবে, পরে যে যার মতো ব্যবস্থা করবে, ভালো হয় যদি এক সাথে ঘর ভাড়া করে থাকে। তখন পঁচাত্তর সাল।

দলবেঁধে সবাই রওনা হলো। কেন্দ্রের একজন আয়া ওদের পৌঁছে দিতে গেল। সেদিনের কথা ভুলব না। একে তো সবাই গ্রামগঞ্জের মেয়ে, লেখাপড়া কেউই তেমন জানে না, ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট চেনে না, আর বড় কথা, সেদিনই তারা চার দেয়ালের আবরু ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে—বছর তিনেক পর। শেফালি দল ভেঙে আলাদা হয়ে শোরুমে কাজ করতে বেঁকে বসল। বুঝিয়ে-সুজিয়ে কাজ হলো না, সে অন্যদের সাথে কারখানায়ই কাজ করবে। রাফিয়াকে বলতে সে বলল দেখতে ভালো বলেই সে ওকে শোরুমে রাখতে চেয়েছিল, রাজি যখন হচ্ছে না, কিছু দিন কারখানায় থাকুক, পরে দেখা যাবে। যাওয়ার আগে লাইন ধরে একেকজন পা ছুঁয়ে সালাম করল, টের পাচ্ছিলাম প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে প্রত্যেকেই পায়ে হাত ঠেকিয়ে বসেছিল। চোখে-মুখে কারো হাসি নেই। অনিশ্চয়তায় কি? কেউ জানে না বাইরে কী অপেক্ষা করছে।

দূর-বিভূঁইয়ে যুদ্ধশিশু

চম্পার চোখে পলক পড়ে না, টেলিভিশনে এ কে?

জবার সাথে থাকবে বলে ছুটি নিয়েছিল আধবেলার। ফ্যাক্টরিতে কাজের চাপ কিছুটা কম, কয়েকটা জরুরি চালানের কাজ হয়ে যেতে তাদের ফ্লোরের সবাই গত কয়েক দিন শান্তিতে আছে। দুপুর থেকে জবার সাথে খুব ভালো কেটেছে চম্পার। ইশকুলে জবা নতুন অনেক কিছু শিখছে—ইংরেজি, অঙ্ক। চম্পা না বুঝলেও একেকটা বই-খাতা মেলে মাকে বোঝাতে জবার খুশি-খুশি মুখ দেখে সে অবাক হয়ে ভাবছিল এ সুখ এত দিন কোথায় ছিল! সন্ধ্যায় আম্মার ঘর থেকে জোরে জোরে কয়েকবার চম্পা চম্পা ডাক শুনে ছুটে যেতে টিভির দিকে ইশারা করে বললেন, ‘দেখ।’

একটা বিদেশি মেয়ে ঠাঠাস্ ইংরেজি বলছে, পাশে বসা একজন এদেশি পুরুষ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেই সে কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে। চম্পা কী দেখবে! তাকে ‘দেখ’ বলে আম্মা যে টিভির পর্দায় চোখজোড়া আঠা দিয়ে গেঁথে রেখেছেন, আর যেন কিছুর খেয়াল নাই। চম্পা বোকার মতো কতক্ষণ মেয়েটাকে দেখল, সাদা বিদেশিদের মতো না, কালোদের মতোও না, লম্বা সোজা চুল আঁটো করে বেণি করা। মুখ না চালালে বাঙালি বলেও হয়তো কেউ ভুল করত, তবে অঙ্গ-ভঙ্গি, বিশেষ করে ঘন ঘন ঘাড়-মাথা-হাত নাড়ানোয় বিদেশি ছাড়া কী! বয়স আন্দাজ করা মুশকিল, বাইশ-তেইশ হতে পারে, আবার তিরিশ-একত্রিশ হলেও চম্পার কী আসে-যায়! আম্মা দেখতে বলছেন, সে দেখছে।

কিছুক্ষণ পরে আম্মা মুখ খুললেন, ‘কী দেখলি? তোর মতো ভীতুর ডিম না, পারবি ওর মতো কথা বলতে? তোরই তো বয়সি।’

আম্মার মাথা ঠিক তো? কাকে কী বলছেন, আর কার সঙ্গেই-বা তার তুলনা করছেন! রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে আবার একটা ধাঁধায় ফেললেন, ‘কী বুঝলি?’

জবাব একটাই—মাথামুণ্ডু কিছু না। মুখে বলল না অবশ্য, তবে আন্দাজ করল কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে।

গণ্ডগোল ছাড়া কী! আম্মা এর পর যা বললেন তাতে চম্পা এতই অবাক হলো, কী বলবে কথা খুঁজে পেল না। হাঁ হয়ে শুনল, মেয়েটা এসেছে আমেরিকা না জার্মান না বিলাত থেকে, যুদ্ধের সময় তার মা আটকা ছিল মিলিটারি ক্যাম্পে, যুদ্ধ শেষে তার জন্মের মাসখানেক পর মা-ই তাকে রেখে যায় ইসলামপুরে শিশু ভবনে। এই শিশু ভবন নামটা চম্পা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। সেখান থেকে তাকে দত্তক নেয় এক বিদেশি পরিবার। এত বছর পরে সে এসেছে যদি মা-র খোঁজ পায়। চম্পা অবাক হলো, আম্মা ঠিকই বলেছেন এ তো তারই বয়সি হওয়ার কথা, দুই-তিন মাস এদিক-ওদিক হতে পারে। এই জন্যই আম্মা তার সাথে তুলনা করছিলেন!

মেয়েটা একা একা ঢাকায় এসেছে, উঠেছে এক হোটেলে না গেস্টহাউসে। আগের দিন নাকি খবরের কাগজের লোকজন ডেকে নিজের ঘটনা বলেছে, তাই তো আজ ওকে টিভিতে দেখাচ্ছে। আম্মা বললেন মেয়েটা জানে না আসল মা ওর নাম রেখেছিল কি না, তার ধারণা রাখেনি, রাখলে কি তাকে শিশু ভবনে রেখে যেত! এখন ওর যে নাম এটা ওর পালক বাবা-মায়ের দেওয়া—লিওনা। মায়ের ওপর তার রাগ নাই, তাকে তো পথেঘাটেও ফেলে দিতে পারত। তবে শিশু ভবনে যারা ছিলেন তারা নাকি খাতাপত্রে একটা নাম লিখে রেখেছিলেন, সেটা লীনা। লীনা থেকে লিওনা।

আম্মা বলে যাচ্ছেন, এদিকে চম্পা টের পাচ্ছে তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এমনও হয়? লোক ডেকে বলেছে সে কে, কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানে না—মায়ের নাম, বাড়ি কোথায়, কিছু না। পালক বাবা-মা তাকে কিছু বলতে পারেনি, শুধু বলেছে তারা সরকারের অনুমতি নিয়ে শিশু ভবন থেকে তাকে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের আরও দুজন ছেলেমেয়ে ছিল, ওদের সাথেই সে বড় হয়েছে, খেলাধুলা করেছে, ইশকুলে গিয়েছে, লেখাপড়া শেষ করে এখন বড় চাকরি করে। বিয়ে করেছে, স্বামীও নাকি তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল, সে আনতে রাজি হয়নি। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না এ তারই বয়সি, তিরিশ-একত্রিশ যে ভেবেছিল, তাও বেশি মনে হয়েছিল। চম্পার এখন একচল্লিশ না বিয়াল্লিশ, এরও তা-ই।

‘তুই যে পলাইয়া থাকস, একে দেখলি কত দূর থেকে আসছে মা-র খোঁজে। অবশ্য ও বড় হয়েছে উন্নত দেশে, ওর চিন্তা-ভাবনা আলাদা। নামটা সুন্দর না, লিওনা?’

‘কী বলল?’

‘অনেক কিছু বলল। ছোটবেলার কথা, ওর পালক বাবা-মা ওকে নিজেদের ছেলেমেয়ে থেকে কোনো দিন আলাদা করে দেখেনি। তাদের কাছে শুনেছে তারা যখন ওকে নিয়ে যায়, ওর অনেক অসুখ-বিসুখ ছিল, ওজনও কম ছিল, বেশ কিছু দিন চিকিৎসার পর ভালো হয়েছে। পালক বাবা-মাকে নিজের বাবা-মা বলেই জানে। ওদের বয়স হয়েছে, চাকরির জন্য সে এখন অন্য শহরে থাকে, কিন্তু প্রতি সপ্তায় তাদের দেখতে যায়। মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে এক সাথে থাকতে যায়, ওরাও এসে থাকে তার বাসায়।’

‘আর?’

‘ও জানতে চেয়েছে দেশে যারা যুদ্ধশিশু রয়েছে তারা কেমন আছে? তোকে ওর কাছে নিয়ে গেলে কী ভালো হতো!’

‘ওইখানে মাইনষ্যে ঘিন্নায় না?’

‘এত সময় কী বললাম! ঘেন্না করলে বিদেশ থেকে এত সাধ করে পালক বাবা-মা ওকে দত্তক নিতে আসে! আর বললাম না ও বিয়ে করেছে, স্বামী কী করে তা অবশ্য বলেনি। বলল না স্বামীও আসতে চেয়েছিল? ঘেন্না করলে লেখাপড়া, চাকরি, বিয়ে এসব হয়! চেহারায় কী ধার দেখলি তো, কথাবার্তাও সাফ-সাফ।’

‘আর কী বলল?’

‘চল তোকে ওর কাছে নিয়ে যাই। কোথায় উঠেছে বের করা কঠিন না।’

না না, আম্মা না।’

‘শোন, ও তো ওর মায়ের খোঁজ পাবে না, পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নাম জানে না, ঠিকানা জানে না। ও এসেছে, মনে কর, নিজেকে বুঝ দিতে। এই সুযোগে অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবে, বলা তো যায় না, আমার খোঁজও করতে পারে। না হয়, আমিই গেলাম।’

‘না আম্মা।’

‘কী না না! আমি গেলে তোর আপত্তি কীসের।’

‘আপনে যাইতে চান, যান। আমি না।’

‘না কেন বল, আমি ওকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম তোর কথা। যদি তোকে ওর কাছে নিয়ে যাওয়া যায়! তুই ওর কথা শুনতি, ও শুনত তোর কথা। চিন্তা করিস না, কথাবার্তা বোঝানোর ব্যবস্থা করা যাবে। ওর কথা বাংলা করে তোকে, আর তোর কথা ইংরেজি করে ওকে, হবে না?’

‘আম্মা না।’

‘এত জানের ডর, ও তোকে খেয়ে ফেলবে! ওকে তো টিভিতে দেখলি, ওর কথাও তোকে বললাম, কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছা করছে না?’

চম্পা কী বলবে! কিছু না বলে উঠতে যাবে, আম্মা বলে উঠলেন, ‘ও যদি আমার সাথে দেখা করতে আসে, বলা তো যায় না কেউ আমার কথা বললে আসতেও পারে, তুই তখন ওই দরজার ফুটো দিয়ে চোরের মতো দেখিস।’

আম্মা যা খুশি বলতে পারেন, চুরি করলেই চোর এ কথাটা যে মিথ্যা, আম্মাকে কে বোঝাবে!

রাতে জবার পাশে শুয়ে চম্পা বারবার চমকে উঠল, কী সাহস মেয়ের, কোনো রাখঢাক নাই, মাকে খুঁজতে এসেছে এ কথা সাংবাদিকদের ডেকে বলেছে, টিভিতে পর্যন্ত এসেছে! মায়ের নাম জানে না, বাড়িঘরের খবর জানে না, কোথায় কী খুঁজবে! লিওনা নামটা আসলেই সুন্দর। একটা ব্যাপারে চম্পার খটকা লাগছে, মাকে খুঁজতে এসেছে, কিন্তু কথা বলার সময় চোখে-মুখে দুঃখ-কষ্টের ছাপ-টাপ নাই, এমনকি তাকে মনমরাও মনে হয়নি, চটপটে গলায় কথা বলছিল, আবার মুখটাকে মাঝেমধ্যে হাসি হাসিও করছিল।

হঠাৎ আশ্চর্য কথা ভেবে চম্পা টের পেল বুক ধড়ফড় করছে। এমন যদি হতো তার মা-ও তাকে বিদেশিদের কাছে দত্তক দিয়ে দিত! এটুকু ভেবে সে আর এগোল না। অসম্ভব চিন্তাটা কেন মাথায় টোকা দিল এ নিয়ে ভাবাভাবিতে না গিয়ে জোর করে চোখের ঝাঁপ ফেলল।

পোষ মানানোর হাতিয়ার

রেপের সঙ্গে যদি সেক্সের সম্পর্ক না থাকে, ব্যাপার যদি হয় বিদ্বেষ, তা হলে কি উইপন অব ওয়ার বললেই ল্যাঠা চুকে যায়! ফাহমিদার সঙ্গে মনে আছে এ নিয়ে তর্ক হয়েছিল অনেক দিন আগে। যুদ্ধে কোন পক্ষ কী অস্ত্র ব্যবহার করবে তা বলে দেওয়ার নিয়ম নেই—একে ফোরটিসেভন না থ্রি নট থ্রি, সাবমেরিন না ফ্রিগেট। রেপও তেমনি। ফাহমিদার মতে এটা একটা পারসেপশন, তার নিজের কথা নয়। কিন্তু তারপরও জাফর সাদেকের অনেক দিন ধরেই মনে হয়েছে ব্যাপারটা আরও গভীরের। যুদ্ধ যদি হয় এমন এক হিংস্রতা যাতে বিজয়ী পক্ষ অপর পক্ষকে অস্ত্রবলে হারিয়েই ক্ষান্ত হয় না, তাকে তছনছ করে পদানত করার নানা কৌশলও খাটায়—যার মধ্যে রেপ অন্যতম, তা হলে পেছনে মূল প্রেরণাটা কী?

প্রশ্নটা যে তাকে উত্ত্যক্ত করে, কখনো কখনো এক নাছোড় আচ্ছন্নতায় ঠেলে দেয়, দিকদিশা না পেয়ে নিজের ওপর ক্ষিপ্ত হওয়া ছাড়া পথ থাকে না—এ কাকে বোঝাবেন! বোঝাতে যে চান তা মোটেও না। অনেক দিন তো হলো, দেশে কী ঘটেছিল, কেন রেপকে জেনোসাইড বলে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা গেল না, এসব জানতে বাকি নেই। অবশ্য নিজে যা লেখার লিখেছেন, রাগ-রোষের মধ্যেও মূল কথা যা বলার বলেছেন। এমনও লিখেছেন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার কথা যে বলা হয়—রেডিও-টিভিতে, চায়ের দোকানে, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সমাবেশে হরদম রিনরিনে গলায় বাজে—তা তো দেশের নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত। সাগর হোক বা নদী, কথা একই। কিন্তু এক দল যাদের রক্তের দেখা মেলেনি, রক্তের রঙ লাল কি না সন্দেহ, নদী-সাগর দূরের, ডোবা-নালাও হয়নি, আগেই মুছে সাফসুতরা করে ফেলা হয়েছে, তাদের কথা নেই কেন? বিষয়টা ঢেকেঢুকে রাখার ফল যা দাঁড়াল তাকে কী বলা যায়—অনির্ণীত ইতিহাস, আনরিজলড্ হিস্টরি অব দ্য নেশন?

তারপরও একটা ঘোর ঘোর পর্দা থেকে গিয়েছিল—বিদ্বেষ মেটাতে রেপকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব? দলবদ্ধভাবে ট্রেঞ্চে-বাংকারে, পোড়ো বাড়িতে, স্কুল ঘরে, রেলের ওয়াগনে—লাগাতার, আনরিলেন্টিং! কতটা লক্ষ্যমুখী হলে বিদ্বেষ রেপে রূপ নিতে পারে? এর জবাব কি এই :

Wartime rape has been used as a form of genetic imperialism, where the forcible impregnation through martial rape ‘can undermine national, political, and cultural solidarity, changing the next generation’s identity, confusing the loyalties of all victimized survivors’ and thus can be seen as an act of genocide. Rape in sectarian conflicts such as that which took place in Bangladesh is thus also used as a tool of ethnic cleansing in which it is used to either impregnate women in order for them to bear the ‘enemy’s’ children, or to prevent them from becoming mothers in their own communities by making them socially unacceptable or physically unable to bear children. Rape has been described as an ‘instrument of domestication’, which ‘breaks the spirit, humiliates, tames, produces a docile, deferential, obedient soul’ possessing only that degree of control over their bodies as allowed by men. Martial rape affects not only its immediate victims but also the men connected to the victims. It splits ties between the victims and the rest of society, while helping to form bonds between the rapists. Rape has a symbolic impact, that of dominance, not only over women but also the men who failed to protect them from their aggressors. It may also be relevant to note that martial rape is a practice defined by unwritten rules, for example, that only females are fair game,’ that age does not matter, that soldiers who rape ‘enemy women’ are not to be reported for it, that anonymous publicity of it may be desirable.

ঘোরপ্যাচের ব্যাপার না। রেপ তা হলে এক পোষ মানানোর হাতিয়ার, দখলদার সৈন্যদের এনোনিমাস পিতৃত্বের ফলে যে সন্তানের জন্ম হবে, সে ধর্ষিতার পেট থেকে খসে পড়ামাত্র একটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য ভেঙে দিতে তৎপর থাকবে। পাকিস্তানিদের লক্ষ্য কি এও ছিল যে ভূমিষ্ঠ হয়েই গড়গড় করে বাংলার বদলে উর্দু, পশতুতে বাতচিত জুড়ে দেবে। প্রেরণাটা কি এভাবে গোটা একটা বাহিনীর রেঙ্ক এন্ড ফাইলে কাজ করে—একই বিধিবদ্ধ হিংস্রতায় ও শৃঙ্খলায়?

‘আচ্ছা, এ নিয়ে আপনি এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বলেন তো? এমন তো না যে এসব কথা মাথা খাটিয়ে আবিষ্কার করতে হয়।’

ফাহমিদার কথায় যুক্তি আছে, জাফর সাদেক তো যুদ্ধকালীন রেপকে থিওরাইজ করতে যাচ্ছেন না। এ তার কাজও নয়। তা হলে? এ পোকাটা মাথায় রেখে কী লাভ! দেশে তো তার হয়ে গেল বেশ অনেক দিন, এ নিয়ে কেউ তেমন মুখ খোলে না। বড়জোর যা বুদ্ধিজীবীদের মাথায় নড়েচড়ে তা এ রকম—আমাদের মেয়েদের অনেক ক্ষতি হয়েছে, তারা তো আমাদেরই মা, বোন, মেয়ে। ক্ষতি যতটা পারা যায় পোষানোই এখন কাজ, ওদের পুনর্বাসন, খাওয়া-পরার বন্দোবস্ত করা, আর… আর, আর কী থাকে! প্রায় প্রতি জেলায় পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলো এসবই দেখভাল করছে।

মুখে তারা এসব বলেন না ঠিক, তবে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার ধান্দা যেন নিজেদের আড়াল করতে একটা মস্ত ঢাল। আর পুনর্বাসনকেন্দ্র, ওখানে যারা আছেন তারা নিজেরাই চওড়া পেটা-লোহার ঢাল, মেয়েদের আড়াল করে তাদের কথা বলতে না দিয়ে যেন মহাপুণ্যের কাজ করছেন। মেয়েদের সাথে কথা বলা যে প্রয়োজন, ডকুমেন্টেশনের জন্য প্রয়োজন, আর এ জন্য ভিডিওগ্রাফি ছাড়া উপায় নেই এ কথা কে বোঝাবে! ফাহমিদা অবশ্য কিছু কাজ করেছেন, সেসব কেস স্টাডি। শাপলার পক্ষ থেকে মাঝে মাঝেই তাকে মেয়েদের সাথে কথা বলতে হয়, সে সুবাদেই কেস স্টাডি।

ফাহমিদার কেস স্টাডি নিয়ে জাফর সাদেকের আপত্তি। অন্তত গোটা তিরিশেক কেস তো হবেই। এসবের কোনোটাই ঢাকা বা ঢাকার বাইরের পুনর্বাসনকেন্দ্রে গিয়ে করা হয়নি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাপলা যেসব মেয়েদের সাহায্য করছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে রেকর্ড করা জবানির ওপর ভিত্তি করে তৈরি কেস স্টাডি। প্রথম যেদিন জাফর সাদেক শুনলেন ফাহমিদা এ কাজে প্রায়ই নানা জায়গায় যান, কখনো একা, কখনো তারেক বা মান্নিকে নিয়ে, তিনি কিছু বলেননি। বরং মনে হয়েছিল ফাহমিদা যখন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেই কাজটা করছেন, তাকে সঙ্গে রাখলে ক্ষতি কী হতো!

কথাটা একদিন বলেও ফেললেন। ফাহমিদার জবাব রাখঢাকহীন। মেয়েরা নাকি তাকে দেখলে কথা বলবে না, আর প্রতিটা কেস স্টাডিতে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়, নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়। ফাহমিদা তাদের পরিচিত, সেটাও বড় কথা নয়, মেয়েরা তাকে বিশ্বাস করে।

‘আমাকে বিশ্বাস না করার কারণ?’

‘ওরা তো আপনাকে চেনে না, তার ওপর আপনি পুরুষ, তার ওপর আপনার হাতে থাকবে ক্যামেরা। এলাকায়ই ঢুকতে পারবেন না।’

‘আপনি যে মুখে মুখে শুনে একেকটা কেস তৈরি করেন, এর বিশ্বাসযোগ্যতা কী?’

‘মানে, বানিয়ে বানিয়েও তো লিখতে পারি?’

‘সে কথা বলছি না।’

‘তবে?’

‘কাজটা তো করছেন ডকুমেন্টেশনের জন্য। আর ডকুমেন্টেশনের প্রথম কথা অথেনটিসিটি।’

‘অথেনটিক না এ প্রশ্ন কেন উঠবে?’

‘আমি বলছি না প্রশ্ন উঠবে, তবে উঠতে তো পারে। আপনি কি মেয়েদের নাম-ধাম সব বলে দেন? এলাকার ঠিকানা মেনশন করেন?

‘না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত নামই ব্যবহার করি, কারো কারো বেলায় অন্য নাম বসিয়ে দিই, তবে সেটা যে প্রকৃত নাম না, তা বলি।

‘ঠিকানা?’

‘প্রিসাইজ ঠিকানা না। জেলা বা মহকুমার উল্লেখ থাকে।’

‘তা হলে অথেনটিসিটির কী থাকল?’

‘প্রত্যেক কাজেরই একটা নিজস্ব প্যাটার্ন থাকে, ফরমেটও বলতে পারেন। সেটা তো অকারণে হয়নি, প্রয়োজনেই হয়েছে। প্রাইভেসি এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা মেনটেন করাটা দায়িত্ব।’

জাফর সাদেক কথা বাড়ালেন না। মনে হলো, এ নিয়ে তর্ক করলে ফাহমিদা এ ধরনের কেস স্টাডি আর কোথায় কোন দেশে কিভাবে হয়েছে সেসবের উদাহরণ টেনে আনবেন। বলা যায় না কিছু নমুনাও সামনে মেলে ধরতে পারেন। অ্যানমেরি এমনি এমনি তাকে প্রফেসর ডাকেন না।

কথা না বাড়ালেও ফাহমিদা বোঝা গেল কিছু বলার জন্য রীতিমতো তৈরি, বললেন, ‘ডকুমেন্টেশন ঘটনার প্রাইমারি, প্রত্যক্ষ বিবরণ, আজ যে আমরা হিটলারের গেস্টাপোদের এত এত ঘটনা জানি, বা অটোম্যানদের হাতে আর্মেনিয়ান ম্যাসাকারের, সেসবের অনেক প্রকৃত ঘটনা উঠে এসেছে বিচ্ছিন্ন ডকুমেন্টেশন থেকে। ডকুমেন্টেশন ইতিহাস নয় ঠিকই, কিন্তু ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসাবে ঐতিহাসিকদের অনেক ভুলত্রুটি ডকুমেন্টেশনে ধরা পড়ে, এমন অনেক সত্য বেরিয়ে পড়ে যা কনভেনশনাল ন্যারেটিভকে বদলে দেয়। আমি যা করছি তা ছিটেফোঁটা, রিসার্চার তো না, সেদিক থেকে বলতে পারেন প্রাইমারি কিছু তথ্য বা ঘটে যাওয়া ঘটনার কাঁচা, রো বিবরণ। তবে আমার জানা মতে অনেকে আছেন যারা ভালোভাবে পরিকল্পনা করে করছেন। একটা সময়ের ইতিহাস তো কেবল ইতিহাসবিদেরা লেখেন না, সমাজের সবাই মিলে লেখেন, কলম না ধরেও লেখেন।’

শেষ বাক্যটা বেশ, শুনতে ভালো লাগে, যদিও অর্থহীন। জাফর সাদেক মজা পেলেন, বললেন, ‘চলেন আজ আপনাকে লাঞ্চ খাওয়াই।’

‘আমার কথা আপনার কাছে ঠাট্টার মতো লাগছে?

‘মোটেও না। তবে ব্যাপার হলো আগের দিনে তো টেকনোলজি ছিল না, এখন আছে, আর তাই লিখে রাখার চেয়ে ভিডিওগ্রাফি বা ডকু ফিল্ম মিডিয়াম হিসাবে অনেক ইফেক্টিভ, পাওয়ারফুল

‘সত্যি ঠাট্টা করছেন না?’

‘কী আশ্চর্য! কোন কথাকে নিয়ে ঠাট্টা করব! আপনি তো কুল, আমার মতো তো না। আমাকে নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে, মুখে না বললেও বুঝি। আপনাকে নিয়ে যে ঠাট্টা করবে সে একটা ম্যাডকেপ। চলেন।’

‘কোথায়?’

‘কাছেই, মিরপুর রোডে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে না? নামে চায়নিজ আসলে কী কে জানে!’

দিনেদুপুরে প্রায়ান্ধকার রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুই পা ফেলতেই জাফর সাদেক হোঁচট খেলেন, সম্ভবত সদ্য পাতা কার্পেটের না-ভাঙা ভাঁজে জুতার সংঘর্ষে। পড়েই হয়তো যেতেন, ফাহমিদার গায়ে জোর আছে বলতে হবে, শক্ত হাতে কনুই আঁকড়ে ধরে থাকায় টাল সামলে বললেন, ‘এরা অন্ধকার করে রাখে কেন?’

একজন ওয়েটার ছুটে এসেছিল। জাফর সাদেক তাকে লক্ষ করে বললেন, ‘কার্পেটটা কোন জায়গার ভাই?’ ওয়েটার তার গলায় সম্ভবত সেদিনই প্রথম পরা ঝুলঝুলে বো-তে হাত ঠেকিয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে একটা খালি টেবিল দেখিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনারা এখানে বসেন।’

‘কার্পেটটা কোথাকার বললেন না। আমার এ রকম একটা দরকার, ঘরে ভালো ব্যায়াম হবে।’

ওয়েটারকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারই দেখানো টেবিলের দিকে এগোতে গিয়ে জাফর সাদেক ভাবলেন তিনি নিজে হাঁটছেন, না ফাহমিদা তাকে ধরে ধরে হাঁটাচ্ছেন। টেবিলের কাছাকাছি আসা পর্যন্ত ফাহমিদা যে তার কনুই চেপে ধরে আছেন, এ যেন ফাহমিদারও খেয়াল নেই। কিন্তু এতক্ষণ ধরে ছিলেন, হঠাৎ ছাড়েন কী করে এ কথা মনে করেই হয়তো চেয়ার টেনে জাফর সাদেককে বসানো পর্যন্ত আলতো করে হলেও কনুই ধরে থাকলেন।

‘লেগেছে?’

‘আরে না। বললাম না এ রকম একটা পেলে ঘরে মাঝেমধ্যে আছাড়-টাছাড় খেলে শরীর ফিট থাকবে।’

‘সব কিছু নিয়ে মজা, আছাড় খেলে শরীর ফিট থাকে?’

‘শুধু শরীর না, মনও।’

মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার দিয়ে ফাহমিদা গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘অনেক দিন হয়ে গেল, না?’

‘কীসের?’

‘আপনার দেশে আসার।’

‘হ্যাঁ, টাইম ফ্লাইজ।’

‘মিস করেন না?’

‘ইংল্যান্ডকে? নাহ্। আপনাকে তো বলেছি আমার ওখানে করার কিছু ছিল না। অবশ্য এখানেও …’

ফাহমিদা অন্য প্রসঙ্গে গেলেন। ‘অনেকটা সময় তো দেশে কাটিয়ে গিয়েছিলেন, লেখাপড়ার পুরো সময় …’ বলে কী দিয়ে কথা শেষ করবেন ঠিক করতে না পেরে বেফাঁস বলে ফেললেন, ‘কিন্তু তেমন এটাচমেন্ট গড়ে ওঠেনি, স্যরি, মনে কিছু করবেন না।’

‘মনে করার কিছু নাই। এটাচমেন্ট আমার কোথাও নাই।’

‘আমি সে অর্থে বলিনি, মানে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও তেমন …’

‘বললাম তো আমার কোথাও এটাচমেন্ট নাই, থাকলে বেঁচে যেতাম। আমি কোথাও বিলং করি না, এটা কোনো গর্বের কথা না, আনফর্চুনেটলি ইটস দ্য রিয়েলিটি উইথ মি।’

‘এ কথা ঠিক না। এটাচমেন্ট যদি না থাকবে সব ছেড়েছুড়ে আসতে পারতেন?’

‘ফাহমিদা, আমার কিছুই ছিল না যে ছেড়েছুড়ে আসব। আমি ডাক্তার জাফরুল্লাহ বা এবিএম মোবিন না—ওরা সত্যিকার অর্থে সব ছেড়েছুড়ে এসেছে।’

‘তা হলে আপনি যে এলেন, এত কাজ করলেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে এত লেখালেখি করলেন বা এখনো করে যাচ্ছেন?’

‘এসব এটাচমেন্টের কারণে?’

‘তো?’

‘কীসের প্রতি?’

‘আবার জিজ্ঞেস করছেন? দেশের প্রতি। আপনি যা লেখেন সেসব তো একাডেমিক পারপাসে না, প্রচণ্ড আর্জ থেকে লেখেন। আপনি যতটা লিখেছেন বা ডকুমেন্টেশন করেছেন, দেশ-বিদেশে প্রচার করেছেন, সেভাবে আর কেউ করেছে!’

‘একটা কথা বলবেন, সিরিয়াসলি?’

‘কী?’

‘আপনার কি সত্যি মনে হয় এসবের কোনো ভেল্যু আছে?’

‘কী আশ্চর্য, এ কথা আমার কাছে জানতে চাচ্ছেন!’

‘হ্যাঁ, চাচ্ছি।’

‘আপনাকে যা ভেবেছিলাম আপনি তা না, আপনার নাইভিটি দুঃখজনক।’

‘জানতে চাওয়া নাইভিটি? মানে যতটা ধুরন্ধর আমাকে ভেবেছিলেন আসলে ততটা নই?’

কথার পিঠে কথা চলতে পারত। ফাহমিদা সেটা বুঝেই যেন নখ খুঁটতে লাগলেন। ওয়েটার ট্রে-তে করে খাবার নিয়ে আসতে ফাহমিদা টেবিলে প্লেট-ডিশ গোছগাছ করতে করতে অনেকটা যেন আনমনে বললেন, ‘আপনি জানেন আপনি কী করেছেন, কী করতে চান, অন্য কারো মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নাই। আপনি তো কারো মতামত নিয়ে কাজগুলো করেননি। আপনার নিজের জাজমেন্টই সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট।’

জাফর সাদেক কথা বললেন না। খাবার কেমন এ নিয়ে দুজনের কেউ কিছু বললেন না। এক সময় প্লেট-চামচের টুংটাং ছাপিয়ে ফাহমিদা বললেন, ‘আমি এক জায়গার খোঁজ পেয়েছি, কয়েকজন মেয়ে, রেপ ভিকটিম, ওখানে কাজ করে। একটু সময় লাগবে, আমি চেষ্টা করছি, কথাও বলেছি।’

জাফর সাদেক যেন ঠিকমতো শুনতে পেলেন না।

ফাহমিদা বললেন, ‘আশা করি সাক্ষাৎকার রেকর্ড করতে পারবেন, ভিডিওগ্রাফি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *