ব্ল্যাক বুদ্ধা – ৫৫

অধ্যায় পঞ্চান্ন – বর্তমান সময়
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট

সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের করিডর ধরে প্রায় দৌড়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে এগিয়ে চলেছে সুলতান আর ইকবাল।

তারা সুরমা নদীর টাইটানিকে গণ্ডগোলের পর জালাল আর তানভীর মিলে ব্ল্যাক বুদ্ধা নিয়ে ল্যাবে রওনা দেয়ার পর থেকেই দুজনে টানা কাজ করে গেছে। মোটামুটি যখন সব গুছিয়ে এনে ভোরের আলো ফুটতে যাবে এমন সময় সিলেট থানা থেকে একটা কল পেয়ে ইকবাল সচকিত হয়ে ওঠে।

সেইসঙ্গে সুলতানকে জানায় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কী ঘটেছে একেবারে সঠিকভাবে বোঝাতে না পারলেও এটা বলতে পেরেছে সে যে ল্যাবে কিছু একটা ঘটেছে, সেখানে ঝামেলা হয়েছে। ওসি জালালকে মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে কমান্ডার তানভীরও আছে, কিন্তু তার কী অবস্থা, সে আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না সেটা ইকবাল বলতে পারেনি। খবরটা শোনামাত্রই ওরা তেমুখীর কাছ থেকে পুলিশের একটা জিপ ম্যানেজ করে রওনা দেয় সিলেট ওসমানী মেডিকেলের উদ্দেশ্যে। ওরা হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌছাতে সকাল হয়ে গেছে। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ওরা হাসপাতালে প্রবেশ করে জানতে পারে, ওসি জালাল উদ্দিনকে মারাত্মক আহত অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কামন্ডার তানভীর মালিক অপারেশন থিয়েটারের সামনেই আছে। সেই পুলিশের কাছ থেকেই অপারেশন থিয়েটারটা কোন দিকে আছে সেটা জেনে নিয়ে দুজনে এখন ভোর বেলার খালি করিডর ধরে প্রায় দৌড়ে চলেছে সেদিকে।

অপরেশন থিয়েটারের কাছাকাছি এসে ওয়ার্ড দিয়ে বেরিয়ে আসা ট্রলিতে করে নিয়ে যেতে থাকা এক রোগীর সঙ্গে আরেকটু হলে ধাক্কা খেয়ে নিজেও পড়তে যাচ্ছিল রোগীকেও প্রায় ফেলে দিতে যাচ্ছিল সুলতান। কোনোমতে সামলে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারের সামনে প্রবেশ করল ওরা। অপারেশান থিয়েটারে একটার পর একটা রোগীর অপারেশন চলতেই থাকে। তাই এটার সামনে ভিড়ও থাকে সবচেয়ে বেশি।

সকালবেলা হলেও একদল উৎকণ্ঠিত আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে বসে থাকা তানভীরকে দেখে সুলতানের কলজেটা প্রায় লাফিয়ে উঠল। কারণ আহত বিধ্বস্ত রক্তে রঞ্জিত হয়ে থাকা তানভীরকে দেখে মুহূর্তের জন্যে সুলতান ভেবেছিল তানভীরেরই বুঝি গুলি লেগেছে। তানভীরের রক্তে রঞ্জিত শার্ট দেখে এমনটা মনে হয়েছে ওর কাছে কিন্তু ওদেরকে দেখতে পেয়ে তানভীরকে স্বাভাবিকভাবে উঠে আসতে দেখে বুঝল সে ঠিকই আছে।

‘কি ব্যাপার বস, হয়েছে কি?’ সুলতান একে তো দৌড়ে আসার বেগে হাঁপাচ্ছে তার ওপরে সে আসলে কথা খুঁজে পাচ্ছে না, কী বলবে। বিশেষ করে এখনো সে জানেই না আসলে এখানে ঘটছে কি। ‘জালাল ভাইয়ের কি অবস্থা?’

‘বস, আসলে হয়েছিল কি?’ সুলতান যে প্রশ্নটা আবারো করতে যাচ্ছিল সেটা বেরিয়ে এলো ইকবালের মুখ দিয়ে।

তানভীর কোনো জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। তার সাদা শার্ট জালালের রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। তানভীরের জিন্সের প্যান্টেও রক্তের ছাপ। গায়ের লেদার জ্যাকেকটা খুলে হাতে ধরা। সুলতানের কাছে মনে হলো মানুষটাকে এখন পর্যন্ত যতক্ষণ ধরে দেখছে, এরকম দিশেহারা একবারও লাগেনি। তানভীর এগিয়ে এসে নিজের লেদার জ্যাকেটটা ইকবালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটা হাত রাখল সুলতানের কাঁধে। তারপর ফিরে তাকাল সুলতানের চোখে।

তানভীরের চোখ দুটো বসে আছে গর্তে, চেহারা একেবারে বিধ্বস্ত। সুলতানের চোখে চোখ রেখে সে দুইবার মুখ খুলেও কথা বলতে পারল না। তৃতীয়বারের চেষ্টায় পরিষ্কার কথা বলে উঠল। ‘সুলতান আমি ধোঁকা খেয়ে গেছি। ডক্টর মিতায়নই আসলে জেড মাস্টার। প্রফেসর টেড চ্যাঙ আসলে নির্দোষ ছিল। প্রফেসর টেড চ্যাঙই ছিল এই কেসের মূল প্রবক্তা, জেড মাস্টার প্রফেসর মিতায়নের কৃত্রিম একটা প্রোফাইল তৈরি করে সেটার আড়ালে লুকিয়ে সব কাজ সারছিল। বিশেষ করে আমাদের সে ব্যবহার করেছে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যে। আমাদের দিয়ে সে ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করিয়ে ওটা নিয়ে পালিয়েছে,’ বলে সে একটু থেমে ধীরে ধীরে ইকবাল আর সুলতানকে বিস্তারিত বলে গেল ভোরবেলা ল্যাবের ভেতরে আসলে কী ঘটেছে।

তানভীরের কথা শেষ হতে দুজনেই চুপ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সুলতান বলে উঠল, ‘জালাল ভাইয়ের কী অবস্থা এখন?’

‘ওটিতে ঢোকানো হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। এতক্ষণে মনে হয় অপারেশনও শেষ হয়ে গেছে। তবে ডক্টর কিছু জানায়নি।’

‘ল্যাব থেকে বের হলেন কিভাবে?’ সুলতান প্রশ্ন করল।

‘ওরা বেরিয়ে যাবার পর জানালা দিয়ে আমি চিৎকার করতে থাকি,’ তানভীর যোগ করল। ‘কিছুক্ষণ পরে রাস্তা থেকে একজন সুইপার আমার চিৎকার শুনে দেখতে আসে কী হয়েছে। এরপর…’ বলে তানভীর কাঁধ ঝাঁকাল।

‘বস, ইএএফ তো আমাদের চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে,’ সুলতান চিন্তিত মুখে বলে উঠল। ‘একে তো ওদেরকে আপডেট দেয়া হয়নি, তার ওপরে আবার নিজেরা মাতব্বরি করে ব্ল্যাক বুদ্ধা উদ্ধার করেও হারিয়েছি আমরা।’

‘এগুলোর কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ না,’ তানভীর ইকবালের হাত থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে নিল। ‘ওরা আমাকে ধরবে নিজেদের আয়ত্তের ভেতরে জেড মাস্টারকে পেয়েও বুঝতে পারা তো দূরে থাক-আমরা তার দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছি, এটা-’

‘আচ্ছা ওরা এভাবে ল্যাবে, মানে—’ তানভীরকে থামিয়ে দিয়ে ইকবাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তানভীর তাকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলে উঠল।

‘আমি এখন এত কিছু বলতে পারব না,’ বলে তানভীর ইকবালের হাত থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে নিল। ‘এটা কি জিপের চাবি?’ ইকবাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই তানভীর বলে উঠল, ‘আমি এখন ল্যাবে যাব, গোসল দিব, খাবো তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসব। এতসব কিছু হয়েছে একমাত্র তাড়াহুড়োর কারণে। আমি যদি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারতাম…’ বলে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইকবালের কাছ থেকে জিপের নম্বর জেনে নিয়ে ওদেরকে জালালের শারীরিক অবস্থার আপডেট জানাতে বলে চলে এলো পার্কিং লটে। সেখানে এসে নম্বর মিলিয়ে জিপটা খুঁজে বের করে ওটা নিয়ে চলে এলো ল্যাবে। ল্যাবে পৌঁছে নিজের রুমে গিয়ে খাবারের অর্ডার দিয়ে গোসলে ঢুকল।

গরম পানি দিয়ে ফ্রেশ গোসল দিয়ে, ফার্স্ট এইড কিট খুলে নিজের কাটাকুটির যত্ন নিতে বসল ও। এর আগে ওসমানী মেডিকেলে ডক্টর চেক করে বলেছে মেজর কোনো ইনজুরি নেই। ছোটোখাটো ডাক্তারি শেষ করে খাবার খেয়ে নিয়ে বিছানার ওপরে পদ্মাসনে বসে ও মেডিটেশন করতে শুরু করল।

ওকে নিজের কাছে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে, ব্যবহার করতে হবে নিজের অ্যনালিটিক্যাল স্কিল। ঠান্ডা মাথায় পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে, একে একে ভাবতে লাগল সব প্রশ্নের উত্তর। ছোট্ট একটা হিসেব মেলানো বাকি রেখেই হঠাৎ ও বিছানা থেকে নেমে ইন্টারকমে কল দিল ল্যাবের অপারেটরকে। টমি ল্যাবে আছে কি না জেনে নিয়ে তাকে কয়েকটা নির্দেশ দিল ও।

টমির সঙ্গে কথা শেষ করে সিকিউরড লাইনে কল করল পাশা স্যারকে। কিন্তু উনি কল না ধরাতে চুপচাপ জানালার কাছে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবারো ভাবতে শুরু করল ও। হঠাৎ মনে হলো মাকে কল করা হয়নি। কিন্তু কয়েকবার কল করার পরও মা কল ধরল না। ফোন রেখে পোশাক পরতে শুরু করল ও। জিন্স প্যান্টটা পায়ে গলিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ধাম ধাম শব্দ হলো।

তানভীরের প্যান্ট পরা শেষ না হতেই আবারো দরজায় জোরে জোরে শব্দ শুনে ও জবাব দিল, ‘আসছি।’ কোনোমতে প্যান্টটা পরা শেষ করে দরজার লকটা আনলক করতেই ধাম করে খুলে গেল ওটা। আরেকটু হলে তানভীরের নাক চেপ্টা হয়ে যেত দরজার আঘাতে।

দরজা খুলে যেতেই দুই পা পিছিয়ে গেল ও। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল তিনজন মানুষ। প্রত্যেকের পরনে বিশেষ কালো পোশাক। কেউই অস্ত্র বের করেনি কিন্তু তানভীর দেখল প্রত্যেকেরই একটা করে হাত কোমরে, অস্ত্রের ওপরে রাখা।

‘আপনি তানভীর মালিক?’ মোটা লালচে গোঁফওয়ালা অফিসার প্রশ্ন করল। এই লোকটাকেই তানভীর ঢাকা এয়ারপোর্টে ইএএফের প্রধান বাবুল আহমেদের সঙ্গে দেখেছিল। তানভীর হ্যাঁ-সূচক জবাব দিতেই সে বলে উঠল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে আসবেন, ইএএফের প্রধান বাবুল আহমেদ আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

‘বাবুল স্যার, সিলেটে?’ তানভীর বেশ অবাক হয়েই জানতে চাইল।

‘কোনো কথা নয়,’ মোটা গোঁফ প্রায় ধমকে উঠল। ‘আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন,’ বলে সে একটা হাত বাড়াল তানভীরকে ধরার জন্যে। লোকটা তানভীরের কাঁধে একটা হাত রাখতেই রাগের হলকা বয়ে গেল ওর শরীরে। লোকটা ওর বাঁ কাঁধে নিজের ডান হাত রেখেছে, লোকটার কবজিটা আলতো করে ধরে চট করে বিশেষ আর্ম লকে মোচড় দিল তানভীর। এটাকে বলা হয় রিভার্স আর্ম লক। দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলে যেকোনো মানুষকে মুহূর্তের ভেতের শুইয়ে দেয়া সম্ভব।

তানভীর এত দ্রুত রিঅ্যাক্ট করে উঠবে লোকটা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। আর্মলকে লোকটার কবজি ধরে মোচড় দিতেই ব্যথায় বসে পড়ল সে। তবে তার চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়া হলো তার পেছনের লোকদের ভেতরে। পেছনের দুজন মেশিনের মতো যার যার অস্ত্র বের করে আনল। সেইসঙ্গে একজন মৃদু শিস দিতেই আরো দুজন অস্ত্রধারী ঢুকে পড়ল রুমের ভেতরে। ওদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে গুলি করে দেবে যেকোনো মুহূর্তে। সেই মোটা গোঁফই একটা হাত তুলে থামতে বলল নিজের লোকদেরকে।

একহাতে অন্য হাতটা ডলতে ডলতে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। তানভীর দেখল রাগে লাল হয়ে গেছে মানুষটার মুখ।

‘অফিসার বিহ্যাইভ ইয়োরসেল্ফ, আমি যদি এখানে সরাসরি বাবুল স্যারের নির্দেশ পালনের জন্যে না আসতাম তবে…’ সে কথা শেষ না করে নিজের লোকদের অস্ত্র নামানোর ইশারা করে বলে উঠল, ‘আপনি জলদি চলুন, দেরি হলে সে দায়ভার আমার নয়।’

তানভীর বিছানার ওপরে রাখা নিজের কাপড় দেখাল। ‘কাপড় তো পরতে পারব, নাকি এরকম আধ ন্যাংটো অবস্থাতেই আপনাদের বসের সঙ্গে মিটিং করতে হবে?’

মোটা গোঁফের মুখটা যেন রাগের সঙ্গে জ্বলছে, কিছু না বলে সে কাপড় পরার জন্যে ইশারা করল। তানভীর দ্রুত কালো একটা ফুল হাতা শার্ট পরে ওটার ওপরে কালো জ্যাকেট চাপাল। ব্যাগের ভেতরে এই সেটটাই ছিল ওর। কাপড় পরা হতেই লোকগুলোর সঙ্গে বেরিয়ে এলো ও করিডরে। ওকে নিয়ে সোজা চলে এলো ওরা ল্যাবের সেই কনফারেন্স রুমে।

রুমের ভেতরে প্রবেশ করে দেখল ইএএফের প্রধান বাবুল আহমেদ পুরোদস্তুর ইউনিফর্মে সজ্জিত হয়ে বসে কথা বলছে ল্যাবের প্রধান ডক্টর প্রবীরের সঙ্গে। ওকে দেখতে পেয়ে ডক্টর প্রবীর উঠে দাঁড়াল। বাবুল আহমেদ স্রেফ ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখল একবার। তারপর হাতের ইশারায় বসতে বলল।

‘কমান্ডার, আপনি সুস্থ আছেন?’ ল্যাবের প্রধান স্প্যানিশ অভিনেতার মতো দেখতে ডক্টর প্রবীর জানতে চাইল।

তানভীর মাথা নেড়ে জবাব দিল ও ভালো আছে। বাবুল আহমেদের দিকে ফিরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগে বাবুল আহমেদই কথা বলে উঠল

‘কমান্ডার, আপনি কি একটা গল্প জানেন?’ বাবুল আহমেদ এখনো ওর দিকে সরাসরি তাকায়নি। একহাতে নিজের মোবাইলটা নাড়াচাড়া করতে করতে বাইরের তাকিয়ে কথা বলছে সে। তানভীর কোনো জবাব না দিয়ে তাকে দেখল। তারপর বেশ দৃঢ় গলাতেই জানতে চাইল, ‘কোনো গল্প স্যার?’

বাবুল আহমেদ সরাসরি ফিরে তাকাল ওর দিকে। কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তানভীরও উদ্ধত দৃষ্টিতে সরাসরি তাকিয়ে আছে। ‘কমান্ডার, আমি তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। এতকিছুর পরেও তুমি গল্প শুনতে আগ্রহী, ব্যাপারটা খুবই অবাক করছে আমাকে,’ বলে বাবুল আহমেদ রোবটের মতো টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোকগুলোর ভেতরে মোটা গোঁওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘ফারুক, তুমি ভাবতে পারো এই লোক এখনো গল্প শুনতে চায়।’

লোকগুলো প্রায় সবাই হেসে উঠল। সেই মোটা গোঁফ বাবুল আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল। ‘স্যার, একজন ফিল্ড এজেন্ট কি জিনিস সেই ব্যাপারে এর কোনো ধারণা নেই, তাই…’

‘একদম ঠিক বলেছো ফারুক, ফিল্ড এজেন্ট-–’

বাবুল আহমেদকে কথা শেষ করতে দিল না তানভীর। ‘স্যার, অবশ্যই আমি জানি না ফিল্ড এজেন্টের মর্ম কি, কারণ আমি আপনাদের মতো ফিল্ড এজেন্ট নই। তাহলে আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না আমার মতো আপনাদের ভাষায় ‘একজন আনাড়িকে কেন আপনারা এত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে কমান্ডার করে পাঠালেন।’

‘কারণ, তোমার বসের কথায় আমি তোমার ওপরে বিশ্বাস রেখেছিলাম,’ বাবুল আহমেদ প্রায় গর্জে উঠল। ‘সেটার প্রমাণও তুমি দিয়েছিলে এক দিনের ভেতরে ডক্টর মিতায়নকে খুঁজে বের করে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে এভাবে তুমি সব ধ্বংস করবে এটা কে ভাবতে পেরেছিল। আমি ভেবেছিলাম তুমি পাশার কাছের লোক। তুমি অন্তত তার কথা শুনবে। কত বড়ো সাহস, প্রথমবারের মতো ফিল্ডে নেমে তুমি আনঅথরাইজড অপারেশন কনডাক্ট করো! তুমি নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছো, তোমার দলের লোকজনের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছো। সাধারণ জনগণের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছো, একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র অর্বাচীনের মতো সমাধান করার চেষ্টা করে সব গুবলেট করেছো। ডু ইউ নো হোয়াট দ্য হেল ডিড ইউ ডু?’ বাবুল আহমেদ রীতিমতো গর্জন করে চলেছে।

তানভীরের মাথা নিচু হয়ে গেছে। কথাগুলো একদম ঠিক। তবুও ও বোঝানোর চেষ্টা করল। ‘স্যার, আমার আনঅথরাইজড অপারেশনের কারণে কিন্তু কিছু ঘটেনি। বরং—’

.’কমান্ডার, তুমি কথা বলবে না, ইউ আর ফিনিশড, ইয়োর স্টোরি ইজ ফিনিশড,’ বাবুল আহমেদ রাগের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে। তানভীরের দিকে এগিয়ে এসে সে তানভীরের একেবারে মুখের কাছে মুখ এনে বলে উঠল, ‘তোমার কাহিনি শেষ।’

তানভীর বাবুল আহমেদের রাগে জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়েই দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘স্যার, আমার গল্প তো স্রেফ শুরু হলো। যদিও আমার গল্পটা একটু লম্বা কিন্তু এর ক্লাইমেক্স এখনো বাকি।’

বাবুল আহমেদ এখনো তানভীরের দিকে তাকিয়েই আছে। ছোট্ট করে সে জানতে চাইল, ‘মানে?’

‘মানে ব্যাখ্যা করার আগে আমি আপনার সঙ্গে একা কথা বলতে চাই,’ বলে সে বাবুল আহমেদের লোকদেরকে দেখাল সেইসঙ্গে ডক্টর প্রবীরকেও। একদম একা।’

বাবুল আহমেদ একটু ভেবে সেই মোটা গোঁফ ফারুককে ইশারা করল তার কাছে আসতে। তাকে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে ফিরে তাকাল তানভীরের দিকে। ‘বলো কমান্ডার, কী বলতে চাও তুমি।’

তানভীর সবার বেরিয়ে যাবার জন্যে ইশারা করল। ‘স্যার, আপনি কিছু মনে না করলে আমি ওই টেরেসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাই,’ বলে সে টেবিলের ওপর দিয়ে একটা ছোট্ট চিরকুট এগিয়ে দিল বাবুল আহদেমের দিকে। চিরকুটটা পড়ে বাবুল আহমেদ চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তানভীরও তাকিয়ে আছে, হুট করেই উঠে দাঁড়াল বাবুল আহমেদ। চলো, কমান্ডার।

ওরা কনফারেন্স রুমের সঙ্গে লাগোয়া টেরেসে চলে এলো। বাইরে খোলা টেরেসে হালকা রোদের ভেতরে দাঁড়িয়ে তানভীরের দিকে তাকিয়ে প্রায় ধমকে উঠে বাবুল আহমেদ একটা আঙুল তুলে তানভীরকে সাবধান করে দিল ‘কমান্ডার, তুমি অনেক ঝামেলা করেছো কিন্তু যদি তুমি আর কোনো বাড়াবাড়ি করো তবে-’ ।

‘স্যার, আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তবে আমি জানি ব্ল্যাক বুদ্ধা কোথায় আছে,’ বাবুল আহমেদেকে থামিয়ে দিয়ে তানভীর বলে উঠল। বাবুল আহমেদের অবাক দৃষ্টির সামনেই ও যোগ করল, ‘সেটাকে উদ্ধার করতে হলে অবশ্যই আপনার সহায়তা লাগবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *