পটললাল ও মিস জুলেখা

পটললাল ও মিস জুলেখা

ভূমিকা

বহুবিবাহ এখন আর রীতিসম্মত নয়। সমাজে এমন অনেক পুরুষ, এমনকী মহিলাও আছেন যাঁরা জীবনে বেশ কয়েকবার বিয়ে করেছেন। কিন্তু একসঙ্গে একাধিক স্বামী বা স্ত্রী থাকা আইনসিদ্ধ নয়। এখন বিয়ের পরে প্রতিটি বিয়ের আগেই পূর্ববর্তী বিয়ের আইনত বিচ্ছেদ না করে নতুন বিয়ে আইনের চোখে অসিদ্ধ।

তবে হলিউডের এক অভিনেত্রীর কথা শোনা যায়, তার এতবার বিয়ে হয়েছে ও বিয়ে ভেঙেছে যে তার হিসেব মিলছে না, দেখা যাচ্ছে যে তিনি যতবার বিয়ে করেছেন তার চেয়ে একবার বেশি ডিভোর্স করে বসে আছেন।

পটলাল ও মিস জুলেখার এই রহস্য কাহিনিও বহুবিবাহ জড়িত। তবে কোনও পরিচিত বা অপরিচিত স্ত্রী বা পুরুষ কাউকেই আহত করা এই কাল্পনিক গল্পের উদ্দেশ্য নয়। কয়েকটি চরিত্র বেছে নিয়েছি। নেহাতই রচনার প্রয়োজনে, বাস্তব জীবনের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। কোনও চরিত্রই কোনও জীবিত বা মৃত ব্যক্তির ছায়াবলম্বনে গঠিত নয়।

০১. নকুল শুকুল ওরফে ডা. সহদেব শুক

আজ কয়েকদিন হল ভয়াবহ গরম পড়েছে। কলকাতায় এত গরম বহুকাল পড়েনি। বৈশাখের শেষদিকে অল্প বৃষ্টি হয়েছিল। পুরো জ্যৈষ্ঠ মাসটা খা-খা গনগন করে জ্বলছে। আবহাওয়া দপ্তর বলছে বৃষ্টি নামতে এবার আষাঢ় মাস এসে যাবে।

এই গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে মর্মান্তিক লোডশেডিং। তবে লোডশেডিংয়ে ডাক্তার সহদেব শুকের খুব অসুবিধে হয় না। তার নিজের ভাল ইনভারটার আছে। রাতে ঘুমের মধ্যে যদি লোডশেডিং হয়ে যায় পাখা ঠিক মতোই ঘুরতে থাকে, সহদেব টেরও পান না।

কিন্তু পাখা ঘুরলেই তো হল না, পাখার বাতাসে এই গরমে আর সেই স্বস্তি নেই। শেষরাতের দিকে পাখার বাতাস পর্যন্ত গরম হয়ে যায়।

সারা শরীর ঘামে ভেজা। বিছানায় চাদর প্যাঁচ প্যাঁচ করছে। ঘুম থেকে উঠে পাখাটা বন্ধ করে দিয়ে একটু জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ান সহদেব। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় একটু আরাম লাগে। তারপর বাথরুম-টাথরুম সাঙ্গ করে শর্টস আর রঙিন গেঞ্জি পরে তিনি ময়দানের দিকে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন।

কড়েয়া রোডের এই বাড়িতে সহদেব একাই থাকেন, বাড়ির লোকেরা মেদিনীপুরের ভবগ্রামে দেশের বাড়িতে। এতে সুবিধেই হয়। ডাক্তার সহদেব শুক একজন প্রতিষ্ঠিত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারই শুধু নন, কৃতবিদ্য গোয়েন্দা। তবে খুন, ডাকাতি, মারামারির গোয়েন্দাগিরি মোটেই পছন্দ নয় সহদেববাবুর। রক্ত দেখলে তার মাথা ঝিমঝিম করে। তিনি জাল-জোচ্চুরি, অপহরণ, কিডন্যাপিং ইত্যাদির তদন্তে পারদর্শী।

কড়েয়া রোড থেকে ময়দান কাছে নয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত যাতায়াতে প্রায় চার মাইল হয়ে যায়। বেকবাগান দিয়ে বেরিয়ে জগদীশচন্দ্র বসু রোড ধরে থিয়েটার রোড বরাবর হেঁটে যান সহদেব। এটাই তার সারাদিনের ব্যায়াম, মর্নিং ওয়াক।

আজ একটু আগেই উঠে পড়েছেন সহদেববাবু। সারারাত তার ভাল করে ঘুম হয়নি। গতকাল বিকেলেই একটা নতুন কেস এসেছে তাতে, খুবই জটিল আর রহস্যময় কেস, বাংলা থিয়েটারের উদীয়মানা ক্যাবারে নর্তকী মিস জুলেখার স্বামী পটললাল পালকে কে বা কারা পরশুদিন রাতে চুরি করে নিয়ে গেছে। তবে পটললালকে সত্যিই অপরহণ করা হয়েছে না তিনি নিজেই পালিয়েছেন, সে বিষয়ে ডাক্তার সহদেবের মনে বেশ খটকা আছে।

এই খটকাই এই অন্তর্ধান কাহিনির চারপাশে একটা রহস্যের বেড়াজাল ছড়িয়েছে। আর তাই ভাবতে ভাবতে রাতের ঘুম চটে গিয়েছিল সহদেববাবুর।

.

ডাক্তার সহদেব শুকের পূর্বনাম নকুল শুকুল।

নকুল নামটি তেমন অপ্রচলিত কিছু নয়। আমাদের আশপাশে নকুল নামের লোক অনেক সময়েই দেখা যায়। ভবানীপুরের পাড়ায় একসময় একই রাস্তায় দুই নকুল ছিল, যার জন্যে একজনকে বলা হত অহিনকুল আর অন্যজনকে বলা হত মহীনকুল।

সেইরকম শুকুল পদবিটিও তেমন অচেনা কিছু নয়। শুকুল পদবিধারী লোকের সংখ্যা কিছু কম নয়।

কিন্তু দুইয়ে মিলে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। নকুল শুকুল নামটি হয়তো অনুপ্রাসের জন্যেই হাস্যকর মনে হয়।

ব্যাপারটা সহদেববাবু টের পেয়েছিলেন কলকাতায় ডাক্তারি করতে এসে। তারপরে যখন শখের গোয়েন্দাগিরি আরম্ভ করলেন, স্পষ্টই অনুভব করলেন এই নকুল শুকুল নামে চলবে না।

এই প্রসঙ্গে দুয়েকটা প্রাচীন কথা বলতে হয়। সহদেববাবুর বাবা জগন্নাথ শুকুল তাদের ভবগ্রামের শখের যাত্রাদলের সভাপতি ছিলেন। নিজে পালাকার ছিলেন, অর্থাৎ যাত্রার নাটক লিখতেন, তা ছাড়া নিজে অভিনয়ও করতেন। পরিষ্কারভাবে বলা উচিত জগন্নাথবাবু যাত্রাপাগল ছিলেন।

বহু খেটে তিনি একটা যাত্রাপালা লিখেছিলেন, মহাভারতের কাহিনি নিয়ে। সেই কাহিনির নাম ছিল, আমি কৌরব, আমিই পাণ্ডব আজকালকার দিনে ওইরকম একটা পালা লিখলে তিনি খ্যাতি ও অর্থ দুই-ই পেতেন, অনায়াসেই পেতেন।

গ্রাম্য যাত্রাকার জগন্নাথবাবুর সেরকম সৌভাগ্য অবশ্য হয়নি কিন্তু মহাভারত নিয়ে পালা লিখে মহাভারতের কাহিনিতে তার হৃদয় ও মন নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল।

ওই আমি কৌরব, আমিই পাণ্ডব নামক তার স্বরচিত পালায় তিনি পাণ্ডুরাজার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। কেমন অভিনয় করতেন তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই কিন্তু আসল কথা হল তিনি নিজের বাস্তব জীবনেও পাণ্ডুরাজা বনে গেলেন।

পরপর চারটি পুত্রসন্তান জন্মেছিল জগন্নাথবাবুর স্ত্রীর গর্ভে। তাদের নামকরণ হল যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন এবং নকুল।

প্রথমে তিনটি সন্তান জন্মানো পর্যন্ত তিনি তাঁর স্ত্রীকে কুন্তী বলে ডাকতেন, চতুর্থ সন্তান নকুল জন্মানোর পর তিনি সেই স্ত্রীকে মাদ্রী বলে ডাকা শুরু করলেন। মধ্যে একবার জগন্নাথবাবুর মাথায় এমন বুদ্ধিও ঢুকে গিয়েছিল যে তিনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহণ করবেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম দেবেন মাদ্রী, এমন মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু তার সে স্বপ্ন সফল হয়নি। প্রথমা স্ত্রী, মানে সহদেববাবুর মাকে তিনি অসম্ভব ভয় পেতেন, অপরিসীম নির্যাতনের ভয়ে তিনি পরেরবার বিয়ে করতে এগোননি, এগোতে সাহস পাননি। ফলে বাধ্য হয়েই একই স্ত্রীকে প্রথমে কুন্তী এবং পরে মাদ্রী বলে সম্বোধন করতেন।

কিন্তু এর চেয়েও খারাপ ব্যাপার ঘটল।

জগন্নাথবাবু পঞ্চম পুত্র জন্মানোর আগেই একদিন মধ্যরাতে আমি কৌরব, আমিই পাণ্ডব যাত্রাপালায় তৃতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে দেহরক্ষা করলেন। মাদ্রীর মৃত্যুর পরে তাঁর নিজের বুকে দুবার করাঘাত করার কথা ছিল, তিনি নিজেই এই নির্দেশ রচনা করেছিলেন তার পালায়।

কিন্তু সেদিন উত্তেজনাবশত তিনি ছাব্বিশবার বুকে করাঘাত করেছিলেন, এবং সেটাই তার মৃত্যুর কারণ হয়। ওই সময়ে তার স্ত্রীর সন্তান-সম্ভাবনা না থাকায় সহদেবের আর জন্মগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

পরিণত বয়সে নকুল শুকুল যখন যথাক্রমে ডাক্তারি ও গোয়েন্দাগিরি শুরু করলেন, তিনি ভেবে দেখলেন যে নাম বদলানো অবশ্যই জরুরি। এ কথাটা তার মাথায় এল যে তারা পাঁচ পাণ্ডব না হয়ে চার পাণ্ডব হয়েছেন, পঞ্চম পাণ্ডব যার হওয়ার কথা ছিল সে হল সহদেব, তার যমজ ভ্রাতা হয়ে যার জন্মানো উচিত ছিল। যমজ মানে একই লোক প্রায় বলা যায়, সুতরাং যে নকুল সেই সহদেব হতে পারে।

এইরকম জটিল চিন্তার পরিণতি দাঁড়াল যে নকুল ভাবতে লাগলেন আমার নামও তো সহদেব হতে পারত, আমি কেন সহদেব হব না। সহদেব নামটা ভালই, তা ছাড়া নকুল শুকুলের অন্ত্যমিল থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়।

এই সময়ে চারদিকে আদালতে এফিডেভিট করে নাম-পদবি বদলানোর ধূম চলছে। খবরের কাগজের পাতায় সারি সারি নাম পদবি বদলের বিজ্ঞপ্তি। ব্যারাকপুরের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে এফিডেভিট করে ভ্যাবল চোংদার শ্রীযুক্ত উত্তমকুমার হয়েছেন। আলিপুর আদালতে হলফনামা করা হয়েছে যে, আমি শ্যামশুল হক আজ হইতে নজরুল ইসলাম হইলাম।

কেউ কেউ নিজের নামই শুধু নয়, বাবার নাম পর্যন্ত পালটিয়ে দিয়েছে, দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, আমি খগারাম চট্টরাজ পিতা নগারাম চট্টরাজ সাকিন বাসুদেবপুর, ডাকঘর বাসুদেবপুর ব্যাঙ্কশাল কোর্টের এফিডেভিডবলে খগেন চট্টোপাধ্যায় পিতা নগেন চট্টোপাধ্যায় হইয়াছি।

বাবার নাম বদলানোর অবশ্য প্রয়োজন পড়েনি নকুল শুকুলের। তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে মাত্র পঁচিশ টাকা খরচ করে শেয়ালদা কোর্টে গিয়ে এফিডেভিট করে এলেন। ব্যাপারটা আদালতের আঙিনায় রীতিমতো জলভাতের মতো হয়ে গেছে। আগেই টাইপ করা আছে স্ট্যাম্প পেপারে, শুধু শূন্যস্থানে বর্তমান নাম এবং আকাঙিক্ষত নাম, সেইসঙ্গে ঠিকানা ইত্যাদি বসিয়ে দিলেই হল। তারপর হাকিমের সামনে একজন উকিল সনাক্ত করবে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কাজটা সারা হয়ে গেল। রাতারাতির চেয়েও তাড়াতাড়ি নকুল শুকুল সহদেব শুকুল হয়ে গেলেন।

কথায় বলে মানুষের লোভের শেষ নেই। সহদেব শুকুলে পরিণত হয়েও নকুলবাবুর মনে সুখ নেই। এবার নাম নয়, পদবি বদলের দিকে ঝোঁক পড়ল তার। পৈতৃক শুকুল পদবিটা বিসর্জন দিয়ে একটা নতুন পদবি নিতে হবে। অবশেষে তিনি নিজেই অনেক ভেবেচিন্তে স্থির করলেন শুকুল পদবিটা হেঁটে শুক করলেই বেশ মর্ডান হয়ে যাবে।

নকুল শুকুল থেকে সহদেব শুক হতে আরেকটা এফিডেভিট লাগল। প্রথমেই তার মাথায় ব্যাপারটা খেললে একটা এফিডেভিটেই ঝামেলা মিটত। আরেকবার শেয়ালদা আদালতে পঁচিশ টাকা এবং দুঘণ্টা সময় ব্যয় করে সহদেব শুকের আবির্ভাব হল।

.

গোয়েন্দাপ্রবর ডাক্তার সহদেব শুকের এই সংক্ষিপ্ত অথচ প্রয়োজনীয় পূর্ব বৃত্তান্তের পর এবার আজকের সকালের ঘটনায় ফেরা যাক।

ভিক্টোরিয়ার সামনে থেকে প্রাতভ্রমণ সেরে কড়েয়া রোডের দিকে ফিরছিলেন সহদেব। একটু অন্যমনস্কই ছিলেন তিনি। থাকারই কথা। মাথার মধ্যে ঘুরছে মিস জুলেখার স্বামী পটললাল পালের রহস্যময়ভাবে গায়েব হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ, সেই সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় সরোজিনী মঞ্চে যৌবনের লীলা নাটকে মিস জুলেখার উদ্দাম, মোহময়ী নৃত্যের চমক-ঠমকগুলি, দৈহিক মোচড়গুলি ছেঁড়া ছেঁড়া ছবির মতো চোখের সামনে এখনও ভাসছে।

অনিদ্রা, গরম, রহস্য ও উত্তেজনা চারে মিলে একটু ঘোরের মধ্যে আছেন সহদেববাবু। অনেক নেশা করলে কোনও কোনও সময়ে পরেরদিন সকালেও এরকম ঘোর থাকে। তবে ময়দানে খোলা হাওয়ায় হেঁটে এখন একটু ভাল লাগছে।

থিয়েটার রোড আর চৌরঙ্গির মোড়ে এক ডাবওয়ালা বসে। এই সাতসকালেই তার ব্যবসা শুরু হয়ে যায়। ময়দান ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল প্রত্যাগত ভ্রমণকারীরা কেউ কেউ এখানটায় দাঁড়িয়ে। সুনির্মল কচি নারিকেলবারি পান করেন।

ডাবওয়ালাকে চেনেন সহদেববাবু। মাঝেমধ্যে একটা ডাব এর কাছ থেকে কিনে খান। আজকেও একটা খেলে ভাল হত, ডাবওয়ালার কাছে গিয়ে সহদেববাবু দাঁড়ালেন। লোকটাও তখন ডাবের কাঁদি গুছিয়ে সাজাচ্ছে।

সহদেববাবু দেখলেন, এ লোকটা পুরনো ডাবওয়ালা নয়। সে লোকটা লুঙ্গি পরত, সঙ্গে রঙিন ফতুয়া। বোধহয় দেশে গেছে। তার অবর্তমানে নতুন লোকটা এখন হয়তো কিছুদিন ব্যবসাটা চালাবে।

এই নতুন লোকটা মোটেই ডাবওয়ালা টাইপের ষণ্ডা চেহারার নয়। রোগা, পরনে কালো ফুলপ্যান্ট, লাল স্পোর্টস গেঞ্জি। হাতে ঘড়িও রয়েছে। তা ছাড়া দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো ক্ষীণ

স্টাইলিস গোঁফ, ব্যাকব্রাশ চুল। দেখে রাস্তার ফেরিওয়ালা বলে ভাবা কঠিন।

লোকটির কাছে গিয়ে একটা ডাব চাইলেন সহদেববাবু। ডাবের কাদির পাশে রাখা একটা চটের থলের মধ্যে লোকটা হাত ঢুকিয়ে কী খুঁজল, তারপর বলল, ডাবকাটার কাটারি দেখছি নেই।

সহদেববাবু পুরনো লোক, সমস্যাটা জানেন। ডাব বিক্রি হয়ে গেলে বিকেলে ফেরার সময় আগের লোকটা ওপাশের ষোলোতলা বাড়িটার কেয়ারটেকারের কাছে দা জমা রেখে যেত। পরেরদিন সকালে সতেরোতলায় চিলেকোঠায় যেখানে ওই কেয়ারটেকার থাকে সেখানে গিয়ে দা-টা ফেরত নিয়ে আসত। এর বিনিময়ে কেয়ারটেকারবাবু দৈনিক একটা ডাব বিনামূল্যে পান করতেন।

সহদেববাবু এই ব্যাপারটা নতুন লোকটিকে বললেন। লোকটি বলল, ও তাই বলুন। ডাবওয়ালা তো এ কথা আমাকে কিছু বলেনি।তারপর, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে কাটারিটা নিয়ে আসছি, এই বলে লোকটা ষোলোতলা বাড়ির দিকে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল।

লোকটা চলে যাওয়ার পর সহদেববাবুর খেয়াল হল পুরনো ডাবওয়ালাটা দেহাতি হিন্দিতে কথা বলত, আর এই লোকটা পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে।

এক হিসেবে খুশিই হলেন সহদেববাবু, তা হলে বাঙালি যুবকেরা এখন রাস্তায় ডাবের ব্যাপারির ব্যবসাও করছে। কিছু না করার চেয়ে, চুরি জোচ্চুরি করার চেয়ে এ কাজ ঢের ঢের ভাল। হাজার হলেও স্বাধীন ব্যবসা তো।

লোকটিকে মনে মনে প্রশংসা করলেন সহদেববাবু। কিন্তু লোকটি যে কাটারি আনতে গেল, সেই যে গেল আর তো ফেরে না।

এদিকে রাস্তায় ওই বহুতল বাড়িটার সামনে কীসের যেন রীতিমতো সোরগোল শুরু হয়েছে। চিৎকার হই-হল্লা ক্রমশই বাড়ছে।

ডাবের লোকটি নিশ্চয় ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। সহদেববাবু এবার একটু বিরক্ত হলেন, এই জন্যেই বাঙালির ব্যবসা হয় না। ডাব বেচা বন্ধ করে রাস্তায় হট্টগোল লিপ্ত হলে কচু ব্যবসা হবে।

রাগ করে, ডাব না খেয়েই সহদেববাবু বাড়ির পথ ধরলেন।

 পথে যেতে যেতেই শুনলেন একটা ডাকাত মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে ওই ষোলোতলা ফ্ল্যাট বাড়িটায় ঢুকেছিল, লিফটে করে ওপরে উঠে যাচ্ছিল। আজকাল খুব সকালের দিকে এ ধরনের ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে এরকম রাহাজানি প্রায়ই হচ্ছে।

সুখের কথা, লিফটটা ছাড়তে না ছাড়তেই লোডশেডিং হয়ে ডাকাতটা লিফটের মধ্যে আটকিয়ে যায়।

রাস্তা থেকেই ডাকাতটাকে দেখা যাচ্ছে। একতলার, মানে গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটু উঁচুতে লিফটের মধ্যে কোলাপসিবল গেটের ফাঁকে লোকটার গলা অবধি দেখা যাচ্ছে। পরনে কালো প্যান্ট, লাল গেঞ্জি, হাতে কাটারি।

জানা গেল, পুলিশে ফোন করা হয়েছে, এখনই পুলিশ আসছে।

কিন্তু সহদেববাবুর কেমন মনে হল, এ তো সেই রাস্তায় ডাবওয়ালাটা। লাল স্পোর্টস গেঞ্জি, কালো ফুলপ্যান্ট, হাতে কাটারি। নিশ্চয়ই লোকটা কাটারি নিয়ে নেমে আসছিল সেই সময় আটকিয়ে গেছে। ওঠার সময় আটকায়নি, তখন কাটারি কোথায় পাবে।

এখনই পুলিশ এসে যাবে। লোকটাকে ধরে নিয়ে যাবে। সারাদিন ধরে ফুটপাথে ডাবের কাঁদি পড়ে থাকবে। লোকটা কবে ছাড়া পাবে কে জানে। এক এই বাড়ির কেয়ারটেকার ওকে রক্ষা করতে পারে।

 বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে সহদেববাবুর মনে হল এ ব্যাপারে তারও একটু দায়িত্ব আছে। তার জন্যেই লোকটি কাটারি আনতে গিয়েছিল। গোয়েন্দা দপ্তরের সঙ্গে সহদেববাবুর ভালই সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সাধারণ পুলিশেরা শখের গোয়েন্দাদের মোটেই পছন্দ করে না। দুয়েকবার সহদেববাবু সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।

আজকে গোলমালের মধ্যে মাথা গলালে পুলিশ হয়তো তাকেও জড়াবে। তার যে গোয়েন্দা দপ্তরে সরাসরি যোগাযোগ আছে, সেখানে যে তার বেশ খাতির, তার পক্ষে সব পুলিশকে সেটা জানানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া পটললাল পালের অন্তর্ধান রহস্যের অবিলম্বে সমাধান করতে হবে। সেই সূত্রে মিস জুলেখার সঙ্গে আজ বিকালবেলাতেই আবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। সুতরাং আপাতত পুলিশ এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। ঝুট ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই।

০২. মিস জুলেখা ওরফে শ্রীমতী লেখা ভট্টাচার্য

মিস জুলেখার নাম শুনে যদি কেউ ধরে নেন যে তিনি কোনও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তরুণী তবে তিনি খুব ভুল করবেন।

প্রথমেই সেই ভ্রান্তি নিরসন করা দরকার। ডাক্তার সহদেব শুকের মতো মিস জুলেখারও একটি পূর্বনাম আছে। অবশ্য তিনি আদালতে এফিডেভিট করে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে নাম বদল করেননি। নাম বদলিয়েছেন নেহাতই। পেশার দায়ে।

মিস জুলেখার আগের নাম ছিল শ্রীমতী লেখা ভট্টাচার্য।

রীতিমতো ভটচাজ বামুন বংশের মেয়ে, গঙ্গাতীরের প্রসিদ্ধ পরিবারের। তিনি কিশোরী বা তরুণী এমনকী যুবতীও প্রায় নন। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর বয়েস হয়েছে তাঁর, তিন পুত্রকন্যার জননী।

ক্লাস টেনে পড়ার সময় টেস্ট পরীক্ষার ঠিক দুদিন আগে গলির মোড়ের শ্রীহনুমান ব্যায়ামাগারের বালিকা শাখার ব্যায়াম শিক্ষক নারায়ণ ত্রিবেদীর সঙ্গে কুমারী লেখা ভট্টাচার্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে দক্ষিণেশ্বরে মা কালীর সামনে মালাবদল করেন এবং সিঁথিতে সিঁদুর আরোপ করে শ্রীমতী লেখা ত্রিবেদীতে পরিণত হন।

এরপর চার-পাঁচ বছরের মধ্যে তিনটি পুত্রকন্যা তার জন্মায়। কিন্তু ব্যায়ামবীর নারায়ণ ত্রিবেদী এর মধ্যেই সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে একদিন শেষরাতে লোটাকম্বল সম্বল করে একটা খবরের কাগজের ঠোঙায় রান্নাঘরের পেছনের ছাইগাদা থেকে কয়েক মুঠো ছাই নিয়ে পথে বেরিয়ে সেগুলো সারা শরীরে মেখে নিমতলা শ্মশানঘাটের কিঞ্চিৎ উত্তরে গঙ্গার ধার ঘেঁষে রেলের লাইন বাঁচিয়ে আস্তানা গাড়েন। যেকোনও কারণেই হোক, সংসার ত্যাগের পর তিনি প্রায় এক বছর মৌনী অবস্থায় থাকেন। সেখানে তার পরিচয় হয় মৌনীবাবা বলে।

অনেক খোঁজখবর করে শ্রীমতী লেখা তিন ছেলেমেয়ের হাত ধরে নিমতলায় মৌনীবাবার কাছে। পৌঁছেছিলেন। কিন্তু মৌনীবাবা তখন কথা বলেন না, তদুপরি লেখাদেবীর রাগারাগি, কান্নাকাটি, শাপশাপান্ত সব কিছু উপেক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছোট কলকেতে গাঁজা সেবন করে যান।

এদিকে, লেখাদেবীকে বেওয়ারিশ ভেবে মৌনীবাবার শিষ্যদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন তাকে খাদ্য ও বাসস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয়।

লেখাদেবীর গত্যন্তর ছিল না।

আর সেই থেকেই তার পতন কিংবা অভ্যুত্থানের শুরু। ক্রমশ চিৎপুরের যাত্রাদলে সাইড পার্ট, নায়িকার সখীর ভূমিকায় নৃত্যগীতাদি ও ছলাকলা–লেখাদেবী ধীরে ধীরে, ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, সুখে-দুঃখে প্রমোদ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন।

এর পরে অবশ্য লেখা থেকে জুলেখা হতে বহু বছর লেগেছে। পার্ক স্ট্রিটের বার হয়ে উত্তর কলকাতার প্রগতিশীল সামাজিক নাটকের মঞ্চে প্রায় উদোম হয়ে পৌঁছুতে বেশ পরিশ্রম হয়েছে।

তা ছাড়া এর মধ্যে বহুবার স্বামীবদল করতে হয়েছে তাঁকে নিজের পেশারই স্বার্থে। তবে পুত্রকন্যা আর জন্মায়নি।

কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে, শ্রীমতী লেখা ওরফে মিস জুলেখা যখনই যে স্বামীর ঘর করেছেন, খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন, সতীত্বের সঙ্গে করেছেন।

ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণের বাড়ির মেয়ে, আসলে সতীসাধ্বী হওয়া তার রক্তে রয়েছে।

পটললাল পালের সঙ্গে তাঁর শেষ বিবাহ। এই মাত্র কয়েকমাস আগে। পূর্ববর্তী পতিদেবতা হরিলাল আগরওয়ালা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এর কিছুদিন আগেই। হরিলাল আগরওয়ালার প্রায় আশি বছর বয়েস হয়েছিল, তার নিজের ঘর সংসার জমজমাট ছিল, শুধু মোহের বশে ধর্মান্তরিত হয়ে মিস জুলেখার পাণিগ্রহণ করেন।

তবে সে অন্য কথা।

প্রসঙ্গটা উঠল এই কারণে যে পটললাল পাল ছিলেন আগরওয়ালা সাহেবের টাউট। তিনিই আগরওয়ালা সাহেবকে জুলেখার কাছে নিয়ে আসেন এবং তার বিবাহের সবরকম বন্দোবস্ত করেন।

পটললালের বয়স যদিও মিস জুলেখার থেকে অন্তত আট-দশ বছর কম হবে তবু আগরওয়ালার মৃত্যুর পর জুলেখা স্থির করলেন, আর বুড়োহাবরা নয়, কখন দুম করে মরে যায়। কিছু ঠিক নেই, তার চেয়ে পটললাল পালের মতো চনমনে যুবকই স্বামী হিসেবে ভাল।

পটললালের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরে পুনর্বার হিন্দু হয়ে মিস জুলেখার মনে সম্প্রতি খুব ধর্মভাব দেখা দিয়েছে। এতকাল যা করেননি, এই বিয়ের পর থেকে তিনি শাঁখা সিঁদুর পরতে লাগলেন। মঙ্গলবারে জয়মঙ্গল ব্রত পালন করে সারাদিন উপোস করতে লাগলেন, তাতে অবশ্য ভালই হল, কিছুটা অতিরিক্ত মেদ ঝরল, এ বয়েসে সেটা দরকার।

শুধু শাঁখা-সিঁদুর বা উপোস দেয়া নয়, প্রতি লক্ষ্মীবারে অর্থাৎ বৃহস্পতিবারে মিস জুলেখা লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে লক্ষ্মীর আরাধনা করতে লাগলেন। ফুল, চন্দন, প্রসাদ সব কিছু দিয়ে লক্ষ্মী ঠাকরুনের পুজো হতে লাগল। খাটের পিছনে এক চিলতে জায়গায় একটা বার্নিশ করা কাঠের সিংহাসনে লক্ষ্মীর ফটো বসিয়ে প্রতিদিন সকালে ধূপধুনো, শঙ্খ রবে বন্দনা শুরু হল। সন্ধ্যারতিটা অবশ্য সম্ভব হত না, পেশার তাগিদে তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হত, মঞ্চে বা বারে।

শাঁখা নিয়ে একটু অসুবিধে হয়েছিল। হাতে শাঁখা পরে ক্যাবারে নাচ একটু বেমানান। কিন্তু দেখা গেল উত্তর কলকাতার এ জাতীয় নাটকের দর্শকেরা এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামান না, তারা শাখা দেখতে আসেননি, তারা নাটকও দেখতে আসেননি, তারা মিস জুলেখাকে, তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখতে এসেছেন দাম দিয়ে টিকিট কেটে। শাখা নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত নন, একেবারে মাথা ঘামালেন না।

 সিথির সিঁদুর নিয়ে অবশ্য কোনও অসুবিধা হয়নি। কারণ মিস জুলেখা একটা সোনালি রঙের পরচুলা পরে নাচেন, তাতেই সিঁদুর সমেত মাথার চুল ঢাকা পড়ে যায়।

তবে আসল অসুবিধে হয়েছিল মিস জুলেখার কোমরের মাদুলি নিয়ে।

প্রথম বিয়ের মতোই পটললাল পালের সঙ্গে এই সর্বশেষ বিয়েও কালীবাড়িতে মালাবদল করে হয়েছিল। তবে এবারে কালীঘাটে, দক্ষিণেশ্বরে নয়।

বারবার বিয়ে করার ব্যাপারটা মিস জুলেখার আর ভাল লাগছিল না। কালীবাড়ির দরজাতেই এক ত্রিকালসিদ্ধ সাধুবাবার আবির্ভাব হয়েছে। দীর্ঘ এক হাজার আট বছর হিমালয়ের গুহায় কাটিয়ে আজ কয়েকদিন হল কালীঘাটে ফিরে এসেছেন। সাধুবাবাকে ঘিরে বেশ ভিড়।

কালীমন্দিরে মালাবদল করে বিয়েতে জুলেখা বেশ অভিজ্ঞা, তিনি তাড়াতাড়ি পটললালের সঙ্গে বিয়েটা সাঙ্গ করে সাধুবাবার কাছে ফিরে এলেন।

মহিলা বলে ভিড় ঠেলে এগোতে কোনও অসুবিধা হল না মিস জুলেখার। তা ছাড়া বড়দিন বা ইংরেজি নববর্ষে এর চেয়ে অনেক বেশি গাদাগাদি মাতালের ভিড়ে পানশালায় তাঁকে নাচতে হয়, ভিড় ঠেলতে তিনি ভালই জানেন।

সাধুবাবার পাশেই তার এক চেলা দাঁড়িয়ে, মধ্যবয়সি, সাধারণ চেহারা, সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি পরা। সাধুবাবার মতো তারও কপালে একটা বিরাট সিঁদুরের ফোঁটা জ্বলজ্বল করছে। তবে সাধুবাবার মতো তার চেলার মাথাভর্তি জটা নেই কিংবা গলায় বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা নেই, বিশাল দাড়িগোঁফও নেই।

সে যা হোক এই চেলাঠাকুরকেই মিস জুলেখা জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, সাধুবাবা কি সত্যিসত্যিই এক হাজার আট বছর হিমালয়ের গুহায় ছিলেন?

চেলাঠাকুর বললেন, সে আমি বলতে পারব না। আমার দুই ছেলে পলাশির যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পক্ষে যুদ্ধ করে ক্লাইভের তোপের মুখে প্রাণ দেয়। সেই থেকে আমি বিবাগী হয়ে হিমালয়ের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই। সেখানেই সাধুবাবার সঙ্গে দেখা। কিন্তু সে তো মাত্র দুশো বছর আগের কথা। হাজার বছরের কথা তো বলতে পারব না।

 হাজার বছর না হোক, দুশো বছর শুনেই সাধুবাবা সম্পর্কে জুলেখার মনে ভারি শ্রদ্ধার ভাব এল। সাধুবাবার রক্তাভ চোখসহ মুখটাও কেমন মায়াবি, যেন গতজন্মের চেনা।

মিস জুলেখা একেবারে সামনে গিয়ে সাধুবাবার দুই পা জড়িয়ে ধরে উচ্ছাস ভরে ডুকরিয়ে উঠলেন, বাবা, আমি আর পারছি না, আমি আর বিয়ে করতে পারছি না।

সাধুবাবা এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলেন। মিস জুলেখার কণ্ঠস্বর শুনে চমকিয়ে চোখ খুলে একবার মিস জুলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওগো, বাবা নয়। বাবা নয়। আমি তোমার বাবা নই। এই বলে চেঁচা দৌড় লাগালেন কালীঘাট রোডের দিকে, সমবেত ভক্তদের তোয়াক্কা না করে ভিড়ের মধ্যে সে এক সাংঘাতিক দৌড়।

আগেই মুখটা চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, তারপরে কণ্ঠস্বর, অবশেষে এই পলায়নী দৌড় এসবই মিস জুলেখা, না ঠিক মিস জুলেখা নয়, সেই প্রাক্তনী শ্রীমতী লেখা ভট্টাচার্য (ত্রিবেদী) মহোদয়ার খুবই চেনা।  

মুহূর্তে মিস জুলেখা চিনতে পারলেন, এ তার সেই প্রথম স্বামী শ্রীযুক্ত নারায়ণ ত্রিবেদী।

সেই নারায়ণ ত্রিবেদী যে আগেও যখন কোনও রকম বিপদে পড়ত এই রকম লাফ দিয়ে দৌড়ে পালাত।

 তা পালাক, পালিয়ে যাক। তাতে এখন আর মিস জুলেখার দুঃখ বা আফসোস নেই। নারায়ণ ত্রিবেদীর প্রতি আর সামান্য কোনও টানও নেই জুলেখার মনে, শুধু একটু স্মৃতি বেদনা আছে। আর তা ছাড়া এখন নারায়ণ যদি জানতে পারে যে লেখা নৃত্যগীত নিপুণা হয়েছে, ভাল আয় করছে, স্বচ্ছল হয়েছে, সে যেরকম চরিত্রের লোক হয়তো এসে এই এতদিন পরে ভাগ চাইবে।

কিন্তু, হায়রে অদৃষ্টের পরিহাস।

জীবনের একাদশতম বিয়ে করতে এসে সেই প্রথম স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, যার সঙ্গে এখনও বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি।

.

সাধুবাবার এই আকস্মিক পলায়নে চেলাঠাকুরও কেমন বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন, এখন একটু সামলিয়ে নিয়ে বললেন, সাধুবাবার এরকম প্রায়ই হয়। ভগবান ডাকলে আর বসে থাকতে পারেন না। এভাবে দৌড়ে তার কাছে চলে যান। এই বলে চেলাঠাকুর সাধুবাবার পলায়ন পথের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন।

তারপর পুরনো কথার খেই ধরে তিনি মিস জুলেখাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি বলছিলেন। যেন, বিয়ে করতে পারছি না। আর বিয়ে করতে পারছি না। ব্যাপারটা কী?

এতদিন পরে নারায়ণ ত্রিবেদীকে, তার প্রথম ভালবাসা, প্রথম স্বামীকে দেখে মিস জুলেখার মনের সাগরের তটে একের পর এক তিক্ত-মধুর স্মৃতির ঢেউ এসে আছড়িয়ে পড়ছিল। তিনি একটু ঘোরের মধ্যেই ছিলেন। নারায়ণ ত্রিবেদী লোকটা সুবিধের নয়, কিন্তু সে তো তার তিন সন্তানের জনক। চেলাঠাকুরের প্রশ্নে মিস জুলেখার সম্বিৎ ফিরে এল, তিনি চেলাঠাকুরকে বললেন, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, ঠিকই বলেছিলাম, অনেকবার বিয়ে করা হয়ে গেল আমার। আর বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না।

চেলাঠাকুর বুদ্ধিমান লোক, পলাশির যুদ্ধে দুই ছেলেকে হারিয়ে তার ক্ষণিক বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল, কিন্তু সেটা অনেকদিন কেটে গেছে। এতদিন পরে এখন তার রীতিমতো চনমনে বুদ্ধি।

 আজ সাধুবাবা পালিয়েছেন। রোজগারের আশা কম। চেলাঠাকুর মিস জুলেখার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলেন, এই একজন মক্কেল পাওয়া গেছে, এর কাছে কিছু আশা করা যেতে পারে। দু-চার গণ্ডা যা হয়, তাই লাভ। না হলে আজ উপোস দিতে হবে।

তাই তাড়াতাড়ি চেলাঠাকুর মিস জুলেখাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কতবার বিয়ে করেছেন?

 মিস জুলেখা সলজ্জ কণ্ঠে জানালেন, তা প্রায় দশ-এগারোবার হবে।

চেলাঠাকুর তাই শুনে বললেন, মাত্র দশ-এগারো বার! এ তো কলিতীর্থ কালীঘাট, এখানে যারা আসেন তাদের মধ্যে অনেকে পনেরো বিশবার করে বিয়ে করেছে। হামেশাই লোকে, মেয়েলোকে বছরে দু-তিনবার করে বিয়ে করে। এমনকী একই মাসে একই মেয়েছেলেকে দুবার বিয়ে করতে দেখেছি।

 ভূমিকা শেষ করে চেলাঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে জুলেখাকে জানালেন, একটা অব্যর্থ বিবাহনিবারণী মাদুলি আমার কাছে আছে। এক মেমসাহেব নেবেন বলে কাশী থেকে আনিয়েছিলাম। তা সেই মেমসাহেব তো এলেন না। আপনি যদি নেন তো আপনার জন্যে নিয়ে আসি। সোয়া একান্ন টাকা, মানে একান্ন টাকা পঁচিশ পয়সা দাম পড়বে।

মিস জুলেখা ভাবলেন যে কত পয়সাই তো নয়ছয় হয়, না হয় আরও সোয়া একান্ন টাকা গেল। দেখাই যাক না বিয়ে ভাঙাটা বন্ধ হয় কি না। তা ছাড়া পটললালকে তার খুবই পছন্দ।

মিস জুলেখার সম্মতি পেয়ে চেলাঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের দক্ষিণ দিকে একটা বেলোয়ারি দোকানে গিয়ে পেতলের রং করা একটা টিনের মাদুলি পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে আর দু মিটার লাল ফিতে একটাকা দিয়ে কিনে ফেললেন। তারপর মন্দিরের উঠোন থেকে একটা পরিত্যক্ত শালপাতার ঠোঙা তুলে তার থেকে একটু পাতা ছিঁড়ে মাদুলির মধ্যে ঢুকিয়ে মিস জুলেখার কাছে ফিরে গেলেন। মিস জুলেখা তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে পঞ্চাশ টাকার নোট, একটা এক টাকার নোট আর একটা আধুলি খুঁজে বার করলেন।

সোয়া একান্ন টাকা থেকে পঁচিশ পয়সা বেশিই হয়ে গেল, এতে মাদুলির প্রভাবের কোনও হেরফের হবে কিনা জুলেখার এই প্রশ্নে চেলাঠাকুর বললেন, সাংঘাতিক ধ্বক এই মাদুলির, পঁচিশ পয়সার তারতম্যে এর কী হবে?

এ কথা শুনে জুলেখা চেলাঠাকুরের হাতে সাড়ে একান্ন টাকাই ধরে দিলেন। চেলাঠাকুরও খুশি হলেন, তার মোট দেড় টাকা খরচ হয়েছিল, এতে পঞ্চাশ টাকা পুরো লাভ হল। বিয়ের পুরুতের সঙ্গে বিয়ের খরচ-খরচা নিয়ে বেশ একটা বচসা লেগেছিল পটললালের। মন্দিরের বারান্দাতেই আটকিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এতক্ষণে গম্ভীরমুখে ফিরে এসে বললেন, পুরুতব্যাটা বলছে, ধর্মান্তরিতার পুনর্বিবাহ দশ-পনেরো টাকায় হবে না। একান্ন টাকা পঁচিশ পয়সার কমে এ বিয়ে সিদ্ধ হবে না। তা সিদ্ধ হোক অসিদ্ধ হোক আমি সোয়া একান্ন টাকা দিচ্ছি না।

পটললাল অতিশয় ছিঁচকে ব্যক্তি। তাঁর স্বভাবের এই দিকটা মিস জুলেখা জানেন। তিনি দেখলেন আবার সোয়া একান্নর ধাক্কায় পড়েছেন। কী আর করা যাবে, খুচরো টাকা আর ছিল না, পটললালকে একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন, বিয়ে নিয়ে কিপটেমি কোরো না। যাও পুরুত ঠাকুরকে সোয়া একান্ন টাকা দিয়ে এসো।

 জুলেখা জানেন ফেরত আটচল্লিশ টাকা পঁচাত্তর পয়সা পটললাল তাকে কখনওই দেবেন না। তা হোক, পটললালের তো হাতখরচা লাগে। আগরওয়ালা মরে যাওয়ার পর এখন সে আর পয়সা পাবে কোথায়?

পটললালকে দেখে চেলাঠাকুর একটু গুম মেরে গিয়েছিলেন। লোকটা সুবিধের বলে মনে হচ্ছে।। বিয়ের সোয়া একান্ন টাকার ওপরে আবার যদি মাদুলির সোয়া একান্ন টাকা টের পেত, তাহলে হয়তো এ টাকাটা কেড়েই নিত।

এখন পটললাল মন্দিরের বারান্দার দিকে চলে যেতে হাতের মুঠো খুলে লাল ফিতে সমেত মাদুলিটা বের করে জুলেখার হাতে দিয়ে চেলাঠাকুর বললেন, মাদুলিটা অতি জাগ্রত। কখনও কাছছাড়া করবেন না। এই লাল ফিতেটা দিয়ে বেঁধে কোমরে ধারণ করবেন।

ইতিমধ্যে পটললাল ফিরে এসেছেন, তাঁকে দেখেই চেলাঠাকুর হাওয়া হয়ে গেলেন।

 মিস জুলেখা এবং পটললাল মন্দিরের বাইরে রাস্তায় এসে একটা ট্যাকসি ধরে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা চেনা ঠেকে চলে গেলেন বিবাহ উৎসব উদ্যাপন করতে।

সেখানে পৌঁছেই বাথরুমে গিয়ে জুলেখা কোমরে লাল ফিতে লাগানো সেই মাদুলিটা বেঁধে ফেললেন। পটললালের মতিগতিতে তার বিশ্বাস নেই, এই ঠেকে পটললালের চেনা অনেক মেয়ে আসে। তাদের কারও সঙ্গে ঝুলে পড়লেই বিপদ।

বয়েসের দোষে মিস জুলেখার শরীরে একটু বেশি চর্বি জমেছে। নর্তকীদের শরীরের কোনও কোনও অংশে মাংসচর্বি একটু বেশি থাকলে দর্শকেরা পছন্দই করে।

কিন্তু মিস জুলেখার একটা ছোট নেয়াপাতি ভুড়িও হয়েছে। ফলে ঠিক সরাসরি কোমরের ওপরে লাল ফিতেয় বাঁধা মাদুলিটা রইল না। নাইয়ের একটু নীচে নেমে গেল, ফুল্ল কোমরবতী রমণীরা নাইয়ের নীচে যেখানে শাড়ি নামিয়ে পরেন সেই জায়গায় মাদুলিসহ ফিতেটার অবস্থান হল।

আগেই বলেছি সোনালি উইগ পরে সিঁদুরসহ মাথার চুল ঢেকে এবং হাতে শাঁখা রেখেও মিস জুলেখার তথাকথিত ক্যাবারে নৃত্যের কোনও অসুবিধে হয়নি, কিন্তু কোমরে মাদুলিটা বাধার সৃষ্টি করল। এতক্ষণে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা বিশদ করে বলা উচিত।

কোমরে মাদুলি বাঁধার পর প্রথম সন্ধ্যায় মঞ্চে আবির্ভূত হবার আগে মেকআপম্যান ওই মাদুলিটি দেখতে পায় এবং আপত্তি জানায় যে মাদুলিটা রাখা যাবে না। খুলে ফেলতে হবে।

বলা বাহুল্য এতে সতীসাধ্বী মিস জুলেখা খুবই আপত্তি জানান। বস্ত্র উন্মোচনে তাঁর মোটেই আপত্তি নেই, কিন্তু মাদুলিটি রাখতে হবে।

খবর পেয়ে পরিচালক ও প্রযোজক আসেন। এঁরা দুজনে যমজ ভাই। পারিবারিক পুরনো রেড়ির তেলের ব্যবসা এঁদের। আজকাল রেড়ির তেলের চাহিদা নেই, ব্যবসা পড়ে গেছে। তাই এঁরা অবশেষে থিয়েটারের ব্যবসায় এসেছেন।

দুই ভাই এসে অনেকক্ষণ ধরে মিস জুলেখার চারপাশে ঘুরে ঘুরে মাদুলিটা দেখলেন। তারপর মিস জুলেখা আপত্তি করছেন না দেখে সাহস সঞ্চয় করে হাত দিয়ে মাদুলিটা যাচাই করতে লাগলেন।

ওঁদের মুখচোখ এবং নৈতিক চরিত্রের মানের কথা ভেবে মিস জুলেখা শঙ্কিত বোধ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন এই প্রস্তাবে যে ওই লালফিতের সঙ্গে দুটো শোলার কদম ফুল ঝুলিয়ে মাদুলিটা ঢেকে দেওয়া হবে।

তদবধি কোমরের লালফিতেয় নাভির ঠিক নীচে দুটো শোলার কদম ফুল নৃত্য দৃশ্যে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তবে কদমদুটো লাগানোর সময় বৃদ্ধ মেকআপম্যান দিল মহম্মদ বড় বেশি সময় নেয়। কোনও কোনও দিন প্রযোজক ও পরিচালক কদমফুল লাগানোর সময় ফুল দুটো দিল মহম্মদ ঠিকমতো লাগাচ্ছে কি না তা দেখার জন্যে উপস্থিত থাকেন। সঙ্গে অনেক সময় তাদের সাঙ্গপাঙ্গও থাকে। মিস জুলেখার নাচের চেয়ে তার সাজগোজ করার, শোলার কদম ফুল ঝোলানোর ব্যাপারটা ঘনিষ্ঠ মহলে এখন অনেক বেশি জনপ্রিয়।

০৩. আবার ডাঃ শুক

আবার এসেছে গন্ধমাদন
চারদিক মাতে সৌরভে।
কৌ-কৌ-কৌ কাক ও কুকুর
বাড়ি ভরে যায় কৌরবে ॥

শুধু গোয়েন্দাগিরি বা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারই নয়। শ্রীযুক্ত নকুল শুকুল ওরফে সহদেব শুক একজন শৌখিন সংগীতকার।

অদ্যাবধি তিনি সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। তার মধ্যে যেগুলি তার নিজের পছন্দ হয়েছে সেগুলিতে নিজেই সুর দিয়ে নিজেই গেয়েছেন।

এই গানগুলি কেমন সে বিষয়ে আমার মতো সংগীত-মূর্খ ব্যক্তির কোনও অভিমত না দেয়াই ভাল। তবে বেলেঘাটার দি নিউ ডেমোক্রেটিক মিউজিক ক্যাসেট কোম্পানি এই পুজোতেই তার একটা গানের সংকলন প্রকাশ করবে, তার জন্যে সহদেববাবুর নগদ সাত হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।

তবে তাতে দুঃখ নেই। মিস জুলেখার স্বামীকে খুঁজে বার করতে পারলে কিছু আসান হবে।

 মিস জুলেখাকে সহদেববাবু কেসটা হাতে নেয়ার পরে প্রশ্ন করেছিলেন, আমার কী প্রাপ্য?

 মিস জুলেখা ভ্রূভঙ্গিসহ শরীর নাচিয়ে বলেছিলেন, আমার দু মাসের নাচ।

তা, সহদেববাবু খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, মিস জুলেখার প্রতি মাসের নাচের আয় পাঁচ হাজার টাকা। সুতরাং দুমাসে দশ হাজার টাকা, সে কিছু কম নয়। গানের ক্যাসেটের পয়সা জুগিয়েও হাতে কিছু থাকবে।

কিন্তু সহদেববাবুর কলমে এবার গান মোটেই আসছে না।

সেদিন কর্পোরেশনের একটা ময়লা ভরতি লরি চাকা খুলে কড়েয়া রোডের মোড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল। বীভৎস গন্ধে সারা পাড়া বাহাত্তর ঘণ্টা আচ্ছন্ন ছিল। অবশেষে ময়লাগুলো একা একাই কী করে ঝোড়ো হাওয়ায়, বৃষ্টির জলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে গন্ধ কমতে লাগল, তবে লরিটা এখনও হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। পতনের দিন সন্ধ্যা হতে না হতেই লোডশেডিং যেই হল, কারা যেন কোথা থেকে এসে ভাঙা এবং ভাল চাকাগুলো সব ঝটাঝট খুলে নিয়ে চলে গেল। তারপর থেকে লরিটা কচ্ছপের মতো পড়ে আছে।

সেই লরিটাকেই স্মরণ করে হয়তো এই আবার এসেছে গন্ধমাদন গানটির সূচনা তবে এই গানটিতে কৌরব শব্দটি যুগ্ম ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রথম কৌরব মানে হল কাকের কৌ কৌ, কুকুরের কৌ কৌ এই সব রব, ময়লা ফেলার লরি ভেঙে পড়ায় কাক ও কুকুরের আনন্দ ধ্বনি।

আর দ্বিতীয় কৌরব হল; পাণ্ডব কৌরবের কৌরব। মহাভারত বিশারদ পিতার যোগ্য পুত্র হিসেবে পাণ্ডব কৌরবের ব্যাপারটা সহদেববাবুর মজ্জাগত।

সহদেববাবু জানেন তিনি একাই দুই পাণ্ডব, নকুল এবং সহদেব এবং কৌরবেরা তাঁর পরম শত্ৰু, যাকে বলে জ্ঞাতি শত্রু।

বাড়ি ভরে যায় কৌরবে, এই পংক্তিটা লেখার পর থেকেই কেমন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন সহদেব। কৌরবে মানে শত্রুতে যদি বাড়ি ভরে যায়, তাহলে তো সর্বনাশ।

কিন্তু এই মুহূর্তে এসব শৌখিন চিন্তার অবকাশ নেই সহদেব ডাক্তারের। বাইরের চেম্বারে অন্তত দশজন রোগী অপেক্ষা করছে। দশজনই ইঁদুরের কামড়ের রোগী।

সম্প্রতি কলকাতায় ইঁদুর খুব বেড়ে গেছে, শহরতলিতে আরও। বিভিন্ন ইঁদুর মারার ওষুধে তাদের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না, বরং বৃদ্ধি হচ্ছে, ইঁদুর মারার ওষুধ খেয়ে খেয়ে তারা ক্রমশ বেশি দুর্দান্ত, বেশি হিংস্র হয়ে উঠছে। মানুষদের তারা আর আজকাল একেবারেই ভয় পায় না।

কলকাতায় ডাক্তারি করতে এসে বুদ্ধিমান সহদেববাবু একথা অনুধাবন করেছিলেন যে এখানে সব বিষয়ের ডাক্তার হয়ে ব্যবসা বা পসার জমাতে দেরি হবে, একেবারে নাও হতে পারে। তার চেয়ে কোনও একটা জরুরি বিষয়ের ডাক্তার হলে তাড়াতাড়ি পসার জমবে, খ্যাতি ও অর্থ হবে।

যে সময় সহদেববাবু এই সব ভাবছিলেন সেই সময়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা পরপর দুটি ইঁদুর, একটি নেংটি ইঁদুর এবং একটি ছুঁচো যথাক্রমে তার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুল এবং ডান পায়ের পায়ের বুড়ো আঙুল কামড়িয়ে দেয়।

 বাধ্য হয়ে তিনি পরদিন সকালে বাড়ির কাছেই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে যান। সেখানে। ইমারজেন্সি আউটডোরে দেখেন প্রায় সবাই ইঁদুরের কামড়ের রোগী।

এরপর বাড়ি ফিরে এসে ইঁদুর ও ইঁদুরের কামড়, ইঁদুরের কামড়ে বিষ আছে কিনা, তার প্রতিক্রিয়া কী হয়, প্রতিষেধকই বা কী, এই সব বিষয়ে বিভিন্ন চিকিৎসাগ্রন্থ সংগ্রহ করে গভীর পড়াশোনা করেন।

তারপর দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন, বাড়ির সামনেও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন, তাতে বড় বড় হরফে লেখা,

ইঁদুরের দংশনের অব্যর্থ উপশম
মাত্র তিন ডোজে উপকার
বিফলে মূল্য ফেরত
ডাঃ সহদেব শুক
কড়েয়া রোড, কলিকাতা

এই বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ডের দুপাশে দুটি হিংস্র ইঁদুরের ছবি আঁকা, সেগুলো প্রায় কুমিরের মতো বড় এবং খরদন্তী।

ইঁদুরের দংশনের চিকিৎসায় সহদেববাবুর বেশ হাতযশ হয়েছে।

আজকের দশজন রোগীকেই তিনি যত্ন করে দেখলেন ও ওষুধ দিলেন। কিন্তু শুধু ওষুধ দিলে তো কাজ হয় না, ওষুধ খাওয়ার সময় একটা গোপন মন্ত্রও মনে মনে বলতে হয়।

বলা বাহুল্য, সেই গোপন মন্ত্রটিও ডা. সহদেব শুকেরই রচনা। একটু গোলমেলে ছন্দের এই মন্ত্রটি হল,

শুক বলে,
ইঁদুর কী জিনিস
শুক বলে,
ইঁদুরের দাঁতে বিষ।
শুক বলে,
ভয় না পাবিস!
শুক বলে,
অহর্নিশ, অহর্নিশ,
অহর্নিশ!

অহর্নিশ মানে দিন ও রাত্রি, মানে চব্বিশ ঘণ্টা। এইটুকু বুঝলেই মন্ত্রের মর্মার্থ ধরা যায়।

ইঁদুরের বিষে ভয় নেই। ডাক্তার সহদেব শুক বলছেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ভাল হয়ে যাবে।

 তিন ডোজ ওষুধ আর তার সঙ্গে স্বরচিত এই মন্ত্র, বিনিময়ে রোগী প্রতি বত্রিশ টাকা। সকালবেলাতেই তিনশো বিশ টাকা আয় হয়ে গেল।

ইঁদুর দংশনের চিকিৎসা করে ভাগ্য ফিরে গেছে সহদেববাবুর। তা ছাড়া এই ইঁদুর দংশনের চিকিৎসার সূত্রেই তার শখের গোয়েন্দাগিরিতে প্রবেশ। পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের ডাকসাইটে উপপ্রধান সাহেবকে খোদ লালবাজারে দপ্তরের মধ্যে একটা ছুঁচো কামড়িয়ে দেয়। সেই চিকিৎসার সূত্রে ডাঃ সহদেব শুককে তলব করা হয়েছিল পুলিশ দপ্তরে। সেখানে দংশিত উপপ্রধান সাহেবের ক্ষতস্থান দেখে ডাক্তার সহদেব শুক বলেন, আসল ছুঁচো নয়, কোনও নকল প্লাস্টিকের ইঁদুরের মারাত্মক কেমিক্যাল লাগানো নকল বিষাতের কামড়।

সবাই সহদেববাবুর বিশ্লেষণ হৃদয়ঙ্গম করার আগে উপপ্রধান সাহেব বিষক্রিয়ায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলেন, তাঁর নাক মুখ দিয়ে সাদা ফেনার মতো গাজলা বেরোতে লাগল। তাকে তখনই হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে তার প্রাণরক্ষা করা হয়।

এদিকে দপ্তরেরই একপাশে স্প্রিং লাগানো প্লাস্টিকের ইঁদুরটি বড় কাঠের আলমারির নীচে পাওয়া যায়। তখনই অনেকের খেয়াল হয় যে উপপ্রধান সাহেব আজ সকালবেলাতেই প্লাস্টিক কিং মোহন মেহতাকে বহুক্ষণ জেরা করেছেন কালো টাকার ব্যাপারে। সঙ্গে সঙ্গে মোহন মেহতার বাড়িতে ও অফিসে সার্চ করা হল, কয়েক হাজার বিষাক্ত প্লাস্টিকের ইঁদুর বেরোল এই দুই জায়গা থেকে এবং এর পর থেকে সবাই জেনে গেল যে কলকাতায় সব ইঁদুর কামড়ের কেসই আসল ইঁদুরের কামড় নয়, অনেকগুলিই প্লাস্টিকের নকল বিষাক্ত ইঁদুরের কাজ।

সে যা হোক এর পর থেকে গোয়েন্দা দপ্তর ছোটবড়, নানারকম গোলমেলে কেসে সহদেব ডাক্তারের পরামর্শ নিতে লাগলেন। এবং সেই সূত্রেই মিস জুলেখা তাকে গতকাল যোগাযোগ করেন। পুলিশ দপ্তর স্বামী চুরির, বিশেষত মিস জুলেখার স্বামী চুরির, পটললাল পালের মতো স্বামী চুরির কেস সহজে হাতে নিতে চায়নি, তাঁরাই ডাক্তার সহদেব শুককে অনুরোধ করে কেসটা নিতে।

.

কেসটা গতকালই নিয়েছেন সহদেববাবু। বিকেলবেলাতেই থিয়েটার হলে যাওয়ার পথে মিস জুলেখা সহদেববাবুর চেম্বারে এসেছিলেন।

সহদেববাবু ধরে নিয়েছিলেন এটাও কোনও ইঁদুরের কামড়ের কেস। তাই সরাসরি মিস জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কোথায় কামড়েছে?

মিস জুলেখা বলেন, কামড়ায়-টামড়ায়নি। চুরি গেছে।

ঠিক এই সময়েই পুলিশের ফোন আসে। তারা কেসটির কথা উল্লেখ করে জানান যে মিস জুলেখাকে তারাই পাঠিয়েছেন।

তখন মিস জুলেখার হাতে মোটেই সময় ছিল না। নাটকের সময় হয়ে গেছে। তিনি ডাঃ সহদেব শুককে অনুরোধ করলেন তিনি যদি এই সন্ধ্যায় সরোজিনী মঞ্চে একবার আসেন, তাহলে সহদেববাবুর যৌবনের লীলা নাটকটি তৎসহ উপরি পাওনা মিস জুলেখার নাচও দেখা হয়, আর সেই সঙ্গে ইন্টারভ্যালের সময় পটললাল পালের চুরি যাওয়ার কাহিনিও শুনতে পারেন। থিয়েটারের গেটে গিয়ে তিনি যেন দারোয়ানকে মিস জুলেখার কথা বলেন, তা হলে দারোয়ান তাকে সরাসরি গ্রিনরুমে নিয়ে যাবে, সেখানেই উইংসের আড়ালে একটা চেয়ারে বসে নাটকটা দেখতে পারবেন।

তাই হল, মিস জুলেখা চলে যাওয়ার আধঘণ্টা পরে একটু সাজগোজ করে একটা ট্যাকসি ডেকে সহদেববাবু সরোজিনী মঞ্চে পৌঁছালেন, সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান তাকে গ্রিনরুমে নিয়ে গেল।

সেখানে বেশ ভিড়। প্রযোজক-পরিচালক সমেত আরও বেশ কয়েকজন মিস জুলেখার মেক-আপ করা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং মেক-আপম্যান দিল মহম্মদকে নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছেন। একটু পরেই মিস জুলেখার নাচের সিন।

শরীরে তরঙ্গ তুলে, চোখ নাচিয়ে মিস জুলেখা সহদেববাবুকে স্বাগত জানালেন। তারপর পরীর মতো হালকা নীল রঙের ওড়না উড়িয়ে এক লাফে গিয়ে পড়লেন স্টেজের ঠিক মাঝখানে এবং মুহূর্তের মধ্যে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন সেই নীল ওড়না, তারপর সেকী তাথৈ তাথৈ নৃত্য, এই ভারী শরীরে এমন কসরত করা যে সম্ভব চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

দর্শকবৃন্দ চেয়ারের হাতলে চাটি মেরে আহা, আহা, মার হাব্বা, মার হাব্বা, মর গিয়া, জানলে লিয়া বলে চেঁচাতে লাগল। মঞ্চ জুড়ে সে কী দাপাদাপি মিস জুলেখার, দৌড়ে, লাফিয়ে, ঘুরপাক খেয়ে, চিত হয়ে শুয়ে, উপুড় হয়ে বসে নীল আলো, লাল আলো, বেগুনি আলোয় নাচ করতে লাগলেন মিস জুলেখা। শেষের দিকে একদম উদ্দাম হয়ে গেলেন, এতক্ষণ কোমরের দোলায় কদম ফুল দুটো বাত্যাতাড়িত বৃক্ষশাখায় ফলের মতো আন্দোলিত হচ্ছিল, এবার সে দুটো মঞ্চের ওপর। খসে পড়ে গেল।

দর্শকরা অনেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ পয়সা ছুঁড়তে লাগল, শিস দিতে লাগল। কদম ফুল দুটি মঞ্চের ওপর থেকে মিস জুলেখা পদাঘাতে হলের দিকে বল কিক করার মতো করে পাঠিয়ে দিলেন। সেই কদম ফুল কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যে হলের ভেতরে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। ড্রপসিন নেমে এল সেই মুহূর্তে।

বদন মণ্ডলে, সুডৌল বাহুতে এবং শরীরে সর্বত্র স্বেদবিন্দু, উত্তেজনায় ও পরিশ্রমে ঘনঘন নিশ্বাস পড়ছে, নাক ফুলে ফুলে উঠছে, মিস জুলেখা উইংস দিয়ে বেরোনোর পথে সহদেববাবুর বাহু আকর্ষণ করে পাশের একটা ছোট ঘরে প্রবেশ করলেন।

সহদেববাবুর বুকের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগল, তিনি জীবনে এমন অবস্থার সম্মুখীন এর আগে কখনও হননি।

কিন্তু তেমন গুরুতর কিছু ঘটল না। মিস জুলেখা একটু দম নিয়ে তারপর চোখেমুখে একটা মোহময়ী ভাব এনে মদির দৃষ্টি মেলে সহদেববাবুকে বললেন, নাচ কেমন দেখলেন?

তারপর সহদেববাবুর থতমত খাওয়ার অবস্থা দেখে বললেন, আসলে জানেন এই নাটকের স্টোরিটা খুব প্যাথেটিক, নাচটা হল একটা কলেজে পড়া ভদ্রঘরের মেয়ের, সে এম এ পরীক্ষার ফি দিতে পারছে না, সেই টাকা জোগাড় করার জন্যে হোটেলে নাচছে।

ইতিমধ্যে মিস জুলেখার নির্দেশানুসারে দুটো কোল্ড ড্রিঙ্ক এসেছে, সত্যিই কোল্ড, বেশ ঠান্ডা।

সেই ঠান্ডা পানীয় ঔ দিয়ে ঢকঢক করে খেতে খেতে মিস জুলেখা বললেন, আমার পরের নাচ আধঘণ্টা পরে। সে নাচটাও খুব দুঃখের। মেয়েটা পরীক্ষা ভালই দিয়েছে, কিন্তু পরীক্ষার খাতা যে লোকটা দেখছে সে লোকটা শালা এক নম্বরের লম্পট। সে বলেছে আমাকে ড্যান্স দেখাতে হবে না হলে আমি তোমাকে পাশ করাব না। বাধ্য হয়ে মনের দুঃখে মেয়েটা ড্যান্স করছে।

এতক্ষণ সহদেববাবু কোনও কথা বলেননি। এবার বললেন, তাই নাকি?

মিস জুলেখা বললেন, যাক এসব কথা। এবার পটলের ব্যাপারটা বলি।

মিস জুলেখার কাছ থেকে যতটুকু জানা গেল তা হল এই রকম।

পটল অর্থাৎ পটললাল পালকে মিস জুলেখা অনেকদিন ধরেই চেনেন। তাঁর পূর্বতন স্বামী আগরওয়ালার সঙ্গে পরিচয় ও ধর্মান্তরিত করে বিয়ে দেওয়া দুটোতেই পটললালের মুখ্য ভূমিকা ছিল, সে ছিল আগরওয়ালার গোপন কাজের সহায়ক।

যদিও পটললাল বয়েসে অনেক ছোট, আগরওয়ালার মৃত্যুর পর পটলকেই বিয়ে করেন মিস জুলেখা। কিন্তু তখন তিনি জানতেন না যে পটললাল কপর্দকশূন্য।

তা হোক, পটললালকে তিনি ছাড়তে চান না। বিয়ে করে করে তিনি হদ্দ হয়ে গেছেন। পটললালের খরচ খরচা সবই তিনি চালাবেন। কালীঘাটের মা কালীর কাছে প্রার্থনা করে মাদুলি নিয়ে এসেছেন যাতে তাকে এরপরে আর বিয়ে করতে না হয়।

এই পর্যন্ত বলে মিস জুলেখা কোমরের মাদুলিটা হাত দিয়ে দেখালেন, সহদেববাবু বললেন, থাক, থাক।

এবার মিস জুলেখা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, পটল, আমার পটললাল চুরি হয়ে গেল।

সহদেববাবু বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, চুরি হয়ে গেল? চুরি হয়ে গেল মানে কী? একটা সদ্য মানুষ, আস্ত মানুষ চুরি হয়ে যায় কী করে?

চোখের জল, স্টেজ থেকে কুড়িয়ে আনা সেই নীল ওড়নাটা দিয়ে মুছে মিস জুলেখা বললেন, তাই তো হল, শয়তানি রেশমকুমারীর কাজ ওটা।

ব্যাপারটা প্রথমে না বুঝলেও ধীরে ধীরে সহদেববাবু মিস জুলেখার কাছ থেকে জানতে পারলেন রেশমকুমারী হল যাত্রার নায়িকা। মিস জুলেখা যেমন মোটেই মিস নন, তেমনিই শ্রীমতী রেশমকুমারী কুমারী নন, তিনি পটললালের প্রথমা স্ত্রী।

একেবারে সেই পরশুরামের ভূষণ্ডির মাঠের কাহিনি। যখন পটললাল ও রেশমকুমারী একত্রে থাকতেন, দৈনিক অলস, অকর্মণ্য পটললালকে রেশমকুমারী জুতো পেটা করতেন। পটললালের বুকে, পিঠে হাই হিলের লাঞ্ছনা চিহ্ন মিস জুলেখা অনেক দেখেছেন। পটললাল যখন এসে কেঁদে পড়তেন, অনেক নারকেল তেল, মলম সেসব ক্ষতস্থানে মিস জুলেখা লাগিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু আজ দু-আড়াই বছর পটললাল-রেশমকুমারীর ছাড়াছাড়ি। রেশমকুমারীর সোনার নাকছাবি চুরি করে সেই যে পটললাল পালিয়েছিলেন তারপর রেশমকুমারী তাঁর আর খোঁজখবর নেননি।

এখন এতদিন পরে মিস জুলেখা পটললালকে মালা বদল করে কালী সাক্ষী রেখে জীবনসঙ্গী করার পর আবার পটললালের ওপরে রেশমকুমারীর দৃষ্টি পড়েছে।

কিন্তু মিস জুলেখাই বা তার দাবি ছাড়বেন কেন? রীতিমতো সোয়া একান্ন টাকার ধর্মবিয়ে। পটললালের ওপর তার অধিকারই বা কম কী?

এই নিয়ে রেশমকুমারীর সঙ্গে মিস জুলেখার অনেক বচসা, চিৎকার-চেঁচামেচি, হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে পটললালের মনোভাব এতদিন কিছুই বুঝতে পারেননি মিস জুলেখা।

০৪. পটললাল পাল

পটললাল পালের চরিত্র বর্ণনার খুব বেশি প্রয়োজন নেই।

গতদিনের মিস জুলেখার ঘটনাটা বললেন বেশ কিছুটা বোঝা যাবে।

সাধারণত নাচের পর মঞ্চ থেকে দর্শকদের ছুঁড়ে দেওয়া খুচরো টাকাপয়সা মিস জুলেখা কুড়োন না। বৃদ্ধ প্রম্পটার ড্রপসিন পড়ার পর সেগুলো কুড়িয়ে কিছু নিয়ে নেয়, কিছু মিস জুলেখাকে দেয়।

কিন্তু দুদিন আগের সন্ধ্যায় এক মাতাল দর্শক নাচের দৃশ্যে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে প্রথমে খুচরো পয়সা, তারপরে দু-টাকা নোট, তারপরে আরও বড় নোট এবং অবশেষে দুটো একশো টাকার নোট মঞ্চে ছুঁড়ে দেয়।

একশো টাকার নোট দুটো ফেলে আসেননি মিস জুলেখা। ড্রপসিন পড়ার পর ওই নোটদুটো নিজেই কুড়িয়ে আনেন এবং তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে রাখেন।

রাতে আর খেয়াল ছিল না। শোয়ার ঘরের টেবিলের ওপরে ভ্যানিটি ব্যাগটা ফেলে রেখে ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়েছিলেন। বিছানার অন্য প্রান্তে পটললাল আগে থেকেই নিদ্রামগ্ন ছিলেন।

অনেক বেলায় ঘুম থেকে উঠে মিস জুলেখা দেখলেন পটললাল বাড়িতে নেই। বীণাপাণি নামে তাঁর কাজের লোককে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, জামাইবাবু একটু আগে বেরিয়েছে।

পটললালের যে কিঞ্চিৎ হাতটানের স্বভাব আছে সেটা বহুকাল ধরেই মিস জুলেখার বিলক্ষণ জানা। চট করে তার মনে পড়ে গেল গতকাল রাতের সেই দুটো একশো টাকার নোটের কথা।

যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। একশো টাকার নোট দুটো ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে উধাও, সেই সঙ্গে পটললালও উধাও হয়েছেন।

সাধারণত, এরকম ক্ষেত্রে দুয়েকদিন বাদে পটললাল ফিরে আসেন। কিন্তু এদিন বিকেলেই পটললাল ফিরলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল পটললালের পাঞ্জাবির কলার চেপে বলশালিনী মিস জুলেখা তার সবকয়টি পকেট সার্চ করলেন।

বুক পকেট থেকে বেরোল সেকরার দোকানের একটা রসিদ, শ্রীলক্ষ্মী জুয়েলারি ওয়ার্কস, প্রোঃ হারাধন রায়। রসিদটা পটললাল পালেরই নামে, লেখা আছে লাল পাথর বসানো নাকছাবি বাবদ অগ্রিম দুশো টাকা।

রসিদটা দেখামাত্র মিস জুলেখার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। নাকছাবির অগ্রিম রসিদ দেখেই বুঝতে পারলেন এটা সেই শয়তানি রেশমকুমারীর জন্যে বায়না দেওয়া হয়েছে। একদা রেশমকুমারীর নাকছাবি চুরি করে পটললাল পালিয়েছিলেন। এখন সেই নাকছাবি উপহার দিয়েই আবার ঘনিষ্ঠতা শুরু হচ্ছে।

রেশমকুমারীর মতো কথায় কথায় জুতো চলে না মিস জুলেখার। তবে হাত ভালই চলে। গোটা কয়েক থাবড়া মেরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে শোবার ঘরের পাশে বক্সরুমে পটললালকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিলেন। থাকুক এই গরমে একটা রাত এই অন্ধকূপে বন্দি। এতে যদি বিশ্বাসঘাতকের কিছু শিক্ষা হয়।

.

পটললালকে বক্সরুমে আটকিয়ে রেখে মিস জুলেখা নাচতে চলে গেলেন।

 ফিরে এলেন রাত দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ। পটললালের অধঃপতনে মর্মাহত হয়ে আজ বহুদিন পরে তিনি এক বোতল দিশি মদ টেনেছেন। আজ দিল মহম্মদ বা অন্য কাউকে তার কোমরের মাদুলি নিয়ে গোছগাছ করতে বাধা দেননি।

মিস জুলেখা বাড়ি ফিরলেন রীতিমতো স্খলিত চরণে। প্রায় টলতে টলতে। তখনও বক্সরুমের বাইরের শেকলটা আটকানো।

ক্লান্ত দেহে বিছানায় শুয়ে মিস জুলেখা অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বক্সরুমের মধ্যে নানারকম খুটখাট শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বুঝলেন পটললাল বন্ধ ঘরের মধ্যে চলাফেরা করছে। জানলাহীন বন্ধ ঘরে এই গুমোটে হয়তো পটললালের দম আটকিয়ে আসছে।

পটললালের ওপর এতক্ষণে একটু মায়া হল মিস জুলেখার। তিনি উঠে গিয়ে অন্ধকারে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে বক্সরুমের দরজাটার শিকলটা খুলে দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল। ঘরের মধ্যে থেকে চকিতে যিনি বেরিয়ে এলেন তিনি কিন্তু মোটেই পটললাল নন। সালোয়ার কামিজ পরিহিতা এক দশাসই মহিলা বেরলেন ঘর থেকে। কিঞ্চিৎ মত্ত হলেও শ্রীমতী জুলেখার জ্ঞান বেশ টনটনে থাকে, তিনি তাড়াতাড়ি দরজার পাশে দেয়ালে আলোর সুইচটা জ্বালিয়ে দিলেন।

আলো জ্বলতে মিস জুলেখা দেখতে পেলেন যে মহিলাটি আর কেউ নন যাত্ৰাসুন্দরী রেশমকুমারী। মুহূর্তের মধ্যে একটি সবল বাহুর চড়ে মেঝের ওপরে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন মিস জুলেখা। পড়ার মুহূর্তে দেখলেন রেশমকুমারীর পিছু পিছু প্রথমে পটললাল এবং তার পিছে কাজের মেয়ে বীণাপাণি বেরোল।

মনে হল বাইরে বারান্দায় আরও দুয়েকজন লোক রয়েছে। রেশমকুমারী পটললালের হাত ধরে দৌড়ে গেলেন। সিঁড়িতে বেশ কয়েক জোড়া ছুটে যাওয়া পায়ের শব্দ শুনতে শুনতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন মিস জুলেখা। তার মুখেচোখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে বীণাপাণির পনেরো মিনিট লাগল। জ্ঞান ফিরে এলে বীণাপাণির মুখে শুনলেন যে রাত আটটা নাগাদ কয়েকজন ষণ্ডামার্কা লোক নিয়ে রেশমকুমারী এসে বীণাপাণিকে ভয় দেখিয়ে জেনে নেন পটললাল কোথায়। তারপর বীণাপাণিকে নিয়ে তিনি ওই বন্ধ ঘরে ঢুকে যান এবং পটললালকে বলেন, আজ জুলেখাকে শিক্ষা দেব আর বীণাপাণিকে বলেন, একদম চুপ করে থাক।

.

মিস জুলেখা থাকেন মৌলালির কাছে একটা পুরনো গলিতে। জায়গাটা কড়েয়া রোড থেকে তেমন দূরে নয়। এক ট্রামেই যাওয়া যায়।

আজ মিস জুলেখার শো নেই। আজ তাঁর নাটকের অফ ডে। এসব দিনে অনেক সময় তিনি সন্ধ্যার দিকে কোন বারে গিয়ে এক্সট্রা নাচিয়ে হিসেবে কিছু উপরি উপার্জন করেন। কিন্তু স্বামী পটললালের শোকে তিনি ক্রমশ উথালপাতাল হয়ে উঠেছেন। উপরি রোজগারে তার রুচি নেই। তিনি প্রায় শয্যাশায়িনী হয়ে রয়েছেন।

মিস জুলেখার ওখানে সন্ধ্যার দিকে যাওয়ার কথা ডাক্তার সহদেব শুকের। কিন্তু তার আর তর সইছে না। গরমের দিনের দীর্ঘ বিকেল, দিনের আর অন্ত নেই। সাতটার আগে সন্ধ্যা হবে না।

বহুদিন ধুতি পাঞ্জাবি পরেননি সহদেববাবু। আজ বিকেল পাঁচটা থেকে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন আর গরমে গলগল করে ঘামছেন।

বাইরের ঘরে পাখার নীচে বসে একটা আলগা তন্দ্রায় চোখ জড়িয়ে এসেছিল ডাক্তার সহদেব শুকের, সেই তন্দ্রার ঘোরে আবছায়া স্বপ্নে দেখলেন কালকের মঞ্চের সেই নীল ওড়নাটা একটা ফুলের মালার মতো গলায় জড়িয়ে মিস জুলেখা তার কাছে এসে তার গলায় সেই নীল ওড়নার মালাটা পরিয়ে দিয়ে বলছেন, তুমিই আমার পটললাল।

তাড়াতাড়ি সুখস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে সহদেববাবু ভাবলেন, দেরি হয়ে গেল। কিন্তু দেয়ালঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন তখনও ছটা বাজতে পাঁচ সাত মিনিট বাকি। বাথরুমে গিয়ে মুখে  চোখে জল দিয়ে বাইরের ঘরে ফিরে এসে আবার বসলেন তিনি। একটু আগের স্বপ্নের আমেজটা তখনও তাকে জড়িয়ে রয়েছে। নীল ওড়না কী করে ফুলের মালা হয়ে গেল সেই কথা ভাবতে লাগলেন সহদেববাবু।

অথচ তার এখন ভাবার কথা পটললালের অন্তর্ধান নিয়ে, রহস্যজনকভাবে পটললালের গায়েব অথবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে।

দুঃখের বিষয় পটললাল বিষয়ে কিছুই ভাবতে পারছেন না গোয়েন্দাপ্রবর সহদেব শুক। পটললালের কথা ভাবার আগেই মিস জুলেখার লাস্যময়ী নৃত্যদৃশ্য ফিরে আসছে তার অক্ষিপটে। তার সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে নীল ওড়নার ছায়ায়।

কিন্তু পটললালের ব্যাপারটা নিয়েই তো ভাবতে হবে। মিস জুলেখা সহদেববাবু গেলে পরেই জানতে চাইবেন, কতদূর কী করলেন? আমার পটললাল, প্রাণের পটললাল কোথায়?

যা হোক, কোনওভাবে সোয়া ছটা বাজল। বাইরে রোদ মিলিয়ে এসেছে। সুসজ্জিত সহদেব শুক বাড়ি থেকে বেরোলেন। মোড়ে গিয়ে ট্রামে উঠে মৌলালিতে নামলেই মিস জুলেখার ঠিকানায় পৌঁছে যাবেন।

কিন্তু সহদেববাবু আর দেরি করতে পারছেন না। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েই সামনে একটা ট্যাকসি পেয়ে সেটাতেই উঠে বসলেন।

ট্যাকসিটা মল্লিকবাজার আর পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে ট্রাফিক পয়েন্টে অনেকক্ষণ আটকিয়ে গেল। মোড়ের মুখে একটি অল্পবয়েসি ছেলে দৈনিক পত্রিকার সান্ধ্য বিক্রি করছিল। মাত্র পঞ্চাশ পয়সা দাম। আর এই সান্ধ্য সংস্করণে অনেক রকম রোমাঞ্চকর খবর থাকে যা সকালের কাগজে সাধারণত পাওয়া যায় না।

এক কপি কাগজ ট্যাকসির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সহদেববাবু কিনলেন।

এবং তারপরেই সহদেববাবুর চমকিত হওয়ার পালা।

একেবারে প্রথম পাতায় কাটারি হাতে সকালবেলার ডাবওয়ালার ছবি ছাপা হয়েছে এবং তার পাশে সংবাদ, সেই সংবাদের হেডলাইন হল, ডাকাতির দায়ে ক্যাবারে নর্তকীর স্বামী গ্রেপ্তার। সংবাদের মধ্যে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়েছে।…জেরার মুখে পুলিশের কাছে আসামি কবুল করেছে যে তার নাম হল পটললাল, সে বিখ্যাত ক্যাবারে নাচিয়ে মিস জুলেখার বর্তমান স্বামী।

…আজ সকালে একটি বহুতল বাড়ির লিফটের মধ্যে মারাত্মক কাটারি হাতে একটি নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশ প্রচণ্ড তৎপরতার সঙ্গে তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। স্থানীয় থানা থেকে। দুপুরবেলা তাকে গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে গোয়েন্দা দপ্তরের উপপ্রধান স্বয়ং তাকে জেরা করছেন।

..দুপুরবেলাতেই আসামিকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পটললালের হয়ে কেউ জামিনের আবেদন করেনি। বিচারক তাকে সাতদিন পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

…আবার গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে এসে তার জেরা চলছে। কিন্তু পটললাল এখনও স্বীকার করেনি যে সে ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে ওই বহুতল বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। তার হাতে কাটারি কেন ছিল সেই প্রশ্নের উত্তরে পটললাল প্রতিবারই বলছে যে ওই কাটারি ডাকাতির জন্যে নয়, ডাবকাটার জন্যে সে আনছিল। পুলিশ অবশ্য এই আজগুবি কথা বিশ্বাস করেনি।

এই সংবাদ পাঠ করতে সহদেববাবুর এক মিনিটও লাগেনি।

ততক্ষণে ট্রাফিক খুলে গেছে, ট্যাকসি লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে মল্লিকবাজার পেরিয়ে গেছে।

সংবাদটি পাঠ করে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন সহদেববাবু। কীসে কী হয়, কীসে কী মিলে যায়।

আশ্চর্য, পটললালকে এত সহজে পেয়ে যাবেন সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি সহদেব গোয়েন্দা।

কিন্তু এখন নিরীহ পটললালকে উদ্ধার করতে হবে। বলতে গেলে পটললালের বর্তমান হেনস্থার জন্যে সহদেববাবু নিজেও অনেকটা দায়ী। তিনি কাটারির অনুসন্ধান না দিলে পটললাল কাটারির অস্তিত্ব জানতেই পারত না, এইরকম গোলমালেও পড়ত না।

তাড়াতাড়ি ট্যাকসি ঘুরিয়ে সহদেববাবু গোয়েন্দা দপ্তরে চলে গেলেন। সেখানে পুলিশের গোয়েন্দা উপপ্রধান তখনও পটললালের জেরা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পটললালকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারলেন সহদেববাবু। সেই কালো ফুলপ্যান্ট, লাল স্পোর্টস গেঞ্জি, সকালের সেই চৌরঙ্গি মোড়ের ডাবওয়ালা।

সহদেববাবুকে দেখে গোয়েন্দা উপপ্রধান জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? মিস জুলেখার স্বামী রত্নটিকে দেখছেন? আপনি উদ্ধার করার আগেই আমরা ওকে গ্রেপ্তার করেছি। একেবারে সাক্ষাৎ ডাকাত।

এবার সহদেববাবু বললেন, এ লোকটা কিন্তু ডাকাত নয়। পুরো ব্যাপারটার আমি সাক্ষী।

সহদেববাবুর কথায় মনে জোর পেয়ে হঠাৎ বারান্দার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে পটললাল বললেন, ওই তো। ওই তো।

দেখা গেল বারান্দায় একটি বেঁটে মতন লোক, মাথায় টাক, পরনে পাজামা, ফুলশার্ট, হাওয়াই চপ্পল ঘুরঘুর করছে। তাকে ভেতরে ডেকে আনা হল।

চেহারা, জামাকাপড় ইত্যাদি দেখে এবং পটললালের ওই তো, ওই তো শুনে সহদেববাবুর কী মনে হওয়াতে তিনি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি থিয়েটার রোডের মোড়ের ফ্ল্যাট বাড়িটার কেয়ারটেকার?

লোকটি খুবই ভিতু প্রকৃতির, সামনের একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে বলল, হ্যাঁ। আমার নাম নিতাই সামন্ত, আমি ওই বাড়ির কেয়ারটেকার, সতেরো তলার চিলেকোঠায় থাকি।

গোয়েন্দা উপপ্রধান বিস্মিত হয়ে ব্যাপার কী ঘটে লক্ষ করতে লাগলেন।

সহদেববাবু নিতাই সামন্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাটারিটা আপনিই ওকে দিয়েছিলেন?

 নিতাই বলল, হ্যাঁ।

সহদেববাবু বললেন, তা হলে পুলিশ যখন ওকে গ্রেপ্তার করল আপনি একটু এগিয়ে এসে সব কথা বললে এই লোকটির বিনা দোষে এতটা হেনস্থা হত না।

নিতাই বলল, আমি ছিলাম বাথরুমে। তা ছাড়া সতেরো তলায় যে নীচের কোনও শব্দ পৌঁছায়। না। তা ছাড়া লোডশেডিংয়ে লিফটও বন্ধ, ওঠানামা নেই। অনেক পরে যখন ঘটনাটা শুনলাম তখন পুলিশ ওকে নিয়ে চলে এসেছে।

সহদেববাবু বললেন, তখন পুলিশের কাছে চলে গেলেন না কেন?

নিতাই বলল, পুলিশকে বড় ভয় পাই। বিশেষ করে থানায় ঢুকতে বুক দুরদুর করে। পরে যখন শুনলাম এখানে নিয়ে এসেছে, বিবেকের দংশনে ভয়ে ভয়ে চলে এলাম। তাও ভেতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছিলাম না।

সহদেববাবু বললেন, সে তো দেখলাম।

.

গোয়েন্দা উপপ্রধানকে সকালবেলার পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে বলতেই তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। কাটারিটা বাজেয়াপ্ত করে পটললালকে তিনি ছেড়ে দিলেন।

পটললালকে নিয়ে আবার ট্যাকসি করে এবার সরাসরি মিস জুলেখার মৌলালির আস্তানায় রওনা হলেন সহদেববাবু।

ট্যাকসিতে যেতে যেতে পটললাল তার বিড়ম্বিত জীবনের কথা সহদেববাবুকে বললেন। সব কথা লিখে লাভ নেই, এই কাহিনিতে তার প্রয়োজনও নেই। গত পরশু দিন সন্ধ্যার পর থেকে ঘটনাবলি হলেই চলবে।

সেদিন মিস জুলেখা থিয়েটার হলে চলে যাওয়ার পর তিনজন শক্তিশালী অনুগ্রাহককে নিয়ে এসে রেশমকুমারী জুলেখার বাড়িতে হামলা চালায়। তখন বীণাপাণি একাই ছিল বাড়িতে। তাকে ভয় দেখিয়ে জেনে নেয় পটললাল কোথায়।

 কিন্তু শুধু পটললালকে উদ্ধার করাই রেশমকুমারীর উদ্দেশ্য ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন মিস জুলেখাকেও শিক্ষা দিতে যাতে পটললালের ওপর স্বত্ব মিস জুলেখা ছেড়ে দেয়।

বীণাপাণি যাতে চেঁচামেচি করতে না পারে সেই জন্যে ঠিক হল তাকেও পটললালের ঘরে শিকল দিয়ে রাখা হবে। কিন্তু বীণাপাণি এতে কাদাকাটি করতে থাকে, বলতে থাকে, জামাইবাবুর সঙ্গে আমাকে একই ঘরে আটকিয়ে রেখো না। আমি তাহলে আর লোকজনকে মুখ দেখাতে পারব না।

বীণাপাণির বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। তখন রেশমকুমারী সিদ্ধান্ত নিলেন বীণাপাণির সঙ্গে তিনিও ওই ঘরে পটললালের সঙ্গে থাকবেন। বাইরে থেকে শিকল তুলে দিলে আর বোঝা যাবে না ভেতরে পটললাল ছাড়াও অন্যেরা রয়েছে।

থিয়েটার থেকে ফিরে কোনওদিনই মিস জুলেখা বীণাপাণির খোঁজ করেন না। বাইরে থেকেই খেয়ে আসেন, বাড়ি ফিরে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়েন।

রেশমকুমারীর হিসেবমতো আজও ঠিক তাই হয়েছিল। তা ছাড়া মিস জুলেখা শুয়ে পড়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়েন।

কিন্তু গলদ হয়েছিল অন্য জায়গায়। যে লোকটিকে রেশমকুমারী মিস জুলেখা ঘুমিয়ে পড়লে বক্সরুমের শিকল খুলে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সে নামকরা গুণ্ডা হলেও সাংঘাতিক ঘুমকাতুরে। মিস জুলেখা ঘুমিয়ে পড়ার আগেই সে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ে, ফলে দরজা খোলা হয় না।

তখন বাধ্য হয়ে রেশমকুমারীকে খুটখাট শব্দ করতে হয়, ওইটুকু বদ্ধ ঘরে, গরমে, গুমোটে তিনজনের দমবন্ধ হয়ে আসছিল।

এর পরের ঘটনা তো আগেই বলেছি।

পটললালের কাহিনি শুনতে শুনতে ট্যাকসি মিস জুলেখার বাড়িতে পৌঁছে গেল। শুধু আরেকটা প্রশ্ন ছিল সহদেববাবুর, ডাবওয়ালা হতে গেলেন কেন?

পটললাল বললেন, জুলেখার বাড়ি থেকে দৌড়ে পালানোর সময় আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, বললাম, জুলেখা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। এভাবে তাকে ফেলে যেতে পারব না। সঙ্গে সঙ্গে রেশম আমাকে লাথি মারে, আমি মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। রেশমের লোকেরা আমাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলে রেশমের বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন দুপুরে রেশম যখন রিহার্সাল দিতে যায় আমিও পালাই। তারপরে সেকরার দোকানে গিয়ে বলি, নাকছাবি লাগবে না, আমার অগ্রিম দুশো টাকা ফেরত দিন। লোকটা একটু গাঁইগুঁই করে শেষে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিল। সেই টাকা নিয়ে ভাবলাম নিজের পায়ে পঁড়াব, থিয়েটার রোডের মোড়ে ডাবের ব্যাপারির কারবারটা কিনে নিলাম। তার পরে তো আপনি জানেন।

মিস জুলেখা পটললালকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। শুধু একটাই প্রশ্ন, পটললাল আবার পালাবে না তো? সহদেব বললেন, পালালেও রেশমকুমারীর কাছে আর যাবে বলে মনে হয় না। এমনকী ওর নাকছাবির বায়নার টাকাও ফেরত নিয়ে এসেছে।

আপাতত এতেই সন্তুষ্ট মিস জুলেখা। পটললালকে নিয়ে তিনি নৈশভোজ করতে পার্ক স্ট্রিটের দিকে রওনা হলেন। ডাক্তার সহদেব শুককেও সঙ্গ দিতে বললেন। সহদেববাবু বাইরে খান না। স্বপাক খান। তাই গেলেন না।

এই মিলনান্ত কাহিনির অবশেষে একটা ছোট দুঃখের ব্যাপার আছে।

ডাক্তার সহদেব শুক ভেবেছিলেন মিস জুলেখা তাঁকে ফি দেবেন তার দু মাসের নাচের মজুরি, দশ হাজার টাকা। মিস জুলেখা তো স্পষ্টই বলেছিলেন, আমার দু মাসের নাচ।

কিন্তু তার মানে যে নগদ টাকা নয়, মিস জুলেখা তাঁকে দু মাস উইংস থেকে তার নাচ উপভোগ করতে দেবেন সেটা সহদেব ডাক্তার ভাবেননি। সহদেব ডাক্তারের যে খুব ক্ষতি হয়েছে তা কিন্তু মনে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত একটি শো-ও তিনি বাদ দেননি। প্রতি সন্ধ্যায় জুলেখার মোহময়ী নৃত্যে তিনি মশগুল।

.

পুনশ্চ:

এই রসরহস্য কাহিনির নায়িকা মিস জুলেখা ওরফে শ্রীমতী লেখা ভট্টাচার্যের (তিন) ছেলেমেয়ে। কিন্তু কাহিনিটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে রচিত বলে ওই তিন বালক-বালিকাকে কাহিনির বাইরে রেখেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *