ডালের বস্তার ওপর টং-এ বসে এক্সারসাইজ খাতায় হিসেব করছিল প্রীতম। বাহ্যজ্ঞান নেই। হিসেব করতে তার বড় ভাল লাগে। আর ব্যবসার প্রাণই হল হিসেব। আগে হিসেবের কায়দাটা ভাল জানা ছিল না তার। মণিরাম শিখিয়েছে। বলেছে, হিসেবটা যদি ঠিকমত করতে পারিস তো ভিত বেঁধে ফেললি। ওইখানে ভুলচুক করলে দর ফেলতে গড়বড় হয়ে যাবে। তা হলেই সর্বনাশ।
দোকান সামলাতে পরেশকে রেখেছে সে। মাইনে দিয়ে লোক রাখার মতো তালেবর সে এখনও হয়নি। পরেশ এক রকম যেচে এসেই আগ বাড়িয়ে দোকানের ভার নিয়েছে। তার মুশকিল হল, থাকার জায়গা নেই। ট্রাকের খালাসি ছিল। গড়বড়ে জিনিস লোড হত ট্রাকে। ড্রাইভার আর তার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। আর সেই সময়টায় পেচ্ছাপ করতে নেমেছিল বলে বেঁচে যায় পরেশ। সেই থেকে পালিয়ে আছে। ঘনশ্যাম ব্যাপারি পাইকার। তারই কেমন একটু আত্মীয় হয় বলে ঘনশ্যামই এক দিন এসে গছিয়ে গেল। বলল, কটা দিন থাকতে দাও। ও বেচারার দোষ নেই, সাতে-পাঁচে ছিলও না, ফেঁসে গেছে ঝুটমুট। গণ্ডগোল থিতু হলে ফিরে যাবে। চুরিটুরি করলে আমি জামিন আছি।
সেই থেকে পরেশ আছে। ছেলে কিছু খারাপও নয়। দু’বেলা ঘনশ্যামের বাড়িতেই খেয়ে আসে। দিনে পাঁচ টাকা করে হাতখরচ দেয় প্রীতম। সুবিধে হল, সে মাল আনতে গেলে দোকানটা চালু রাখে পরেশ। খদ্দের ফিরে যায় না। রাতে চাল-ডালের বস্তার ওপর শুয়ে ঘুমায়। কিন্তু মুশকিল একটাই, সর্বদা একখানা দুঃখী মুখ চোখের সামনে দেখতে প্রীতমের মোটেই ভাল লাগে না। চোখটাও যেন সব সময় কান্নার আগে ছলোছলো মতো হয়ে থাকে। কথা বিশেষ কয় না। ভারী চুপচাপ আর মনখারাপ। এইটেই কেমন যেন সহ্য হতে চায় না প্রীতমের।
চাপাচাপি করায় এক দিন কেবল বলেছিল, কত দূরে দূরে চলে যেতুম তো, সেইটে ভেবে কষ্ট হয়। দুনিয়ায় হরেক রকমের চিড়িয়া, কার যে কীসের ওপরে টান তা বোঝে কার বাপের সাধ্যি। টাকা-পয়সার আমদানি নেই, ছুটি নেই, ভবিষ্যৎ নেই, শুধু দূরে দূরে যাওয়ার আনন্দ আবার কেমনধারা, কে জানে বাপু! একটা রোগাভোগা চেহারার ছেলে উঁকিঝুঁকি মারছিল, বাইরেটা অন্ধকার হয়ে এসেছে বলে দেখা যাচ্ছিল না।
—এটা কি ফুটুদার দোকান?
পরেশ কী বলল, বোঝা গেল না।
—সীতু নাকি রে? বলে বস্তার ওপর থেকে নেমে এল প্রীতম।
—ভেতরে আয়।
—তুমি আর পিউ স্টোর্সে বসো না?
—দু’দুটো দোকান সামলানো কি সোজা? ওটাতে সরস্বতী বসে।
—এ দোকানটাও তোমার?
—হ্যাঁ, জিলিপি খাবি?
—না, সরস্বতীদি তো খাইয়েছে।
—তাই বুঝি?
—দুটো।
প্রীতম হাসল। বোকা ছেলেটা অল্পেই ভারী খুশি হয়।
—আমার হিসেবের খাতাটা একটু দেখে দে তো। দিবি?
—দাও না।
প্রীতম ওকে এক্সারসাইজ খাতাটা ধরিয়ে দিল। সিল করা তেলের টিনের ওপর নিজেই একটা বস্তা ভাঁজ করে পেতে বসে গেল সীতু। সে আর কিছু না পারলেও যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগটা খুব পারে। কখনও ভুল হয় না। অন্য বিষয়ে ডাব্বা খেলেও অঙ্কে আশি নব্বই পায়।
প্রীতমের হিসেবে কখনও ভুল হয় না। তবু এক জোড়ার চেয়ে দু জোড়া চোখ সব সময়েই ভাল। আর সীতুর যে অঙ্কের মাথা পরিষ্কার এটা সে ভালই জানে। আর শুধু অঙ্কই নয়, সীতুর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার আছে। সে যখন পিউ স্টোর্সে বসত তখন এক দিন জিলিপি খেতে খেতে সীতু বলেছিল, তোমার দাঁড়িপাল্লা নেই?
—না, স্টেশনারি দোকান তো, তাই দাঁড়িপাল্লা লাগে না।
—দাঁড়িপাল্লার দোকান আমার খুব ভাল লাগে।
সেই দাঁড়িপাল্লার দোকান হল এইটে। আর বলতে নেই, এই দোকানে প্রীতম মা লক্ষ্মীর পায়ের মলের শব্দও যেন শুনতে পায়। এই দোকান করেই সে ব্যাঙ্কের টাকা প্রায় শোধ করে এনেছে।
—ও সীতু?
—উঁ!
—দাঁড়িপাল্লার দোকানটা তোর পছন্দ হয়েছে?
—ও লোকটা কে?
—ও পরেশ। কেন রে?
—এমনি। ও আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল।
—তাই নাকি? তোকে চেনে না তো, তাই। আর তাড়াবে না।
—তোমার হিসেব ঠিক আছে। ভুল নেই।
খাতাটা প্রীতমের হাতে দিয়ে উঠে পড়ল সীতু।
—কোথায় চললি?
—দিদিকে খুঁজতে। নগেনের দোকানে ঢুকেছে।
—ওই তো নগেনের দোকান। খুঁজতে হবে কেন, বেরোলেই দেখতে পাবি।
—দিদি বেরোবে না। আমি বেরোলে, তার পর বেরোবে।
—তাই নাকি? কেন রে?
—কী জানি। বলল, তুই প্রীতমদার দোকানে গিয়ে বসে থাক। তুই বেরোলে আমিও বেরোবো।
—তোর দিদিটা কে বল তো?
—শেফালি। ক্লাস নাইন।
—তা হবে, আচ্ছা আজ যা, আবার আসিস।
সীতু চলে গেলে প্রীতম চুপচাপ বসে রইল। সীতুকে দেখে নগেনের দোকান থেকে যে মেয়েটা বেরিয়ে এল তাকে এই সুঁঝ্কো আঁধারে ভাল দেখতে পেল না প্রীতম। এ দিকে একটু তাকিয়ে রইল মেয়েটা। তার পর সীতুর সঙ্গে চলে গেল। সন্ধের মুখে খদ্দেরের আনাগোনা বেড়ে গেল খুব। গলির দোকান হলে কী হয়, বিক্রিবাটা খুব ভাল। প্রীতমের কোনও দুঃখ নেই এখন।
পরেশের দোকানদারির অভিজ্ঞতা নেই। চটপটেও নয়। তাই সন্ধের মুখটায় প্রীতমকেই হাত লাগাতে হয়। মুদির দোকানের বিক্রির হিসেব রাখা মুশকিল। শশী পাল কেরোসিন, ব্লেড আর ন্যাপথলিন নিয়ে গেল তো বাসন্তী আড়াইশো সর্ষের তেল, কালোজিরে আর গোলা সাবান। নিত্যানন্দ একখানা ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে হাওয়া হল তো শ্রীপতি এল কাঠকয়লা, গরুর দড়ি আর শটিফুড কিনতে। হিমসিম অবস্থা।
ওরই মধ্যে টুলে বসে রোজকার মতো ফুট কেটে যাচ্ছে হরিপদ দাস, বলি, তোর কি মাথায় কোনও চিন্তা-ভাবনা নেই! দোকান করলেই হবে? সরস্বতীর তো বাপু সতেরো আঠারো হল, চেহারার চটক থাকতে থাকতে বিয়ে লাগিয়ে দে। সুমন্ত কি খারাপ পাত্তর রে? বারো বিঘে জমি, রাইস মিল, মুড়ি-কল। পছন্দ নয় তো, সুধীর রায়ও আছে। আদালতের বাঁধা সরকারি চাকরি। হোক পিওন, সরকারি চাকরি বলে কথা। বাগনানে পাকা বাড়ি।
কথা কওয়ার সময় নেই, কিন্তু শুনে যেতে হচ্ছে। তবে, প্রীতম বিরক্ত হয় না। হরিপদরও দোষ নেই। পেট চালাতে নানান ধান্দা করে বেড়াতে হয়। জমি-বাড়ির দালালি, ঘটকালি, দরখাস্তর মুসাবিদা, কাউকে ফেলে না প্রীতম, ‘দূর ছাই’ করে না, তার সর্বদা তূষ্ণী ভাব।
এক জন ঝাঁ চকচকে বউ মানুষ এসে দাঁড়াল। শশব্যস্তে বসা থেকে উঠে পড়ল প্রীতম। বাপ রে! সাব ইন্সপেক্টর বরেন মজুমদারের বউ, বন্দনা মজুমদার।
—চাওমিন আছে?
—আছে বউদি।
—লোকাল মেড নয় কিন্তু।
—আজ্ঞে না, ব্র্যাণ্ডেড মাল।
—আর সয়া সস, চিলি সস?
—আছে বউদি।
মহিলার হাবভাবই অন্য রকম। এ জায়গার সঙ্গে মেলে না। যেমন চেহারার চেকনাই, তেমনই আদবকায়দা। জিনিসগুলো খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখল। তার পর বটুয়া খুলে দাম দিয়ে দিল।
—আপনি আজকাল পিউ স্টোর্সে বসেন না?
—না, আমার বোন বসে।
—হ্যাঁ, সে দিন আইলাইনার চাইলাম, খুঁজেই পেল না।
কাচুমাচু হয়ে প্রীতম বলে, নতুন তো, তাই। আমি বরং বাড়িতে আইলাইনার পৌঁছে দেব।
—দরকার নেই। আমি আনিয়ে নিয়েছি। আপনি যখন বসতেন তখন পিউ স্টোর্সে মেয়েদের খুব ভিড় হত। আজকাল হয় না। আপনি মেয়েমহলে বেশ পপুলার, তাই না?
প্রীতম লজ্জার হাসি হেসে বলল, মেয়েদের জিনিসপত্র রাখি তো, তাই। মুখ টিপে একটু হেসে বন্দনা চলে গেল। হরিপদ পিছন থেকে ফুট কাটল, জব্বর কাস্টমার পেয়েছিস।
—সব কাস্টমারই সমান।
—এম এ বি টি, বুঝলি? কিন্তু আজও বাচ্চা বিয়োতে পারেনি।