ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৫৬

অধ্যায় ছাপ্পান্ন – সময় : ১৮৮০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ
কন্নোর, ভারতবর্ষ

হালকা স্বরে কারো ডাকে শামানের ঘুমটা ভেঙে গেল। অভ্যাসবশত ঘুমটা চটে যেতে আনমনেই ওর হাত চলে গেল বিছানার পাশে রাখা অস্ত্রের দিকে। কিন্তু মুখের সামনে চেহারাটা দেখে নিজেকে সামলে নিল ও। বয়স্ক একজন মহিলা, হাতে একটা পানির পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শামানকে ডাকার জন্যে সামান্য ঝুঁকে ছিল সে, শামান উঠে বসতেই পিছিয়ে গেল খানিকটা।

শামান মৃদু হেসে তাকে আশ্বস্ত করল। আড়মোড়া ভেঙে মহিলার দিকে হাত বাড়াল পানির পাত্রটার জন্যে। শামানের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোটোখাটো অসংখ্য ব্যথা—গতকালের যুদ্ধের ফসল। ফলে শরীর নাড়ালেই শরীরের এখানে ওখানে নানা ধরনের ব্যথার অস্তিত্ব অনুভব করছে, তবে এসব কিছু ওর জন্যে নতুন নয়। গতকাল ঝড়ের মতো একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর সারারাত একবারের জন্যে হলেও দুই চোখের পাতা এক করেনি। ফলে আজ দুপুরের ভেতরে সব পরিকল্পনা ঠিক করে জঙ্গলের ভেতরের দিকে থারুদের ফসলের গুদাম আর গবাদি পশুর সংরক্ষণাগারের দিকে রওনা দিয়ে দুপুরের ভেতরে পৌছানোর পর ওর প্রথম কাজ ছিল পরিচ্ছন্ন হয়ে ঘুমানো। সেই যে ঘুম দিয়েছিল এই বৃদ্ধার ডাকে ঘুম ভাঙল।

মহিলার হাত থেকে পানির পাত্রটা নিতে নিতে শামান একবার গুদাম ঘরটার একপাশের ছোট্ট জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চমকে গেল। বাইরে গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। শামান পানির পাত্রটা হাতে নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে মহিলা হাতের ইশারায় ওর শোবার জায়গাটার পাশেই একটা খাবারের পাত্র দেখাল। শামান পাত্রটা তুলে নিয়ে খেতে খেতে বৃদ্ধাকে ভালোভাবে খেয়াল করল। বুড়ো মহিলার মুখের একপাশে পুড়ে যাবার দগদগে ক্ষত। চোখে-মুখে কেমন জানি দিশেহারা ভাব।

শামানের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। যুদ্ধ সাধারণ মানুষের সঙ্গে কী করতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই বৃদ্ধা। ওর বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। কে জানে হয়তো ওর নিজের মা-ও কোনো একদিন এরকমই কোনো এক যুদ্ধের বলি হয়েছে। কিংবা কে জানে হয়তো এই বৃদ্ধার মতোই দিশেহারা হয়ে বেঁচে আছে আজো। শামানের মনে হলো বৃদ্ধাকে কিছু বলা উচিত দুবার মুখ খুলেও কিছু না বলে চুপ করে রইল ও। খেতে লাগল মন দিয়ে।

‘আইজ নাকি কী অইবে মন্তলার বাজারে?’ শামান খেতে খেতেই বৃদ্ধার প্রশ্নটা শুনে মুখ তুলে তাকাল। কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে চুপ মেরে রইল।

‘শাক্যগর অত্যাচারের শেষ কোনোহানে?’ বলে বৃদ্ধা অন্যদিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘আইজ থেকে বিশ বছর আগে আমগো লগে শাক্যগর যুদ্ধের সময় আমার স্বামী মারা যায়। তখন শাক্যর থারুগর লগে বেঈমানি কইরা শত শত থারু সৈন্যরে বলি দিছিল। আর আইজ বিশ বছর পরে বিক্রমের হাতে আমার পোলা মারা গেছে,’ বলে বৃদ্ধা ফিরে তাকাল শামানের দিকে। ‘কইতে পারো বাপ কী নিয়া বাঁচব আমি?’ বৃদ্ধার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে তার মুখের পোড়া ক্ষতের ওপরে।

কোনো কারণ ছাড়াই শামানের চোখে পানি চলে এলো। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বৃদ্ধার দুই কাঁধে হাত রেখে শামান বলে উঠল। ‘আমি কথা দিচ্ছি মা, যা হয়েছে কিন্তু এই উপত্যকায় আবারো শান্তি ফিরে আসবে। তোমাদের কালন্তি ফিরে আসবে, আর আজ মন্তলার বাজারে খারাপ কিছুই হবে না,’ বলে শামান চোরা চোখে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে রওনা দিল বাইরের দিকে।

ইচ্ছে করেই বৃদ্ধার চোখের সঙ্গে নিজের দৃষ্টি মেলাতে পারেনি ও। যদিও মনে মনে একটা পরিকল্পনা ঠিক করেছে ও-তবু নিজেও জানে না একটা সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে আসলে কতখানি কী করতে পারবে ও। আর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যার আপনজন গেছে তারই ক্ষতি, যুদ্ধের পর যতই শান্তি ফিরে আসুক হারানো মানুষ তো আর ফিরে আসে না।

বাইরে বেরিয়ে দেখল অন্ধকার নেমে এসেছে। থারুদের ফসলের গুদামের একপাশে বিরাট একটা জায়গা খালি করা হয়েছে, সেদিকেই রওনা দিল ও। সেখানেই গুদাম ঘরের ছাউনির নিচে জড়াজড়ি করে অবস্থান করছে থারুদের গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা জনগোষ্ঠী। ওদের সর্বাগ্রে অবস্থান করছে থারু সৈনিকরা। শামান সেদিকে এগিয়ে যেতেই সৈনিকদের প্রধান এগিয়ে এলো ওর দিকে। লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটা ওকে দেখে অভিবাদন জানাল। ‘যোদ্ধা, আমরা প্রস্তুত। সবাই আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে।’

শামান নিজের তলোয়ারটা কোমরে ভালোভাবে গুঁজে নিয়ে লম্বা দাড়ির দিকে ফিরে জানতে চাইল, ‘বিধু কোথায়?’

‘এই যে ওস্তাদ,’ জবাব এলো পেছন থেকে। শামান ফিরে তাকিয়ে দেখল কোমরে বন্ধনী আঁটতে আঁটতে এগিয়ে আসছে বিধু। ওদের সামনে এসে থেমে গেল সে। ওরা সকালবেলা থারুদের গ্রামে জাথুরিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর ওখানেই প্রাথমিক কিছু আলোচনা সেরে নিয়ে রওনা দেয় জঙ্গলের ভেতরের দিকে। জাথুরিয়া ওদেরকে প্রাথমিক সব তথ্য জানিয়ে বিধোরীর দুর্গে ফিরে যাবার জন্যে রওনা দেয়। কারণ তাকে খুঁজে না পেলে সন্দেহ করতে পারে বিক্রম কিংবা শংকর।

বিধু কাছাকাছি আসতেই শামান জানতে চাইল, ‘জাথুরিয়ার কাছ থেকে আর কোনো খবর এসেছে?’

‘হ্যাঁ, এসেছে, কাছাকাছি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বিধু জবাব দিল। ‘সেটা আনার জন্যেই জঙ্গলের অন্যপাশে গেছিলাম আমি।’

‘জাথুরিয়া নিজে এসেছিল?’

‘নাহ,’ দুইপশে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল বিধু। ‘হেয় লোক পাঠাইছিল। ওই লোকই সব খবর দিছে। রাজা বিক্রম কহন কী করব, কেমনে কী করব সব বইলা গেছে হেয়,’ একটু থেমে সে সব বিস্তারিত বলে গেল শামানকে।

শামান মনোযোগ দিয়ে সব শুনে একটু ভেবে ফিরে তাকাল থারু সৈনিকদের প্রধান, লম্বা দড়িওয়ালা লোকটার দিকে। ‘তোমরা কয়জন আছো দলে?’

লোকটা নিজের লোকদের দিকে একবার দেখে নিয়ে জবাব দিল, ‘মোট আছি আমরা আঠারোজন, আর গ্রামের কিছু যুবক আছে। চাইলে ওদেরকেও দলে নেয়া যাইতে পারে।’

শামান এক মুহূর্ত চিন্তা করল। ‘নাহ শুধু আজ সন্ধের কথা চিন্তা করলে হবে না। এখানকার নিরাপত্তার ব্যাপারটাও দেখতে হবে। এক কাজ করো, তোমার দলের আঠারোজনের ভেতর থেকে পনেরো জনকে বেছে নাও। বাকি তিনজন আর গ্রামের যুবকরা মিলে এই জায়গাটা পাহারা দেবে।’

লম্বা দাড়ি দলের ভেতরে লোক বাছাই করতে করতে শামান একটা লাঠি দিয়ে বালু মাটিতে দাগ কেটে জাথুরিয়ার পাঠানো তথ্য অনুযায়ী পরিকল্পনামাফিক কয়েকটা আকৃতি এঁকে ফেলল। লম্বা দাড়ি নিজের লোকদেরকে প্রস্তুত করে আনতেই ওদেরকে বালুময় জায়গাটার সামনে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল বিধু।

লম্বা দাড়িসহ দলে পনেরো জন। সেইসঙ্গে বিধু আর ও নিজে। দলে তিরন্দাজ আছো কয়জন?’ শামান জানতে চাইল। পনেরোজনের ভেতরে ছয়জন হাত তুলল। ওদেরকে আলাদা করে দাঁড় করাল বিধু।

‘এবার সবাই ভালোভাবে দেখো,’ বলে ও মাটির দিকে নির্দেশ করল। ‘আমাদের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী আজ সন্ধের ঠিক পর দিয়েই রাজা বিক্রম তার লোক-লস্কর আর ঘোরসওয়ার বাহিনী, বন্দি ও সেইসঙ্গে বুদ্ধের অবতার নিয়ে মন্তলার হাটের দিকে রওনা দেবে। ওখানে পৌঁছে নাকি স্বয়ং বুদ্ধের অবতারের নির্দেশে হত্যা করা হবে কালন্তি-ঘোষিত-ধোয়ীসহ বাকিদেরকে। আমার পরিকল্পনা হলো; ওদেরকে আমরা মন্তলার হাটে পৌঁছাতেই দেব না। পথিমধ্যেই আক্রমণ চালাব। তাহলে ওদেরকে কাবু করাটা সহজ হবে মনে হচ্ছে। তবে শুরুতেই বলি, আমাদের পরিকল্পনার একটা বড়ো সমস্যা হলো, ওরা বিধোরী থেকে মন্তলার দিকে যেতে দুটো পথের কোনোটা ব্যবহার করবে সেটা আমরা জানি না।’

লম্বা দাড়ি বলে উঠল, ‘জোর সম্ভাবনা, ওরা বড়ো পথটাই ব্যবহার করবে। কারণ ঘোড়ার গাড়ি আর বাহিনী নিয়ে মন্তলা যেতে হলে ওই পথটাই সবথেকে নিরাপদ।’

‘আমারও তাই ধারণা। কাজেই আমরা ধরে নেব ওরা সেই পথেই যাবে সেই অনুযায়ীই পরিকল্পনা করব। পরিকল্পনা খুব সহজ,’ বলে মাটিতে দেখাল। ওখানে পর পর কয়েকটা লম্বা বাক্সের মতো সাজানো। যদি ধরে নিই এইটাই ওদের বহর। তাহলে প্রথমে থাকবে রাজা বিক্রমের লোকেরা। তারপর ঘোড়সওয়ার বাহিনী, তারপরে মনে হয় ঘোড়ার গাড়িতে বন্দি আর বুদ্ধমূর্তি। আমরা তিনদলে ভাগ হয়ে যাব। একটা দল থাকবে আমার নেতৃত্বে, এই দলটা ঘোড়ার ওপরে থাকবে। একেবারে বিধোরী থেকে নজর রাখা ও আক্রমণের মূল ভাগে থাকব আমরা। এরপরের দলটা থাকবে তোমার নেতৃত্বে, তোমাদের কাজ হবে রাজার বাহিনীর শেষ ভাগে আক্রমণ চালানো,’ বলে ও আঁকা ছবির শেষটা দেখাল। ‘আর বাকি দলটা থাকবে বিধুর নেতৃত্বে, এই দলের বেশির ভাগ থাকবে তিরন্দাজ বাহিনী। এদের কাজ হবে দলের অগ্রভাগে আক্রমণ চালানো।’

সবাইকে বুঝে নেয়ার জন্যে একটু সময় দিয়ে ও আবারো বলে উঠল, আবারো বলছি, লম্বা দাড়ির দল আক্রমণ চালাবে বাহিনীর শেষ ভাগে, বিধুর দল আগ্রভাগে, দুই দিকের অক্রমণে ওরা যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে এই সুযোগে আমার দল যারা ঘোড়ার ওপরে থাকবে আমরা জায়গামতো আক্রমণ চালিয়ে বন্দিদের উদ্ধার করব সেইসঙ্গে বুদ্ধমূর্তিটাও। আবারো বলছি, আমাদের মূল কাজই হবে বন্দি আর মূর্তি উদ্ধার করা। আর যদি সুযোগ পওয়া যায় তবে রাজা বিক্রম আর শংকরাদিত্যকে শেষ করা। এই আমাদের পরিকল্পনা আর আমাদের শাক্যদের ভেতর থেকে সহায়তা করবে জাথুরিয়া। কারো কোনো প্রশ্ন?’ কেউ কিছু জানতে চাইল না।

বিধু আর লম্বা দাড়ির দিকে তাকিয়ে শামান বলে উঠল, ‘সবাই মনে রাখবে, এই যুদ্ধ আপনজনদের বাঁচানোর যুদ্ধ, নিজের অস্তিত্বকে বাঁচানোর যুদ্ধ, সবচেয়ে বড়ো কথা নিজের ধর্ম, নিজের সম্মানকে বাঁচানোর যুদ্ধ, কাজেই সবাইকে প্রাণপণে লড়তে হবে,’ কথাগুলো বলে ও বিধুর দিকে ফিরে তাকাল। সামান্য মাথা নেড়ে সায় জানাল বিধু।

সময় এসে গেছে নিজেদের প্রমাণ করার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *