বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে 

বাঙলাদেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যে এখনো সম্পন্ন হয়নি এ বিষয়ে সোভিয়েট সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদীদের এদেশীয় অনুচররা ব্যতীত’ কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত মহলে অন্য কারো কোন দ্বিমত নেই। সকলেই সাধারণভাবে স্বীকার করছেন যে আমাদের দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এখনো সম্পন্ন হয়নি এবং এখানে সংগ্রামের বর্তমান স্তর হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর। 

কিন্তু এই সাধারণ স্বীকৃতি সত্ত্বেও এই বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, শত্রু-মিত্র, নীতি ও কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় ধারণা অনেকাংশে অপরিচ্ছন্ন এবং বেঠিক হওয়ার ফলে আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেক বিভ্রান্তি বর্তমান বাঙলাদেশে ব্যাপকভাবে বিরাজ করছে। এই সব অপরিচ্ছন্ন ও ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে যদি সুষ্ঠু ও সতর্ক বিশ্লেষণ, আলোচনা ও পর্যালোচনা না হয় তাহলে কর্মক্ষেত্রে যে হতবুদ্ধিতা, বিশৃঙ্খলা এবং সংগ্রামী ঐক্যের অভাব দেখা যাচ্ছে তা নির্মূল ও দূরীভূত করে বিপ্লবের সাফল্যকে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার যে, ভুলভ্রান্তি যত মারাত্মক হয় তার পরিণামে আন্দোলনের ক্ষতিও হয় ততই ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী ও মারাত্মক। আমাদের দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এ ধরনের অনেক ভুলভ্রান্তি যে হয়েছে একথা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। 

কাজেই এ ক্ষেত্রে যা অবশ্য প্রয়োজনীয় কর্তব্য তা হলো অতীতের এবং বর্তমানেরও, এই সমস্ত ভুলভ্রান্তিকে সঠিকভাবে নির্ণয় ও চিহ্নিত করা। ভুলভ্রান্তি নির্ণয় ও চিহ্নিতকরণের প্রচেষ্টার ফলে কারো মনে যদি নোতুন উদ্দীপনা ও কর্ম উদ্যমের স্থলে হতাশার সঞ্চার হয় তাহলে সেই হতাশার মূল কারণ এই ভ্রান্তি নির্ণয় প্রচেষ্টার মধ্যে সন্ধান না করে হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির শ্রেণী চরিত্রের এবং মার্কসবাদী লেনিনবাদী তত্ত্বের সঠিক উপলব্ধির ক্ষেত্রে তার অক্ষমতা এবং তার প্রতি তার আস্থাহীনতার মধ্যেই করতে হবে। কাজেই ভুলভ্রান্তির বিশ্লেষণ অথবা তার আলোচনা পর্যালোচনা যদি কারো মধ্যে নোতুন সংগ্রামী উদ্দীপনার পরিবর্তে কর্মবিমুখ হতাশার সঞ্চার করে তাহলে সেই হতাশাকে কাটিয়ে ওঠা, তাকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে তার উচিত আরও গভীরভাবে মার্কসবাদ লেনিনবাদ এবং মাও চিন্তাধারাকে অধ্যয়ন ও আয়ত্ত করা এবং সমালোচনা সম্পর্কে অমার্কস্বাদী দৃষ্টিভঙ্গী যত সত্বর সম্ভব পরিহার করা। কারণ মার্কস্বাদী দৃষ্টিভঙ্গীর একটি প্রধান পরিচয় হলো সমালোচনাকে বৈজ্ঞানিক ও বস্তুনিষ্ঠ করা, সমালোচনাকে নেতিবাচক ব্যাপার মনে না করে তাকে সঠিক ও গঠনমূলক চিন্তা-কর্মের পক্ষে অপরিহার্য মনে করা এবং সমালোচনার দ্বারা হতাশাগ্রস্ত না হয়ে তার থেকে সঠিক চিন্তা, কর্ম ও সংগ্রামের প্রেরণা লাভ করা। 

আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভুলভ্রান্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে একই ধরনের ভুলভ্রান্তি এত বেশী হয়েছে ও তার পরিণামে সমগ্র আন্দোলন এমনভাবে বিপর্যন্ত হয়েছে, এত অসংখ্য বিপ্লবী কর্মীর জীবন বিপন্ন, বিনষ্ট ও বিপর্যস্ত হয়েছে যে, সেই সব ভুলভ্রান্তির সঠিক পরিচয় নির্ধারণ ও তার ফলাফলের পরিমাপ করা ভবিষ্যতে সংগ্রামকে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে আজ অপরিহার্য। যথার্থ সমালোচনার ঘাটতি অথবা অনুপস্থিতিই এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সর্বপ্রধান দুর্বলতা। এই দুর্বলতাকে দূর করতে সক্ষম না হলে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী কর্মীর আত্মদানও বিপ্লবের সাফল্যকে নিশ্চিত করবে না। উপরন্তু পুরাতন ভুলের পুনরাবৃত্তি পুরাতন পরিণামকেই আবার ডেকে আনবে। এই সব বিভ্রান্তি, বিপর্যয় ও ব্যর্থতাকে উত্তীর্ণ হতে হলে বিপ্লবের প্রতি পরিপূর্ণভাবে অনুগত থেকে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিশ্লেষণের হাতিয়ারকে আশ্রয় করে, এবং বস্তুনিষ্ঠ হয়ে অতীত ও বর্তমান আন্দোলনের নানা দিকের আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনাকে ব্যাপকভাবে অগ্রসর কর্মীদের মধ্যে, এমনকি জনগণের সচেতন অংশের মধ্যেও, ছড়িয়ে দিতে হবে। একমাত্র এই সমষ্টিগত ও গণতান্ত্রিক আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমেই এদেশের শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন তার সঠিক পরিণতির দিকে সমগ্র সমাজকে এগিয়ে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক বাঙলাদেশের প্রকৃত ভিত্তি রচনা করতে পারবে। 

এ জন্যে এ ধরনের আলোচনা-পর্যালোচনা সমালোচনাকে ভয় করার অথবা তার দ্বারা হতাশাগ্রস্ত হওয়ার প্রশ্ন সত্যকার বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে নিতান্তই অবান্তর। শুধু তাই নয়। সমালোচনার এই প্রক্রিয়াকে ব্যাপক ও গভীর করাই আজ তাঁদের অন্যতম প্রধান মৌলিক বৈপ্লবিক দায়িত্ব। 

ইংলণ্ড, ফ্রান্স, জার্মান প্রভৃতি ইউরোপের প্রধান প্রধান দেশগুলিতে আঠারো উনিশ শতকে যখন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয় তখন সেই বিপ্লব পরিচালিত হয় দেশীয় সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। শিল্প-বিপ্লব ও তারপর শিল্প বিকাশের সাথে সাথে দেশীয় অর্থনীতিতে সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তে ধনবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ক্রমশঃ প্রাধান্যে আসে এবং ভূস্বামীদের হাত থেকে অর্থনৈতিক শক্তিও সেই অনুযায়ী ক্রমশঃ বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। 

এই প্রক্রিয়া জারী থাকার সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা মোটামুটি সামস্ত ভূস্বামী ও তাদের প্রতিভূ রাজা-রাজড়াদের হাতেই থাকে। রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার মধ্যেকার এই ব্যবধান, শুধু ব্যবধান নয় বৈরিতা, উৎপাদনের ক্রমবিকাশের পথে একটা মস্ত বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে অবিচ্ছিন্ন। রাজনৈতিক ক্ষমতা যেমন অর্থনৈতিক ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষমতাই চরম বিশ্লেষণে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকৃত উৎস। 

ইউরোপে রাজনৈতিক ক্ষমতা সামন্ত ভূস্বামীদের হাতে এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্থাৎ উৎপাদনের উপকরণসমূহ মূলতঃ বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকার ফলে সমাজে যে সঙ্কটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সে পরিস্থিতির সমাধান বিপ্লবের মাধ্যমে ঘটে। এই ধরনের বিপ্লবের সর্বোচ্চ রূপ আমরা দেখি ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবে। 

কিন্তু ফরাসী বিপ্লব ছাড়াও ইংলণ্ড, জার্মানী, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ইতালী প্রভৃতি দেশগুলিতেও মূলতঃ একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামন্ত ভূস্বামী শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব, হ্রাস ও ধ্বংস হয় এবং ইউরোপের দেশে দেশে বুর্জোয়া শ্রেণী নিজেকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত করে। 

ইউরোপের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে যে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো : (ক) এই বিপ্লব পুরোপুরিভাবে দেশীয় সামন্তবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত (খ) এই বিপ্লবের নেতা বুর্জোয়া শ্রেণী (গ) এই বিপ্লবের দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণী নিজের বিজয় অর্জন পর্যন্ত সমগ্রভাবে ও প্রায় সর্বতোভাবে সামন্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিযুক্ত (ঘ) এই বিপ্লবের সহযোগী হলো শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজ (ঙ) এই বিপ্লবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কোন প্রশ্ন নেই, কারণ পুঁজিবাদী বিকাশ তখনও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়নি। 

ইউরোপের দেশে দেশে এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যখন সম্পন্ন হয়েছে অথবা হওয়ার পথে ঠিক সেই ঐতিহাসিক পর্যায়েই মার্কসবাদের আবির্ভাব। মার্কস এঙ্গেলস যে তত্ত্ব আবিষ্কার করেন তার মাধ্যমে তাঁরা সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক প্রক্রিয়াগুলি উদ্ঘাটিত করেন এবং অর্থনৈতিক বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় ও ধারাসমূহকে চিহ্নিত করেন। বস্তুনিষ্ঠ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁরা দেখান যে সমগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া ও পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমূহ পরিশেষে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে একটা বন্ধ্যাত্ব এবং অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে বাধ্য এবং সেই অচল অবস্থার অবসান সম্ভব একটি মাত্র পথে—সে পথ হলো ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা অগ্রসর শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ 

উনিশ শতকের শেষ ভাগ এবং বিশ শতকের গোড়াতে রাশিয়ায় এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেখান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন একটি পার্টির মধ্যে সুসংহত হয়ে ক্ষমতার চৌকাঠে উপনীত হয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব 
সম্পন্ন হওয়ার সময় রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি) এত সুসংহত একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় যে, তাঁদের নেতৃত্বে সেই বৎসরই অক্টোবর মাসে সেখানে সংগঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। 

১৯১৭ সালের রুশ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে : (ক) এই বিপ্লব সামন্তবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত (খ) এই বিপ্লবের নেতা বুর্জোয়া শ্রেণী হলেও সমগ্রভাবে তাঁরা বিপ্লবের সপক্ষে নেই। বুর্জোয়া শ্রেণীর বড়ো তরফ অর্থাৎ বড়ো বুর্জোয়া শ্রেণী এর বিরোধী (গ) বড়ো বুর্জোয়া শ্রেণীর এই বিরোধিতার কারণ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে তার সংযোগ (ঘ) এই বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণী ও তাঁদের পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ (ঙ) এই বিপ্লবে কৃষক সমাজের ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য (চ) এই বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। 

১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবসহ পূর্ববর্তী ইউরোপীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবসমূহের সাথে ১৯১৭ সালের রাশিয়ার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে পার্থক্য দেখা যায় তা হলো বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের তুলনামূলক অবস্থানের ক্ষেত্রে। এই দুই পর্যায়ের বুর্জোয়া বিপ্লবে এই তিন শ্রেণীর অবস্থানের পার্থক্য মূলতঃ দেখা দেয় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের অবস্থানের জন্যে। আঠারো-উনিশ শতকের ইউরোপীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব অথবা গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু রুশ বিপ্লবের সময় সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব পরিসরে পরিণত হয়েছিলো এক মহা পরাক্রান্ত শক্তিতে। 

কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে কীভাবে এই পার্থক্য সৃষ্টি করলো? এই প্রশ্নের আলোচনার মধ্যে শুধু যে রুশ বুর্জোয়া বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলির কারণসমূহই আমরা বুঝতে পারবো তাই নয় পরবর্তীকালে চীন, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের এবং আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্যগুলিও এর মাধ্যমেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। 

৪ 

ইউরোপের যে সমস্ত দেশগুলিতে আঠারো উনিশ শতকের দিকে বুর্জোয়া শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় অর্থাৎ যে সমস্ত দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রথম দিকে সম্পন্ন হয় সেই দেশগুলিই পুঁজিবাদকে নিজেদের দেশীয় অর্থনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুদৃঢ় করে পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে। দেশীয় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানোর জন্য তাদের প্রয়োজন হয় বিদেশী বাজার এবং বিদেশী কাঁচামালের। সাম্রাজ্যবাদী বিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগও হয়ে দাঁড়ায় তাদের পক্ষে এক অপরিহার্য প্রয়োজন।

এজন্যেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত এই পুঁজিবাদী দেশগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন অনুন্নত দেশগুলিতে তো বটেই, এমনকি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে পর্যন্ত, নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ ঘটাতে থাকে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম ভাগে রাশিয়া নিজে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ হলেও ইংলণ্ড, ফ্রান্স ইত্যাদির তুলনায় তা ছিলো অনগ্রসর এবং সে জন্যেই ঐ সময়ে রাশিয়াতেও ইংলণ্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ও প্রভাব নগণ্য ছিলো না। এক দিকে, পুঁজিবাদী শিল্প বিকাশের ফলে তৎকালীন রাশিয়ায় একটি বড়ো বুর্জোয়া শ্রেণীর জন্ম হয়েছিলো। অন্যদিকে এই বড়ো বুর্জোয়াদের সাথে ইংলণ্ড, ফ্রান্স ইত্যাদির সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সংযোগ ঘটেছিল।

সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে এই সংযোগের ফলে রুশ বড়ো বুর্জোয়া শ্রেণী সামন্তবাদ ও তার প্রতিভূ জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার পক্ষপাতী ছিলো না এবং সেই হিসাবে তার মধ্যে শ্রেণী কাঠামোগত একটা দুর্বলতা দেখা দিয়েছিলো। এই দুর্বলতা পরবর্তীকালে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকার মুৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের মধ্যে আরও প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়। এই দুর্বলতার ফলেই রুশ বুর্জোয়াজীকে ১৯১৭ সালেও একটা পুরোপুরি স্বাধীন শ্রেণী বলা যেতো না। 

পুরোপুরি একটি স্বাধীন শ্রেণী না হওয়ার ফলেই রুশ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুর্জোয়াশ্রেণী সমগ্রভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, উপরন্তু তার বড়ো অংশটি বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিলো এবং পরবর্তীকালে মেনশেভিকদের সাথে একত্রিত হয়ে বিপ্লবকে পরাস্ত করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলো। এই স্বাধীনতার অভাবেই পূর্ববর্তী এই ধরনের বুর্জোয়াদের মতো তারা সামন্তবাদ বহুলাংশে উচ্ছেদের অথবা সামন্তবাদী শক্তিকে ভয়ানকভাবে খর্ব করার পক্ষপাতী ছিলো না। রুশ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের অপেক্ষাকৃত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার এটাই ছিলো মূল কারণ। 

বুর্জোয়া নেতৃত্বের এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতার জন্যেই তাঁরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে টিকিয়ে রাখতে ও তাকে সম্পূর্ণ করতে চায়নি। উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও তার সাথে আপোসহীন বড়ো বুর্জোয়াদের সাথে মিলিত হয়ে অন্যান্য স্তরের বুর্জোয়ারাও শ্রমিক শ্ৰেণী ও কৃষক সমাজের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে ব্যর্থ ও পরাস্ত করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলো। 

কিন্তু পুঁজিবাদের অনেকখানি বিকাশের ফলে শ্রমিক শ্রেণী ও তার মিত্র কৃষক সমাজের সম্মিলিত রাজনৈতিক শক্তি তৎকালীন রাশিয়ার এত বেশী প্রাধান্যে অবস্থিত ছিলো যে তাকে পরাস্ত করা সমান্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সহযোগী দেশীয় বুর্জোয়াদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং তার ফলে লেনিনের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, সেখানে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়েছিলো। 

৫ 

চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রেণীসমূহের অবস্থান রাশিয়ার থেকে বেশ কিছুটা স্বতন্ত্র। দীর্ঘ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালে মাও সেতুঙ-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি চীনে ক্ষমতা দখল করে। এই বিপ্লবের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি লক্ষণীয় তা হলো : (ক) এই বিপ্লব সামন্তবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত (খ) সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোসপন্থী বুর্জোয়া অর্থাৎ মুৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালিত (গ) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত (ঘ) এই বিপ্লবের নেতৃত্ব শ্রমিক শ্রেণী ও তার পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির (ঙ) এই বিপ্লবে পেটি ও মধ্য বুর্জোয়া শ্ৰেণী ব্যাপকভাবে মিত্র শক্তির ভূমিকা পালন করে (চ) এই বিপ্লবে কৃষক সমাজ প্রধান শক্তির ভূমিকা পালন করে (ছ) এই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে উন্নীত হতে চীনের কয়েক বৎসর সময় অতিক্রান্ত হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলির আলোচনাকালে যে জিনিসটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হচ্ছে চীনে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান। এই অবস্থান বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান থেকে অনেকখানি স্বতন্ত্র। এক শতকেরও বেশি সময় চীন নানাভাবে বৃটিশ, ফরাসী, ওলন্দাজ, জার্মান, জাপানী, মার্কিন ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দ্বারা শোষিত ও নিপীড়িত হয়েছে। অল্প সময়ের জন্যে জাপানীরা সরাসরি চীনা ভূখণ্ডের কিছু অংশ নিজেদের প্রত্যক্ষ দখলে রাখলেও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীরা হংকং-এর মতো জায়গা ব্যতীত সরাসরি কোন এলাকা তেমন দখলে রাখেনি। তাঁরা ব্যবসায়ী ও শিল্প পুঁজির মাধ্যমেই প্রধানতঃ তাঁদের শোষণ নিপীড়নকে চীনে স্থায়ী রেখেছিলো। এ ছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিপ্লবের চূড়ান্ত জয়ের কয়েক বৎসর পূর্ব থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা সামন্তবাদের রক্ষক ও মুৎসুদী পুঁজির প্রতিভূ চিয়াং কাইশেক সরকারকে পূর্বের থেকে আরও অধিক ও ব্যাপকহারে সামরিক সাহায্য যোগান দিয়েছিলো। 

এক শতকেরও বেশী সময় চীনে সামাজ্যবাদের এই অবস্থান ও উপস্থিতি শিল্প বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক ছিলো এবং সেই হিসেবে তারা সেখানে স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণী বিকাশের ক্ষেত্রেও ছিলো মস্ত এক বাধাস্বরূপ। সাংহাই, ক্যান্টন ইত্যাদি এলাকায় যা কিছু শিল্প গড়ে উঠেছিলো তার প্রায় সমস্তই ছিলো সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি অথবা সেই পুঁজির সাথে কোন না কোন প্রকারে সংযুক্ত। 

চীনে পুঁজিবাদী বিকাশ রাশিয়ার মতো না ঘটার ফলে সেখানকার বিপ্লবে কৃষকদের প্রাধান্য তুলনায় অনেক বেশী থাকে। পুঁজিবাদের এই অনগ্রসরতার জন্যে সেখানে বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর, বিশেষতঃ বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাও রাশিয়ায় ঐ শ্রেণীর ভূমিকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তার কারণ চীনে এই শেষোক্ত শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা যেভাবে নির্যাতিত হতো রাশিয়ায় ততখানি হতো না। এ জন্যেই মাও বারবার বিপ্লবীদের একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বিপ্লবের ক্ষেত্রে বর্তমান পর্যায়ে উন্নত পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা এবং আধা ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী দেশগুলির বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা মোটেই এক নয়, এক হতে পারে না। দ্বিতীয়োক্ত দেশগুলিতে তারা যে গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে প্রথমোক্ত দেশগুলিতে তা তো করেই না, উপরন্তু সে ক্ষেত্রে তাঁরা মোটামুটিভাবে প্রতিবিপ্লবী শিবিরেই অবস্থান করে। 

চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সব থেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিপ্লবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব। এবং এ প্রসঙ্গে আবার যে জিনিসটি বিশেষভাবে লক্ষ করা দরকার তা হচ্ছে এই যে, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে ঐতিহাসিকভাবে এই ভূমিকা পালন চীন বিপ্লবে সম্ভব হয়েছে সেখানে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান ও উপস্থিতির জন্যে। এই অবস্থান ও উপস্থিতিই দেশীয় বুর্জোয়াদের শ্রেণীগত মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে রেখে তার স্বাধীন ও নেতৃত্বদানকারী ভূমিকাকে অসম্ভব করেছে। এই অবস্থানই চীনের শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিকে সক্ষম করেছে শ্রমিক, কৃষক ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের সম্মিলিত শক্তিকে সংহত ও সংগঠিত করে সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দেশীয় সহযোগী মুৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের সম্মিলিত শক্তিকে পরাস্ত এবং উৎখাত করতে। 

কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এইভাবে চীনে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় তারই অপর নাম জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। 

বুর্জোয়া গণতন্ত্রিক আন্দোলনের বুর্জোয়াজীর ভূমিকা এবং কমিউনিস্টদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে যে নোতুন চিন্তা-ভাবনা অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে শুরু হয় সে বিষয়ে এখানে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা দরকার। কারণ এই চিন্তা- ভাবনা থেকেই পরবর্তীকালে চীন বিপ্লবের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচিত হয়।

আরও একটি কারণে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের এবং লেনিনের প্রাসঙ্গিক বক্তব্যকে এখানে উল্লেখ করা দরকার। সে কারণটি হলো এই যে, বাঙলাদেশে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজীবাদীদের দেশীয় দালাল বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির বেঈমানরা সম্প্রতি তাদের পত্র-পত্রিকায় খুব জোরেশোরে এই বক্তব্যকে তাদের অধনবাদী পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রতিবিপ্লবী তত্ত্বের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে হাজির করছে। এই বেঈমানরা শুধু যে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল তাই নয়, দেশীয় ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে এরা হলো জাতীয়করণকৃত শিল্প বাণিজ্য থেকে উদ্ভূত কালোবাজারী, চোরাকারবারী ও চোরাচালানীতে নিযুক্ত ব্যক্তিগত পুঁজিরও নির্লজ্জ দালাল। আওয়ামী লীগ সরকারের সমাজতন্ত্র গড়ার সংগ্রামে শরীক থেকে এরাও ব্যাপক লুটতরাজের খবর কোন না কোনভাবে পেয়ে এসেছে এবং চোরাচালানী, কালোবাজারী পুঁজি উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখে এরা মরিয়া হয়ে পুঁজিবাদী জাতীয়করণের সপক্ষে লেনিনের উক্তিকে এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিকের কতকগুলি বক্তব্যকে বিকৃত ব্যাখ্যার দ্বারা কাজে লাগাতে চাইছে। 

রুশ অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে লেনিন স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি অনেকখানি সংহত হওয়ার পর উপনিবেশিক ও পশ্চাৎপদ দেশগুলির গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে যে নোতুন চিন্তার সূত্রপাত ঘটে তার মূল কথা হলো ঐ সমস্ত দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যেভাবে বুর্জোয়াজীর নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার কথা ইতিপূর্বে বলা হচ্ছিলো সেভাবে এই ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হওয়া আর সম্ভব নয়। আর তা সম্ভব নয় দুটি মূল কারণে। প্রথমতঃ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথে এই সমস্ত দেশের পুঁজির বড়ো অংশের আঁতাত ও সংযোগ। 

এ প্রসঙ্গে জাতীয় এবং ঔপনিবেশিক প্রশ্নের ওপর গঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিকের কমিশনের রিপোর্ট ও লেনিনের তৎসংক্রান্ত বক্তব্য এখানে প্রথমে উল্লেখ করা দরকার। উৎপীড়ক জাতিসমূহ (সাম্রাজ্যবাদী) এবং উৎপীড়িত জাতিসমূহের (উপনিবেশিক) মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির দ্বন্দ্বের উল্লেখের পর লেনিন বলছেন: 

“তৃতীয়তঃ, আমি পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রশ্নটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই। এটা এমন এক প্রশ্ন যা কিছু মতপার্থক্যের জন্মদান করেছে। আমরা আলোচনা করেছি যে, নীতিগতভাবে ও তত্ত্বগতভাবে এটা বলা ঠিক হবে কিনা যে, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের উচিত পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করা। আমাদের আলোচনার ফলে আমরা ঐক্যমত হয়ে সিদ্ধান্তে এসেছি যে, “বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে আমরা জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের কথা বলবো। এটা সন্দেহাতীত যে, যে কোন জাতীয় আন্দোলন কেবলমাত্র বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনই হতে পারে, কারণ পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হলেন কৃষক, যারা বুর্জোয়া ধনবাদী সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করেন। এটা বিশ্বাস করা কল্পনাবিলাস হবে যে, এই সমস্ত পশ্চাৎপদ দেশগুলির কমিউনিস্ট পার্টিগুলি, যদি সেখানে তাদের উদ্ভব সম্ভবও হয় তাহলেও কৃষক আন্দোলনের সাথে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক স্থাপন না করে এবং তাকে সক্রিয় সমর্থন না দিয়ে কমিউনিস্ট রণকৌশল ও কমিউনিস্ট নীতি অনুসরণ করতে পারে। যাই হোক, আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে যে, আমরা যদি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলি তাহলে আমরা সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যেকার সকল পার্থক্যকে বিলুপ্ত করে দেবো। তথাপি সেই পার্থক্য ইদানীং পশ্চাৎপদ এবং ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে, কারণ সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াজী নিপীড়িত জাতিগুলির মধ্যে সংস্কারবাদী আন্দোলন রোপণ করার জন্যে তার ক্ষমতায় যা কিছু করা সম্ভব তাই করছে। শোষক দেশগুলির ও উপনিবেশিগুলির বুর্জোয়াজীর মধ্যে একটা সমঝোতা হয়ে গেছে যার ফলে প্রায়ই—এবং সম্ভবতঃ এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই— নিপীড়িত দেশগুলির বুর্জোয়াজী জাতীয় আন্দোলন সমর্থন করলেও তারা সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াজীর সাথে সম্পূর্ণ একমত অর্থাৎ সকল বিপ্লবী আন্দোলন ও বিপ্লবী শ্রেণীসমূহের বিরুদ্ধে তারা এর সাথে নিজেদের শক্তিকে সংযুক্ত করে। কমিশনের মধ্যে এটা তর্কাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং আমরা স্থির করেছি যে, একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই পার্থক্যকে হিসেবের মধ্যে ধরা এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক’-এর পরিবর্তে ‘জাতীয় বিপ্লবী’ শব্দটি ব্যবহার করা। এই পরিবর্তনের তাৎপর্য এই যে, আমরা কমিউনিস্টরা উপনিবেশগুলিতে বুর্জোয়া-মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করবো তখনই যখন সেগুলি হবে খাঁটি বিপ্লবী এবং যখন তাদের প্রবক্তারা বিপ্লবী নীতিকে কৃষক সমাজ ও শোষিত জনগণকে শিক্ষিত এবং সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আমাদের কাজে বাধাদান করবে না। এই শর্তসমূহ যদি বিরাজ না করে তাহলে এই সকল দেশে কমিউনিস্টরা নিশ্চয়ই লড়াই করবে সংস্কারবাদী বুর্জোয়াদের সাথে, যাদের মধ্যে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নায়করাও রয়েছেন।,”[৪] 

কমিশন রিপোর্টের ওপর এই একই আলোচনায় লেনিন আর একটি বক্তব্য খুব স্পষ্টভাবে উত্থাপন করেছেন যার গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তব্যটি হলো নিম্নরূপ : 

“প্রশ্নটিকে এইভাবে উত্থাপন করা হয়েছিলো : যে সমস্ত পশ্চাৎপদ দেশগুলি এখন মুক্তি পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং যাদের মধ্যে যুদ্ধের পর থেকে প্রগতির দিকে কিছুটা অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী স্তর অপরিহার্য, এই বক্তব্যকে কি আমরা সঠিক বলে বিবেচনা করতে পারি? আমরা নেতিবাচক জবাব দিয়েছি। যদি বিজয়ী বিপ্লবী সর্বহারা তাদের মধ্যে নিয়মিত প্রচারকার্য চালায় এবং সোভিয়েত সরকারসমূহ যদি তাদের সাহায্যে সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে এগিয়ে আসে, সেই অবস্থায় পশ্চাৎপদ জনগণকে অনিবার্যভাবে পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম করতে হবে এটা ধরে নেওয়া সঠিক হবে না। উপনিবেশ ও পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে আমাদেরকে যে শুধু যোদ্ধাদের স্বাধীন বাহিনী ও পার্টি সংগঠন সৃষ্টি করতে হবে তাই নয়, শুধু যে এই মুহূর্তেই কৃষক সোভিয়েত সংগঠিত করার জন্য প্রচার কার্য শুরু করতে হবে এবং তাঁদেরকে প্রাক-পুঁজিবাদী অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে তাই নয়, উপরন্তু কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে যথোপযুক্ত তত্ত্বগত ভিত্তিতে এই বক্তব্য পেশ করতে হবে যে, অগ্রসর দেশগুলির সর্বহারার সাহায্যে পশ্চাৎপদ দেশগুলি পুঁজিবাদী স্তর অতিক্রম না করেও বিকাশের কতকগুলি স্তরের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ব্যবস্থায়, সাম্যবাদে উপনীত হতে পারে। 

ওপরে লেনিনের যে বক্তব্যগুলি উদ্ধৃত করা গেল তার সার সংক্ষেপ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো এই : (ক) পশ্চাৎপদ এবং ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ঐ নামে অভিহিত না করে তাকে জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন নামে অভিহিত করাই অধিকতর সঙ্গত হবে (খ) প্রত্যেক জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন সন্দেহাতীতভাবে মূলতঃ হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন (গ) সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়ারা উৎপীড়িত দেশগুলির বুর্জোয়াদের সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে এবং তার ফলে এই দ্বিতীয়োক্ত দেশগুলিতে বুর্জোয়াদের মধ্যে সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলনের দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করলে এই দুই ধারার মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যকে বিলুপ্ত করা হবে (ঘ) সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াজী ও শোষিত দেশগুলির বুর্জোয়াজীর মধ্যে সমঝোতার ফলে দ্বিতীয়োক্ত বুর্জোয়াজী জাতীয় আন্দোলন কিছুটা সমর্থন করলে নিজেদের দেশে সকল প্রকার বিপ্লবী আন্দোলন ও বিপ্লবী শ্রেণীর বিরোধিতার ক্ষেত্রে তারা প্রথমোক্ত বুর্জোয়ার সাথে নিজেদের সমস্ত শক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকে (ঙ) কমিউনিস্টরা উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করবে একমাত্র তখনই যখন সেই আন্দোলন হবে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী এবং যখন সেই বিপ্লবী আন্দোলনের প্রবক্তারা কৃষক সমাজ ও শোষিত জনগণকে বিপ্লবী শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের প্রচেষ্টাকে বাধাদান করবে না (চ) বুর্জোয়ারা যদি (ঙ)তে বর্ণিত শর্ত পালন না করে তাহলে কমিউনিস্টরা সংস্কারবাদী বুর্জোয়াজীর বিরোধিতা করবে, তাঁদের বিরুদ্ধে লড়বে (ছ) প্রথম মহাযুদ্ধোত্তরকালে ও সোভিয়েত রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে অনিবার্যভাবে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে যেতে হবে এই বক্তব্য ভুল (জ) কারণ যে সমস্ত দেশে সর্বহারা ক্ষমতায় এসেছে তাঁদের কার্য এবং সোভিয়েত সরকারসমূহের সর্বপ্রকার সাহায্য যদি পশ্চাৎপদ দেশগুলি পায় এবং তাদের সাহায্যে সেখানে যদি বিপ্লবী যোদ্ধাদের বাহিনী ও পার্টি সংগঠন গড়ে ওঠে তাহলে তাদেরকে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ অপরিহার্যভাবে অতিক্রম করতে হবে সেটা মনে করা ভুল (ঝ) যথোপযুক্ত তত্ত্বগত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে ঘোষণা করতে হবে যে, পশ্চাৎপদ দেশগুলি পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমনকি সাম্যবাদে উপনীত হতে পারে। 

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও সাম্যবাদে উত্তরণ প্রসঙ্গে লেনিনের উপরোক্ত বক্তব্যগুলিকে অতি সতর্কভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ করতে হবে কারণ এই সতর্কতা ব্যতীত অনেক ভুলভ্রান্তির নিরসন হবে না এবং লেনিনের দোহাই পেড়ে সংশোধনবাদী বেঈমানদের তত্ত্ববাগীশতার সত্যকার প্রতিবিপ্লবী রূপটিও ধরা পড়বে না। 

এ প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়টি এখানে লক্ষ করা দরকার সেটা হচ্ছে এই যে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াজী নিপীড়িত দেশগুলির বুর্জোয়াজীর সাথে একটা সমঝোতায় আসার ফলে সেখানকার বুর্জোয়াদের মধ্যে যে সংস্কারবাদী চিন্তা ও আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে তার ফলেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সেই নামে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সাথে আপোসের কারণে নিপীড়িত জাতিগুলির বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রেণীগতভাবে স্বাধীন না হওয়ার ফলে প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিপ্লবী জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, তাতে অংশগ্রহণ পর্যন্ত তাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তাই নয়। এই বুর্জোয়া শ্রেণী নিপীড়িত দেশের সকল প্রকৃত বিপ্লবী আন্দোলন ও বিপ্লবী শ্রেণীর সক্রিয় বিরোধী। 

দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনই মূলতঃ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। কারণ এই আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন ও সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত কোন সাফল্য অর্জন করতে পারে না। এবং কৃষকরা মূলতঃ যে উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে তা হলো বুর্জোয়া-ধনবাদী। অর্থাৎ অন্যভাবে বলা চলে যে, কৃষক সমাজকে বাদ দিয়ে যেহেতু জাতীয় বিপ্লব কল্পনা করা যায় না এবং কৃষক যেহেতু উৎপাদনের বুর্জোয়া- ধনবাদী সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করে, তাই জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন মূলতঃ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। কাজেই নিপীড়িত দেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে সাম্রাজ্যবাদের যে আপোস হয়েছে তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্যে এই বিপ্লবের সাথে পূর্ব পরিচিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পার্থক্য নির্দেশ করার উদ্দেশ্যে তাকে জাতীয় বিপ্লব আখ্যা দিলেও এই নামকরণের দ্বারা তার মৌলিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চরিত্র খর্ব হয় না। 

তৃতীয়তঃ, নিপীড়ত দেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন অংশকেই জাতীয় আন্দোলনে সমর্থন ও সাহায্য করা যায় না, একথা বলা হচ্ছে না। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই সব দেশে বুর্জোয়াজী যে সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোস করে ফেলেছে এবং তাদের কোন অংশের মধ্যেই বৈপ্লবিক কোন সম্ভাবনা নেই, একথা ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে না। উপরন্তু বলা হচ্ছে যে, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে একমাত্র তখনই সমর্থন করা যাবে যখন তা হবে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী এবং যখন তার প্রবক্তারা কৃষক সমাজ ও ব্যাপক নিপীড়িত জনগণকে শিক্ষিত ও সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, নিপীড়িত দেশের বুর্জোয়াজীর একটি অংশ এখনো প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী হতে পারে এবং তাদের সাথে একত্রে কাজ করা এখনও কমিউনিস্টদের পক্ষে সম্ভব। 

চতুর্থতঃ, বিজয়ী বিপ্লবী সর্বহারার, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তিসমূহ এবং উন্নত দেশসমূহের সর্বহারার সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থনে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে একটি অনুন্নত সমাজের পক্ষে সম্ভব কতকগুলি স্তর পার হয়ে এমনভাবে এগিয়ে যাওয়া, যার ফলে সেই সমাজ অনিবার্যভাবে পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করেই সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদে উপনীত হতে পারে। এখানে যে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি বিশেষ সতর্কতার সাথে লক্ষ করা দরকার সেটা হলো, পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বমূলক ভূমিকা। এই ভূমিকা ব্যতীত যে এই উত্তরণ একেবারেই অসম্ভব লেনিন এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বক্তব্য থেকে তা অত্যন্ত স্পষ্ট 

পঞ্চমতঃ পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করে সমাজতন্ত্রে উপনীত হওয়ার জন্যে প্রয়োজন যথোপযুক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তি। 

লেনিন ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের এই বক্তব্যসমূহের আলোকে পরবর্তীকালের চীনা বিপ্লব এবং ভিয়েনাম, কোরিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস ইত্যাদি দেশে বিপ্লবের বিকাশের ধারা, অগ্রগতি ও সাফল্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এই সমস্ত দেশের বিপ্লবে কৃষক সমাজকে মূল শক্তি হিসেবে এবং দেশীয় বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অংশকে মিত্র হিসেবে অবলম্বন করে কমিউনিস্ট পার্টি পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করে নিজেদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছে অথবা সেই বিপ্লব সম্পন্ন করার পথে। এই ধরনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে যথোপযুক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তির কথা লেনিন ওপরে উল্লেখ করেছেন সেই তাত্ত্বিক ভিত্তিই পরবর্তী চীন বিপ্লবের অগ্রগতির সাথে সাথে মাও সেতুঙ কর্তৃক রচিত হয় এবং চীনের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে তাকে তিনি নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার এই তত্ত্বের ভিত্তিতে এই ধরনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাধারণ নামকরণ পরবর্তী পর্যায়ে দাঁড়ায় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। 

এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী পর্যায়ে বিশদ আলোচনা করবো এবং আমাদের দেশের অনুরূপ আন্দেলনের সাফল্য অসাফল্য, ওঠানামা সব কিছুর হিসেব নিয়ে ভবিষ্যতে তার রূপটি কি হবে সে বিষয়ে একটা নির্দিষ্ট ধারণায় উপনীত হওয়ার চেষ্ট করবো। কিন্তু তার পূর্বে আমাদের যে কাজটি এখানে করতে হবে সেটা হলো, সংশোধনবাদী বেঈমানদের এ বিষয়ে যা বক্তব্য তার একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা এবং তাদের প্রতিবিপ্লবী চরিত্রকে পরিষ্কারভাবে উদ্ঘাটন করা। 

এখানে প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে, অধনবাদী পথ নামে যে তাত্ত্বিক সুড়ঙ্গ কেটে উপরোক্ত বেঈমানের দল বিপ্লবী কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে উপস্থিত হতে চেষ্টা করছে তার সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কোনই সম্পর্ক নেই। এ সুড়ঙ্গ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিরোধী ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ-কোসিগিন গোষ্ঠীরই নিজস্ব সৃষ্টি। 

এদের এই অধনবাদী পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মূল কথা হলো সর্বহারার একনায়কত্ব বাতিল এবং পুঁজিবাদী জাতীয়করণের মধ্যে বুর্জোয়া নেতৃত্বে অনুন্নত নিপীড়িত দেশগুলির অর্থনীতিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে সোভিয়েত সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে নিজেদের দেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভালভাবে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হয় এবং অধনবাদী পথে ‘সমাজতন্ত্রের পথের পথিক দেশগুলিতে তাদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পুঁজি বিনিয়োগ, কাঁচামাল লুণ্ঠন ও অসম বাণিজ্যের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে অবাধ করা যায়। 

বস্তুতঃপক্ষে, পুঁজিবাদী জাতীয়করণের মাধ্যমে ‘সমাজতন্ত্রে’ উত্তরণের এই প্রতিবিপ্লবী তত্ত্বটিকে বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকর করতে হলে সর্বহারার একনায়কত্বের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বটি বাতিল না করে কোন উপায় নেই। এই তত্ত্বকে বাতিল তারা এ জন্যেই করেছে এবং আধা-সামন্তবাদী নয়া-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে পুঁজিবাদী জাতীয়করণের ‘অধনবাদী’ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের তত্ত্ব হাজির করেছে। 

শুধু তাই নয়। পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের বক্তব্যটিকে তারা এমনভাবে উপস্থিত করছে যাতে মনে হয় যে, সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ব্যতিরেকেই একটি দেশের পক্ষে সামন্তবাদী, আধা-সামন্তবাদী অথবা নিম্নতর পর্যায় থেকে সরাসরি সমাজতন্ত্রে চলে যাওয়া বাস্তবতঃ সম্ভব। অথচ লেনিনের উপরোক্ত বক্তব্য থেকে খুব পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, যে সমাজের বিপুল অধিকাংশ জনগণ কৃষক সমাজের অন্তর্ভুক্ত সেখানে বুর্জোয়া-ধনবাদী উৎপাদন সম্পর্ক কিছুকাল থাকবেই এবং সেই সম্পর্ককে সর্বহারার অগ্রবাহিনী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই বিলোপ করতে হবে। কিন্তু এখানেও শেষ নয়। যে সমাজে ধনবাদী বিকাশ কিছুটা হয়েছে সেখানেও বুর্জোয়াজীর একটি বিপরীত অংশের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়নি। উপরন্তু বলা হয়েছে যে, তাদের বিপ্লবী জাতীয় সংগ্রামে অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে কমিউনিস্টরা তাদেরকে সমর্থন করবে। একথা বলার প্রকৃত অর্থ এই যে, নিপীড়িত দেশগুলিতে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে এবং শ্রমিক শ্রেণী, কৃষক সমাজ ও বিপ্লবী বুর্জোয়াদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে জয়যুক্ত হয়ে, পুঁজিবাদের আর কোন বিকাশ ঘটার সুযোগ না দিয়ে, সমাজতন্ত্রে উপনীত হতে পারে। 

১৯২০ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের এই অধিবেশনের পরবর্তী পর্যায়ে আধা-সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিপীড়িত দেশগুলিতে বিপ্লবের বিকাশ কিভাবে হওয়া সম্ভব তা নিয়ে যে চিন্তা-ভাবনা এই সমস্ত দেশে শুরু হয় তারই প্রতিফলন ঘটে চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, লাওস কম্বোডিয়া ইত্যাদি দেশের সামন্তবাদ, মুৎসুদ্দী পুঁজি (সংস্কারবাদী বুর্জোয়া) ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে এবং এই আন্দোলনের ‘যথোপযুক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তির’ যে কথা লেনিন তার উপরি উদ্ধৃত বক্তব্যে বলেছেন, সেই তাত্ত্বিক ভিত্তি মাও সেতুঙ-এর দ্বারা রচিত হয়। লেনিন ও স্ট্যালিন যেমন রুশ বিপ্লবের নেতৃত্ব দানকালে মার্কসবাদী তত্ত্বকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেন, মাও সেতুঙও ঠিক সেইভাবে চীন বিপ্লবের নেতৃত্ব দানকালে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বকে আরও সমৃদ্ধ এবং বিকশিত করেন। এ জন্যেই মাও হলেন লেনিন-স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারী এবং বর্তমান যুগে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শ্রেষ্ঠতম প্রবক্তা। 

১০

সাম্রাজ্যবাদের সাথে নিপীড়িত দেশগুলির বুর্জোয়াজীর একটি অংশের, বাস্তবক্ষেত্রে বড়ো অংশের, আপোস হয়ে যাওয়ার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্যে লেনিন এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অন্যান্য নেতারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত না করার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও এ বিপ্লব যে প্রকৃতপক্ষে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সেটা তাঁরা সুস্পষ্টভাবেই বলেন। মাও-সেতুঙ কিন্তু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বরাবর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। কারণ লেনিন যে ‘যথোপযুক্ত তাত্ত্বিক ভিত্তির’ কথা বলেছিলেন চীন বিপ্লবের বিকাশ এবং অগ্রগতির সাথে সাথে মাও সেতুঙ সেই তাত্ত্বিক ভিত্তি যথোপযুক্তভাবেই রচনা করেন এবং তার মাধ্যমেই আধা সামন্তবাদী আধা ঔপনিবেশিক দেশে সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোসকামী ও আপোসবিরোধী দুই অংশের প্রতি কী নীতি গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য উপস্থিত করেন। এ ক্ষেত্রে স্ট্যালিনের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যও এই পর্যায়ের তত্ত্ব নির্মাণে সহায়ক হয়।[৬]

কিন্তু মাও সেতুঙ এক্ষেত্রে শুধু যে বুর্জোয়াজীর দুই অংশের প্রতি কমিউনিস্টরা কি নীতি অবলম্বন করবে সেটাই নির্ধারণ করেন তাই নয়। পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর পুরোপুরি অতিক্রম না করে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে কিভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তীর্ণ হওয়া যায় তার বিস্তারিত তত্ত্বও মাও সেতুঙ রচনা করেন। এই তত্ত্ব যে ‘অধনবাদী’ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব নয়, তা বলাই বাহুল্য। 

এই সংক্ষিপ্ত সাধারণ আলোচনার পর এবার আলোচ্য বিষয়ে মাও সেতুঙ-এর বক্তব্যকে বিশদভাবে এবং আমাদের দেশের পরিস্থিতিকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা দরকার। 

১১ 

১৯২০ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অধিবেশনে পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করে সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদে উত্তীর্ণ হওয়ার যে কথা লেনিন বলেছিলেন তার প্রকৃত অর্থ কি? এই অর্থ পরিষ্কার না করে মাও সেতুঙ-এর তত্ত্ব আলোচনায় গেলে এ বিষয়ে মার্কসবাদী চিন্তার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাটি ঠিকমতো বোঝা যাবে না। সে জন্যে পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ বলতে লেনিন ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটা 

প্রথমে দেখা দরকার। বামপন্থী কমিউনিজম শিশুসুলভ উচ্ছৃঙ্খলতা নামক গ্রন্থের যে অংশে লেনিন বলশেভিজমের প্রধান প্রধান স্তরগুলির উল্লেখ ও পর্যালোচনা করেছেন সেখানে ১৯০৭-১০- এর পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলছেন যে, “শ্রেণী পার্থক্যের বাইরে ও শ্রেণীর ঊর্ধ্বে যে মোহ ছিল, পুঁজিবাদকে এড়িয়ে যাওয়া সম্পর্কে যে মোহ ছিল, তা বাতাসে উড়ে গেল।” “এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পুঁজিবাদকে এড়িয়ে যাওয়ার মোহ বাতাসে উড়ে যাওয়ার কথা লেনিন যে সময় বলছেন (১৯২০) সেই সময়েই তিনি আবার পুঁজিবাদের স্তর অতিক্রম না করে পশ্চাৎপদ দেশগুলির সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনার কথাও বলছেন। 

এর থেকে যে জিনিসটি প্রথমেই বুঝতে হবে তা হলো, ‘পুঁজিবাদের স্তর অতিক্রম না করার অর্থ ‘পুঁজিবাদকে এড়িয়ে যাওয়া নয়। 

১৯২০ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অধিবেশনের সময় পুঁজিবাদী স্তর অতিক্রম না করে যে সমস্ত পশ্চাৎপদ দেশগুলির সমাজতন্ত্রে উত্তরণের কথা বলা হয়েছিলো সে দেশগুলির অধিকাংশেই পুঁজিবাদী বিকাশ কিছু কিছু শুরু হয়েছিলো এবং ভারতবর্ষ ও চীনের মতো দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ অনেকখানি ঘটেছিলো। কাজেই এই সমস্ত দেশে বাস্তবতঃ পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম করার অর্থ যে পুঁজিবাদকে ‘এড়িয়ে যাওয়া’ ছিলো না, তা বলাই বাহুল্য। পরবর্তীকালের ইতিহাস থেকেও দেখা গেছে যে ভারত, চীন, মিসর ইত্যাদি দেশগুলিতে পুঁজিবাদকে এড়িয়ে যাওয়া তো সম্ভব হয়ইনি, উপরন্তু পুঁজিবাদের বিকাশ সেখানে আরও ঘটেছে। 

আসলে এখানে ‘পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর অতিক্রম না করার’ যে কথা বলা হয়েছে তার প্রকৃত অর্থ হলো, পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর পুরোপুরি অতিক্রম না করা। অর্থাৎ পুরাতন পুঁজিবাদী দেশগুলি যেভাবে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী বিকাশ শুরু হওয়ার পর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্ব ও পরবর্তী পর্যায়ে পুঁজিবাদী বিকাশের বিভিন্ন স্তর পর্যায়ক্রমে পুরোপুরি অতিক্রম করে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়েছিলো সেইভাবে পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর পুরোপুরি অতিক্রম করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে উপনীত হওয়া এইসব পশ্চাৎপদ দেশগুলির দ্বারা সম্ভব নয়।

সাম্রাজ্যবাদে উত্তরণকে পুঁজিবাদী বিকাশের একটা সীমারেখা হিসেবে যদি গণ্য করা হয় তাহলে এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, এই সব দেশগুলির কোনটির মধ্যে পুঁজিবাদী বিকাশ অল্প এবং কোনটির মধ্যে অনেকখানি হলেও তাঁদের কোনটিই ঐ সীমারেখা স্পর্শ করতে পারবে না। তার পূর্বেই পুঁজিবাদী বিকাশ রুদ্ধ হয়ে সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে একটা বৈপ্লবিক সংকট সৃষ্টি হবে এবং সেই সঙ্কটের নিরসন ঘটবে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে। এই বিপ্লবই উৎপাদনের সামাজিকীকরণকে এমনভাবে সম্পূর্ণ করবে যার ফলে পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর পুরোপুরি অতিক্রম না করে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব হবে।

পুঁজিবাদী বিকাশের প্রথম পর্যায়ের ইউরোপীয় পুঁজিবাদের সাথে পশ্চাৎপদ দেশগুলির পুঁজিবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের ফলেই দ্বিতীয়োক্ত এই দেশগুলির বুর্জোয়াজীর পক্ষে প্রথমোক্ত দেশগুলির বুর্জোয়াজীর মতো নিজ নিজ দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি কি? এ পার্থক্য হলো এই যে, ইউরোপীয় বুর্জোয়াজী ছিলো স্বাধীন এবং পশ্চাৎপদ দেশগুলির বুর্জোয়াজী সাম্রাজ্যবাদ কবলিত হওয়ার ফলে অল্পবিস্তর পরাধীন। এই পরাধীনতার কারণেই পশ্চাৎপদ দেশগুলির পক্ষে সম্ভব নয় পুঁজিবাদী বিকাশের স্তর পুরোপুরি অতিক্রম করা। এ জন্যেই স্বাধীন বুর্জোয়াজীর নেতৃত্বে পুঁজিবাদ উৎপাদনের সামাজিকীরণ যেভাবে ব্যাপক ও গভীর করে, যেভাবে এবং যতখানি সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের অবসান ঘটায়, সেইভাবে পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ ব্যাপক ও গভীর হয় না এবং তার ফলে সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের উচ্ছেদও ব্যাহত হয়। 

কিন্তু এই সমস্ত পশ্চাৎপদ দেশগুলির বুর্জোয়াজীর দ্বারা যদি পুঁজিবাদের বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ ব্যাপক ও গভীর করা ও সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব না হয়, তাহলে সে কাজ কার দ্বারা সম্ভব, এর উত্তর—শ্রমিক শ্রেণী। পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বেই উৎপাদনের সামাজিকীকরণ ব্যাপক ও গভীর করা ও সেই সাথে সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের উচ্ছেদ সম্ভব। অক্টোবর বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে আধা-সামন্তবাদী এবং ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বুর্জোয়াজীর পরাধীনতা ও চরিত্রগত দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতেই বলা হয় যে, এই ধরনের দেশগুলিতে উৎপাদনের বিকাশ ঘটানো পুঁজিবাদের স্তর পুরোপুরি অতিক্রম না করেই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব। 

এ ক্ষেত্রে আর একটি জিনিস যা পরিষ্কার হচ্ছে তা হলো, আধা-সামন্তবাদী ও আধা- ঔপনিবেশিক যে কোন দেশে উৎপাদনের বিকাশ ঘটানোর জন্যে শুধু সামন্তবাদের উচ্ছেদই প্রয়োজনীয় নয়। সাম্রাজ্যবাদের উৎখাতও অপরিহার্য। বস্তুতঃপক্ষে সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত না করা পর্যন্ত সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কের অবসান ঘটানোর প্রশ্ন এ ধরনের কোন দেশে নিতান্তই অবান্তর। এবং সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে যুগপৎ উচ্ছেদ করার জন্যে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে যে বিপ্লব সেই বিপ্লবেরই নাম জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। চীনে এই বিপ্লবই ১৯৪৯ সালে সংঘটিত হয়েছিলো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। 

১২

শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পশ্চাৎপদ আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির বিপ্লবকে নয়া গণতান্ত্রিক, জনগণতান্ত্রিক অথবা অন্য যে কোন নামেই অভিহিত করা হোক, মূলতঃ তা হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, বিশেষতঃ অর্থনৈতিক লক্ষ্যের দিক থেকে। এই বিষয়টির প্রতি উপযুক্ত দৃষ্টি না দেওয়ার ফলেই আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির আন্দোলনকে অনেকে জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন আখ্যা দিলেও সেই বিপ্লবী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও করণীয় কর্তব্যগুলি সম্পর্কে নানান ভুলভ্রান্তি করে বসেন। বিপ্লবের এই মৌলিক চরিত্রের প্রতি খেয়াল না থাকার জন্যে একদিকে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ এবং অপরদিকে বামপন্থী হঠকারিতা ও তত্ত্ববাগীশতা বারবার আন্দোলনকে কানাগলির মধ্যে ঠেলে দিয়ে বিপর্যস্ত করে। 

শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পশ্চাৎপদ আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির বিপ্লবের মূল লক্ষ্য বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক এ কথার অর্থ কি? এর অর্থ হলো সামন্তবাদের উচ্ছেদ, দেশের মাটি থেকে সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ, সাম্রাজ্যবাদের সাথে আঁতাতবদ্ধ দেশীয় বুর্জোয়াজী, বিশেষতঃ বড়ো বুর্জোয়াজীর উৎখাত। কিন্তু এই বিপ্লবের লক্ষ্য সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পরিপূর্ণ উচ্ছেদ হলেও পুঁজিবাদের পরিপূর্ণ উচ্ছেদ এর লক্ষ্য নয়। উপরন্তু দেশীয় বুর্জোয়াজীর মধ্যে দেশপ্রেমিক পেটি ও মধ্য বুর্জোয়া শ্রেণী এবং তার আর্থিক জীবন ও উৎপাদন ক্ষমতাকে রক্ষা করা হলো এই বিপ্লবের অন্যতম করণীয় কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এই বুর্জোয়াদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সহানুভূতি যেমন একদিকে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের জন্মদান করে, অন্যদিকে তেমনি তাদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত কঠোর মনোভাব অথবা শত্রুতার বশবর্তী হয়ে তাদেরকে রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা জন্মদান করে বামপন্থী হঠকারিতা। এই দুই পথই বিপ্লবীদের পক্ষে পরিত্যাজ্য। 

১৩ 

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য কি এবার সেটা একটু বিস্তারিতভাবে দেখা যাক। 

লেনিন খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন, 

“কোন শ্রেণীসচেতন শ্রমিক কি সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্যে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে ভুলতে পারে, অথবা প্রথমটিকে দ্বিতীয়টির জন্যে ভুলতে পারে? না, একজন শ্রেণীসচেতন শ্রমিক নিজেকে সামাজিক-গণতন্ত্রী বলে এ জন্যে যে, এই দুই সংগ্রামের সম্পর্ককে সে বোঝে। সে জানে যে গণতন্ত্রের মাধ্যমে, রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে ব্যতীত সমাজতন্ত্রে যাওয়ার আর কোন পথ নেই। এজন্যে সে চেষ্টা করে গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ও দৃঢ়ভাবে অর্জন করতে যাতে করে সে চূড়ান্ত লক্ষ্য সমাজতন্ত্রে উপনীত হতে পারে। সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে শর্তসমূহ এক নয় কেন? কারণ এই দুই সংগ্রামে শ্রমিকদের মিত্রশক্তি নিশ্চিতভাবে হবে ভিন্ন ভিন্ন। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শ্রমিকরা পরিচালনা করে বুর্জোয়া শ্রেণীর একটি অংশের, বিশেষতঃ পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে একত্রিত হয়ে। অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম শ্রমিকরা পরিচালনা করে সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে। আমলা ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালিত হতে পারে এবং নিশ্চয়ই পরিচালনা করতে হবে সমস্ত কৃষক, এমনকি অবস্থাপন্ন ও মধ্যকৃষকদেরকে সাথে নিয়ে। অন্যদিকে, বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে এবং সেই সাথে অবস্থাপন্ন কৃষকদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম একমাত্র সর্বহারাদের সাথে মিলিত হয়েই যথাযথভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে। 

চীনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব (যাকে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়েছে) সম্পর্কে সাধারণত বলতে গিয়ে মাও সেতুঙ বলছেন, 

“নিঃসন্দেহে বর্তমান বিপ্লবই প্রথম পদক্ষেপ যা পরবর্তী পর্যায়ে দ্বিতীয় পদক্ষেপ সমাজতন্ত্রে পরিণত হবে। এবং চীন একমাত্র তখনই সত্যিকার অর্থে সুখের দেখা পাবে যখন সে সমাজতান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করবে। কিন্তু সমাজতন্ত্র প্রবর্তনের সময় আজও আসেনি। বিপ্লবের বর্তমান করণীয় কাজ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং এই করণীয় কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সমাজতন্ত্রের প্রশ্নই ওঠে না। চীনা বিপ্লব প্রথমে নয়া গণতান্ত্রিক এবং তারপর সমাজতান্ত্রিক এই দুই পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। তাছাড়া প্রথম পদক্ষেপটি অনেক সময় নেবে এবং তা রাতারাতি সম্পন্ন করা যাবে না। আমরা কল্পনাবিলাসী নই এবং আমরা যে বাস্তব অবস্থার মুখোমুখি তার থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পারি না।” 

“কিছু বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণাকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই দুটি বিপ্লবী স্তরের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলে একটি মাত্র বিপ্লবের এক তথাকথিত তত্ত্বের ওকালতি করে যাতে করে প্রমাণ করা যায় যে, তিন জনগণের নীতি সব ধরনের বিপ্লবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং যাতে কমিউনিজমের অস্তিত্বের যুক্তিই নাকচ হয়ে যায়। এই ‘তত্ত্বকে’ ব্যবহার করে তারা মরিয়া হয়ে কমিউনিজম, কমিউনিস্ট পার্টি, অষ্টম রুট ও নোতুন চতুর্থ বাহিনী এবং শেনসী-কানসু- নিংসিয়া সীমান্ত এলাকার বিরোধিতা করে। তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো সমস্ত বিপ্লবের মূলোৎপাটন করা, একটা ব্যাপক বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও জাপানের বিরুদ্ধে একটা ব্যাপক প্রতিরোধের বিরোধিতা করা এবং জাপানি আক্রমণকারীদের কাছে তাদের আত্মসমর্পণের জন্য জনমতকে তৈরী করা। জাপানী সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা এটা ইচ্ছাকৃতভাবে উৎসাহিত হচ্ছে।”[৯] 

দেখা যাচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দুই পৃথক ও নির্দিষ্ট স্তরকে একাকার করে তাত্ত্বিক তালগোল পাকানো যে সামগ্রিকভাবে দুই বিপ্লবের পক্ষেই মারাত্মক সে সম্পর্কে লেনিন এবং মাও দুজনেই হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করছেন। কারণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে বাদ দিয়ে অথবা একেবারে অতিক্রম করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চিন্তা বিপ্লবের বিরুদ্ধ শক্তি অর্থাৎ প্রতিবিপ্লবী শক্তির হাতকেই সর্বক্ষেত্রে জোরদার করতে বাধ্য। 

১৪ 

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একাকার করে দেখা এবং তার ভিত্তিতে রণনীতি নির্ধারণের মৌলিক তত্ত্বগত ভ্রান্তি সম্পর্কে লেনিন, স্ট্যালিন ও মাও সেতুঙ বারংবার উল্লেখ করেছেন। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্বে আর পরিচালিত এবং সফল হতে পারে না, সেটা ১৯২০-এর থেকেই তত্ত্বগতভাবে স্বীকৃত ও বাস্তবক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে। 

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অর্থনৈতিক লক্ষ্য—সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের অবসান এবং সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক শোষণের উচ্ছেদ—অর্জন ব্যতীত কোন সমাজে সামগ্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রচলন সম্ভব নয় অর্থনৈতিক কারণেই। কারণ সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ে অর্থনীতি উন্নীত হওয়ার একটি অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ। উৎপাদনের এই সামাজিকীকরণ, বিশেষতঃ কৃষি উৎপাদনের সামাজিকীকরণ, সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের পরিপূর্ণ উচ্ছেদ ব্যতীত সম্ভব নয়। এবং সাম্রাজ্যবাদ ও মুৎসুদ্দী পুঁজির আধিপত্য যতদিন থাকে ততদিন পর্যন্ত তাঁরা এই সম্পর্ককে যথাসাধ্য টিকিয়ে রাখে। এ কারণেই কৃষি উৎপাদনের পরিপূর্ণ সামাজিকীকরণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দেশীয় দালাল মুৎসুদ্দী বুর্জোয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার উচ্ছেদ ব্যতীত সম্ভব নয়। এজন্যেই তাই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সাম্রাজ্যবাদ ও মুৎসুদ্দী পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এক অপরিহার্য শর্ত।

একটি আধা-সামন্তবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণীর মূল নেতৃত্বে সমগ্র মেহনতী ও শোষিত জনগণের এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হচ্ছে এক ধরনের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে অন্য আর এক ধরনের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, সামন্ত মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া একনায়কত্বের বিরুদ্ধে শ্রমিক কৃষক দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই ধরনের একনায়কত্বকেই মাও আখ্যা দিয়েছেন জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব।[১১] 

‘কমিউনিস্টরা একনায়কত্ববাদী’ – শত্রুপক্ষের এই অভিযোগ প্রসঙ্গে মাও বলছেন, 

“মহাশয়রা, আপনারা ঠিকই বলেছেন, আমরা ঠিক তাই। কয়েক দশকের মধ্যে দিয়ে অর্জিত চীনা জনগণের অভিজ্ঞতা তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কার্যকর করতে অর্থাৎ প্রতিবিপ্লবীদেরকে কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে এবং কেবলমাত্র জনগণকেই সে অধিকার দিতে।”

“এই জনগণ কারা? চীনের বর্তমান পর্যায়ে তারা হলো শ্রমিক শ্রেণী, কৃষক সমাজ, শহরের পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণী ও জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী। শ্রমিক শ্রেণী ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এই শ্রেণীসমূহ তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের জন্য এই নিজস্ব সরকার নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়; সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী কুকুর-জমিদার শ্রেণী ও আমলা বুর্জোয়াদের এবং সেই সাথে ঐ সামন্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি কুওমিনটাং প্রতিক্রিয়াশীল ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে নিজেদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে দমন করে এবং তাদেরকে কথা ও কাজে অবাধ্য না হয়ে ঠিকমতো আচরণ করার সুযোগ দেয়। যদি তারা অবাধ্যভাবে কোন কথা বলে অথবা কাজ করে তাদেরকে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দেওয়া এবং শাস্তি দেওয়া হবে। গণতন্ত্র প্রচলিত থাকবে বিভিন্ন স্তরের জনগণের মধ্যে, যারা ভোগ করবে, জমায়েত হওয়ার ও সমিতি গঠন ইত্যাদির স্বাধীনতা। ভোটদানের অধিকার একমাত্র জনগণকেই দেওয়া হবে এবং প্রতিক্রিয়াশীলদেরকে নয়। এই দুই দিকের সমন্বয়—জনগণের জন্য গণতন্ত্র এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের ওপর একনায়কত্ব—এই হলো জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব।”

“এইভাবে কাজ করা হবে কেন? এই প্রশ্ন সকলের কাছেই খুব স্পষ্ট। যদি এইভাবে কাজ করা না হয় তাহলে বিপ্লব ব্যর্থ হবে, জনগণ দুঃখ কষ্ট ভোগ করবে এবং দেশ আবার অন্যের দখলে চলে যাবে।”[১২] 

এ প্রসঙ্গে মাও আরও বলছেন, 

“জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব শ্রমিক শ্রেণী, কৃষক সমাজ ও শহুরে পেটি-বুর্জোয়ার মৈত্রী এবং প্রধানতঃ শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষক সমাজের মৈত্রীর ওপর প্রতিষ্ঠিত কারণ এই দুই শ্রেণীই চীনের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। সাম্রাজ্যবাদ ও কুওমিনটাং প্রতিবিপ্লবীদের উচ্ছেদের ক্ষেত্রে এই দুই শ্রেণীই হলো প্রধান শক্তি। নয়া গণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণও প্রধানতঃ তাদের মৈত্রীর ওপরই নির্ভরশীল।”[১৩] 

১৯২০ সালের পর থেকে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব যেমন মার্কসবাদী লেনিনবাদী তত্ত্বের বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে অন্যদিকে তেমনি জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের এই তত্ত্বও এই পর্যায়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লব তত্ত্বের এক অপরিহার্য অঙ্গ। চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতিসহ অন্যান্য আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির প্রত্যেকটিতেই অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কিত এই দুই তত্ত্বের ভিত্তিতেই বিপ্লব পরিচালিত ও সফল হয়েছে এবং এখনো পর্যন্ত যে সমস্ত দেশে বিপ্লব সফল হয়নি সেখানে এই ভিত্তিতেই বিপ্লবী সংগ্রাম, শ্রমিক কৃষক ও দেশপ্রেমিক জাতীয় বুর্জোয়াদের শ্রেণী সংগ্রাম, অব্যাহত রয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব সম্পর্কে দুটি জিনিস বিশেষভাবে বোঝা দরকার। প্রথমতঃ এই বিপ্লবের লক্ষ্য বুর্জোয়া পার্লামেন্টারী ও বুর্জোয়া নির্বাচন প্রথার প্রবর্তন নয়, উপরন্তু তার পরিপূর্ণ উচ্ছেদ। এই রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যেই প্রয়োজন শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে অন্যান্য বিপ্লবী শ্রেণী ও শক্তির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, তাঁদের একনায়কত্ব। দ্বিতীয়তঃ এই একনায়কত্ব শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের মতো ছোট পুঁজি ও পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে পরিচালিত নয়। এই সম্মিলিত একনায়কত্বের সংগ্রাম হলো সামন্ত ভূস্বামী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল মৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের সম্মিলিত একনায়কত্বের বিরুদ্ধে। একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্রে যে শুধুমাত্র বুর্জোয়াজী অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর একনায়কত্ব থাকে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলে সে রকম কোন পরিস্থিতি আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে থাকে না। এসব দেশে একনায়কত্বও যেমন একাধিক শ্রেণীর হয়, তেমনি তাকে উৎখাত করে সরাসরি অন্য ধরনের যে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সেটাও শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব না হয়ে হয় শ্রমিক কৃষক জাতীয় বুর্জোয়াদের সম্মিলিত একনায়কত্ব। কিন্তু তার অর্থ আবার এই নয় যে, এই একনায়কত্বে প্রতিটি শ্রেণীর অবস্থান, গুরুত্ব, শক্তি এবং ভূমিকা সমান থাকে। মোটেই তা নয়। এই সম্মিলিত একনায়কত্বের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকাই প্ৰধান, অগ্রণী এবং নেতৃত্বমূলক। এই প্রাধান্য ও নেতৃত্বের জন্যেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবী কতকগুলি পর্যায়ে অতিক্রম করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তরিত হয় এবং উপরোক্ত তিন শ্রেণীর সম্মিলিত একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে পরিশেষে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বকেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। 

শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই তাত্ত্বিক ভিত্তিকে যথাযথভাবে রচনা করার মাধ্যমেই মাও সেতুঙ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সেই নামে অভিহিত করার যে অসুবিধার কথা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের ১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে আলোচিত এবং উল্লিখিত হয়েছিল তা দূর করেন এবং পরবর্তীকালে এই ধরনের বিপ্লবী আন্দোলনকে জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন না বলে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন নামেই অভিহিত করেন। 

১৫ 

আধা-সামন্ততান্ত্রিক নয়া-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বিপ্লবের স্তর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক শুধু আমাদের দেশে নয় অন্যান্য সমপর্যায়ভুক্ত দেশগুলিতে চলছে। এই সব আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যে যে দুটি মূল চিন্তাধারা বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে তা হলো : (ক) বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রতিটি দেশই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে উপনীত হয়েছে, কাজেই সেদিক থেকে এ সামন্তবাদী নয়া-ঔপনিবেশিক দেশগুলিও কোন ব্যতিক্রম নয়। এগুলিতেও তাই সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার কাজে বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। (খ) বিশ্ব পরিস্থিতি বর্তমানে বিপ্লবের অনুকূল হলেও আধা- সামন্ততান্ত্রিক নয়া-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে এই স্তরে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব নয়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক-দেশপ্রেমিক জাতীয় বুর্জোয়াদের সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে এই ধরনের দেশগুলিতে প্রথমে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা জনগণের গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে এবং একমাত্র এই বিপ্লবের মাধ্যমেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করা ও শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর। 

এই দুই চিন্তাধারা সম্পর্কে এই প্রবন্ধে ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। এখন বিশেষভাবে যে বিষয়টির উল্লেখ দরকার সেটা হচ্ছে এই যে, (খ)-তে বর্ণিত দ্বিতীয় চিন্তাধারার অনুসারীদের মধ্যে (ক)-এ বর্ণিত প্রথম চিন্তাধারার প্রভাবজনিত বিচ্যুতি। অর্থাৎ আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা- ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে বিপ্লবের বর্তমান স্তর জনগণতান্ত্রিক বা জাতীয় গণতান্ত্রিক এ কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও রণনীতি ও রণকৌশলের ক্ষেত্রে এমন সব বক্তব্য হাজির করা অথবা বাস্তবক্ষেত্রে এমন সব কাজ করা যা ঘোড়ার আগে গাড়ী জোড়ারই সামিল। এইভাবে গাড়ী জোড়ার ফলে তাদের চিন্তাকর্মের পরিণতি প্রকৃতপক্ষে প্রথম চিন্তাধারা উদ্ভূত ক্রিয়াকলাপের থেকে বিশেষ তফাৎ হয় না এবং তার ফলে বিপ্লবী পরিস্থিতির মধ্যে অগ্রগতি সাধিত হয়ে বিপ্লবী পরিস্থিতি চমৎকার ও পরিপক্ক হয়ে ওঠার পরিবর্তে পরিস্থিতির মধ্যে বিপ্লবের পরিপন্থী অনেক উপাদান নোতুন নোতুন জটিলতা ও ব্যর্থতার জন্মদান করে। শুধু তাই নয়। এই ধরনের বিচ্যুতি বামপন্থী হঠকারিতা ও দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ এ দুটিরই পথ প্রশস্ত করে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক অগ্রগতিকে বিপর্যস্ত করে। 

১৬ 

বিপ্লবের স্তর আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই যে জিনিসটি লক্ষ করা দরকার সেটি হচ্ছে কোন একটি বিশেষ সমাজে কোন্ কোন্ শ্রেণী ও শক্তি শোষক ও শাসকের ভূমিকায় অবস্থান করছে। কারণ শাসক শোষকদের এই অবস্থানই বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করে এবং বিপ্লবী রণনীতি এবং কৌশলও তার দ্বারাই নির্ণীত হয়। 

উন্নত পুঁজিবাদী সমাজগুলিতে পুঁজিবাদীরাই হলো শাসক ও শোষক। এই ধরনের সমাজে যে একনায়কত্ব থাকে তা হলো পুঁজিবাদী একনায়কত্ব। এই পুঁজিবাদী একনায়কত্বের দেশে বিপ্লবের স্তর সরাসরিভাবে হলো সমাজতান্ত্রিক। পুঁজিবাদী একনায়কত্ব উচ্ছেদ করে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাই এই অবস্থায় বিপ্লবীদের করণীয় কর্তব্য। কিন্তু আধা- সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে শাসন ও শোষণ যে কেবলমাত্র পুঁজিপতিরাই চালায় তা নয়। এ ধরনের সমাজে একাধিক শ্রেণী হিসেবে সামন্ত ভূস্বামী শ্রেণী ও পুঁজিপতি শ্রেণী উভয়ই যৌথভাবেই ব্যাপক কৃষক শ্রমিক মেহনতী জনগণের উপর নিজেদের শাসন শোষণ অব্যাহত রাখে। শুধু তাই নয়। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ অবস্থা বিশেষে পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে এই দুই মূল শোষক শাসক শ্রেণীকে সাহায্য করে এবং তাঁদের যৌথ একনায়কত্বের উৎখাতের জন্য শ্রমিক কৃষক ও জনগণের অপরাপর অংশের সম্মিলিত সংগ্রামের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত নিজেদের শক্তিকে যথাসাধ্য প্রয়োগ করার জন্যে প্রস্তুত থাকে। এজন্যে এই সমস্ত দেশের বিপ্লবী সংগ্রাম যে শুধুমাত্র সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় তাই নয়। এই সংগ্রামকে হতে হয় পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীও। শোষক-শাসক শ্রেণীসমূহের এই অবস্থানের জন্যেই এ ধরনের কোন দেশ ও সমাজে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নীতি গ্রহণ করা চলে না, চলে না অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণীকে বাদ দিয়ে এই পর্যায়ে শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। 

কেন তা চলে না এ বিষয়ে ধারণা আরও একটু পরিষ্কার করার জন্যে সংক্ষিপ্তভাবে এটুকু বললেই চলে যে, কোন আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক সমাজে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধ্বনি তুললে ও রণনীতি গ্রহণ করলে শ্রমিক শ্রেণী এবং কৃষকসহ জনগণের অন্যান্য মেহনতী ও দেশপ্রেমিক অংশগুলির মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কারণ এই স্তরে নিপীড়িত জনগণের অন্যান্য অংশ শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লব করতে চাইলেও শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব স্বীকার করা তাদের দ্বারা শ্রেণীগত কারণেই সম্ভব হয় না। তা না হওয়ার কারণ শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের অর্থই হলো অন্যান্য শ্রেণীর উচ্ছেদ। নিজেদের বিশেষ শ্রেণী অবস্থানের উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের উচ্ছেদ কেউই চায় না। কৃষক ও অন্যান্য মেহনতী জনগণও তা চাইতে পারেন না। এজন্যে সমাজতন্ত্রের রণনীতি এবং শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের ধ্বনি কোন আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশে নিপীড়িত মেহনতী জনগণকে দ্বিধা এমনকি বহুধা বিভক্ত করতে এবং পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে সাহায্য করবে, বিপ্লব সম্পন্ন করতে নয়। এটাই হলো মূল কারণ যার জন্যে কোন আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশেই কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধ্বনি দিতে পারেন না, সমাজতন্ত্রের রণনীতি তারা সেক্ষেত্রে সরাসরি গ্রহণ করতে পারেন না। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কতকগুলি অপরিহার্য কাজ (যে কাজগুলি বুর্জোয়ারা আর সম্পন্ন করতে পারে না।) সম্পন্ন করেই তাঁদেরকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে অগ্রসর হতে হয়। 

১৭ 

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, উৎপাদনের সামাজিকীকরণ কোন সমাজে যতদিন পর্যন্ত হচ্ছে না ততদিন সে সমাজ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অথবা সমাজতান্ত্রিক গঠন কার্য কোনটির জন্যই প্রস্তুত হতে পারে না এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের করণীয় কর্তব্যগুলি সমাধা করার অর্থ হচ্ছে উৎপাদনের সামাজিকীকরণের মাধ্যমে এই প্রস্তুতিকে সম্পন্ন করা। 

একটি উদাহরণের দ্বারা এই বক্তব্যকে আরও একটু স্পষ্ট করা যেতে পারে। যে কোন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষিজমির মালিকানা থাকে রাষ্ট্রের হাতে। কৃষিকার্যে যাঁরা নিযুক্ত থাকেন তাঁরা, ছোট বড় জমির মালিক অথবা বর্গাচাষী হিসেবে নিযুক্ত না থেকে কৃষি শ্রমিক, মজুরী শ্রমিক হিসাবেই নিযুক্ত থাকেন। অর্থাৎ কৃষিকার্যে নিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও তাঁরা আর পুরাতন অর্থে কৃষক নয়, তাঁরা হলেন শ্রমিক। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকের এই শ্রমিকে রূপান্তর একটি অনিবার্য প্রক্রিয়া। 

আমাদের মতো একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি গ্রহণের অর্থ হচ্ছে ভূমিসংক্রান্ত এমন এক নীতি অনুসরণ করা যা দ্রুতগতিতে সমগ্র কৃষক সমাজ এবং অন্যান্য উৎপাদন ক্ষেত্রে ক্ষুদে মালিকদের বিপ্লব বিরোধী করে তুলবে, তাদেরকে প্রতিবিপ্লবী শিবিরে নিশ্চিতভাবে ঠেলে দেবে। কারণ ভূমিসংক্রান্ত ব্যাপারে সমাজতান্ত্রিক নীতির অর্থই হলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভূমিখণ্ড পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসা, সেসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করা। অর্থাৎ ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের জমি এবং ছোট ছোট কল-কারখানার মালিকদের মালিকানা স্বত্ব কেড়ে নেওয়া। 

আমাদের মতো দেশে কোন বিপ্লবী দল যদি এই ধরনের কর্মসূচী নিয়ে জনগণের সামনে এখনই উপস্থিত হন তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে? তারা কি কৃষক সমাজকে মিত্র হিসাবে পাবেন? না, তারা কৃষকদের মিত্র হিসেবে তো পাবেনই না, উপরন্তু তারা পরিণত হবে এই ধরনের বিপ্লবী কর্মসূচীর দৃঢ় শত্রুতে। এবং কৃষকদের ক্ষেত্রে যা সত্য অসংখ্য দেশপ্রেমিক ক্ষুদ্র শিল্প উৎপাদক এবং অন্যান্য জীবিকায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। 

এই পরিস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সামন্তবাদ মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোন সম্মিলিত বিপ্লবী সংগ্রাম তো সম্ভব হবেই না, উপরন্তু শ্রমিক শ্রেণী ও তাঁদের দল জনগণের ব্যাপকতম অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং কৃষক ও নিপীড়িত জনগণের অন্যান্য অংশ প্রতিবিপ্লবী শিবিরে অবস্থান করে বিপ্লবের বিরোধিতা করবে। এর ফলে শুধু যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই সম্ভব হবে না তাই নয়, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাও নস্যাৎ হয়ে সামন্তবাদ, মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের হাতই সর্বতোভাবে জোরদার হবে। 

১৮ 

সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের জন্যে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ যে অপরিহার্য প্রয়োজন একথা উল্লেখ করেছি। এখন দেখা দরকার উৎপাদনের সামাজিকীকরণ বলতে ঠিক কী বোঝায় এবং কীভাবে অথবা কী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব। 

প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, উৎপাদনের সামাজিকীকরণ সমাজতন্ত্রের পথে একটা অগ্রসর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হলেও তারা এক অথবা সমার্থক নয়। এর অর্থ হলো উৎপাদনকে ক্ষুদে মালিক-উৎপাদকদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে এমন ব্যবস্থাধীন করা যাতে সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তিভিত্তিক ব্যাপার না থেকে একটা সামাজিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ব্যাপক আকারে হয় এবং বহুসংখ্যক শ্রমিকের শ্রমশক্তি তাতে যৌথভাবে নিয়োজিত থাকে। শিল্পক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া দেখা দেয় কলকারখানার উৎপাদনের মধ্যে। এই ধরনের উৎপাদনে যেমন শত শত হাজার হাজার শিল্প শ্রমিক নিয়োজিত থাকেন কৃষি খামারেও তেমনি শত শত হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক নিযুক্ত থাকেন। এই ধরনের উৎপাদনে উৎপাদন আর ক্ষুদ্র মালিক-উৎপাদকদের ব্যাপার থাকে না, উৎপাদনের সামাজিকীকরণ ঘটে। 

উৎপাদনের এই সামাজিকীকরণ ঐতিহাসিকভাবে প্রথম পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পুরোপুরি সংগঠিত হয়। কলকারখানা ও খামারে উৎপাদনের উপাদানসমূহের ব্যক্তি মালিকানা সত্ত্বেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক এবং বহুসংখ্যক শ্রমিকের যৌথ শরীকানায় উৎপাদন ঘটে। কিন্তু উৎপাদনের এই যৌথ শরীকানার অর্থ সমাজতন্ত্র নয়। কারণ যৌথ শরীকানা এ ক্ষেত্রে ঘটেছে উৎপাদনের উপকরণসমূহের ব্যক্তিমালিকানায় এবং এই ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ করেই সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। স্বভাবতঃ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, উৎপাদনের এই ব্যাপক ও যৌথ শরীকানার মাধ্যমে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। কিন্তু তা না হলেও উৎপাদনের সামাজিকীকরণের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ঐতিহাসিকভাবে সমাজতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়। এজন্যেই পুঁজিবাদী বিকাশের পরবর্তী স্তরই হচ্ছে সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রে তাই সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার সামাজিকীকরণ নোতুন ভাবে হয় না, তার মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ করে উৎপাদনের সামাজিকীকরণকে একটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়, উৎপাদন সম্পর্কে ও বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। যে সমস্ত দেশে পুঁজিবাদী বিকাশ একটা বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়েছে সেখানে তাই সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতিই সেখানকার ক্ষেত্রে সঠিক রণনীতি। 

ক্ষুদে মালিক-উৎপাদকের উচ্ছেদের মাধ্যমে যে সমাজে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ ঘটেছে সেখানে মালিক শ্রেণীর আকার ছোট, তারা সংখ্যায় অল্প এবং উৎপাদনের মূল শক্তি শ্রমিক শ্রেণীর আকার বড়ো, তারা অসংখ্য। এজন্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তর হলেও উৎপাদনের মূল শক্তি শ্রমিক শ্রেণী সেখানে বিপ্লবের বিরোধিতা করে না, উপরন্তু বিপ্লবে তারা শরীক হয়, তাতে নেতৃত্ব দান করে। 

কিন্তু উৎপাদনের সামাজিকীকরণ যে সমাজে ঘটেনি, যে সমাজে উৎপাদন এখনো পর্যন্ত ক্ষুদে মালিক-উৎপাদকদের দ্বারা প্রধানতঃ নিয়ন্ত্রিত, সে সমাজে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান দেওয়া, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি গ্রহণের পরিণতি কি? এই আহ্বান ও রণধ্বনির মাধ্যমে বাস্তব ক্ষেত্রে এই ধরনের ক্ষুদে মালিক উৎপাদক-নিয়ন্ত্রিত সমাজে কি সমাজতন্ত্র সরাসরি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? যে কোন আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক সমাজের ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন অতিশয় প্রাসঙ্গিক এবং এই প্রশ্নের পর্যালোচনা ব্যতীত এই ধরনের কোন সমাজে বিপ্লবের স্তর নির্ণয় কোন মতেই সম্ভব নয়। 

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক যে কোন সমাজে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান দিলে বিপ্লবীরা ব্যাপক মেহনতী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, এই আহ্বানের দ্বারা মেহনতী জনগণের একটা বিশাল অংশকে, অধিকাংশকে, বিপ্লবের বিরোধী শক্তিতে পরিণত করা হয়। তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হয় প্রতিবিপ্লবী শিবিরের পক্ষপুটে। এবং এর পরিণতিতে বিপ্লব না ঘটে সমাজে যা ঘটে তাহলো নৈরাজ্য। এই নৈরাজ্যকে ব্যবহার করে প্রতিবিপ্লবী শক্তিরাই নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে জোরদার করে। কীভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেটা এবার দেখা দরকার। 

১৯ 

একটি আধা-সামন্তবাদী আধা-ঔপনিবেশিক সমাজের উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে, প্রধানতঃ তা অগণিত ক্ষুদে মালিক উৎপাদকদের দ্বারা সংগঠিত। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকেই এখানে প্রথম বিবেচনা করা দরকার। 

যে কোন আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষিই উৎপাদনের মূল ক্ষেত্র এবং কৃষকরাই হলেন জনগণের বিপুল অধিকাংশ। এই ব্যবস্থায় বড়ো জমিদার বা ভূস্বামী শ্রেণীর হাতে ব্যক্তিমালিকানার দিক থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি জমি কেন্দ্রীভূত হলেও মোট জমির অধিকাংশের মালিকানাই ন্যস্ত থাকে এমন সব ক্ষুদে মালিকদের হাতে যারা নিজেরা কৃষিকার্যে অংশগ্রহণ করেন অথবা কৃষি শ্রমিক অথবা বর্গাদারদের মাধ্যমে জমি চাষ করেন। জমির মালিকানা স্বত্ব বজায় রাখার কামনা বড়ো জমিদারদের থেকে এদের কম নয়। বড়ো জমিদার যেমন নিজের আয়ত্তগত জমির ওপর তার মালিকানা টিকিয়ে রাখতে চায়, ছোট জমির মালিকরাও তেমনি চায় নিজের নিজের জমির ওপর তাদের মালিকানা স্বত্বকে টিকিয়ে রাখতে। শুধু তাই নয়। জমি যাদের নেই সেই ভূমিহীন কৃষকদের জমির আকাঙ্ক্ষাও এই ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় প্রবল থাকে। এই পরিস্থিতিতে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সে ছোট বড়ো যাই হোক, সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদের কর্মসূচী উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট জনগণের এক বিপুল অধিকাংশকে যে বিপ্লবের বিরোধী করে তুলবে সে বিষয় কোন সন্দেহ নেই। এর ফলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি তো ব্যর্থ হবেই উপরন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যাপকভাবে শুরু হবে যা প্রতিক্রিয়াশীল ভূস্বামী শ্রেণী মুৎসুদ্দী ও সাম্রাজ্যবাদীদের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী, জাতীয় মুক্তি অর্জনের কর্মসূচীকে পর্যন্ত নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত ও পরাস্ত করবে। 

একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক সমাজে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে অগ্রসর না হয়ে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান দিলে তার দ্বারা শুধু যে গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক কৃষক সমাজই প্রতিরোধে অংশ নেবে তাই নয়। শহরের ক্ষুদে উৎপাদক, ছোট ছোট কলকারখানার মালিকেরা তার বিরোধিতা করবে এবং নিজেদের দেশপ্রেমিক চরিত্র সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে মুৎসুদ্দী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে বিপ্লব বিরোধিতার ক্ষেত্রে হাত মেলাবে। 

২০

ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরকে ডিঙ্গিয়ে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি প্রতিবিপ্লবী শক্তিসমূহকে, সামন্তবাদী, মুৎসুদ্দী ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকেই সাহায্য ও জোরদার করে। 

এজন্যেই আজ এই ধরনের দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদীরা বিপ্লবের ও জনগণের বিভিন্ন শ্রেণীর শত্রুদের মাধ্যমে সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আওয়াজ তোলাচ্ছে। সরাসরি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা না বলে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা যারা বলছে অথবা সেই বিপ্লবের রণনীতি যারা জনগণের সামনে উপস্থিত করছে তাদের বিরুদ্ধে সে জন্যেই তারা নানা চাতুর্যপূর্ণ বাক্যবিন্যাস ও তত্ত্ববাগীশতা শুরু করেছে। এই বাক্যবিন্যাস ও তত্ত্ববাগীশতা যে তারা শুধু এ দেশীয় দালালদের মাধ্যমেই করছে তাই নয়। এরা এখন তাঁদের ইউরোপীয় এবং মার্কিন এজেন্টদেরকেও একাজে নিযুক্ত করেছে। তারাও দেশে দেশে, এবং বাঙলাদেশেও, স্থানীয় এবং আমাদের ক্ষেত্রে বাঙালী ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিজেদের বক্তব্য খুব আক্রমণাত্মকভাবে প্রচার করছে। এ ব্যাপারে ট্রটস্কীপন্থীদের তৎপরতাও কম নয়। চীন বিপ্লবের সময়ে ১৯২৭ সাল থেকে সরাসরি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই রণধ্বনি তুলে তারা চেন তু-সিউ-এর নেতৃত্বে যে প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত করেছিলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মাধ্যমে তারা বাঙলাদেশেও আজ ঠিক সেই চক্রান্তমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবীদেরকে এই সব রং-বেরংয়ের প্রতিবিপ্লবীদের তৎপরতা সম্পর্কে অবশ্যই যথার্থভাবে অবহিত এবং সাবধান হতে হবে। 

২১

সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থার ক্রমউচ্ছেদের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বেই ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপে সর্বপ্রথম উৎপাদনের সামাজিকীকরণ শুরু হয় এবং পুঁজিবাদী শিল্প ও অর্থনীতি বিকাশের ফলে সামাজিকীকরণ উৎপাদনের ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর অংশে বিস্তৃত হয়। বড়ো বড়ো কল-কারখানা এবং কৃষি খামারে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন উত্তরোত্তরভাবে একটা যৌথ এবং সামাজিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে পুঁজিবাদী সমাজে একদিকে পুঁজি এবং অপরদিকে শ্রমিক শ্রেণীর শক্তিকে দুই পরস্পর বিরোধী বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বুর্জোয়ারা এককভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র ইত্যাদির ওপর নিজেদের একনায়কত্ব কায়েম রাখে। বুর্জোয়া শ্রেণীর একনায়কত্বকে ধ্বংস এবং উচ্ছেদ করেই এ ধরনের সমাজে বিপ্লব সম্ভব হতে পারে, অন্য কোন পথে নয়। এবং এ জন্যেই এই সব পুঁজিবাদী সমাজে বিপ্লবের স্তর হলো সমাজতান্ত্রিক। 

আধা-সামন্ততান্ত্রিক নয়া-ঔপনিবেশিক যে কোন সমাজে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান অবস্থানের জন্যে বুর্জোয়া নেতৃত্বে শিল্পের যথোপযুক্ত বিকাশ এবং উৎপাদনের দ্রুত সামাজিকীকরণ সম্ভবপর নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কাঁচামাল লুণ্ঠন ও নিজেদের বাজারের স্বার্থেই এ ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশকে সাধ্যমতো অসম্ভব করে তোলে। এবং সে জন্যেই আধা সামন্তবাদী নয়া-ঔপনিবেশিক কোন সমাজে বুর্জোয়া নেতৃত্বে উৎপাদনের সামাজিকীকরণের মাধ্যমে পুঁজিবাদের প্রাথমিক ঐতিহাসিক পর্যায়ের মতো কোন সামন্তবাদ বিরোধী বিপ্লব অথবা জাতীয় অর্থনীতিকে সাম্রাজ্যবাদের কবল মুক্ত করা সম্ভব নয়। এ কাজ সম্ভব একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এবং শ্রমিক কৃষক ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের যৌথ শক্তির বৈপ্লবিক প্রয়োগের মাধ্যমে। এই বিপ্লবের মাধ্যমেই তাদের দ্বারা সম্ভব বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বোক্ত অসমাপ্ত কাজকে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সম্পন্ন করা। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বড়ো বড়ো শিল্প কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করে পুঁজিবাদী বিকাশকে সাধারণভাবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে সমবায়ের মাধ্যমে সামন্ত অর্থনীতিকে দ্রুত উচ্ছেদ করে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ সাধনেরই অপর নাম হলো জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের দ্বারা উৎপাদনের সামাজিকীকরণ সাধিত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়েই হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই দুই পর্যায়ের দুই ধরনের বিপ্লবের নির্দিষ্ট চরিত্র এবং করণীয় কর্তব্যগুলি যদি যথাযথভাবে নির্ণয় ও হিসেব করে অগ্রসর হওয়া না যায় তাহলে বিপ্লবী আন্দোলন যে বিপর্যস্ত ও পদে পদে ব্যর্থ হতে বাধ্য সে কথা বলাই বাহুল্য। 

২২

শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের অর্থ শুধুমাত্র অন্যান্য শ্রেণীর ওপর তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বই নয়, উপরন্তু অন্যান্য শ্রেণীর দমন এবং উচ্ছেদ। এ জন্যে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে শ্রমিক, কৃষক অন্যান্য মেহনতী জনগণ ও ক্ষুদে উৎপাদকের শত্রু সামন্তবাদ, মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা নেতৃস্থানীয় এবং মৌলিক হলেও তা কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব না হয়ে হয় শ্রমিক, কৃষক ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের সম্মিলিত একনায়কত্ব, যে একনায়কত্বকে মাও সেতুঙ আখ্যা দিয়েছেন জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব। যে কোন আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশে একমাত্র এই জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া, একমাত্র এই ধরনের একনায়কত্বের মাধ্যমেই সম্ভব শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দৃঢ় এবং সুসংবদ্ধ করে তার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। 

জনগণের এই গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি অপরিহার্য শর্ত এবং এই শর্তকে পূর্ণ করার অন্যতম অপরিহার্য প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে শ্রমিক, কৃষক ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের ঐক্যফ্রন্ট। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এই ঐক্যফ্রন্ট ব্যতীত তাই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিকাশ ও সাফল্য একেবারেই অসম্ভব। 

কিন্তু কিভাবে এই ঐক্যফ্রন্ট সম্ভব? এ প্রশ্ন আলোচনাকালে যে কথাটি সর্বাগ্রে মনে রাখা দরকার তা হলো এই যে, এই ঐকফ্রন্টের নেতৃত্বের ভূমিকা শ্রমিক শ্রেণীর। তবে অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর নয়। সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ এবং সর্বোপরি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দৃঢ়ভাবে অবস্থিত শ্রমিক শ্রেণীর। কোন দেশের শ্রমিক শ্রেণীই নিজেদের পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দৃঢ়ভাবে সংগঠিত না হয়ে শ্রমিক শ্রেণীর এই প্রয়োজনীয় ঐক্য এবং তাত্ত্বিক সমৃদ্ধিকে সম্ভব করতে পারে না। কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা এজন্যেই জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমন কি তার প্রাথমিক পর্যায় শ্রমিক, কৃষক ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের ঐক্যফ্রন্টের ক্ষেত্রেও একেবারে মৌলিক এবং অপরিহার্য। 

তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, কমিউনিস্টরা শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগামী অংশ হিসেবে যে সব দেশে শ্রমিক কৃষক ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রচেষ্টা ক্ষেত্রে অনুপস্থিত অথবা প্রভাবশালী না থাকেন সেখানে এ ধরনের কোন ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয় না। সে অবস্থায় জনগণের ব্যাপক অংশের মধ্যে ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা যতই প্রবল থাক, নির্যাতনকারী শ্রেণীগুলির বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ যতই ব্যাপক হোক, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট কিছুতেই স্থাপিত ও কার্যকর হয় না। বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়াদের দেশপ্রেমিক অংশ যতই গণতান্ত্রিক ঐক্য ইত্যাদির কথা বলুক, যতই তারা সে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করুক কমিউনিস্টদের নেতৃস্থানীয় ভূমিকার অবর্তমানে তা শেষ পর্যন্ত তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির হাতিয়ারেই পরিণত হয়। 

২৩ 

আমাদের দেশে জনগণের গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে যে কোন প্রচেষ্টা ইতিপূর্বে নেওয়া হয়নি অথবা সে বিষয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি, তা ঠিক নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, যেটুকু চিন্তা-ভাবনা ও প্রচেষ্টা এ বিষয়ে দেখা গেছে তা সঠিক হয়নি। এবং তা না হওয়ার ফলেই কার্যক্ষেত্রে এ দেশের কমিউনিস্টরা নিজেদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদেরকে সমবেত এবং ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি। 

এই ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের দায়িত্ব ছিলো প্রধানতঃ তিনটি। প্রথমতঃ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে একটি কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সুসংবদ্ধ করা এবং কমিউনিস্টদের নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করা। দ্বিতীয়তঃ, মেহনতী জনগণের এবং গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের শ্রেণী সংগঠন ও গণসংগঠনসমূহকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সক্রিয় এবং সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। তৃতীয়তঃ, দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়াদের পার্টিগুলির মধ্যে গণতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে সামন্তবাদ, মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে সহযোগিতার ভিত্তিতে কতকগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করা। 

এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং জনগণের গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের নীতি ও কার্যকলাপের দিকে তাকালে স্পষ্টই দেখা যাবে যে, উপরোক্ত তিনটি দায়িত্বের কোনটিই তাদের দ্বারা এ পর্যন্ত সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয়নি। 

কমিউনিস্ট আন্দোলন এ দেশে এখনো বহুধাবিভক্ত। পার্টি, গ্রুপ ইত্যাদিতে বিভক্ত এই আন্দোলন যতদিন পর্যন্ত না নিজের ঐক্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে একটি পার্টির মধ্যে কমিউনিস্টদেরকে ঐক্যবদ্ধ করছে ততদিন পর্যন্ত অন্যদেরকে একটি ঐক্যফ্রন্টে একত্রিত করার চেষ্টা যে একেবারেই নিরর্থক ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা সে কথা বলাই বাহুল্য। কীভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব সে আলোচনার অবকাশ বর্তমান আলোচনায় নেই। এখানে শুধু এটুকু উল্লেখ করাই দরকার যে কমিউনিস্টদের নিজেদের ঐক্য, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংহতি ব্যতীত একটি নয়া-ঔনিবেশিক দেশে ব্যাপক শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনগণ ও দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের গণতান্ত্রিক ঐক্যফ্রন্ট কিছুতেই সম্ভব নয়। 

শ্রেণী সংগঠন ও গণসংগঠনসমূহকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার ওপর যে গুরুত্ব কমিউনিস্টদের দেওয়া প্রয়োজন ছিলো সে গুরুত্ব এখানে কোন পর্যায়েই সঠিকভাবেই দেওয়া হয়নি। উপরন্তু এ ধরনের সংগঠনগুলির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেও ছিলো এক মারাত্মক ত্রুটি। এ ত্রুটিটি হলো এই যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা গণসংগঠনের নামে এমন কতকগুলি পুরোপুরি তাঁবেদার সংগঠন গঠনের প্রচেষ্টা করেছেন, যেগুলির কর্মসূচীর সাথে খোদ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচীর কোন উল্লেখযোগ্য তফাৎ থাকেনি। অর্থাৎ এইসব গণসংগঠনের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির পার্থক্যকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা তাঁরা করেছেন। যেখানেই ব্যাপক শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনগণ আছেন সেখানেই কমিউনিস্টদের কাজ করা দরকার এবং জনগণের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা দরকার—লেনিনের এই নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা ঠিকমতো চলতে সক্ষম হননি। তাঁরা চেয়েছেন এমন এক একটি কৃষক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন খাড়া করতে যেগুলির ওপর শুধু কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপক প্রভাব ও পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাই নয়, তার কর্মসূচীও হবে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচীর অনুরূপ। প্রথম থেকেই এই দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রেণী সংগঠন ও গণসংগঠনসমূহকে গঠন ও পরিচালনা করার ফলেই তাদের যথোপযুক্ত বিকাশ কমিউনিস্টদের তদারকীতে হয়নি। এই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ফলেই এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি যখন একে একে বহুধাবিভক্ত হয়েছে তখন শ্রেণী সংগঠন এবং গণসংগঠনগুলিও সেই অনুযায়ী হয়েছে বহুধাবিভক্ত। প্রত্যেক পার্টি এবং গ্রুপ নিজের নিজের নেতৃত্বাধীন এই ধরনের সংগঠন হাতে রাখার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলে শ্রমিক কৃষক ও সর্বস্তরের মেহনতী জনগণের বৃহত্তর ঐক্য সাধন তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু এ ক্ষেত্রে ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তাঁরা অনৈক্যের শক্তিকেই জোরদার করেছেন, ব্যাপক গণতান্ত্রিক শক্তিকে সারা দেশময় বহুধাবিভক্ত করতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন। 

বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়াদের পার্টি সম্পর্কেও কমিউনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো মারাত্মকভাবে ভুল, ধ্বংসাত্মক ও বিলোপবাদী। এই ধরনের পার্টিগুলির চরিত্রকে শ্রেণীসংগঠন ও গণসংগঠনের চরিত্রের সাথে এক করে দেখে তারা এগুলির মধ্যে অবাধে প্রবেশ করে একদিকে যেমন তাঁদের শক্তিবৃদ্ধি করেছেন তেমনি অন্যদিকে তাঁদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের সাথে নিজেদের সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে যে কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে এই যে, এই ধরনের বুর্জোয়া পেটি- বুর্জোয়া রাজনৈতিক পার্টিগুলিকে শ্রেণীসংগঠন ও গণসংগঠনের সাথে এক করে দেখা এবং সেগুলিকেও কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলে কমিউনিস্ট পার্টি যখন একে একে ক্রমশঃ বহুধাবিভক্ত হতে থাকলো তখন এই ধরনের বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্রুপগুলিও প্রত্যেকে নিজেদের তাবেদার এক একটি পেটি-বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল খাড়া করতে সচেষ্ট হলো। এইভাবে কমিউনিস্টরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে তাদেরকে উত্তরোত্তরভাবে বিভক্ত এবং বিপ্লবী শক্তিসমূহকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে তাদেরকে উত্তরোত্তরভাবে দুর্বল করলেন। 

২৪

শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি হিসেবে এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী আন্দোলনের অবশ্য করণীয় কাজগুলি সঠিকভাবে নির্ধারণ ও সম্পন্ন করে বিপ্লবী পরিস্থিতিকে পরিপক্ক করতে না পারার কারণ একদিকে আমাদের দেশের বিপ্লবের সঠিক তত্ত্ব নির্ধারণে ব্যর্থতা এবং অন্যদিকে শ্রেণী সংগঠন ও গণসংগঠনগুলির মাধ্যমে শ্রেণী সংগ্রামকে উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ও ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। সে জন্যেই এই দুই ব্যর্থতার যথাযথ কারণ বিশ্লেষণ এবং সেই বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে বিপ্লবী রাজনীতির পুনর্গঠন আজ এই দেশে বিপ্লবী পরিস্থিতিকে সত্য অর্থে চমৎকার ও পরিপক্ক করা এবং বিপ্লবকে সম্পন্ন করার এক অপরিহার্য শর্ত। 

বাঙলাদেশে বিপ্লবের বর্তমান স্তর যে জনগণতান্ত্রিক এবং এই বিপ্লবই যে একটি চীনের প্রাচীর অতিক্রম না করে নিজের একটা স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরিত হবে সে বিষয়ে সাধারণভাবে বিপ্লবীদের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য বিতর্ক নেই। কিন্তু তা না থাকলেও বিপ্লবের এই স্বীকৃত সাধারণ স্তরে বিপ্লবী পরিস্থিতির অগ্রসরতা ও পরিপক্কতার পরিমাণ সম্পর্কে যথেষ্ট ভ্রান্তি এখনো বিরাজ করছে। এই ভ্রান্তির অবসান ঘটাতে গেলে বাস্তব পরিস্থিতির সামগ্রিক চরিত্রের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই বিপ্লবী তত্ত্ব এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডসমূহকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করাতে হবে। 

এই আদর্শগত সংগ্রামই বর্তমান পর্যায়ে বাঙলাদেশে বিপ্লবী সংগ্রামের একটি সুনির্দিষ্ট ও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ রূপ। 

তথ্যসূত্র 

১ এদের বক্তব্য হলো এই যে, বাঙলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখন অধনবাদী পথে এগিয়ে চলেছে এবং বাঙলাদেশের বর্তমান যুগ হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যের যুগ। এদের মূল শ্লোগান : এবারের সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম। 

২ শিল্প ব্যাংক বীমা ইত্যাদির জাতীয়করণ যে শুধু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই হয় তাই নয়। পুঁজিবাদীরাও নিজেদের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা-রক্ষা ও তাকে প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজন মতো শিল্প ব্যাংক বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ করে থাকে। এ ধরনের জাতীয়করণের অনেক উদাহরণ অনেক দিন থেকেই বৃটেন, সুইডেন এবং অপরাপর কতকগুলি পুঁজিবাদী দেশে দেখা যায়। ১৯৪৯ সালে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত শিল্পকে জাতীয়করণ করেন। পরে অবশ্য তাঁদের সুপ্রীম কোর্ট সেই জাতীয়করণকে বেআইনী ঘোষণা করে। পার্শ্ববর্তী দেশ পুঁজিবাদী ভারতে প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিল্প এবং বিদেশী ব্যতীত সমস্ত দেশীয় ব্যাংক বীমা জাতীয়করণ করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান নির্বাচনে পিপলস পাটির প্রেসিডেন্ট ভুট্টো কিছু কিছু শিল্প এবং ব্যাংক বীমা জাতীয়করণের কর্মসূচী ঘোষণা করেন এবং ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্ষমতায় যাওয়ার পর পাকিস্তানে ব্যাংক বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ করা হয়। বাঙলাদেশে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শিল্প ব্যাংক বীমা জাতীয়করণের পরিবর্তে দেশীয় শিল্প ব্যাংক বীমা জাতীয়করণের প্রয়োজন দেখা দেয়। পুঁজিবাদেরই স্বার্থে এই পুঁজিবাদী জাতীয়করণকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের দালালরা সমাজতান্ত্রিক জাতীয়করণ বলে ১৯৭২ সাল থেকে প্রচার করে আসছে। 

৩ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেস। জুলাই ১৯-আগষ্ট ৭, ১৯২০। 

৪. Lenin, Collected Works vol. 31, P. 241-42 Progress Publishers, Moscow. 1966 

৫. Ibid. P. 244 

৬. প্রাচ্যের শ্রমজীবী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ১৯২৫ সালে স্ট্যালিনের ভাষণ। 

৭. Lenin, Collected Works vol. 31, P. 2৪ Progress Publishers, Moscow. 1966

৮. Lenin : Petty – Bourgeois and Proletarian Socialism. Collected Works, Vol. P. 442-43, Progress Publishers, Moscow, 1965 

৯. Mao Tse-Tung: Selected Works Vol. 11, P. 35৪ 

১০. আধা-সামন্তবাদী Semi-feudal শব্দটির বঙ্গানুবাদ। কিন্তু তার অর্থ অর্ধেক সামন্তবাদী ও অর্ধেক পুঁজিবাদী নয়। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে বোঝায় এমন একটি সমাজ যেখানে সামন্তবাদ পুরোপুরি নেই, তার মধ্যে পুঁজিবাদী বিকাশ আংশিকভাবে ঘটেছে। এই আংশিক বিকাশ ঠিক কতখানি সেটা প্রত্যেক দেশেই বাস্তব অবস্থার বিস্তৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ধারণ করা দরকার। 

11. Mao Tse- Tung : OP. Cit. Vol. 11, P. 411-24 

12. Mao Tse – Tung : Ibid, Vol. 11, P. 417-1৪ 

13. Ibid. P. 421 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *