মেয়েরা কি শুধু বাচ্চা বিয়োনোর যন্তর নাকি?
—তা নইলে বিয়োবে কে? পুরুষমানুষ আর সব পারে, ওইটে পারে না। বুঝলি রে? যে-মেয়ে ওইটে পারে না, সে যতই তড়পাক, মেয়ে-জন্মই বৃথা। পুরিয়ায় করে একটু ইসবগুল দে তো দেখি। আজ মোটে ক্লিয়ার হয়নি। পেটটা থম মেরে আছে।
ইসবগুল সস্তা জিনিস নয়, তাই প্রীতম শশী কবরেজের করা ত্রিফলার গুঁড়ো খানিকটা পুরিয়া করে দিয়ে বলল, এইটে মেরে খাও গে, সকালে বগবগ্ করে নেমে যাবে। নির্বিকার মুখে পুরিয়াখানা জামার ঝুলপকেটে ঢুকিয়ে হরিপদ বলে, দু-দুটো কারবার ফেঁদে বসলি, আমদানিও তো ভালই দেখছি। এই বেলা একটা পলিসি করিয়ে নিবি নাকি! ধর হাজার পঞ্চাশ। প্রিমিয়ামও গায়ে লাগার মতো নয়।
প্রীতম একটু হেসে বলল, তুমি কি পোড়াচোখে আর কাউকে দেখতে পাও না? এখনও ভরপেট ভাতের পাকা ব্যবস্থা হয়নি, এর মধ্যেই ওসব লাখ-বেলাখ এনে ফেলছ?
—ওরে, তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে, না কি? বিয়ে করবি, সংসার হবে, তখন….
—কে বলল আমার ভবিষ্যৎ আছে? ও সব আমার নেই। আমি শুধু আজকের দিনটা বুঝি। কাল ভোর হলে কালকের কথা ভাবতে লাগব। আগ বাড়িয়ে কবে কী হবে তা নিয়ে মাথা গরম করতে যাব কেন?
প্রীতমের গলায় একটু ঝাঁঝ ছিল। তাইতেই হরিপদ চুপ মেরে গেল। টোপটা খেল না। বেশির ভাগই খায় না। তা বলে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না হরিপদ। কথা পাল্টে সে বলে, হ্যাঁ রে! মোদকের মধ্যে কি হেরোইন থাকে?
প্রীতম ভ্রূ কুঁচকে বলে, হেরোইনের দাম জানো?
—কে যেন বলছিল, শশী কবরেজের মোদকে হেরোইন আছে।
—তোমার মাথা।
—আমিও তাই ভাবছি, হেরোইন থাকলে মোদক এত সস্তা হয় কী করে?
গোপাল মাইতি এসে একখানা বড় ফর্দ দাখিল করে বলল, মেপে রাখ, আধ ঘন্টা বাদে নিয়ে যাব। তাড়া আছে। প্রীতম আর পরেশ ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হরিপদ আক্ষেপ করে আপনমনেই বলতে লাগল, আহাম্মক আর কাকে বলে! ওর নাকি আখের বলেই কিছু নেই। দুনিয়ার মানুষ আখের গোছানোর জন্য হাঁসফাঁস করে মরছে, তারা কি সব বোকা? দশ-পনেরো বছর বাদে যখন গোছা গোছা টাকা পেতিস তখন বুঝতিস পলিসি কী জিনিস। তা নাহয় না-ই করলি, শেয়ার বাজারেও লাগাতে পারিস কিছু। মন্দা বাজারে ধরলি, তেজি বাজারে ছাড়লি, গায়ে হাওয়াটি লাগল না। হাতে বাণ্ডিল বাণ্ডিল চলে এল।
—কথা কমাও হরিদা। কথা বেশি কও বলেই তোমার হাওয়া বেরিয়ে যায়, আজ অবধি কাজের কাজ একটাও করে উঠতে পারলে না।
হরিপদ মোটেই রাগ করল না। নির্বিকার মুখে বলে, ওরে, এ বার হাওয়া ঘুরবে, দেখিস।
—তাই নাকি?
—শাশুড়ি মরো-মরো।
—মরলে কি তুমি গিয়ে খন্যাডিহিতেই গেঁড়ে বসবে নাকি?
—খন্যাডিহি ভাল জায়গা। ফুলের চাষ হয়। ফসলে আর ক’টা টাকাই বা থাকে। ফুলের চাষ সারা বছর। গত বারই তো শুনেছি শাশুড়ি চল্লিশ হাজার টাকার ব্যবসা করেছে। দেখাশুনো করার লোক থাকলে আরও হত।
প্রীতম জানে হরিপদ এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না। শাশুড়ি মরলে খন্যাডিহি যাবে বটে, কিন্তু দু’দিনেই সব বেচেবুচে দিয়ে ফিরে আসবে। তার পর টাকাটা উড়িয়ে ফের এই রকম সন্ধেবেলায় এসে তার দোকানে বসে লেজ নাড়বে। কিছু লোকই থাকে ও-রকম, যারা উড়িয়ে যত সুখ পায় তত আর কিছুতে নয়।
হরিপদর মধ্যে তার বাবা বিনোদকুমারের একটা আদল আছে। জলের ফেনার মতো ভেসে যেতে বড় সুখ পায়, কিছু ঘটিয়ে তুলতে পারে না। কেউ জুয়ার বাজি ধরে, কেউ শাশুড়ির মরার জন্য অপেক্ষা করে, কেউ অদৃষ্টের ওপর বরাত দিয়ে বসে থাকে। রাত ন’টা নাগাদ দোকানের ঝাঁপ ফেলল প্রীতম। বিক্রিবাটার টাকা গুনেগেঁথে ব্যাগে ভরল। তার পর উঠে পড়ল।
—চলি হে পরেশ।
—হুঁ।
সাইকেলখানার ওপর কম রগড়ানি যায় না। তবে, প্রীতম জিনিসের সঙ্গে ভাবসাব করতে জানে। রোজ ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মোছে, তেল দেয়। তা ছাড়া, দরকার মতো মেরামত করিয়ে নেয়। নিতাই পোদ্দারের কাছ থেকে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কিনেছিল। দিব্যি চলছে। আরও বছর দশেক চালিয়ে দেবে সে। মোড়ের কাছে এসে দেখল সীতু শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
—কী রে, বাড়ি যাসনি?
—রিকশা পাচ্ছি না যে!
—কেন, রিকশার অনটন কীসের?
সীতু একগাল হাসল, সব নাকি ধান তুলতে চলে গেছে। কাল সকালে ফিরবে।
—তা হেঁটেই মেরে দে না। একটুখানি তো পথ।
—দিদি পারবে না যে!
—দিদি! তোর দিদি কোথায়?
—ওই যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফুচ্ফুচ্ করে কাঁদছে। মা বকবে তো তাই।
সাইকেল থেকে নেমে পড়ল প্রীতম। তাই তো! এরা তো বেশ আতান্তরেই পড়েছে। পথটা পুরুষের পক্ষে বেশি নয় বটে, কিন্তু মেয়েদের পক্ষে বোধহয় বেশিই। তা ছাড়া বিপদ-আপদ ঘটতে পারে।
—তুই সাইকেল চালাতে পারিস না?
—পারি তো।
—তা হলে দিদিকে চাপিয়ে নিয়ে চলে যা আমার সাইকেলে। ফেরত দিতে হবে না। কুতুবের দোকানে জমা করে দিস।
—আমি জানতাম।
—কী জানতিস?
—আজ আমি তোমার সাইকেলটাতে চাপব।
কথাটা বিশ্বাস হয় প্রীতমের। সবাই বোকা বলে বটে, কিন্তু ছোঁড়াটার মধ্যে একটা কিছু আছে। ভগবান নানা বিচিত্র জিনিস দুনিয়ায় পাঠান, কার মধ্যে ঝাঁপি থেকে কী বেরোয় কে জানে বাবা! ও পাশ থেকে শেফালি চাপা স্বরে ভাইকে বলল, না, না, আমি তোর সাইকেলে চাপব না, ফেলে দিবি।
সীতু বলে, আচ্ছা, একটুক্ষণের জন্য উঠেই দেখ না!
—না বাপু, তুই তো রোগাভোগা ছেলে।
চাপাচাপিতে নিমরাজি হল মেয়েটা। উপায়ও নেই। রাত হয়ে যাচ্ছে। দিদিকে রডে বসিয়ে কেত্রে ফেত্রে উঠে পড়ল সীতু। কিন্তু সাইকেল টলোমলো করছে। দশ হাত যেতে না যেতেই ঝপাং করে রাস্তার গর্তে পড়ে কাত হল। দু’জনেই মাটিতে গড়াগড়ি। প্রীতম গিয়ে সীতুকে তুলল। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে নিজেই উঠে পড়ল টপ করে, ফেললি তো! হাঁদারাম কোথাকার!
—ব্যথা পেয়েছিস দিদি?
—না, লাগেনি।
তীক্ষ্ণ চোখে সাইকেলখানা পরখ করছিল প্রীতম। না, চোট হয়নি, ঠিকই আছে। বলল, সাইকেল ছাড়া তো উপায় নেই। সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। শেফালি কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, ও তো পারবে না। আবার ফেলে দেবে।
—ঠিক আছে, তোমরা দু’জন রড আর ক্যারিয়ারে বসে যাও, আমি ঝট করে নামিয়ে দিয়ে আসছি। পারবে তো? ভয় করবে না?
শেফালি চুপ। সীতু বলল, খুব পারব। চল রে দিদি।
শেফালির আর কোনও আপত্তি হল না। সীতু উঠল রডে, শেফালি ক্যারিয়ারে। একটু একটু হিমেল বাতাসে আলোছায়াময় রাস্তায় সাইকেলখানা মসৃণ গতিতে ছুটছে। দুই শক্তিমান হাতে হ্যাণ্ডেল ধরা, চওড়া পিঠের আড়াল, শেফালির শরীর আর মন শিউরে শিউরে উঠছে। স্বপ্নের পুরুষ এত কাছে এলে কি বাঁচে কোনও মেয়ে? সে তো মরে যাচ্ছে! হে ভগবান, এটা যেন আমার স্বপ্ন না হয়। যা দুষ্টু তুমি। সুখ ভণ্ডুল করে দিতে তোমার জুড়ি আর কে?