ব্যাঙ

ব্যাঙ

কার্তিকের বৃষ্টি

প্রত্যেকদিন যেরকম হয়, আজও তাই হল। ভোরবেলা, খুব ভোরবেলা সাড়ে চারটে-পাঁচটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল রমেশবাবুর।

অথচ এরকম কথা ছিল না।

গতকালই চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন রমেশবাবু, রমেশচন্দ্র রায়। পাকা তেত্রিশ বছর আটমাস এগারো দিন বন্যপ্রাণী ও পশুপালন অধিকারে এক নাগাড়ে চাকরি করেছেন তিনি। এর মধ্যে প্রথম কয়েকবছর নিম্নবর্গীয় এবং উচ্চবর্গীয় কেরানির পদে, তারপরে বাকি জীবন ছোট বড়বাবু এবং বড়। বড়বাবু হয়ে। বিপত্নীক রমেশবাবু তাঁদের সাবেকি পৈতৃক বাড়ির অর্থাৎ হাতিবাগানে হরি সেন স্ট্রিট এবং হেমেন্দ্র ঘোষ রোডের উত্তর-পশ্চিম মোড়ের দ্বিতীয় বাড়ির বাইরের ঘরে একাই থাকেন। বাড়ির মধ্যে ভাই-ভাইবউ, ছেলে-ছেলের বউ, ভাইপো, ভাইঝি একটা ছোট নাতনি ইত্যাদির বসবাস।

বছর দশেক আগে, স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে পরেই বাড়ির মধ্য থেকে এই বাইরের ঘরে সরে আসেন রমেশবাবু। তারপর থেকেই সংসারের সঙ্গে তার একটু আলগা আলগা সম্পর্ক। মাসকাবারি সংসার খরচের টাকাটা ভাইবউয়ের হাতে তুলে দিয়ে তার শেষ। মাঝেমধ্যে ছোট নাতনিটা তাঁর কাছে এসে ঘুর ঘুর করে, খুব মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা। মুখের উঁচটা ধরে ঠাকুমার মতো।

পরলোকগতা স্ত্রীর কথা স্মরণ হতে একটু উদাস হয়ে যান তিনি। কিন্তু নাতনিটাকে খুব পাত্তা দেন না। আর মায়া বাড়াতে চান না। এসব অবশ্য অবান্তর কথা। ব্যাঙের ঘটনার সঙ্গে খুব প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু গল্পোপম ছোট গল্প লিখতে গেলে অনেক আশেপাশের কথা লিখতে হয়, সেটাই নাকি নিয়ম।

আসল কথা হল, বন্যপ্রাণী ও পশুপালন অধিকারের বড়বাবু রমেশচন্দ্র রায় গতকাল রিটায়ার করেছেন। তিনি মনে মনে স্থির করেছেন, এবার একটু বহির্মুখী হতে হবে। এতদিন বাড়ির ব্যাপারে আলগা দিয়েছেন, এবার অফিসও আলগা হয়ে গেল। এবার জিরানোর সময় এসেছে।

তবে শুধু জিরানো নয় সেই সঙ্গে বাইরের পৃথিবীটাকে, জগৎ সংসারকে একটু দেখতে হবে।

সেই নাইনটিন ফিফটি সিক্স, পৌনে তিন টাকায় এক সের মাংস, মিঠে পান তিন পয়সা, বাংলা পান দু পয়সা, একটা আইসক্রিম সোডা তিন আনা, পাইস হোটেলে ভাত-ডাল-ভাজা-তরকারি-মাছ দুবেলা তিরিশদিন মাসে সাড়ে আটাশ টাকা। রমেশচন্দ্রের মনে পড়ছে বাটা কোম্পানি সেই প্রথম হাওয়াই চটি বাজারে বার করল, দাম সাড়ে ছয় টাকা। দাম শুনে চমকে গিয়েছিলেন রমেশবাবু, তখন কলকাতা-ধানবাদ রেলগাড়িতে যাতায়াতি টিকিটের দাম সাত টাকা। এসব পুরনো কথা মনে করে দুঃখ করার লোক নন রমেশবাবু। তিনি সরকারি অফিসের বড়বাবু ছিলেন, রীতিমতো বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন লোক। তিনি জানেন, যেসব সময় গেছে সে আর ফিরে আসবে না তবে অন্য সময় আসছে, সামনে পড়ে রয়েছে অঢেল ফাঁকা সময়। সে সময়টার সদ্ব্যবহার করতে হবে।

এতদিন পর্যন্ত বড় কষ্টে, বড় পরিশ্রমে কেটেছে। অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি, বিশেষ কোনওদিন ছুটিছাটা নেওয়া হয়নি। সে যাওবা আগে নিয়েছেন, সেও সংসারের দরকারে, সে সময় পরিশ্রম হয়েছে। আরও বেশি।

রমেশবাবু ঠিক করেছিলেন অবসরের পরের দিন থেকেই জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বদলিয়ে ফেলবেন। আজ সকালে সাড়ে সাতটার আগে কিছুতেই ঘুম থেকে উঠবেন না। কিন্তু আজও সেই সাত সকালে ঘুম ভেঙে গেল।

রমেশবাবু তবু বিছানা আঁকড়িয়ে পড়ে রইলেন, জানলা দিয়ে বাইরে থেকে ফিকে আলো আসছিল, গায়ে একটা পাতলা চাদর ছিল, সেটা দিয়ে মুখ ঢেকে নিলেন এবং যে কোনও কারণেই হোক এই অবস্থায় তাঁর একটু হালকা তন্দ্রার মতো ভাব এল। কিন্তু বেশিক্ষণ নয় মাত্র দশ-পনেরো মিনিট পরেই তিনি পুরো জেগে উঠলেন।

এতদিনের অভ্যেস একদিনে কি যাবে? তন্দ্রা কেটে যেতে রমেশবাবুর প্রথমেই মনে পড়ল, আজকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকার কথা তার। বাড়ির কাজের মেয়েটা প্রত্যেকদিন সকাল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে তাকে এক কাপ চা আর দুটো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট দেয়। কাল রাতেই তিনি ভ্রাতুস্পুত্রবধূকে বলে দিয়েছেন, বউমা, কাল থেকে এত সকালে আমাকে চা দিতে বারণ কোরো। আমি বেলায় উঠে নিজেই চেয়ে নিয়ে চা খাব।

কিন্তু অন্যদিনের মতো আজও একই সময়ে, কিংবা হয়তো একটু আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। রমেশচন্দ্রের। তারপরে তন্দ্রাও মাত্র মিনিট দশেকের। যদিও এটা কার্তিক মাস। হাওয়ায় একটা হিমেল ভাব, শেষরাতে একটু ঠান্ডা থাকা উচিত। কিন্তু ঘুম ভাঙতে রমেশচন্দ্র বুঝতে পারলেন গরম লাগছে, কপালে, পিঠে একটু ঘাম। কানের লতির নীচে একটু উষ্ণভাব। যে চাদরটা দিয়ে মুখ ঢেকে আলো এড়াচ্ছিলেন, সেটা একটা পাতলা মুগার চাদর। সেটা এবার সরিয়ে দিলেন রমেশচন্দ্র। একটু স্বস্তি হল।

হরি সেন স্ট্রিটের এই একতলার উত্তর-পশ্চিম মুখের বাইরের ঘরটা চিরদিনই খুব গুমোট। বারো ফুট গলি, চারপাশে সব দোতলা-তিনতলা বাড়ি হাওয়া আসবে কোত্থেকে?

হয়তো এই সব কারণেই কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন, যাকে সময় লাঘবের জন্যে ব্যস্তলোকেরা বলেন সিইএসসি, যাঁদের প্রথম বিদ্যুৎ গছাতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে হরি সেন স্ট্রিটের নাগরিকেরা অন্যতম।

কাঠের চার ব্লেডের একটা আদ্যিকালের ডি সি পাখা এ ঘরে রয়েছে, সেটার বয়েস ষাট-সত্তর হওয়া মোটেই আশ্চর্য নয়। রমেশবাবু নিজে জন্ম থেকেই সেটা দেখছেন।

 আকাশে বোধহয় খুব মেঘ করেছে। চারদিকে কেমন একটা চাপা ভাব। এ ঘরের পাখাটা পারতপক্ষে রমেশবাবু ব্যবহার করেন না। কিন্তু আজ কী মনে হল, তিনি বিছানা থেকে উঠে পাখাটা চালিয়ে দিলেন।

পুরনো পাখাটা প্রায় দিন পনেরো বন্ধ ছিল। পরশুদিন জগদ্ধাত্রী পুজো গেছে। প্রত্যেক বছরই নিয়ম করে কালীপুজোরপরে পাখাটা চালানো বন্ধ করে দেন রমেশবাবু। এবারেও তাই করেছেন।

আজ এই সকালে পাখাটার সুইচ অন করে দিতে পাখাটা কিন্তু স্টার্ট নিল না। অনেক সময় এরকম হয়, পুরনো পাখা কিছুদিন বন্ধ থাকলে চালু হতে সময় নেয়।

এ রোগের চিকিৎসা রমেশবাবুর জানা আছে। ঘরের কোনায় দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দেওয়া একটা বেতের লাঠি আছে, সেই লাঠিটা নিয়ে পাখার ব্লেডে লাগিয়ে জোরে একটা ধাক্কা দিলেন তিনি।

পাখাটা আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। ঠান্ডা হাওয়ায় আরাম পেলেন রমেশবাবু, আবার বিছানায় ফিরে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।

এবার সত্যিসত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ভাঙল ব্যাঙের ডাকে আর বৃষ্টির শব্দে।

একটু ঠান্ডাও লাগছিল। বিছানার ওপর উঠে বসলেন রমেশবাবু। সারা রাতের গুমোট কেটে গিয়ে এই ভোরবেলায় প্রবল বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির তোড়ের শোঁ শোঁ শব্দ তারই মধ্যে ঘোঁঙর ঘোঁ ঘোঁঙর ঘোঁ ব্যাঙের ডাক স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

ঘুমের ঘোর কেটে যেতে রমেশবাবু খেয়াল করলেন কার্তিক মাসে কলকাতায় এমন বৃষ্টি কিছুটা অস্বাভাবিক হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। কোনও কোনও বছর এরকম হয়।

কিন্তু ব্যাঙ? এই গহন শহরে হরি সেন স্ট্রিটে ব্যাঙ এল কোথায়। কোনওদিন তো এ অঞ্চলে ব্যাঙ দেখেননি রমেশবাবু।

কিন্তু মনে হচ্ছে খুব কাছেই ডাকছে ব্যাঙটা।

রমেশবাবু প্রথমে ঘরের মধ্যে, তারপর জানলা দিয়ে ঘরের বাইরে চোখ মেলে ব্যাঙটাকে খুঁজতে লাগলেন।

০২. একটি প্রক্ষিপ্ত প্রসঙ্গ: ব্যাঙ কী ও কেন?

গল্পটা পুরনো। কিন্তু ব্যাঙ নামের কাহিনিতে গল্পটা না লিখে উপায় নেই।

বিপিন পাল কলেজে বাংলা পড়াতেন এক ভদ্রলোক। অধ্যাপকের পৈতৃক বাটি ময়মনসিংহে, মাতুলালয় বাখরগঞ্জে।

[কী বলছেন, কী?

বিপিন পালের নামে কোথাও কোনও কলেজ নেই? সুরেন ব্যানার্জি থেকে হীরালাল পাল পর্যন্ত সকলের নামে কলেজ আছে কিন্তু মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় বিপিন পাল অ্যাবসেন্ট, অনুপস্থিত। বিপিন পাল বাদ?

ভাবা যায়?]

 সে যাক। ধরে নিচ্ছি, বিপিন পালের নামে না থাকলেও অন্য কোনও নামের একটা কলেজে এক বাংলার অধ্যাপক ছিলেন, যার উচ্চারণে দেশজ টান ছিল যথেষ্ট প্রবল।

তিনি বৈষ্ণব কবিতা পড়াচ্ছিলেন, সেই যেখানে বর্ষার কথা আছে, মত্ত দাদুরীর কথা আছে। ছাত্রেরা স্বভাবতই দাদুরী মানে কী জানতে চাইল।

অধ্যাপক মহোদয় বললেন, সে কী তোমরা দাদুরী মানেও জান না। দাদুর মানে হল বেঙ, দাদুরী মানে হল মহিলা বেঙ।

ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো বুঝল ব্যাপারটা, কিন্তু অনেকেই তখন মজা পেয়ে গেছে, তারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, বেঙ কী স্যার?

অধ্যাপক বুঝলেন এরা কলকাতার ছেলে, জন্মেও ব্যাঙ দেখেনি, তাই তিনি শুদ্ধ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন, বেঙ বুঝলে না? বেঙ হল ভ্যাক।

.

শয্যাত্যাগ করে উঠে কলঘরের দিকে যেতে যেতে আজ অনেকদিন পরে এই বাজে গল্পটা মনে পড়ল রমেশচন্দ্রের। সেই সঙ্গে হঠাৎ তার খেয়াল হল আজ প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর বা তারও বেশি সময় তিনি কোনও ব্যাঙ দেখেননি।

এই হাতিবাগান-শ্যামবাজারি কলকাতায় ব্যাঙ আর কোথা থেকে আসবে। কলকাতার বাইরে বিশেষ বেরোনো হয় না। মধ্যে দুবার পুরী আর একবার দিল্লিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে। সেসব জায়গাতেও কোনও ব্যাঙ দেখেননি।

ব্যাঙ সত্যি দেখতে কেমন মনে করার চেষ্টা করলেন রমেশবাবু। মনে পড়ছে, ভালই মনে পড়ছে। সেই ছোটবেলায় যুদ্ধের সময়ে বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে এই হরি সেন স্ট্রিটের বাড়িতে তালা দিয়ে তাদের বাড়িসুদ্ধ সবাইকে তার বাবা কুষ্টিয়ার একটা গ্রামে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। নিজে ফিরে এসে একটা মেসে উঠেছিলেন, তারও ছিল সরকারি চাকরি। চাকরির জন্যেই ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে।

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা এসব। কিন্তু কুষ্টিয়ার সেই ছোট জোলো গ্রাম হরিনাথপুরের স্মৃতি এখনও অম্লান রয়ে গেছে রমেশবাবুর মনে।

বাবা! কতরকম যে ব্যাঙ ছিল হরিনাথপুরে!

নামগুলো এখনও মনে আছে। সোনা ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, চুনো ব্যাঙ, রাজা ব্যাঙ, বাবু ব্যাঙ।

নামগুলো মনে রয়েছে কিন্তু সবরকম ব্যাঙের চেহারা এখন আর মনে নেই। শুধু মনে আছে সোনা ব্যাঙের গায়ে সত্যি একটা সোনালি আভা ছিল, বিশেষ করে চোখের নীচে আর গলার কাছে, বৃষ্টির দিনের রোদ সোনা ব্যাঙের গায়ে পড়লে ঝলমল করে উঠত তাদের শরীর।

আর বাবু ব্যাঙের কথাও মনে আছে।

কেন যে সেগুলোকে বাবু উপাধি দেওয়া হয়েছিল সেই অল্প বয়েসে ধরতে পারেননি রমেশচন্দ্র। এখন, এতকাল পরে চেহারাটার আভাস মনে আসছে তার, গোবদা গোবদা পা, লম্বা নাক, গোল চোখের মণির চারধারে কৃষ্ণবলয় ঠিক যেন পণ্ডিতি চশমা। বারান্দা দিয়ে কলকাতার দিকে যেতে যেতে রমেশবাবু পঁয়তাল্লিশ বছর পরে আজ বুঝতে পারলেন কেন ওই ব্যাঙগুলোকে বাবু বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছিল।

.

মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই হরি সেন স্ট্রিটের ব্যাঙের ডাকের রহস্যটা উত্তীর্ণ হয়েছেন রমেশবাবু।

ব্যাঙটা ঘরেও ডাকছে না, বাইরেও ডাকছে না। গত একশো বছর কিংবা দেড়শো বছর হরি সেন স্ট্রিটে, হরি সেন স্ট্রিটের আশপাশে কোথাও কোনও ব্যাঙ ডাকেনি। অথবা আরও হয়তো আগে থেকে। সেই যে বছর মারাঠা ডিচ খোঁড়া হয়, আদি কলকাতা আর চড়কডাঙা, জেলেপাড়া, কলুটোলা, হাতিবাগান আর শ্যামবাজার-চিৎপুরের সব ব্যাঙ নাকি পালিয়ে গিয়ে মারাঠা ডিচে আশ্রয় নেয়। তারপরে আর সদর শহরে একটাও ব্যাঙ দেখা যায়নি।

বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে যে ব্যাঙের ঘোঁঙর ঘোঁ ঘোঁঙর ঘোঁ ডাক শুনেছিলেন রমেশবাবু একটু পরেই বুঝতে পেরেছিলেন সেটা বেরুচ্ছে পুরনো ওই চার ব্লেডের ডি সি পাখার ভেতর থেকে। বহুদিন অয়েল করা হয়নি। কোনওরকম মেরামতিও হয়নি–পাখাটা আর চলতে পারছে না। ওই রকম করুণ আর্তনাদ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে কিংবা সদ্য অবসরপ্রাপ্ত রমেশবাবুর কাছে সে অবসর প্রার্থনা করছে। তারও তো অনেকদিন হয়ে গেল।

রমেশবাবুর চেয়ে বেশিই।

আস্তে উঠে রমেশবাবু ঘরের দেয়ালের কাছে গিয়ে পাখার সুইচটা অফ করে দিলেন। ঘোঁঙর ঘোঁ শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল।

বাইরে বৃষ্টিটাও প্রায় থেমে এসেছে। এখন আর বৃষ্টির আওয়াজে সেই শোঁ শোঁ ভাবটা নেই। ঝিরঝির করে অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। উত্তর থেকে একটু ঠান্ডা হাওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর শীতটা একটু তাড়াতাড়ি এসে গেল। এই বৃষ্টিটাই এনে দিল।

কলতলা থেকে ফিরে এসে রমেশবাবুর চা খাওয়ার কথা খেয়াল হল। অন্যদিন হলে এতক্ষণ কাজের মেয়েটা চা দিয়ে যেত কিন্তু তিনি নিজেই কাল বারণ করে দিয়েছেন এত সকালে চা দিতে। একটু পরে বৃষ্টিটা থামতে রমেশবাবু ছাতাটা নিয়ে রাস্তায় বেরলেন কাছে পিঠে কোনও একটা ফুটপাথের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে নেবেন।

অফিস বা বাড়ির বাইরে বহুকাল কোনও দোকান-টোকানে চা খাননি রমেশচন্দ্র। পাড়ার মোড়ের দুদিকে দুটো চায়ের দোকান রয়েছে। কেমন যেন সংকোচ হল রমেশবাবুর সেসব দোকানে চা খেতে। পুরনো পাড়া, আশপাশে অনেক চেনাজানা লোক। রাস্তায় কোথাও কোথাও এরই মধ্যে জল জমে। গিয়েছে, কাদাও যথেষ্ট। কোনও রকমে ধুতিজুতো বাঁচিয়ে সামনের দিকে কলেজ স্ট্রিটের বরাবর ট্রামরাস্তা ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন রমেশবাবু।

বিবেকানন্দ রোড পার হয়ে ঠনঠনের কালীমন্দিরের উলটোদিকে একটা রাস্তার চায়ের দোকানে কাঠের বেঞ্চিতে বসে একটা সস্তার কেক আর পরপর দু কাপ চা খেলেন তিনি।

চা খাওয়া হয়ে যেতে দোকানের পয়সা মিটিয়ে হাতের হাতঘড়িতে রমেশবাবু দেখলেন সবে সোয়া ছয়টা বাজে। অফিস নেই, বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। হাতে অঢেল সময়। এদিকে বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘও বিদায় নিয়েছে। গলিখুঁজির ফাঁক দিয়ে সূর্যের হালকা আলো রাস্তায় এসে পড়ছে। এই ভোরবেলাতেই ফুটপাথের গর্তের ঘোলাজলে দুটো কাক মাথা ডুবিয়ে স্নান করছে।

অনেকদিন পরে এসব জিনিস চোখে পড়ল রমেশবাবুর। তার কেমন যেন মনে হল জীবনটা বড় বৃথা গিয়েছে। অন্তত এখনও একটা কিছু করা দরকার। সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন তিনি।

০৩. তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা

হাঁটতে হাঁটতে কলেজ স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত এসে গেলেন রমেশবাবু। অনেকরকম এলোমেলো চিন্তা করছেন তিনি, এ বয়েসে নতুন করে কী-ই বা করবেন? কী-ই বা করতে পারেন? কবিতা লেখা, গান করা এসব কোনওদিনই তার ধাতে আসে না। আর তা ছাড়া, সেটা এ বয়েসে আরম্ভ করাও খুব হাস্যকর দেখাবে। অনেকে দেখা যায় রিটায়ার করে রাজনীতি করতে নামে। সমাজসেবার অজুহাতে এ দল কি ও সঙেঘ নাম লেখায়। না সে সমস্তও রমেশবাবুর দ্বারা হবে না। ধর্মকর্মেও তেমন আস্থা বা মন নেই তাঁর।

কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবেই। জীবনটাকে একটু বাজিয়ে দেখা, একটু চেখে দেখা, এই তো শেষ সুযোগ। এরপর ক্রমশ বুড়ো, অথর্ব হয়ে যাবেন। তার আগে…..

 এদিকে ভোরবেলার সেই পুরনো পাখার ঘোঁঙর ঘোঁ, ঘোঁঙর ঘোঁ ডাকটা এখনও তাঁর কানে লেগে রয়েছে। মাথার মধ্যে ঘুরছে। সত্যিই সামান্য একটা ব্যাঙের ডাক কতকাল তিনি শোনেননি। একটা ব্যাঙ চোখে পর্যন্ত দেখেননি।

তিনি এতকাল চাকরি করেছেন বন্যপ্রাণী ও পশুপালন অধিকারে। সেখানে সাপ কুমির, বাঘ-সিংহ, গোরু-ছাগল এমনকী হাঁস-মুরগি পর্যন্ত কত রকম সব কত নোট তাকে লিখতে হয়েছে, চিঠি ড্রাফট করতে হয়েছে।

কিন্তু ব্যাঙ, না ব্যাঙের কথা ফাইলপত্রে কখনও উঠেছে বলে মনে পড়ছে না। অনেকদিন আগে বিদেশে ব্যাঙ রপ্তানি প্রসঙ্গে একটা নথি তাঁর কাছে এসেছিল, সেটাও তিনি দেখে শুনে বাণিজ্য দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

এরই মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে গোলদীঘি, মেডিক্যাল কলেজ পার হয়ে বউবাজারের মোড়ে চলে এসেছেন রমেশবাবু।

ব্যাঙের ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ঘুরছে আর ঘুরছে। ঘোঁঙর ঘোঁ, ঘোঙর ঘোঁ।

অবশেষে বউবাজারে ভীমনাগের সন্দেশের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রমেশবাবু ঠিক করলেন তা হলে ব্যাঙ দিয়েই নতুন জীবনটা শুরু হোক। অনেকদিন পরে আজ কোথাও গিয়ে একটা ব্যাঙ দেখে আসি।

কাছে পিঠের মধ্যে সেই প্রাচীন গড়ের মাঠ রয়েছে। আজ সকালে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। নিশ্চয়ই সেখানে অনেক ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যাবে। হয়তো ডাকও শোনা যাবে।

রাস্তা ক্রশ করে উলটো দিকের ফুটপাথে চলে এলেন রমেশবাবু। সেখানে বাসস্টপে গিয়ে একটা টু বি দোতলা বাসে চেপে বসলেন তিনি।

সকালবেলায় বাসে তেমন ভিড় নেই। এখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ট্রামে বাসে ভিড় বাড়তে থাকবে। এর মধ্যেই ময়দান থেকে ঘুরে আসবেন তিনি।

থিয়েটার রোডের মোড়ে বাস থেকে নেমে বিড়লা তারামণ্ডলের ওপাশ থেকে সরাসরি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঢুকলেন।

সকালবেলায় বৃষ্টির জলে এখনও ছপছপ করছে মাঠটা। এখনও কিছু কিছু লেট ভ্রমণকারী মাঠে মুক্ত বায়ু সেবন করছে। মাউন্ট পুলিশের গোটা দশ-পনেরো অশ্বারোহী চক্রাকারে পাক খাচ্ছে। বোধহয় তাদের ট্রেনিং হচ্ছে।

অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন রমেশবাবু। কিন্তু পুরো মাঠটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটা ব্যাঙ দেখতে পেলেন না। বোধহয় ঘোড়ার উপদ্রবে ব্যাঙেরা লুকিয়েছে৷

কিন্তু লুকোবে কোথায়?

মাঠটা কোনাকুনি ক্রশ করে যেখানে মোহনবাগান ক্লাবের ঘেরা মাঠের পেছনে ফোর্টের গা ঘেঁষে একটা নয়ানজুলি রয়েছে সেখানে উঁকি দিলেন রমেশবাবু। বৃষ্টির জলের স্রোত তরতর করে বয়ে যাচ্ছে ড্রেনটা দিয়ে সেখানে উঁকি দিয়ে দেখলেন রমেশবাবু, কিন্তু ব্যাঙের কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।

একজন সদাশয় প্রকৃতির স্বাস্থ্যবান মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, পরনে ট্রাকস্যুট, চেহারাটা কেমন চেনাচেনা, প্রচুর ঘেমেছেন, মাঠের মধ্য দিয়ে আসছিলেন। ওপাশের রাস্তার ওপরে তার গাড়িটা রয়েছে, সেটায় উঠতে যাবেন তিনি, রমেশবাবুকে উবু হয়ে ড্রেনে উঁকি দিতে দেখে এগিয়ে এলেন, সহৃদয় কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু হারিয়েছে আপনার?

গলার স্বর শুনে এবং চেহারার আদল দেখে রমেশবাবুর খেয়াল হল টিভি-তে দেখেছেন এঁকে, ইনি হলেন পি কে। পি কে ব্যানার্জি-ফুটবলের নামজাদা কোচ, অতীতের দিকপাল ফুটবল প্লেয়ার।

কী আর বলবেন রমেশবাবু, থতমত খেয়ে বোকার মতো বলে বসলেন, ব্যাঙ, ব্যাঙ খুঁজছিলাম।

পি কে সহানুভূতির স্বরে বললেন, ব্যাঙ কি আর পাবেন এসব জায়গায়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেখুন, সেখানে প্রচুর আছে। এখনও দুচারটে থাকতে পারে।

তারপর একটু থেমে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পি কে বললেন, আমি তো আমার ছেলেদের ব্যাঙ ধরে খেতে বলি। প্রোটিন আছে, সুস্বাদু। কিন্তু কে কার কথা শোনে? শুধু টোস্ট আর ওমলেট খেয়ে কি ফুটবল খেলা হয়। এইভাবেই বাঙালি গেল।

পি কে চলেগেলেন। প্রায় এক কিলোমিটার উজিয়ে অতঃপর রমেশবাবু যখন ভিক্টোরিয়া উদ্যানে প্রবেশ করলেন, তখন রোদ্দুর বেশ চড়ে গেছে। দুচার জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল প্রায় শুন্য। সকালবেলার সেই হিমভাব বাতাসে নেই, বরং রীতিমতো গরম লাগছে, ঘাম হচ্ছে।

পি কের পরামর্শ কিন্তু কাজে লাগল না। ভিক্টোরিয়ার আনাচে কানাচে অনেক ঘোরাঘুরি করে পুকুরগুলোর পাড়ে এখানে ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে একটিও ব্যাঙ নজরে এল না রমেশবাবুর। বরং বেশি অনুসন্ধিৎসু হতে গিয়ে গাছের আড়ালে, ঝোঁপের ভিতরে প্রেমিক যুগলদের অবিশ্বাস্য সব অশালীন দৃশ্য তার চোখে পড়ল। এখন মানে মানে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলেই রক্ষা। উত্তরের দিকের গেট দিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রবেশ করেছিলেন রমেশবাবু, অবশেষে ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত, নিরাশ অবস্থায় উত্তরের গেট দিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের শেষ প্রান্তে এস এস কে এম হাসপাতালের মুখে বেরিয়ে এলেন।

বাড়ি ফেরার বাসে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি। কাছেই রবীন্দ্রসদনের পাশ থেকে উলটোডাঙার খালি বাস ছাড়ে। কিন্তু হঠাৎ রমেশবাবুর খেয়াল হল এখান থেকে চিড়িয়াখানা মোটেই দূরে নয়, হাঁটাপথে বড়জোর পনেরো মিনিট।

চিড়িয়াখানার ভেতরে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে শেষবার গিয়েছিলেন রমেশবাবু তার মা বাবার সঙ্গে। সেসব অনেকদিন আগেকার কথা। এর মধ্যে একদিন নাতনিকে নিয়ে আসবেন ভেবেছিলেন তাও হয়ে ওঠেনি।

চিড়িয়াখানার দিকে এগোতে এগোতে রমেশচন্দ্র ভাবতে লাগলেন চিড়িয়াখানায় ব্যাঙের খাঁচা আছে কিনা। সারা দুনিয়ার হাজার রকম জীবজন্তু চিড়িয়াখানায় আছে আর ব্যাঙ থাকবে না, নিশ্চয়ই আছে।

চিড়িয়াখানায় পৌঁছে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে রমেশবাবু কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরলেন। তারপর একটা ম্যাপের সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়ালেন, তার মধ্যে বিভিন্ন রকম জীবজন্তুর খাঁচার পথ নির্দেশ দেওয়া আছে।

কিন্তু না। এর মধ্যে কোথাও ব্যাঙের খাঁচার কোনও অস্তিত্ব নেই। একটু বিভ্রান্ত বোধ করলেন রমেশবাবু। কিন্তু কী আর করবেন, কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়। আর আঁতিপাঁতি করে খুঁজতেও ভরসা পাচ্ছেন না তেমন। বিশেষ করে একটু আগের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্ডেনের সেই অভিজ্ঞতা মোটেই মধুর নয়।

সাইনবোর্ডের সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই রমেশচন্দ্রের চোখে পড়ল বিজলি গ্রিল। অনেকদিন আগে বিজলি গ্রিলের দেবু বারিক রমেশচন্দ্রের সঙ্গে এক স্কুলে কিছুদিন পড়েছিল। এখন হয়তো আর চিনতে পারবে না।

তা না পারুক। গুটি গুটি বিজলি গ্রিলে গিয়ে দাঁড়ালেন রমেশবাবু। দোকানটা তখন সদ্য খুলেছে, সামনে কাউন্টারের পাশে যে ভদ্রলোক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, দেবু আছে, দেবু বারিক?

ভদ্রলোক বললেন, না দেবুবাবুকে তো এখন পাবেন না। কেন, বলুন তো?

একটু ইতস্তত করে রমেশবাবু বললেন, না তেমন কিছু নয়। আমি দেবুর ক্লাসফ্রেন্ড ছিলাম, একটা খবর জানতে চাইছিলাম।

ভদ্রলোক বললেন, কী খবর বলুন?

 রমেশবাবু একটু দম নিয়ে, একটু চিন্তা করে বললেন, আচ্ছা, আপনাদের এই চিড়িয়াখানায় ব্যাঙের কোনও খাঁচা নেই।

কাউন্টারের ওপারের ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন, কিছুক্ষণ রমেশবাবুকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন, তারপর বললেন, ব্যাঙের খাঁচা? ব্যাঙের? হাসালেন দাদা আপনি। কাক, কাঠবেড়ালি, ব্যাঙ, চড়ুই এদের আবার খাঁচা কী? তাহলে তো নেড়িকুকুর, পাতি বেড়াল, টিকটিকি আর শালিককেও খাঁচায় রাখতে হবে।ভদ্রলোক হো হো করে হাসতে লাগলেন।

কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে তবুও শেষরক্ষা হিসেবে রমেশবাবু বললেন, কিন্তু, মনে করুন, এমন কোনও লোক চিড়িয়াখানায় এসেছে যে জীবনে কখনও ব্যাঙ দেখেনি…

এমন কোনও লোক যে জীবনে কখনও ব্যাঙ দেখেনি!…

ভদ্রলোকের অট্টহাস্য উচ্চতর হল, তারপর কী ভেবে তিনি হাসি থামিয়ে রমেশবাবুকে বললেন, ব্যাঙের কোনও খাঁচা নেই বটে, তবে কেউ যদি সত্যি সত্যিই ব্যাঙ দেখতে চায়, সে সাপের খাঁচায় গেলে ব্যাঙ দেখতে পাবে।

রমেশবাবু এই সংবাদে উত্তেজিত হয়ে বললেন, কী রকম?

ভদ্রলোক ভারিক্কি চালে বললেন, সাপের খাদ্য হল ব্যাঙ। সব সাপকেই ব্যাঙ খেতে দেয়া হয়। এইতো এখনই দশটা-সাড়ে দশটার সময় সব খাঁচায় খাবার দেয়া হবে। আপনি সাপের খাঁচার ওখানে। গেলে দেখতে পাবেন খাঁচায় রাশিরাশি ব্যাঙ ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

খবরটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এমন নৃশংস ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত হতে চান না রমেশচন্দ্র।

তবু নিতান্ত ব্যাঙ দর্শনের মানসেই গুটিগুটি রেপটাইল হাউস তথা সর্পভবনের দিকে এগিয়ে গেলেন রমেশবাবু।

প্রতি মুহূর্তে রমেশবাবু ভয়ে, দ্বিধায় কাতর হচ্ছিলেন। হয়তো গিয়ে দেখবেন কাঁচের দেয়ালের ওপাশে সাপ গিলে খাচ্ছে একটার পর একটা ব্যাঙ। ব্যাঙ দেখার আনন্দের চেয়ে তাহলে যে ব্যাঙ নিধনের এই যন্ত্রণা অনেক বড় হয়ে যাবে।

রমেশবাবুর ভাগ্য ভাল।

সপ্তাহে একদিন মাত্র সাপেদের খাবার দেয়া হয়। এবং আজকের দিনটি সেই দিন নয়। গতকালই নাকি ছিল সাপেদের খাবার দেয়ার দিন।

সুতরাং সর্পভবনে গিয়ে নিতান্তই অল্পবিস্তর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বৃহদপি বৃহৎ সাপ এবং কয়েকটি মেছে ও গেছো কুমির দেখলেন রমেশচন্দ্র, কিন্তু একটিও ব্যাঙ দেখতে পেলেন না। তবে কোনও কোনও সাপের উত্তুঙ্গ এবং সচল পাকস্থলী দেখে বুঝতে পারলেন, ওরই অন্তরালে রয়েছে এক কিংবা একাধিক ব্যাঙ, যাদের জীবন্ত গিলে ফেলা হয়েছে।

.

বেলা প্রায় বারোটা বাজে।

ভগ্নমনোরথ রমেশবাবু খিদিরপুর বাজারের রাস্তায় চিড়িয়াখানার পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। বাইরে গনগন করছে রোদ, কে বলবে এটা কার্তিকের শেষ। আজ সকালেই উঠেছিল জোর উত্তুরে হাওয়া আর শীতল বৃষ্টি।

তিন নম্বর বাসস্ট্যান্ড খিদিরপুর বাজারের পাশেই। সেটায় চড়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে গ্রে স্ট্রিট-সার্কুলার রোডের মোড়ে নেমে অনেকটা হেঁটে যখন হরি সেন স্ট্রিটের কাছে এসে পৌঁছলেন রমেশবাবু তখন প্রায় দেড়টা বাজে। সূর্য ঢলে পড়েছে, বড় বড় লম্বা ছায়া পড়েছে রাস্তায়।

এদিকে তার বাড়িতে হইচই পড়ে গেছে। থানায় ডায়েরি করা হয়েছে। লোকটা গেল কোথায়? চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কি লোকটা বিবাগী হয়ে গেল। আস্ত লোকটা উধাও হয়ে গেল। শুধু বাড়ির লোক নয়, পাড়াসুদ্ধ লোক পর্যন্ত জড়িত হয়ে পড়েছে এই দুশ্চিন্তায়।

গলির মোড়েই ব্যাকুল মুখে রমেশবাবুর ভাইপো দাঁড়িয়ে ছিল। সে রমেশবাবুকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, এই তো জ্যাঠা ফিরে এসেছে। তার চিৎকার শুনে গলির ভেতর থেকে অনেক লোক ছুটে বেরিয়ে এল।

রমেশবাবু বাড়িতে এসে শুনলেন তাঁর ছেলে, ভাই কারও আজ অফিস যাওয়া হয়নি। বাড়ির কারও নাওয়া খাওয়াও হয়নি। ভাই কিংবা ছেলে এখন কেউই আর বাড়ি নেই। দুজনেই তাঁকে খুঁজতে বেরিয়েছে। একজন দক্ষিণে গেছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, অন্যজন গেছে উত্তরদিকে আর জি কর হাসপাতালে। বেলা তিনটে নাগাদ তারাও ফিরল। সবাই হইচই করতে লাগল, কী হয়েছিল? কোথায় গিয়েছিলে!

রমেশবাবু তাদের কী আর বলবেন। শুধু মুখে বললেন, না। এই এমনি একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম।মনে মনে ভাবলেন, এদের যদি বলি ব্যাঙ খুঁজতে, ব্যাঙ দেখতে গিয়েছিলাম, তা হলে এরা হয়তো ধরে নেবে আমি পাগল হয়ে গেছি।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া মিটতে মিটতে বিকেল হয়ে গেল।

 সারাদিনের পথশ্রম এবং ক্লান্তিতে অবেলায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন রমেশবাবু।

 যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘোর সন্ধ্যা। ঘুম থেকে উঠে বিছানায় আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে তিনি শুনতে পেলেন তার নাতনি একটা ছড়ার বই খুলে আপনমনে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ছে, ৫২২

তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা
কোলা ব্যাঙের ছা।
খায় দায় গান গায়
তাইরে নাইরে না।

বিছানায় বসেই নাতনিকে ডাকলেন রমেশবাবু, খুকু তোর ছড়ার বইটা একটু নিয়ে আয়তো দেখি।

দাদু সাধারণত খুকুকে কখনও এমনভাবে ডাকে না। আজ দাদুর ডাক শুনে পরম উৎসাহে খুকু ছড়ার বইটা নিয়ে দাদুর কাছে এল। বিছানা থেকে উঠে ঘরে আলো জ্বেলে খুকুকে সামনের কাঠের চেয়ারটায় বসিয়ে কলতলায় মুখ ধুতে গেলেন রমেশবাবু।

ফিরে এসে তাক থেকে চশমাটা নামিয়ে খুকুর ছড়ার বইটা খুলে ব্যাঙের ছবিটা তন্ময় হয়ে দেখতে লাগলেন তিনি।

ছড়ার বইটার প্রথম পাতাটা ছেঁড়া। বোঝা গেল না ছবিটা কে এঁকেছে, শিল্পীর নামটা পাওয়া গেল। রমেশবাবু নাতনিকে বললেন, দেখেছিস ব্যাঙের ছবিটা কী সুন্দর এঁকেছে।

খুকু বলল, এর চেয়ে অনেক ভাল ভাল ব্যাঙ আজ বিকেলে টিভিতে দেখিয়েছে। তাইতো ছড়াটা পড়ছিলাম।

ভেতরের ঘরে একটা ছোট সাদাকালো টিভি আছে। বিকেলে খুকু রাস্তায় খেলতে যাওয়ার জন্যে যখন বায়না করে তখন খুকুর মা তাকে টিভি খুলে বসিয়ে দেয়। দূরদর্শনে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের সময় সেটা। অনেকদিন অনুষ্ঠান খুবই খটমট লাগে খুকুর। আবার খুব মজাও হয় কখনও কখনও যেমন আজকেই হয়েছে, আজকের প্রোগ্রাম ছিল: মানুষের পরম বন্ধু ব্যাঙ।

০৪. তাইরে নাইরে না

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আর বাড়ির বাইরে গেলেন না রমেশবাবু। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ভাইপোর কাছ থেকে জীববিজ্ঞানের বইটা চেয়ে নিয়ে উভচর প্রাণীর অধ্যায়টা খুব ভাল করে দেখলেন তিনি।

এবং সেখানেই একটা খবর পেলেন। খবরটা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠান্ডা পড়ার সঙ্গে ব্যাঙ অদৃশ্য হয়ে যায়। খানাখন্দে, গর্তে লুকিয়ে পড়ে। সুতরাং আপাতত কয়েকমাস আর ব্যাঙের খোঁজে আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরি করে বিশেষ লাভ নেই। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে একটা ভিডিও ক্লাব হয়েছে। অফিসে যাতায়াতের পথে রমেশবাবুর সেটা চোখে পড়েছে। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে সেই ক্লাবে গিয়ে তিনি খোঁজ করলেন, গতকাল টিভিতে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে একটা ব্যাঙের প্রোগ্রাম হয়েছিল সেটা কি ভিডিওতে আবার দেখা সম্ভব।

ভিডিও পারলারের সুযোগ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম অপারেটর কাম মেকানিক মংলু প্রসাদ চতুর, অভিজ্ঞ ব্যক্তি। কলকাতা শহরে তার জীবিকার হাতেখড়ে হয়েছিল সুরেন ব্যানার্জি রোডে অশ্লীল বইয়ের দোকানে সেলসম্যানি করে।

মংলু প্রসাদ রমেশবাবুর কথায় কী বুঝল কে জানে। অশ্লীল সামগ্রীর খদ্দের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট, সে হঠাৎ রমেশবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কী একটা কু প্রস্তাব দিল।

রমেশবাবু মংলুকে একটা থাপ্পড় লাগাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ক্রোধ দমন করে দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে এলেন।

বন্যপ্রাণী ও পশুপালন অধিকারের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান সহায়ক শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র রায় আমার আপন মামাতো দাদা। পরস্পর খবর পেয়েছিলাম যে রিটায়ার করার পর তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে।

এটা কোনও আশ্চর্য ব্যাপার নয়। সব অফিসেই বহু পাগল থাকে। যতদিন তারা অফিস করে বাড়ির লোকেরা, সেই সঙ্গে পাড়াপ্রতিবেশী জানতেই পারে না যে তারা পাগল। আর দশজনের মতোই তারা স্নান করে, ভাত খেয়ে অফিস যায়-দশটা পাঁচটা করে। কিন্তু অবসর নেওয়ার পরে তাদের স্বরূপ প্রকাশিত হয়, ধরা পড়ে যে তারা পাগল।

সে যা হোক সামাজিকতার খাতিরে একদিন রমেশদাকে দেখতে গেলাম। বিজয়ার পরে যাওয়া হয়নি।

বাইরের ঘরে খাটে বসে রমেশদা খসখস করে কী সব লিখছেন একটা জলচৌকির ওপর কাগজ রেখে। খাটভর্তি তাড়া তাড়া কাগজ, গাদা গাদা বই। সেসব বইয়ের মধ্যে হিতোপদেশ, জাতকের গল্প থেকে শুরু করে এমনকী গতযুগের ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থাবলী মায় বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা অব্দি রয়েছে।

বিজয়ার বিলম্বিত প্রণাম ও কোলাকুলি সাঙ্গ হওয়ার পরে রমেশদা বললেন, খোকন, যখন বুঝতে পারলাম আগামী কয়েকমাসের মধ্যে, ওই সামনের বর্ষার আগে সশরীরে কোনও ব্যাঙ দেখার কোনও সম্ভাবনা নেই, তখন সারা দিন রাত যতক্ষণ সম্ভব টিভি দেখতে লাগলাম। দিল্লির মর্নিং প্রোগ্রাম, দুপুরের ইউ জি সি, সন্ধ্যায় ঢাকা, কলকাতা, এক নম্বর, দুই নম্বর চ্যানেল, দিল্লি ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক সব তন্নতন্ন করে দেখতে লাগলাম যদি কোথাও একটা ব্যাঙের দৃশ্যও দেখতে পাই।

এর মধ্যে অবশ্য একবার গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়েছিলাম। শুনেছিলাম সেখানে ব্যাঙের মাংস বিক্রি হয়, যদি মাংসে রূপান্তরিত হওয়ার আগে ব্যাঙের মরদেহটা দেখতে পাই এই আশায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনলাম, ব্যাঙের মাংসের কোনও চাহিদা নেই, মেনু থেকে ওই পদ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 আমি সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, এত যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দূরদর্শন পর্যবেক্ষণ করলেন, সংবাদের পর সংবাদ, সিরিয়ালের পর সিরিয়াল কোথাও কোনওদিন একটা ব্যাঙ নজরে এল না।

খুব গম্ভীর হয়ে রমেশদা বললেন, না। একেবারেই না।তারপর আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি নিজেই এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি।

রমেশদার আত্মপ্রত্যয় দেখে আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর প্রশ্ন করলাম, কী রকম?

এইবার মুচকি হেসে রমেশদা বললেন, টিভি দেখে দেখে সিরিয়াল করার ব্যাপারটা আমি ধরে ফেলেছি। আমি নিজেই একটা সিরিয়াল করছি, যুগে যুগে ব্যাঙ।

আমি প্রতিধ্বনি করলাম, যুগে যুগে ব্যাঙ!

রমেশদা বললেন, অবাক হচ্ছিস কেন? এই সব বই থেকে একেকটা স্টোরি নিচ্ছি। তেরোটা স্টোরি হবে। সাতটা করে ফেলেছি। হিতোপদেশের ধর্মপ্রাণ ব্যাঙ, কুয়ো আর সাগরের ব্যাঙ, ব্যাঙ জন্মে জাতক, ত্রৈলোক্যনাথের কঙ্কাবতীর হিট-মিট-ফ্যাট ব্যাঙ সাহেব এমনকী বুদ্ধদেব বসুর ব্যাঙের কবিতাটা নিয়ে একটা বাইশ মিনিটের চিত্রনাট্য লিখে ফেলেছি।

তারপর একটু দম নিয়ে রমেশদা আমাকে বললেন, শুনবি একটু?

আমি অথৈ জলে পড়তে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রমেশদাই রক্ষা করলেন, বোধহয় একটু মায়া হল আমার ওপর, বললেন, না থাক। তোরও সময় নষ্ট হবে, আমারও সময় নষ্ট হবে। পর্দায় তো দেখতে পাবিই। এই বর্ষাতেই শুটিং শুরু করব। ভাবছি যদি ভিসা পাসপোর্ট করে উঠতে পারি বাংলাদেশে কুষ্টিয়ায় গিয়ে হরিনাথপুর গাঁয়ে শুটিং করতে যাব। বাবা, কত রকম ব্যাঙ যে সেখানে দেখেছিলাম ছোটবেলায়।

রমেশদাকে বাইরের ঘরে রেখে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম।

অনেকদিন পরে এসেছি, সকলের সঙ্গেই দেখা করে যাই।

রমেশদা আবার মন দিয়ে সিরিয়াল লেখায় হাত লাগালেন।

০৫. সংযোজন

বোঝাই যাচ্ছে, এই গল্প শেষ হতে এখনও অনেক বাকি। সে জন্যে অন্তত আগামী বর্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা। করতে হবে।

শুধু আপাতত দাড়ি টানার আগে অনেকদিন আগের এক নাক-উঁচু কবির এক বহুবিখ্যাত, বহুপঠিত কবিতার শেষ পঙক্তিটি অকারণেই স্মরণ করছি,

Not with a bang but whimper.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *