বেশি দূরে নয় – ০৭

বুক চিতিয়ে সপাটে খানিক হাঁটার পরই বিনোদকুমার বুঝল, বুড়োবয়সকে খুব বেশি পিছনে ফেলতে পারেনি। পোষা কুকুরের মতো গা শুঁকতে শুঁকতে পিছন পিছন আসছে। টের পেল, যখন হাঁফ ধরে যাওয়ায় মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দম নিতে হচ্ছিল। ওরে বাপু! যৌবনপ্রাপ্তি কি আর ছেলের হাতের মোয়া? বয়স তেমন ভাঁটিয়ে যায়নি, কিন্তু শরীরের জোয়ার নেমে গেছে। বয়সকালে নেশাভাঙও তো কম করেনি! তার ওপর এই ফুক ফুক রোজ ডজনখানেক সিগারেট ফোঁকা— এরও তো মাশুল আছে, নাকি?
মাশুল মেলাই দিতে হচ্ছে বিনোদকে। কতক জানিত কর্মফল, কতক অজান। আটন গেট-এ তার এক জন মেয়েমানুষ ছিল, এক জন ছিল ফুলেশ্বরে। সব্বার নামও মনে নেই। পাপটাপ যখন করেছে, তখন পাপ জেনেই করেছে। তবে মনস্তাপ ছিল না। একটু আধটু তো ও রকম হবেই বাপু! তখন বিনোদের চেহারাখানা কী ছিল বলো! নদের নিমাই করে কত বুড়োবুড়ির চোখে জল এনে ফেলেছিল। কত বুড়ি পালার পর পায়ের ধুলো নিয়ে যেত।
বিনোদ টের পেল, বয়সটা তার পায়ের গোছের কাছেই বসে আছে। তাড়ালেও যাবে না। অথচ হিসেবের বয়স তার হয়নি।
—বিনোদ নাকি রে? এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?
বিনোদ দেখল, সামনে সফলরাম। তা সফলই বটে। গঙ্গারামপুরের সব ক’টা টাকাওলা লোককে পাল্লার এক ধারে, আর সফলরামকে অন্য ধারে চাপালে সফলের দিকেই পাল্লা মাটিতে ঠেকবে।
—এই মেয়েটির জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
—তা দাঁড়িয়ে থাকবি তো থাক না! বিড়বিড় করে কাকে গাল দিচ্ছিস?
বিড়বিড় করছে নাকি সে? ওই এক মুশকিল হয়েছে আজকাল। সে টের পায় না, কিন্তু লোকে দেখতে পায়। সে নাকি একা একা বিড়বিড় করে। তা করে হয়তো, কিন্তু সেটা টের পায় না কেন সেটাই বুঝতে পারে না বিনোদ।
—গাল দিচ্ছি না দাদা, নানা কথা ভাবছি আর কী!
—পষ্ট দেখলুম হাত-পা নেড়ে কথা কইছিস! বলি লোককে শাপ-শাপান্ত করিস না তো?
—কী যে বলেন দাদা!
—বিচিত্র কী! ঘর-বসা লোকের মনে মেলা গাঁদ জমে থাকে তো!
প্রকৃতির নিয়মেই বড়লোকদের সামনে বিনোদ ভারী দুর্বল বোধ করে। মনের জোরটা পায় না। টাকার জোরের কাছে কোন জোরটাই বা খাটে বাপু? সে একটু হেঃ হেঃ করে বলল, ঘর-বসা না হয়ে উপায়ই বা কী বলুন? শরীরটা জুত-এর নেই।
—তাই থাকে রে পাজি? তুই তো চিরকালের নষ্ট! এইটুকুন বেলা থেকে দেখে আসছি। তবে তোর কপালটা বড্ড ভাল।
সসম্ভ্রমে চুপ করে থাকে বিনোদ। সফলরাম নিজেই বলে, তুই নষ্ট হলেও ছেলেটা তোর ভাল। তোর মতো লপেটা-বাবু নয়। করে-কর্মে দাঁড়িয়ে গেছে।
—তা আপনাদের আশীর্বাদে।
—এটা কলিযুগ জানিস তো! এ যুগে আশীর্বাদও ফলে না, অভিশাপও ফলে না। এ হল নগদা-নগদির যুগ, যেমন করবি তেমনি পাবি। জুয়োর দান ধরে নেংটি-ঘটি সার করলি, এখনও চোখ খুলল না? আশীর্বাদ-টাশীর্বাদ সব বাজে কথা। ছেলেটা যে তোর মতো হয়নি সেইটেই তোর কপাল।
তা বিনোদ এ সব কথাও বিস্তর শোনে। ঘরে, বাইরে, পথেঘাটে। বউ শোনায়, আত্মীয়স্বজন শোনায়, উটকো লোকও শোনায়। কিছু ভুলও শোনায় না। হ্যাঁ, তার ছেলেটা ভাল, আর সে খারাপ। তা বাপু, তাতে হলটা কী?
কী একটা কথা বলছিল সফলরাম, ধরতাইটা ঠিকমতো শোনেনি। কানের দোষই হবে বোধহয়। শেষটা শুনতে পেল, আমি বাপু রাজি হইনি।
—কথাটা কী হচ্ছিল দাদা?
—তোর ছেলের কথাই হচ্ছিল। আমার বউমা বলছিল, ফুলির সঙ্গে ফুটুর সম্বন্ধ করলে কেমন হয়! আমি বলে দিয়েছি, ও লাইনে মোটেই চিন্তা কোরো না। ছেলে ভাল হলে কী হবে, বিনোদেরই তো রক্ত। রক্তে রক্তে কোন বিষ অর্শায় তার ঠিক কী! তোর কাছে বলেছে কিছু?
ব্যাপারটা স্পর্ধারই সামিল। জিভ কেটে বিনোদ বলল, আজ্ঞে না, ও রকম কোনও কথা হয়নি মোটেই।
—আর হবেও না। বারণ করে দিয়েছি। আগেভাগেই জানিয়ে রাখা ভাল, নইলে আবার একটা প্রত্যাশা থাকবে তো!
না, বিনোদের কোনও প্রত্যাশা নেই। বউ মানেই একটা ফ্যাকড়া, একটা বাধক। বউ-বাচ্চার জন্যই না বিনোদের দুই নৌকোয় পা রেখে জীবন কাটল! ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে সে বলে, না, না, তা হয় না। ঘাড়ে দু-দুটো আইবুড়ো বোন, জুয়াড়ি বাপ, কে যে বউমাকে বুদ্ধিটা দিল কে জানে!
সফলরাম ঠোঁটকাটা লোক সবাই জানে। বিনোদের মোটেই রাগ বা অপমান হল না। সে দিব্যি হাসি-হাসি মুখ করে বলে, সে তো বটেই। সফলরাম চলে যাওয়ার পরও খানিক দাঁড়িয়ে রইল বিনোদ। তার একটু ভয় হচ্ছে। ফুটু বিয়ে বসলে তার নতুন বিপদ দেখা দেবে। বউ এসে যদি বাড়ি-ছাড়া করে, তা হলে তাকে এই বাজারেই ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করতে হবে।
—ও বাবা!
চটকা ভেঙে বিনোদ দেখে, সামনে বিম্ববতী।
—চল মা, বাড়ি চল। বাজার হয়েছে?
—হ্যাঁ।
—দে, একখানা ব্যাগ বরং আমাকে দে।
—আমি পারব। তুমি চলো তো!
বুকটা ধকধক করছে। এখনও হাঁফটা পুরোপুরি কাটেনি। বয়স হয়েছে কী হয়নি, তা ঠিক বুঝতে পারছে না বিনোদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *