ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ – ১

এক

এক নাগাড়ে দু’দিন উপোস করে অনাহারক্লিষ্ট জীবনের প্রতি ভীষণ ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন খোলার ঘরে বসে পরনের ছেঁড়া লুঙ্গিটার আঁচলে কুড়িয়ে পাওয়া যবের দানা রেখে চিবিয়ে খাচ্ছিলাম, ঠিক এমন সময় ভগবান আমার ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে বলল, ‘বসে বসে কি করছ, চলো এই শহরের শিশুদের একবার দেখে আসি।’

আমি একটা বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বললাম, ‘যাও, যাও, আমার কাছে ওসব ফালতু টাইম নেই।’

ভগবান বলল, ‘অত রাগছ কেন? চলো মোড়ের রেস্তোরাঁ থেকে দু’টো স্লাইস, একটা আমলেট এবং সিংগেল চা খাইয়ে দেবো তোমাকে।’

‘সত্যি বলছ, না কোন এমনি চাপাবাজী করছ?’

আমি দু’টো অস্থির চোখ ভগবানের দিকে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম।

ভগবান পকেট থেকে কড়কড়ে দশ টাকার একটা নোট বের করে আমার লোভাতুর চোখের সামনে একবার আন্দোলিত করল।

আমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম এবং বললাম, ‘আগে থেকে কেন বলোনি তাহলে? আমার আবার টাইম টেবিল আছে নাকি? দু’টো পয়সা খরচ করলে বোম্বেতে এমন কোন কাজ নেই যা হয় না।’

ইরানী রেস্তোরাঁতে ঢুকে আমি বেয়ারাকে বললাম, ‘দেখো সাহেব কি চায়, তাকে দাও। কিন্তু আমাকে গোটা চারেক স্লাইস, দু’টো ডিমের আমলেট এবং একটা ডবল চা জলদি দাও।’

ভগবান প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘ডবল ডবল কেন? আমি তো শুধু ডবল স্লাইস, এক আমলেট, এক চার কথা বলেছিলাম।’

আমি বললাম, ‘তুমি তো স্বর্গের রেস্তোরাঁর কথা মনে করে অর্ডার দিয়েছ। কিন্তু এটা স্বর্গ নয়, বোম্বাই। এখানকার ব্যাপার স্যাপারই অন্য রকম। সম্ভবতঃ বোম্বাইর স্লাইস তুমি কোনদিন দেখনি। এত মসৃণ এবং পাতলা যে, চোখের সামনে ধরলে এপার ওপার দেখা যায়। কিছু মাখন লাগিয়ে তুমি বরং তা দিয়ে দিব্যি শেভও করতে পার। আর ডিমের কথা বলছ? বোম্বের মুরগীগুলো এত ছোট ডিম দিয়ে থাকে যে, দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া পেয়ালায় ডিম খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। চায়ের কথা আর কি বলব, এখনকার চায়ের কাপগুলোতে যে পরিমাণ চা দেয়া হয়, এক ফোঁটা চোখের জলও এর চাইতে বেশী।’

কিন্তু ভগবান আমার কথায় সায় দিলো না। আমিও তার যুক্তি মানতে রাজী হলাম না। এ নিয়ে আমরা দশ মিনিট কথা কাটাকাটি করলাম। কিন্তু শেষাবধি রেস্তোরাঁর মালিক যখন পুলিশ তলব করার কথা বলল, তখন ভগবান চুপসে গেল এবং বাধ্য হয়ে আমার জন্যে চারটা স্লাইস, দুটো আমলেট ও ডবল চায়ের অর্ডার দিয়ে নিজের জন্যে একটা এসপ্রো আনিয়ে নিলো।

আমি বললাম, ‘তুমি শুধু শুধু ঝগড়াটা করলে। আমার কথা যদি প্রথমেই মানতে, তাহলে এখন তোমাকে এসপ্রো খেতে হতো না।’

ভগবান লজ্জিত হয়ে বলল, ‘ভাই আজকাল ফরেন এক্সচেঞ্জের বড় সংকট চলছে। স্বর্গ থেকে বোম্বেতে আসার জন্যে আমি মাত্র দুটো টাকার এক্সচেঞ্জ পেয়েছি। জানি না এখানে কদ্দিন থাকতে হয়। এজন্যে আমাকে প্রতিটি পাই হিসেব করে খরচ করতে হয়।

আমি তেড়ে উঠে বললাম, ‘গল্প করার আর জায়গা পাও না তুমি। তোমার আবার ফরেন এক্সচেঞ্জের ঝামেলা কিসের? এসব ঝামেলা তো এই গরীবদের জন্যে। এই মর্তের মাটিতে একজন কারখানা মালিকের পক্ষে যেখানে ফরেন এক্সচেঞ্জ যোগাড় করতে বেগ পেতে হয় না, সেখানে সারা দুনিয়ার মতো বিরাট একটা কারখানার যে মালিক তার তো মোটেই বেগ পাবার কথা নয়।’

‘তুমি ওসব বুঝবে না। ভগবানকে কায়দা-কানুন মেনে চলতে হয়। তা না হলে এই দুনিয়াটা কবেই অচল হয়ে বসে থাকত!’

ভগবান আমাকে বলল, ‘চলবে, না মানে? কথাটা বুঝিয়ে বলো।’

কি ভাবে চলবে? মুহুর্তে যদি আমি তোমার এই স্লাইসকে লোহায় পরিণত করে দিই, তাহলে তুমি ওটাকে চিবিয়ে খেতে পারবে?’

আমি বললাম, ‘কিন্তু এই বোম্বাই শহরের এমন কতিপয় হোটেল আছে যেখানে স্লাইস রুটিগুলো লোহার মতোই হয়ে থাকে।’

ভগবান আবার বলল, ‘আমি যদি তোমার এই চায়ে বিষ মিশিয়ে দিই তাহলে তুমি মরে যাবে না?’

‘বোম্বেতে রোজ হাজার হাজার লোক বিষাক্ত চা পান করে থাকে।’

‘আমি যদি আলোর গতি এতখানি কমিয়ে আনি যে, সূর্য থেকে পৃথিবী পর্যন্ত আসতে আলোর গতি ঘন্টায় মাত্র তিন মেইল থাকবে, তখন তোমরা বাঁচবে কি করে?’

এবারে আমি চুপসে গেলাম। ভগবান শেষ কথাটি তো ষোল আনাই ঠিক বলেছে। আমি তাড়াতাড়ি মাথা নত করে প্লেটে আমলেট খুঁজতে লাগলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা দাদর পুলের নীচে উপনীত হলাম। পুলের এক পাশে একটা মন্দির রয়েছে। মন্দিরে সাধু বাবারা গাঁজা-ভাঙ্গের রপ্ত করছেন। অন্যদিকে রেলওয়ে ষ্টেশনের লৌহ শলকার পাঁচিল ঘেঁষে গোটা কয়েক শীর্ণকায় কুকুর শুয়ে আছে। তারও অদূরে রয়েছে রাশি রাশি ময়লা আবর্জনার স্তূপ। দাদর পুলে ওঠার সোপানের দু’পাশে লাইন দিয়ে বসে আছে ভিক্ষুকের দল। মোট কথা, চতুর্দিকেই বিস্মিত হবার মতো বহু দৃশ্যরাজী বিরাজ করছে।

ভগবান ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘এ তুমি আমায় কোথায় নিয়ে এলে?’

‘কেন? শহরের ছেলেপিলেদের সাথে দেখা করবে বলেই না নিয়ে এলাম এখানে।’

‘কৈ, তোমার সেই ছেলেপিলেরা কোথায়?’

আমি বললাম, ‘ছেলেপিলেদের সাথে পরিচিত হবার পূর্বে এটা বোধ হয় ভালো হবে, চলো আমরাও ছেলেদের বেশ ধারণ করি। এ কাজ তো তুমি স্বচ্ছন্দে করতে পারো। এতে কোন ফরেন এক্সচেঞ্জের ঝামেলা নেই।’

পর মুহুর্তেই আমরা দু’জন শিশু বনে বনে গেলাম। আমাদের পরনে বস্তির ছেলেপিলেদের মতো ময়লা ছেঁড়া প্যান্ট এবং আধ-ময়লা জামা ছিল। আমি জামরুল বিক্রি করার জন্যে একটা টুকরি সংগ্রহ করে নিলাম। ওদিকে ভগবানও একটা কাঠের ট্রে যোগাড় করে নিয়ে তাতে ছেলেদের রং-বেরং-এর ছড়াছবির বই সাজিয়ে নিল। আমরা তাড়াতাড়ি দাদর পুলের সোপান অতিক্রম করে ওপরে উঠে গেলাম এবং লোহার রেলিং-এর কাছে জামরুল আর বই’র পসরা সাজিয়ে বসে গেলাম।

‘এ কি করছ? ঝটপট টুকরিটা তুলে নাও।’–পাশ থেকে এক বৃদ্ধা কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলল। বৃদ্ধার চেহারা যেমন ভূতুড়ে, তেমনি তার আওয়াজও কুশ্রাব্য। বৃদ্ধার টুকরিতে আমার মতো জামরুল রয়েছে।’

আমি বললাম, ‘এটা সরকারী পুল। এখানে যার ইচ্ছা সেই দোকান দিয়ে বসতে পারে। চারিদিকে দেখতে পাচ্ছ না সবাই নিজের নিজের দোকান সাজিয়ে বসেছে। অতএব আমি কি অপরাধ করেছি যে এখানে বসতে পারব না? এটাকি তোমার বাবার পুল?’

বৃদ্ধার সামনে বছর আটেকের একটা গাট্টা-গোট্টা ছেলে টুকরি সাজিয়ে বসেছিল। তার টুকরিতে কলা ছিল। আমার কথা শুনে আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘টুকরি ওঠাবে, কি উঠাবে না তাই বল।’

আমি কোন কিছু জবাব দেবার আগে ছেলেটির আপাদমস্তক দেখে নিলাম। বয়েসে লম্বায় আমার চাইতে কম মনে হলো। তাই আমি ঘাড় বাঁকা করে বললাম, ‘না, উঠাব না –এখানেই বসব।’

দুই

ছেলেটি উদ্যত সাপের ফণার মতো ফোঁস করে উঠল।

পরমুহুর্তেই দেখলাম তার একটা পা আমার পেটে, একটা ঘুষি আমার মুখের উপর আর আমি মাতিতে চিৎপটাং। ভগবান আমাকে বাঁচাতে এলে একটা প্রচন্ড ঘুষি তার মুখেও পড়ল। ভগবানের নাক থেকে দর দর করে রক্ত ঝরতে লাগলো।

‘টুকরিটা তোল।’

ছেলেটা আমার উপর হুকুম চালাল, আমি ভগবানের দিকে তাকালাম। ভগবান তখন নাকের রক্ত মুছছিল এক মনে। আমি আর তার দিকে না তাকিয়ে নির্বিবাদে টুকরিটা তুলে নিলাম। তারপর পায় পায় আমরা দু’জন সামনের দিকে পা চলিয়ে দিলাম।

কয়েক পা এগিয়ে আসার পর ভগবান আমাকে বলল, ‘জানো, ছেলেটাকে নিমেষে কুপোকাৎ করে ফেলতে পারতাম, হতভাগা চোখেমুখে সর্ষেফুল দেখতো, কিন্তু এসব আমার নীতিবিরুদ্ধ যে।’

‘তাকি আর বলতে?’ আমি কোমরে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম।

আরো একটু এগিয়ে যেতেই অন্য একটা ছেলের দেখা পেলাম। সে একটা কাঠের উপর রেখে ক’টা ফাউন্টেন পেন বিক্রি করছিল। সে ক্রমাগত হাঁকছিল –‘আসল শেফার্ডস পেন, মাত্র চার আনা, আসল শেফার্ডস্‌……’

ভগবান বিস্মিত হয়ে আমাকে বলল, ‘আসল শেফার্ডস পেন তো পঁচাত্তর টাকাতে মেলা দায়। অথচ চার আনায় সে বিক্রি করছে কেমন করে?’

আমি বললাম, ‘হতে পারে ছেলেটির বাবা কোটিপতি।’

আমি চারদিকে ইতিউতি করে বললাম, ‘চলো, এই ছেলেটার কাছেই আমরা বসে পড়ি।’

আমাদের আসতে দেখেই ছেলেটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘এদিকে এসো না যেন, অন্যদিকে দেখো। আমার বেচা বিক্রি মাটি করো না।’

আমি বললাম, ‘দোস্ত, আমার কাছে রয়েছে জামরুল আর ওর কাছে রয়েছে ছবির বই, তুমি তো বিক্রি করছ কলম, তোমার ক্ষতি হবে কেমন করে?’

ছেলেটি কন্ঠে ঝাঁজ মিশিয়ে বলল, ‘তোমাদের মতো আনাড়ীদেরকে বোঝানো মুশকিল। এ তল্লাটে নতুন এসেছো মনে হচ্ছে। বেচা-বিক্রি কোনদিন করেছ বাপের জন্মে? খদ্দেরের মেজাজ জানো কিছু? এই পুলে এসে লোকেদের মেজাজ কিভাবে বদলে যায় তা আমি জানি। কলম কেনার জন্যে এসে বহু লোক শেষে জামরুল কিনে চলে যাবে। অতএব আগেভাগেই কেটে পড়ো।’

ছেলেটি দেখতে আমাদের চাইতে বেশ তাগড়া ছিল।

আমার আর দ্বিরুক্তির সাহস হলো না। সেখান হ’তে পাততাড়ি গুটালাম।

কিছুদূর এসে ভগবান বলল, ‘তুমি হয়ত ভাবছ ছেলেটি আমাদের চাইতে তাগড়া। জানো। আমি ওকে জন্মের মত শেষ করে দিতে পারি। কিন্তু আগেই বলেছি এসব আমার নীতিবিরুদ্ধ কাজ।’

‘তাতো বটেই!’ আমি সম্মতিসূচক মাথা দোলালাম।

এবারে আমরা পুলের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি। পুরোটা পুলে কেউ আমাদের বসতে দিল না, শেষ প্রান্তে এসে দেখি এখানে এক ছেলে। না, ছেলে বলা ঠিক হবে না। রীতিমতো যুবকই বলা চলে তাকে। বিশ-বাইশ বছরের যুবক। ছেলেটির হাতে রং-বেরং-এর রুমাল। রুমালগুলো একটা ছাতাতে সাজিয়ে নিয়েছে। সে যখন ছাতাটি চক্রাকারে ঘুরতে থাকে, তখন মনে হয় একটা রঙধনু চক্র রচনা করেছে।

ভগবান গলার সুরটা অত্যাধিক মোলায়েম করে তাকে বলল, ‘আমরা কি তোমার পাশে বসে একটু বেচা-কেনা করতে পারি?’

সে বলল, ‘বসতে পারো, তবে তাড়াতাড়ি চার আনা পয়সা বের করো।’

ভগবান তাড়াতাড়ি পকেট থেকে আট আনা পয়সা বের করে তার হাতে দিল। আমরা দু’জন নিশ্চিন্ত মনে তার পাশে পসরা সাজিয়ে বসে গেলাম। এভাবে ঘন্টাখানেক কেটে গেল। আমি অনেক কষ্টে দু’আনার জামরুল বিক্রি করলাম। কিন্তু ভগবান একটি বইও বিক্রি করতে পারলো না। ভাগবান নিরাশ হয়ে বলল, ‘আমি কত আশা নিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্যে ছড়া-ছবির বই নিয়ে এলাম, অথচ কিনা একটি বইও……..’

যুবকটি এ কথা শুনে হাসতে লাগলো।

ভগবান বলল, ‘এতে আবার হাসবার কি আছে? কেন, বোম্বাই শহরে ছেলেপিলেরা পড়াশুনা করে না?’

‘পড়বে না কেন? আলবত পড়ে, আমি নিজে বি.এ. পাস।’

‘বি. এ. পাস করে তুমি রুমাল বিক্রি করছ?’

ভগবানের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত।

যুবকটি আবার হাসল। একটা বিশেষ ধ্বনি তুলে সে পাশের ছেলেটিকে ডেকে বলল, ‘ভিক্টর এদিকে আয়তো।’

ভিক্টর ঘড়ি বিক্রি করছিল।

কাছে আসতেই ভিক্টরকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও, এর নাম ভিক্টর। এম. এ. পাস।’

এরপর সে অন্যান্যদের সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওর নাম শরিফ। এন্ট্রান্স পাস।’

এর নাম ধুলি। অষ্টম শ্রেণী পাস। ওর নাম ফিরোজ, সপ্তম শ্রেণী পাস। আর ওর নাম গুর খাঁ, পঞ্চম শ্রেণী পাস করে মায়েদের চুড়ি বিক্রি করছে।’

ভগবান ওদের দিকে চোখ ছানাবড়া করে একবার দেখে বলল, ‘তাতো বুঝলাম। কিন্তু স্কুল-কলেজে তোমরা যাও কখন?’

‘স্কুল-কলেজে আমরা কোনদিন যাই না।’ সমস্বরে সবাই অট্টহাসি করে হেসে বলে উঠল।

‘তাহলে তোমরা নিজেদেরকে বি. এ. পাস, ম্যাট্রিক পাস কেমন করে বলো?’

‘এজন্যে বলি যে, আমরা যথা সময়ে যদি স্কুলে যেতে পারতাম, তাহলে আজ বি. এ. পাস করতাম, শরিফ এন্ট্রান্স পাস করতো। আর গুর খাঁ ক্লাশ ফাইভে পড়তো, তাকে আর মেয়েদের চুড়ি বেচতে হতো না।’

আমাদের চাকরিকে একটা ভীড় জমে উঠেছে দেখে এক পুলিশ হাওয়ালদার হাঁকতে হাঁকতে দৌড়ে এলো। হাতে তার ছোট একটা বেতের ছড়ি। আন্দোলিত করতে করতে বলল, ‘কি হচ্ছে এখানে, কি হচ্ছে?’

‘না, তেমন কিছু নয়, হাওয়ালাদারজি। এ দুটো নতুন ছোকড়া রংবাজ এসেছে এই পুলে। এখানে বেচা কেনা চলবে না, সব বে-আইনী কাজ।’

পুলিশ বলল, ‘না, এখানে কোন বেচা-কেনা চলবে না, সব বে-আইনী কাজ।’

‘ঝটপট দুটো টাকা বের করো।’ ভিক্টর আস্তে করে আমার কানে কানে বলল।

‘যদি দুটো টাকা না দিই?’ ভগবান পাশ থেকে বলল।

‘তাহলে পুলে বেচা-কেনা করা বে-আইনী হবে।’

‘হুম!’ বলে ভগবান কতক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর পকেট থেকে দু’টো টাকা বের করে ভিক্টরের হাতে দিল। ভিক্টর পুলিশকে একটু দূরে নিয়ে কি যেন বলাবলি করল। পুলিশ সেখান থেকে চলে গেল। তারপর সবাই আবার যার যার দোকানে ফিরে গেল।

প্রায় দেড় ঘন্টা অতিক্রান্ত হলো। ভগবানের একটি বইও কেউ কিনল না। লোকজন এসে রুমাল এবং জামরুলের দোকানে ভীড় জমাতে লাগল। কিছু কিছু লোক ফাউন্টেন পেন, মোজা, চুড়ি, হেয়ার পিন, রিবন ইত্যাদিও কিনতে লাগল। কিন্তু ভগবানের বই’র দোকানের কাছে কেউ ভুলেও ঘেঁষলো না।

‘কি বিচিত্র এই দেশ!’ ভগবান দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম, ছেলেপিলের বাবারা এই সুন্দর সুন্দর ছবির বইগুলো কিনে তাদের সন্তানদের উপহার দেবে। কিন্তু আমি তার সে রকম কোন লক্ষণই দেখছি না।’

‘যেসব বাবাদের কাছে শুধু স্কুলের পাঠ্য বই কেনার পয়সা নেই, তারা তোমার ছড়া-ছবির বই কিনবে কোন দুঃখে?’ আমি ভগবানের মন্তব্যের প্রতিবাদে বললাম।

তিন

ভগবান আমার কথার একটা মোক্ষম জবাব খুঁজছিল, এমন সময় নিচের দিকে একটা শোরগোল শোনা গেল। চেয়ে দেখলাম, একটা লম্বা-চাওড়া লোক এদিকে আসছে। গলাতে একটা গোল তাবিজ, গায়ে চটকদার জামা, পরনে একটা পাতলুন। পাতলুনের মুড়ি গোড়ালীর ওপরে তোলা। পায়ে পায়ে সোপান পেরিয়ে ক্রমশঃ নবাবী ঢং-এ পুলের উপর দিকে উঠে আসছে। তাকে দেখেই ভিখারীরা দাঁড়িয়ে গেল এবং মাথা নত করে সম্ভ্রম প্রকাশ করল। পথচারীরা তার দিকে তাকিয়ে কানাঘুষা করতে লাগল। পায়ে পায়ে আরো কাছাকাছি আসতেই রুমাল বিক্রেতা সোজা বত্রিশ দাঁত বের করে একটা সেল্যুট মারল। সাথে সাথে ভিক্টর, শরীফ, গুর খাঁ –সবাই সেল্যুট করল। আমরা দু’জন যেমন ছিলাম তেমনই দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোন রকম সম্ভাষণ না পেয়ে আমাদের দিকে একটা জ্বালাময়ী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পা-টা এগিয়ে দিলো ভগবানের টুকরির দিকে। এক ঝটকায় টুকরিটা দূরে সরিয়ে দিয়ে ভিক্টরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এরা আবার কোত্থেকে এসে জুটলো এখানে?’

ভিক্টর আমতা আমতা করে বলল, ‘দাদা…দাদা, ছোকড়া দু’টো নতুন এসেছে। এখানে ধান্ধাবাজী করবে, হাবিলদারজী রাজী আছেন।’

শুনে দাদা হাবিলদারের উদ্দেশ্যে কষে গালি ছুঁড়লেন এবং সবশেষে বললেন, ‘এদেরকে বলো নিয়মিত আমার রোজকার চার আনা দিতে পারলে এই পুলে ঠাঁই পাবে।’

‘হাবিলদার অনুমতি দিয়েছেন। সরকারের লোকেরা যেখানে অনুমতি দিয়েছে, সেখানে তুমি বারণ করার কে শুনি?’ ভগবান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল।

‘আমি কে? বলেই দাদা আস্তিন গুটাতে লাগল। ‘দাঁড়া, দেখিয়ে দিচ্ছি, আমি কে?’

পরমুহুর্তেই দাদা ভগবানের আস্ত টুকরিটা তুলে ছুঁড়ে মারল। টুকরির সুন্দর সুন্দর ছবির বইগুলো পাখীর পালকের মতো বাতাসে উড়তে উড়তে বিক্ষিপ্তভাবে অদূরে রেললাইনে গিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পরবর্তী পর্যায়ে আমার জামরুলের টুকরিটাও। জামরুলগুলোও রেলয়াইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। জামরুলগুলো পড়তেই কোত্থেকে এক পাল ছেলে-ছোকড়া বেরিয়ে এলো এবং তুলে তুলে তা পরমানন্দে খেতে লাগল। কিন্তু কি আশ্চর্য, ছেলেগুলো ছবির একটা পাতাও ছুঁল না। ভগবানের দু’চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে এলো। ভিক্টর এবারে আমাদের কাছে এসে বলল, ‘ইনি হলেন, এই পুলের দাদা। মনে কর ইনিই মালিক। তার বিনা অনুমতিতে এখানে কারো বসার সাধ্য নেই। যা করেছ, ক্ষমা চেয়ে নাও আর চার আনা পয়সা আগেই দিয়ে ফেলো। নয়তো সব সময় তোমাদের হয়রাণ করবে।’

‘কিসের চার আনা? এক পয়সাও দেব না এবং এ পুলে বসেই বেচাকেনা করব, দেখি কে ঠেকায়?’

দাদা দাঁতে দাঁত ঘষে ভগবানের গলা টিপে ধরল এবং কোমর হাতড়ে একটা লম্বা কালো চাকু বের করে নিলো। পেছন থেকে আমি তার পা কামড়ে ধরলাম। সে আমার দিকে ফিরতেই কৌশলে আমরা দু’জনে দিলাম ছুট। দাদাও আমাদের পিছু নিল। কিন্তু আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে রণজিৎ ষ্টুডিওতে এসে ঢুকে পড়লাম। এই এলাকার দাদা হলেন, আবার অন্যজন। এজন্যে সে আর ষ্টুডিওতে ঢোকার সাহস পেল না। নিষ্ফল আক্রোশে আমাদের গালি দিতে দিতে ফিরে গেল।

প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ আমরা রণজিৎ ষ্টুডিওর কলা বিভাগের তিন মাথা বিশিষ্ট ব্রহ্মমুর্তির পেছনে আত্মগোপন করে থাকলাম। তারপর এক সময় নিরাপদ মনে করে বেরিয়ে পড়লাম। ভয়ে তখনো বুক দুরু দুরু করছিল। তখন লাঞ্চের সময় ছিল এজন্যে কলা বিভাগে কোন লোক ছিল না। ভগবান ব্রহ্মমূর্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তিন মাথা বিশিষ্ট মূর্তিটা ব্রহ্মজীর, না?

‘হাঁ।’

‘ব্রহ্মার পূজা হয় এখানে নিশ্চয়ই?’

‘না ভগবান, এখানে নগদ লেনদেনের কারবার। এখানে একমাত্র টাকা-পয়সারই পূজা হয়ে থাকে। এ তো প্লাষ্টার নির্মিত ব্রহ্মমূর্তি। প্রয়োজনে ছবির সেটে রাখা হয়েছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে এইব্রহ্মার মাটি দিয়েই আবার রাবণ তৈরী করা হবে।’

‘হুম।’ ভগবানকে একটু চিন্তান্বিত দেখালো।

‘কিছু বলছিলে?’ আমি বললাম।

‘না, আজ বেশ মনে পড়ছে, সৃষ্টির আদিতে আমি যখন ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করলাম, সে আমার কাছে তিনটা মাথা চেয়ে বসেছিল। আমি ভ্রু-কুঁচকে বলেছিলাম, তিনটা মাথা দিয়ে কি হবে। কিন্তু ব্রহ্মা নাছোড়বান্দা হয়ে বলেছিল, না, তিনটা মাথা দিতে হবে আপনাকে। তিনটা মাথা দিলে আমার কিইবা এমন ক্ষতি। তাই আমি তাকে তিনটা মাথাই দিয়েছিলাম। কিন্তু সে সময় তিনটা মাথা চাওয়ার তাৎপর্য আমার বোধগম্য হয়নি। কিন্তু আজ যখন গুন্ডারা আমার গলা টিপে ধরল, আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম, দাদার পুলে যারা কেনা-বেচা করতে চায় তাদের ঘাড়ের উপর চারটা মাথা থাকা দরকার। এতদিনে বুঝলাম ব্রহ্মা আমার কাছে তিনটা মাথা কেন চেয়েছিল।’ বলেই ভগবান একটু মুচকি হাসল।

‘ব্রহ্মা তিনটা মাথা কেন চেয়েছিল সেটা তুমিই ভালো বলতে পার। যেমন তুমি, তেমনি তোমার ব্রহ্মা। তবে আমি জানি, এই দুনিয়াতে একটা মাথাই বাঁচিয়ে রাখা দায়, আর তিনটা মাথা হলে এত খাবার দাবার কোত্থেকে জোটে।’

খাবার-দাবার প্রসঙ্গে আসতেই আমার খুব ক্ষুধা পেতে লাগল। ভগবান বলল, ‘তোমার তো আর কাজ নেই, শুধু ক্ষুধা আর ক্ষুধা।’

‘কেন, তোমার ক্ষুধা পায় না?’

‘না। আমার কোন ক্ষুধা নেই। তবে কখনো কখনো আমার মাথা ব্যথা হয়ে থাকে।’ ভগবান মুখটা গম্ভীর করে বলল।

‘মাথা ব্যথা? কখন হয় সেটা?’

‘যখন কোন তারকা কক্ষচ্যুত হয়, যখন কোন শিশু মায়ের কোল খালি করে চলে যায় আর যখন কোন ফুল নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ঝরে যায়।’

ব্যথাটা কি তখন মাথাতে হয়ে থাকে, না অন্তঃকরণে?

‘মাথাতেই। অন্তঃকরণ বা হৃদয় বলে তো আমার কিছু নেই। আমি এমন কি দেবতাদেরকেও হৃদয় দিইনি। হৃদয় শুধু আমি মানব জাতিকে দিয়েছি। কারণ মানুষ জাতের পক্ষে পাপাচার করা সম্ভব।’

আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম আর ভগবানকে দেখছিলাম আড়চোখে। ভগবানের চেহারাতে কোন ভাবলেশ ছিল না। অভিব্যক্তিতে কোন দর্শন ছিল না। শিশুর মতো নিষ্পাপ অনাবিল একখানি মুখ। সহসা আমার মনে হলো, আমাদের কাছেই একটা গণেশ শুড় উত্তোলন করে ভগবানের পদযুগলের কাছে ভক্তি নিবেদন করল। হঠাৎ ভগবান আমাকে বলল, ‘চলো, তোমার ক্ষুধা পেয়েছে, তোমার ক্ষুধা মিটিয়ে দিই।’

‘অসম্ভব। মানুষের ক্ষুধাও কেউ কোনদিন নিবৃত করতে পারে?’

রণজিৎ ষ্টুডিওর কেন্টিনে ঢুকে আমি প্রথমে ‘কোকা কোলা’ পান করলাম। তারপর ডাল ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, বিরানি এবং ক্ষীরমালাই উদরসস্থ করলাম। ভগবান কিছুই নিল না। তার জন্যে শুধু দু’টো এসপ্রোর বড়ি নিল। খেয়ে দেয়ে যখন বিল দেবার পালা এলো ভগবান মানিব্যাগ বের করতেই ভেতর থেকে দশ টাকার বহু নোট উঁকি দিল। পাশে এক ফিল্মষ্টার বসেছিল। এত টাকা দেখে তার চক্ষু চড়ক গাছ আর কি!

ফিল্মষ্টার-এর নাম ছিল টিক্কু। ছবিতে বাচ্চাদের ভূমিকাতে সে একচেটিয়া। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। কমেডিয়ান হিসাবেও মন্দ না। কিন্তু ইদানীং তার দিনকাল ভালো যাচ্ছিল না। যেভাবে টিক্কু আমার প্লেটের দিকে তাকাচ্ছিল তাতেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম তার পকেটের অবস্থা। তাছাড়া দাদর পুলের কাছের চৌরঙ্গীর পানের দোকানে মাঝে মাঝে দেখা হতো তার সাথে, তখন দু’চার আনা ধার কর্জ নিতো আমার কাছ থেকে। অবশ্য যখন আমার কাছে পয়সা থাকত।

টিক্কুর মুখাবয়ব নিশপাপ শিশুর মতো ভাবলেশহীন। দেখে মায়া হয়। তার উচ্চতা আমাদের চেয়েও এক ফুট কম। টিক্কু একটু সৌজন্যমুলক হাসি হেসে ভগবানের কাছ ঘেঁষে বসল।

‘বোম্বেতে নতুন এসেছ, না?’

টিক্কু আমার প্লেটের দিকে চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে বলল। দু’একবার জিভও চেটে নিলো অলক্ষ্যে।

ভগবান বলল, ‘হাঁ, আজই এসেছি।’

‘ছবিতে কাজ-কাম করার ইচ্ছে আছে নাকি?’

‘ছবিতে? কিন্তু সুযোগ কোথায়?’

‘আছে বৈ কি! তোমার মা-বাপ কোথায়?’

‘মা-বাপ তো নেই আমার।’ ভগবান নেহাত অনাথের মতো বলল।

টিক্কু এবার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল এবং ভগবানের কাঁধে হাত রাখল। আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ও তোমার ছোটভাই, না?’

‘না, ও আমার এক বন্ধু।’ ভগবান বলল।

চার

টিক্কু আমার দিকে চরম সন্দেহের চোখে তাকাল। তার চোখ দেখে মনে হলো, আমি বন্ধু না ছাই –আমি একটা চোর ছাড়া কিছু না। তার এ ধারা দৃষ্টিপাতের জবাবে আমিও তার দিকে একটা বিরূপ ভ্রুকুটি নিক্ষেপ করলাম।

‘তাহলে তোমার বন্ধুও ছবিতে কাজ করতে এসেছে?’

‘জানি না তার মনোভাব কি। তাকেই জিজ্ঞেস করো।’ ভগবান বলল।

‘জিজ্ঞেস করে আর কি হবে? এই চেহারা নিয়ে সারা জীবন সাধনা করেও সে ফিল্মে চান্স পাবে না।’

টিক্কু আর একবার আমার দিকে শ্যেন দৃষতিতে তাকাল। ভগবান বলল, ‘আর আমি? আমার চেহারাটা…?’

‘তোমার? তোমার চেহারাতে বরং একটা আকর্ষণ আছে। তোমার চেহারাতে এমন একটা সহজাত লাবণ্য রয়েছে যা কিনা ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির সকল শিশুশিল্পীর চেহারা ম্লান করে দিতে পারে। তোমার একটা আদর্শ চেহারা বটে!’

‘আর আমার চেহারাটা এবড়ো-খেবড়ো, তাই না?’

টিক্কুর কথা শুনে আমার গা জ্বালা করছিল। এ কথাটাই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। এ সময় টিক্কু আমাকে ঠিক চিনে উঠতে পারল না। কেননা, আমি তো আর আমি নেই। একজন শিশুতে রূপান্তরিত হয়েছি আমি। আর আমি যদি এ সময় শিশু না হয়ে আসল চেহারায় থাকলাম, টিক্কুর অবস্থা কাহিল করে দিলাম।

টিক্কু আমার কথা না শোনার ভান করে ভগবানকে প্রশ্ন করল, ‘তোমার নাম কি?’

‘ভগবান।’

‘তোমার বয়স কত?’

‘আমি বলতে পারব না।’

‘দেখতে তো আমারই মতো। বড় জোর বার বছর হবে।’

‘তোমার তাহলে মাত্র বার বছর বয়েস?’ ভগবান পালটা প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, আগামী ক্রিসমাসের সময় বার বছর পুরো হবে।’

টিক্কু নেহাত বিনীতভাবে বলল। তারপর খুবই সোহাগভরে হাত দু’টো ভগবানের কাঁধের উপর রেখে বলল ‘জানো, আমার নাম কিন্তু টিক্কু। ফিল্ম লাইনে আমি আজ ত্রিশ বছর যাবৎ আরে না না, মাত্র তিন বছর যাবৎ কাজ করেছি। চাইল্ড ষ্টারদের মাঝে আমার নাম একেবারে পয়লা নম্বরে! কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার মনে হচ্ছে কোন ক্রমেই আমি তোমার কাছ ঘেঁষতে পারব না, অর্থাৎ কিনা তুমি যদি এ লাইনে সত্যিকার পদার্পণ করো। আমি লক্ষ্য করছি, তোমার চোখে একটি বিশেষ লক্ষণ প্রতিভাত হচ্ছে…’

‘তার মানে?’

টিক্কু কথাটি না শোনার ভান করে বলেই চলল তুমি যদি আমার কথা মতো চলো, ‘তাহলে আমি তোমাকে ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রির সবচাইতে বড় ষ্টার বানিয়ে দেব। সবচাইতে বড় চাইল্ড ষ্টার ডেইজি ইরানী কত টাকা পায় জানো?’

‘কত পায়?’

‘প্রতি ছবির জন্যে ত্রিশ হাজার।’

‘ত্রিশ হাজার? না, এ কোনদিন সম্ভব নয়। দশ বছরের এক শিশু শিল্পীর জন্যে এত টাকা?’

‘ডেইজির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সোমী কত পায় জানো?’

ভগবান নেতিবাচক ইঙ্গিত করে বলল, ‘না, জানি না তো।’

‘চল্লিশ হাজার!’

‘জানো, আজ থেকে পনের বছর আগে, মানে পাঁচ বছর, আরে বছর নয়, পাঁচ মাস আগে এই অধমই সোমীকে সর্বপ্রথম ছবিতে কাজ করার সুযোগ করে দেয়।’

‘বাব্বা, চল্লিশ হাজার! আর আমি কিনা মাত্র দু’শো টাকা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। একত্রে দু’শো টাকার বেশী আমি কোনদিন দেখিওনি।’

‘দেখনি? চলো আমার সাথে। আমি ফিল্ম ডাইরেক্টরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’

টিক্কু ভগবানকে একরকম টেনেই নিয়ে চলল।

‘আরে ভগবান, আমাকে ফেলে তুমি কোথায় চললে? আমি তোমার সাথে আসছি।’

‘কিন্তু, কিন্তু…’

‘আমি ফিল্ম ষ্টার হতে চললাম।’

আমি দাঁতে দাঁত পিষে কেন্টিনেই বসে পড়লাম।

প্রায় একঘন্টা পর ভগবান ফিরে এলো, কিন্তু একাকী।

‘টিক্কু কোথায়?’

‘সে ওখানেই রয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যার দিকে ‘হিন্দুমাতা’ সিনেমার কাছে আমদের দেখা হবে।’

‘আসলে ব্যাপারটা কি? হতভাগা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল তোমাকে?’

ভগবানকে বেশ হাসি খুশী লাগছিল। ঠোঁটে একঝিলিক হাসি লেগে আছে।

‘ক’দিনের মধ্যে আমিও একজন ফিল্মষ্টার হতে যাচ্ছি। স্বর্গে গিয়ে আমার আর কাজ কি? শুনতে পাচ্ছ? আমি কিন্তু আর স্বর্গে ফিরে যেতে চাই না। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই আমার স্যুটিং শুরু হবে। প্রথম ছবিতেই ওরা আমাকে ত্রিশ হাজার দিতে রাজী হয়েছে। থাকার জন্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা ফ্লাটও আমার জন্যে খালি করা হচ্ছে। ভ্রমণের জন্যে একটা কেডিলাক গাড়ীও পাচ্ছি। এসব ছেড়ে কোন বোকা স্বর্গে যেতে চায়?’ স্বর্গে যা পাব না, আমি তার সবই এখানে পাব। পত্র-পত্রিকায় আমার রঙ্গিন ছবি ছাপা হবে, আমার নাম নেবে সবাই।

‘তোমার নাম তো এমনিতেই সবাই নিয়ে থাকে। সব জায়গাতে বিছমিল্লাতেই তোমার নাম উচ্চারণ করা হয়।’

‘সবাই তো নেয়। কিন্তু খবরের কাগজে তো আমার নাম থাকে না। মসজিদ, মন্দির, গুরুদ্বার, গির্জা –সর্বত্রই আমার নাম উচ্চারণ করা হয় মানি, কিন্তু খবরের কাগজে আদ্যোপান্ত চষে বেড়ালেও আমার নাম পাওয়া যায় না। এমন কি নাইট ক্লাব, হোটেল ইত্যাদিতেও আমার নাম নেই। মোটকথা সব রকম চমকপ্রদ স্থানগুলোতে আমার এ অনুপস্থিতি আমার সহ্য হয় না। কত আনন্দ, এখন থেকে ‘মুভি কেয়ার’ পত্রিকাগুলোতে আমার ছবির পূজা করা হবে। নিরূপা রায়ের মতো অভিনেত্রীর সাথে আমি অভিনয় করবো। আর জান, অশোক কুমার এবং প্রাণও এ ছবিতে থাকছে।’

বলতে বলতে ভগবান খুশিতে একেবারে নেচে উঠল। আমি ভগবানকে নিরস্ত করে বললাম, ‘তুমি একটাবোকার হদ্দ। তুমি যদি এসব করে বেড়াও তো বিশ্ব-সংসার কে চলাবে?’

‘চুলোয় যাক তোমাদের বিশ্ব।’ ভগবান অনেকটা বিরক্তি ভরে বলল। ‘জানো, এই তোমাদের দুনিয়ার কথা ভাবতে গেলেই আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়।’

শুনতে শুনতে আমি একেবারে ঘেমে উঠলাম। তাড়াতাড়ি একটা ‘কোকা কোলা’ এনে তেষ্টা মেটাতে মেটাতে বললাম, ‘কিন্তু এসব এত তাড়াতাড়ি পাকাপাকি হয়ে গেল কেমন করে?’

‘শুধু আমার চেহারা দেখেই। এমন নিষ্পাপ আর নির্মল চেহারা নাকি আর হয় না। জান, টিক্কু ছেলেটা বড় ভালো। প্রথমে সে আমাকে সহকারী পরিচালকের কাছে নিয়ে গেল। সহকারী পরিচালক সহানুভুতিশীল মন নিয়ে আমার করুণ জীবন বৃতান্ত শুনলো এবং যখন জানল যে, আমার মা-বাপ কেউ নেই আর আমি ছবিতে কাজ করতে ইচ্ছুক –তখন আমার প্রতি বেশ সদয় হলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার পকেটে দু’টো টাকা হবে?’

আমি বললাম, ‘হবে।’

বললেন, ‘আমাকে দাও, ডিরেক্টর আজ আমাকে লাঞ্চের টাকাটা দেয়নি। তোমার টাকাটা কালকে নিয়ে নিও। ছবিতে চমৎকার একটা রোল আছে। ওটা তোমারই জন্যে বরাদ্দ থাকল। শিশু-শিল্পী হিসেবে তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। দাঁড়াও, আমি এক্ষুণি ডিরেক্টরের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’ –এসব শুনে আমি তাকে দু’টো টাকা দিয়ে দিলাম।

আমি ঠোট উল্টিয়ে বললাম, ‘শেষ অব্দি টাকা দু’টো দিয়েই দিলে?’

‘হাঁ, কারণ সে পরক্ষণেই আমাকে ডিরেক্টরের সাথে দেখা করবার জন্যে নিয়ে গেল। ডিরেক্টর ছবির একটা শট্‌ নেয়ার ব্যাপারে খুবই ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু টিক্কু এবং সহকারী পরিচালক যখন কানে কানে বলল –সুন্দর নাদুস নুদুস একটা ছেলে পাওয়া গেছে। শিশু-শিল্পী হিসেবে তাকে অপূর্ব মানাবে তখন ডিরেক্টর হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এলো এবং আমার আদ্যেপান্ত করুণ কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শুনল। যখন সে জানতে পারল যে, আমি পিতৃমাতৃহীন তখন ডিরেক্টর আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপাততঃ গোটা দশেক টাকা হবে তোমার কাছে? আমি জানালাম, হবে। তখন সে আমাকে বলল, টাকাটা দিয়ে দাও। কালকে ডিষ্ট্রিবিউটরের চেকটা এলেই তোমার টাকাটা পেয়ে যাবে। আমার আগামী ছবিতে তোমাকে চান্স দিচ্ছি। এসব শুনে আমি তাকে দশ টাকা এগিয়ে দিলাম। এরপর টিক্কু আমাকে ছবির ডিষ্ট্রিবিউটরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে গেলে। ডিষ্ট্রিবিউটর কলকাতার কলের জন্যে টেলিফোনের সামনে বসেছিল। আমার কথা শুনে সেও ছুটে এলো। অনুরূপভাবে সেও আমার করুণ জীবন বৃত্তান্ত মনোযোগ দিয়ে শুনল। আমার কাহিনী শুনতে শুনতে যখন জানতে পারল যে, আমার মা-বাপ নেই,তখন চোখ দু’টো তার অশ্রুসজল হয়ে উঠল। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বলল, তোমার পকেটে টাকা আছে? অল্প সময়ের জন্যে গোটা পঁচিশেক টাকা হবে? আমি কালই একটা চেক পাচ্ছি। কাল তোমার টাকাটা দিয়ে দেব। তোমার সাথে কালই আমাদের পাকাপাকি ত্রিশ হাজার টাকার কনট্রাক্ট সেরে ফেলব। এসব শুনে ডিষ্ট্রিবিউটরকেও আমি পঁচিশ টাকা দিলাম। কেমন মনে হয় তোমার? অশোক কুমার, প্রাণ আর নিরূপা রায়ের সাথে পত্র-পত্রিকায় চমৎকার লেটারিং-এ আমার নামটাও থাকবে।’

বলতে বলতে ভগবান আর একচোট হেসে নিলো। সারা দেহ-মনে আনন্দ উছলে পড়ছিলো যেন তার।

এতক্ষণে আমি মুখ খুললাম। বললাম, ‘সবাইতো নিলো, টিক্কু কিছু নিলো না তোমার কাছ থেকে?’

‘না, তবে সে প্রথম যাত্রাতেই গোটা পাঁচেক টাকা নিয়েছিল, সে টাকা তো কালই দিয়ে দিচ্ছে সে। আজ বিকেলে হিন্দুমাতা প্রেক্ষাগৃহের কাছে আমাদের আবার দেখা হবে। টিক্কু বেশ ছেলে।’

‘টিক্কু বেশ ছেলে না ছাই! হারামজাদার বয়েস যে চল্লিশ তা কি তুমি জান না? খোদার কসম, তোমার মত এমন বোকা আমি আর দেখিনি।’

ভগবান চোখ ছানাবড়া করে আমার দিকে তাকাল। কিছুই যেন বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছিল আমার ক্রুদ্ধ মুখাবয়ব। ভগবানের অসহায় অভিব্যক্তি দেখে আমার মায়া হলো। কেন মিছেমিছি তাকে দুঃখ দিলাম। আমি হেসে উঠে তার হাত চেপে ধরে বললাম, ‘যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। চলো ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পড়ি। নয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার পকেট খালি হয়ে যকাবে।’

বিকেল পাঁচটায় আমরা দু’জনে হিন্দুমাতা প্রেক্ষাগৃহের কাছে টিক্কুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু টিক্কুর টিকিটি পর্যন্ত দেখা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *