১১
মিঃ সান্যাল সিটের উপর বসে পড়েছেন। এবার কাঁপুনিটা রাগের নয়, ভয়ের, কারণ তিনি জানেন তিনি জব্দ, তাঁর আর পালাবার পথ নেই।
এদিকে শুটিং-এ গণ্ডগোল বুঝে কেউ নিশ্চয়ই চেন টেনে দিয়েছে, কারণ ট্রেনটা যেভাবে থামল সেটা চেন টানলেই হয়।
থামার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শোরগোল শুনতে পেলাম। একই লোকের নাম ধরে অনেকে চিৎকার করছে।
‘ভিক্টর! ভিক্টর! কোথায় গেল, ভিক্টর?’
পুলকবাবুর গলা। যত গণ্ডগোল তো ভিক্টরকে নিয়েই, কারণ তার লাফিয়ে পড়ার কথা ছাতে, আর সে কিনা সোজা এসে ঢুকেছে আমাদের কামরায়।
ফেলুদা দরজা খুলে মুখ বার করে পুলকবাবুকে ডাকলেন।
‘এই যে মশাই, এদিকে।’
ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে আমাদের কামরায় উঠে এলেন। দেখে মনে হল তাঁর শেষ অবস্থা, কারণ শুনেছি এই ধরনের একটা শটে গণ্ডগোল হওয়া মানে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা জলে যাওয়া।
‘ব্যাপার কী, ভিক্টর? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?’
‘আপনার ছবিতে জেট বাহাদুর আখ্যা একমাত্র ভিক্টর পেরুমলই পেতে পারে, পুলকবাবু।’
‘তার মানে?’ পুলকবাবু অবাক হয়ে দেখলেন ফেলুদার দিকে। তার ফ্যালফ্যালে ভাবটার মধ্যে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে বিরক্তি মেশানো রয়েছে।
‘আর স্মাগলারের পার্টটা পরমেশ কাপুরকে না দিয়ে আপনার এঁকে দেওয়া উচিত ছিল।’
‘কী সব উলটোপালটা বকছেন। ইনি কে?’ পুলকবাবু মিঃ সান্যালের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ইতিমধ্যে ডানদিকের রাস্তায় দুটো নতুন গাড়ির আবির্ভাব হয়েছে—একটা পুলিশ জিপ আর একটা পুলিশ ভ্যান। জিপটা আমাদের কামরার পাশেই এসে থামল। তার থেকে নামলেন ইনস্পেক্টর পটবর্ধন।
এইবার পুলকবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা মিঃ সান্যালের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুই টানে তাঁর দাড়ি আর গোঁফ, আর আরও দুই টানে তাঁর পরচুলা আর চশমাটা খুলে ফেলে দিয়ে বলল—
‘আপনার গা থেকে গুলবাহারের গন্ধটাও টেনে খুলে ফেলতে পারলে খুশি হতাম মিস্টার গোরে, কিন্তু ওই একটি ব্যাপারে ফেলু মিত্তিরও অপারগ।’
* * *
‘প্রোডিউসার মিসায় ধরা পড়লে ছবি বন্ধ হয়ে যাবে এ কথা আপনাকে কে বললে, লালুদা?’
প্রশ্নটা করলেন পুলকবাবু। লালমোহনবাবু কিছুই বলেননি, কেবল ঘাড় গোঁজ করে গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন; যদিও এটা ঠিক যে গম্ভীর হবার একটা কারণ হল জেট বাহাদুরের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তা।
‘জেট বাহাদুরকে কেউ রুখতে পারবে না, লালুদা’, বললেন পুলকবাবু। ‘গোরে চুলোয় যাক, গোল্লায় যাক, হাজতে যাক, যেখানে খুশি যাক—প্রোডিউসার তো আর বম্বেতে একটা নয়। চুনি পাঞ্চোলি তো এক বছর থেকে আমার পেছনে লেগে আছে—দেখবেন আপনারা থাকতে থাকতেই নতুন ব্যানারে আবার কাজ আরম্ভ হয়ে গেছে।’
আজকের শুটিং অবিশ্যি সেই দেড়টায় বন্ধ হয়ে গেছে। গোরে আর নিম্মোর হাতে হাতকড়া পড়েছে, নানাসাহেবের নওলাখা হার পুলিশের জিম্মায় চলে গেছে। আজ যে এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে সেটা ফেলুদা আগেই বুঝেছিল, আর তাই ও সকালে সিগারেট কিনতে যাবার নাম করে ইন্সপেক্টর পটবর্ধনের সঙ্গে দেখা করে পুলিশের ব্যবস্থা করে এসেছিল। গোরে নাকি এককালে একটানা বারো বছর কলকাতায় ছিল, শুধু ডন বস্কো নয়, সেন্ট জেভিয়ার্সেও পড়েছে—তাই বাংলাটা সে ভালই জানে—যদিও বম্বেতে সে সচরাচর হিন্দি, মারাঠি আর ইংরেজিটাই ব্যবহার করে।
আমরা বসে আছি খাণ্ডালা ডাকবাংলোর বারান্দায়। চমৎকার পাহাড়ে জায়গা, বাতাসে রীতিমতো ঠাণ্ডার আমেজ। বম্বের অনেকেই নাকি খাণ্ডালায় চেঞ্জে আসে। সাফারির মাটন দো পেঁয়াজি আর নান খাওয়া হয়ে গেছে আগেই, এখন বিকেল সাড়ে চারটে, তাই চা আর পকৌড়া খাচ্ছে সকলে।
আমাদের টেবিলে আমরা তিনজনই বসেছি। পুলকবাবু ছিলেন এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে, এইমাত্র উঠে মেরহোত্রার টেবিলে চলে গেলেন। অর্জুন মেরহোত্রার একটু যেন মনমরা ভাব; তার একটা কারণ হয়তো এই যে, আজকের হিরো হচ্ছে নিঃসন্দেহে প্রদোষ মিত্তির। ইতিমধ্যে অনেকেই ফেলুদার সই নিয়ে গেছে, এমনকী ভিলেন মিকি পর্যন্ত।
সেকেন্ড হিরো যে ভিক্টর পেরুমল তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। ফেলুদা ভিক্টরকে আগে থেকেই তালিম দিয়ে রেখেছিল। বলেছিল—‘ঘোড়া নিয়ে যখন ট্রেনের ধারে পৌঁছাবে, তখন ফার্স্ট ক্লাস কামরার দিকে একটু চোখ রেখো। গোলমাল দেখলে সোজা দরজা দিয়ে ঢুকে এসো’, ফেলুদার দুহাত মাথার উপর তোলা দেখেই ভিক্টর ধরে ফেলেছে গণ্ডগোলের ব্যাপার। আশ্চর্য, এত বড় একটা কাজ করেও তার কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। সে এরই মধ্যে আবার বাংলোর সামনের মাঠে তার লোকজন নিয়ে ওয়ান-টু-থ্রি করে কুং-ফু অভ্যাস শুরু করে দিয়েছে।
‘কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে কী—’
লালমোহনবাবু এই এতক্ষণে প্রথম মুখ খুললেন। ফেলুদা ওঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে কি, আপনি এখনও যেই তিমিরে সেই তিমিরে—তাই তো?’
জটায়ু একটা গোবেচারা হাসি হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালেন।
ফেলুদা বলল, ‘আপনার মনের অন্ধকার দূর করা খুব কঠিন নয়। তবে তার আগে গোরে লোকটাকে একটু বুঝতে হবে, তা হলেই তার কার্যকলাপটা বোধগম্য হবে।
‘প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে সে আসলে স্মাগলার, কিন্তু ভেক ধরেছে সম্ভ্রান্ত ফিল্ম প্রোডিউসারের। আপনার গল্প থেকে সে ছবি করছে। গল্পে আপনি শিবাজী কাস্লে স্মাগলাররা থাকে বলে লিখেছেন। স্বভাবতই গোরে তাতে বিচলিত হয়ে পড়ে। তার মনে প্রশ্ন জাগে—আপনি শিবাজী কাস্ল সম্বন্ধে কদ্দূর কী জানেন, কারণ সে নিজে স্মাগলার আর তার বাসস্থানও শিবাজী কাস্ল। এইটে জানার জন্য সে সান্যাল সেজে আপনার বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। আপনার সঙ্গে আলাপ করে সে বোঝে যে ভয়ের কোনও কারণ নেই, আপনি অত্যন্ত নিরীহ নির্লিপ্ত মানুষ এবং শিবাজী কাস্ল-এর ব্যাপারটা আপনার কাছে একেবারেই কাল্পনিক। সেই সময় তার মাথায় আসে আপনার হাত দিয়ে বইয়ের প্যাকেটে নওলাখা হার পাচার করার আইডিয়া। মালটা গোরে পাঠাচ্ছিল তারই এক গ্যাঙের লোককে—যে খুব সম্ভবত থাকে শিবাজী কাস্লেরই সতেরো নম্বর তলার দুনম্বর ফ্ল্যাটে। আপনি যদি ধরা পড়েন, তা হলে দোষ দেবেন সান্যালকে, গোরেকে নয়—তাই তো? অর্থাৎ সান্যালকে খাড়া করে গোরে নিজে থাকছে সেফসাইডে।
‘এদিকে হয়ে গেল গণ্ডগোল। আপনি পঞ্চাশ লাখ টাকার হারের বদলে চালান করে বসলেন আপনারই পাঁচটাকা দামের বই। সেই বইয়ের প্যাকেট নিয়ে লালশার্ট অর্থাৎ নিম্মো শিবাজী কাস্লের লিফ্ট দিয়ে উঠছিল সতেরোতলায়; সেই সময় গোরেরই কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাঙের লোক নিম্মোকে আক্রমণ করে প্যাকেট আদায় করার জন্য। নিম্মো তাকে খুন করে প্যাকেট যথাস্থানে চালান দিয়ে গা ঢাকা দেয়। এদিকে প্যাকেটে যে হার নেই সে খবর পেতেই গোরেকে চলে আসতে হল। সে তো বুঝেছে কী হয়েছে। তার এখন দুটো কাজ করতে হবে। এক, হার ফিরে পেতে হবে; দুই, আমাদের খতম করতে হবে। তার একমাত্র ভরসা যে আমরা লাইফ ডিভাইনের রহস্য ভেদ করে হারটা পুলিশের হাতে জমা দিইনি। গোরে এসেই বুঝল যে সান্যালের পুনরাবির্ভাবের প্রয়োজন হবে। সান্যালই যখন মালটা পাঠিয়েছিল, তখন সান্যালকেই সেটা পুনরুদ্ধার করতে হবে, তা হলে গোরের নিজের উপর কোনও সন্দেহ পড়বে না।’
‘কিন্তু গুলবাহার—’
‘বলছি, বলছি—সব বলছি। গুলবাহার সেন্টের ব্যবহারটা গোরের শয়তানি বুদ্ধির আশ্চর্য উদাহরণ। এটার জন্য সে কলকাতা থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। সান্যাল মানেই গুলবাহার, আর গুলবাহার মানেই সান্যাল—এ ধারণা অন্তত আপনার মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল—তাই নয় কি?’
‘হ্যাঁ—তা একরকম হয়েছিল বইকী।’
‘বেশ। এবার মনে করে দেখুন—সেদিন গোরে আমাদের বৈঠকখানায় বসিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল—ভাবটা যেন আপনার জন্যে টাকা আনতে গিয়েছে—কেমন?’
‘ঠিক।’
‘সেই ফাঁকে লিফ্টে ঢুকে দুফোঁটা গুলবাহার সেন্ট ছিটিয়ে দেওয়া কি খুব কঠিন ব্যাপার? উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সব ক’টা তলা শুঁকেও যখন কোনও সেন্টের গন্ধ পেলাম না, তখনই বুঝলাম যে গন্ধটা রয়েছে শুধু লিফ্টের ভিতর। অর্থাৎ সেটা হচ্ছে মানুষের গা থেকে নয়, এসেছে সেন্টের শিশি থেকে। ঠিক সেইভাবেই লোক লাগিয়ে লোটাস সিনেমার সামনে গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কয়েক ফোঁটা সেন্ট গাড়ির সিটে ছিটিয়ে দেওয়াও অতি সহজ ব্যাপার।’
ফেলুদা বুঝিয়ে দিলে সত্যিই সহজ। লালমোহনবাবুও যে ব্যাপারটা বুঝেছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু তাঁর মুখে হাসি ফুটছে না দেখে বেশ অবাক লাগল। সেটা যে শেষ পর্যন্ত পুলকবাবুর একটা কথায় ফুটবে সেটা কী করে জানব?
চা শেষ করে যখন শহরে ফেরার তোড়জোড় চলছে, সূর্যটা পাহাড়ের পিছনে নেমে যাওয়ায় হঠাৎ ঠাণ্ডা বেড়ে মাঝে মাঝে বেশ কাঁপুনি লাগিয়ে দিচ্ছে, তখন দেখি পুলকবাবু আমাদের দিকে ব্যস্তভাবে এগিয়ে আসছেন।
‘লালুদা, জেট বাহাদুরের বিজ্ঞাপন পড়ছে শুক্কুরবার—কিন্তু তার আগে একটা ব্যাপার জেনে নেওয়া দরকার।’
‘কী ব্যাপার ভাই?’
‘আপনার কোন নামটা যাবে—আসল না নকল?’
‘নকলটাই আসল ভাই’, একগাল হেসে বললেন লালমোহনবাবু, ‘বানান হবে জে এ টি এ ওয়াই ইউ।’