আজগর না আজগরের ভূত

আজগর না আজগরের ভূত

আজগরের কত সাহস, বস্তিতে ঘর চিনে যাওয়ার পর ফ্যাক্টরিতে এসে হাজির! সারা দিন ডিউটি শেষে ওভারটাইমের তিন-চার ঘণ্টা মেশিনে ঝুঁকে থাকার পর নিজের ঘাড়-মাথা-হাতকে নিজের না, মেশিনেরই বাড়তি ঘাড়-মাথা-হাত মনে হয়। চম্পা যে একাই এমন ভাবে বলা যাবে না, জানতে চাইলে কে না বলবে হাতে সাড়া পায় না, ঘাড় নাড়াতে পারে না, আর মাথাটা যদি নিজেরই হবে, মেশিনের ববিনের মতো ঘুরে ঘুরে চক্কর কেন কাটে? আর ব্যথা, সারা গায়ে এত ব্যথা—টনটনে, ঝিনঝিনে না—যেন ব্যথারও হাত-পা আছে, সেই হাত-পা-ও ব্যথায় অবশ।

সেদিন বেরোতে বেরোতে রাত প্রায় নয়টা। সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হচ্ছিল, সারা দিন বসে থেকে খিল ধরা ঘাড়-পিঠ-কোমর টেনে গেট বরাবর পা ফেলতে খোলা বাতাসে সবে একটু একটু করে খিলগুলো আলগা হচ্ছে, এমন সময় গেটের পাশ থেকে—’একটু শুনবা’। ঘুরে তাকিয়ে রাস্তা ও গেটের আলোয় যাকে দেখল সে নির্ঘাত আজগরের ভূত, চম্পা এক নজর তাকিয়ে পা চালিয়ে ফ্যাক্টরি থেকে দলে দলে বেরোনো মেয়েদের একটা দলে ভিড়ে গেল। মনে মনে বলল মান্তুর পথ আগলে সাহস বেড়ে গেলে আমার পথ আগলে দেখুক কী করি!

কিছু পথ এক সাথে গিয়ে দল থেকে আলাদা হয়ে গেলেও পা তার জোরেই চলেছে। পেছন ফিরে তাকানো দূরের, ডানে-বাঁয়েও চোখ না ফেলে একই তালে বস্তির মুখে কানাফুরকানের দোকানে পৌঁছে হাঁটার বেগ কিছুটা কমিয়েছে। ঘরে ঢুকে দরজা আটকে পানি খেয়েছে প্রায় পুরো জগ। মান্তু নেই, খাবার বেড়ে রেখেছে। খিদায় বুকে-পেটে আগুন, রাগে মাথাটাও জ্বলছে। কয়েক বালতি পানি না ঢাললে মাথা ঠান্ডা হবে না, কিন্তু দরজা খুলতে ভয় ভয় করছে। মান্তু এত রাতে কোথায় গেল! কিছু সময় অপেক্ষা করল চম্পা, যদি আজগরের সত্যিই সাহস বেড়ে গিয়ে থাকে আর ঘর পর্যন্ত চলে আসে! এমন সময় দরজায় দুমদুম ঘা পড়তে সে আঁতকে উঠল। চম্পাবু চম্পাবু বলে মান্তুর গলা শুনে নিশ্চিত হয়ে দরজা খুলল।

বেশ রাত করে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে মান্তুকে দেখল মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে হাঁটুর ওপরে সাদা কাপড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে জোরে জোরে চিরুনি চালাচ্ছে। মাথাভরতি উকুন, কয়েক দিন পর পর মাথায় উকুনমারা তেল দেয়, কাজ হয় না। চম্পা প্রথম থেকেই সাবধান করে দিয়েছিল মাথা থেকে উকুন ছাড়াতে, এক বিছানায় ঘুমায়, কিন্তু কী কারণে কে জানে মান্তুর মাথার উকুন তার মাথা থেকে চম্পার মাথায় পাড়ি দেয় না। সেদিন যে ওকে বলেছিল শাহজাদাকে খবর দিতে এ নিয়ে আর কথা হয়নি। মান্তু হয়তো ভয়ে ভয়ে আছে কখন চম্পা কথাটা তোলে। তোলার সময় কি হয়েছে? ফ্যাক্টরি চেনাতে কি এবার আজগর মান্তুর পথই আগলায়নি, সত্যি সত্যি পায়ে পড়েছে?

মান্তু যেমন বলেছিল শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে, এক নজর দেখে চম্পার সে রকমই লেগেছে। দড়ি পাকানো চেহারা, বড় অসুখ-বিসুখ হওয়াই স্বাভাবিক। দশ-এগারো বছর আগের আজগরের ভূত বলেই মনে হয়েছে। কী বলছিল এখন আর মনে করতে পারছে না। নাম ধরে ডাকেনি চম্পা নিশ্চিত, একটু খাড়াও বলেছিল, না একটু কী? একটু-টা শুধু মনে আছে। কী চায় তার কাছে? এত রাতে ফ্যাক্টরির গেটে দাঁড়িয়েছিল, জানল কী করে চম্পার ওভারটাইম? দাঁড়িয়ে তো ছিল নিশ্চয় অনেকক্ষণ, এত রাতে বাড়ি ফিরে যাবে, না কি এখন ঢাকায়ই থাকে? আবার দারোয়ানগিরি ধরেছে কোনো বড় লোকের বাড়িতে-যে স্বাস্থ্য, দারোয়ানের চাকরি এখন কেউ দেবে না।

মান্তু সেই যে বসেছে, উকুনের গোষ্ঠী খতম না করে মনে হয় না উঠবে। চোখে আলো লাগছে চম্পার, কিন্তু আলো নেভাতে বললে ওর সাথে কথা বলতে হয়। আজ পাঁচ দিন কথা বন্ধ। চম্পা বলে না, তাই বলে মান্তুর মুখ বন্ধ থাকে না, কাজের কথা বলে, চম্পার মুখে হ্যাঁ না-ও নাই। চম্পা যে কথা বন্ধ করে আছে এটা বুঝতে তার সময় লেগেছে, অন্তত দিন দুয়েক তো লেগেছেই। চম্পার এখন মনে হচ্ছে মান্তু মিথ্যা বলেনি, আজগরই জোর করে ঠিকানা আদায় করেছে। তবে সব কিছুর গোড়ায় মান্তুর সেই কথাটা, গলার রগ ফুলিয়ে নাকি বলেছে চম্পা ভালো আছে। গাধার গাধা, তুই কি কাকলাশ যে গলার রগ ফুলিয়ে আজগরের রক্ত শুষে নিবি! না কি ব্যাপার ওই রকমই, আজগরকে শিক্ষা দিতে রগ ফোলানো? তুই শিক্ষা দেওয়ার কে! কী কথা, রগ ফুলিয়ে বলেছে!

ঘুম ঘুম চোখে মান্তুর চিরুনির বেদম খসর খসর আওয়াজ কানে নিয়ে চম্পা ভাবল এবার তবে সত্যিই এ বস্তি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, সঙ্গে চাকরিটাও! একবার যখন আজগর দেখা দিয়েছে, আরও দেবে।

.

ভোরে চোখ খুলতে আবার সেই রাত পর্যন্ত মেশিনে ঝুঁকে পড়ে ঘাড়-মাথা-হাত মেশিনকে বিলিয়ে দিতে হবে ভাবতে শরীরের নানা জায়গা কোরাসে কঁকিয়ে উঠল চৌকি থেকে নামবে, তখনি গত রাতের কথা মনে হতে চম্পা গা ঝাড়া দিয়ে লাফিয়ে নেমে দরজা খুলল। বাইরে সবে আলোটা রাতের কালি ঝেড়ে সাফসুতরা হচ্ছে। শীত-শীত হাওয়ার গন্ধ লাগছে নাকে। দরজার দুই পাটে হাত রেখে বুক টানটান করে সে শ্বাস নিল, বস্তি হলেও ভোরবেলার হাওয়াটা টাটকা। কী ভেবেছিল রাতে? বস্তি ছাড়বে, সঙ্গে চাকরিও? ভূতে ধরেছিল বলেই এমন কথা ভেবেছিল।

আজগরের ভূত বা অন্য ভূতই হোক, সে কেন ভূতের ভয়ে পালাবে? জীবনে প্রথম এভাবে চিন্তা করতে পারছে ভাবতে দরজার পাল্লা দুটো জোরে চেপে ধরতে মনে হলো নড়বড়ে হলেও পাল্লা দুটো তাকে সাহস জোগাচ্ছে, পরপরই সে মান্তু মান্তু বলে ডাকল। মান্তুর সাথে যে কথা বন্ধ মোটেও ভোলেনি। মান্তুকে ধাক্কিয়ে ঘুম থেকে তুলে বলল, ‘আর কত ঘুমাইবি ছেমড়ি, উঠ।’

কড়া-প্যাচ ওড়না ও অন্য শেফালি

জাফর সাদেকের কাজে বাগড়া দিয়েছিলাম ঠিকই, কেন্দ্রে তাকে ভিড়তে দিইনি, যদিও তার গোঁয়ার চোখমুখ বলছিল সে যা করতে চায় করে ছাড়বে। সে যেন ওঁৎ পেতে ছিল, আর কী আশ্চর্য, শেষপর্যন্ত ধরল তো ধরল শেফালিকেই। তবে সে নিশ্চয় কল্পনাও করেনি শেফালি এভাবে শান্ত, ঠান্ডা গলায় বোমা ফাটাবে। সে তো চেয়েছিল একজন বীরাঙ্গনাকে যে চোখ ভিজিয়ে নিজের যন্ত্রণার কাঁদুনি গাইবে, এর বেশি তার কী আশা করার ছিল! কিন্তু যাকে পেল, সে চোখ ভেজানো বা কাঁদুনি গাওয়া দূরের, ক্যামেরার আলো-ঠিকরানো চোখে চোখ রেখে কী অবলীলায়ই না বলে গেছে—কোনো উসকানি ছাড়া কথার পিঠে কথা বসিয়েছে, যেন নিজে না, অন্য কেউ তার গলায় বসে একের পর এক কথা জুগিয়ে গেছে। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে উত্তেজনায় জাফর সাদেকের কি তখন মনে হয়নি এতটা আশা করেনি? আলোয় ভেসে যাওয়া মুখ মোমের মতো গলছিল, এদিকে শানিত চোখের ঈষৎ কোঁচকানো ভঙ্গি মুখের কথার চেয়ে যেন বেশিই বলেছিল। সেই না-বলা কথার হদিস পেতেই কি জাফর সাদেক প্রশ্নটা করেছিল, তার পর জবাবটা যখন শুনল, সে কি তার কানকে বিশ্বাস করতে পেরেছিল?

দশ-বারো মিনিটের ভিডিওতে শেফালি মিনিট ছয়-সাতেক। ইংরেজি, বাংলা কমেন্টারিসহ অত্যন্ত যত্ন নিয়ে কাজটা করেছিল জাফর সাদেক। সেই সাথে সে যে উঁচু মানের স্টিল ফটোগ্রাফার তার প্রমাণ দিতে নানা এঙ্গেল থেকে শেফালির বেশ কিছু ছবিও তুলেছিল।

ভিডিও বানিয়ে, ছবি তুলে তার রাগ-রোষ কতটা ঠান্ডা হয়েছিল বলতে পারব না, সে শেফালির বড় বড় ছবিসহ দেশি-বিদেশি পত্রিকায় প্রতিবেদন ছেপেছিল। অ্যালবাম করেছিল ইংরেজি-বাংলায় যার মলাটজুড়ে ছিল শেফালির মুখ, আর মুখজুড়ে আলোকচ্ছটাময় তীব্র চোখ। শেফালির সেই মুখ মানুষ লুফে নিয়েছিল। বীরাঙ্গনা নিয়ে যাদেরই কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়েছে, শেফালির মুখটা মনে পড়েছে। পত্র-পত্রিকায় তখন শেফালির ছড়াছড়ি। জাফর সাদেক তা-ই চেয়েছিল, শেফালিকে তার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়া।

বেশি দিন লাগেনি, শেফালির ফলভোগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আগেই আমাকে বলেছিল কেন্দ্রে থাকতে তার ভালো লাগে না। এর মধ্যে অন্য জায়গায় নিজে নিজেই কাজ জোগাড় করেছিল। যেখানে কাজ করত তার কাছাকাছি ঘর ভাড়া করেছিল, চম্পাকেও নিয়ে গিয়েছিল, কাজে যেতে চম্পাকে সঙ্গে নিত। আমি কিছু বলিনি, সত্যি বলতে, তার এই মনোবলকে উপভোগ করছিলাম। অনেক মেয়েকে দেখতাম তার উল্টো, নিজেদের চেষ্টায় কিছু করবে ভাবতে পারত না, আড়ালে-আবডালে থাকতে চাইত। শেফালি যে সে রকম না, ভুলটা অল্প দিনে ভেঙে যেতে স্বস্তি পেয়েছিলাম। পুনর্বাসনকেন্দ্র উঠে যাবে-যাবে করছে, এ সময় মেয়েরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে ফেললে তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকে না। সরকারও তা-ই চাইছিল, ভাবখানা—অনেক দিন তো মাগনা থাকা-খাওয়া হলো, আর কত, এবার পথ দেখো।

পথ দেখতে গিয়ে শেফালি হয়তো বেশিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল। হতে পারে কেন্দ্রে অনেক দিন পার করে তার মনে হয়েছিল বাইরের আলো-হাওয়ায় টিকতে গেলে কিছুটা বেপরোয়া না হয়ে উপায় নাই। জাফর সাদেক কার মাধ্যমে তাকে পেয়েছিল জানি না, তাকে নিয়ে কী করতে চায় তা কি ভেঙে বলেছিল, রাজি করাতে কি খুব বেগ পেতে হয়েছিল—এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিতে যাইনি। ততদিনে শেফালির কপাল পুড়তে শুরু করেছে। প্রথমে চাকরি খোয়ানো, তার পর ঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়া দিয়ে যা শুরু হয়েছিল তা নিশ্চয় তাকে এতটাই হতভম্ব করে দিয়েছিল, সে ভেবেছিল এর নাম বাইরে আসা! মাত্র অল্প দিনেই বাইরের আলো-হাওয়া তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। শেফালি লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল।

অনেক দিন খোঁজ-খবর না পেয়ে সম্ভব সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করলাম। যে মহিলা সমবায়ে আরও তিনজনের সঙ্গে ওকে কাজে লাগিয়েছিলাম, সেখানে কেউ ওর খবর জানে না। পরে যেখানে নিজে থেকে কাজ জোগাড় করেছিল সেখানে গিয়ে শুনলাম তারা তাদের কাজের পরিবেশ নষ্ট হতে দিতে চায় না, তাই মানে মানে কেটে পড়তে বলেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রে ফিরে আসবে না জানতাম, কিন্তু আমার ঘর যে ওর জন্য খোলা তা তো ভালো করেই জানত। কিন্তু গেল কোথায়? সঙ্গে আবার আড়াই-তিন বছরের চম্পা। গ্রামে চলে যাবে, এ তো কল্পনারও অতীত।

মন খারাপ করে জোড়াতালির দিন পার করছিলাম। এ সময় পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের ঘটনা। রেডিওতে মেজর ডালিমের গলাচেরা ঘোষণা শুনে মনে হয়েছিল কানে তালা লেগে গেল, যেন এই মাত্র সপরিবারে শেখ মুজিবকে মেরে রক্তমাখা জামাকাপড়েই রেডিও স্টেশন দখল করতে এসেছে। পরের কয়েকটা দিন পাথর হয়ে বুকে চেপে থাকল। দিনে দিনে পট বদলাতে লাগল, খুনিদের সাঙ্গোপাঙ্গ বাড়তে লাগল, হাঁ হয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া তখন করার কী ছিল!

আগে যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, তা-ই হলো। পুনর্বাসনকেন্দ্র নিয়ে খুনি সরকারের মাথাব্যথা নেই। উঠেই গেল পুনর্বাসনকেন্দ্র। মেয়েরা যারা তখনো ছিল, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে, তাদের এক রকম ঠেলে বিদায় করা হলো। কে কোন দিকে ছিটকে পড়ল সে খবর তখন কে রাখে!

কেন্দ্র উঠে যেতে আমি বেকার হয়ে পড়লাম। হাতে কাজকর্ম নাই, এদিকে মাথাভরা দুশ্চিন্তা। মাস কয়েক যেতে একদিন একটা চিঠি পেলাম, কেন্দ্রের ঠিকানায় লেখা, পিয়ন ছেলেটা আমার জানাশোনা বলে বাসায় চিঠি পৌঁছে দিল। শেফালির চিঠি। পড়াশোনা অল্পই করেছিল, বানান-টানানের ঠিক ছিল না, তবে হাতের লেখা ছিল সুন্দর, কেন্দ্রে থাকতে কখনো কখনো অন্যদের হয়ে চিঠি লিখে দিত। ছোট কয়েক লাইনের চিঠি, এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম। শেফালি লিখেছিল, সে ঢাকাতেই আছে, এক বাসায় আয়ার কাজ করে, চম্পা তার সঙ্গেই থাকে। আমার কাছে আসতে মন চায়, কিন্তু সাহস পায় না। চিঠিতে ঠিকানা দেয়নি, বুঝলাম ইচ্ছা করেই দেয়নি যাতে তার খোঁজ না করি।

চিঠি পেয়ে মনটা দমে গেল। কোথায় আশা করেছিল নিজে কিছু একটা করবে, করতে যে পারত এ নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। এখন মানুষের বাসায় আয়াগিরি করছে। কেন জানি মনে হলো আমার ওপর তার অভিমান জমে আছে। সে যখন চরে-ফিরে দুনিয়া দেখবে বলে বেরিয়ে গেল, তখন তো আমি কিছু বলিনি, বুদ্ধি-পরামর্শও দিইনি, এর ফলে না বুঝে না জেনে বিপদে পড়ল। এমন চিন্তা সে করতেই পারে, কিন্তু আমি তো চেয়েছিলাম সে তার মনোবল ও সাহস নিয়ে নিজে নিজে টিকে থাকার পথ বের করুক। করে সে ফেলত, যদি না জাফর সাদেকের ফাঁদে গাধার মতো শুধু পা-ই না, মাথা-গর্দানও ঢুকিয়ে দিত।

এর মাস দুয়েক পর এক সন্ধ্যায় শেফালিকে দেখে চমকানোর পালা। খোলা দরজায় ওর পাশে চম্পাকে না দেখলে সাধ্য ছিল না ওকে চেনার। কপাল ঘেরা ওড়নার ঘোমটায় চোখ-নাক-ঠোঁট ছাড়া মুখের প্রায় সবটুকুই ঢাকা। ভিতরে আসার পর আমি ভেবেছিলাম কান্নাকাটি করবে। শেফালি করেনি, ওড়না খোলার সময় খেয়াল করছিলাম সেটা কায়দা করে পেঁচিয়ে সেফটিপিন গেঁথে আটকানো। আমার তখন সেই প্রথম দিন অস্থায়ী কেন্দ্রের মেঝেতে তার পড়ে থাকার ঘটনা মনে পড়ছিল। কদমছাঁট চুলে ছোট এইটুকু মাথা, মুখে চোখে পড়ার মতো ডান ভুরুর জড়ুল। আমি তখন সেই অনেক দিন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে তার মাথাটা কাছে টেনেছিলাম। ওড়নার চাপে চুল বসে গিয়ে মাথাটা ছোট দেখাচ্ছিল। সেই দিনের কথা মনে করেই কি না তার মাথাটা বুকে নিতে গিয়ে হঠাৎ থমকে থেমে গিয়েছিলাম।

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ক্যাম্প থেকে বের করে আনা সেদিনের শেফালি আর ওই দিনের শেফালিতে যেন কোনো তফাত নেই, আবার ছিলও। আমার পরিষ্কার মনে পড়ছিল প্রথম দেখার সেই দিন ভেবেছিলাম শেফালিকে বাঁচানো যাবে না, অচেতন অবস্থায় খিঁচুনি তুলে ঘাড়-মাথা ঝাঁকাচ্ছিল, আমি না বুঝেই ওর কদমছাঁট মাথাটা কোলে চেপে ধরে ভেবেছিলাম ওর যন্ত্রণা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই দিতে পারব। আর অনেক দিনে বাদে দ্বিতীয় দফায় যখন তার মাথাটা বুকে নিতে যাচ্ছিলাম, সেই প্রথম দিনের ভয়টা যেন সত্যি হয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল— বাঁচানো তো গেল না। প্রথম দিন ও হাত-পা ছুড়ছিল, চেপে ধরে বাগে আনতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছিল, আর ওই দিন ওড়নায় চেপে বসা চুলে ছোট মাথাটা টেনে নিতে ওর শরীরে কোনো সাড়াই পাচ্ছিলাম না।

রাতটা আমার কাছে থাকবে বলে এসেছিল। ওকে জিজ্ঞেস করার অনেক কিছু ছিল, করব-করব করেও করিনি। মনে হয়েছিল যা হওয়ার হয়ে গেছে, জানতে চেয়ে ঘটনা তো পাল্টানো যাবে না। তার চেয়ে বরং ও নিজে থেকে কিছু বলতে চাইলে বলুক। কেন্দ্র উঠে গেছে শুনে ওর চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করিনি। বলেছিলাম আমার কাছে এসে থাকতে। মাথা নেড়ে না করেছিল। কেন, অসুবিধা কী? মুখে কিছু না বলে জোরে মাথা নেড়েছিল। বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম আমার কাছে থাকলে আমারও ভালো লাগবে। বলেছিল দরকার পড়লে আসবে। আরও বলেছিল যে বাসায় কাজ নিয়েছিল, মাসখানেক আগে সেখান থেকে চলে গেছে। তার নাকি মনে হতো বাসার লোকজন তাকে চিনে ফেলেছে। নতুন আয়া পাচ্ছে না বলে বিদায় করতে পারছিল না। সে তাই কিছু না জনিয়ে শ্যামলী না কোথায় এক বাসায় কাজ নিয়েছে। কথা শুনে ধাক্কা খেলেও তখন বুঝিনি এটাই শেফালির নতুন জীবন। সে এত বিখ্যাত বা কুখ্যাত, কড়া-প্যাচ ওড়নার ঢাকাঢাকিতেও মানুষ তাকে চিনে ফেলে!

সকাল হতে শেফালি যাবেই যাবে। চম্পা এঘরে-ওঘরে ঘোরাঘুরি করছিল। কেন্দ্রে থাকতে আমাকে ভয় পেত, শেফালিই আমার নাম করে ভয় দেখাত, বস্তায় ভরে নিয়ে যাব বলত। ঘটনাটা সে হয়তো এত দিনে ভুলে গেছে। শেফালিকে আটকাতে না পেরে বলেছিলাম চম্পাকে রেখে যাক। শেফালি মলিন হেসেছিল, তিন বছরের চম্পাকে আমি পালতে পারব না এ কথাই তখন ভেবে থাকবে। যাওয়ার আগে বাংলায়, ইংরেজিতে আমার ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বলেছিলাম হারায় না যেন। মোবাইল ছিল না তখন, ল্যান্ডফোনের নম্বর দিয়েছিলাম।

জবা ও অশ্রুদানি

জবা ভাবতে পারেনি ইশকুল ছাড়াও বাসায় সে একজন স্যারের কাছে পড়বে। মা শুনে অবাক হয়ে বলেছে, ‘কস কী?’ স্যারটা অল্পবয়সি, নিজেও ছাত্র, কথা কম বলে, মুখ গম্ভীর করে পড়া বোঝায়, বুঝিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে ‘কী বুঝলা’। না পারলে রাগী-রাগী মুখ করে আবার বোঝায়। প্রথম-প্রথম জবা ভয়ে কাঠ হয়ে থাকত। স্যারের কথাও ঠিকমতো ধরতে পারত না। মাসখানেকে ভয় কিছুটা কেটেছে, তবে স্যার অনেক পড়া দিয়ে যায়, সেসব সামলাতে সন্ধ্যার পর টিভি দেখা বাদ দিতে হয়েছে। দিনে দিনে তার মনে হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান মোটামুটি রপ্ত করতে পারছে। অঙ্কটা মাথায় ঢুকতে চায় না। একই অঙ্ক বারবার বোঝানোর পরও ভুল করে। কয়েক দিন আগে তো স্যার রেগেমেগে স্কেল দিয়ে টেবিলে চাপড় দিল, আওয়াজটা জোরে হয়েছিল, জবা ভেবেছিল পিঠেই বুঝি স্কেল পড়ল।

ইশকুলে একটা সমস্যা হচ্ছে, ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো ছোট-ছোট, কোনো কোনোটা লম্বায় তার কাঁধ পর্যন্তও না। ভর্তি করার সময় নানু তার বয়স কি দিয়েছিলেন সে জানে না, তবে বাবার নাম বসাতে গিয়ে মুশকিলে পড়েছিলেন, ‘তোর মা বলছিল নাম আজগর, নামের আগে-পিছে কিছু আছে কি না কে জানে, তুই জানোস?’

জবা মাথা নেড়ে না বলতে নানু বলেছিলেন, ‘খালি আজগর কেমন লাগে, মোহাম্মদ আজগর পছন্দ হয়, না আজগর আলী?’

জবা কী বলবে, চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলে নানু হাসির কথা বলছেন এমনভাবে বললেন, ‘বাপের নাম রাখতে শরম লাগছে, না রে?’

একটু পরে কী ভেবে বললেন, ‘মোহাম্মদ আজগরই লিখলাম। মনে রাখবি। বল দেখি কী নাম?’

জবা জীবনে প্রথম বাবার নাম শুনল।

নানু বললেন, ‘বল বল।’

জবা একটা ঢোক গিলে বলল, ‘মোহাম্মদ…’

‘পুরাটা বল।’

‘মোহাম্মদ আসগর।’

‘আসগর না, আজগর, আজগর।’

নানু তার পর খাতা-পেনসিল দিয়ে বলেছিলেন, ‘লেখ দেখি কয়েকবার। পয়লা নিজের নাম, নিচে—বাবা মোহাম্মদ আজগর, তার নিচে—মা চম্পা বেগম।’

নানুর সামনে বসে কয়েকবার লিখেছিল জবা। তবে পরে নিজে নিজে খাতার পাতার পর পাতা ভরতি করে তিন লাইনে নাম তিনটা লিখে লিখে হয়রান হয়ে ও লেখার নেশা কাটাতে পারেনি। নিজের কাণ্ড দেখে সে অবাক হয়েছিল।

অবাক সে আজকাল অনেক কিছুতে হয়। ছোটবেলায় মায়ের সাথে এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় পালানোর সময় যতটা হয়নি তার চেয়ে বেশিই হয়। তখন ছোট ছিল, মা যা বলেছে, শুনে গেছে, নিজে তেমন কিছু ভাবেনি, বা ভেবেছে সবার জীবনই হয়তো এ রকম। বস্তি ছেড়ে এখন যে এত বড় বাড়িতে থাকছে, সকাল হতেই ইশকুলে যাওয়ার তোড়জোড়, ইশকুলে নানা রকম ছেলেমেয়ে, তাদের কত কথা কত গল্প—অবাক হওয়ার জন্য এসবই যথেষ্ট। আর এখন তো সে বড় হচ্ছে, বড় হতে গিয়ে আগে যা ভাবেনি বা ভাববার সময় পায়নি, সবই যেন দলবেঁধে মাথায় ঘোরাঘুরি করে। তার বয়সি এমন কেউ আছে যে পড়া মুখস্থ করার মতো বাবার নাম বানান করে জপে জপে লিখে খাতার পাতা ভরে ফেলে!

মায়ের মুখে কোনো দিন বাবার নাম শোনেনি, তারও ইচ্ছা হয়নি জানতে— দেখেইনি, নাম জেনে কী করবে! মা শুধু বলেছে তার মায়ের কথা—নানির কথা; ছোট থাকতেই বলেছে, আর বলেছে কাউয়ার কথা। নানি কাউয়াকে ভয় করত, কাউয়ার ভয়ে কলকারচরে গিয়ে হারিয়ে গেছে। মা-ও কাউয়ার ভয়ে তাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে এক বস্তি ছেড়ে আরেক বস্তিতে ভাগত। কিন্তু এসব ঘটনা তো তার মনে তখন তেমন দাগ কাটেনি। এখন যখন একেকটা ঘটনা মনে পড়ে, সে খুব অবাক হয়ে ভাবে এমন ঘটনা তো আর কারো বেলায় ঘটে না। ইশকুলে এত এত ছেলেমেয়ে—এমন কাউকে পাওয়া যাবে যার মা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়ায়! নানিকে সে দেখেনি, নানির কারণেই মায়ের এ দশা, কিন্তু মা যে এত কষ্ট করল, এখনো করছে, এর বিচার কে করবে? জবার মনে হয় বিচার হওয়া দরকার। মায়ের কী দোষ! কয়েক দিন আগে নানুকে জিজ্ঞাসা করেছিল তার মা কি কোনোদিনই মানুষের সামনে আসতে পারবে না? নানু কতক্ষণ তাকিয়েছিলেন তার মুখে, জবাব দেননি। বাবার ব্যাপারটা তাকে মোটেও ভাবায় না। কিন্তু মাকে নিয়ে যত ভাবে ততই দুশ্চিন্তা বাড়ে। মা-র মতো যাদের যুদ্ধের কারণে জন্ম তাদের আবার একটা নামও আছে—যুদ্ধশিশু। নাম খারাপ না, তবে নানির মতো যারা, তাদের নামটা এমন কেন কে জানে—বীরাঙ্গনা, ভয়-ভয় লাগে শুনতে। দুইটাই শুনেছে সরকারের দেওয়া নাম। নামে দুই, আসলে এক—দুইজনই ভাগে।

আজকাল মাথায় নতুন একটা ভয় ঢুকেছে। তার মা যুদ্ধশিশু জানাজানি হলে কি তাকে ইশকুলে রাখবে, বের করে দেবে না? আর জানাজানি যদি না-ও হয়, সে কি কোনো দিন অন্য কারো কাছে মাকে নিয়ে গল্প করতে পারবে? মাকে তা হলে তারও লুকিয়ে রাখতে হবে। লুকিয়ে যে রাখছে না তা না। এ বাসার বুয়া কুলসুমের মা, যাকে সে খালা ডাকে, সময় পেলেই নিজের বাড়িঘর, গ্রামের কথা বলে। এমনি এমনি বলে, বস্তিতে যেমন মর্জিনার মা নিজের ভরা সংসারের গল্প জুড়ত, সে রকম করে না বললেও নিজের বাবা-মা, স্বামী, মেয়ে, মেয়ের জামাই নিয়ে কত কথা বলে! বলতে ভালো লাগে বলেই বলে। জবাকেও কখনো এটা-সেটা জিজ্ঞাসা করে, এমনি এমনি করে, গল্প করার ছুতা বের করতেই করে। জবা সাবধানে জবাব দেয়, অনেক সময় নিজে বলার চেয়ে কুলসুমের মা-র কাছে নানা কিছু জানতে চায়। জবা বোঝে মহিলা চালাক হলে এত দিনে তার মনে নানা খটকা জাগত।

সেদিন স্যার আসার কথা না, বিকালে বই-খাতা নিয়ে বসতে হবে না, জবা ভাবছিল নানুর ফোন থেকে মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। ফোন লাগিয়ে নানু নিজেই কখনো কখনো কথা বলতে ডাকেন। নিজে থেকে গিয়ে বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতে নানুর ঘরে উঁকি দিতে দেখে নানু সেই যে দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছেন ওঠেননি। কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে কমজোর বাঁ হাতটায় আঙুল বোলাতে চোখ খুললেন। একটু পর কুলসুমের মা চা নিয়ে ঢুকতে বিছানা থেকে ছোট বাচ্চারা যেমন বুক-পেট ছেঁচড়ে নামে অনেকটা সে রকমই এক পায়ের পর আরেক পা মেঝেতে ঠুকে হাতে ভর দিয়ে উঠে চশমা খুঁজলেন। জবা তৈরি ছিল, চশমা হাতে দিতে পা টেনে টেনে বাথরুমের দিকে গেলেন। নানুকে একেক সময় খুব বুড়ো-বুড়ো লাগে। কয়েক দিন আগে সাহস করে বয়স জানতে চেয়েছিল। নানু বলেছিলেন, ‘কত আর, তোর যা তার চেয়ে সামান্য, এই ধর মোটে ষাট-পঁয়ষট্টি বছর বেশি।’ মুখে মুখে হিসাব করলে একেকবার একেকটা হয়, জবা খাতার লিখে হিসাব করেছে। তার তেরোর সঙ্গে ষাট মানে তিয়াত্তর, পঁয়ষট্টি মানে আটাত্তর- সে তো আশির কাছাকাছি।

বাথরুম থেকে ফিরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে নানু বললেন, ‘পড়া নাই আজ?’

মাথা নেড়ে বসে থেকে মাকে ফোন করার কথা মনে হলেও জবা অন্য কথা ভাবল। নানুকে কি আবার সেদিনের কথাটা জিজ্ঞাসা করবে?

নানু টিভি ছেড়ে কতক্ষণ এক চ্যানেল থেকে আরেক চ্যানেলে ঘুরেফিরে রিমোট দিয়ে বললেন, ‘নে, কী দেখবি দেখ।’

জবা মাথা নাড়াল, দেখবে না। নানু অবাক হয়ে বললেন, ‘হঠাৎ কী হলো, টিভিতে মন নাই!’

তার তখন খেয়াল হলো জবা অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে আছে, বললেন, ‘মা তো এখনো মনে হয় ডিউটিতে, কথা বলবি?’

আবারও মাথা নেড়ে না বলে জবা তেমনি বসে থাকল। তার কেন জানি মনে হলো নানুও তার মতো মায়ের কথা ভাবছেন। এমনও হতে পারে, সেদিন যে জবাবটা দেননি, এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করছেন। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে নানু বললেন, ‘বারান্দায় চল তো, গাছের কী অবস্থা দেখি। পানি দেওয়া হয় নাই দুই দিন।’

স্মৃতিময় এক জোড়া দুল

আজ আর গেটের পাশ থেকে না, তবে মান্তু যেমন পথ আগলানোর কথা বলেছিল তেমন করে না হলেও আজগরকে সামনে দেখে চম্পা চোখ তুলে তাকাল। দুই সপ্তা ওভারটাইম করে আজই প্রথম দিনের আলো থাকতে থাকতে বেরোনোর সুযোগ পেয়েছিল। সে রাতে আজগরকে হঠাৎ দেখে ভূত মনে হওয়ার কারণ হয়তো ছিল, কিন্তু আজ এই শেষবেলার নরম-লালচে আলোয় সামনের লোকটাকে ভূত মনে না হলেও একে আজগর কী করে বলে! কাঠি-কাঠি শরীর, মাথার চুল সবই সাদা, গাল বসে গিয়ে দুই চোয়ালের মাঝখানের গভীর খানাখন্দে জালিকুমড়ার বিচির মতো পিটপিটে চোখ, এদিকে আবার ঘাড়টাও সামনে ঝোঁকানো—সেটা পথ আগলাতে, না সরু চোঙের মতো ঘাড়ে বসানো মাথাকে ঠেকনা দিতে কে বলবে!

আজগর যেন চাইছিল চম্পা তাকে দেখুক, হয়তো তাই সামনে দাঁড়িয়েও চট করে কথা বলতে মুখ খুলল না। চম্পা একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আবার চোখ তুলতে আজগর বলল, ‘একটু খাড়াইবা?’

আবার সেই ‘একটু’। আগেরবারও ‘একটু’ দিয়ে কী বলেছিল।

চম্পা বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকলে আজগর বলল সে মান্তুর কাছে ঠিকানা পেয়ে কয়েক দিন ধরে একটা কথা বলবে বলে ঘোরাঘুরি করছে। ঠিকানা মান্তু দিতে চায়নি, জোরাজুরি করে নিয়েছে, বস্তিতে গিয়েছিল, তবে চম্পার অসুবিধা হবে ভেবে ঘরে যায়নি। দিন কয়েক আগে সকালে চম্পার পেছন পেছন এসে ফ্যাক্টরিটা দেখে গেছে।

চম্পা উসখুস করছে দেখে আজগর কাজের কথা পাড়ল। সে একবার জবাকে দেখতে চায়। চম্পা কান খাড়া করে কথাটা শুনল। পরপরই আজগর যা বলল তা কানে বেশ অন্যরকম ঠেকল। বলল, তার দিন শেষ, ডাক্তার ক্যানসার সন্দেহ করছে, পরীক্ষা করালে ধরা পড়বে। খামোখা পয়সা খরচ করে পরীক্ষা করিয়ে কী লাভ, আর পরীক্ষার টাকা-পয়সাও তার নাই। এ অবস্থায় তার বড় ইচ্ছা একবার জবাকে দেখে। সে হিসাব করে দেখেছে গত জ্যৈষ্ঠ মাসে জবা তেরোয় পড়েছে। দেখলে সে জবাকে চিনবে না, জবাও তাকে চিনবে না। জবাকে বলার দরকার নাই, সে শুধু দূর থেকে একবার দেখবে। বলে চম্পাকে অবাক করে রঙজ্বলা প্যান্টের পকেট থেকে ছোট লাল রঙের প্লাস্টিকের কৌটা খুলে এক জোড়া কানের দুল বের করে বলল, ‘তুমার জিনিস, ফালাইয়া আসছিলা, অভাবে না খাইয়া থাকছি, এইটা ভাঙি নাই।’

একটা কিছু বলা দরকার। এত বছর পর লোকটাকে আপনে না তুমি বলবে এ দোটানায় মিনিটখানেক পার করে চম্পা মুখ খুলল, ‘জবারে দেইখা আপনের কী লাভ! আর এইটার কথা আমার মনে নাই, অন্য কাউর অইতে পারে, আমার না। শরীল খারাপ অইছে, জমাজমি বেইচা চিকিস্যা করান। জবারে দেখলে ব্যারাম ভালা অইব? আমি যামু, পথ ছাড়েন।’

আজগর মোটেও পথ আগলে দাঁড়ায়নি, তারপরও পথ ছাড়েন শুনে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে দুই পা পেছনে সরে চম্পার জন্য পুরো রাস্তা ছেড়ে দিতে চম্পা গত দিনের মতো পা চালাতে গেল না। সে দেখল আজগর তার ঝোঁকানো ঘাড়-মাথা খাড়া করতে করতে লাল রঙের কৌটাটা পকেটে পুরছে। সে খেয়াল করল প্যান্টের পকেটে ডান হাতটা ঢুকিয়ে বের করতে তাকে রীতিমতো কসরত করতে হচ্ছে। কনুইয়ের কাছে হাতটা থরথরিয়ে কাঁপছে, কনুইয়ের জায়গাটা অতিরিক্ত বেঁকেও আছে। ‘আতে কী?’ বেখেয়ালে মুখ দিয়ে কথাটা বের হতে চম্পা চমকাল, সেই সাথে এও মনে হলো, না চাইতেই একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে। হাতে কী—এটা যার সমস্যা তার, সে কেন জানতে চাইল? কিন্তু জানতে যখন চেয়েছে, জবাব না শুনে নড়ে কী করে! কাঁপা-কাঁপা হাতটা বের করে অন্য হাতে চেপে ধরে আজগর বলল, ‘এইটা এইরমই করে বহুত দিন। জবা কি ইশকুলে যায়?’

যা ভেবেছিল চম্পা, মুখ ফস্কে হাতের খবর নিতে গিয়ে এখন জবার কিসসা গাওয়া লাগবে। সে পা বাড়াতে বাড়াতে জবাব দিল, ‘জবার ইশকুল দিয়া কাম কী? হে যায়। জবা আমার ধারে থাকে না, জবারে দেখনের খেয়াল বাদ দিয়া চিকিস্যা করান।’

হাঁটতে হাঁটতে চম্পা ভাবল সে রাতের মতো জোরে পা চালাচ্ছে। দরকার তো নাই জোরে হাঁটার। এ আজগরকে ভয় পাওয়ার মানে হয় না। কী করতে পারে সে? বস্তি চিনেছে, ফ্যাক্টরি চিনেছে, কয়েক দিন বড়জোর ঘোরাঘুরি করবে। জবাকে দেখার কপাল হবে না। কানের দুল জোড়ার কথা চম্পা মোটেও ভোলেনি। কী করে ভোলে! বিয়ের আগে বনানীর সেই বাসায় কাজ করার সময় টিপে টিপে পয়সা জমিয়ে দুল জোড়া গড়িয়েছিল। গয়না বলতে এই পয়লা ও শেষ, তাও নিজের রোজগারে। খুবই অবাক হয়েছিল আজগর যখন পকেট থেকে বের করেছিল। কত দিন আগের জিনিস, ছোট লাল বাক্সটা দেখামাত্র চম্পা চিনেছিল। তবে চট করে মুখে যা এসেছে বলে ফেলে ঠিকই করেছে। আজগর জানে এটা তার, না জানার কারণ নাই, তারপরও চম্পা অস্বীকার করায় সে যা বোঝার বুঝেছে। কিন্তু আজগর ঢাকায় কী করছে? শরীরের যে হাল, কাজকর্ম করার প্রশ্নই ওঠে না। ভালোমতো দাঁড়াতে পারছিল না, আর হাতটা যেভাবে কাঁপছিল তাতে এ হাত দিয়ে কিছু করার কথা ভাবা যায় না। বোকার মতো হাতের কথা জিজ্ঞাসাও করে বসেছিল, জবাবে কী বলেছিল চম্পা বোঝেনি। চম্পা তার নিজের ব্যবহারে সন্তুষ্ট, ঠিক যা বলার, যেভাবে বলার, বলেছে। মাথা খারাপ না হলে আজগর আর পেছন পেছন হাঁটবে না। কী আহ্লাদ, একবার জবাকে দেখবে, দূর থেকে দেখবে! যদি বলত, জবা না, চম্পাকে দেখতেই কয়দিন ধরে ঘোরাঘুরি করছে, তা হলে? চম্পা বুঝতে পারছে তাড়াতাড়ি ছুটি পেয়ে মাথাটা আউলা হয়ে গেছে।

মাথাটা যে সত্যিই কিছুটা আউলাঝাউলা হয়ে গেছে তার প্রমাণ মিলল যখন ঘরে এসে তার খেয়াল হলো সে মান্তুর কাছে গড়গড় করে আজগরের কাহন গাইছে। কোথায় দেখা হলো, প্রথমে কী বলে সামনে দাঁড়াল, সে কী বলল। এমনকি কয়দিন আগে রাতে ওভারটাইম করে ফ্যাক্টরি গেট পার হওয়ার সময় এক ঝলক দেখা হওয়ার ঘটনাও। মান্তু হাঁ হয়ে শুনে গেল, সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আজগরের সাথে তার নিজের দেখা হওয়া ও বস্তির ঠিকানা দেওয়ার কথায় সেদিন চম্পা যেভাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল, তার পর আজগরকে নিয়ে কথা হবে, তাও চম্পার মুখ থেকে, এর চেয়ে তাজ্জবের কী হতে পারে!

মান্তু সাহস পেয়ে বলল, ‘চেয়ারা-সুরতের কী হাল দেখছো?’

‘আমার আর খাইয়া লইয়া কাম নাই চেয়ারা দেখি!’

‘ওমা, কইলা না হমকে খাড়াইয়া জবারে দেখতে চাইল, তুমি মুখ দেখো নাই?’

‘আমার কী ঠেকা পড়ছিল!’

‘তাইলে? এতখন যে কইলা, তুমারে দুল নিতে সাধছে, তুমি নেও নাই, আত কাপতেছিল দেইখা জিগাইছো কী অইছে—জিগাও নাই?’

‘জিগাইছি তো তোর কী অইছে?’

‘ও খুদা, আমার কী অইব! তুমি কইলা সেই জইন্য জিগাইলাম চেয়ারা-সুরতের হাল খিয়াল করছো কিনা।’

‘হো করছি, ভূতের লাহান।’

‘আর কী কইল?’

‘ক্যানছার অইছে, বাঁচব না।’

‘কও কী ক্যানছার? আমার লগে যহন দেখা অইছিল, অসুখের কথা কয় নাই, তুমারে কইছে তাইলে। ক্যানছারের চিকিস্যায় হুনছি ম্যালা খৰ্চা।’

‘কইছি চিকিস্যা করাইতে, খেত-জমি বেইচ্যা অইলেও করাইতে।’

‘এইটা কইছো, ভালা করছো। খেত-জমি কী আর আছে, টুকটাক কিছু থাকলে থাকতে পারে। আর কী কইছো?’

চম্পা সাবধান হলো। এই পাগলি তাকে পুছ করছে আর সেও জবাব দিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা করাতে বলেছে কেন বলতে গেল? মাথাটা গরম-গরম লাগছে,

মান্তুর সঙ্গে খামোখা বকবক না করে গোসলে গেলে পারত।

রাতে চম্পা শোবার তোড়জোড় করছে, মান্তু বলে উঠল, ‘আমি কই কি, জবারে দেখতে চাইছে, একবার দেখাও। কইছে না দূর থাইকা দেখব, অসুবিদা কী! ক্যানছারে মানুষ বাচে না গো চম্পাবু, কওয়া যায় না কুন দিন জানি …’

চম্পা কথা বলছে না দেখে মান্তু বিড়বিড় করে বলল, ‘মানুষটা খারাপ আছিল না, তয় কপালে খারাবি থাকলে কেও ঠেকাইতে পারে না। তুমি তো নিজে থাইকা চইলা আসছো, হে তো তুমারে যাইতে কয় নাই। যাওনের সুময় আটকাইলে পারত

‘তর ওয়াজ শ্যাষ অইছে? আর আজাইরা প্যাচাল না, ঘুমা।’

জবার কথা

এত খারাপ লাগছে—এইটুকু জবার মাথায় যে প্রশ্নটা ঘুরছে তার কী জবাব দেব? জবা শেফালিকে দেখেনি, চম্পার মুখেই তার নানির কথা যা শুনেছে। শেফালির কারণেই চম্পার আজ যে এ অবস্থা এজন্য হয়তো শেফালির প্রতি তার মনোভাব কিছুটা জটিল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। শেফালি সম্বন্ধে জবাকে আমি কখনো কিছু বলিনি, সেও কিছু জানতে চায়নি। জবা শুধু তার মাকে দেখেছে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মায়ের দুর্ভোগ দেখে বড় হয়েছে। এত দিন হয়তো মাকে নিয়ে ভাবেনি, বয়স বাড়তে এখন ভাবছে। ভেবে সুরাহা করতে না পেরে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তাও এমন প্রশ্ন যার জবাব সরাসরি দেওয়া কঠিন, ঘোরপথে দিতে যাওয়া মানে প্রতারণা। তার মা কি কোনোদিনই মানুষের সামনে আসতে পারবে না—কথাটার কী জবাব হতে পারে?

দীর্ঘদিন মাথায় শেফালিকে নিয়ে কাটিয়ে এখন আমি একটা দোটানায়, কে বেশি বিড়ম্বিত—শেফালি, না চম্পা? এর কারণ কি চম্পার মতো যারা, তারা আমার চিন্তা-ভাবনায় আসার সুযোগ পায়নি? আসলে এ কথাও ঠিক, যুদ্ধের পর কোথায় কোনদিকে কোন যুদ্ধশিশু ছিটকে পড়েছে তার খবর আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী বেশ কয়েক বছর আগে আমার একটা ভিডিও ইন্টারভিউ করেছিল, সে সময় সে একটা ঘটনার কথা বলেছিল। অনেক বছর আগে রংপুরে না দিনাজপুরের এক গণ্ডগ্রামে কুড়ি-বাইশ বছরের একটা ছেলেকে সে দেখেছিল। ছয় ফুটের মতো লম্বা, টকটকে ফরসা গায়ের রঙ, কটা চোখ, সাধারণ বাঙালিদের তুলনায় অতিরিক্ত খাড়া নাক, লালচে চুল। এক জোতদারের বাড়িতে রাখালি করত। ছেলেটা আর কেউ না, এক যুদ্ধশিশু। এলাকায় লোকজন ওর ঘটনা জানত। লেঙ্গা, বেঙ্গা, ছেঙ্গা যার যেমন খুশি ডাকত। নাম নিশ্চয় একটা ছিল, কেউ মনে রাখেনি। সে তার লম্বা গড়ন ও অন্যরকম চোখমুখ নিয়ে ছোটবেলা থেকে অবজ্ঞা, অসম্মানের খোরাক হতে হতে সমাজ যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই নিজের অবস্থান মেনে নিয়েছিল। আফসানের ধারণা সে নিজেকে নিয়ে তেমন কোনো সমস্যায় ছিল না। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধিও কম ছিল, হতে পারে দিনের পর দিন লোকজনের ঠাট্টা, ইতরামিতে বুদ্ধিশুদ্ধি গজানোর স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা তার বেলায় কাজ করেনি।

তার মানে কি একজন যুদ্ধশিশুর টিকে থাকার এটাই পথ? এর জবাব এত দিন পর আমাকে কে দেবে!

চম্পার সাথে যেসব বাচ্চারা পুনর্বাসনকেন্দ্রে ছিল, তারা কে কোথায় জানা নাই। এক চম্পাই রয়ে গেছে আমার কাছাকাছি। আর এত বছর পর ভিন্ন এক যুদ্ধশিশু লিওনাকে দেখে একটা ধারণা যা হলো সেটা রানির কাহিনি পড়ে ভেস্তে গেল।

আজ এ নিয়ে যতই ভাবছি, মনে হচ্ছে চম্পা আমার কাছে বড় একটা গুরুত্ব পায়নি। ওর সংসার ভাঙার খবরে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম, কিন্তু এর ফলে সে যে তার মায়ের পথে হাঁটবে বিশ্বাস করিনি, আর যখন দেখলাম সে তা-ই করছে, আমি বকাঝকা করেছি। বলেছি তার আর তার মায়ের জীবন এক না, সে যেন মাকে নকল না করে। কী যুক্তিতে এমন ভেবেছিলাম বলতে পারব না। এতটা পথ সে একা একা চলেছে, কত দুর্ভোগ সহ্য করেছে, কিন্তু আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়নি। জবাকে নিয়ে সমস্যায় ছিল; জবা আমার কাছে থাকায় ইদানীং সে কিছুটা ঝামেলামুক্ত। কিন্তু জবাকে কী বলি?

বাড়িটা খালি খালি। রান্নাঘরে কুলসুমের মা-র নড়াচড়ার আওয়াজ নাই। দিন কয়েক আগে তার কুলসুমের মেয়ে হয়েছে। মেয়ে হওয়ায় কুলসুমের কী অবস্থা কে জানে, তবে তার মা-র মুখ ভার। আমাকে বলেছে মেয়ে হওয়ায় তার এত দিনের দোয়া-কালাম বিফলে গেল—মাইয়া পালা আর বিলাই পালা এক। আমি কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম মেয়ে ও নাতনিকে দেখতে যাবে বলে ছুটি চাইবে। দুই-তিন দিন সাড়া-শব্দ না পেয়ে আমি নিজে থেকেই বললাম মেয়েকে দেখে আসতে। তেমন আগ্রহ দেখাল না। গতকাল কী মনে করে বলল যাবে। বেতনের টাকা জমেছিল, সেখান থেকে কিছু নিল, আমি মেয়ে ও নাতনির জন্য আলাদা করে টাকা দিয়ে বললাম মেয়ের ঘরে গিয়ে যেন মুখ বেজার করে না থেকে বাচ্চার দেখাশোনা করে।

কুলসুমের মা চলে যেতে জবা মহাফুর্তিতে আজ দুপুরে ভাত, ডাল রান্না করেছে। আমাকে ঢুকতে দেয়নি রান্নাঘরে, সে নাকি অনেক ছোট থাকতেই রান্নাবান্না পারে। বেগুনভর্তা, আলুভর্তা ছাড়াও ছোট মাছের চচ্চড়ি, চিংড়ি দিয়ে কলমিশাক, পুঁইশাক রান্না করতে পারে। শুধু মাংস রান্না শেখা বাকি। খেতে বসে অবাক হয়েছি, ডাল ভালোই হয়েছে। ফ্রিজে রান্না করা খাবার তুলে রাখা ছিল, সে সব আমি দেখিয়ে দিয়েছি, সে গরম করেছে।

এই সন্ধ্যাবেলা মেঝেতে বই-খাতা ছড়িয়ে ঘাড়-মাথা ভেঙে জবা ঝুঁকে আছে তা আছেই। আমার পায়ের আওয়াজে মাথা তুলে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে আমি ওর খাটে গিয়ে বসলাম। বারান্দা লাগোয়া এই ছোট ঘরটা এখন ওর, একটা খাট ছাড়াও টেবিল-চেয়ার রয়েছে। অনেক বলেও ওকে টেবিলে বসাতে পারিনি, মাস্টারের কাছে পড়তে বসলে খাটে বসে টেবিলে বই-খাতা খোলে, অন্য সময় মেঝেতেই বসে। খাটেও পারতপক্ষে ওঠে না রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া।

ভেবেছিলাম ইশকুলের হোমওয়ার্ক করছে, কিন্তু না, আমাকে দেখে তড়িঘড়ি খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেও ফ্যানের বাতাসে খাতার পাতা ফরফর করে উল্টে যেতে পেনসিলে আঁকা এলোমেলো গ্রামের ছবি দেখে মজা পেলাম। সে তখনি ঝুঁকে পড়ে আবার খাতা বন্ধ করতে যাবে, আমি খাতাটা চাইতে কাঁচুমাচু মুখ করে দিল। বেশ কটা ছবি—বলপেনের, পেনসিলের। গ্রামের ছবি আঁকতে বাচ্চাদের আগ্রহের পেছনে অবচেতন কারণ-টারণ থাকতে পারে। যে বাচ্চা শহর ছাড়া কিছু দেখেনি, সেও প্রথম-প্রথম গ্রামের ছবিই আঁকবে। রোগা একটা নদী, নদীর পাড়ে কুঁড়েঘর, বাঁকা নারকেলগাছ, কলাগাছের ফালি-ফালি ঝুলঝুলে পাতা। ছোটবেলা আমিও তাই করেছি। উদ্দেশ্য যদি হয় কল্পনাশক্তিকে উসকে দেওয়া, তা হলে ছবিগুলো এক রকম হবে কেন—নিপাট, ঝুট-ঝামেলাহীন? জবার এগুলো অবশ্য কোনো হিসাবেই পড়ে না। মাথামুণ্ডু নাই। নদী আঁকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু উঁচু-নিচু ঢেউগুলোকে লাগছে এবড়োখেবড়ো রাস্তার মতো, সেটা আবার কুঁড়েঘরের মতো যে চারকোনা বাক্স এঁকেছে তার ভিতরে চলে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি কুকড়েমুকড়ে ও যে কী করবে বুঝতে পারছে না। একটা সাদা পাতায় কাঁপা হাতে পেনসিল ঘষে একটা গাছ আঁকলাম, গাছের নিচে কী দেওয়া যায় ভেবে শিং বাগানো গরুর মোটামুটি আদল ফুটে উঠতে ওকে বললাম, ‘দেখ তো, চেনা যায়?’

খাতা হাতে পেয়ে জবার চোখে পলক পড়ে না। বললাম রঙপেনসিল কিনে দেব, ছবি আঁকার খাতাও, আর সে যা ভাবতে পারছে না, তাও—ওকে আঁকা শেখাব। এককালে ছবি আঁকতাম শুনে মনে হলো এমন অদ্ভুত কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার না-ই বা করে কী করে! গাছটা তো গাছের মতোই লাগছে, আর শিং দেখে গরুটা যে রেগে আছে, না বোঝার কথা নয়।

রাতে খেয়েদেয়ে জবাকে জিজ্ঞাসা করলাম মায়ের কষ্টের জন্য সে কি তার নানিকে দায়ী ভাবে? এ নিয়ে তার সঙ্গে আগে কখনো কথা বলিনি, প্রশ্নটা হঠাৎই করলাম তেমন কিছু না ভেবে; যদিও কদিন ধরে মনে হচ্ছিল সে হয়তো শেফালির ওপর দোষ চাপায়। শেফালিকে সে দেখেওনি। অদেখা একজন—হোক সে তার মায়ের মা—তার কারণে তার মা কেন জীবনভর ভুগবে, আর মায়ের কষ্ট দেখে সে-ই বা কেন কষ্ট পাবে?

জবা চুপ করে থাকায় ভাবলাম আচমকা প্রশ্নে জবাব দিতে সময় নিচ্ছে, কিন্তু সে চুপ করেই থাকল। টেনে কাছে নিতে বলল, ‘মায়ের কী দোষ!

বলতে পারতাম তার নানির কী দোষ! কিন্তু এতে কোনো ফয়সালা হয় না। পরপরই জবা যা বলল তাতে দেখলাম আমি তার কাছে যত সোজাসাপটা জবাব আশা করেছিলাম, সে তত সহজে ব্যাপারটা দেখছে না। ‘মায়ের কী দোষ’ বলেছে বটে, তবে এ যেন অভিমানের কথা। সে বলল, ‘নানি মায়রে ছাড়ছিল মা-র ভবিষ্যৎ চিন্তা কইরা, আমারে মায় ছাড়ছে আমার ভবিষ্যৎ ভাইবা, দুইজনই বাচ্চাগো ভবিষ্যৎ নিয়া ভাবছে, নিজেগো নিয়া ভাবে নাই।’

ধাক্কা খেলাম, এ কি জবার কথা! ও তা হলে ভাবছে শেফালি ও চম্পা নিজেদের দিকে নজর দিলে অবস্থা এমন হতো না? কথাটা পুরোপুরি অস্বীকার করি কী করে! আমি সেদিকে না গিয়ে সোজা পথ ধরলাম। বললাম তার মা তাকে ছেড়ে গেছে কে বলল! দুই দিন আগেই না তাকে দেখে গেল! চাইলেই যখন খুশি আসতে পারে, ফোনে কথা বলতে পারে। জবাকে তার লেখাপড়ার জন্য আমার কাছে রেখেছি, চম্পাও তা-ই চেয়েছে। এতে ছাড়াছাড়ির কথা আসছে কেন? তার মা আর নানির কথা আলাদা, কিন্তু তারা মা-মেয়ে একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে আছে। জবা থাকতে চম্পার কীসের অভাব, কীসের কষ্ট!

সুযোগ পেয়ে কথাগুলো বলতে পেরে আমার ভালো লাগলেও জবা সাড়া দিল না। নিজের যুক্তিতে অটল থাকতেই কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *