ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৫১

অধ্যায় একান্ন – বর্তমান সময়,
সুরমা নদীর ওপরে, সিলেট

ট্রেনিং আর অভিজ্ঞতা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস ।

প্রথমটা মানুষকে যেকোনো কাজের উপায় বলে দেয়, আর দ্বিতীয়টা করে তোলে দক্ষ। তানভীরের ট্রেনিং যতই আন্তর্জাতিক মানের হোক না কেন বিপজ্জনক মিশনে শত্রুর মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা জালালের অনেক বেশি।

শেখারভদের দল আর ওদের মাঝে আচমকা সুলতান এসে পড়তেই সবার প্রথমে সে-ই সচেতন হয়ে উঠল। ‘সুলতান নিচু হও,’ বলেই সে বের করে আনল নিজের পিস্তল, ওটা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে গুলি করল শেখারভদের উদ্দেশ্যে।

লঞ্চের কোনোায় ঠিক যেখানে অবস্থান করছিল শেখারভসহ দলের বাকিরা সেদিকে গুলি করতেই ওরা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ওদের কাউকে উদ্দেশ্য করে জালাল গুলি ছোড়েনি, সে গুলি করেছিল দেয়ালে ঝোলানো বড়ো একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশারকে উদ্দেশ্য করে। যদিও সে গুলি করেছিল ওটার মাঝ বরাবর কিন্তু গুলিটা মাঝ বরাবর না লেগে গিয়ে লাগল এক্সটিংগুইশারের মুখে আটকানো পাম্পারের মতো জিনিসটাতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওটা বিস্ফোরিত হয়ে ধোঁয়ার মতো গ্যাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, আর হঠাৎ ফোলানো বেলুনের মুখ খুলে দিলে যেভাবে ওটা শূন্যে ছুটতে শুরু করে, ঠিক ওমনি এক্সটিংগুইশারটা বাতাসে বেলুনের মতো বিক্ষিপ্তভাবে ছুটতে শুরু করল।

অন্যদিকে জালাল চিৎকার করা মাত্রই সুলতান মাটিতে শুয়ে পড়ে এক গড়ান দিয়ে সরে গেছে একদিকে। সামান্য উঁচু হয়েই আবারো পিস্তল তুলল শত্রুদের দিকে। রুপালি চুলের লোকটাকে এক ঝলক দেখতে পেয়ে তার দিকেই পিস্তল তুলল ও, কিন্তু লোকটা তার চেয়ে অনেক বেশি ফাস্ট। লোকটা সামনে থাকায় চায়নিজ মতো লোকটাকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে ধরেছিল, কিন্তু সুলতানকে পিস্তল তুলতে দেখে সে সোজা গুলি করল সুলতানের দিকে। গুলিটা সুলতান আর শেখারভের মাঝখানে সেই প্যাঁচানো সিঁড়িতে লেগে ছিটকে গেল অন্যদিকে।

সুলতান দুটো গুলি করলেও একটাও লাগাতে পারল না জায়গামতো। শেখারভের সঙ্গের লোকগুলো গুলি করতেই আড়াল নিল ও ডেকের ওপরে রাখা একটা বড়ো জেনারেটরের আড়ালে। কিন্তু ওটাই কাল হলো ওর জন্যে। অন্য কোনো আড়াল না পেয়ে ঝোঁকের বসে জেনারেটরের আড়ালে শুয়ে পড়তেই ওটার ওপরে একের পর এক গুলি এসে লাগল, সেইসঙ্গে সমানে স্পার্ক করতে লাগল জেনারেটরের এখানে ওখানে। একদিকে সমানে গুলি এসে লাগছে, তাই নড়ার উপায় নেই, অন্যদিকে জেনারেটর দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় এটাতে আগুন ধরে যেতে পারে। তীব্র আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল সুলতান, ‘কমান্ডার।’

গোলাগুলি শুরু হতেই তানভীর ডেকের ওপরে রাখা কয়েকটা বালির বস্তার মতো জিনিসের আড়ালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। লঞ্চের ভারসাম্য ঠিক করার জন্যে দড়ি দিয়ে বেঁধে ভেজা বালির বস্তাগুলো ঝুলিয়ে দেয়া হয় একদিকে। বস্তাগুলো সম্ভবত ওখানে রাখা হয়েছে এই কাজের জন্যেই। কিন্তু প্রথমে যেটা খেয়াল করেনি সেটা হলো বস্তাগুলো পরিমাণে অনেক কম তাই এগুলো রাখার স্তূপের উচ্চতাও অনেক কম। তাই নিজের শরীরকে পুরোপুরি ওটার আড়ালে লুকিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে।

তবে এক অর্থে ও ভাগ্যবান। কারণ গুলি শুরু হলেও আর ও যেখানে লুকিয়ে আছে সেই জায়গাটা মোটামুটি ডেকের শেষ প্রান্তে হওয়াতে ওর দিকে নজর দেয়নি তেমন কেউ। বরং ও বস্তার আড়ালে লাফিয়ে পড়েই অন্যদিকে চোখ তুলে দেখতে পেল রুপালি চুলের শেখারভ টেড চ্যাঙকে টেনে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই দুই পক্ষ থেকেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নামিয়ে ফেলল তানভীর।

তিনটে ব্যাপার মাথার ভেতরে পাক দিয়ে উঠছে ওর। প্রথমত, নিজের দলের মানুষ দুজনার নিরাপত্তা। কারণ ও দেখেছে জালাল আর সুলতান দুজনার কেউই ভালোভাবে আড়াল নিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, শেখারভকে ও দেখেছে টেড চ্যাঙকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লঞ্চের একপাশে, সম্ভবত ওখানে নৌকাটা এখনো বাঁধা আছে, কাজেই পরিষ্কার বোঝা যায় ওরা পালানোর চেষ্টা করবে নৌকো নিয়ে, পালিয়ে কতদূরে যেতে পারবে সেটা প্রশ্ন নয়, কিন্তু পালানোর চেষ্টা করবে। তৃতীয়ত, গোলাগুলি শুরু হতেই লঞ্চের অন্য অংশ থেকে ভেসে আসছে আতঙ্কিত লোকজনের কণ্ঠস্বর, যদিও এখনো কেউই এদিকে অসেনি, কিন্তু কৌতূহলবশত লোকজন এখানে কী হচ্ছে দেখার জন্যে অবশ্যই আসবে। সেক্ষেত্রে ক্রশ ফায়ারের ভেতরে পড়লেই অকারণে বৃথা প্রাণতো যাবেই জেড মাস্টারের লোকেরা নিরীহ মানুষদেরকে জিম্মি করতে পারলে ওরাই বিপদে পড়বে। তার মানে যা করার এক্ষুণি করতে হবে।

তানভীর মাথা তুলে জালালকে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই অন্যদিকে থেকে ভেসে এলো সুলতানের তীব্র চিৎকার। তানভীর দেখল সুলতান একটা জেনারেটরের আড়ালে বসে আছে, গুলি লেগে সমানে স্পার্ক করছে জেনারেটর। মনে-মনে আঁতকে উঠল ও, একবার ফুয়েল লিক হলেই আগুন ধরে যাবে ওটাতে। জীবনে এমন অসহায় খুব কমই বোধ করেছে ও। ‘জালাল ভাই, ‘ চিৎকার করে উঠল ও। জবাবে জালাল কিছু বলার আগেই কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ ভেসে এলো।

‘তানভীর,’ জালালের চিৎকার শুনে বস্তাগুলোর ফাঁক দিয়ে মুহূর্তের জন্যে তাকে দেখতে পেল ও। কিন্তু সে কী বলছে বোঝার আগেই একটা শব্দে অন্যদিকে ফিরে তাকাল। বাক্সটা টেনে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। তারমানে শেখারভ, আর তার বস জেড মাস্টার বাক্সটা নিয়ে কেটে পড়তে চাইছে। ওরা বাক্সটা সরানোর চেষ্টা করছে, তারমানে এখুনি সময়। যদিও গুলি ভেসে আসছে ও জালালের দিকে ফিরে ইশারা করে তিনটে আঙুল দেখাল। জালালও মাথা নেড়ে সায় দিতেই দ্রুতবেগে একটা একটা করে আঙুল নামিয়ে আনলে শেষ আঙুলটা নামাতেই দুজনে একসঙ্গে আড়ালের পেছন থেকে হাত উঁচু করে গুলি করতে শুরু করল। একইসঙ্গে জালাল চিৎকার করে সুলতানকে জেনারেটরের আড়াল থেকে সরে আসার জন্যে নির্দেশ দিল।

সুলতান এক গড়ান দিয়ে জেনারেটরের আড়াল থেকে সরে এসে জালাল যে ডেক চেয়ারটার আড়ালে লুকিয়ে আছে সেটার আড়ালে চলে এসে পাগলের মতো হাঁপাতে লাগল। কিন্তু জালাল আর সুলতান দুজনেই স্বস্তির নিশ্বাস নেয়ার আগেই তানভীরের নির্দেশ ভেসে এলো ওকে কভার করার জন্যে।

‘কমান্ডার, ব্যাপারটা, অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে,’ সুলতান একবার অন্যপাশে দেখে নিয়ে বলে উঠল

‘সময় নেই,’ তানভীরের গলা ভেসে এলো। এখন কিছু করতে না পারলে আর হবে না, ওরা পালাবে, আর নিরীহ লোকজন এসে পড়বে যেকোনো সময়। আমি তিন গুনতেই তুমি আর সুলতান একসঙ্গে গুলি করতে শুরু করবে, বলেই সে ওদেরকে কোনো সুযোগ না দিয়ে গুনতে শুরু করে দিল, ‘তিন, দুই এক,’ তানভীরের গোনা শেষ হতেই সুলতান আর জালালের পিস্তলে নরক নেমে এলো। জালাল ডেক চেয়ারটার আড়াল থেকে মাথা তুলে গুলি করতে লাগল আর সুলতান চেয়ারের এক পাশে ঝুঁকে দুই পিস্তল থেকেই গুলি উগড়ে দিতে শুরু করল লোকগুলোর দিকে।

‘সাবধান, তানভীরের গায়ে যেন না লাগে,’ গুলি করতে করতেই সুলতানকে সাবধান করে দিল জালাল। মাথা নেড়ে সায় জানাল সুলতান।

ওরা দুজনে গুলি শুরু করার আগেই কাউন্টডাউন করার সময়েই নিজের ডেজার্ট ঈগল বের করে এনেছিল তানভীর। জালাল আর সুলতান গুলি শুরু করতেই আড়াল থেকে একটা ডাইভ দিয়ে বেরিয়ে এলো ও পিস্তল হাতে। জালালরা যেদিক থেকে গুলি করছে ও সম্পূর্ণ অন্যদিকে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসেই সেকেন্ডেরও কম সময়ের ভেতরে পরিস্থিতি যাচাই করে নিল ও। শেখারভ কিংবা চ্যাঙের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।

তবে অন্য লোকগুলোর ভেতরে একজন পা ভেঙে পড়ে আছে অন্য একজন বাক্সটা টেনে সরিয়ে ফেলছে। আর দুজন গুলি করছে আড়াল থেকে। তানভীর আরেকটা ডাইভ দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেল, তারপর জালাল আর সুলতানের সম্ভাব্য গুলির লাইন এড়িয়ে লাফ দিল। বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে একেবারে লঞ্চের কোনার দিকে গড়িয়ে এলো ও। মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই পিস্তল তুলে গুলি করল সামনের দিকে। বাক্স টানতে থাকা লোকটা পড়ে গেল। শেখারভদের বাকি দুই সঙ্গীর একজন গুলি করছিল জালালদের দিকে সে পিস্তল ঘুরিয়ে তানভীরের দিকে আনার আগেই তার মাথা বিস্ফোরিত হলো ফাটা তরমুজের মতো।

সঙ্গীর বিস্ফোরিত মস্তকের গলে যাওয়া মগজের ছিটে মুখে লাগতেই অন্যজন আধ বসা অবস্থা থেকে পড়ে গেল মাটিতে, তানভীরকে এগিয়ে আসতে দেখে উলটো ঘুরে দৌড় দিল প্যাসেজটা ধরে। তানভীর পিস্তল তুললেও দ্বিধায় পড়ে গেল—এভাবে পালাতে থাকা মানুষটার পিঠে গুলি করবে কি না, কিন্তু ওকে যাতনার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়ল মানুষটা। সরু প্যাসেজটা ধরে এগিয়ে যেতেই কেউ যেন ভোতা একটা শাবলের এক প্রান্ত সর্বশক্তিতে বসিয়ে দিল ওর পেটে, আঘাতেই তীব্রতা সহ্য করে ওঠার আগেই একই পরিমাণ শক্তির সঙ্গে আরেকটা আঘাত এসে লাগল ওর বুকের ডানপাশে ফুসফুসের ওপরে।

তীব্র ধাক্কার চোটে প্রায় উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেল ও লঞ্চের কাঠের দেয়ালের সঙ্গে। মাথাটা ডুগডুগির মতো বাড়ি খেল কাঠের সঙ্গে। ধপ করে সরাসরি ডেকের ওপরে বসে পড়ল ও। হাত থেকে ছুটে গেছে ডেজার্ট ঈগল। ফুসফুসের ওপরে বুলেটপ্রুফ ভেস্টে গুলি লাগলেও আঘাতের চোটে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতে গিয়ে মনে হচ্ছে যেন গলা দিয়ে আগুন টানছে। চোখেও ঝাপসা দেখছে খানিকটা। কিন্তু এটা দেখতে পেল দানব আকৃতির লোকটা এগিয়ে আসতে- আসতে আবারো পিস্তল তুলেছে ওর দিকে। এবার আর বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বাঁচাতে পারবে না, বরং কপালে একটা গুলি করে দিলেই শেষ হবে খেলা।

পাগলের মতো পিস্তলটা ধরার জন্যে হাত বাড়াল ও, প্রায় পৌঁছে গেছে ওর হাতটা দুলে উঠল লঞ্চের একপাশ। পিস্তলটা সরে গেল আরো খানিকটা, তানভীরও বসা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল, ফিরে তাকিয়ে দেখল শেখারভও দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেছে। তানভীর পিস্তলটা ধরার জন্যে শোয়া থেকে বাউলি কেটে এগিয়ে গেল বেশ অনেকটা, হাতে চলে এসেছে পিস্তলটা।

ওটা হাতে নিয়ে ঘুরে বসেই দেখল শেখারভও পিস্তল তুলেছে ওর দিকে। দুজনেই গুলি করল কিন্তু তার আগেই আবারো দুলে উঠল লঞ্চ, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভট-ভট শব্দের সঙ্গে নৌকাটা সরে যেতে লাগল। শেখারভের গুলি তানভীরের পেছন দিকে গিয়ে লাগল সেই জেনারেটরটার ওপরে, আর তানভীরের গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে লাগল শেখারভের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা টেড চ্যাঙের গায়ে। শেখারভকে সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছনে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে সব লক্ষ্য করছিল জেড মাস্টার, গুলি খেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল সে। তারপর টুপ করে পড়ে গেল পানিতে। সেদিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে শেখারভের দিকে পিস্তল তাক করল তানভীর, কিন্তু গুলি করার আগেই জেনারেটর বিস্ফোরণের তীব্র ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে পড়ল শেখারভের গায়ের ওপরে।

দুজনেই গড়িয়ে পড়ে গেল ডেকের ওপরে। যদিও একের পর এক আঘাতে আহত তবুও শেখারভের ওপরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার ডান হাতের নার্ভ পয়েন্টে একটা ছোটো কারাতে চপ মারতেই পিস্তলটা পড়ে গেল লোকটার হাত থেকে। লোকটাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা-কাঁধ আর হাত মোচড় দিয়ে স্প্যানিশ কুস্তির কায়দায় চেপে ধরল তানভীর। মাটিতে শোয়া অবস্থায় হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটে এই বিশেষ হেড-লকটা খুবই কাজের জিনিস। শেখারভকে আটকে দিয়ে খুশি হয়ে উঠতে যাচ্ছিল তানভীর কিন্তু সকালের মতো সেই তীব্র আতঙ্কের সঙ্গে অনুভব করল শূন্যে উঠে যাচ্ছে সে। অবিশ্বাস্য শারীরিক শক্তির বলে শোল্ডার লক অবস্থায় থাকার পরেও শেখারভ ওকে শূন্যে তুলে ফেলছে।

খানিকটা উঠে বসেই শরীরটাকে সে ছেড়ে দিল নিচের দিকে। ফলে তার শরীরের অর্ধেক নিচে অবস্থান করা তানভীর একদিকে বাড়ি খেল ফ্লোরে, অন্যদিকে শেখারভের ভারী শরীরের চাপে দম বন্ধ হয়ে এলো ওর। তবে এখানেই শেষ নয় অধিক আতঙ্কের সঙ্গে ও অনুভব করল শেখারভ নিজেকে ছাড়িয়ে তো নিয়েছেই সেইসঙ্গে নিজের মোটা মোটা আঙুলগুলো দিয়ে চেপে ধরেছে ওর মাথার দুই পাশ। একবার সুযোগ পেলে এই লোক স্রেফ চেপেই মেরে ফেলবে ওকে। টেকনিক ভুলে গিয়ে নিজের দুই হাত আলগা করে ফেলল তানভীর, পায়ে গুঁজে রাখা ছুরিটা এক হাতে বের করে এনে সেটা বসিয়ে দিল শেখারভের গলায়। কিন্তু ছুরিটা গলায় না লেগে ওটা বসে গেল লোকটার কাঁধের ওপরে।

সঙ্গে সঙ্গে ওকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল তানভীর, শরীরটাকে সোজা করে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়াল। শেখারভও এক হাতে কাঁধ থেকে ছুরিটা বের করে ছুঁড়ে ফেলে দিল ডেকে, তারপর সোজা ঝাঁপিয়ে পড়ল তানভীরের ওপরে।

জায়গাটা খুবই সরু তবুও শেখারভতে সোজা ছুটে আসতে দেখে একপাশে খানিকটা চেপে গেল তানভীর। ছুটে আসা শেখারভকে একপাশে চাপিয়ে দিয়ে নিজের একটা পা তুলে শরীরটাকে অ্যাক্রোবেটিক ভঙ্গিতে খানিকটা শূন্যে তুলে ফেলল তারপর ডান পা-টা নামিয়ে আনল ছুটন্ত শেখারভের ঊরুর ওপরে। মোটেই এরকম কোনো আঘাত আশা করেনি সে, পুরোপুরি চমকে উঠল মানুষটা। ছুটে আসার গতি তো কমলোই-এক হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল সে। তানভীর ফ্রি স্টাইল কিকের ভঙ্গিতে পায়ের ব্লেডটা চালিয়ে দিল তার গলা বরাবর। এই কিকটাকে বলে ‘ব্রুস লি কিক’।

তবে শেখারভের ওপরে পুরোপুরি কাজে লাগল না কিকটা। কারণ তানভীর লাথিটা মারলেও পা-টাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সময়ে সে এক হাতে ধরে ফেলল তানভীরকে। পা-টা ধরে শক্ত হাতে টান দিতেই তানভীর ছিটকে চলে এলো শেখারভের ওপরে। তাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে একদিকে ছুটে গেল শেখারভ। দুজনে মিলে গড়িয়ে পড়ল সেই ডেকের কোনোায় যেখানে একটু আগে গোলাগুলি হয়েছে।

তানভীর দেখল পিস্তল হাতে জালাল আর সুলতান দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলছে লঞ্চের লোকজনের সঙ্গে গোলাগুলির শব্দ শুনে ওরা নিশ্চয়ই ছুটে এসেছে কী হয়েছে জানার জন্যে। ওরা দুজনে ছিটকে গিয়ে ওখানে পড়তেই সবাই চমকে উঠল। জালাল আর সুলতান পিস্তল তুলল কিন্তু জড়াজড়ি অবস্থায় গুলি করার প্রশ্নই আসে না। ডেকের ওপরে পড়তেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তানভীর, হাতের ইশারায় গুলি করতে মানা করল ওদেরকে। শেখারভও উঠে দাঁড়িয়েছে, রক্তাক্ত চেহারা বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে।

দুজনে উঠে দাঁড়াতে তানভীরই প্রথম আঘাত করল এবার। মাটিতে ডাইভ দিয়ে এগিয়ে শেখারভের প্যান্টের বেল্ট চেপে ধরল একহাতে, অন্য হাতে শরীটাকে ব্যালেন্স করে মাটিতে কবজি ঘুরিয়ে পেছন থেকে টান দিল তাকে। এটাকে বলে ব্যাক হিপ থ্রো। টান খেয়ে পুরোপুরি উল্টে গিয়ে অনেক পিছিয়ে একপাশে ছিটকে সরে গেল শেখারভ।

তার কাঁধের একপাশের হাড় সরে গিয়ে একটা হাত অকেজো হয়ে ঝুলছে একপাশে, মারামারিতে আর পারবে না বুঝতে পেরে সে অন্য ভালো হাতটা দিয়ে নিজের জুতোর একপাশ থেকে বের করে আনল ছোটো একটা পিস্তল, ওটা তাক করল তানভীরের দিকে। তবে সে গুলি করার আগেই প্রায় একইসঙ্গে জালাল আর সুলতানের গুলি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। কপাল আর গলা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত।

শেখারভকে গুলি খেতে দেখে ডেকের ওপরে বসে পড়ল তানভীর। শরীরে এক বিন্দু শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। সে প্যাঁচানো সিঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দম ফিরে পাবার চেষ্টা করতে লাগল। আশপাশে লোকজন অনেক কথা বলছে, জালাল সুলতান জানতে চাইছে ও ঠিক আছে কি না। জবাব না দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল ও। কোস্টগার্ড এসেছে কি না কে জানে, তবে ও এটা জানে–ব্ল্যাক বুদ্ধা সম্ভবত উদ্ধার হয়েছে, গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে গেছে টেড চ্যাঙ ওরফে জেড মাস্টার। আর তার সহকারী শেখারভের মৃতদেহ পড়ে আছে চোখের সামনেই।

এখন ওর ছোট্ট একটা কাজ আছে তবে সেটার আগে, একটু নিশ্বাস নিতে চায় ও। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো আনন্দে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চায়। বেঁচে থাকার আনন্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *