বিবি এগারো বারো

বিবি এগারো বারো

বি বি ওয়ান ওয়ান ওয়ান টু

সাদাত কলেজ করটিয়ার প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খান সাহেব খুব কড়া অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁরই আমলে সাদাত কলেজ ফাস্ট গ্রেড কলেজে উন্নীত হয়।

ফার্স্ট গ্রেড কলেজ মানে বি. এ ক্লাস পর্যন্ত। তার আগে সাদাত কলেজে আই. এ. পর্যন্ত পড়ানো হত। তখন কলকাতা ছাড়া সারা বঙ্গপ্রদেশে বি. এ. পর্যন্ত পড়ার কলেজ সামান্য সংখ্যক ছিল, বলা যায় আঙুলে গোনা যেত।

কলেজ ফার্স্ট গ্রেড হওয়ার পর প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খান এম, এ, বি. এল আরও কড়াকড়ি শুরু করলেন। বি. এ. পরীক্ষার আগে প্রিটেস্টে আর টেস্টে যারা সব বিষয়ে পাশ করেনি তাদের তিনি ফাঁইনাল পরীক্ষার জন্যে নির্বাচন করতেন না। তার বক্তব্য ছিল, বি. এ. পরীক্ষা ছেলেখেলা নয়, এই পরীক্ষা প্রথম দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, এই পরীক্ষা পাশ করলে গ্র্যাজুয়েট হয়, এই পরীক্ষার মান রক্ষা করতে হবে, যারা পরীক্ষা দিতে বসবে তারা যেন পরীক্ষার যোগ্য হয়।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের এই রকম কড়াকড়ির যুগে মীরের বেতকা গ্রামের বকর ভাই, আবু বকর চৌধুরী পর পর তিনবার বি. এ পরীক্ষার টেস্টে ডিসঅ্যালাউ হলেন এবং অবশেষে লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন।

বকর ভাই আমার কাকার সঙ্গে স্কুলে সহপাঠী ছিলেন। সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কাকা ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকা জগন্নাথ কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন। বকর ভাই করটিয়ায় সাদাত কলেজে।

বি. এ পরীক্ষায় বসতে না পারার দুঃখে বকর ভাই বাড়ি ছাড়লেন, কলকাতায় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে চলে এলেন ব্যবসা করতে, বিভিন্ন সরকারি অফিসে কী সব টুকটাক জিনিসপত্র সাপ্লাই করতেন। যুদ্ধের বাজারে হঠাৎ বড়লোক হয়ে উঠলেন বকর ভাই, কলকাতায় ক্লাইভ স্ট্রিটে নিজের আলাদা অফিস করলেন, মীরের বেতকায় গ্রামের বাড়িতে দোতলা পাকা দালান বানালেন, পুকুরের ঘাট বাঁধালেন, আটিয়ার পুরনো মসজিদ একবার নিজের পয়সায় আগাগোড়া চুনকাম করিয়ে দিলেন।

ক্লাইভ স্ট্রিটে যে অফিস করেছিলেন বকর ভাই তার নাম দিয়েছিলেন এ-বি-সি সাপ্লায়ার্স। এ-বি-সি হল আবু বকর চৌধুরীর নামের আদ্যক্ষর সমষ্টি।

ব্যবসা ভালই চলছিল বকর কাকার কিন্তু এর মধ্যে যুদ্ধ শেষ হল, ছেচল্লিশের ষোলোই আগস্টের দাঙ্গায় কলকাতা তছনছ হয়ে গেল, স্বাধীনতা এল, দেশ ভাগ হল, আমাদের দিকের দেশটা পাকিস্তান হয়ে গেল, কিন্তু বকর ভাই কলকাতায় রয়ে গেলেন। তার এ-বি-সি সাপ্লায়ার্স তখন আর তেমন চলছে। তবু অফিসটা ছিল, মাঝেমধ্যে ছুটিছাটায় বাড়ি যেতেন বকর ভাই, বাকি সময় কলকাতাতেই অফিস আগলাতেন। থাকতেন পার্কসার্কাসে, সেখান থেকে ট্রামে ডালহৌসি হয়ে ক্লাইভ স্ট্রিটের অফিস।

ততদিনে আমরাও অনেকেই কলকাতায় চলে এসেছি। বকর ভাই আমার কাকার বন্ধু ছিলেন, গ্রাম সুবাদে তাকে আমাদের বকর চাচা বলা উচিত, কিন্তু আর সকলে বকর ভাই ডাকত বলে আমরাও তাই ডাকতাম। সে যা হোক, বকর ভাই প্রায় নিয়মিতই আমাদের পুরনো কালীঘাটের বাড়িতে আসতেন।

বকর ভাইয়ের ওই এ-বি-সি সাপ্লায়ার্সের অফিসে একটা ফোন ছিল। তখন ঘরে ঘরে ফোনের এত ছড়াছড়ি ছিল না, একটা পাড়ায় দু-চারটে বাড়ির খোঁজ করলে ফোন দেখা যেত, এমনকী সব অফিসেও ফোন ছিল না।

বকর ভাইয়ের অফিসের ফোন নম্বর ছিল বড়বাজার এক হাজার একশো বারো, সংক্ষেপে ইংরেজিতে বি বি ওয়ান ওয়ান ওয়ান টু ( বি বি ১১১২)। তখনও এখনকার মতো অটোমেটিক ফোন। চালু হয়নি। ফোন তুলে এক্সচেঞ্জে নম্বর চাইতে হত।

ব্যবসাপত্র কলকাতায় ভাল চলছিল না। দিনকালও ভাল নয়। অবশেষে বকর ভাই ঠিক করলেন ব্যবসাপত্র গুটিয়ে দেশে ফিরে যাবেন।

চলে যাওয়ার আগের দিন আমাদের বাসায় এলেন হাতে একটা ভারী রেশনব্যাগ। অল্পবিস্তর কথাবার্তার পর ব্যাগের ভিতর থেকে বার করলেন একটা টেলিফোনের রিসিভার, কষ্টিপাথরের মতো কালো কুচকুচে সে একটা প্রমাণ সাইজের টেলিফোন যন্ত্র। আজকালকারগুলোর মতো খেলনা জিনিস নয়। রীতিমতো ভারী অন্তত দেড়সের, দুসের ওজন হবে। তার সঙ্গে কয়েক হাত লম্বা তার রয়েছে, সে তারও এক আঙুল মোটা, আজকালের তারের মতো ফিনফিনে নয়।

ফোনটার কথা বলার জায়গায় বেশ চওড়া করে ছড়ানো একটা চোঙার মতো জিনিস রয়েছে। কানে দেওয়ার জায়গাটাও বেশ বড়।

বকর ভাই বললেন, এ জিনিস আর একালে পাওয়া যাবে না। আসল বেল কোম্পানির সাবেকি জিনিস। অফিসের ফোনটা কাল থেকে কাটিয়ে দিয়েছি কিন্তু কোম্পানি থেকে এসে রিসিভারটা নিয়ে গেল না। এটা আর দেশে নিয়ে গিয়ে কী কাজ হবে। বর্ডারে কাস্টমসেও ধরতে পারে। তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি। যদি কখনও ফিরে আসি, ফেরত নিতেও পারি, না হলে তোমাদেরই থাকবে।

ফোনটা রেখে বকর ভাই দেশে চলে গেলেন। পরে দেশ থেকে তার একটা সংক্ষিপ্ত পৌঁছ সংবাদ এসেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি। বকর ভাই চলে যেতে আমরা ভাল করে ফোনটা দেখলাম। সাদা কাগজ এঁটে কালো ফোনটার গায়ে লাগানো, তাতে লেখা,

ABC Suppliers
BB 1112

সেই থেকে বি বি এক এক এক দুই আমাদের সঙ্গে রয়ে গেল। বি বি মানে বড়বাজার, বড়বাজার এক্সচেঞ্জ, এখন যেমন ফোর ফাইভ ডবল টু তখন ছিল বড়বাজার, পার্ক সার্কাস এই রকম এক্সচেঞ্জের নাম ফোন নম্বরে। মাথা গোঁজার তাগিদে এই পোড়া বিদেশি শহরে বাক্স বিছানা ঘাড়ে করে কত যে ঘুরপাক খেলাম। বি বি এক এক এক দুই কিন্তু তদবধি আমাদের সঙ্গে রয়ে গেল।

ফোনের লাইন নেই, কানেকশন নেই শুধু একটা জলজ্যান্ত রিসিভার আমাদের বাড়িতে বাইরের ঘরে এ জিনিস দেখে অনেকে বিস্মিত হত। কেউ কেউ ভুল করে ফোন করতে গিয়ে জব্দও হয়েছে।

তবে এ জাতীয় ব্যাপার আমাদের বাড়িতে ঘটে থাকে। আমার দাদা একবার রেডিয়োর এরিয়েল জলের দরে পেয়ে কিনে এনেছিল তখন আমাদের কোনও রেডিয়ো নেই। বিজন আমার ছোট ভাই, চাঁদনি চক থেকে একটা অ্যান্টেনা কিনে আনল কারণ সেটা তার সামর্থ্যের মধ্যে, আর কিনে আনল এই আশায় যে আমি যদি টিভিটা কিনি, অ্যান্টেনা ব্যবহার করার জন্যেই কিনব। এরও পরে আমার স্ত্রী মিনতি গ্যাসের উনুন কিনেছিলেন গ্যাসের সিলিন্ডার আসার ঢের আগে।

ঘোড়ার আগে লাগাম জোগাড় করে পরে সেই লাগামের জন্যে ঘোড়ার পিছনে আমরা অনেক ছুটেছি। সুতরাং টেলিফোনের রিসিভারটার জন্যে এক সময় একটা কানেকশনের দরখাস্ত আমাদের করতে হল।

ততদিনে বি বি এক এক এক দুই আমাদের সংসারে, দেবত্ব অর্জন করেছে। কষ্টি পাথরের মতো, শালগ্রাম শিলা কিংবা শিবলিঙ্গের মতো কালো কুচকুচে বলেই তোক বা অন্য কারণেই হোক আমার পিসিমা তার অন্যান্য তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সঙ্গে জুড়ে দেন বি বি এক এক এক দুই। পিসিমা বলতেন বিবি এগারো বারো। তিথিপর্বে সিঁদুর, চন্দনের ফোঁটা পরানো হত, ফুল বেলপাতাও দেয়া হত বিবিকে। শেষের দিকে দেখেছি ছোট স্টেনলেস স্টিলের থালায় বাতাসা বা নকুলদানাও রাখা হত। পিসিমা বলতেন, বি বি এগারো বারো খুব জাগ্রত।

আমরা বলতাম, এখনও জাগ্রত নয়, তবে জাগ্রত করার চেষ্টা চলছে, অর্থাৎ কানেকশন আনার চেষ্টা হচ্ছে।

কিন্তু আমাদের গোড়ায় গলদ হয়েছিল। আমরা কেউ খেয়ালই করিনি যে এই আদ্যিকালের ভারী টেলিফোনটা এই অটোমেটিকের যুগে চলবে না। এই টেলিফোনে ডায়াল করার কোনও ব্যাপার নেই।

অবশেষে একদিন সর্বনাশটা ঘটল। আমরা কেউ বাসায় নেই, সেদিন উলটো রথ না কি যেন, পিসিমা গেছেন কালীঘাট মন্দিরে, এই রকম একটা দুপুরবেলায় টেলিফোনের লোকেরা এসে কানেকশন দিয়ে গেল আমাদের বাড়িতে।

তখন বাসায় একা কাজের লোক ছিল। তাকে আগেই ভাল করে বুঝিয়ে বলা ছিল যে বাইরের ঘরের টেবিলে বিবি এগারো বারোর পাশেই নতুন টেলিফোনটা বসবে। কারণ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে দুপুরবেলায় যখন আমরা কাজেকর্মে বাড়ির বাইরে থাকব তখনই কানেকশন দিতে, লাইন বসাতে টেলিফোন অফিসের লোক আসবে। তাই আসে।

কিন্তু আমরা ভাবতে পারিনি যে পিসিমাও বাড়িতে থাকবেন না। পিসিমা বাড়িতে থাকলে তার আরাধ্য দেবতা বিবি এগারো বারো আমাদের হাতছাড়া হত না, হাতছাড়া হওয়া সম্ভব ছিল না।

০২. ফোর এইট ওয়ান ওয়ান ওয়ান টু

আটচল্লিশ এগারো বারোর বৃত্তান্ত আরম্ভ করার আগে বিবি এগারো বারো কী করে আমাদের হাতছাড়া হয়েছিল সে কথা অবশ্যই বলতে হবে। আসলে দুটো একই ব্যাপার।

সেই উলটোরথ নাকি ঝুলন পূর্ণিমা তা সে যাই হোক না কেন, এক ঝিরিঝির বরষার পুণ্য দিবসে টেলিফোন কোম্পানির লোকেরা আমাদের কালীঘাটের বাড়িতে টেলিফোন বসিয়ে গেল।

আমাদের বহুকালের অভিভাবিকা পুরনো কাজের লোক কুড়ানির মা তখন আমাদের দেখাশোনা করত। সে দেশ থেকে আমাদের কাছে এসেছিল, আমাদের কাছেই আমৃত্যু ছিল। তার কেউ ছিল কি না তার কোনও খবর আমরা রাখতাম না, সেও বোধহয় রাখত না। তার মৃত্যুর পরে কেওড়াতলা শ্মশানে দাদা তার মুখাগ্নি করেছিল।

কুড়ানির মার কথা কবে যেন অন্য কোথায় লিখেছিলাম এখানে শুধু একটা কথা বলে রাখি। কুড়ানির মার আসল নাম ছিল কুড়ানি, শুধুই কুড়ানি। কিন্তু বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে এত তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায় যে স্বাভাবিক ভাবেই আমরা তাকে কুড়ানির মা বলে ডাকতে থাকি এবং সেও এতে মোটেই আপত্তি করেনি। শুধু একবার বলেছিল, আমি আবার মা ছিলাম কোন জন্মে?

 কুড়ানির মা আমাদের সব জিনিসপত্র এমনকী স্মৃতি আগলে রাখত। হঠাৎ হঠাৎ বলে বসত, আজ তো বৈশাখ মাসের প্রথম রবিবার, আজ বিকেলে তো হরিপাগলার মেলা। কোথাকার কে হরিপাগলা, কবেকার এক গেঁয়ো মফসসল শহরের উপান্তে তার নামে মেলা বসত বাংলা সনের প্রথম রবিবারে, কুড়ানির মা ছাড়া সেসব স্মৃতি কেই বা মনে রেখেছিল?

কুড়ানির মা ছাড়া কেই বা দীপান্বিতা শ্যামাপুজোর আগের ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় হঠাৎ প্রদীপের সলতেগুলোয় বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে বলে উঠত, এই সন্ধ্যায় বড়বাবা স্বর্গে গিয়েছিল,বড়বাবা মানে আমাদের ঠাকুরদা।

আমাদের মা বাবা তখন দেশে রয়েছেন, আমরা পিসিমার সঙ্গে কলকাতায়, কুড়ানির মা-ও দেশ থেকে এসেছে। সেও ছোটবেলা থেকেই আমাদের দেখছে।

এতদিন পরে মনে হয় আমাদের অভিভাবকত্ব নিয়ে আমাদের ভালমন্দ দেখাশোনার ব্যাপারে পিসিমার সঙ্গে বুঝি তাঁর অদৃশ্য একটা রেষারেষি ছিল।

সে যা হোক। একটা ব্যাপার খুবই পরিষ্কার ছিল যে পিসিমার বিবি এগারো বারো ওরফে বিবি ওয়ান ওয়ান ওয়ান টু-কে সে একদম সমীহ করত না, তার দেবত্বে বিশ্বাস করত না। মোট কথা বি বি এগারো বারোর প্রতি তার কোনও ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল না।

 আমাদের বাড়িতে যেদিন টেলিফোন এল সেদিন দুপুরে শূন্যবাড়িতে কী হয়েছিল জানি না, কিন্তু সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এসে দেখি পিসিমা খুব চেঁচামেচি করছেন।

কুড়ানির মাকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, দুপুরে ফোনের লোকেরা এসে নতুন ফোন বসিয়ে দিয়ে পুরনো ফোন নিয়ে চলে গেছে।

 পিসিমা কালীমন্দির থেকে ফিরে আসার পরে সে এসব কথা পিসিমাকে কিছুই বলেনি, বলার প্রয়োজন বোধ করেনি, এখন সন্ধ্যাবেলায়, এই একটু আগে পিসিমা আরতি দিতে গিয়ে দেখেন বিবি এগারো বারো নেই, তার জায়গায় একটা তন্বী, আধুনিকা, ছিমছাম নতুন যুগের দূরভাষ যন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আমরাও ব্যাপারটায় খুব চটে গেলাম। নতুন ফোনের জন্যে টাকা দিয়েছি, নতুন ফোন আসবে, ঠিক কথা, কিন্তু সেই জন্যে পুরনো ফোনটা, যেটার কোনও কানেকশন নেই, যেটা টেলিফোন কোম্পানি আমাদের দেয়নি, সেটা টেলিফোনের লোকেরা নিয়ে যাবে কেন?

আমরা ঠিক করলাম পরদিন টেলিফোন অফিসে গিয়ে বিবি এগারো বারোকে উদ্ধার করব। কিন্তু পিসিমা তাতে রাজি হলেন না, বললেন, বিবি এগারো বারো নাম আর মুখে এনোনা। ওটা এঁটো হয়ে গেছে, ওটাকে আর ঘরে আনা যাবে না।

ব্যাপারটা আমরা ভাল বুঝলাম না। পিসিমা বললেন, দেবতা অপবিত্র হয়ে গেলে বিসর্জন দিতে হয়। ওটাকে উদ্ধার করে আমরা যেন গঙ্গায় ফেলে দিই।

গোলমালে বাড়িতে নতুন ফোন আসার আনন্দটাই মাটি হতে বসেছিল। আমরা এবার নতুন ফোনটাকে দেখতে লাগলাম। রিসিভারটা তুলে দেখলাম ডায়াল টোন নেই, মৃত। তার মানে রিসিভারটা দিয়ে গেছে এখন কানেকশন দেয়নি।

ফোনটার গায়ে একটা টিকেট ঝোলানো আছে, দেখা গেল তাতে ফোনের নম্বরটা লেখা রয়েছে। সেটা পড়েই দাদা চেঁচিয়ে উঠল, কী আশ্চর্য, এটাও এগারো বারো দেখছি।

অবাক হয়ে আমরা সবাই উঁকি দিয়ে দেখলাম টিকিটের গায়ে ফোনের নম্বর দেয়া রয়েছে ৪৮ ১১১২, ফোর এইট ওয়ান ওয়ান ওয়ান টু।

আশ্চর্য মিল, অসম্ভব যোগাযোগ। এবং তখনই আমরা বুঝতে পারলাম নম্বরের এই সাদৃশ্যের জন্যেই পুরনো ফোনের বদলে নতুন ফোন আসছে, এই কথা ভেবেই টেলিফোন অফিসের লোকেরা পুরনো বাতিল ফোনযন্ত্রটা অর্থাৎ আমাদের বিবি এগারো বারোকে নিয়ে গেছে। তার বদলে বসিয়ে দিয়ে গেছে আটচল্লিশ এগারো বারো।

এর পরে আমরা প্রায় প্রতিদিন টেলিফোন অফিসে যাতায়াত করলাম। দুটো কারণ, (এক) বিবি এগারো বারোকে উদ্ধার করার জন্যে, (দুই) আটচল্লিশ এগারো বারোয় প্রাণ সঞ্চার করার জন্যে।

দুটোর কোনওটারই কিন্তু কোনও সুরাহা হল না।

বিবি এগারো বারো গুদামে জমা পড়ে গিয়েছিল। অনেকগুলো গুদাম ঘর তার মধ্যে শত শত মৃত টেলিফোনের শবদেহ, বর্তমানে বা ভবিষ্যতে সেগুলো কার কী কাজে লাগবে সেটা কেউই জানে না।

দু-চারদিন চেষ্টা করার পরই বোঝা গেল গুদাম থেকে বিবি এগারো বারোকে পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব। তা ছাড়া টেলিফোন অফিসের কাউন্টারের দিদিমণি ইতিমধ্যে নানারকম বিপজ্জনক প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন।

আমাদের কানেকশন ছিল না তবু রিসিভার পেলাম কোথা থেকে, ওই বাতিল পুরনো রিসিভার আমাদের কী কাজে লাগবে, রিসিভারটার নম্বর মিলিয়ে দেখতে হবে ওটা চোরাই রিসিভার কি না। এই সব খারাপ প্রশ্ন।

আমি তখন অল্প কিছুদিন ল কলেজে যাতায়াত আরম্ভ করেছি। ফৌজদারি দণ্ডবিধির রিসিভার অফ স্টোলেন প্রপার্টিস কথাটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। রিসিভার অফ স্টোলেন রিসিভার হলে কী হতে পারে, ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলাম। বিবি এগারো বারোর আশা ছেড়ে দিলাম।

কিন্তু আটচল্লিশ এগারো বারো, ওই ফোর এইট ওয়ান ওয়ান ওয়ান টু ফোনটাও চালু হল না। প্রত্যেক দিনই শুনি পরের দিনই কানেকশন পাওয়া যাবে। বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমে কেবল ডুবে গিয়েছে, জল শুকোলেই লাইন ঠিক হবে। যার লাইন দেয়ার কথা, সেই যন্ত্রীর চিকেন পক্স হয়েছে। অথবা, তিনি শ্রীরামপুর থেকে আসেন এখন রেল অবরোধ চলছে বলে আসতে পারছেন না।

একেকদিন একেকসময় একেকরকম অজুহাত। অনেক সময় বিরক্তি ও উষ্মা প্রকাশ।

 আমরা প্রায় হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম।

হঠাৎই চার সপ্তাহের মাথায় একদিন সকাল আটটা বত্রিশ মিনিট একুশ সেকেন্ডে, সময়টা আমরা ডায়েরিতে নোট করে রাখি টেলিফোন কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্যে, টেলিফোনটা পরপর তিনবার টিং টিং করে বেজে উঠল। হইচই পড়ে গেল আমাদের বাড়িতে, কিন্তু ফোনটা তুলে কোনও ডায়ালটোন পাওয়া গেল না।

এর পরেও কিছুক্ষণ পরপর ওই রকম তিনবার টিং টিং হতে লাগল। আমরা বিশদ বিবরণ এবং সময়-টময় জানিয়ে টেলিফোন অফিসে চিঠি দিলাম।

দিন পনেরো পরে টেলিফোন দপ্তর থেকে জানা গেল আমাদের রিসিভারটা খারাপ হয়ে গেছে ওটা বদলাতে হবে।

রিসিভারটা ভালই বা ছিল কবে যে খারাপ হয়ে গেল, তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কী করে খারাপ রিসিভারের কথাটা জানাজানি হয়ে গেল। দলে দলে লোক টেলিফোন কোম্পানি থেকে আসছি বলে আমাদের বাড়িতে এসে কড়া নাড়তে লাগল এবং লোভনীয় সব রঙের রিসিভার দেখাতে লাগল, মাত্র একশো টাকার বিনিময়েই যেকোনও একটা পাওয়া যাবে।

আমরা বেছে বুছে একটা হালকা গোলাপি রঙের ফোন পছন্দ করলাম। কিন্তু অসুবিধে হল পিসিমাকে নিয়ে, বর্তমান আটচল্লিশ এগারো বারোর আরাধনা ইতিমধ্যেই পিসিমা শুরু করে দিয়েছেন। সেই ফুল, বেলপাতা, চন্দন, সিঁদুর, বাতাসা নকুলদানার প্রসাদ সবই চলছে।

পিসিমাকে অনেক কষ্টে বোঝানো হল, এটাও আটচল্লিশ এগারো বারো, শুধু রংটাই যা আলাদা।

গোলাপি টেলিফোনটা বসল আমাদের বাড়িতে এবং একটু উন্নতিও দেখা গেল।

না। ডায়াল টোন নয়। শুধু টিংটিং শব্দ বেরোতে লাগল। আগের মতো কিছুক্ষণ পরপর তিনবার টিংটিং নয়। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা সারা রাত শুধু টিংটিং, টিংটিং।

প্রথমে মৃদুভাবেই আরম্ভ হয়েছিল ওই টিংটিং ধ্বনি, কিন্তু ক্রমশ সেটা উচ্চ থেকে উচ্চতর গ্রামে উঠতে লাগল। দু-চারদিন পরে আমরা বুঝতে পারলাম টেলিফোনটা রিসিভার থেকে তুলে নামিয়ে রাখলে আর টিং টিং করে না।

আমাদের পিসিমা কিন্তু সুযোগটার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন। সন্ধ্যারতির পর খঞ্জনি বাজিয়ে পিসিমা মিনিট পনেরো হরিবোল হরিবোল করতেন। বাঁ হাতে বাত হওয়ায় তখন খঞ্জনিটা বাজাতে কষ্ট হত।

গোলাপি টেলিফোনটা পিসিমার খঞ্জনি বাজানোর কষ্ট লাঘব করল। সন্ধ্যাবেলায় পনেরো মিনিটের জন্যে রিসিভারটা যুক্ত করে দেওয়া হত, সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার টিং-টিং শব্দ বেরোত আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পিসিমা হরিবোল হরিবোল সংকীর্তন করতে লাগলেন।

ভালই চলছিল ব্যাপারটা, হঠাৎ এর মধ্যে ফোন আসা আরম্ভ হল। টিং টিং নয় ওই টিং টিংয়ের মধ্যেই সত্যিকারের ফোন বাজার ক্রিং ক্রিং শব্দ।

প্রথম ফোনটা এল জাপান কিংবা মাদ্রাজ থেকে। লোকটা কী যে বলল কিছুই বুঝতে পারলাম না। ছুটে গিয়ে ফোনটা প্রথমে বিজন ধরেছিল, একটু পরে আমার হাতে দিয়ে বলল, কিছু বুঝতে পারছি না লোকটা জাপানি ভাষায় কথা বলছে। আমার কিন্তু ফোনটা ধরে মনে হল তামিল ভাষায় কথা বলছে, মাদ্রাজ কিংবা শ্রীলঙ্কা থেকে নিশ্চয়।

আরও নানা রকম ফোন শেষ রাতে, মধ্য রাতে, মধ্য দুপুরে আসতে লাগল। আমরা কিন্তু ফোন করতে পারতাম না, তবে ধরতাম।

দাদা বুঝতে পেরেছিল। দাদা বলল, এসব ফোন আসছে ইউনাইটেড নেশন থেকে। তোরা কেউ ধরবি না। আমার সঙ্গে পরামর্শ চাইছে।

ফোন বাজলেই দাদা ধরে ইংরেজিতে জবাব দিত, নো, নো, ফিলিপাইনসে আর গম নয়, ইয়েস ইয়েস পাকিস্তান তিনটে ছোট আণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছে, ইয়েস ইয়েস। সুইডিশ ব্যাঙ্ক, নো নো নো অ্যাকাউন্ট, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সবের পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা মোটেই বুঝতে পারিনি।

হঠাৎ একদিন খুব ভোরবেলায় আটচল্লিশ এগারো বারোর মধ্য থেকে সাইরেনের ভোঁও-ও শব্দে আমাদের সকলের ঘুম ভাঙল।

বাইরের ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি টেবিলের উপরে, টেলিফোনের রিসিভারটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নাচছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিসিভারটার দু প্রান্ত দিয়ে নীল ধোঁয়া বেরোতে লাগল, কী রকম একটা প্ল্যাস্টিক পোড়ার গন্ধ। তারপরে দুম করে একটা শব্দ হল। টেলিফোনটা ঘন নীল ধোঁয়ার মধ্যে আড়াল হয়ে গেল। সব জানলা খুলে দিলাম, কিছুক্ষণ পরে জানলা দিয়ে ওই নীল ধোঁয়া বেরিয়ে যেতে দেখি সব শূন্য, টেলিফোনটা নেই; মহাশূন্যে পরমব্রহ্মে লীন হয়ে গেছে।

 কিন্তু সম্পূর্ণ লীন বোধহয় হল না। সন্ধ্যাবেলায় পিসিমার সঙ্গে আমরাও স্পষ্ট খঞ্জনির ধ্বনি শুনতে পেতাম, পিসিমা তালে তালে হরিবোল গাইতেন।

বোধহয় টেলিফোনটা ভূত হয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে একটা টেলিফোনের ছায়া সারাদিন আমাদের বাড়িময় ঘুরে বেড়াত। কখনও অবিচ্ছিন্ন মৃদু টিং টিং শোনা যেত, কখনও অবিশ্বাস্য ক্রিং ক্রিং শুনে আমরা চমকে উঠতাম, অন্যমনস্কভাবে ফোনটা ধরতে যেতাম। ধরতে না পারলেও বেশ শুনতে পেতাম, হ্যালো, হ্যালো, কে যেন জাপানি না মাদ্রাজি ভাষায় কী বলছে।

আমরা বুঝতে পারতাম যে টেলিফোনটা আমাদের বাসাতেই রয়েছে, আমরাই শুধু সেটাকে দেখতে পাচ্ছি না।

কালীঘাটের বাড়ি থেকে আমরা বহুকাল চলে এসেছি। দাদা, কুড়ানির মা বিগত।

তবে পিসিমা আছেন। হঠাৎ কখনও কখনও বিবি এগারো বারোর কথা বলেন। তখনই আমাদের আটচল্লিশ এগারো বারোর ভৌতিক স্মৃতি মনে পড়ে। ভয়ে গা শিউরে ওঠে।

জানিনা কালীঘাটের সে বাসায় এখন কারা আছে, আটচল্লিশ এগারো বারোর বিদেহী আত্মা এখনও সে বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় কি না তাও জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *