পনেরো
এবারে মেরিন ড্রাইভের পথ ধরে চলছিলাম। কখনো সমুদ্রের তরঙ্গ ভঙ্গের উত্তাল গর্জন এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল আমাদের পায়ের কাছে। আমরা ক্রমান্বয়ে চৌপাটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
চলতে চলতে ভগবান আমাকে বলল, ‘ছেলেপিলেদের দ্বারা এসব নোংরা কাজ করানো উচিত নয়। শিশুরা তো দেশের সম্পদ। জীবনের প্রথম উষালগ্নেই এদের অন্তঃকরণকে কলুষিত করে পাপ-পঙ্কিল জীবনের দিকে চালিত করা ঠিক নয়। এসব কোমলমতি শিশুরা থাকবে স্কুলে। এ বয়সই তো এদের আচার, ব্যবহার এবং ভদ্রতা শেখার সময়। অথচ এ সময়েই তাদেরকে মদ বিক্রি করতে দেখা যায়। মেয়ে সাপ্লাইয়ের মতো চরম নোংরা কাজও এদেরকে দিয়ে করানো হয়। কুকুরের মতো টেক্সির পেছনে ধাওয়া করে এক আনা দু’ আনার জন্যে। আমি তো এই শিশুদেরকে এ কাজের জন্যে পৃথিবীতে পাঠাইনি। বোম্বেতে কি কোন স্কুল নেই এসব ছেলেপিলেদের জন্যে? তোমাদের সমাজের ছেলেপিলেরা স্কুলে যায় না? ভালো কাপড়-চোপড় পরে বগলে বই নিয়ে তোমাদের ছেলেরা কি স্কুলে কোনদিন যায় না? তোমাদের শিশুরা জীবনের পাঠ কি মাষ্টার মশাই’র কাছ থেকে শেখে না? এ ধরনের স্কুলে পড়ুয়া একটি ছেলেও কি নেই? আমি কি এসব ছেলেদেরকে দু’নয়ন ভরে একটু দেখতে পাব না?’
আমি বললাম, ‘স্কুলে পড়াশুনা করে এ ধরনের ছেলেপিলে একেবারে যে নেই, তা নয়। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। চলো তমাকে এ ধরনের ছেলেপিলেদের দেখিয়ে দেবো মালাবার হিল স্কুলে। মালাবার হিলের মডার্ণ স্কুলে এ ধরনের ফুটফুটে ছেলেদের অন্ত নেই। কিন্তু আমি যে চলতে পারছি না। ক্ষুধায় আমার পেট দুমড়ে আসছে।
ভগবান বলল, ‘কই তোমার সেই মডার্ণ স্কুল কোথায়?’
আমি বললাম, ‘ওইতো সামনের পাহাড়ের টিলার ওপরে।
ভগবানের দৃষ্টি সহসা পাহাড়ের উপরের সুদৃশ্য স্কুলের দিকে নিবদ্ধ হলো। ভগবান আমাকে বললো, চোখ বন্ধ করতে, আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। পরমুহুর্তেই দেখলাম, আমরা দু’জন মালাবার হিল স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।
স্কুল ভবনটি খুবই সুদৃশ্য, সুরম্য। দ্বিতল ভবনটির বিভিন্ন দেয়ালে মূল্যবান প্রস্তরখন্ড ব্যবহৃত হয়েছে। পুরোটা ভবনে গোলাবি রং-এর বার্নিশ আর দরজা-জানালায় দেয়া হয়েছে সাদা রং। লনে সবুজ ঘাস আর রকমারী ফুলের সমারোহ। লনে ছোট শিশুরা দলে দলে ছুটাছুটি করছিল।
ভগবান বলল, ‘এই বুঝি তোমাদের স্কুল?’ এরপর ভগবান স্কুলের চাপরাসীকে থামিয়ে বলল, ‘তোমাদের স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল কোথায়?’
চাপরাসী ভ্রূ-কুঞ্চিত করে আমাদের আপাদপমস্তক দেখে নিল। ময়লা অগোছালো কাপড়-চোপড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা যদি বার্নিশ কোম্পানী থেকে এসে থাকো তাহলে সোজা একাউন্টেন্টের কাছে চলে যাও এই পথ ধরে।’
ভগবান কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল, ‘না, আমরা কোন বার্নিশ কোম্পানীর লোক নই। আমরা প্রিন্সিপ্যালকে চাই।
বাধ্য হয়ে চাপরাসী বামদিকে হাত দেখিয়ে বলল, ‘বড়সা’ব এদিকে বসেন।
চাপরাসী লোকটি আমাদেরকে যে দরজার দিক দেখিয়ে দিলো, তার ভেতরের কক্ষটি বেশ সুসজ্জিত। ভেতরের জানালাগুলোতে রয়েছে কড়া সবুজ রং-এর পর্দা। বাইরে পিতলের তৈরী নাম-ফলকে লেখা রয়েছে ‘প্রিন্সিপ্যাল’। দরজার দু’পাশে রয়েছে দু’টো ফুলের টব। এ সময় প্রিন্সিপ্যালের চাপরাসী কোথায় যেন গিয়েছিল। এই সুযোগে আমরা দু’জন ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
প্রিন্সিপ্যাল ভদ্রলকের বেশ গোলগাল সুন্দর চেহারা। মাঝারী ধরনের লম্বা-চওড়া লোক। ভদ্রলোক যখন হাসেন, মনে হয় একটা চমৎকার জবা ফুল ফুটে রয়েছে। অথবা মনে হয় একটা উজ্জ্বল ১০০ পাওয়ারের বিজলীবাতির আলোকে তার মুখটা ঝলসানো। হাসির সময় তার মুখ থেকে নিরন্তর আলো ঠিকরে পড়তে থাকে। এ সময় তিনি টেবিলে ঝুঁকে কি যেন লিখছেন। কারো আগমন টের পেয়ে মাথা না তুলেই বলেলন, ‘বসুন, আমি আপনাদের কি খেদমত করতে পারি?’
ভগবান বলল, ‘আমরা দু’জন আপনার স্কুলে ভর্তি হতে চাই।
প্রিন্সিপ্যাল এবার মাথা তুললেন এবং তার মুখের উপরে বর্ণিত সেই হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু আমাদের চেহারা ও পোশাক-আশাক দেখে তার মুখের সেই উজ্জ্বল হাসি মিলিয়ে গেল। মনে হলো কে যেন সুইচ অফ করে দিয়েছে। এবারে তাকে খুব গম্ভীর মনে হলো।
গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘মিউনিসিপ্যাল স্কুলে চেষ্টা করো।
ভগবান বলল, ‘কিন্তু আমরা তো এ স্কুলেই ভর্তি হতে চাই।
প্রিন্সিপ্যাল বলল, ‘কোন ক্লাশে ভর্তি হতে চাও?’
‘পঞ্চম শ্রেণীতে।
প্রিন্সিপ্যাল জবাব দিলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণীতে তো আগামী বছরের জন্যে সকল সিট রিজার্ভ হয়ে আছে।
ভগবান বলল, ‘এটা কি স্কুল, না রেলগাড়ীর কম্পার্টম্যান্ট?’
প্রিন্সিপ্যাল আসলে একজন ভারতীয় হলেও এই মুহুর্তে তাকে বিদেশী মনে হচ্ছিল। দু’বাহু নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘…আর আমরা সেসব ছেলেদেরকেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকি যারা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়।
তারপর ভগবানের দিক মুখ করে বললেন, ‘তুমি পরীক্ষায় কেমন রেজাল্ট করেছ?’
আমি বললাম, ‘ওতো সব সময় সব ক্লাশে ফার্ষ্ট হয়।
প্রিন্সিপ্যালের মুখে আবার উজ্জ্বলতা ফিরে এলো। প্রিন্সিপ্যাল এবারে তার দিকে একটা ফর্ম এগিয়ে দিয়ে বলেলন, ‘তোমার বাবার কি নাম এবং তার পেশা কি?’
ভগবান বলল, ‘আমার তো বাবা-মা কেউ নেই।
‘তাহলে তোমার পড়ার খরচ কে চালাবে?’ প্রিন্সিপ্যাল ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন।
ভগবান বলল, ‘ফার্ষ্ট ক্লাসের ছেলেদের জন্যে কোন বৃত্তি নেই?’
‘হ্যাঁ, তাতো মাসে পনের টাকা মাত্র।
ভগবান বলল, ‘ওই পনের টাকা দিয়েই আমার চলবে।
প্রিন্সিপ্যাল বললেন, ‘পনের টাকা তো আমার স্কুলের ছেলেদের ধোপা খরচ। সবকিছু মিলিয়ে আমার ছেলেদের মাথাপিছু খরচ হয় প্রতি মাসে ২৫০ টাকা।
ভগবান বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘এক ছেলের পেছনে আড়াইশ’ টাকা! এক ছেলের পেছনে এত টাকা খরচ করতে পারে, বোম্বেতে এমন ক’জন লোক আছে?’
‘কয়েক হাজার তো অবশ্যই হবে।
‘তাহলে বাকী লোকদের ছেলেপিলে কোথায় পড়ে?’
‘তাদের জন্যে অন্য স্কুল রয়েছে।
ভগবান বলল, ‘কিন্তু সেগুলো তো এত ভালো স্কুল নয়। যতাদের ছেলেরা যদি এ ধরনের উন্নত মানের স্কুলে পড়তে চায়, তাদের কি করতে হবে?’
প্রিন্সিপ্যাল উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘তাদেরকে লক্ষপতি দেখে বাপ নির্বাচন করতে হবে। আমার হাতে এত সময় নেই –এসব ফালতু কথায় সময় কাটানোর জন্যে। এবার তোমরা আসতে পারো।
ষোল
মানে মানে আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু ভগবানের মনটা কেমন উশখুশ করছিল। বারান্দা দিয়ে চলতে চলতে সে হঠাৎ একটা ক্লাশে ঢুকে পরল। আমি দু’হাতে বাধা দেয়া সত্ত্বেও সে ঢুকে পড়ল। বাধ্য হয়ে আমাকেও তার সঙ্গ নিতে হলো। ক্লাশে ঢুকে আমরা একেবারে পেছনের বেঞ্চে যেয়ে বসলাম। ক্লাশের ছেলেরা চোখ ছানাবড়া করে আমাদের দেখতে লাগলো। ক্লাশে মাষ্টার মশাই বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিল অনর্গল। এজন্যে আমাদের কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার সময় ছিল না তার। টিচার নেপলিয়ান বোনাপার্টের ওপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন –নেপোলিয়ান বোনাপার্ট একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন।
ভগবান চট করে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কেন তিনি একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন?’
‘যেহেতু তিনি ইউরোপ জয় করেছিলেন।
ভগবান আবার প্রশ্ন করল, ‘সে কি একাই ইউরোপ জয় করেছিল? তার অভিযানে সাহায্য করার জন্যে কি লক্ষ লক্ষ সৈন্য ছিল না? সৈন্যদের সাহায্য ছাড়া যদি সে দেশ জয় করতে পারতো তাহলে তাকে আমি একজন বিরাট মানুষ বলে মানতে পারলাম। যুদ্ধ করার মধ্যে বাহাদুরিটা কোথায়? যুদ্ধে তো হাজার হাজার লোক মারা যায়। লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ সংহারকারীকে কোন্ যুক্তিতে বড় মানুষ বা মহান ব্যক্তি বলা যেতে পারে?’
এতক্ষণে টিচার ভগবানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন এবং বললেন, ‘তুমি কে? তোমাকে তো এ ক্লাশের ছেলে বলে মনে হচ্ছে না। তোমাদের পরনে একি পোশাক, স্কুলের ইউনিফর্ম কোথায়? গেট আউট!’
ভগবান অট্টহাসি হেসে বাইরে চলে এলো।
টিচার তার এহেন দুষ্টুমিতে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন।
লনের একদিকে ক’টি ছেলে ভলিবল খেলছিল। আমরা এবার তাদের দলে যেয়ে শামিল হলাম।
ভগবান হঠাৎ বলটি ধরে ফেলে বলল, ‘আমরাও তোমাদের সাথে খেলবো।’
সমস্বরে সবাই বলল, ‘তোমরা কে? তোমরা আমাদের স্কুলের ছেলে নও।
ভগবান বলল, ‘স্কুলের ছেলে নই তো কি হয়েছে? তোমরা ছেলে, আমরাও ছেলে, মিলেমিশে খেলা করব।’
‘না, আমরা তোমাদের সাথে খেলব না। আমাদের বল ফিরিয়ে দাও বলছি। তোমাদের সাথে খেলব না।
‘কেন খেলবে না? কিছুক্ষণ খেলতে দাও। মনটা একটু হালকা হবে। ভগবান কাচুমাচু করে বলল।
‘আমাদের বল দেবে কিনা বলো?’ বলে সবাই আমাদের ঘিরে ধরল।
একটা ছেলে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘হতভাগা, নোংরা, কুকুর কোথাকার! স্কুলের ভেতর ঢুকে পড়েছ। দেখাচ্ছি তোমাদের মজা!’ –বলেই ছেলেটি ভগবানের উপর ঝাঁপিয়ে পরল।
ভগবানের নাকে-মুখে দমাদম কিল-ঘুষি পড়তে লাগল। আমি প্রাণপণে বাধা দিতে গিয়ে চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগলাম। আমার নাকে-মুখেও কয়েক ঘা লেগেছে ততক্ষণে।
সন্ধ্যায় আমি এবং ভগবান ফুলা নাক এবং ক্ষত-বিক্ষত হাত-পা নিয়ে ডেরায় ফিরছিলাম। ভগবান চরম আক্ষেপের সুরে বলল, ‘ছি! এই বুঝি তোমাদের শহর, যেখানে ছেলেরা ছেলেদের দেখতে পারে না।’
ডেরায় ফিরে এসে ক্লান্তি এবং একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে হেলান দিয়ে বসেছিলাম।
ভগবান আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ঘুমাচ্ছ না কেন?’
‘ঘুম আসছে না, ঘুমোব কেমন করে?’
ভগবান বলল, ‘ঘুম কেন আসছে না?’
‘ক্ষুধা পেয়েছে তাই।’
ভগবান একটু মুচকি হেসে বলল, ‘ক্ষুধা পেয়েছে তো কি হয়েছে, গোস-পরাটা পোলাও-বিরানী চিকেন-টিক্কা যেটা ইচ্ছে সেটা আনিয়ে নাও। বোম্বের যে কোন একটা ভালো রেষ্টুরেন্টে এর সবগুলোই পাবে তুমি।
আমি ক্ষুধার তীব্রতা প্রকাশ করে বললাম, ‘কিন্তু তোমার এই দুনিয়ায় বিনা পয়সায় তো কোনটা পাবার জো নেই।
ভগবান বলল, ‘কে বললে বিনা পয়সায় কিছু পাওয়া যায় না? বাতাস তো রয়েছে সকল সৃষ্ট জীবের জন্যে। আমি বাতাস ‘ফ্রি অব কষ্ট্’ করে দিয়েছি।’
আমি দাঁতে দাঁত পিশে বললাম, ‘ঠিক আছে, আজ রাতে বাতাস খেয়েই কাটাবো। চলো, বাইরে চলো।
ভগবান বলল, ‘না, আমি যাব না। আমার ঘুম আসছে।
আমি বললাম, ‘একচেটিয়া তোমার ঘুম আসলে তো চলবে না। আমার যেহেতু ঘুম আসছে না, এজন্যে তোমারও ঘুমানো চলবে না।’
ভগবান বলল, ‘কোথায় যেতে চাও?’
‘হাওয়া খেতে। বলেই আমি ভগবানকে চাটাই থেকে টেনে ছিঁচড়ে তুওললাম।’
ভগবান আপত্তি করে বলল, ‘আমাকে শুতে দাও।’
আমি বললাম, ‘তা হয় না। আমি যতক্ষণ কোন কিছু খেতে না পাব, তোমাকে শুতে দেব না।’
অতঃপর ভগবানকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। রাত সবে এগারটা বেজেছে। তবু চারিদিকে দম আটকে আসবার মতো ভ্যাপসা গরম। মনে হচ্ছে, গরম ধোঁয়াটে বাতাস গলার মধ্যে দম আটকে ফেলতে চায়।
আমি বললাম, ‘এগুলোকে তুমি হাওয়া বলতে চাও?’
ভগবানের চোখে-মুখে তখনো ঘুমের আমেজ। ভগবান তখনও ছেলের রূপ ত্যাগ করেনি। কচি খোকার মতো মুখখানা…মায়াবী চেহারা…আমার কথা যেন তার কানে গেল না।
আমি তার গা ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘কি, শুনতে পাও না? ওই দেখ।
ভগবান বলল, ‘কই, কি হেয়েছে?’
আমরা চলতে চলতে প্রায় পুলের পাদদেশে এসে পড়েছি। চারিদিক নীরব নিস্তদ্ধ। রাজপথের দূর-দূরান্ত পর্যন্ত খাঁ খাঁ করছিল। আশেপাশের গলিগুলোও নীরব, অন্ধকার। পুলের নিম্নাংশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশেপাশে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। পুলের অনতিদূরে একটা লাইট পোষ্টের বাতি টিম টিম করে জ্বলছিল। হঠাৎ দেখা গেল পুলের মাঝখানে বসে একটা দশ-এগার বছরের ছেলে ঠোঙ্গা থেকে তুলে তুলে ‘ভিলপুরী’ খাচ্ছে।
আমি বললাম, ‘ওই দেখ, ছেলেটি ভিলপুরী খাচ্ছে। চলো, ওর কাছ থেকে ওগুলো ছিনিয়ে নিই।
ভগবান বলল, ‘এটা তো ভালো কাজ নয়।’
আমি বললাম, ‘তুলে রাখো তোমার ভালোমন্দ, ক্ষুধায় মরে গেলাম!’
ভগবান আবার বলল, ‘জবরদস্তি কেড়ে নেওয়া মস্তবড় পাপ। আমি কোনমতে এর অনুমতি দিতে পারি না। তবে আমরা ছেলেটির কাছে খাবার ভিক্ষা করতে পারি।
আমরা আস্তে আস্তে ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে ছেলেটির মনে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সে নিশ্চিন্ত মনে ভিলপুরী খাচ্ছিল। আমরা পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ছেলেটির কাছে আমাদের ক্ষুধার কথা জানালাম। জানাতেই ছেলেটি কোন রকম দ্বিরুক্তি না করে ঠোঙ্গাটি আমাদের দিকে এগিয়ে দিল। এগিয়ে দিতেই আমরা ঠোঙ্গাটি লুফে নিলাম এবং চোখের পলকে যা ছিল গলাধঃকরণ করে ফেললাম।
আমাদের এহেন অবস্থা দেখে ছেলেটি বলল, ‘মনে হচ্ছে, তোমরা ক’দিন ধরে কিছু খাওনি।
আমি বললাম, ‘তা তো বুঝতেই পারছ।’
সতেরো
ছেলেটি তার পা পুলের নীচের দিকে নামিয়ে দিয়েছিল। পা দোলাতে দোলাতে বলল, ‘তোমরা দু’জন যদি আমার সাথে কাজ করতে রাজী হও, তাহলে আমি একটা টাকা দেব।
আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, ‘এক টাকা! পুরো একটা টাকাই দেবে বলছ?’
‘হ্যাঁ, এক টাকা।
ভগবান বলল, ‘আমাদের কাজটা হবে কি?’
‘ছেলেটা পা দোলাতে দোলাতে পুলের ডান দিকে হাত নির্দেশ করে বলল, ‘ওদিকের মোড় থেকে খুব শীগগিরই এক পারসী বাবা বেরিয়ে আসবে। মাথায় থাকবে তার কালো টুপি, পরনে সাদা আচকান আর হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ। সে খুব শীগগিরই আসবে। সে বেরিয়ে আসতেই তোমরা দু’জন তার পায়ে যেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
‘পায়ে পড়তে যাবো কেন?’
‘পায়ে পড়ে শুধু বলবে, পারসী বাবা, তোমার মতো মানুষ হয় না। দয়া করে এক আনা পয়সা দাও। দু’দিন থেকে আমরা ভুখা আছি। দয়া করে এক আনা……..’
আমি বললাম, ‘তারপর?’
তারপর সে তোমাদের যদি কিছু দেয় তো ভালো, না দিলেও সই। তোমাদের এক টাকা ঠিকই থাকবে।
‘কিন্তু দু’আনা উপার্জনের জন্যে তুমি আমাদের দু’জনকে দু’টাকা দেবে কেন?’
ছেলেটি বলল, ‘ফালতু কথা জিজ্ঞেস করে কোন লাভ আছে? পয়সা যদি কামাতে চাও, যেভাবে বলছি, সেভাবে লেগে যাও। কারো পায়ে পড়ে থাকলেও কে দেয় তোমাদের একটা পয়াসা?’
ভগবান আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ছেলেটি তো ঠিকই বলেছে। ছেলেটি বেশ দয়ালু বলে মনে হচ্ছে। দু’আনা কামাই হোক বা না হোক, সে আমাদের পুরো টাকা দিতে রাজী। ঠিক এ ধরনের ছেলেদের সন্ধানেই আমি স্বর্গ থেকে এসেছিলাম। তুমি মনে করছ, শহরে শিশুরা কি অবস্থায় আছে আমি বুঝি জানি না। কিন্তু আমার বিলক্ষণ জানা আছে, এ ধারিত্রীর পাপ-সাগরে একটা না একটা নিষ্পাপ শিশু আমি পাবই। এ ছেলেটিই আমার সেই ছেলে। সৃষ্টির আদিকালে আমি যে নিষ্পাপ শিশুদের সৃষ্টি করেছিলাম, তারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের অস্তিত্ব নেই এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
ভগবান একটা অন্তরঙ্গ দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো, ছেলেটিও প্রতিদানে তার প্রতি মুচকি হেসে তার ঝুলন্ত পা দু’টো ঘন ঘন নাড়তে লাগলো।
এতদসত্ত্বেও আমার মনে এক অজানা সন্দেহ দোল খেতে লাগলো। এজন্যে আমি ছেলেটিকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কি করে বুঝব যে, তুমি আমাদের টকাটা ঠিকই দেবে? তোমার কাছে টাকা আছে কি নেই, তাই বা কেমন করে জানব?’
এ কথা শুনে ছেলেটি তার পকেট থেকে এক টাকার দশটা নোট বের করে আমাদের চোখের সামনে দোলাতে লাগল।
‘এই চেয়ে দেখো, আমার কাছে এক টাকা নয়, দু’টাকা নয়, পুরো দশ টাকা রয়েছে। এই টাকার ভেতরে, তোমাদের অংশও রয়েছে। তোমাদের যদি এমন অবিশ্বাস হয়, তাহলে নাও আটা আনা আগাম দিচ্ছি। যখন পারসী বাবার পায়ে হুমড়ি খেয়ে ভিক্ষা চাবে, তখন পাবে বাকী আট আনা।
আমরা আট আনা হাতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তার পর আমরা পুলের উপর নিশ্চুপ হয়ে পারসী বাবার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই পারসী বাবা, পরনে সাদা আচকান, মাথায় কালো টুপি আর হাতে ব্যাগ নিয়ে গলির মোড় থেকে বেরিয়ে এলো।
তাকে দেখতেই ছেলেটি আমাদের পাঁজড়ে গুঁতো মেরে বলল, ‘ঐতো এসেছে। আরো কাছাকাছি আসতে দাও। এই পুলের কাছে আসলেই পা জড়িয়ে ধরবে।
আমি বললাম, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এমন করে পা জড়িয়ে ধরবো যে, পয়সা না দেয়া পর্যন্ত পা ছাড়বোই না শালার।
‘সাবাস!’
পায় পায় লোকটি পুলের কাছাকাছি এসে উপনীত হলো। কাছে আসতেই আমি লাফিয়ে পড়ে তার পা জড়িয়ে ধরলাম।
লাচার হয়ে লোকটি ঘবড়ে গিয়ে বলল, ‘কি হয়েছে, অমন করছ কেন?’
‘বড্ড গরীব, দু’দিন কিছু খাইনি। দয়া করে দু’আনা পয়সা দাও।
পারসী বাবা রেগে গিয়ে বলল, ‘ভাগো, যত্তসব……!’
আমি আরো সজোরে তার পা জড়িয়ে ধরলাম। বার বার বলতে লাগলাম, ‘বড্ড গরীব, দু’দিন উপোষ……’
নিরুপায় হয়ে পারসী বাবা তার হাতের ব্যাগ খুলে খুচরো পয়সা খুঁজতে লাগলো। আমি বার বার আমার সেই কথা আওড়াচ্ছিলাম।
সহসা পারসী বাবার কন্ঠ থেকে অন্ধকারের বুক চিরে আর্ত্মনাদ বেরিয়ে এলো। হাতের ব্যাগটি তার মাটিতে পড়ে গেল। রক্তাক্ত হয়ে সে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। পর মুহুর্তে দেখতে পেলাম সেই ছেলেটির হাতে একটি রক্তাক্ত চাকু। চোখের পলকে সে দৌড়ে রেলওয়ে ইয়ার্ড পার হয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে লাগলো এবং এক সময় সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
এসব মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঘটে গেল। এবারে ভগবানের চক্ষু চড়কগাছ। ভগবান নীচু হয়ে দেখলো পারসী বাবার নিস্পন্দ দেহটি, তার নিথর চোখ দুটো আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার ব্যাগটিও খোলা পড়েছিল। ব্যাগের ভেতরে কিছু মিষ্টান্ন রয়েছে। ছেলেপিলেদের জন্যে নিয়ে যাচ্ছিল বাসায়।
একটি চলমান গাড়ীর সার্চ লাইটের আলো এসে পড়লো আমাদের উপর। আমি ভয় পেয়ে ভগবানের গা ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘চলো, ভাগো, নইলে ধরে নিয়ে যাবে আমাদের।
ভগবান তন্ময় ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল, ‘কিন্তু এ শবদেহ……নিস্পাপ পারসী বাবার কি হবে?…..’
আমি বললাম, ‘ওসব রাখো, নইলে এই গ্রেফতার হলাম বলে।
বলেই আমরা দৌড়াতে লাগলাম। অলি-গলি, রেলপথ ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা ট্রাম ট্রান্সমিশনের গোল চত্বরের কাছে এসে উপনীত হলাম। এখানে এসে বড় বিচিত্র মনে হলো এই জীবনের চাঞ্চল্য। চারিদিকে নিয়ন বাতির ধবধবে আলো। ছেলেবুড়ো, সুন্দরী মেয়ে ও নানা ধরনের পথচারীদের সমাগমে মুখরিত চারদিক। ট্রাম চলছিল, বাস চলছিল –সবাই যে যার আপন আপন গন্তব্যে চলছিল বিরামহীন।
আঠার
যখন নিরন্ধ্র অন্ধকার ছেয়ে গেল এবং একে একে নগরীর সকল জাগ্রত মানুষ ঘুমিয়ে গেল আমি ভগবানকে বললাম, ‘তুমি এ ধরনের একটা হত্যাকে যদি হজম করে নিতে না পার তাহলে তুমি কিসের ভগবান?’
‘তাহলে আমি কি?’ ভগবান বলল।
আমি বললাম, ‘তুমি কি সে কথা আমি বলতে পারি না, তবে এই হত্যা যজ্ঞকে সামনে রেখে তুমিই বলো, তুমি আসলে কি?’
ভগবান মুহুর্তে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি যে আসলে কি তা আমি নিজেও জানি না। কতকাল গত হলো –আমি ছিলাম আগুন –বন-বনান্তর আর করে দিয়েছি। বন্য মানুষেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আমাকেই তখন ভগবান মনে করে পূজা করতে লাগলো। আমি পানি ছিলাম –তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের সে তান্ডব দেখে লোকেরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। আমি সূর্য ছিলাম –আমার খর তাপে, কিরণের সম্পাতে আমি মেঘমল্লারকে খন্ড-বিখন্ড করে বেরিয়ে এসে সোনালী আলোর বন্যার সারা চরাচরকে উদ্ভাসিত করেছি। আমি ছিলাম ধূ-ধূ প্রান্তর, বিশালকায় বৃক্ষ, বৃহদাকার ফণাধর সাপ –এমনি আমার কত কত নাম –কত কত রূপ –কত কত মন্ডপ আমাকে ঘিরে –এভাবে মানুষের প্রতিটি চরিত্রের প্রতিফলন আমাকে নিয়ে। এরপর কালক্রমে মানব সমাজ ভয়কে জয় করে নিলো আর আমি আসন পেলাম অনেক শীর্ষে –আমি সহসা বিশালকার বৃক্ষ, সমুদ্রের তান্ডব আর সূর্য থেকে বেরিয়ে এলাম এবং নিঃসীম শূন্যে পাড়ি দিলাম –আমার তখন কোন আকৃতি ছিল না –নিরাকার ছিলাম –আমি এক, অভিন্ন –আকাশ পাতালের অনেক উর্ধ্বে আমার মহা আসনে সমাসীন হলাম। আমার চারিদিকে বিশাল সৌর জগত পরিব্যাপ্ত –কোটি কোটি চন্দ্র তারকা সূর্য আর বিষুব রেখার মন্ডল পরিক্রম করে বিস্ময় প্রকাশ করেছে যে আসলে আমি কি?
সহসা আমি মানুষের হাতের ছোট একটা বলের মতো বস্ত শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম। সে বলটি নৃত্য করতে করতে আকাশ পাতাল সূর্য ও সৌর পরিক্রমাকে প্রকম্পিত করে আমার সিংহাসনের কাছে এসে লেগে গেল এবং আমার আসন টালমাটাল হয়ে উঠল, আর আমি তন্ময় হয়ে ভাবছিলাম আসলে আমি কি?’
আমি বললাম, তাহলে শেষাবধি কি ঠিক করলে যে, তুমি আসলে কি? দাদর পুলের উপকন্ঠের একটি অন্ধকার ঝুপড়ির মধ্যে এই ক্ষুধার্ত মানুষটির কাছে তোমার আসল পরিচয় ফাঁস করতে হবে। আজ হত্যাকারী এবং হন্তা –দু’জনের চেহারাই তোমার সামনে রয়েছে। একটি শবদেহের চাইতে রহস্যজনক বস্তু এ ধরাধামে কিছু নেই। এই নিষ্পাপ শবদেহের উপর হাত রেখে দিব্যি করে বলো, ‘তুমি কে? তুমি কে? সকল চিন্তা ও গবেষণার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে তুমি আসলে কে?’
ভগবান এত কিছু শোনার পর শেষে আস্তে করে বলল, ‘আসলে আমি মানুষ।’
কথাটা একটা বিস্ফোরণের মত শোনালো। এবং অখন্ড নীরবতার মাঝে কানের মধ্যে গুঞ্জন করে বেড়াতে লাগলো। অন্ধকারের মাঝে ঝিল্লিরব আর এ কথার অনুরণই ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি ভাবতে লাগলাম, সত্যি, ভগবান মানুষ? মানুষ, অর্থাৎ হত্যাকারী এবং হন্তা দু’জনই? ভোমরা এবং ফুল? বার্ধক্য এবং যৌবন? জীবন এবং মৃত্যু? অনুরাগ এবং বিরাগ? ঘৃণা এবং মলন? সভ্যতা এবং বর্বরতা? ফেরেশতা এবং শয়তান?
মানুষ। অর্থাৎ কিনা, মানুষ যতটুকু উন্নত ততটুকু, মানুষ যতটুকু নীচ ততটুকু নীচ…এ সবই কি সত্যি? এটা কি সত্যি যে, ভগবান মানুষকে তার প্রতিবিম্ব হিসেবে সৃষ্টি করেছে এবং মানুষও তাদের দর্পণে ভগবানকে দেখেছে। মানুষ শুধু মানুষ। যেদিন এ ধরা থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে…সেদিন কি ভগবানও মরে যাবে? তখন কি প্রকৃতির লীলা বৈচিত্র্য কিছুই থাকবে না?
উনিশ
দ্বিতীয় দিন ভগবান বলল, ‘আমি কালই স্বর্গে চলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে এরোড্রামে পৌঁছে দিয়ে আসো।’
আমি হেসে উঠে বললাম, ‘তুমি প্লেনে চড়ে স্বর্গে যাবে?’
ভগবান বলল, ‘না, যখন চলতে শুরু করবে, আমি প্লেনের প্রপেলারে চেপে বসব –এভাবে প্লেন যখন নিঃসীম শূন্যে উঠে যাবে, সেখান থেকে উপর উঠে যেতে আমার আর তেমন অসুবিধে হবে না। কারণ এক্সচেঞ্জের ঝামেলা তো শুধু এই মর্তের মাটির লোকদের জন্যে।’
আমি বললাম, ‘তাহলে কখন রওনা দিতে চাও?’
‘সন্ধ্যার দিকে রওনা দেব, ততক্ষণে তুমি আমাকে আরো কিছু ছেলেপিলে দেখাও।’
আমি বললাম, ‘ছেলেদের দেখার সাধ এখনো তোমার মিটলো না?’
‘না, অদ্যাবধি আমি সেই ছেলেকে দেখিনি, যাকে আমি সত্যি দেখতে এসেছিলাম। আজ শেষ দিন, আজ হয়ত তার দেখা পেয়ে যাবো।
আমি বললাম, ‘তোমার সেই ছেলে সম্ভবত বোম্বেতে নেই।
‘তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে?’
‘কোথায় পাওয়া যাবে তা আমি কেমন করে বলব? তুমিই বা কি ধরনের ভগবান! তুমি যে ধরনের পূত-পবিত্র ছবি কল্পনা করে এসেছ, তা যদি আমাদের সমাজে না থাকে তাহলে তুমি কোথায় পাবে তাকে?’
ভগবান বলল, ‘তোমাদের সমাজে নিষ্পাপ পবিত্র জীব তো শিশুরাই, –শিশুরাই তোমাদের সমাজের আসল পুঁজি। কিন্তু তোমরা তা কাজে লাগাতে পারলে কৈ?’
আমি বললাম, ‘পুঁজি তো সুদের ওপর লগ্নি করে এবং মুনাফা অর্জন করে। অতএব আমরাও যদি মুনাফার জন্যে কোমলমতি শিশুদের কাজে খাটাই, তাতে তোমার এত বিস্ময়ের উদ্রেক হয় কেন? তুমি বাবা, স্বর্গে যেতে চাও, চলে যাও –আসলে সে ধরনের কোন কোমলমতি ছেলে এই শহরে পাবে না।
ভগবান বলল, পাবো, ‘পাবো, আজ সন্ধ্যা অবধি খুঁজলে অবশ্যি পাওয়া যাবে।
তারপর একটু থেমে বলল, ‘চলো, এবার ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ো। আসলে গোড়াতেই আমাদের একটা ভুল হয়ে গেছে –তা হলো আমরা বড় আকারের ছেলের রূপ পরিগ্রহ করে ভুল করেছি। এবার আমরা দু’বছরের বেশী বড় মোটেই হবো না।
আমি বললাম, ‘সবই তোমার ইচ্ছে। তোমার ইচ্ছে হলে স্তন্যপায়ী ছোট শিশুর রূপ ধারণ করতেও ক্ষতি নেই। তবে কিনা, আমার এতো ছোট শিশু হতে ভালো লাগে না। এতো ছোট হলে শেষে পায়ে হেঁটে এই ঝুপড়ি পর্যন্ত আসার উপায় থাকবে না।
ভগবান বলল, ‘তাহলে তুমি হও আট বছরের আর আমি হই ছ’বছরের।
সারাদিন আমরা বোম্বের অলিগলি রাজপথ ঘুরে বেড়ালাম। যত নোংরা ঘিঞ্জি গলি, বস্তি, এখানে সেখানে বহু খোঁজাখুজি করলাম –কিন্তু সে ধরনের কোন শিশুর দেখা পেলাম না। শেষাবধি সূর্য যখন প্রায় অস্তাচলে ঢলে পড়েছে, দু’জনই ক্ষুধা-পিপাসায় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এমন সময় বুড়ি বন্দর ডক্ইয়ার্ডের কাছাকাছি বছর সাতেক বয়সের একটা খোঁড়া ছেলের দেখা পেলাম। ময়লা দুর্গন্ধ ছিন্নবসন পরিহিত ছেলেটির হাতে কতগুলো পয়সা। সে পয়সা গুণতে গুণতে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার চোখেমুখে একটা অপূর্ব প্রশান্তি। নিরুদ্বিগ্ন হাসি-খুশি এমন একটা মুখ সচরাচর চোখে পড়ে না।
ভগবান তাকে দেখেই চমকে উঠলো। রীতিমতো একটা লাফ মেরে তার কাছে যেয়ে উপস্থিত হলো এবং বলল, ‘তোমার নাম?’
‘ভিকু।
‘কি কাজ কর?’
‘ভিক্ষা করে খাই।’
ভগবান বলল, ‘লজ্জা করে না ভিক্ষা করতে?’
‘লজ্জা, কিসের লজ্জা? এই দেখো…পয়সা, শুধু পয়সা আর পয়সা। বলেই খোঁড়া ছেলেটি দু’হাত নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো।’
ভগবান তার ভাবসাব দেখে দু’পা পিছু হটে গেল এবং নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমরা ক’ভাই-বোন?’
‘বিশ জন।’
‘বলছ কি, বিশ জন? সবাই কি তোমার সহোদর?’
‘সহোদরই বলতে পারো। আমরা এক টুলিতে বিশ জন একত্রে থাকি।’
‘তোমাদের বাবা-মার কাছে নিশ্চয়ই?’
‘না, আমাদের দাদার কাছে। সে আমাদের খুব ভালবাসে। দু’বেলা খাবার, কাপড়-চোপড় –থাকার জন্যে জায়গা সবই তার কৃপায়। জানো, আমরা মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখি, দাদার কাছে আমরা বেশ আছি।
ভগবান আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর খোঁড়া ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাদের টুলিতে আমাদের দু’জনকে থাকতে দেবে?’
আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘তুমি ভিক্ষুকদের টুলিতে থাকতে চাও?’
ভগবান বলল, ‘তাতে হয়েছে কি? আমি এমন প্রশান্ত-চিত্ত সুবোধ বালকের দেখা আর পাইনি। আমার তো মনে হয় বিশটি ছেলেই ওর মতো সাদাসিদে। আমি অবশ্যই ওদের দলে যাবো।
ছেলেটি বলল, ‘দাদা তোমাদের জায়গা দেবেন কিনা এখন থেকেই বলা যায় না। তবে আমি তোমেদের নিয়ে যেতে পারি এক শর্তে, দাদা কিন্তু ভীষণ কড়া লোক, তার সব কথায় হ্যাঁ বলতে হবে।
ভগবান সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘কোন অসুবিধে হবে না।’
আমি ভগবানকে আলাদা ডেকে নিয়ে নানা কথা বলে বাধা দিলাম। কিন্তু সে মানলো না, বাধ্য হয়ে দু’জনে খোঁড়া ছেলেটির পেছনে পেছনে চলতে লাগলাম। ছেলেটির পেছনে আমরা বহু অলিগলি অতিক্রম করলাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। চারদিকে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়লো। অবশেষে সে আমাদের একটা পচা এঁদো ডোবার পাশের সারি সারি কতগুলো অন্ধকার ঘরের কাছে নিয়ে এলো। বিষাক্ত বাতাস আর ধোঁয়ায় চারদিকে দম আটকে যাবার মত পরিবেশ।
খোঁড়া ছেলেটি আমাদেরকে একটা ঝুঁপড়ি ধরনের আস্তানার বিপরীত দিকের একটা স্বল্প পরিসর আঙ্গিনায় এনে দাঁড় করালো। আঙ্গিনার চারদিকে দলে দলে খোঁড়া, কানা, হাত নেই, পা নেই ইত্যাদি ধরনের বিকলাঙ্গ ছেলেমেয়েদের দল। সবাই মিলে মোটা-তাজা দশাসই ধরনের একটি লোককে সারাদিনের হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল এ লোকটিই সকলের দাদা। তার পাশে দু’জন গাট্টা গোট্টা ধরনের জোয়ান দাঁড়িয়ে কটমট করে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে আছে।
সহসা দাদা একটি বিকলাঙ্গ মেয়েকে চড় মেরে বলল, ‘আজ দেখছি দশ পয়সা কম এনেছিস।’
মেয়েটি চড় খেয়ে বেসামাল হয়ে অন্য একটি ছেলের গায়ে যেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ছেলে-মেয়ে দুটোই কান্না জুড়ে দিলো।
দাদা আবার হাঁক দিল, ‘বের কর বাকী দশ পয়সা।’
মেয়েটি কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলল, ‘আমার কাছে নাই।’
দাদা তার দেহরক্ষীদের একজনকে ইশারা করতেই সে মেয়েটিকে বেদম মারতে মারতে দশ পয়সা বের করে নিলো। পয়সাটি সে গলার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল।
এরপর দ্বিতীয় একটি ছেলের পালা। সে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলো। এই আঙ্গিনার অদূরে কতগুলো খড়কুটো জ্বেলে ক’জন বয়স্ক ভিক্ষুক আগুন পোহাচ্ছিল। এদিকের মার-ধোর সম্পর্কে তারা নির্বিকার। আপন মনে তারা আগুনের তাপ গ্রহণ করছিল।
এরপর ভিকুর পালা এলো। দুরু দুরু বুকে সে এগিয়ে এলো। দাদা ভিকুর আজকের উপার্জন দেখে খুশি হলো, বলল, ‘সাবাস! আগামী দু’দিন যদি এরকম আনতে পারো, পরশু সিনেমা দেখাব।
ভিকু বলল, ‘দাদা, আজ আমার দু’জন বন্ধু নিয়ে এসেছি। আমাদের খাতায় নাম লেখাতে চায়।’
বলেই ভিকু আমাদের দু’জনের হাত ধরে দাদার সামনে এনে হাজির করলো। দাদা চোখ ছানাবড়া করে আমাদের আপাদমস্তক দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘তোদের মা-বাপ কোথায়?’
আমি আস্তে করে বললাম, ‘মারা গেছে।
আমাদেরকে টুলিতে ভর্তি করে নেয়া হলো। যথারীতি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম।
গভীর রাতে ভিকু এসে আমাদের গা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ওঠো, দাদা তোমাদের ডাকছে।’
আমি বললাম, ‘এত রাতে কেন ডাকছে?’
‘তোমাদের নাম খাতায় তুলবে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা কেমন করে?’
ভিকু বলল, ‘তোমার পা ভেঙ্গে আমার মতো করে দেবে। আর দাদা (ভগবানের দিকে ইঙ্গিত করে) বলছিল –এই ছেলেটির চেহারা খুবই মায়াবী। পথচারীদের দেখে দয়া হবে। ওর চোখ আন্ধা করে দিলে সবচেয়ে ভালো হবে।’
শুনে আমি চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগলাম। চীৎকার করে বললাম, ‘সত্যি বলছ, আমার পা ভেঙ্গে দেবে?’
ভগবানও কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমার চোখ নষ্ট করে দেবে কেন?’
ভিকু বলল, ‘বোঝা না কেন? সুস্থ সবল শিশুদের কেউ ভিক্ষা দেয় না। এ ধরনের ছেলেদের প্রতি কারো দয়া হয় না। যার চোখ নেই বা হাত নেই, পা নেই – এ ধরনের ছেলেদের সবাই ভিক্ষে দিয়ে থাকে। তোমার পা এবং ওর চোখ নষ্ট করে তোমাদের ভর্তি করিয়া নেয়া হবে।’
সব শুনে আমরা পালিয়ে বাঁচার চিন্তা করলাম। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমরা যখন প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিলাম, চারদিকে হৈ-হৈ রৈ-রৈ পড়ে গেল। রাতের অন্ধকারে ধরো ধরো, পালিয়ে গেল’ ইত্যাদি ধ্বনি শুনে আমাদের হৃদস্পন্দন আরো বেড়ে গেল।
আমি পড়ি মরি করে পালিয়ে বাঁচতে সমর্থ হলাম। কিন্তু ভগবান পালাতে পারলো না, ভগবান ধরা পড়ে গেল।
পাশের একটা ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে গিয়ে গভীর উৎকন্ঠা নিয়ে আমি ভগবানের পরিণাম দেখার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে রইলাম।
ভগবান আসন্ন যন্ত্রণার ভয়ে চীৎকার করছিল। দুটো গাট্টা-গোট্টা গুন্ডা ভগবানকে কষে ধরে রেখেছিল। আস্তে আস্তে ভগবানকে দাদার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। দাদা একটা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের সামনে বসে ছিল। আগুনে একটা লৌহ শলাকা দগ্ধ হচ্ছিল। গুন্ডা দুটো ভগবানকে জবরদস্তি টেনে এনে দাদার সামনে শুইয়ে দিল। তারা দু’জনে ভগবানের হাত এবং পা চেপে ধরল শক্তভাবে। দাদা এক সময় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তারপর গনগনে আগুনের লাল লৌ শলাকাটি বের করে নিল আস্তে আস্তে।
সহসা একটা প্রচন্ড চীৎকারে আকাশ-বাতাস যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। একটা তীব্র যন্ত্রণাবিদ্ধ আর্তনাদ থেকে আমি যেন একটা কথা শুনতে পেলাম ……
‘হ্যাঁ, আমি দেখেছি,…..আমি দেখেছি।’
লোকেরা বলাবলি করছিল, এ সবই মিথ্যে। না ভগবান কোনদিন আমার কাছে এসেছিল, না আমি তাকে কোনদিন দেখেছি। বোম্বের অলি-গলিতে আমাকে নিয়ে যে ঘুরে বেড়িয়েছে, সে ভগবান নয়। এ সবই আজগুবী বানোয়াট কাহিনী। আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা মাত্র।
অবশ্য জবাবে আমি কোনকিছু হলফ করে বলতে পারিনে। তবে এটুকু আমি আপনাদের খেদমতে নিবেদন করে বলতে পারি, আসলে আমি ভগবানকে দেখেছি। সত্যিই দেখেছি, সম্ভবতঃ আপনিও তাকে দেখে থাকবেন, কিন্তু চিনতে পারেনি।
আমি যখন ভগবানকে প্রথমবার দেখি, তখন সে ছিল মাত্র দু’বছর বয়সের একটি অবলা শিশু। তার চোখ দুটো ছিল অন্ধ। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় সে দাদর পুলে দাঁড়িয়ে দু’হাত মেলে কান্না গদ্গদ কন্ঠে পথচারীদের কাছে ভিক্ষা চাইছিল।
-সমাপ্ত –